সূরা বাকারাহর ১৫২ নং আয়াতে আল্লাহ সুবহানু তা’আলা বলেনঃ
“অতএব তোমরা আমাকে স্মরণ কর,আমিও তোমাদের স্মরণকরব”।
এই আয়াতের নিয়ে উল্লেখ করার মত বেশ কিছু বিষয় আছে। প্রথমত, আয়াতটি পড়ে এই ভেবে আপনার সম্মানিত বোধ করা উচিত, “দারুণ, আল্লাহ আমাকে স্মরণ করবেন?” মানুষ সাধারণত তাঁর কাজের জন্যে পরিচিত হতে ভালোবাসে। এটা হতে পারে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন করা, গরীবকে খাওয়ানো, মসজিদ পরিষ্কার করা- যে কাজই হোক না কেন, যখন একজন মানুষ আপনাকে আপনার কাজের জন্যে চিনবে এবং প্রশংসা করবে তখন আপনার ভালো লাগবে। এই কারণে অনেকেই তাদের কলেজের ডিগ্রী বা সার্টিফিকেট, পুরস্কার, স্মৃতিফলক এ ধরণের জিনিষগুলো দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখে। এর মাধ্যমে কৃতিত্বপূর্ণ কাজের জন্য অন্যের কাছ থেকে সাক্ষ্য বা স্বীকৃত লাভের আশা করা হয়। এর অন্তর্নিহিত অর্থ হল, আপনি অন্যের মতামতকে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ গুরুত্ব দেন এবং তাদের স্বীকৃতি আপনার অন্তরে গর্ববোধের জন্ম দেয়। এর মাধ্যমে আপনি কাজের গুরুত্বও প্রতিফলিত হয়।
এখন ভেবে দেখুন, কোন মানুষ নয় বরং মানবজাতি ও সমগ্র মহাবিশ্বের যিনি সৃষ্টিকর্তাও পালনকর্তা, তিনি আপনাকে স্বীকৃতি দিচ্ছেন! তিনি আপনার কথা আলাদা করে স্মরণ করছেন!এই ব্যাপারটি তো আপনাকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দেওয়ার কথা! এটি জানা মাত্রই আপনার ভাবতে বসে যাওয়ার কথা, আচ্ছা কোন সে কাজ যার জন্য আল্লাহ আপনাকে স্মরণ করছেন? আপনি ভাববেন,“এই যে য্বিকির (আল্লাহকে স্মরণ), এর মধ্যে কি এমন আছে যাতে আত্মনিমগ্ন হবার কারণেই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা’আলা হাজার-লক্ষ-কোটি সৃষ্টির মাঝ থেকে আমাকে বেছে নিয়েছেন? অথচ কাজটা কতই না সহজ! আপনি এমন একজন, যিনি কিনা অন্যের স্বীকৃতি ও প্রশংসা পেয়েই সম্মানিত ও গর্ববোধ করছেন, এই আয়াতটি পড়ে যখন আপনি অনুভব করবেন সমগ্র বিশ্বের মালিক আপনাকে স্মরণ করছেন, তখন কি আপনি এর চাইতেও বহুগুণ বেশি গর্ব আর সম্মান বোধ করবেন না?। আর এটা তো এমন এক স্বীকৃতি যা অমূল্য, কেননা তা আল্লাহর পক্ষ থেকে।
দ্বিতীয়ত, আপনার জানা উচিত যে যিকির দুই ধরনেরঃ একটি অভ্যাসগতভাবে আর অপরটি ঘটে থাকে সচেতন চিত্তে, এবং এর মাঝে একমাত্র একটা ধরণই কেবল আল্লাহর স্বীকৃতি এনে দিতে পারে । ইবন আল-যাওজী এটি বর্ণণা করেছেন:
“একজন অমনোযোগী ‘সুবহানাল্লাহ’বলবে অভ্যাসের বশে। আর একজন সচেতন ব্যক্তি, সে সর্বদা সৃষ্টির রহস্য বা সৃষ্টিকর্তার সুন্দর বৈশিষ্ট্য নিয়ে চিন্তা করতে থাকবে এবং বলে উঠবে ‘সুবহানাল্লাহ’। তাই, এই তাসবীহ হচ্ছে চিন্তাশীলমনের গভীর ভাবনার ফসল। সচেতনরা এভাবেই তাসবীহ পাঠ করে। আর তারা অতীতের গুনাহের কুৎসিত দিক নিয়েও ভেবে দেখবে আর এটি তাদের ধাবিত করবে গভীর ভাবনায় ডুবে যেতে, উদ্বিগ্ন হতে, অনুতাপ করতে। এই চিন্তা থেকে তারা বলে উঠবে ‘আস্তাঘফিরুল্লাহ’ (অর্থ: আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই)। এটাই সত্যিকারের তাসবীহ এবং ইস্তিগফার। আর একজন গাফেল ব্যাক্তিও তাসবীহ পাঠ করবে এবং ইস্তিগফার করবে,তবে অভ্যাসের বশে, উপলব্ধি থেকে নয়। আহ! কতই না পার্থক্য এ দুটি ধরনের মাঝে......”
পরিশেষে, এই আয়াতে আল্লাহর উদারতার নিদর্শনও পাই। দেখুন, তিনি আপনাকে স্মরণ করবেন, স্বীকৃতি দেবেন, পুরস্কৃত করবেন, কারণ আপনি তাঁকে স্মরণ করেছেন, কিন্তু সেটি কখন? প্রথমত তিনি আপনার উপর রহম করেছেন, এবং তা অবলোকনের পরেই কিনা আপনি তাঁর স্মরণের দিকে ধাবিত হয়েছেন, তার আগে নয়! আপনি তাঁকে স্মরণ করেছেন যখন আপনি তাঁরই দেয়া খাবার খাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন, যা একটি নি’আমত। আপনি তাঁর দেয়া ঘরে প্রবেশ করছেন, যা তার একটি নি’আমত। আপনি তাঁরই দেয়া নি’আমত বিছানায় ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তাঁরই দেয়া নি’আমত ঘুম থেকে উঠছেন আর তাঁর দেয়া দৃষ্টি শক্তি ব্যবহার করছেন, তাঁরই সৃষ্টিকরা প্রকৃতির বিস্ময় দেখছেন, আপনার ঘরে তাঁরই দেয়া নি’আমত শিশুর জন্মে আনন্দে উদ্বেলিত উপভোগ করছেন – আপনার পুরো জীবনটিই তাঁর দেয়া উপহার আর রহমতে ভরা – সমস্ত কিছুই তাঁর দেয়া। তাই, এই আয়াত আপনাকে বলছে যে আল্লাহ আপনাকে স্বীকৃতি দিচ্ছেন এ কারণে যে আপনি তাঁকে স্মরণ করেছেন, আর আপনি তাকে স্মরণ করেছেন আল্লাহর দেওয়া রহমতের কারণে, যা কিনা আল্লাহ সবকিছুর আগেই আপনাকে দান করেছেন!
তারিক মেহান্না,
প্লিমাউথ কারেকশনাল ফ্যাসিলিটি,
আইসলেশন ইউনিট – সেল # ১০৮।
Comment