জ্ঞানের দুর্ভিক্ষ
পৃথিবীতে কত কোটি কোটি মানুষ। এর মধ্যে জ্ঞানীদের সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়। বাহ্যদৃষ্টিতে জ্ঞানী গণনা করতে গেলে যে-কেউ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হবে যে, অতীতের যুগগুলোর চাইতে এখন জ্ঞানীদের সংখ্যা অনেক অনেক বেশি। হ্যাঁ, অতীতের মনীষীদের জ্ঞান শ্রেষ্ঠ হতে পারে, গভীর হতে পারে; কিন্তু পরিমাণে তারা বর্তমান সময়ের জ্ঞানীদের ধারেকাছেও নেই।
এক জায়গায় কেন্দ্রীয় ওলামা পরিষদের মাহফিলে বাদ মাগরিব জনৈক বক্তার আলোচনা শুনছিলাম। বক্তা মাহদি নিয়ে যারা আলোচনা করে, প্রথমে তাদের একহাত দেখে নিলেন। এরপর যা বললেন, তার সারকথা ছিল, লোকে বলে, দাজ্জাল আসার সময় একেবারে ঘনিয়ে এসেছে। কিন্তু তারা বাস্তবতা নিয়ে ভাবে না। বাস্তবতা তো হলো, এই দেশে এখন এত হাজার মাদরাসা আছে, এত লাখ আলেম আছে আর এত বিলিয়ন তালিবুল ইলম ও হাফেজে কুরআন আছে। এরা থাকতে কখনোই ফিতনা আসতে পারে না। কারণ, যে ফিতনাই আসুক না কেন, এরাই সর্বাগ্রে তা রুখে দেবে।
আমি সেই ‘শাইখুল হাদিস’ সাহেবকে দোষ দিই না। বাহ্যদৃষ্টিতে বিবেচনা করলে যে-কেউই এরূপ বিভ্রমে পড়ে যাবে। কিন্তু বেশি না, মাত্র দুটো সহিহ হাদিসের দিকে নজর দিলেই এই মিছে ঘোর কেটে যাবে। যদিও হাদিস নিয়ে আবার অনেকে ভাবতে চায় না। হাদিস সামনে উপস্থাপন করলেও চোখ বাঁকিয়ে তাকায়। ভাবখানা এমন যে, হাদিস দিয়ে তো দলিল দেয় আহলে হাদিসরা। কথায় কথায় খালি হাদিস দেখালেই হবে নাকি! বড়রা কী বলছেন, কী করছেন ও যুক্তি কী বলে; এগুলো দিয়ে হাদিস ফিল্টারিং করে নিতে হবে। দুই-একটা হাদিস দেখেই লাফ দেয়া যাবে না।
এসব গোড়া মানসিকতার ব্যবচ্ছেদ করার জন্য এই পোস্ট নয়। এখানে জাস্ট দুটো হাদিসের ওপর আলোকপাত করা উদ্দেশ্য; যার আলোকে আমাদের বাস্তব অবস্থা পরিষ্কার হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।
সহিহ বুখারিতে (হাদিস : ২৯৬৪) এসেছে, সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ রা. বলেন :
وَإِنَّ أَحَدَكُمْ لَنْ يَزَالَ بِخَيْرٍ مَا اتَّقَى اللهَ وَإِذَا شَكَّ فِيْ نَفْسِهِ شَيْءٌ سَأَلَ رَجُلاً فَشَفَاهُ مِنْهُ وَأَوْشَكَ أَنْ لَا تَجِدُوْهُ وَالَّذِيْ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ مَا أَذْكُرُ مَا غَبَرَ مِنْ الدُّنْيَا إِلَّا كَالثَّغْبِ شُرِبَ صَفْوُهُ وَبَقِيَ كَدَرُهُ
তোমাদের যে-কেউ ততক্ষণ ভালো থাকবে, যতক্ষণ সে আল্লাহ তাআলাকে ভয় করতে থাকবে। আর যখন সে কোনো বিষয়ে সন্দিহান হয়ে পড়বে, তখন সে এমন ব্যক্তির নিকট প্রশ্ন করে নেবে, যে তাকে সন্দেহমুক্ত করে দেবে। আর সে যুগ অতি নিকটে, যখন তোমরা এমন ব্যক্তি পাবে না। শপথ সেই সত্তার, যিনি ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই। দুনিয়ায় যা অবশিষ্ট রয়েছে, তার উপমা এরূপ, যেমন একটি পুকুরের মধ্যে পানি জমেছে। এর পরিষ্কার পানি তো পান করা হয়েছে, আর নিচের ঘোলা পানি বাকি রয়ে গেছে।
সালাফদের ইলমি শ্রেষ্ঠত্বের ওপর ইমাম ইবনু রজব হাম্বলি রহ. পুস্তিকা রচনা করে গেছেন, ‘ফাযলু ইলমিস সালাফ আলা ইলমিল খালাফ’। কিন্তু এ বিষয়ে স্বতন্ত্র পুস্তিকা নয়, শুধু উপরিউক্ত হাদিসটির দিকে নজর দিলেই অনেক বাস্তবতা পরিষ্কার হয়ে যায়। কিছু অন্ধ যেমন বলে বেড়ায়, মসজিদে আসলে, মাহফিলে গেলে, তাবলিগে বের হলে বা জিহাদে থাকলে করোনা হবে না; কিন্তু তারা একবারও ভাবে না, এরচে অনেক উত্তম আমলে থাকাবস্থায়ও আমরা অনেক সাহাবি, তাবেয়ি ও তাবে তাবেয়িকে হারিয়েছি বিভিন্ন মহামারির আঘাতে। আমরা নিশ্চয়ই তাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ নই। তাদের মহামারি ধরতে পারলে আমাদেরকে কেন পারবে না? ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ অনেক ফরজ বিধান ছেড়ে দিয়ে কেন এসব মেকি বুজুর্গির মহড়া!
যাহোক, সহিহ বুখারি গ্রন্থে বর্ণিত উপরিউক্ত উক্তিটি লক্ষণীয়। বিশেষ করে এ বাক্যটা, ‘আর সে যুগ অতি নিকটে, যখন তোমরা এমন ব্যক্তি পাবে না।’ আমরা তাঁর যুগ থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছি। পেরিয়ে গেছে ১৪০০ বছর। অথচ তিনি জানিয়েছিলেন, জ্ঞানীদের দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে তার যুগের খুব নিকটতম সময়েই। তাহলে এই যে আমরা জ্ঞানীদের এত বিশাল পরিমাণ দেখি, আসলেই কি তারা জ্ঞানী? যদি জ্ঞানী হন, তাহলে এই উক্তির কী অর্থ? আমাদের ভেতরে দীনি বিষয়ে যত প্রশ্ন জাগে, আমরা যদি সেগুলোর জবাব জানতে পারতাম, তাহলে আমরা কল্যাণের মধ্যে থাকতাম। এই যুগে আকিদা, তাওহিদ, শিরিক, কুফর, সিয়াসাত ও কিতাল ইত্যাদি মৌলিক বিষয়াদি রিলেটেড প্রশ্নগুলোর জবাব কি আমরা পাই? বছরের পর বছর টেবিলে প্রশ্ন ফেলে রাখলেও এর উত্তর ছাপার অক্ষরে না হোক, অন্তত আমাদের কর্ণকুহরে একান্তে ক্ষীণ আওয়াজেও ধ্বনিত হয়? সত্যিই, আজ আমরা বড়ই অসহায়।
সহিহ বুখারির (হাদিস : ৬৪৯৮) অপর বর্ণনায় এসেছে, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন :
إِنَّمَا النَّاسُ كَالإِبِلِ الْمِائَةِ لاَ تَكَادُ تَجِدُ فِيهَا رَاحِلَةً
নিশ্চয়ই মানুষ এমন শত উটের মতো, যাদের মধ্যে থেকে তুমি একটিকেও বাহনের উপযোগী পাবে না।
সদাকা রাসুলুনা। নিশ্চয়ই আমাদের রাসুল ﷺ সত্য বলেছেন। আমরাই এই বাস্তবতার চাক্ষুষ সাক্ষী।
লেখকঃ বিশিষ্ট আলেম ও দাঈ
সংগৃহীত
Comment