কুরআন এবং আপনি (পর্ব ১)
সূরা বাকারার শুরুতে আপনি দেখতে পাবেন আল্লাহ মুত্তাকীনদের সর্বপ্রথম যে বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন তা হল তারা ‘আল গায়েব ‘ অর্থাৎ অদৃশ্য জগতে বিশ্বাস করে। সর্বজনবিদিত ধারণাগুলো ছাড়াও আপনার জীবনে এই বিষয়টির আরও কিছু কার্যকরী তাৎপর্য রয়েছে।
প্রথমত, হে মুওয়াহহিদ [১] – আপনি যা বিশ্বাস করেন, তা এই জন্যে বিশ্বাস করেন না যে তা জনপ্রিয়, সহজলভ্য, আকর্ষণীয় এবং আরামদায়ক । আপনি আপনার আশেপাশের মানুষগুলোর প্রতিক্রিয়া দেখে সত্য – মিথ্যা, ঠিক – ভুল, গ্রহণীয় – বর্জনীয় এসবের মানদণ্ড নির্ধারণ করেন না। বস্তুতঃ এইসব পারিপার্শ্বিক ব্যাপারগুলো আপনার কাছে অর্থহীন। যদি এই পৃথিবীর ছয়শ কোটি মানুষ কোনো কিছুতে বিশ্বাস করে, সেটা আপনার বিশ্বাসকে বিন্দুমাত্র টলাতে পারে না। বরং মাস না যেতেই পালটে যাওয়ার প্রবণতায় নিমজ্জিত নিত্য পরিবর্তনশীল এই জগতে, আপনার বিশ্বাসের ভিত্তি হল এক অপরিবর্তনীয় জগতের প্রতিক্রিয়া, যার মানদণ্ড কখনও বদলায় না। স্বর্গীয় সুখ আর শাস্তি, জান্নাত আর জাহান্নাম, ফেরেশতা আর শয়তানের অদেখা সেই জগতে ভালো-খারাপ আর সত্য-মিথ্যার মানদন্ড সৃষ্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত অপরিবর্তিত আছে এবং শেষ সময় পর্যন্ত এমনই থাকবে। এই শ্বাশ্বত মানদন্ডের নথিপত্র, আল কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে সেই-না-দেখা জগত থেকেই। আপনার আশপাশের মানুষ কী মনে করলো, আপনি তাদের কাছে নন্দিত হলেন নাকি নিন্দিত ,দুনিয়ার পরিবর্তনশীল ধারা কোন দিকে ধাবিত হল এই বিষয়গুলোকে সেই মানদন্ড মোটেই আমলে নেয় না।
আমার ভাই ও বোনেরা, এই জন্যই কুরআনে বর্ণিত তাওহীদের মানদন্ডকে আঁকড়ে ধরতে পেরে আপনি নিজেকে সবচেয়ে লাভবান মনে করেন। এই যুগেও সেই আদর্শের আল ওয়ালা ওয়াল বারা[২] এর বাহক হতে পারাটাকে আপনি সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ কাজ হিসাবে গণ্য করেন। আর এই আদর্শই আপনাকে তাগুতের [৩] সাথে আপোষ অথবা এর সামনে মাথা নত করাকে এই পৃথিবীর হীনতম অপমান হিসেবে চিনতে শেখায়। আপনার হৃদয় আপনার জনপ্রিয়তা আর বৈষয়িক স্বাচ্ছন্দ্যের পরোয়া না করেই এই আদর্শের উপর অটুট থাকে। কেন? কারণ আপনি যে আদর্শের উপর চলেন তা এমন এক জগত থেকে আগত যেখানে রীতিনীতি কখনো পরিবর্তিত হয় না। তাই এই অদৃশ্য জগতের উপর বিশ্বাস আপনাকে সেই অপরিবর্তনীয় মানদন্ডের মতোই দৃঢ়পদ রাখবে। রাতারাতি ধর্মত্যাগ করা যে সমাজে আধুনিকতায় পরিণত হয়েছে, আজকের সেই সমাজে সূরা বাকারার এই আয়াতগুলো যেন আরও অর্থবহ হয়ে ওঠে।
গায়েবের উপর দৃঢ় বিশ্বাস আপনাকে সাহসী করে তোলে। সত্যকে সমুন্নত রাখতে আপনি জীবনে যেকোনো ঝুঁকি নিতেও প্রস্তুত। স্মরণ করুন বদর যুদ্ধের সময় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সেই দুআ-
“হে আল্লাহ ! এই ক্ষুদ্র দল যদি আজ পরাজিত হয় তবে এই দুনিয়ায় আপনার ইবাদাত করার আর কেউ থাকবে না।”
চিন্তা করুন সেই দিন মুসলিমদের বিপক্ষে কতটুকু প্রতিকূলতা ছিল – ব্যর্থতা আর বিলুপ্তির ঝুঁকি এত বেশি ছিল যে ইসলাম চিরতরে মুছে যাবার মত অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিলো। অথচ এসব কিছু শুধু তাদের সংকল্পকেই আরও দৃঢ় করে তুলেছিল এবং তারা নিঃশঙ্ক চিত্তে অগ্রসর হয়েছিল। নিজেকে জিজ্ঞেস করুন, কী তাদেরকে এতটা ঝুকি নিতে উদ্বুদ্ধ করলো? কী তাদের মনে সাহস সঞ্চার করলো?কীসের দ্বারা তাদের অন্তরগুলো এতটা দৃঢ়তা লাভ করলো? আপনি অনুধাবন করবেন যে, এই পৃথিবীতে ক্রিয়াশীল শক্তিগুলো সম্পর্কে তাদের গভীর দূরদৃষ্টি ছিল। তারা জানতেন যে অদেখা গায়েবের জগত থেকে এমন শক্তি উন্মোচিত হতে পারে এবং হবে যা মানুষের পক্ষে কখনও কল্পনাও করা সম্ভব না। সেই শক্তি কখন আসবে তা তারা নির্দিষ্টভাবে না জানলেও তারা এটা জানতেন যে তা প্রকাশ হবেই, আর তা প্রকাশ হয়েওছিল।৪ হেবা দাবাগ (Heba Dabbagh)তার ‘Just Five Minutes‘গ্রন্থে (পৃঃ ৪৮-৪৯) বর্ণনা করেন যে কারাবন্দী অবস্থায় তার মাকে ওনার ছেলের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিলো। তিনি এর উত্তরে বলেছিলেনঃ “আমি কেবল এতটুকু জানি যে, আমি তাকে বড় করেছি ঘর থেকে মসজিদ আর মসজিদ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার জন্য”। পরবর্তীতে সেই কর্মকর্তা জিজ্ঞাসাবাদকারীকে নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘”কে নির্যাতন করার ব্যবস্থা কর“। হেবার মা জবাবে বলেন যে, “কী আশ্চর্য ! আমি তোমার মা’র বয়েসী আর তুমি আমাকে মারতে চাও!” এরপর তাকে একাকী বন্দী অবস্থায় রাখা হয়। তখন তিনি অকারণে তাকে আটকে রাখার ব্যাপারে কারাগারের ওয়ার্ডেনের কাছে অভিযোগ করেন। তিনি বলেনঃ “আমাকে কাগজ – কলম দিন। আমি এই পুরো ডিভিশনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করব”। অফিসার উত্তরে বলে যেঃ “এটার অনুমতি নেই। এটি কখনও কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছবে না।আর এটা আইনের পরিপন্থী”। পরে হেবার মা বলেন,“তবে আমি একমাত্র আল্লাহ’র কাছে আমার অভিযোগ তুলে ধরবো। তিনিই সর্বোত্তম বিচারক। আল্লাহ চান তো একদিন তুমি আমার অবস্থানে থাকবে কিন্তু আমার মতো ধৈর্য তোমার থাকবে না।” বোন হেবা পরে উল্লেখ করেন যেঃ “একমাস বা দুইমাস পর আমরা সেই অফিসারের মৃত্যু সংবাদ পাই। সে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় । গাড়ির স্টিয়ারিং তার পেটে ঢুকে গিয়েছিলো।”
সুতরাং, অনুধাবন করুন কীভাবে অদৃশ্য জগত আমাদের এই দৃশ্যমান পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু এর বিপরীত কখনও হয় না – এই বিশ্বাস আপনাকে আরও দৃঢ়পদ করে তোলে। দুনিয়ার কোন শক্তিই আপনার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। কারণ আপনি এর থেকেও অনেক বেশী শক্তিশালী সত্ত্বার কাছে আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। আর এই বাস্তবতায় আমাদেরকে শতভাগ বিশ্বাসী হতে হবে।
গায়েবে বিশ্বাসী হিসেবে আপনি যেকোনো আপাতদৃষ্ট ক্ষতিকে গ্রহণ করতে সক্ষম। বরং ক্ষতিটাকে আপনি প্রাপ্তি বলে মনে করেন। আপনার লাভ ক্ষতির হিসাব আপনার আশেপাশের মানুষদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তারা লাভ ক্ষতির হিসাব করে টাকা আর সুস্থতার ভিত্তিতে। আর আপনি লাভ ক্ষতি পরিমাপ করেন দৃঢ়তা আর আল্লাহ’র সন্তুষ্টির ভিত্তিতে। আপনি যতক্ষণ আপনার নীতির সাথে সৎ থাকছেন আর আল্লাহ’র সন্তুষ্টির সবগুলি শর্ত যথাযথভাবে পালন করছেন, ততক্ষণ আসলে আপনার ক্ষতি বলতে কিছুই নেই। নীতির ক্ষেত্রে দুর্বলতা আর শরীয়াহ লঙ্ঘনই আপনার নিকট সবচেয়ে বড় ক্ষতি। বাহ্যতভাবে উহূদ যুদ্ধ মুসলিমদের পরাজয় মনে হলেও, প্রকৃতপক্ষে তা যে একটি বিজয় ছিল সে বিষয়ে ইমাম ইবন আল-কায়্যিম তার ‘যাদ-উল-মাআদ’ গ্রন্থে প্রায় আট পৃষ্ঠাব্যাপী বিশদ আলোচনা করেছেন। মুসলিমদের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে যারা পরিষ্কার ধারণা লাভ করতে চান, তাদের উচিত তার এই লেখাটি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা ও বিশ্লেষণ করা। আমরা যদি গায়েবের আদর্শের মানদণ্ডে আমাদের লাভ – ক্ষতি নির্ধারণ করি তবে এই দুনিয়ার কোন ক্ষতিই আর আমাদের কাছে ক্ষতি মনে হবে না, তা সে যত বড়ই হক না কেন। আমাদের ধর্মকে আক্রমণ করা হবে, আমরা জেলে বন্দী হব, আমাদের ভূমি আক্রান্ত হবে, লুট করা হবে। কিন্তু এসব আমাদের পরাজিত করতে পারে না কারণ এসবই এই দুনিয়ার লেনদেন। কিন্তু সেই অদৃশ্য জগতে আমাদের পুরস্কারের খতিয়ান প্রস্তুতি, জান্নাতে আমাদের জন্য নির্মাণাধীন প্রাসাদসহ অন্যান্য কর্মচাঞ্চল্য জয় – পরাজয়ের এক ভিন্ন চিত্র অংকন করে।
এই চিন্তাধারার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছেন আমাদের বোন আফিয়া সিদ্দিকীর মা। বোন আফিয়া সিদ্দিকী বছরের পর বছর এমন মানুষদের কাছে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন যারা দিনরাত বক্তৃতা দেয় নারীদের সাথে আমাদের কেমন আচরণ করা উচিত। তাকে প্রথমে অপহরণ করা হয়, পরে আমেরিকার গোপন কারাগারে আটকে রাখা হয়, সন্তানদের কাছ থেকে আলাদা করা হয়, তার প্রতি কৃত অত্যাচারের প্রমাণগুলোকে তার সাথেই নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার আশায় তাকে তলপেটে দুইবার গুলি করা হয়। আরও অনেক অবর্ণনীয় অত্যাচারের শিকার হয়েছেন আমাদের এই বোন। আর সবশেষে তার বিরুদ্ধে এমন এক অবাস্তব অভিযোগ আনা হয় যা তার শারীরিক অবস্থার আলোকে চরম হাস্যকর।এই নারীর প্রতি চালানো নির্যাতন আমাদের হৃদয়ের অনুভূতিগুলোকে বাকহীন করে দেয়। এতদসত্ত্বেও তার সাহসী মায়ের চিন্তাধারা গায়েবের প্রতি অবিচল বিশ্বাসের এক নিখুঁত উদাহরণ।আর এই বিশ্বাসই তাকে আপাতদৃষ্টির এই দুরবস্থাকে বিজয় হিসাবে গ্রহণ করার শক্তি যুগিয়েছে। তিনি তার কন্যার প্রতি আনীত অভিযোগ শুনে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন এইভাবেঃ
‘এতদিন আমি খুবই অসুস্থ ছিলাম, আমি বিছানা থেকে উঠতে পারছিলাম না। কিন্তু আমার মেয়ের বিচারের রায় শুনে আমি যেন নতুন জীবন পেয়েছি। যদি বিচারকরা মনে করে থাকে যে আফিয়ার পরিবারের জন্য আজকের দিনটি একটি কালো দিন, তার মা রায় শুনে অজ্ঞান হয়ে যাবে, তবে তারা জেনে রাখুক আজকের চেয়ে খুশির দিন আমার জীবনে আর আসেনি। আল্লাহ এক আফিয়ার পরিবর্তে আজ আমাকে হাজারটা পুত্র সন্তান দিয়েছেন যারা প্রতিদিন আমাকে সাহায্য করার জন্য আমার দরজায় অপেক্ষা করে।’
সবশেষে তিনি বলেনঃ ‘একজন মু’মিনের লক্ষণ এটাই যে সে আল্লাহ ছাড়া আর কারও সামনে মাথা নত করে না। যেইদিন আমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে কোন সৃষ্ট জীব অথবা বস্তুর করুণা ভিক্ষা করব,সেইদিন আমরা ধ্বংস হয়ে যাবো।’
এটাই লাভ-ক্ষতির প্রকৃত অর্থ যা গায়েবের মানদন্ডের উপর প্রতিষ্ঠিত । এটি এই নশ্বর স্পৃশ্য জগতের উপর নির্ভর করে না ।
তাই গায়েবের উপর বিশ্বাস মুসলিম হিসেবে আমাদের জীবনে অত্যন্ত গভীর আর শক্তিশালী তাৎপর্য বহন করে।
শান্তি ও দয়া বর্ষিত হোক মুহাম্মাদ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর উপর।
তারিক মেহান্না,
প্লিমাউথ কারেকশনাল ফ্যাসিলিটি, আইসোলেশন ইউনিট – সেল # ১০৮,
ফজরের আগে লিখিত,
শুক্রবার ২৭ শে সফর, ১৪৩১ / ১২ ই ফেব্রুয়ারী, ২০১০।
[১] আল্লাহর তাওহীদে সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস স্থাপনকারী
[২] আল্লাহর জন্য ভালোবাসা এবং আল্লাহর জন্য ঘৃণা করা শীর্ষক ইসলামের একটি মূলনীতি
[৩] আল্লাহ ব্যতীত যাদের ইবাদাত(এমন যে কোনো কাজ যা শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট) করা হয় এবং তারা এতে সন্তুষ্ট
[৪] বদর যুদ্ধে ফেরেশতাদের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্যের কথা বলা হচ্ছে। দেখুন সূরাহ আনফাল [৮:৯-১০]
(Collected)
সূরা বাকারার শুরুতে আপনি দেখতে পাবেন আল্লাহ মুত্তাকীনদের সর্বপ্রথম যে বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন তা হল তারা ‘আল গায়েব ‘ অর্থাৎ অদৃশ্য জগতে বিশ্বাস করে। সর্বজনবিদিত ধারণাগুলো ছাড়াও আপনার জীবনে এই বিষয়টির আরও কিছু কার্যকরী তাৎপর্য রয়েছে।
প্রথমত, হে মুওয়াহহিদ [১] – আপনি যা বিশ্বাস করেন, তা এই জন্যে বিশ্বাস করেন না যে তা জনপ্রিয়, সহজলভ্য, আকর্ষণীয় এবং আরামদায়ক । আপনি আপনার আশেপাশের মানুষগুলোর প্রতিক্রিয়া দেখে সত্য – মিথ্যা, ঠিক – ভুল, গ্রহণীয় – বর্জনীয় এসবের মানদণ্ড নির্ধারণ করেন না। বস্তুতঃ এইসব পারিপার্শ্বিক ব্যাপারগুলো আপনার কাছে অর্থহীন। যদি এই পৃথিবীর ছয়শ কোটি মানুষ কোনো কিছুতে বিশ্বাস করে, সেটা আপনার বিশ্বাসকে বিন্দুমাত্র টলাতে পারে না। বরং মাস না যেতেই পালটে যাওয়ার প্রবণতায় নিমজ্জিত নিত্য পরিবর্তনশীল এই জগতে, আপনার বিশ্বাসের ভিত্তি হল এক অপরিবর্তনীয় জগতের প্রতিক্রিয়া, যার মানদণ্ড কখনও বদলায় না। স্বর্গীয় সুখ আর শাস্তি, জান্নাত আর জাহান্নাম, ফেরেশতা আর শয়তানের অদেখা সেই জগতে ভালো-খারাপ আর সত্য-মিথ্যার মানদন্ড সৃষ্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত অপরিবর্তিত আছে এবং শেষ সময় পর্যন্ত এমনই থাকবে। এই শ্বাশ্বত মানদন্ডের নথিপত্র, আল কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে সেই-না-দেখা জগত থেকেই। আপনার আশপাশের মানুষ কী মনে করলো, আপনি তাদের কাছে নন্দিত হলেন নাকি নিন্দিত ,দুনিয়ার পরিবর্তনশীল ধারা কোন দিকে ধাবিত হল এই বিষয়গুলোকে সেই মানদন্ড মোটেই আমলে নেয় না।
আমার ভাই ও বোনেরা, এই জন্যই কুরআনে বর্ণিত তাওহীদের মানদন্ডকে আঁকড়ে ধরতে পেরে আপনি নিজেকে সবচেয়ে লাভবান মনে করেন। এই যুগেও সেই আদর্শের আল ওয়ালা ওয়াল বারা[২] এর বাহক হতে পারাটাকে আপনি সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ কাজ হিসাবে গণ্য করেন। আর এই আদর্শই আপনাকে তাগুতের [৩] সাথে আপোষ অথবা এর সামনে মাথা নত করাকে এই পৃথিবীর হীনতম অপমান হিসেবে চিনতে শেখায়। আপনার হৃদয় আপনার জনপ্রিয়তা আর বৈষয়িক স্বাচ্ছন্দ্যের পরোয়া না করেই এই আদর্শের উপর অটুট থাকে। কেন? কারণ আপনি যে আদর্শের উপর চলেন তা এমন এক জগত থেকে আগত যেখানে রীতিনীতি কখনো পরিবর্তিত হয় না। তাই এই অদৃশ্য জগতের উপর বিশ্বাস আপনাকে সেই অপরিবর্তনীয় মানদন্ডের মতোই দৃঢ়পদ রাখবে। রাতারাতি ধর্মত্যাগ করা যে সমাজে আধুনিকতায় পরিণত হয়েছে, আজকের সেই সমাজে সূরা বাকারার এই আয়াতগুলো যেন আরও অর্থবহ হয়ে ওঠে।
গায়েবের উপর দৃঢ় বিশ্বাস আপনাকে সাহসী করে তোলে। সত্যকে সমুন্নত রাখতে আপনি জীবনে যেকোনো ঝুঁকি নিতেও প্রস্তুত। স্মরণ করুন বদর যুদ্ধের সময় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সেই দুআ-
“হে আল্লাহ ! এই ক্ষুদ্র দল যদি আজ পরাজিত হয় তবে এই দুনিয়ায় আপনার ইবাদাত করার আর কেউ থাকবে না।”
চিন্তা করুন সেই দিন মুসলিমদের বিপক্ষে কতটুকু প্রতিকূলতা ছিল – ব্যর্থতা আর বিলুপ্তির ঝুঁকি এত বেশি ছিল যে ইসলাম চিরতরে মুছে যাবার মত অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিলো। অথচ এসব কিছু শুধু তাদের সংকল্পকেই আরও দৃঢ় করে তুলেছিল এবং তারা নিঃশঙ্ক চিত্তে অগ্রসর হয়েছিল। নিজেকে জিজ্ঞেস করুন, কী তাদেরকে এতটা ঝুকি নিতে উদ্বুদ্ধ করলো? কী তাদের মনে সাহস সঞ্চার করলো?কীসের দ্বারা তাদের অন্তরগুলো এতটা দৃঢ়তা লাভ করলো? আপনি অনুধাবন করবেন যে, এই পৃথিবীতে ক্রিয়াশীল শক্তিগুলো সম্পর্কে তাদের গভীর দূরদৃষ্টি ছিল। তারা জানতেন যে অদেখা গায়েবের জগত থেকে এমন শক্তি উন্মোচিত হতে পারে এবং হবে যা মানুষের পক্ষে কখনও কল্পনাও করা সম্ভব না। সেই শক্তি কখন আসবে তা তারা নির্দিষ্টভাবে না জানলেও তারা এটা জানতেন যে তা প্রকাশ হবেই, আর তা প্রকাশ হয়েওছিল।৪ হেবা দাবাগ (Heba Dabbagh)তার ‘Just Five Minutes‘গ্রন্থে (পৃঃ ৪৮-৪৯) বর্ণনা করেন যে কারাবন্দী অবস্থায় তার মাকে ওনার ছেলের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিলো। তিনি এর উত্তরে বলেছিলেনঃ “আমি কেবল এতটুকু জানি যে, আমি তাকে বড় করেছি ঘর থেকে মসজিদ আর মসজিদ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার জন্য”। পরবর্তীতে সেই কর্মকর্তা জিজ্ঞাসাবাদকারীকে নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘”কে নির্যাতন করার ব্যবস্থা কর“। হেবার মা জবাবে বলেন যে, “কী আশ্চর্য ! আমি তোমার মা’র বয়েসী আর তুমি আমাকে মারতে চাও!” এরপর তাকে একাকী বন্দী অবস্থায় রাখা হয়। তখন তিনি অকারণে তাকে আটকে রাখার ব্যাপারে কারাগারের ওয়ার্ডেনের কাছে অভিযোগ করেন। তিনি বলেনঃ “আমাকে কাগজ – কলম দিন। আমি এই পুরো ডিভিশনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করব”। অফিসার উত্তরে বলে যেঃ “এটার অনুমতি নেই। এটি কখনও কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছবে না।আর এটা আইনের পরিপন্থী”। পরে হেবার মা বলেন,“তবে আমি একমাত্র আল্লাহ’র কাছে আমার অভিযোগ তুলে ধরবো। তিনিই সর্বোত্তম বিচারক। আল্লাহ চান তো একদিন তুমি আমার অবস্থানে থাকবে কিন্তু আমার মতো ধৈর্য তোমার থাকবে না।” বোন হেবা পরে উল্লেখ করেন যেঃ “একমাস বা দুইমাস পর আমরা সেই অফিসারের মৃত্যু সংবাদ পাই। সে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় । গাড়ির স্টিয়ারিং তার পেটে ঢুকে গিয়েছিলো।”
সুতরাং, অনুধাবন করুন কীভাবে অদৃশ্য জগত আমাদের এই দৃশ্যমান পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু এর বিপরীত কখনও হয় না – এই বিশ্বাস আপনাকে আরও দৃঢ়পদ করে তোলে। দুনিয়ার কোন শক্তিই আপনার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। কারণ আপনি এর থেকেও অনেক বেশী শক্তিশালী সত্ত্বার কাছে আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। আর এই বাস্তবতায় আমাদেরকে শতভাগ বিশ্বাসী হতে হবে।
গায়েবে বিশ্বাসী হিসেবে আপনি যেকোনো আপাতদৃষ্ট ক্ষতিকে গ্রহণ করতে সক্ষম। বরং ক্ষতিটাকে আপনি প্রাপ্তি বলে মনে করেন। আপনার লাভ ক্ষতির হিসাব আপনার আশেপাশের মানুষদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তারা লাভ ক্ষতির হিসাব করে টাকা আর সুস্থতার ভিত্তিতে। আর আপনি লাভ ক্ষতি পরিমাপ করেন দৃঢ়তা আর আল্লাহ’র সন্তুষ্টির ভিত্তিতে। আপনি যতক্ষণ আপনার নীতির সাথে সৎ থাকছেন আর আল্লাহ’র সন্তুষ্টির সবগুলি শর্ত যথাযথভাবে পালন করছেন, ততক্ষণ আসলে আপনার ক্ষতি বলতে কিছুই নেই। নীতির ক্ষেত্রে দুর্বলতা আর শরীয়াহ লঙ্ঘনই আপনার নিকট সবচেয়ে বড় ক্ষতি। বাহ্যতভাবে উহূদ যুদ্ধ মুসলিমদের পরাজয় মনে হলেও, প্রকৃতপক্ষে তা যে একটি বিজয় ছিল সে বিষয়ে ইমাম ইবন আল-কায়্যিম তার ‘যাদ-উল-মাআদ’ গ্রন্থে প্রায় আট পৃষ্ঠাব্যাপী বিশদ আলোচনা করেছেন। মুসলিমদের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে যারা পরিষ্কার ধারণা লাভ করতে চান, তাদের উচিত তার এই লেখাটি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা ও বিশ্লেষণ করা। আমরা যদি গায়েবের আদর্শের মানদণ্ডে আমাদের লাভ – ক্ষতি নির্ধারণ করি তবে এই দুনিয়ার কোন ক্ষতিই আর আমাদের কাছে ক্ষতি মনে হবে না, তা সে যত বড়ই হক না কেন। আমাদের ধর্মকে আক্রমণ করা হবে, আমরা জেলে বন্দী হব, আমাদের ভূমি আক্রান্ত হবে, লুট করা হবে। কিন্তু এসব আমাদের পরাজিত করতে পারে না কারণ এসবই এই দুনিয়ার লেনদেন। কিন্তু সেই অদৃশ্য জগতে আমাদের পুরস্কারের খতিয়ান প্রস্তুতি, জান্নাতে আমাদের জন্য নির্মাণাধীন প্রাসাদসহ অন্যান্য কর্মচাঞ্চল্য জয় – পরাজয়ের এক ভিন্ন চিত্র অংকন করে।
এই চিন্তাধারার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছেন আমাদের বোন আফিয়া সিদ্দিকীর মা। বোন আফিয়া সিদ্দিকী বছরের পর বছর এমন মানুষদের কাছে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন যারা দিনরাত বক্তৃতা দেয় নারীদের সাথে আমাদের কেমন আচরণ করা উচিত। তাকে প্রথমে অপহরণ করা হয়, পরে আমেরিকার গোপন কারাগারে আটকে রাখা হয়, সন্তানদের কাছ থেকে আলাদা করা হয়, তার প্রতি কৃত অত্যাচারের প্রমাণগুলোকে তার সাথেই নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার আশায় তাকে তলপেটে দুইবার গুলি করা হয়। আরও অনেক অবর্ণনীয় অত্যাচারের শিকার হয়েছেন আমাদের এই বোন। আর সবশেষে তার বিরুদ্ধে এমন এক অবাস্তব অভিযোগ আনা হয় যা তার শারীরিক অবস্থার আলোকে চরম হাস্যকর।এই নারীর প্রতি চালানো নির্যাতন আমাদের হৃদয়ের অনুভূতিগুলোকে বাকহীন করে দেয়। এতদসত্ত্বেও তার সাহসী মায়ের চিন্তাধারা গায়েবের প্রতি অবিচল বিশ্বাসের এক নিখুঁত উদাহরণ।আর এই বিশ্বাসই তাকে আপাতদৃষ্টির এই দুরবস্থাকে বিজয় হিসাবে গ্রহণ করার শক্তি যুগিয়েছে। তিনি তার কন্যার প্রতি আনীত অভিযোগ শুনে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন এইভাবেঃ
‘এতদিন আমি খুবই অসুস্থ ছিলাম, আমি বিছানা থেকে উঠতে পারছিলাম না। কিন্তু আমার মেয়ের বিচারের রায় শুনে আমি যেন নতুন জীবন পেয়েছি। যদি বিচারকরা মনে করে থাকে যে আফিয়ার পরিবারের জন্য আজকের দিনটি একটি কালো দিন, তার মা রায় শুনে অজ্ঞান হয়ে যাবে, তবে তারা জেনে রাখুক আজকের চেয়ে খুশির দিন আমার জীবনে আর আসেনি। আল্লাহ এক আফিয়ার পরিবর্তে আজ আমাকে হাজারটা পুত্র সন্তান দিয়েছেন যারা প্রতিদিন আমাকে সাহায্য করার জন্য আমার দরজায় অপেক্ষা করে।’
সবশেষে তিনি বলেনঃ ‘একজন মু’মিনের লক্ষণ এটাই যে সে আল্লাহ ছাড়া আর কারও সামনে মাথা নত করে না। যেইদিন আমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে কোন সৃষ্ট জীব অথবা বস্তুর করুণা ভিক্ষা করব,সেইদিন আমরা ধ্বংস হয়ে যাবো।’
এটাই লাভ-ক্ষতির প্রকৃত অর্থ যা গায়েবের মানদন্ডের উপর প্রতিষ্ঠিত । এটি এই নশ্বর স্পৃশ্য জগতের উপর নির্ভর করে না ।
তাই গায়েবের উপর বিশ্বাস মুসলিম হিসেবে আমাদের জীবনে অত্যন্ত গভীর আর শক্তিশালী তাৎপর্য বহন করে।
শান্তি ও দয়া বর্ষিত হোক মুহাম্মাদ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর উপর।
তারিক মেহান্না,
প্লিমাউথ কারেকশনাল ফ্যাসিলিটি, আইসোলেশন ইউনিট – সেল # ১০৮,
ফজরের আগে লিখিত,
শুক্রবার ২৭ শে সফর, ১৪৩১ / ১২ ই ফেব্রুয়ারী, ২০১০।
[১] আল্লাহর তাওহীদে সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস স্থাপনকারী
[২] আল্লাহর জন্য ভালোবাসা এবং আল্লাহর জন্য ঘৃণা করা শীর্ষক ইসলামের একটি মূলনীতি
[৩] আল্লাহ ব্যতীত যাদের ইবাদাত(এমন যে কোনো কাজ যা শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট) করা হয় এবং তারা এতে সন্তুষ্ট
[৪] বদর যুদ্ধে ফেরেশতাদের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্যের কথা বলা হচ্ছে। দেখুন সূরাহ আনফাল [৮:৯-১০]
(Collected)
Comment