শায়খ আবু উমার আসসাইফ রহ. এর ‘আসসিয়াসাতুশ শরঈয়্যাহ্’ কিতাবে কথাটা দেখেছিলাম। তখনই মনে করেছিলাম, একটা পোস্ট দিয়ে দিই। অনেকের উপকারে আসবে। কিন্তু কিভাবে জানি ভুলে গেলাম। আজ অনেক দিন পর আবার মনে পড়লো। মনে করলাম, আজ আর না লিখে থামছি না। নয়তো আবার ভুলে যাব।
শায়খ রহ. ইসলামী রাষ্ট্রের রূপরেখা আলোচনা করছিলেন। তখন কথাটা বলেছিলেন। শায়খের কথাটার ভিত্তি সূরা ফাতিরে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের এ বাণীর উপর-
ثُمَّ أَوْرَثْنَا الْكِتَابَ الَّذِينَ اصْطَفَيْنَا مِنْ عِبَادِنَا فَمِنْهُمْ ظَالِمٌ لِنَفْسِهِ وَمِنْهُمْ مُقْتَصِدٌ وَمِنْهُمْ سَابِقٌ بِالْخَيْرَاتِ بِإِذْنِ اللَّهِ ذَلِكَ هُوَ الْفَضْلُ الْكَبِيرُ
“অতঃপর আমি (এই) কিতাবের ওয়ারিস (উত্তরাধিকারী) বানিয়েছি তাদের, যাদের আমি আমার বান্দাদের মধ্য থেকে মনোনীত করেছি। তাদের মধ্যে কেউ কেউ নিজের প্রতি জুলুমকারী। কেউ কেউ মধ্যপন্থী। আর কেউ কেউ আল্লাহর হুকুম (ও তাওফিকে) নেক কাজে অগ্রগ্রামী। এটি-ই হচ্ছে বিরাট মর্যাদা।”- ফাতির ৩১
আগে পরের আরো দু’টি আয়াতসহ হলে বুঝতে সহজ হবে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
৩১ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা জানিয়েছেন যে, তিনি তার আখিরী নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর যে কিতাব (কুরআন) নাযিল করেছেন, তা হক ও সত্য।
৩২ নং আয়াতে জানিয়েছেন, তিনি তার নির্বাচিত নবীর উপর যে নির্বাচিত কিতাব নাযিল করেছেন, সে কিতাবের উত্তরাধিকারী বানিয়েছেন নির্বাচিত এই আখিরী উম্মাহকে।
৩৩ নং আয়াতে জানিয়েছেন, আখিরী নবীর উপর অবতীর্ণ আখিরী কিতাব যে আখিরী উম্মাহকে দেয়া হয়েছে, তারা জান্নাতবাসী হবে।
এ আয়াতগুলো এ উম্মাহর জন্য বড়ই খুশির সুসংবাদ বহন করছে। আল্লাহ তাআলা জানিয়ে দিয়েছেন, এ আখেরী উম্মাহ আল্লাহ তাআলার স্বয়ং নিজের পছন্দকৃত ও বাছাইকৃত উম্মাহ। তিনি তাদেরকে সর্বশ্রেষ্ট কিতাবের উত্তরাধিকারীরূপে নির্বাচন করেছেন। সর্বশ্রেষ্ঠ শরীয়ত তাদের জীবনবিধানরূপে পছন্দ করেছেন। সর্বশ্রেষ্ঠ নবীর উম্মত হিসেবে তাদের বাছাই করেছেন। শেষে সুসংবাদ দিয়ে দিয়েছেন, এ নির্বাচিত উম্মাহ হবে জান্নাতী । তারা আগেকার উম্মতসমূহের মতো নয়। তারা ইয়াহুদ নাসারার মতো নয়, যারা আল্লাহর কিতাব বিকৃত করেছে। আল্লাহর দ্বীন পরিবর্তন করেছে। নিজেদের বানানো কথাকে আল্লাহর বাণী বলে চালিয়ে দিয়েছে। এ উম্মাহ আল্লাহর কিতাবের যথাযথ হেফাজত করবে। আগেকার উম্মতগুলোর মতো আল্লাহর কিতাবকে বিকৃত করবে না। পরিবর্তন করবে না। পরিবর্ধন করবে না। নিজেদের মনগড়া কথাকে আল্লাহর বাণী বলে চালিয়ে দেবে না। আর এ কারণেই আল্লাহ তাআলা এ উম্মাহকে জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন।
প্রিয় ভাই! আয়াতগুলোর দিকে আবার তাকান। দেখুন আপনার রব কি বলছেন, ‘আমি (এই) কিতাবের ওয়ারিস (উত্তরাধিকারী) বানিয়েছি তাদের, যাদের আমি আমার বান্দাদের মধ্য থেকে মনোনীত করেছি।’
দেখুন আপনার রব কি বলছেন-
ক. সকল জাতি-গোষ্ঠীর মধ্য হতে, সকল উম্মতের মধ্য হতে আপনার রব আপনাকে নির্বাচন করেছেন। পছন্দ করেছেন। ইচ্ছা করলে তিনি আপনাকে অন্য কোন উম্মতের মধ্যে পাঠাতে পারতেন। আপনাকে দ্বীন বিকৃতকারী ইয়াহুদ নাসারা বানাতে পারতেন। কিন্তু না! তিনি আপনাকে নির্বাচন করেছেন।
খ. দ্বিতীয়ত আপনাকে তার সর্বশ্রেষ্ঠ কিতাবের উত্তরাধিকারী বানিয়েছেন। এ কিতাব দিয়ে আপনাকে সম্মানিত করেছেন। এ কিতাব সংরক্ষণ ও প্রচার প্রসারের, এক হাতে তরবারি আরেক হাতে কিতাব নিয়ে এ কুরআনের দাওয়াত পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে ছড়িয়ে দেয়ার জন্যে আপনাকে নির্বাচন করেছেন।
আপনি ভাবছেন, আমি তো জালেম। আমি তো গুনাহগার। আমি কি এর উপযুক্ত? আমি কি পারবো এ মহাসম্মানিত কিতাবের কোন খিদমাত করতে? এমনই কি ভাবছেন? তাহলে দেখুন আপনার রব কি বলছেন,
‘তাদের মধ্যে কেউ কেউ নিজের প্রতি জুলুমকারী। কেউ কেউ মধ্যপন্থী। আর কেউ কেউ আল্লাহর হুকুম (ও তাওফিকে) নেক কাজে অগ্রগ্রামী।’
যাদেরকে আল্লাহ তাআলা তার এ কিতাবের সংরক্ষণের জন্য, এ কিতাবের দাওয়াত ও প্রচার-প্রসারের জন্য নির্বাচন করেছেন, তাদেরকে তিনি তিন ভাগে ভাগ করেছেন-
১. নিজের প্রতি জুলুমকারী। গুনাহগার। মুফাসসিরিনে কেরাম বলেন, উদ্দেশ্য- যাদের নেক কাজের তুলনায় গুনাহের পরিমাণ বেশি।
২. যারা মধ্যপন্থী। যাদের গুনাহ আর নেক কাজের পরিমাণ সমান। কিংবা যারা গুনাহ করেছে আবার তাওবা করে নিয়েছে।
৩. যারা আল্লাহ তাআলার বিশিষ্ট বান্দা। যারা আল্লাহ তাআলার সকল নিষেধ বর্জন করে চলে। সকল আদেশ পালন করে। আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্য সব ধরণের নেক কাজে অগ্রগামী থাকে।
প্রিয় ভাই! দেখুন- এরা সবাই আল্লাহর কিতাবের সংরক্ষক। এ মহা দায়িত্ব তাদের সকলের। এ মহা সম্মান তাদের সবার। হতে পারে সে ব্যক্তিগতভাবে গুনাহগার। নিজের উপর জুলুমকারী। কিন্তু সেও আল্লাহর কিতাবের সংরক্ষক। হতে পারে সে মদখোর। কিন্তু তার হাতেও তরবারি। যে তরবারি দিয়ে আল্লাহ তাআলা তার নবীকে পাঠিয়েছেন। দ্বীনের নুসরতের জন্য। কিতাবের সংরক্ষণের জন্য। সে তরবারি তার হাতে। সে তরবারি দিয়ে সে কিতাবের দুশমনদের গর্দানে আঘাত করে। দ্বিখণ্ডিত করে। দ্বীন মানতে অস্বীকারকারীদের জাহান্নামে পাঠায়।
এ জন্য মুসলিম উম্মাহর সর্বসম্মত আকীদা- জালেম হোক, ফাসেক হোক; কাফের মুরতাদের বিরুদ্ধে সকলে এক। এক দেহের ন্যায়। সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায়। কেউ বাদ যাবে না। সকলের হাতে থাকবে তরবারি। সকলকে নিয়েই হবে লড়াই। কাফেরদের বিরুদ্ধে। দ্বীনের দুশমনদের বিরুদ্ধে। কিতাব অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে। কিতাব অবমাননাকারীদের বিরুদ্ধে। হতে পারে সে জালেম। হতে পারে গনিমত লোভী। হতে পারে পদলোভী। কিন্তু তার অন্তরে আল্লাহর প্রেম। কিতাবের ভালবাসা। দ্বীনের মহব্বত। চোখে স্বপ্ন। দ্বীনের পতাকা উড্ডীনের স্বপ্ন। বিশ্বময়। সারা বিশ্বময়।
প্রিয় ভাই! আপনি গুনাহগার? হতাশ হবেন না। আপনি আল্লাহর মনোনীত বান্দা। এ দ্বীনের জন্য। এ কিতাবের জন্য। আপনার জন্য রয়েছে জান্নাতের ওয়াদা। আপনার রবের পক্ষ থেকে। দেখুন আপনার রবের বাণী-
‘তাদের জন্য আছে অনন্তকাল বসবাসের জান্নাতসমূহ। যাতে তারা প্রবেশ করবে। সেখানে তাদের পরানো হবে সোনার বালা ও মুক্তা। সেখানে তাদের পোশাক হবে রেশমের।’
আপনার রবের এ ওয়াদা এ উম্মাহর সকলের জন্য। শুধু বিশিষ্টদের জন্য নয়। শুধু নেককারদের জন্য নয়। জালেমদের জন্যও। গুনাহগারদের জন্যও। কিতাবের সংরক্ষক সকলের জন্য।
ইমাম বাকের রহ. বলেন,
প্রিয় ভাই! আপনি গুনাহ করেছেন- তথাপি আপনি আল্লাহর নির্বাচিত। কিতাবের জন্য। দ্বীনের জন্য। শরীয়তের জন্য। আপনি নিজেকে দমাতে পারেন না, নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন না, প্রবৃত্তির তাড়না থেকে বাঁচতে পারেন না- তথাপি আপনি আল্লাহর নির্বাচিত। কিতাবের জন্য। দ্বীনের জন্য। শরীয়তের জন্য। আপনি কাফেরের আতঙ্ক। নাস্তিকের যম। দ্বীনদ্রোহিদের ঘুম হারামকারী। শান্তি বিনষ্টকারী। আপনার রব আপনাকে এ কাজের জন্যই নির্বাচন করেছেন।
প্রিয় ভাই! মুফাসসিরিনে কেরাম বলেন, আল্লাহ তাআলা গুনাহগারদের কথা আগে বলেছেন- ‘তাদের মধ্যে কেউ কেউ নিজের প্রতি জুলুমকারী। কেউ কেউ ...।’ কেন? তাদের কথাটা আগে বললেন কেন? মুফাসসিরিনে কেরাম বলেন, আল্লাহ তাআলা গুনাহগারদের আগে উল্লেখ করেছেন- যেন তারা হতাশ না হয়। নিরাশ না হয়। যেন মনে না করে যে, এ মহান কিতাবের সুমহান দায়িত্বের আমি উপযুক্ত নই। এ জন্য আল্লাহ তাআলা তাদের আগে উল্লেখ করেছেন। নেককার ও বিশিষ্টজনদের পরে উল্লেখ করেছেন। তাদের মর্যাদা বেশি হতে পারে; কিন্তু আল্লাহর কিতাবের নুসরতে সকলেই সমান অংশীদার। দ্বীনের দুশমনদের বিরুদ্ধে সকলেই সমান। সকলে এক। এক দেহের ন্যায়। যেন সীসাঢালা প্রাচীর।
প্রিয় ভাই! হতাশ হবেন না। ফিরে আসুন। আপনার মর্যাদার আসনে ফিরে আসুন। আপনি আপনার রবের প্রিয় পাত্র। পছন্দীয়। নির্বাচিত। হতাশ হবেন না।
আপনার রবের দুশমনরা আপনাকে বুঝিয়েছে, এ কিতাবের সাথে আপনার সম্পর্ক নেই। আপনাকে দুনিয়া নিয়ে পড়ে থাকতে শিখিয়েছে। ভোগ-বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দিতে শিখিয়েছে। এ ক্ষণস্থায়ী দুনিয়াটাকেই আপনার জিন্দেগীর সর্বস্ব দেখিয়েছে। তারা আপনাকে ভুলিয়ে দিয়েছে যে, আপনারও একজন রব আছেন। তিনি আপনাকে ভালবাসেন। আপনার জন্য তিনি অফুরন্ত নেয়ামত রেখেছেন। যা কোন চক্ষু কোন দিন দেখেনি। কোন কান কোন দিন শোনেনি। কোন অন্তর কোন দিন কল্পনাও করতে পারেনি। ভুলিয়ে দিয়েছে, আপনি আপনার রবের পছন্দের পাত্র। নির্বাচিত সৈনিক। তার অবাধ্যদের বুকে বিদ্ধ তীর আর ধারালো খঞ্জর। ঝাঁঝরাকারী বুলেট। গলার কাঁটা। পথের কণ্টক। ঘুম হারামকারী। প্রাণসংহারি।
ওহে ভাই! ফিরে আসুন। সব হতাশা ঝেড়ে ফেলুন। আপনার রবের দরবারে হাত তুলুন- ওহে পরওয়ারদেগার! আমি বুঝতে পারিনি। তুমি যে আমাকে ভালবাস। এত ভালবাস। আমি জানতে পারিনি। আমি যে তোমার দ্বীনের সৈনিক, তোমার কিতাবের রক্ষক, তোমার নির্বাচিত, তোমার মনোনীত- আমি জানতে পারিনি। ওহে আমার রব! আমাকে মাফ কর। আমাকে কবূল কর। তোমার দ্বীনের জন্য। তোমার কালামের জন্য। তোমার মহান কিতাবের জন্য। তোমার শরীয়তের জন্য।
শায়খ রহ. ইসলামী রাষ্ট্রের রূপরেখা আলোচনা করছিলেন। তখন কথাটা বলেছিলেন। শায়খের কথাটার ভিত্তি সূরা ফাতিরে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের এ বাণীর উপর-
ثُمَّ أَوْرَثْنَا الْكِتَابَ الَّذِينَ اصْطَفَيْنَا مِنْ عِبَادِنَا فَمِنْهُمْ ظَالِمٌ لِنَفْسِهِ وَمِنْهُمْ مُقْتَصِدٌ وَمِنْهُمْ سَابِقٌ بِالْخَيْرَاتِ بِإِذْنِ اللَّهِ ذَلِكَ هُوَ الْفَضْلُ الْكَبِيرُ
“অতঃপর আমি (এই) কিতাবের ওয়ারিস (উত্তরাধিকারী) বানিয়েছি তাদের, যাদের আমি আমার বান্দাদের মধ্য থেকে মনোনীত করেছি। তাদের মধ্যে কেউ কেউ নিজের প্রতি জুলুমকারী। কেউ কেউ মধ্যপন্থী। আর কেউ কেউ আল্লাহর হুকুম (ও তাওফিকে) নেক কাজে অগ্রগ্রামী। এটি-ই হচ্ছে বিরাট মর্যাদা।”- ফাতির ৩১
আগে পরের আরো দু’টি আয়াতসহ হলে বুঝতে সহজ হবে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ مِنَ الْكِتَابِ هُوَ الْحَقُّ مُصَدِّقًا لِمَا بَيْنَ يَدَيْهِ إِنَّ اللَّهَ بِعِبَادِهِ لَخَبِيرٌ بَصِيرٌ (31) ثُمَّ أَوْرَثْنَا الْكِتَابَ الَّذِينَ اصْطَفَيْنَا مِنْ عِبَادِنَا فَمِنْهُمْ ظَالِمٌ لِنَفْسِهِ وَمِنْهُمْ مُقْتَصِدٌ وَمِنْهُمْ سَابِقٌ بِالْخَيْرَاتِ بِإِذْنِ اللَّهِ ذَلِكَ هُوَ الْفَضْلُ الْكَبِيرُ (32) جَنَّاتُ عَدْنٍ يَدْخُلُونَهَا يُحَلَّوْنَ فِيهَا مِنْ أَسَاوِرَ مِنْ ذَهَبٍ وَلُؤْلُؤًا وَلِبَاسُهُمْ فِيهَا حَرِيرٌ (33)
“(৩১). আমি আপনার নিকট অহি মারফত যে কিতাব পাঠিয়েছি, তা-ই সত্য। যা তার পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের সত্যায়নকারী। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদের সম্বন্ধে সম্যক অবহিত, (তাদের সব কিছুর) দ্রষ্টা।
(৩২). অতঃপর আমি (এই) কিতাবের ওয়ারিস (উত্তরাধিকারী) বানিয়েছি তাদের, যাদের আমি আমার বান্দাদের মধ্য থেকে মনোনীত করেছি। তাদের মধ্যে কেউ কেউ নিজের প্রতি জুলুমকারী। কেউ কেউ মধ্যপন্থী। আর কেউ কেউ আল্লাহর হুকুম (ও তাওফিকে) নেক কাজে অগ্রগ্রামী। এটি-ই হচ্ছে বিরাট মর্যাদা।
(৩৩). তাদের জন্য আছে অনন্তকাল বসবাসের জান্নাতসমূহ। যাতে তারা প্রবেশ করবে। সেখানে তাদের পরানো হবে সোনার বালা ও মুক্তা। সেখানে তাদের পোশাক হবে রেশমের।”- ফাতির ৩১-৩৩
“(৩১). আমি আপনার নিকট অহি মারফত যে কিতাব পাঠিয়েছি, তা-ই সত্য। যা তার পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের সত্যায়নকারী। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদের সম্বন্ধে সম্যক অবহিত, (তাদের সব কিছুর) দ্রষ্টা।
(৩২). অতঃপর আমি (এই) কিতাবের ওয়ারিস (উত্তরাধিকারী) বানিয়েছি তাদের, যাদের আমি আমার বান্দাদের মধ্য থেকে মনোনীত করেছি। তাদের মধ্যে কেউ কেউ নিজের প্রতি জুলুমকারী। কেউ কেউ মধ্যপন্থী। আর কেউ কেউ আল্লাহর হুকুম (ও তাওফিকে) নেক কাজে অগ্রগ্রামী। এটি-ই হচ্ছে বিরাট মর্যাদা।
(৩৩). তাদের জন্য আছে অনন্তকাল বসবাসের জান্নাতসমূহ। যাতে তারা প্রবেশ করবে। সেখানে তাদের পরানো হবে সোনার বালা ও মুক্তা। সেখানে তাদের পোশাক হবে রেশমের।”- ফাতির ৩১-৩৩
৩১ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা জানিয়েছেন যে, তিনি তার আখিরী নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর যে কিতাব (কুরআন) নাযিল করেছেন, তা হক ও সত্য।
৩২ নং আয়াতে জানিয়েছেন, তিনি তার নির্বাচিত নবীর উপর যে নির্বাচিত কিতাব নাযিল করেছেন, সে কিতাবের উত্তরাধিকারী বানিয়েছেন নির্বাচিত এই আখিরী উম্মাহকে।
৩৩ নং আয়াতে জানিয়েছেন, আখিরী নবীর উপর অবতীর্ণ আখিরী কিতাব যে আখিরী উম্মাহকে দেয়া হয়েছে, তারা জান্নাতবাসী হবে।
এ আয়াতগুলো এ উম্মাহর জন্য বড়ই খুশির সুসংবাদ বহন করছে। আল্লাহ তাআলা জানিয়ে দিয়েছেন, এ আখেরী উম্মাহ আল্লাহ তাআলার স্বয়ং নিজের পছন্দকৃত ও বাছাইকৃত উম্মাহ। তিনি তাদেরকে সর্বশ্রেষ্ট কিতাবের উত্তরাধিকারীরূপে নির্বাচন করেছেন। সর্বশ্রেষ্ঠ শরীয়ত তাদের জীবনবিধানরূপে পছন্দ করেছেন। সর্বশ্রেষ্ঠ নবীর উম্মত হিসেবে তাদের বাছাই করেছেন। শেষে সুসংবাদ দিয়ে দিয়েছেন, এ নির্বাচিত উম্মাহ হবে জান্নাতী । তারা আগেকার উম্মতসমূহের মতো নয়। তারা ইয়াহুদ নাসারার মতো নয়, যারা আল্লাহর কিতাব বিকৃত করেছে। আল্লাহর দ্বীন পরিবর্তন করেছে। নিজেদের বানানো কথাকে আল্লাহর বাণী বলে চালিয়ে দিয়েছে। এ উম্মাহ আল্লাহর কিতাবের যথাযথ হেফাজত করবে। আগেকার উম্মতগুলোর মতো আল্লাহর কিতাবকে বিকৃত করবে না। পরিবর্তন করবে না। পরিবর্ধন করবে না। নিজেদের মনগড়া কথাকে আল্লাহর বাণী বলে চালিয়ে দেবে না। আর এ কারণেই আল্লাহ তাআলা এ উম্মাহকে জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন।
প্রিয় ভাই! আয়াতগুলোর দিকে আবার তাকান। দেখুন আপনার রব কি বলছেন, ‘আমি (এই) কিতাবের ওয়ারিস (উত্তরাধিকারী) বানিয়েছি তাদের, যাদের আমি আমার বান্দাদের মধ্য থেকে মনোনীত করেছি।’
দেখুন আপনার রব কি বলছেন-
ক. সকল জাতি-গোষ্ঠীর মধ্য হতে, সকল উম্মতের মধ্য হতে আপনার রব আপনাকে নির্বাচন করেছেন। পছন্দ করেছেন। ইচ্ছা করলে তিনি আপনাকে অন্য কোন উম্মতের মধ্যে পাঠাতে পারতেন। আপনাকে দ্বীন বিকৃতকারী ইয়াহুদ নাসারা বানাতে পারতেন। কিন্তু না! তিনি আপনাকে নির্বাচন করেছেন।
খ. দ্বিতীয়ত আপনাকে তার সর্বশ্রেষ্ঠ কিতাবের উত্তরাধিকারী বানিয়েছেন। এ কিতাব দিয়ে আপনাকে সম্মানিত করেছেন। এ কিতাব সংরক্ষণ ও প্রচার প্রসারের, এক হাতে তরবারি আরেক হাতে কিতাব নিয়ে এ কুরআনের দাওয়াত পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে ছড়িয়ে দেয়ার জন্যে আপনাকে নির্বাচন করেছেন।
আপনি ভাবছেন, আমি তো জালেম। আমি তো গুনাহগার। আমি কি এর উপযুক্ত? আমি কি পারবো এ মহাসম্মানিত কিতাবের কোন খিদমাত করতে? এমনই কি ভাবছেন? তাহলে দেখুন আপনার রব কি বলছেন,
‘তাদের মধ্যে কেউ কেউ নিজের প্রতি জুলুমকারী। কেউ কেউ মধ্যপন্থী। আর কেউ কেউ আল্লাহর হুকুম (ও তাওফিকে) নেক কাজে অগ্রগ্রামী।’
যাদেরকে আল্লাহ তাআলা তার এ কিতাবের সংরক্ষণের জন্য, এ কিতাবের দাওয়াত ও প্রচার-প্রসারের জন্য নির্বাচন করেছেন, তাদেরকে তিনি তিন ভাগে ভাগ করেছেন-
১. নিজের প্রতি জুলুমকারী। গুনাহগার। মুফাসসিরিনে কেরাম বলেন, উদ্দেশ্য- যাদের নেক কাজের তুলনায় গুনাহের পরিমাণ বেশি।
২. যারা মধ্যপন্থী। যাদের গুনাহ আর নেক কাজের পরিমাণ সমান। কিংবা যারা গুনাহ করেছে আবার তাওবা করে নিয়েছে।
৩. যারা আল্লাহ তাআলার বিশিষ্ট বান্দা। যারা আল্লাহ তাআলার সকল নিষেধ বর্জন করে চলে। সকল আদেশ পালন করে। আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্য সব ধরণের নেক কাজে অগ্রগামী থাকে।
প্রিয় ভাই! দেখুন- এরা সবাই আল্লাহর কিতাবের সংরক্ষক। এ মহা দায়িত্ব তাদের সকলের। এ মহা সম্মান তাদের সবার। হতে পারে সে ব্যক্তিগতভাবে গুনাহগার। নিজের উপর জুলুমকারী। কিন্তু সেও আল্লাহর কিতাবের সংরক্ষক। হতে পারে সে মদখোর। কিন্তু তার হাতেও তরবারি। যে তরবারি দিয়ে আল্লাহ তাআলা তার নবীকে পাঠিয়েছেন। দ্বীনের নুসরতের জন্য। কিতাবের সংরক্ষণের জন্য। সে তরবারি তার হাতে। সে তরবারি দিয়ে সে কিতাবের দুশমনদের গর্দানে আঘাত করে। দ্বিখণ্ডিত করে। দ্বীন মানতে অস্বীকারকারীদের জাহান্নামে পাঠায়।
এ জন্য মুসলিম উম্মাহর সর্বসম্মত আকীদা- জালেম হোক, ফাসেক হোক; কাফের মুরতাদের বিরুদ্ধে সকলে এক। এক দেহের ন্যায়। সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায়। কেউ বাদ যাবে না। সকলের হাতে থাকবে তরবারি। সকলকে নিয়েই হবে লড়াই। কাফেরদের বিরুদ্ধে। দ্বীনের দুশমনদের বিরুদ্ধে। কিতাব অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে। কিতাব অবমাননাকারীদের বিরুদ্ধে। হতে পারে সে জালেম। হতে পারে গনিমত লোভী। হতে পারে পদলোভী। কিন্তু তার অন্তরে আল্লাহর প্রেম। কিতাবের ভালবাসা। দ্বীনের মহব্বত। চোখে স্বপ্ন। দ্বীনের পতাকা উড্ডীনের স্বপ্ন। বিশ্বময়। সারা বিশ্বময়।
প্রিয় ভাই! আপনি গুনাহগার? হতাশ হবেন না। আপনি আল্লাহর মনোনীত বান্দা। এ দ্বীনের জন্য। এ কিতাবের জন্য। আপনার জন্য রয়েছে জান্নাতের ওয়াদা। আপনার রবের পক্ষ থেকে। দেখুন আপনার রবের বাণী-
‘তাদের জন্য আছে অনন্তকাল বসবাসের জান্নাতসমূহ। যাতে তারা প্রবেশ করবে। সেখানে তাদের পরানো হবে সোনার বালা ও মুক্তা। সেখানে তাদের পোশাক হবে রেশমের।’
আপনার রবের এ ওয়াদা এ উম্মাহর সকলের জন্য। শুধু বিশিষ্টদের জন্য নয়। শুধু নেককারদের জন্য নয়। জালেমদের জন্যও। গুনাহগারদের জন্যও। কিতাবের সংরক্ষক সকলের জন্য।
ইমাম বাকের রহ. বলেন,
وأن الظلم لا يؤثر في الاصطفاء. اهـ
“(নিজের উপর) জুলুম (তথা গুনাহ) আল্লাহর পছন্দনীয় ও নির্বাচিত হওয়ার পরিপন্থী নয়।”- তাফসীরে বাগাবী ৩/৬৯৬প্রিয় ভাই! আপনি গুনাহ করেছেন- তথাপি আপনি আল্লাহর নির্বাচিত। কিতাবের জন্য। দ্বীনের জন্য। শরীয়তের জন্য। আপনি নিজেকে দমাতে পারেন না, নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন না, প্রবৃত্তির তাড়না থেকে বাঁচতে পারেন না- তথাপি আপনি আল্লাহর নির্বাচিত। কিতাবের জন্য। দ্বীনের জন্য। শরীয়তের জন্য। আপনি কাফেরের আতঙ্ক। নাস্তিকের যম। দ্বীনদ্রোহিদের ঘুম হারামকারী। শান্তি বিনষ্টকারী। আপনার রব আপনাকে এ কাজের জন্যই নির্বাচন করেছেন।
প্রিয় ভাই! মুফাসসিরিনে কেরাম বলেন, আল্লাহ তাআলা গুনাহগারদের কথা আগে বলেছেন- ‘তাদের মধ্যে কেউ কেউ নিজের প্রতি জুলুমকারী। কেউ কেউ ...।’ কেন? তাদের কথাটা আগে বললেন কেন? মুফাসসিরিনে কেরাম বলেন, আল্লাহ তাআলা গুনাহগারদের আগে উল্লেখ করেছেন- যেন তারা হতাশ না হয়। নিরাশ না হয়। যেন মনে না করে যে, এ মহান কিতাবের সুমহান দায়িত্বের আমি উপযুক্ত নই। এ জন্য আল্লাহ তাআলা তাদের আগে উল্লেখ করেছেন। নেককার ও বিশিষ্টজনদের পরে উল্লেখ করেছেন। তাদের মর্যাদা বেশি হতে পারে; কিন্তু আল্লাহর কিতাবের নুসরতে সকলেই সমান অংশীদার। দ্বীনের দুশমনদের বিরুদ্ধে সকলেই সমান। সকলে এক। এক দেহের ন্যায়। যেন সীসাঢালা প্রাচীর।
প্রিয় ভাই! হতাশ হবেন না। ফিরে আসুন। আপনার মর্যাদার আসনে ফিরে আসুন। আপনি আপনার রবের প্রিয় পাত্র। পছন্দীয়। নির্বাচিত। হতাশ হবেন না।
আপনার রবের দুশমনরা আপনাকে বুঝিয়েছে, এ কিতাবের সাথে আপনার সম্পর্ক নেই। আপনাকে দুনিয়া নিয়ে পড়ে থাকতে শিখিয়েছে। ভোগ-বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দিতে শিখিয়েছে। এ ক্ষণস্থায়ী দুনিয়াটাকেই আপনার জিন্দেগীর সর্বস্ব দেখিয়েছে। তারা আপনাকে ভুলিয়ে দিয়েছে যে, আপনারও একজন রব আছেন। তিনি আপনাকে ভালবাসেন। আপনার জন্য তিনি অফুরন্ত নেয়ামত রেখেছেন। যা কোন চক্ষু কোন দিন দেখেনি। কোন কান কোন দিন শোনেনি। কোন অন্তর কোন দিন কল্পনাও করতে পারেনি। ভুলিয়ে দিয়েছে, আপনি আপনার রবের পছন্দের পাত্র। নির্বাচিত সৈনিক। তার অবাধ্যদের বুকে বিদ্ধ তীর আর ধারালো খঞ্জর। ঝাঁঝরাকারী বুলেট। গলার কাঁটা। পথের কণ্টক। ঘুম হারামকারী। প্রাণসংহারি।
ওহে ভাই! ফিরে আসুন। সব হতাশা ঝেড়ে ফেলুন। আপনার রবের দরবারে হাত তুলুন- ওহে পরওয়ারদেগার! আমি বুঝতে পারিনি। তুমি যে আমাকে ভালবাস। এত ভালবাস। আমি জানতে পারিনি। আমি যে তোমার দ্বীনের সৈনিক, তোমার কিতাবের রক্ষক, তোমার নির্বাচিত, তোমার মনোনীত- আমি জানতে পারিনি। ওহে আমার রব! আমাকে মাফ কর। আমাকে কবূল কর। তোমার দ্বীনের জন্য। তোমার কালামের জন্য। তোমার মহান কিতাবের জন্য। তোমার শরীয়তের জন্য।
{قُلْ يَا عِبَادِيَ الَّذِينَ أَسْرَفُوا عَلَى أَنْفُسِهِمْ لا تَقْنَطُوا مِنْ رَحْمَةِ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ جَمِيعًا إِنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ}
“(হে রাসূল!) আপনি বলে দিন, ‘হে আমার বান্দাগণ! যারা নিজেদের প্রতি অবিচার করেছো, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সমুদয় গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন। তিনি তো অতি ক্ষমাশীল। পরম দয়ালু।”- যুমার ৫৩
{قُلْ يَا عِبَادِيَ الَّذِينَ أَسْرَفُوا عَلَى أَنْفُسِهِمْ لا تَقْنَطُوا مِنْ رَحْمَةِ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ جَمِيعًا إِنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ}
“(হে রাসূল!) আপনি বলে দিন, ‘হে আমার বান্দাগণ! যারা নিজেদের প্রতি অবিচার করেছো, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সমুদয় গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন। তিনি তো অতি ক্ষমাশীল। পরম দয়ালু।”- যুমার ৫৩
Comment