[৮]
দ্বীনের বুঝ আসার পর অধিকাংশ জেনারেল পড়ুয়া ভাইদের বিয়ের সময় একটা সাধারণ চাহিদা থাকে- স্ত্রীকে বাইরে জব[চাকুরী] করতে দিবেন না। হ্যাঁ, তাদের এই চাহিদার প্রতি পূর্ণ সম্মান রাখতেই হবে কারণ, বর্তমানে সেক্যুলার সোসাইটিতে একটি মেয়ের, যদিও সে দ্বীনদার না হয়, নিরাপত্তার যে কতটা ঘাটতি রয়েছে তা বলাই বাহুল্য। সেখানে পরিপূর্ণভাবে পর্দা রক্ষা করে কাজ করা দ্বীনদার মেয়েদের জন্য একরকম অসম্ভবই বটে। তাই ভাইদের এই চাহিদার প্রতি আমার পূর্ণ সম্মান আছে। কিন্তু ঘরে থেকেও আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের যথোপযুক্ত তারবিয়্যাহ এবং তাযকিয়্যাহর জন্য আমাদের স্ত্রীদেরকে দ্বীনি শিক্ষায় ও তরবিয়তে বলীয়ান করে তোলার যে গুরুদায়িত্ব আমাদের স্বামীদের উপর আছে তা যেন অনেকটা আলোচনার আড়ালেই থেকে যায়। অথচ অনেক স্ত্রীদেরই পূর্ণ যোগ্যতা আছে ঘরের সমস্ত গুরুদায়িত্ব পালন করেও দ্বীনি শিক্ষার ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার। আর কেনই বা থাকবে না বলুন? যেখানে একটি মেয়ে মেডিক্যাল কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার মত হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে তদপেক্ষা কষ্টকর চাকরিতে জয়েন করে ‘shine’[সাচ্ছন্দ্য উপভোগ] করতে পারে তারা উপযুক্ত গাইডলাইন ও সুযোগ পেলে ঘরে থেকেই আলেমা পর্যন্ত হতে পারেন তা একরকম নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। এজন্য দরকার স্বামীদের পক্ষ থেকে সামান্য স্যাক্রিফাইস ও সাপোর্ট।দেখুন, আমাদের স্ত্রীরা দিনের সিংহভাগ সময় বাচ্চা-সংসার সামলে রাখে বলেই আমরা এত নিশ্চিন্তে রিযিক অন্বেষণ করতে পারি, তাহলে আমাদের কি উচিত নয় বাসায় ফিরে আমাদের স্ত্রীদের জন্য কিছুটা অবসরের ব্যবস্থা করে দেওয়া যেন তারা দ্বীনের সঠিক জ্ঞান অর্জন করতে পারে এবং নিজেদের ও সন্তানদের তারবিয়্যাহ ও তাযকিয়্যাহর একটা রোডম্যাপ তারা পেয়ে যায়? আমাদের স্ত্রীগণ দ্বীনের ‘ইলমি ও আমলী মেহনতে যত এগিয়ে যাবে আমাদের সন্তান-সন্ততিরাও দ্বীনের পথে ততই ‘ইস্তিকামাত’ থাকতে পারবে- এতে নিশ্চয়ই কারও সন্দেহ নেই।
অনেকের মধ্যে একটা ভুল ধারণ কাজ করে যে, মেয়েদের দায়িত্ব শুধুই বাচ্চা সামলানো। আমি এর সাথে প্রচণ্ডভাবে দ্বিমত পোষণ করি। আমি মনে করি, মেয়েদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব ‘বাচ্চা সামলানো’ নয় বরং ‘বাচ্চাকে গড়ে তোলা’। একেবারে শিশুকাল থেকেই একটা বাচ্চাকে দ্বীনের উপর ‘গড়ে তুলতে’ হলে তার মায়ের কতটুকু প্রস্তুতি দরকার সেই খেয়াল কি আমরা বাবারা করি? আর যদি করে থাকি তবে সেই প্রস্তুতির সুযোগ করে দেওয়ার জন্য আমরা কী ব্যবস্থা নিয়েছি? এজন্য তাদের যে অবসরটুকু করে দেওয়ার দরকার ছিল তা কি আমরা করেছি?
তাদের দ্বীন শিক্ষার কোনো মাধ্যমের সাথে জুড়ে দেওয়ার জন্য যে সময়, শ্রম ও অর্থ ব্যয় করা আমাদের জন্য জরুরি ছিল তার কতটুকু আমরা করেছি? সর্বোপরি, আমরা কি আমাদের জীবনসঙ্গিনীকে উৎসাহিত করেছি দ্বীনের জ্ঞানে বলীয়ান হয়ে আমাদের ঘরগুলিকে একেকটা দ্বীনের দূর্গে পরিণত করার জন্য?
আজকাল দ্বীনি কমিউনিটিতে একটা কথা খুব শোনা যায়- আমাদের সমাজে অনেক নারী ডাক্তার প্রয়োজন, তাছাড়া আমাদের নারীরা কোথায় যাবে চিকিৎসার জন্য? অবশ্যই আমাদের অনেক নারী ডাক্তারের প্রয়োজন রয়েছে কিন্তু আমাদের সমাজে কি ‘আলিমার প্রয়োজন নেই? নারীদের অনেক রোগব্যাধি যেমন পুরুষ ডাক্তারের কাছে প্রকাশ করা ও চিকিৎসা নেওয়া বিব্রতকর তেমনি নারীদের অনেক মাস’আলাও আছে যা ইমাম/আলিমদের কাছে জিজ্ঞেস করা বিব্রতকর। আর তাছাড়া শুধু মাস’আলার বাইরেও একজন ‘আলিমা যেভাবে তার সার্কেলের মহিলাদের দ্বীন শিক্ষা দিতে পারে ও দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে দিতে পারে সেভাবে একজন ‘আলিমের পক্ষে সম্ভব নয় সঙ্গত কারণেই।
এখন অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন যে, তাহলে কি আমাদের সবার ঘরণীই আলিমা হয়ে যাবেন? না, তা কখনই নয়। আল্লাহ সবাইকে সমান যোগ্যতা দিয়ে দুনিয়ায় পাঠাননি। কিন্তু যাদের সেই যোগ্যতা আছে তাদেরকে কেন আমরা বঞ্চিত করছি? আর যারা ‘আলিমা হতে পারবেন না তারাতো নিদেনপক্ষে ইসলামিক এডুকেটর[শিক্ষাদাতা] হতে পারবেন। আর এটুকু আমাদের স্ত্রীদের হতেই হবে কারণ, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ‘এডুকেট’ [শিক্ষিত] করার দায়িত্ব অনেকাংশেই কিন্তু তাদের উপর। এখন বিয়ের পর একজন স্ত্রী ‘আলিমা হওয়ার দিকে মনোনিবেশ করবেন নাকি প্রাথমিক পর্যায়ের একজন Islamic educator [ইসলামী শিক্ষাদাতা] হয়েই দায়িত্ব আঞ্জাম দিবেন তা ঠিক করতে হবে কয়েকটি বিষয় মাথায় রেখে-
• নিজের সক্ষমতা
• অবসর সময়ের পরিমাণ
• বেটার হাফের[জীবন সঙ্গী-র] সাপোর্ট
• ফ্যামিলি সাপোর্ট
• শুভাকাঙ্খীদের পরামর্শ
এখানে ভুল বোঝার কোন অবকাশ নেই যে, সন্তানদের শিক্ষা ও দীক্ষায় বাবাদের কোন দায়িত্ব নেই। বাবাদের দায়িত্ব অস্বীকার করা যায় না কিন্তু মায়েরা যদি তাদের দায়িত্ব ভুলে যায় কিংবা দায়িত্ব পালনে এগিয়ে না আসে তবে বাবাদের একার পক্ষে একরকম অসম্ভব সেই দায়িত্ব পুরোপুরি আঞ্জাম দেওয়া।
এতটুকু পড়ে অনেকেই ভাবছেন হয়ত যে, কীভাবে আমরা আমাদের ঘরণীদের দ্বীনি শিক্ষা ও তরবিয়তের ব্যবস্থা করব? বোনেরাও ভাবতে পারেন যে, এই অধম শুধু তাদের উদ্দেশ্যে বয়ান দিয়েই খালাস! কীভাবে বোনেরা বাসায় থেকে দ্বীনের জ্ঞানার্জন করবে আমি এখানে সে সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু বলার চেষ্টা করছি। তবে তার আগে মনে রাখতে হবে, যদি আমরা আমাদের স্ত্রীদেরকে সরাসরি কোন দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোন মাহরামের সাহায্যে পাঠিয়ে ‘আলিমাদের কাছ থেকে দ্বীনের জ্ঞান অর্জনের সুযোগ দিতে পারতাম তবে নিঃসন্দেহে সেটাই ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ পন্থা। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় তা অনেকটাই অসম্ভব, বিশেষত ঢাকা শহরের জ্যাম এড়িয়ে কোথাও যাওয়া-আসা মানেই একদিন শেষ। তাছাড়া বাচ্চাদের বাসায় রেখে যাওয়া থেকে শুরু করে মাহরাম ম্যানেজ করা পর্যন্ত সবকিছুই পারিবারিক বাস্তবতায় সবসময় সম্ভব হয়ে ওঠে না। এর একটা বাস্তবভিত্তিক সমাধান হতে পারে অনলাইনে আমাদের স্ত্রীদের দ্বীন শিক্ষার আয়োজন করা।
আমরা ও আমাদের স্ত্রীগণ এজন্য যা করতে পারি-
• আমাদের বাসায় যদি একটা কম্পিউটার এবং নেট সংযোগ থাকে তবে আমরা অনেকটাই চিন্তামুক্ত। আমাদের উচিত আমাদের আহলিয়াদের প্রথমেই আরবী ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা করা এবং এজন্য তাদেরকে জোর তাকিদ দেওয়া ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদির ব্যবস্থা করা। বর্তমানে অনেক অনলাইন প্রতিষ্ঠান আছে যেখানে বোনদের জন্য আরবী ভাষা ও দ্বীনের অন্যান্য শাখায় জ্ঞানার্জনের সুযোগ আছে। এই ধরণের কোনো একটি প্রতিষ্ঠানে আমরা তাদেরকে ভর্তি করে দিতে পারি। তবে ভর্তির আগে অবশ্যই ভালমত জেনে নিতে হবে যে, ঐ প্রতিষ্ঠানের রুটিন ও সিলেবাসের সাথে সামঞ্জস্য রেখে চলা বোনদের পক্ষে সম্ভব হবে কিনা।[এবং এর পূর্বে গ্রহণযোগ্য কোনো 'আলীম ভাই থেকে অবশ্যই পরামর্শ নিয়ে নেবেন যে, কোন অনলাইন প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করানো আমাদের জন্য মুনাসিব হবে? কোনো মুজাহিদ 'আলিম ভাইদের পরামর্শও নিতে পারেন। নিম্নে দেওয়া লিঙ্কের সব প্রতিষ্ঠান-ই যে আমাদের জন্য মুনাসিব, এমনটা নয়] কারণ, তাদেরকে পড়ার সাথে সাংসারিক ব্যস্ততার একটার বোঝাপড়া সামলাতে হয়। অনলাইনে কোন কোন প্রতিষ্ঠানে দ্বীন শিক্ষার সুযোগ আছে তার একটি লিঙ্ক [শেষে দিয়ে দিব]। এখান থেকে আপনারা খুঁজে নিন আপনাদের জন্য উপযুক্ত প্রতিষ্ঠানটি।
• আরবী ভাষা শেখার পাশাপাশি দ্বীনের একেবারে বেসিক ফিক্বহী আহকাম যেগুলো দৈনন্দিন জীবনে দরকার হয় সেগুলো প্রথমে শেখার দিকে নজর দেওয়া উচিত। পড়ার সময় প্রয়োজনীয় নোট টুকে রাখা ভাল যেন সেখান থেকে আমরা সন্তানদেরও শেখাতে পারি।
• আক্বীদা সংক্রান্ত অহেতুক তাত্ত্বিক মারপ্যাঁচ বর্জন করে একজন মুসলিমের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞানটুকু অর্জনের চেষ্টা করা উচিত। আল্লাহ-র পূর্ণাংগ পরিচয়, ফেরেশতাগণ, কিতাবসমূহ, তাঁর রাসূলগণ, আখিরাত ও তাক্বদীর সংক্রান্ত আক্বীদা একেবারে পরিষ্কার থাকা এবং ইসলামের স্তম্ভগুলির পরিচয়, তাৎপর্য এবং ইসলাম ভঙ্গকারী প্রতিটি বিষয়ের সুপ্সষ্ট জ্ঞান অর্জন করা জরুরি।
• আমরা বাসায় হাফেজা রেখে আমাদের স্ত্রীদের জন্য কুরআন হিফজের ব্যবস্থা করতে পারি- যদি তারা আগ্রহী হয়ে থাকে এবং এজন্য প্রয়োজনীয় সময়টুকু বের করতে পারে। পুরো কুরআন না পারলেও শেষ ৩ জুয মুখস্থ করার চেষ্টা করা উচিত। আর সেটুকুও কঠিন হলে একেবারে শেষ জুযটা (জুয আম্মা) অন্তত মুখস্থ করাই উচিত। আর এটুকু না পারার পেছনে কী অজুহাত থাকতে পারে? হাফেজা রাখা না গেলে অনলাইন হিফজুল কুরআন প্রতিষ্ঠান থেকে সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। Islamic Online University (IOU) এর Global Quran Memorization এমনই একটি প্রোগ্রাম। [অবশ্যই কোনো 'আলিম ভাই থেকে পরামর্শ নিয়ে নেবেন।]
• সালাফদের জীবনী বেশী বেশি অধ্যায়ন করা জরুরী। বোনদের উচিত সালফে সালেহীন নারীগণের জীবনী অধিক পাঠ করা ও নিজেদের মধ্যে আলোচনা করা। দ্বীনের প্রতি সমস্ত কমিটমেন্ট ঠিক রেখেও কীভাবে তারা সন্তানদের তারবিয়াহ ও তাযকিয়াহর আঞ্জাম দিয়েছেন সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা অর্জন করা এবং সেভাবে নিজেদের সন্তানদের তারবিয়াহ ও তাযকিয়াহর দিকে মনোনিবেশ করা উচিত।
• খুব ভাল হয় যদি আমরা সন্তানদের নিয়ে দিনের/সপ্তাহের একটা নির্দিষ্ট সময়ে রুটিন করে বসি এবং আমাদের স্ত্রীগণ যা শিখবে আমরা তা সন্তানদের শেখাই। এতে সন্তানেরা একটা পড়াশোনার পরিবেশ ঘরের মধ্যে দেখতে পাবে এবং তারাও দ্বীন শিক্ষার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠবে। তবে খুব ভালমত মাথায় গেঁথে নেওয়া দরকার যে, আমরা যেন দ্বীন শিক্ষার এই আসরটা যথাসম্ভব তাদের জন্য সহজ ও আনন্দময় করে তুলতে পারি। দ্বীন শেখাতে গিয়ে দ্বীনের প্রতি ভয়/বিদ্বেষ যেন তাদের মনে না ঢুকে যায়-সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে।
অন্তত এতটুকু ঠিক মত করতে পারলেই আশা করা যায় আমাদের স্ত্রীগণ ইসলামিক এডুকেটর হিসেবে নিজেকে তৈরী করতে পারবেন এবং আমাদের সন্তানদের উপযুক্ত দ্বীনি শিক্ষার একটা সঠিক গাইডলাইন তারা নিজে থেকেই বুঝতে পারবেন।
আল্লাহু আ’লাম।
অনলাইন প্রতিষ্ঠান সমূহের একটি লিঙ্ক: https://journeyforlight.wordpress.co...6%B6%E0%A7%8B/
বিঃদ্রঃ উপরোক্ত লিঙ্কের পোস্ট ব্যতীত এই সাইটের অন্যান্য পোস্ট সম্পর্কে আমার জানা নেই। তাই কেউ যদি উক্ত সাইটের অন্যান্য পোস্ট পড়তে চান, তাহলে নিজ দায়িত্বে পড়ে নিতে পারেন। আমি এর জন্য দায়বদ্ধ থাকব না।
- সংগৃহিত ও পরিমার্জিত
[চলবে ইনশাআল্লাহ]
১ম পর্বের লিঙ্ক: https://dawahilallah.com/showthread....%3B&highlight=
২য় পর্বের লঙ্ক: https://dawahilallah.com/showthread....B%26%232468%3B
৩য় পর্বের লিঙ্ক: https://dawahilallah.com/showthread....%3B&highlight=
৪র্থ পর্বের লিঙ্ক: https://dawahilallah.com/showthread....%3B&highlight=
৫ম পর্বের লিঙ্ক: https://dawahilallah.com/showthread....%3B&highlight=
৬ষ্ঠ পর্বের লিঙ্ক: https://dawahilallah.com/showthread....%3B&highlight=
৭ম পর্বের লিঙ্ক: https://dawahilallah.com/showthread....B%26%232468%3B
Comment