বিসমিল্লাহির রাহামানির রাহিম
আল্লাহতা’আলা সূরা আলে-ইমরানের ৩৫ নম্বর আয়াতে বলেছেনঃ
“এবং যখন ‘ইমরানের স্ত্রী বললোঃ হে আমার রব! আমার গর্ভে যা রয়েছে আমি তাকে তোমার নামে উৎসর্গ করলাম…”
একবার কারাগারের এক ধর্মযাজক আমাকে বলেছিলঃ “যতক্ষণ না একজন ব্যক্তি নিজের জীবন আর আরাম-আয়েশের চাইতে সত্যকে বেশি ভালোবাসবে ও প্রাধান্য দেবে, ততক্ষণ পর্যন্ত সত্যের জন্য ত্যাগ স্বীকার করা তার পক্ষে সম্ভব হবে না।” সূরা আলে-‘ইমরানের পুরোটাই হলো এই সত্যের জন্য আত্মত্যাগের বিবরণ। সূরাটি বরাবর দু’শো আয়াত দীর্ঘ, কিন্তু এতে বর্ণিত হয়েছে মাত্র দুইটি কাহিনী- প্রথম অর্ধেকে একটি কাহিনী, আরেকটি শেষের দিকে। যদিও দু’টি কাহিনীর মাঝে রয়েছে ৭০০ বছরের সুবিশাল ব্যবধান, তবুও ঘটনাদুটো খুব চমৎকারভাবে সমগ্র সূরাকে এক সুতোয় গেঁথেছে - আর তা হলো দ্বীনের জন্য আত্মত্যাগ, দ্বীনের জন্য নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দেয়া, এমনকি নিজ পরিবারকেও।
প্রথম কাহিনীটি হলো ‘ইমরানের পরিবারের গল্প, যার নামে এই সূরাটির নামকরণ করা হয়েছে। এখানে বলা হচ্ছে এমন এক পরিবারের কথা যারা সত্যকে প্রচার করতে ও সত্যকে প্রতিষ্ঠিত রাখতে তাদের সবগুলো প্রজন্মকে উৎসর্গ করে দিয়েছিলঃ ‘ইমরান ও তার স্ত্রী, তাদের কন্যা মারইয়াম (কুমারী ম্যারি), তাঁর চাচা যাকারিয়্যা ও তাঁর পুত্র ইয়াহইয়া (জন দ্যা ব্যাপটিস্ট), এবং মারইয়ামের আপন সন্তান ‘ঈসা (খ্রিস্টানরা যাকে যীশু খ্রিস্ট নামে অভিহিত করে)। আল্লাহর বাণীকে সমুন্নত রাখার উদ্দেশ্যে এই পরিবারটির ত্যাগের ইতিহাসের শুরু আজ হতে প্রায় ২০০০ বছরেরও আগে, যখন ‘ইমরানের স্ত্রী আল্লাহর কাছে আলোচ্য আয়াতে উল্লেখিত মানতটি আল্লাহর কাছে পেশ করেছিলেন। এবং ‘ইমরান পরিবারের এই ত্যাগের ধারা অব্যাহত থাকবে ততদিন পর্যন্ত, যতদিন না ‘ঈসা (আ) শেষ যমানায় আবারো আবির্ভূত হচ্ছেন, এবং চূড়ান্ত তাওয়াঘিত (দাজ্জাল এবং ইয়াজুজ-মাজুজ) কে অপসারণ করে ফেলছেন এবং সমগ্র বিশ্ব শরীয়াহ আইন দ্বারা শাসন করছেন।
সূরাতে বর্ণিত দ্বিতীয় কাহিনীটি আরেকটি পরিবারকে ঘিরে, যে পরিবারটি তাদের সবকিছু ঢেলে দিয়েছিল আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করতে। আমরা জানি, উহুদের যুদ্ধে একদিনে সত্তর জন মুসলিম মুশরিকদের হাতে শহীদ হন। বনী-দিনার গোত্রের এক মহিলার পরিবারের সকল পুরুষ সদস্য এই যুদ্ধে শহীদ হন। সেই মহিলা স্বামীহারা হলেন, তাঁর বাবা, ভাই সবাইকে হারালেন সেই একদিনে। হুযাইফাহ বিন আল-ইয়ামান তাঁর পিতার সাথে উহুদে গিয়েছিলেন, নিজের চোখের সামনেই জিহাদের ময়দানে বাবাকে শহীদ হয়ে যেতে দেখলেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ফিরে আসার পথে হামনাহ বিনত জাহশের সাথে তাঁর দেখা হলো, তিনি (সা) তাকে জানালেন যে তাঁর ভাই ‘আবদুল্লাহ, তাঁর চাচা হামযা বিন ‘আবদুল মুত্তালিব, ও তাঁর প্রিয়তম স্বামী মুস’আব ইবন উমাইর সকলেই ঐদিন শহীদ হয়ে গেছেন। ইমরানের পরিবারের মতো একইভাবে এই পরিবারগুলিও কেবলমাত্র তাওহীদ ও ঈমানের পতাকাকে সমুচ্চ রাখতে যেয়ে নিজেদেরকে পুরোপুরি বিলিয়ে দিয়েছিল।
আর আমরা পরবর্তী যমানায়ও অনুরূপ ঘটনা দেখতে পাই যখন একই পরিবারের একাধিক প্রজন্ম দ্বীনের জন্য আত্মত্যাগের এই অসামান্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেঃ ত্রয়োদশ শতাব্দীর বিখ্যাত ‘আলিম ইবন তাইমিয়্যাহ-র বাবা ও দাদা দু’জনেই স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রখ্যাত আলেম ছিলেন (তাঁর দাদার রচিত “মুনতাক্বা আল-আকবার” গ্রন্থটি আশ-শাওকানির “নাইল আল-আওতার” গ্রন্থের বিষয়বস্তু হিসেবে গৃহীত হয়)। অষ্টদশ শতাব্দীর বিখ্যাত সংস্কারক মুহাম্মদ বিন ‘আব্দুল ওয়াহাবের উত্তরসূরীরা তাঁর তাওহীদ প্রচারের মিশন অব্যাহত রাখেন (যাদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তাঁর নাতী সুলাইমান, যিনি সর্বপ্রথম ও সর্বোৎকৃষ্ট ব্যাখ্যা সহকারে “কিতাব আত-তাওহীদ” এর উপর গ্রন্থ রচনা করেন), এবং এরকম রয়েছে আরো অনেকে। আপনি কুতুবদের মাঝেও এমন পরিবারের দেখা পাবেন যেখানে একটি পুরো প্রজন্ম কেবল দ্বীনের তরে বেঁচে ছিলেন (সায়্যিদ, তাঁর ভাই মুহাম্মদ, এবং বোন হামিদা ও আমিনা, তাঁরা সকলেই একই সময়ে কারাবন্দী হয়েছিলেন)।
কতই না চমৎকার হতো যদি যুগ যুগ পরে দ্বীনের জন্য ত্যাগের বীরত্বগাঁথা বর্ণনার সময় আমাদের আপন পরিবার, আমাদের আপন বংশধরদের কথাও এভাবে স্মরণ করা হতো! তবে হ্যাঁ, এই ত্যাগের শুরু সবসময়ই হয় একজন ব্যক্তির নিজেকে দিয়েই।
طارق مهنا
তারিক মেহান্না
প্লাইমাউথ কারেকশনাল ফ্যাসিলিটি
আইসোলেশন ইউনিট #১০৮
Comment