সিরিয়া মহাযুদ্ধের কাল -২য় পর্ব
জসীমউদ্দীন আহমদ
(গত পর্বে আমরা দাজ্জাল ও মহাযুদ্ধ নিয়ে ইহুদি-খ্রিস্টানদের আকিদার সংক্ষেপিত আলোচনা উপস্থাপন করেছিলাম। এই পর্বে শামের মহাযুদ্ধ নিয়ে ইসলামি বিশ্বাস আলোচিত হল।)
ইসলামি বিশ্বাস কী বলে
কেয়ামতের আগে ঘটিতব্য শামের (সিরিয়া) যুদ্ধকে হাদিসের কিতাবে ‘মহাযুদ্ধ’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। ওই যুদ্ধ হবে সুকঠিন এবং ইতিহাসের চূড়ান্ত ফয়সালাকারী যুদ্ধ। যেখানে সত্যের সৈনিকদের সঙ্গে বিশ্বের অপরাপর শক্তিগুলো মোকাবেলায় অবতীর্ণ হবে। মহাযুদ্ধের যুগে শাম হবে মুসলমানদের দুর্জয় ঘাঁটি। মুন্তাখাবে কানজুল উম্মাল ও কানজুল উম্মালের মূল কিতাব এবং হাদিসের বিভিন্ন গ্রন্থে এ ব্যাপারে আস-সাদেকুল মাসদুক মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সা. কর্তৃক অনেক ভবিষ্যদ্বাণী বর্ণিত রয়েছে। মহাযুদ্ধের যুগে শাম ও এর আশপাশের অঞ্চল, এর ভৌগলিক, রাজনীতিক ও আর্থ-সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে ওই হাদিসগুলোতে বিস্তর আলোচনা পাওয়া যায়।
হজরত মুয়াবিয়া ইবনে কুররা রা. তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন। রাসুল সা. বলেন, ‘শাম যখন ধ্বংসের সম্মুখীন হবে, তখন উম্মতের জন্য কোনো কল্যাণ অবশিষ্ট থাকবে না। আমার উম্মতের একদল লোক সর্বদা বিজয়ী থাকবে, কেয়ামত পর্যন্ত বিরুদ্ধবাদীরা তাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।’ (তিরমিজি, আহমদ)
অন্য এক হাদিস থেকে জানা যায়, ‘জনৈক সাহাবি আল্লাহর রাসুলের কাছে হিজরতের অনুমতি চেয়ে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমাকে কোন দিকে হিজরতের আদেশ দেবেন?’ রাসুল সা. বললেন, ‘ওই দিকে।’ (হাত দিয়ে তিনি শামের দিকে ইঙ্গিত করলেন)।’ (তিরিমিজি)
হজরত আবু দারদা রা. থেকে বর্ণিত হাদিসে জানা যায়, রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘মহাযুদ্ধের যুগে মুসলমাদের তাবু হবে শামের সর্বোন্নত নগরী দামেশকের সন্নিকটস্থ ‘আল-গুতা’ অঞ্চলে।’ [সুনানে আবু দাউদ, খ--৪, পৃষ্ঠা ১১১, আল মুগনি, খ--৯, পৃষ্ঠা ১৬৯]
গুগলম্যাপ অনুযায়ী, ‘আল-গুতা’ বা ‘গুতার’ অবস্থানটি হচ্ছে সিরিয়ার রাজধানী দামেশক থেকে মাত্র আট কিলোমিটার দূরে। রাসুল সা. মহাযুদ্ধের যুগে ওই অঞ্চলটিকে মুসলমানদের ‘সামরিক ছাউনী’ বা হেডকোয়ার্টার হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। এখান থেকে সিরিয়া, বসরা (ইরাক), কস্তুন্তুনিয়া (তুরস্ক) ও ফিলিস্তিনে অভিযান পরিচালনা এবং দাজ্জালের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ভবিষ্যদ্বাণীও করা হয়েছে। বাসার আল-আসাদকে আল-গুতা শহরে রাসায়নিক হামলা চালিয়েছিল।
হযরত আবু জায়িরার বর্ণনায় ফোরাত নদীর তীরে (ইরাকে) ভয়ঙ্কর এক লড়াইয়ের কথা বলা হয়েছে। ওই যুদ্ধে মুসলমানদের ব্যাপক শাহাদতের বর্ণনাও দেখা যায়। সাহাবি বলেন, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর কাছে দাজ্জালের আলোচনা উত্থাপিত হলে তিনি বললেন, ‘তার আবির্ভাবের সময় মানুষ তিনভাগে বিভক্ত হয়ে পড়বে। একদল তার অনুগামী হয়ে যাবে। একদল অভিভাবকের ভূমিকা নিয়ে পরিবার-পরিজনের সঙ্গে ঘরে বসে থাকবে। একদল ফোরাতের তীরে এসে শক্তপায়ে দাঁড়িয়ে যাবে। দাজ্জাল তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করবে আর তারা দাজ্জালের সঙ্গে যুদ্ধ করবে। এমনকি তারা শামের পশ্চিমাঞ্চলে লড়াই করবে। সেখানে চিত্রা বা ডোরা বর্ণের ঘোড়া সংযুক্ত একটি সেনা ইউনিট প্রেরণ করা হবে। যারা ওখানে ঘোরতর লড়াইয়ে অবতীর্ণ হবে। আর এর ফলাফল দাঁড়াবে, এদের একজনও আর ফিরে আসবে না’। [মুসতাদরাকে হাকেম, খ--৪, পৃষ্ঠা ৬৪১]
শামে মহাযুদ্ধ সংগঠিত হওয়ার আগে এর সংলগ্ন অঞ্চলে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ, দারিদ্র্য ও ক্ষুধা মহামারি আকার ধারণ করবে বলে জানা যায়। এক হাদিসে ঘোষিত হয়েছে, ‘সবার আগে ধ্বংস হওয়া ভূখ- হল বসরা ও মিসর।’ বর্ণনাকারী [হজরত মাসজুর ইবনে গায়লান] জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী কারণে তারা ধ্বংস হবে, ওখানে তো সম্মানিত ও বিত্তবান ব্যক্তিরা আছেন?’ হাদিসের বর্ণনাকারী হজরত আবদুল্লাহ ইবনে সামিত রা. বললেন, ‘রক্তপাত, গণহত্যা ও অত্যধিক ক্ষুধার [কারণে তারা ধ্বংস হবে]। আর মিসরের ব্যাপার হচ্ছে, নীলনদ শুকিয়ে যাবে। ফলে মিসরে ধ্বংস নেমে আসবে।’ [আস-সুনানু ওয়ারিদাতু ফিল ফিতান, খ--৪, পৃষ্ঠা ৯০৭]
ওহাব ইবনে মুনাব্বিহর বর্ণনায় দেখা যায়, তিনি বলেন, ‘মিসর’ ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত ‘জাজিরাতুল আরব’ (আরব উপদ্বীপ) নিরাপদ থাকবে। ‘কুফা’ ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত ‘মহাযুদ্ধ’ সংঘটিত হবে না। ‘মহাযুদ্ধ’ সংগঠিত হলে ‘বনু হাশেমের’ এক ব্যক্তি ‘কস্তুন্তুনিয়া’ [কনস্ট্যান্টিনোপল-তুরস্ক] বিজয় করবে। [প্রাগুক্ত, খ--৪, পৃষ্ঠা ৮৮৫]
হাদিসে যেসব আলামতের কথা বলা হয়েছে, তার অনেকগুলো ইতোমধ্যে পরিদৃষ্ট হচ্ছে। কয়েক দশক ধরে মার্কিন অবরোধ ও যুদ্ধে বিধ্বস্ত হয়ে ‘বসরা’ তথা ইরাক ধ্বংসপ্রায়। সেখানে ক্ষুধা, অপুষ্টি ও চিকিৎসা সামগ্রীর অভাবে প্রায় সাড়ে বারো লাখ মানুষ মারা গেছে। এছাড়া পুরো ইরাকের ৮৫ ভাগ এলাকা যুদ্ধে পুরোপুরি বা আংশিক ধ্বংস হয়ে গেছে। যুদ্ধের ক্ষতচিহ্ন নিয়ে যেসব এলাকা এখনো কিছুটা দাঁড়িয়ে রয়েছে তাতেও ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের ছাপ স্পষ্ট। ইরাকের মানুষ কয়েক ধাপে গণহত্যার শিকার হয়েছে। আশির দশকে ‘মিখাইল আফলাকে’র আশির্বাদপুষ্ট সেক্যুলার বাথপার্টির ক্ষমতারোহণ ওখানকার সুন্নি ও ধার্মিক মানুষের জীবনে বয়ে এনেছিল অবর্ণনীয় দুর্যোগ। এছাড়া মার্কিন ইন্ধনে আশির দশকের ইরাক-ইরান যুদ্ধ, নব্বই দশকের ইঙ্গ-মার্কিন আগ্রাসন এবং সহস্রাব্দের ‘মিলেনিয়াম’ সূচনায় মার্কিন দখলদারিতে সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে ওই জনপদটি। বিগত কয়েক দশকে সেখানে প্রাণ হারিয়েছে প্রায় তিন মিলিয়ন মানুষ। যার মধ্যে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যে মৃতের সংখ্যা কম করে হলেও ১২ লাখ। জীবিত মানুষদেরও বেশিরভাগ পঙ্গু, বিকলাঙ্গ বা প্রাণঘাতি নানাবিধ রোগেশোকে আক্রান্ত।
অন্যদিকে মিসরের বর্তমান অবস্থা সচেতন সব মানুষই পরিজ্ঞাত। বর্তমানে সেখানে ইসলামপন্থীদের সরিয়ে আমেরিকার গৃহপালিত সেক্যুলার সেনাবাহিনীকে ক্ষমতায় বসানো হয়েছে। যারা ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে কোনো প্রকার রাখঢাক করছে না।
এছাড়া হাদিসে নীলনদ শুকিয়ে যাওয়ার যে কথা বলা হয়েছে, সেটিও ভাবনার বিষয়। ভূগোলবিদরা নীলনদকে মিসরের ‘প্রাণ’ বলে থাকেন। শীত ও বসন্তে নীলনদ শান্তভাবে চলে, কিন্তু বর্ষায় দু’কূল ছাপিয়ে আশপাশের সব জায়গা ভাসিয়ে দেয়। প্লাবনে নদীর উপকূলবর্তী অঞ্চল উর্বর হয়ে ওঠে, এতে ফসল ভালো হয়। এ জন্য নীলনদকে বলা হয় ‘মিসরের প্রাণ’। ৩,৮৬,৯৯০ বর্গমাইল আয়তন বিশিষ্ট দেশটির ৯০ ভাগই মরুভূমি। ফলে ৯৯ ভাগ লোক বাস করে নীল নদের ব-দ্বীপ ও অববাহিকা এলাকায়। এই নদীর মাধ্যমে মিসরের কৃষিক্ষেত্রে পানির যোগান দেওয়া হয়। এছাড়া মিসরীয়দের সুপেয় পানির চাহিদাও মেটানো হয় এই নদীর পানি দিয়ে।
নীলনদের উৎপত্তি আফ্রিকার উগান্ডা সেন্ট্রালের ভিক্টোরিয়া হ্রদ থেকে। ওই হ্রদের একটি ধারা রুয়ান্ডা হয়ে ইথিওপিয়ার মধ্য দিয়ে নীলনদ পর্যন্ত বয়ে গেছে। কিন্তু সমস্যা দেখা দিয়েছে, এপ্রিল ২০১১-তে ইথিওপিয়ার খ্রিস্টান সরকার বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ৪.৮ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে ‘গ্র্যান্ড ইথিওপিয়ান রেনেসাঁস ড্যাম’ (এৎধহফ ঊঃযরড়ঢ়রধহ জবহধরংংধহপব উধস) নামে ইথিওপিয়ার মধ্য দিয়ে প্রবহমান নীলনদের ওপর বাঁধ নির্মাণ শুরু করেছে, যার কাজ শেষ হবে জুলাই ২০১৭ সালে। ১৭০ মিটার উচ্চাতার এই ড্যামটি প্রায় সোয়া এক কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত। বিশাল আকৃতির এই জলবিদ্যুৎ বাঁধটি ইথিওপিয়ার জন্য ‘রেনেসাঁ’ হলেও নীলনদ তথা মিসরের জন্য হবে মরণফাঁদ। কারণ এটি বাস্তবায়িত হলে নীলনদে পানির পরিমাণ বার্ষিক ১১-১৭ বিলিয়ন কিউবিক লিটার করে কমতে থাকবে। এতে অল্প কয়েক বছরে নীলনদ শুকিয়ে মরুভূমিতে পরিণত হবে। এছাড়া নীলনদকে উপজীব্য করে গড়ে ওঠা কৃষিখামারগুলোর প্রায় ২ মিলিয়ন কৃষকও বেকার হয়ে যাবে। মিসর সরকার শুরু থেকে এই প্রকল্পের বিরোধিতা করে আসছে। মুরসি আমলে প্রয়োজনে যুদ্ধেরও ঘোষণা দেয়া হয়। এখন যদি ওই ড্যাম নির্মাণ সম্পন্ন হয়, তাহলে নীলনদকে তা পানিশূন্য করে ফেলবে। যেমন ফারাক্কার কবলে পড়ে বাংলাদেশের অধিকাংশ খরস্রোতা নদী ইতোমধ্যে মৃত্যুবরণ করেছে। হাদিসের ভবিষ্যদ্বাণীও এদিকে ইঙ্গিত করছে।
মুয়াজ ইবনে জাবাল রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, ‘বায়তুল মাকদিস আবাদ হওয়া মদিনার ক্ষতির কারণ হবে। আর মদিনার ক্ষতি মহাযুদ্ধের ক্ষেত্র তৈরি করবে। মহাযুদ্ধ কস্তুন্তুনিয়া [কনস্ট্যান্টিনোপল-তুরস্ক] বিজয়ের কারণ হবে। কস্তুন্তুনিয়া বিজয় দাজ্জালের আবির্ভাবের কারণ হবে।’ বর্ণনাকারী বলেন, আল্লাহর রাসুল সা. হাদিসটির বর্ণনাকারীর উরুতে কিংবা কাঁধের ওপর চাপড় মেরে বললেন, ‘এই মুহূর্তে তোমার এখানে উপবিষ্ট থাকার বিষয়টি যেমন সত্য, আমার এই ভবিষ্যদ্বাণীও তেমনই সত্য।’ [সুনানে আবু দাউদ, খ--৪, পৃষ্ঠা ১১০ ও মুসনাদে আহমদ, খ--৫, পৃষ্ঠা ২৪৫]
এই হাদিসে বায়তুল মাকদিস আবাদ হওয়ার যে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে, ইহুদিবাদী ‘ইসরাইল’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তা বাস্তবায়িত হয়েছে।
বাকি অংশ নিচে.........
জসীমউদ্দীন আহমদ
(গত পর্বে আমরা দাজ্জাল ও মহাযুদ্ধ নিয়ে ইহুদি-খ্রিস্টানদের আকিদার সংক্ষেপিত আলোচনা উপস্থাপন করেছিলাম। এই পর্বে শামের মহাযুদ্ধ নিয়ে ইসলামি বিশ্বাস আলোচিত হল।)
ইসলামি বিশ্বাস কী বলে
কেয়ামতের আগে ঘটিতব্য শামের (সিরিয়া) যুদ্ধকে হাদিসের কিতাবে ‘মহাযুদ্ধ’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। ওই যুদ্ধ হবে সুকঠিন এবং ইতিহাসের চূড়ান্ত ফয়সালাকারী যুদ্ধ। যেখানে সত্যের সৈনিকদের সঙ্গে বিশ্বের অপরাপর শক্তিগুলো মোকাবেলায় অবতীর্ণ হবে। মহাযুদ্ধের যুগে শাম হবে মুসলমানদের দুর্জয় ঘাঁটি। মুন্তাখাবে কানজুল উম্মাল ও কানজুল উম্মালের মূল কিতাব এবং হাদিসের বিভিন্ন গ্রন্থে এ ব্যাপারে আস-সাদেকুল মাসদুক মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সা. কর্তৃক অনেক ভবিষ্যদ্বাণী বর্ণিত রয়েছে। মহাযুদ্ধের যুগে শাম ও এর আশপাশের অঞ্চল, এর ভৌগলিক, রাজনীতিক ও আর্থ-সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে ওই হাদিসগুলোতে বিস্তর আলোচনা পাওয়া যায়।
হজরত মুয়াবিয়া ইবনে কুররা রা. তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন। রাসুল সা. বলেন, ‘শাম যখন ধ্বংসের সম্মুখীন হবে, তখন উম্মতের জন্য কোনো কল্যাণ অবশিষ্ট থাকবে না। আমার উম্মতের একদল লোক সর্বদা বিজয়ী থাকবে, কেয়ামত পর্যন্ত বিরুদ্ধবাদীরা তাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।’ (তিরমিজি, আহমদ)
অন্য এক হাদিস থেকে জানা যায়, ‘জনৈক সাহাবি আল্লাহর রাসুলের কাছে হিজরতের অনুমতি চেয়ে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমাকে কোন দিকে হিজরতের আদেশ দেবেন?’ রাসুল সা. বললেন, ‘ওই দিকে।’ (হাত দিয়ে তিনি শামের দিকে ইঙ্গিত করলেন)।’ (তিরিমিজি)
হজরত আবু দারদা রা. থেকে বর্ণিত হাদিসে জানা যায়, রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘মহাযুদ্ধের যুগে মুসলমাদের তাবু হবে শামের সর্বোন্নত নগরী দামেশকের সন্নিকটস্থ ‘আল-গুতা’ অঞ্চলে।’ [সুনানে আবু দাউদ, খ--৪, পৃষ্ঠা ১১১, আল মুগনি, খ--৯, পৃষ্ঠা ১৬৯]
গুগলম্যাপ অনুযায়ী, ‘আল-গুতা’ বা ‘গুতার’ অবস্থানটি হচ্ছে সিরিয়ার রাজধানী দামেশক থেকে মাত্র আট কিলোমিটার দূরে। রাসুল সা. মহাযুদ্ধের যুগে ওই অঞ্চলটিকে মুসলমানদের ‘সামরিক ছাউনী’ বা হেডকোয়ার্টার হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। এখান থেকে সিরিয়া, বসরা (ইরাক), কস্তুন্তুনিয়া (তুরস্ক) ও ফিলিস্তিনে অভিযান পরিচালনা এবং দাজ্জালের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ভবিষ্যদ্বাণীও করা হয়েছে। বাসার আল-আসাদকে আল-গুতা শহরে রাসায়নিক হামলা চালিয়েছিল।
হযরত আবু জায়িরার বর্ণনায় ফোরাত নদীর তীরে (ইরাকে) ভয়ঙ্কর এক লড়াইয়ের কথা বলা হয়েছে। ওই যুদ্ধে মুসলমানদের ব্যাপক শাহাদতের বর্ণনাও দেখা যায়। সাহাবি বলেন, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর কাছে দাজ্জালের আলোচনা উত্থাপিত হলে তিনি বললেন, ‘তার আবির্ভাবের সময় মানুষ তিনভাগে বিভক্ত হয়ে পড়বে। একদল তার অনুগামী হয়ে যাবে। একদল অভিভাবকের ভূমিকা নিয়ে পরিবার-পরিজনের সঙ্গে ঘরে বসে থাকবে। একদল ফোরাতের তীরে এসে শক্তপায়ে দাঁড়িয়ে যাবে। দাজ্জাল তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করবে আর তারা দাজ্জালের সঙ্গে যুদ্ধ করবে। এমনকি তারা শামের পশ্চিমাঞ্চলে লড়াই করবে। সেখানে চিত্রা বা ডোরা বর্ণের ঘোড়া সংযুক্ত একটি সেনা ইউনিট প্রেরণ করা হবে। যারা ওখানে ঘোরতর লড়াইয়ে অবতীর্ণ হবে। আর এর ফলাফল দাঁড়াবে, এদের একজনও আর ফিরে আসবে না’। [মুসতাদরাকে হাকেম, খ--৪, পৃষ্ঠা ৬৪১]
শামে মহাযুদ্ধ সংগঠিত হওয়ার আগে এর সংলগ্ন অঞ্চলে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ, দারিদ্র্য ও ক্ষুধা মহামারি আকার ধারণ করবে বলে জানা যায়। এক হাদিসে ঘোষিত হয়েছে, ‘সবার আগে ধ্বংস হওয়া ভূখ- হল বসরা ও মিসর।’ বর্ণনাকারী [হজরত মাসজুর ইবনে গায়লান] জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী কারণে তারা ধ্বংস হবে, ওখানে তো সম্মানিত ও বিত্তবান ব্যক্তিরা আছেন?’ হাদিসের বর্ণনাকারী হজরত আবদুল্লাহ ইবনে সামিত রা. বললেন, ‘রক্তপাত, গণহত্যা ও অত্যধিক ক্ষুধার [কারণে তারা ধ্বংস হবে]। আর মিসরের ব্যাপার হচ্ছে, নীলনদ শুকিয়ে যাবে। ফলে মিসরে ধ্বংস নেমে আসবে।’ [আস-সুনানু ওয়ারিদাতু ফিল ফিতান, খ--৪, পৃষ্ঠা ৯০৭]
ওহাব ইবনে মুনাব্বিহর বর্ণনায় দেখা যায়, তিনি বলেন, ‘মিসর’ ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত ‘জাজিরাতুল আরব’ (আরব উপদ্বীপ) নিরাপদ থাকবে। ‘কুফা’ ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত ‘মহাযুদ্ধ’ সংঘটিত হবে না। ‘মহাযুদ্ধ’ সংগঠিত হলে ‘বনু হাশেমের’ এক ব্যক্তি ‘কস্তুন্তুনিয়া’ [কনস্ট্যান্টিনোপল-তুরস্ক] বিজয় করবে। [প্রাগুক্ত, খ--৪, পৃষ্ঠা ৮৮৫]
হাদিসে যেসব আলামতের কথা বলা হয়েছে, তার অনেকগুলো ইতোমধ্যে পরিদৃষ্ট হচ্ছে। কয়েক দশক ধরে মার্কিন অবরোধ ও যুদ্ধে বিধ্বস্ত হয়ে ‘বসরা’ তথা ইরাক ধ্বংসপ্রায়। সেখানে ক্ষুধা, অপুষ্টি ও চিকিৎসা সামগ্রীর অভাবে প্রায় সাড়ে বারো লাখ মানুষ মারা গেছে। এছাড়া পুরো ইরাকের ৮৫ ভাগ এলাকা যুদ্ধে পুরোপুরি বা আংশিক ধ্বংস হয়ে গেছে। যুদ্ধের ক্ষতচিহ্ন নিয়ে যেসব এলাকা এখনো কিছুটা দাঁড়িয়ে রয়েছে তাতেও ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের ছাপ স্পষ্ট। ইরাকের মানুষ কয়েক ধাপে গণহত্যার শিকার হয়েছে। আশির দশকে ‘মিখাইল আফলাকে’র আশির্বাদপুষ্ট সেক্যুলার বাথপার্টির ক্ষমতারোহণ ওখানকার সুন্নি ও ধার্মিক মানুষের জীবনে বয়ে এনেছিল অবর্ণনীয় দুর্যোগ। এছাড়া মার্কিন ইন্ধনে আশির দশকের ইরাক-ইরান যুদ্ধ, নব্বই দশকের ইঙ্গ-মার্কিন আগ্রাসন এবং সহস্রাব্দের ‘মিলেনিয়াম’ সূচনায় মার্কিন দখলদারিতে সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে ওই জনপদটি। বিগত কয়েক দশকে সেখানে প্রাণ হারিয়েছে প্রায় তিন মিলিয়ন মানুষ। যার মধ্যে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যে মৃতের সংখ্যা কম করে হলেও ১২ লাখ। জীবিত মানুষদেরও বেশিরভাগ পঙ্গু, বিকলাঙ্গ বা প্রাণঘাতি নানাবিধ রোগেশোকে আক্রান্ত।
অন্যদিকে মিসরের বর্তমান অবস্থা সচেতন সব মানুষই পরিজ্ঞাত। বর্তমানে সেখানে ইসলামপন্থীদের সরিয়ে আমেরিকার গৃহপালিত সেক্যুলার সেনাবাহিনীকে ক্ষমতায় বসানো হয়েছে। যারা ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে কোনো প্রকার রাখঢাক করছে না।
এছাড়া হাদিসে নীলনদ শুকিয়ে যাওয়ার যে কথা বলা হয়েছে, সেটিও ভাবনার বিষয়। ভূগোলবিদরা নীলনদকে মিসরের ‘প্রাণ’ বলে থাকেন। শীত ও বসন্তে নীলনদ শান্তভাবে চলে, কিন্তু বর্ষায় দু’কূল ছাপিয়ে আশপাশের সব জায়গা ভাসিয়ে দেয়। প্লাবনে নদীর উপকূলবর্তী অঞ্চল উর্বর হয়ে ওঠে, এতে ফসল ভালো হয়। এ জন্য নীলনদকে বলা হয় ‘মিসরের প্রাণ’। ৩,৮৬,৯৯০ বর্গমাইল আয়তন বিশিষ্ট দেশটির ৯০ ভাগই মরুভূমি। ফলে ৯৯ ভাগ লোক বাস করে নীল নদের ব-দ্বীপ ও অববাহিকা এলাকায়। এই নদীর মাধ্যমে মিসরের কৃষিক্ষেত্রে পানির যোগান দেওয়া হয়। এছাড়া মিসরীয়দের সুপেয় পানির চাহিদাও মেটানো হয় এই নদীর পানি দিয়ে।
নীলনদের উৎপত্তি আফ্রিকার উগান্ডা সেন্ট্রালের ভিক্টোরিয়া হ্রদ থেকে। ওই হ্রদের একটি ধারা রুয়ান্ডা হয়ে ইথিওপিয়ার মধ্য দিয়ে নীলনদ পর্যন্ত বয়ে গেছে। কিন্তু সমস্যা দেখা দিয়েছে, এপ্রিল ২০১১-তে ইথিওপিয়ার খ্রিস্টান সরকার বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ৪.৮ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে ‘গ্র্যান্ড ইথিওপিয়ান রেনেসাঁস ড্যাম’ (এৎধহফ ঊঃযরড়ঢ়রধহ জবহধরংংধহপব উধস) নামে ইথিওপিয়ার মধ্য দিয়ে প্রবহমান নীলনদের ওপর বাঁধ নির্মাণ শুরু করেছে, যার কাজ শেষ হবে জুলাই ২০১৭ সালে। ১৭০ মিটার উচ্চাতার এই ড্যামটি প্রায় সোয়া এক কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত। বিশাল আকৃতির এই জলবিদ্যুৎ বাঁধটি ইথিওপিয়ার জন্য ‘রেনেসাঁ’ হলেও নীলনদ তথা মিসরের জন্য হবে মরণফাঁদ। কারণ এটি বাস্তবায়িত হলে নীলনদে পানির পরিমাণ বার্ষিক ১১-১৭ বিলিয়ন কিউবিক লিটার করে কমতে থাকবে। এতে অল্প কয়েক বছরে নীলনদ শুকিয়ে মরুভূমিতে পরিণত হবে। এছাড়া নীলনদকে উপজীব্য করে গড়ে ওঠা কৃষিখামারগুলোর প্রায় ২ মিলিয়ন কৃষকও বেকার হয়ে যাবে। মিসর সরকার শুরু থেকে এই প্রকল্পের বিরোধিতা করে আসছে। মুরসি আমলে প্রয়োজনে যুদ্ধেরও ঘোষণা দেয়া হয়। এখন যদি ওই ড্যাম নির্মাণ সম্পন্ন হয়, তাহলে নীলনদকে তা পানিশূন্য করে ফেলবে। যেমন ফারাক্কার কবলে পড়ে বাংলাদেশের অধিকাংশ খরস্রোতা নদী ইতোমধ্যে মৃত্যুবরণ করেছে। হাদিসের ভবিষ্যদ্বাণীও এদিকে ইঙ্গিত করছে।
মুয়াজ ইবনে জাবাল রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, ‘বায়তুল মাকদিস আবাদ হওয়া মদিনার ক্ষতির কারণ হবে। আর মদিনার ক্ষতি মহাযুদ্ধের ক্ষেত্র তৈরি করবে। মহাযুদ্ধ কস্তুন্তুনিয়া [কনস্ট্যান্টিনোপল-তুরস্ক] বিজয়ের কারণ হবে। কস্তুন্তুনিয়া বিজয় দাজ্জালের আবির্ভাবের কারণ হবে।’ বর্ণনাকারী বলেন, আল্লাহর রাসুল সা. হাদিসটির বর্ণনাকারীর উরুতে কিংবা কাঁধের ওপর চাপড় মেরে বললেন, ‘এই মুহূর্তে তোমার এখানে উপবিষ্ট থাকার বিষয়টি যেমন সত্য, আমার এই ভবিষ্যদ্বাণীও তেমনই সত্য।’ [সুনানে আবু দাউদ, খ--৪, পৃষ্ঠা ১১০ ও মুসনাদে আহমদ, খ--৫, পৃষ্ঠা ২৪৫]
এই হাদিসে বায়তুল মাকদিস আবাদ হওয়ার যে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে, ইহুদিবাদী ‘ইসরাইল’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তা বাস্তবায়িত হয়েছে।
বাকি অংশ নিচে.........
Comment