আমরা মুসলমান। আমাদের ধর্ম ইসলাম। আমাদের প্রভূ একমাত্র আল্লাহ। আমরা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট মহামানব বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উম্মাৎ। আমাদের কর্তব্য হলো রাসূল এর আদেশ-নিষেধ মেনে চলা। তাঁর অনুসরণ-অনুকরণ করা। তাঁর সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা। তাঁকে জান-প্রাণ দিয়ে ভালোবাসা। আল্লাহ তা’লা কুরআনের একাধিক আয়াতে রাসূল কে সৃষ্টিজগতের সবার চেয়ে বেশি ভালোবাসতে বলেছেন। আল্লাহ তা’লা বলেন:
‘বলো তোমাদের নিকট যদি তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তানাদি, তোমাদের ভাই, তোমাদের পরিবার-পরিজন, তোমাদের বংশ-গোত্র, তোমাদের অর্জিত ধন-সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য যা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় কর, (তা যদি) আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তাঁর রাহে জিহাদ করা থেকে অধিক প্রিয় হয়, তবে অপেক্ষা কর, আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত আর আল্লাহ ফাসেক সম্প্রদায়কে হেদায়েত করবেন না। (সূরা তাওবাহ: ২৪)
অন্য আয়াতে এরশাদ হয়েছে:
‘নবী মুমিনদের কাছে তাদের নিজেদের চেয়েও অধিক ঘনিষ্ঠ। (সূরা আল আহযাব: ৬)
হাদিস শরীফে হযরত আনাস (রাযি থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসূল বলেছেন, তোমাদের মধ্যে কেউ পূর্ণ মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার কাছে তার পিতা, তার সন্তান এবং অন্যান্য সকল মানুষ থেকে প্রিয়তম হব।’ (বুখারী ও মুসলিম)
মানুষ একে অপরকে ভালোবাসে হৃদয়ে ও বিশ্বাসে। যার প্রতিচ্ছবি দেখা যায় তার আচার-আচরণ ও কাজ-কর্মে ও সংস্কৃতিতে তাঁর প্রতিচ্ছবিই প্রস্ফুটিত হতে হবে। রাসূলের কল্পনা করলে অন্তর যেন খুশি হয়, তাঁর আলোচনা যেন আত্মার জন্যে খাদ্য হয়, জবান স্বাদ ও আনন্দ হাসিল করে এবং তাঁর মোবারক নাম দ্বারা অন্তর যেন প্রশান্তি লাভ করে।
এখানে জানা আবশ্যক যে, রাসূলের জন্যে কেন সৃষ্টিজগতের সর্বাধিক ভালোবাসা হওয়া উচিৎ। এ প্রসঙ্গে হাদিস বিশেষজ্ঞ আল্লামা ইসহাক (রহ.) ‘দরসে মিশকাত’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, কারো প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি হওয়ার কারণ হলো চারটি।
১. সৌন্দর্য ২. পরিপূর্ণতা ৩. এহসান বা অনুগ্রহ ৪. আত্মীয়তা।
সৌন্দর্যের কারণে ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। সৌন্দর্য়ের উপর কোনো কোনো জীবজন্তুও আশিক হয়ে যায়। যথা- চাদের সৌন্দর্য়ের উপর কোনো কোনো পাখি আশিক। প্রদীপের আলোর উপর কোনো কোনো প্রতঙ্গ এমনভাবে আশিক হয় যে, প্রাণও এ জন্যে বিসর্জন দিয়ে দেয়। এমনিভাবে কারো উপর অন্য কারো দয়া-অনুগ্রহ থাকলেও তার জন্যে ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। মানুষ তো আছেই; এমনকি জীবজন্তুও এহসানের বিনিময়ে ভালোবাসতে আরম্ভ করে এবং অনুগ্রহকারীর পোষ্য বনে যায়। যথা-কুকুর বিড়াল ইত্যাদি। আর যদি কারো মধ্যে সৌন্দর্য় না থাকে তবে এহসান বা অনুগ্রহও পাওয়া যায় না। যোগ্যতার ক্ষেত্রে পূর্ণতা বিদ্যমান। যেমন- বড় কোনো দার্শনিক, কবি-সাহিত্যিকের প্রতি ভালোবাসা হয়ে যায়; ওই ব্যক্তি সুশ্রী না হলেও। আর আত্মীয়তার কারণে ভালোবাসা সৃষ্টি হওয়া তো অত্যন্ত পরিস্কার।
উল্লিখিত কারণসমূহের যে কোনো একটি থাকলেই *যখন ভালোবাসা *সৃষ্টি হয়; তাহলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মধ্যে উক্ত চারটি কারণ ও গুণ পরিপূর্ণ রূপে বিদ্যমান থাকার পরও তার প্রতি ভালোবাসা হবে না তো আর কার প্রতি হবে?
সৌন্দর্য: রাসূল এর দেহের গড়ন ছিল মাধ্যম প্রকৃতির, সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পরিমিত ও সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাঁর চেহারায় ছিলো মমতার আবরণ, কথা-বার্তায় ছিলো বদান্যতা, সবকিছু মিলিয়ে তিনি ছিলেন সর্বাপেক্ষা সৌন্দর্যের অধিকারী এবং আল্লাহর সর্বাধিক প্রিয়। যেহেতু আল্লাহ তা’লা তাকেই সর্বাপেক্ষা প্রিয় বানিয়েছেন, সুতরাং তাকে সর্বাপেক্ষা সুন্দরও বানাবেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সৌন্দর্যের মুগ্ধ হয়ে হাসসান বিন সাবেত রায়ি. একটি শ্লোক রচনা করেছেন। আরবি শ্লোকের অনুবাদ হচ্ছে, “আমার চোখ কখনও তোমার চেয়ে অধিক সুন্দর কাউকে দেখেনি এবং তোমার থেকে সুন্দর কোনো মানুষকে কোনো নারী প্রসব করেনি।”
এ প্রসঙ্গে হযরত আয়শা সিদ্দীকা রাযি. বলেন- একটি সূর্য রয়েছে আমার জন্যে, আর অন্য একটি সূর্য রয়েছে সমগ্র জগতবাসীর জন্যে। কিন্তু আমার সূর্য আকাশের সূর্য হতে উত্তম। কারণ জগতের সূর্যটি ফজরের পর উদয় হয়, আর আমার সূর্যটি রাত্রে এশার পর উদিত হয়।
পরিপূর্ণতা: এই পূর্ণতা মানবীয় চরিত্রের, মানবিক গুণাবলির। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন আপন মহিমায় মানবীয় গুণাবলির পূর্ণতার সুউঁচ্চ শিখরে সমাসীন। তা ইলম ও আমলের দিক থেকে হোক, কিংবা চারিত্রিক ব্যাপারে হোক, আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে হোক। স্বয়ং আল্লাহ তা’লা কোরআনে এরশাদ করেছেন, ‘আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী।’ অন্যসব নবী রাসূলগণকে যে সকল পরিপূর্ণতা দান করা হয়েছিল, সবই একত্রে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দান করা হয়েছিল।
এহসান বা অনুগ্রহ: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দয়া, অনুগ্রহ এবং নম্রতা এত বেশি যে, পবিত্র কোরআনে ঘোষিত হয়েছে, ‘আমি আপনাকে সমগ্র জগতবাসীর জন্যে রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছি।’
রাসূল সমস্ত বনী আদমকে চিরস্থায়ী জাহান্নাম থেকে বাঁচানোর জন্যে প্রচেষ্টা করেছেন এবং অনেককে বাঁচিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আল কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা জাহান্নামের গর্তের কিনারায় গিয়ে পৌঁছে ছিলে; কিন্তু রাসূল তোমাদেরকে তাতে পড়া হতে রক্ষা করেছেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আগমনপূর্ব যুগকে ‘আইয়ামে জাহেলিয়্যাত’ বা অজ্ঞতা ও অন্ধকারের যুগ বলা হয়। দিনের আকাশের সূর্য, রাতের আকাশে চাঁদ-তারকারাজি থাকা সত্ত্বেও সেই যুগকে অন্ধকারের যুগ বলা হয় কেন? তখন কাব্য-সাহিত্যে, সংগীতে আরবরা দুনিয়ার মধ্যে শ্রেষ্ঠ থাকা সত্ত্বেও সেই যুগকে অজ্ঞতার যুগ বলা হয় কেন? আসল কথা হচ্ছে, এই অন্ধকার ও অজ্ঞতা ছিলো মানব চরিত্রের চরম অধঃপতনের। এই অজ্ঞতা ও অন্ধকারের মধ্য দিয়ে তারা জাহান্নামের কিনারায় গিয়ে পৌছে ছিল। আল্লাহ তায়ালা এই অজ্ঞতা ও অন্ধকারের যুগে রাসূল সা কে প্রেরণ করে মানবজাতির প্রতি দয়া ও অনুগ্রহ করেছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পৃথিবীতে ঐশ্বরিক সৌন্দর্য বিতরণ করলেন, তাদের মধ্যে আলো ছড়ালেন। হানাহানি, রক্তপাতের পরিবর্তে মুসলমানরা ভাই ভাই শিক্ষা নিলেন। প্রেম-মমতা ত্যাগ, পরোপকার, প্রভৃতির মাধ্যমে মায়া-মমতার একটি বেহেশতী সমাজ প্রতিষ্ঠা করলেন। তাঁর এই শিক্ষা ও চরিত্রের সৌন্দর্যের জোয়ার ছড়িয়ে পড়ল দুনিয়াজুড়ে। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা পেলাম ইসলামী শিক্ষা ও ইসলামী জীবন দর্শনের সন্ধান। আমাদের সৌভাগ্য যে, আমরা হলাম শ্রেষ্ঠ নবীর উম্মাত।
আত্মীয়তা: সামন্য গভীর দৃষ্টিতে চিন্তা করলে দেখা যাবে যে, রাসূল এর সাথে মুমিনের আত্মীয়তার সম্পর্ক অন্যদের চেয়ে বেশি। কেননা অন্যদের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক জিসমানী বা শারীরিক আর রাসূলের সাথে রুহানি বা আত্মীক। আত্মাহীন দেহ মূল্যহীন। রাসূল হলেন আমাদের মূল্যবান আত্মার পরম আত্মীয়। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘মুমিনদের সাথে রাসূলের সম্পর্ক তাদের সত্ত্বার চেয়েও বেশি এবং রাসূল হলেন তাদের পিতৃতুল্য।’
আবু দাউদ শরীফে হযরত আবু হুরায়রা রাযি. কর্তৃক বর্ণিত হাদীসে রাসূল বলেছেন, ‘আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের পিতার সমতুল্য।
কুরআন হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী, সব রকমের লোক যথা-বড়-ছোট এবং সম-সময়িকদের ভালোবাসার চেয়ে অধিক ভালোবাসা রাসূলের জন্যে হওয়াটা পূর্ণাঙ্গ ইমানের দাবি। সাহাবাগণ রাসূল কে জান প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন। তাকে যথাযথ সম্মান করতেন। সর্বদা তার অনুসরণ-অনুকরণে ব্রতী থাকতেন। তাঁর আদেশ-নিষেধ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন। রাসূলের আদর্শকে সমুন্নত রাখাই ছিলো তাদের জীবনের সাধনা। রাসূলের জন্যে তাদের ভালোবাসা নিজেদের ছেলে-মেয়ে, পিতা-মাতা, আত্মীয় স্বজনদের চেয়েও অধিক ছিলো। ওহুদের যুদ্ধে হযরত আবু তালহা রাযি. এমনভাবে নিজেকে উপস্থাপন করলেন যে, নিজের সমস্ত দেহ আহত হয়ে গেল কিন্তু রাসূলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ওপর একটা তীরও পতিত হতে দিলেন না।
উপরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ভালোবাসার কিছু যৌক্তিক দিক উল্লেক করা হয়েছে। মোটকথা হচ্ছে, একজন মহামানবের প্রতি ভালোবাসার উদ্দীপক সব কারণই প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মধ্যে ছিল। যে সব কারণে মানুষ সাধারণত অপর একজন মানুষের প্রতি মুগ্ধ হয় এর সবকিছুই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জীবন চরিত্রে বিদ্যমান ছিল। আর আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয় হাবীবকে সর্ববিষয়ের পূর্ণতা দিয়ে এ জন্যেই সৃষ্টি করেছেন যে, কারণ আমরা জানি একজন আদর্শবান ব্যক্তির অনসরণ ও অনুকরণের মূল চালিকা শক্তিই হলো সে ব্যক্তির প্রতি হৃদয়ের গভীরে লালন করা ভালোবাসার নির্যাস। যে নির্যাসের শক্তি জীবন দিয়ে হলেও সেই প্রিয়তম ব্যক্তিকে ভালোবাসতে প্রেরণা দেয়। যে নির্যাস শক্তিই জীবনের প্রতিটি রক্তবৃন্দুর বিনিময়ে হলেও সেই প্রিয়তম ব্যক্তির মান-মর্যাদা, ইজ্জত-সম্মানকে অক্ষুন্ন রাখতে একজন মানুষকে প্রযোজনে সুবিশাল শক্তি-সামন্তের অধিকারীর মুকাবিলায় অবতির্ণ হওয়ার সাহস যোগায়। আর এসবই হলো এশক-মহব্বৎ বা নবীপ্রেমের বাহ্যিক নিদর্শন। কিন্তু কেন জানি আমাদের রাসূলপ্রেম বাস্তবতার বিচারে ষৌল আনায় ষৌল আনাই মিথ্যে। আমরা তো নবীপ্রেমের দাবি করি কিন্তু আমাদের জীবনে আজ রাসূল সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাহসমূহ উপেক্ষিত।
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তো দ্বীনের জন্যে শত সহস্র কষ্ট-ক্ল্যশ, জুলুম-নির্যাতন সহ্য করেছেন কিন্তু আমরা আজ তাঁর রেখে যাওয়া দ্বীন ও ইসলামের দুর্দিনে শুধু আত্ম ভুলাবস্থায় জীবন যাপন করছি। কেমন যেন আমাদের কোনো আদর্শ নেই। আমাদের কোনো আদর্শিক নেতা নেই। আমাদের কোনো সঠিক ও যুগপৎ কর্মসূচী নেই। আমাদের আবস্থাটা কেমন যেন সেই মেশ পালের মতনই খেয়ে-দেয়ে কোনো রকম বেঁচে থাকলেই চলে। অতচ দুনিয়ার জন্যে আমাদের যে পরিমান গরজ এর কিদয়াংশও যদি আজ দ্বীনের জন্যে হতো, তবে হয়তো বহুকাল আগেই ইমান, ইসলাম ও মুমিনদের সুদিন ফিরে আসতো। আল্লাহর রাসূলের রেখে যাওয়া দ্বীন ও শরীয়ত নিজ ভাবধারায় চলতে পারতো। কিন্তু কেমন জানি আজ সবকিছুই উলট-পালট এদিক ওদিক হয়ে গিয়েছে। রাসূলপ্রেমিক সত্যিকার মুমিন ও মুজাহিদীনদেরকে- যারা দ্বীনের দুরাবস্থায় নিজেদের সর্বশক্তি ব্যয় করে দ্বীনে মুহাম্মদীকে আপন ভাবধারায় চালাতে নিজেদের অক্লান্ত চেষ্টা সাধনা ব্যয় করছেন। শুধু দ্বীনের জন্যেই যে সকল মুজাহিদ ভাইয়েরা আজ নিজেদের সহায় সম্বল, বিবি-বাচ্চা, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশি সবকিছু হারিয়ে ফেলছেন, তথাপিও মুমিন ও মুসলিম দাবিদ্বার আমাদের বিরাট একটি অংশ আজ তাদেরকে ইসলাম হতে বিচ্ছিন্ন একটি অংশ বলে খুব জোরেসুরেই ডামাঢোল পেটাচ্ছেন। এ কাজটি যে শুধু ইসলামের শত্রুরাই করছেন তা তো নয় বরং রাসূলপ্রেমের দাবিদ্বারদেরও বিরাট একটি অংশ উক্ত ঘৃনিত কাজটি করে যাচ্ছেন। অতচ এসব নবীপ্রেমিকদের নবীপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ কেবল নিজেদের পরিমলে খুব পাকসাফ পোশাক-পরিচ্চদ পরিধান করা, বিশেষ জাতীয় টুপি পড়া, দফদবে সাধা জুতো পড়ার প্রতিই গুরুত্ব প্রদান। এই হলো তাদের সার্বক্ষণিক জিহাদের প্রশিক্ষণসমূহ।
আমাদের দেওবন্দি সালাফগণ যে লক্ষ্যে দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আমরা আজ তা একেবারেই ভুলে গিয়েছি। প্রতিষ্ঠা লগ্নের পর থেকে দারুল উলুম দেওবন্দ যে লক্ষ্য পানে কামিয়াবীর সাথে বীরদর্পে এগিয়েছিল সে মানহাজ ও প্রক্রিয়া আজ আমরা পুরোপুরিই ছেড়ে দিয়েছি। দেওবন্দ নামক পাত্র থেকে আমরা মূল্যবান সেই মুতিটি বাহিরে নিক্ষেপ করে, কংকর ও নুড়িপাথর জাতীয় কিছু দ্বীনি কর্মসূচী দিয়ে তা ভরে ফেলেছি। এককালে যে কাফেলার প্রধান ও প্রাথমিক মিশন ছিলো মানবতার কল্যাণে মানবতার চিরশত্রু বৃটিশ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে জিহাদ পরিচালনা করা, কিন্তু বাস্তব দৃশ্যপটে আজ যা পরিলক্ষিত তা সম্পূর্ণই এর বিপরীত। সেই দেওবন্দি কাফেলা আজ তাদের জীবনদর্শন থেকে জিহাদের অবশিষ্ট রঙটুক পর্যন্ত মুছে ফেলতে একেক করে সব প্রস্তুতি বাস্তবায়ন করছে। এককালে যে দারুল উলূমের সিংহ শাবকেরা জিহাদী স্পৃহায় দেওবন্দ বস্তিতে লাঠি প্রশিক্ষণে মত্ত থাকতো আজ সে দারুল উলুমের সন্তানেরাই দারুল উলুম চত্ত্বরে জিহাদ বিরোধী স্লোগান দিয়ে পুরো দেওবন্দ বস্তির আকাশ-বাতাশ ভারি করে তুলে। আজ তাদেরই একটি বড় জনস্রোত তাজকিয়ার নামে দ্বীনের বিকৃতি সাধন করে যাচ্ছেন। বিশেষত জিহাদের বিকৃতি সাধন করছেন। তাদের অপর একটি ধারা গনতন্ত্র নামক কুফুরি মতবাদের সাথে মিলেজিলে রাজনীতি করছেন আর মুসলিম মিল্লাতের সামনে প্রতিষ্ঠীত ইমান ও কুফুরের সীমানা প্রাচীরকে একেবারেই ধুলিস্সাৎ করে দিচ্ছেন। আর এ শ্রেণীটাও জিহাদের অপব্যাখ্যা করছেন।
দেওবন্দি গড়ানারই বড় মাপের একজন মুরুব্বী হযরত মাও. ইলিয়াছ রহ: এর প্রতিষ্ঠিত তাবলীগ জামাতও আজ দেদার্সে জিহাদের অপব্যাখ্যা করে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু আমরা যদি আজ দেওবন্দি কাফেলার গুরুজনদের দিকে একটু থাকিয়ে দেখি তাহলে পরিস্কার দেখতে পাবো যে, দেওবন্দিরা কেমন উঁচু মানের মুজাহিদ ছিলেন। আমরা জানি মাও. হোসাইন আহমাদ মাদানী, হাজ্বী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী, মাও. কাসেম নানুতুবী রহ: ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদ পরিচালনা করেছেন। সারাটা জীবনই তারা ইংরেজদের বিরুদ্ধে সরব জিহাদ চালিয়ে গিয়েছেন। আজকের তথাকথিক দেওবন্দিরা কিভাবে এ ইতিহাসকে মুছে ফেলবে।
সত্যই আজ কাকে আর কি বলবো? স্বার্থপরায়নতা আমবর্ষার এমন এক বিদঘুটে কালো অন্ধকার যে, এক সময় তা ব্যক্তির হৃদয়ে-মমনে শুধু অন্ধকার আর অন্ধকারই বিস্তার করে। আর তখন ব্যক্তির কাছে নিজ জাতিসত্ত্বার পরিচয়টা পর্যন্ত ঢাকা পড়ে যায়। হোক সে স্বার্থ ব্যক্তিস্বার্থ বা প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থই। আর স্বার্থপরায়নতার এ কুশ্রীত চেহারা শুধু বর্তমানেরই নয় বরং এর অতিত চিত্র এমনই ছিল। কারণ শুধু ব্যক্তিস্বার্থের জন্যেই তো বিশ্ব ওলীকুল শিরমণি বালয়াম বায়ূরার জীবনে অন্ধকার নেমে এসেছিল। তাই না? (আল্লাহ আমাদের সকলকে দ্বীনি স্বার্থের বিপরীত সব ধরনের ব্যক্তিস্বার্থকে কুরবানি করার তাওফিক দান করুন) আমীন!!
قُلْ إِنْ كَانَ آبَاؤُكُمْ وَأَبْنَاؤُكُمْ وَإِخْوَانُكُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ وَعَشِيرَتُكُمْ وَأَمْوَالٌ اقْتَرَفْتُمُوهَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَمَسَاكِنُ تَرْضَوْنَهَا أَحَبَّ إِلَيْكُمْ مِنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ وَجِهَادٍ فِي سَبِيلِهِ فَتَرَبَّصُوا حَتَّى يَأْتِيَ اللَّهُ بِأَمْرِهِ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ
‘বলো তোমাদের নিকট যদি তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তানাদি, তোমাদের ভাই, তোমাদের পরিবার-পরিজন, তোমাদের বংশ-গোত্র, তোমাদের অর্জিত ধন-সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য যা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় কর, (তা যদি) আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তাঁর রাহে জিহাদ করা থেকে অধিক প্রিয় হয়, তবে অপেক্ষা কর, আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত আর আল্লাহ ফাসেক সম্প্রদায়কে হেদায়েত করবেন না। (সূরা তাওবাহ: ২৪)
অন্য আয়াতে এরশাদ হয়েছে:
النَّبِيُّ أَوْلَى بِالْمُؤْمِنِينَ مِنْ أَنْفُسِهِمْ وَأَزْوَاجُهُ أُمَّهَاتُهُمْ
‘নবী মুমিনদের কাছে তাদের নিজেদের চেয়েও অধিক ঘনিষ্ঠ। (সূরা আল আহযাব: ৬)
হাদিস শরীফে হযরত আনাস (রাযি থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসূল বলেছেন, তোমাদের মধ্যে কেউ পূর্ণ মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার কাছে তার পিতা, তার সন্তান এবং অন্যান্য সকল মানুষ থেকে প্রিয়তম হব।’ (বুখারী ও মুসলিম)
মানুষ একে অপরকে ভালোবাসে হৃদয়ে ও বিশ্বাসে। যার প্রতিচ্ছবি দেখা যায় তার আচার-আচরণ ও কাজ-কর্মে ও সংস্কৃতিতে তাঁর প্রতিচ্ছবিই প্রস্ফুটিত হতে হবে। রাসূলের কল্পনা করলে অন্তর যেন খুশি হয়, তাঁর আলোচনা যেন আত্মার জন্যে খাদ্য হয়, জবান স্বাদ ও আনন্দ হাসিল করে এবং তাঁর মোবারক নাম দ্বারা অন্তর যেন প্রশান্তি লাভ করে।
এখানে জানা আবশ্যক যে, রাসূলের জন্যে কেন সৃষ্টিজগতের সর্বাধিক ভালোবাসা হওয়া উচিৎ। এ প্রসঙ্গে হাদিস বিশেষজ্ঞ আল্লামা ইসহাক (রহ.) ‘দরসে মিশকাত’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, কারো প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি হওয়ার কারণ হলো চারটি।
১. সৌন্দর্য ২. পরিপূর্ণতা ৩. এহসান বা অনুগ্রহ ৪. আত্মীয়তা।
সৌন্দর্যের কারণে ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। সৌন্দর্য়ের উপর কোনো কোনো জীবজন্তুও আশিক হয়ে যায়। যথা- চাদের সৌন্দর্য়ের উপর কোনো কোনো পাখি আশিক। প্রদীপের আলোর উপর কোনো কোনো প্রতঙ্গ এমনভাবে আশিক হয় যে, প্রাণও এ জন্যে বিসর্জন দিয়ে দেয়। এমনিভাবে কারো উপর অন্য কারো দয়া-অনুগ্রহ থাকলেও তার জন্যে ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। মানুষ তো আছেই; এমনকি জীবজন্তুও এহসানের বিনিময়ে ভালোবাসতে আরম্ভ করে এবং অনুগ্রহকারীর পোষ্য বনে যায়। যথা-কুকুর বিড়াল ইত্যাদি। আর যদি কারো মধ্যে সৌন্দর্য় না থাকে তবে এহসান বা অনুগ্রহও পাওয়া যায় না। যোগ্যতার ক্ষেত্রে পূর্ণতা বিদ্যমান। যেমন- বড় কোনো দার্শনিক, কবি-সাহিত্যিকের প্রতি ভালোবাসা হয়ে যায়; ওই ব্যক্তি সুশ্রী না হলেও। আর আত্মীয়তার কারণে ভালোবাসা সৃষ্টি হওয়া তো অত্যন্ত পরিস্কার।
উল্লিখিত কারণসমূহের যে কোনো একটি থাকলেই *যখন ভালোবাসা *সৃষ্টি হয়; তাহলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মধ্যে উক্ত চারটি কারণ ও গুণ পরিপূর্ণ রূপে বিদ্যমান থাকার পরও তার প্রতি ভালোবাসা হবে না তো আর কার প্রতি হবে?
সৌন্দর্য: রাসূল এর দেহের গড়ন ছিল মাধ্যম প্রকৃতির, সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পরিমিত ও সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাঁর চেহারায় ছিলো মমতার আবরণ, কথা-বার্তায় ছিলো বদান্যতা, সবকিছু মিলিয়ে তিনি ছিলেন সর্বাপেক্ষা সৌন্দর্যের অধিকারী এবং আল্লাহর সর্বাধিক প্রিয়। যেহেতু আল্লাহ তা’লা তাকেই সর্বাপেক্ষা প্রিয় বানিয়েছেন, সুতরাং তাকে সর্বাপেক্ষা সুন্দরও বানাবেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সৌন্দর্যের মুগ্ধ হয়ে হাসসান বিন সাবেত রায়ি. একটি শ্লোক রচনা করেছেন। আরবি শ্লোকের অনুবাদ হচ্ছে, “আমার চোখ কখনও তোমার চেয়ে অধিক সুন্দর কাউকে দেখেনি এবং তোমার থেকে সুন্দর কোনো মানুষকে কোনো নারী প্রসব করেনি।”
এ প্রসঙ্গে হযরত আয়শা সিদ্দীকা রাযি. বলেন- একটি সূর্য রয়েছে আমার জন্যে, আর অন্য একটি সূর্য রয়েছে সমগ্র জগতবাসীর জন্যে। কিন্তু আমার সূর্য আকাশের সূর্য হতে উত্তম। কারণ জগতের সূর্যটি ফজরের পর উদয় হয়, আর আমার সূর্যটি রাত্রে এশার পর উদিত হয়।
পরিপূর্ণতা: এই পূর্ণতা মানবীয় চরিত্রের, মানবিক গুণাবলির। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন আপন মহিমায় মানবীয় গুণাবলির পূর্ণতার সুউঁচ্চ শিখরে সমাসীন। তা ইলম ও আমলের দিক থেকে হোক, কিংবা চারিত্রিক ব্যাপারে হোক, আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে হোক। স্বয়ং আল্লাহ তা’লা কোরআনে এরশাদ করেছেন, ‘আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী।’ অন্যসব নবী রাসূলগণকে যে সকল পরিপূর্ণতা দান করা হয়েছিল, সবই একত্রে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দান করা হয়েছিল।
এহসান বা অনুগ্রহ: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দয়া, অনুগ্রহ এবং নম্রতা এত বেশি যে, পবিত্র কোরআনে ঘোষিত হয়েছে, ‘আমি আপনাকে সমগ্র জগতবাসীর জন্যে রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছি।’
রাসূল সমস্ত বনী আদমকে চিরস্থায়ী জাহান্নাম থেকে বাঁচানোর জন্যে প্রচেষ্টা করেছেন এবং অনেককে বাঁচিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আল কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা জাহান্নামের গর্তের কিনারায় গিয়ে পৌঁছে ছিলে; কিন্তু রাসূল তোমাদেরকে তাতে পড়া হতে রক্ষা করেছেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আগমনপূর্ব যুগকে ‘আইয়ামে জাহেলিয়্যাত’ বা অজ্ঞতা ও অন্ধকারের যুগ বলা হয়। দিনের আকাশের সূর্য, রাতের আকাশে চাঁদ-তারকারাজি থাকা সত্ত্বেও সেই যুগকে অন্ধকারের যুগ বলা হয় কেন? তখন কাব্য-সাহিত্যে, সংগীতে আরবরা দুনিয়ার মধ্যে শ্রেষ্ঠ থাকা সত্ত্বেও সেই যুগকে অজ্ঞতার যুগ বলা হয় কেন? আসল কথা হচ্ছে, এই অন্ধকার ও অজ্ঞতা ছিলো মানব চরিত্রের চরম অধঃপতনের। এই অজ্ঞতা ও অন্ধকারের মধ্য দিয়ে তারা জাহান্নামের কিনারায় গিয়ে পৌছে ছিল। আল্লাহ তায়ালা এই অজ্ঞতা ও অন্ধকারের যুগে রাসূল সা কে প্রেরণ করে মানবজাতির প্রতি দয়া ও অনুগ্রহ করেছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পৃথিবীতে ঐশ্বরিক সৌন্দর্য বিতরণ করলেন, তাদের মধ্যে আলো ছড়ালেন। হানাহানি, রক্তপাতের পরিবর্তে মুসলমানরা ভাই ভাই শিক্ষা নিলেন। প্রেম-মমতা ত্যাগ, পরোপকার, প্রভৃতির মাধ্যমে মায়া-মমতার একটি বেহেশতী সমাজ প্রতিষ্ঠা করলেন। তাঁর এই শিক্ষা ও চরিত্রের সৌন্দর্যের জোয়ার ছড়িয়ে পড়ল দুনিয়াজুড়ে। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা পেলাম ইসলামী শিক্ষা ও ইসলামী জীবন দর্শনের সন্ধান। আমাদের সৌভাগ্য যে, আমরা হলাম শ্রেষ্ঠ নবীর উম্মাত।
আত্মীয়তা: সামন্য গভীর দৃষ্টিতে চিন্তা করলে দেখা যাবে যে, রাসূল এর সাথে মুমিনের আত্মীয়তার সম্পর্ক অন্যদের চেয়ে বেশি। কেননা অন্যদের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক জিসমানী বা শারীরিক আর রাসূলের সাথে রুহানি বা আত্মীক। আত্মাহীন দেহ মূল্যহীন। রাসূল হলেন আমাদের মূল্যবান আত্মার পরম আত্মীয়। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘মুমিনদের সাথে রাসূলের সম্পর্ক তাদের সত্ত্বার চেয়েও বেশি এবং রাসূল হলেন তাদের পিতৃতুল্য।’
আবু দাউদ শরীফে হযরত আবু হুরায়রা রাযি. কর্তৃক বর্ণিত হাদীসে রাসূল বলেছেন, ‘আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের পিতার সমতুল্য।
কুরআন হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী, সব রকমের লোক যথা-বড়-ছোট এবং সম-সময়িকদের ভালোবাসার চেয়ে অধিক ভালোবাসা রাসূলের জন্যে হওয়াটা পূর্ণাঙ্গ ইমানের দাবি। সাহাবাগণ রাসূল কে জান প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন। তাকে যথাযথ সম্মান করতেন। সর্বদা তার অনুসরণ-অনুকরণে ব্রতী থাকতেন। তাঁর আদেশ-নিষেধ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন। রাসূলের আদর্শকে সমুন্নত রাখাই ছিলো তাদের জীবনের সাধনা। রাসূলের জন্যে তাদের ভালোবাসা নিজেদের ছেলে-মেয়ে, পিতা-মাতা, আত্মীয় স্বজনদের চেয়েও অধিক ছিলো। ওহুদের যুদ্ধে হযরত আবু তালহা রাযি. এমনভাবে নিজেকে উপস্থাপন করলেন যে, নিজের সমস্ত দেহ আহত হয়ে গেল কিন্তু রাসূলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ওপর একটা তীরও পতিত হতে দিলেন না।
উপরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ভালোবাসার কিছু যৌক্তিক দিক উল্লেক করা হয়েছে। মোটকথা হচ্ছে, একজন মহামানবের প্রতি ভালোবাসার উদ্দীপক সব কারণই প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মধ্যে ছিল। যে সব কারণে মানুষ সাধারণত অপর একজন মানুষের প্রতি মুগ্ধ হয় এর সবকিছুই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জীবন চরিত্রে বিদ্যমান ছিল। আর আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয় হাবীবকে সর্ববিষয়ের পূর্ণতা দিয়ে এ জন্যেই সৃষ্টি করেছেন যে, কারণ আমরা জানি একজন আদর্শবান ব্যক্তির অনসরণ ও অনুকরণের মূল চালিকা শক্তিই হলো সে ব্যক্তির প্রতি হৃদয়ের গভীরে লালন করা ভালোবাসার নির্যাস। যে নির্যাসের শক্তি জীবন দিয়ে হলেও সেই প্রিয়তম ব্যক্তিকে ভালোবাসতে প্রেরণা দেয়। যে নির্যাস শক্তিই জীবনের প্রতিটি রক্তবৃন্দুর বিনিময়ে হলেও সেই প্রিয়তম ব্যক্তির মান-মর্যাদা, ইজ্জত-সম্মানকে অক্ষুন্ন রাখতে একজন মানুষকে প্রযোজনে সুবিশাল শক্তি-সামন্তের অধিকারীর মুকাবিলায় অবতির্ণ হওয়ার সাহস যোগায়। আর এসবই হলো এশক-মহব্বৎ বা নবীপ্রেমের বাহ্যিক নিদর্শন। কিন্তু কেন জানি আমাদের রাসূলপ্রেম বাস্তবতার বিচারে ষৌল আনায় ষৌল আনাই মিথ্যে। আমরা তো নবীপ্রেমের দাবি করি কিন্তু আমাদের জীবনে আজ রাসূল সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাহসমূহ উপেক্ষিত।
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তো দ্বীনের জন্যে শত সহস্র কষ্ট-ক্ল্যশ, জুলুম-নির্যাতন সহ্য করেছেন কিন্তু আমরা আজ তাঁর রেখে যাওয়া দ্বীন ও ইসলামের দুর্দিনে শুধু আত্ম ভুলাবস্থায় জীবন যাপন করছি। কেমন যেন আমাদের কোনো আদর্শ নেই। আমাদের কোনো আদর্শিক নেতা নেই। আমাদের কোনো সঠিক ও যুগপৎ কর্মসূচী নেই। আমাদের আবস্থাটা কেমন যেন সেই মেশ পালের মতনই খেয়ে-দেয়ে কোনো রকম বেঁচে থাকলেই চলে। অতচ দুনিয়ার জন্যে আমাদের যে পরিমান গরজ এর কিদয়াংশও যদি আজ দ্বীনের জন্যে হতো, তবে হয়তো বহুকাল আগেই ইমান, ইসলাম ও মুমিনদের সুদিন ফিরে আসতো। আল্লাহর রাসূলের রেখে যাওয়া দ্বীন ও শরীয়ত নিজ ভাবধারায় চলতে পারতো। কিন্তু কেমন জানি আজ সবকিছুই উলট-পালট এদিক ওদিক হয়ে গিয়েছে। রাসূলপ্রেমিক সত্যিকার মুমিন ও মুজাহিদীনদেরকে- যারা দ্বীনের দুরাবস্থায় নিজেদের সর্বশক্তি ব্যয় করে দ্বীনে মুহাম্মদীকে আপন ভাবধারায় চালাতে নিজেদের অক্লান্ত চেষ্টা সাধনা ব্যয় করছেন। শুধু দ্বীনের জন্যেই যে সকল মুজাহিদ ভাইয়েরা আজ নিজেদের সহায় সম্বল, বিবি-বাচ্চা, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশি সবকিছু হারিয়ে ফেলছেন, তথাপিও মুমিন ও মুসলিম দাবিদ্বার আমাদের বিরাট একটি অংশ আজ তাদেরকে ইসলাম হতে বিচ্ছিন্ন একটি অংশ বলে খুব জোরেসুরেই ডামাঢোল পেটাচ্ছেন। এ কাজটি যে শুধু ইসলামের শত্রুরাই করছেন তা তো নয় বরং রাসূলপ্রেমের দাবিদ্বারদেরও বিরাট একটি অংশ উক্ত ঘৃনিত কাজটি করে যাচ্ছেন। অতচ এসব নবীপ্রেমিকদের নবীপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ কেবল নিজেদের পরিমলে খুব পাকসাফ পোশাক-পরিচ্চদ পরিধান করা, বিশেষ জাতীয় টুপি পড়া, দফদবে সাধা জুতো পড়ার প্রতিই গুরুত্ব প্রদান। এই হলো তাদের সার্বক্ষণিক জিহাদের প্রশিক্ষণসমূহ।
আমাদের দেওবন্দি সালাফগণ যে লক্ষ্যে দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আমরা আজ তা একেবারেই ভুলে গিয়েছি। প্রতিষ্ঠা লগ্নের পর থেকে দারুল উলুম দেওবন্দ যে লক্ষ্য পানে কামিয়াবীর সাথে বীরদর্পে এগিয়েছিল সে মানহাজ ও প্রক্রিয়া আজ আমরা পুরোপুরিই ছেড়ে দিয়েছি। দেওবন্দ নামক পাত্র থেকে আমরা মূল্যবান সেই মুতিটি বাহিরে নিক্ষেপ করে, কংকর ও নুড়িপাথর জাতীয় কিছু দ্বীনি কর্মসূচী দিয়ে তা ভরে ফেলেছি। এককালে যে কাফেলার প্রধান ও প্রাথমিক মিশন ছিলো মানবতার কল্যাণে মানবতার চিরশত্রু বৃটিশ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে জিহাদ পরিচালনা করা, কিন্তু বাস্তব দৃশ্যপটে আজ যা পরিলক্ষিত তা সম্পূর্ণই এর বিপরীত। সেই দেওবন্দি কাফেলা আজ তাদের জীবনদর্শন থেকে জিহাদের অবশিষ্ট রঙটুক পর্যন্ত মুছে ফেলতে একেক করে সব প্রস্তুতি বাস্তবায়ন করছে। এককালে যে দারুল উলূমের সিংহ শাবকেরা জিহাদী স্পৃহায় দেওবন্দ বস্তিতে লাঠি প্রশিক্ষণে মত্ত থাকতো আজ সে দারুল উলুমের সন্তানেরাই দারুল উলুম চত্ত্বরে জিহাদ বিরোধী স্লোগান দিয়ে পুরো দেওবন্দ বস্তির আকাশ-বাতাশ ভারি করে তুলে। আজ তাদেরই একটি বড় জনস্রোত তাজকিয়ার নামে দ্বীনের বিকৃতি সাধন করে যাচ্ছেন। বিশেষত জিহাদের বিকৃতি সাধন করছেন। তাদের অপর একটি ধারা গনতন্ত্র নামক কুফুরি মতবাদের সাথে মিলেজিলে রাজনীতি করছেন আর মুসলিম মিল্লাতের সামনে প্রতিষ্ঠীত ইমান ও কুফুরের সীমানা প্রাচীরকে একেবারেই ধুলিস্সাৎ করে দিচ্ছেন। আর এ শ্রেণীটাও জিহাদের অপব্যাখ্যা করছেন।
দেওবন্দি গড়ানারই বড় মাপের একজন মুরুব্বী হযরত মাও. ইলিয়াছ রহ: এর প্রতিষ্ঠিত তাবলীগ জামাতও আজ দেদার্সে জিহাদের অপব্যাখ্যা করে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু আমরা যদি আজ দেওবন্দি কাফেলার গুরুজনদের দিকে একটু থাকিয়ে দেখি তাহলে পরিস্কার দেখতে পাবো যে, দেওবন্দিরা কেমন উঁচু মানের মুজাহিদ ছিলেন। আমরা জানি মাও. হোসাইন আহমাদ মাদানী, হাজ্বী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী, মাও. কাসেম নানুতুবী রহ: ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদ পরিচালনা করেছেন। সারাটা জীবনই তারা ইংরেজদের বিরুদ্ধে সরব জিহাদ চালিয়ে গিয়েছেন। আজকের তথাকথিক দেওবন্দিরা কিভাবে এ ইতিহাসকে মুছে ফেলবে।
সত্যই আজ কাকে আর কি বলবো? স্বার্থপরায়নতা আমবর্ষার এমন এক বিদঘুটে কালো অন্ধকার যে, এক সময় তা ব্যক্তির হৃদয়ে-মমনে শুধু অন্ধকার আর অন্ধকারই বিস্তার করে। আর তখন ব্যক্তির কাছে নিজ জাতিসত্ত্বার পরিচয়টা পর্যন্ত ঢাকা পড়ে যায়। হোক সে স্বার্থ ব্যক্তিস্বার্থ বা প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থই। আর স্বার্থপরায়নতার এ কুশ্রীত চেহারা শুধু বর্তমানেরই নয় বরং এর অতিত চিত্র এমনই ছিল। কারণ শুধু ব্যক্তিস্বার্থের জন্যেই তো বিশ্ব ওলীকুল শিরমণি বালয়াম বায়ূরার জীবনে অন্ধকার নেমে এসেছিল। তাই না? (আল্লাহ আমাদের সকলকে দ্বীনি স্বার্থের বিপরীত সব ধরনের ব্যক্তিস্বার্থকে কুরবানি করার তাওফিক দান করুন) আমীন!!
Comment