সূরা আল ইমরানে, ১৪৪ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ বলছেন,
কুরআনে হাতেগোণা অল্প কিছু আয়াত আছে, যে আয়াতের শব্দগুলো কোন সাহাবার মুখে প্রথমে উচ্চারিত হয়েছিল এবং পরে আল্লাহ কুরআনে ওহী হিসেবে সেগুলোকে নাযিল করেন। এই আয়াতটি তেমনই একটি আয়াত। এটি হল সেই দিনের কথা, যেদিন মুস’আব বিন ‘উমায়েরকে উহুদের দিনে মুশরিকরা চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছিল, তিনি দেখছিলেন রাসূল (সাঃ) কে ও মুশরিকরা ঘিরে ফেলেছে। রাসূল (সাঃ) কে এমন একটি বিপদাপন্ন পরিস্থিতিতে দেখে তিনি নিজেকে নিজে তখন বলে উঠেছিলেন,
"আর মুহাম্মদ একজন রসূল বৈ কিছু নন! তাঁর পূর্বেও বহু রসূল অতিবাহিত হয়ে গেছেন"
এই কথাগুলোই পরবর্তীতে সূরা আল ইমরানের আয়াত হিসেবে নাযিল হয়। মুস’আবকে সেদিন মুশরিকরা হত্যা করেছিল, কিন্তু গুজব ছড়িয়ে পড়ে মুস’আব নয়, রাসূলুল্লাহ ﷺ কে মুশরিকরা হত্যা করেছে। এই ভুয়া তথ্যটি যখন সাহাবাদের কাছে পৌঁছল তখন তারা তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ল। তাদের মধ্যে একটি দল এতটাই বিষাদগ্রস্ত পেল এবং মনোবলহীন হয়ে পড়ল যে তারা পুরোপুরি হাল ছেড়ে দিল, কেউ কেউ পালিয়ে মুনাফিক্বদের দলে যোগ দিল।
আর কেউ ছিল অনড়, তারা বলল, "যদি আল্লাহর নবী মারা গিয়ে থাকেন, তবে যে উদ্দেশ্যে তিনি যুদ্ধ করে গেছেন, সে উদ্দেশ্য সাধনে আমরাও লড়াই করে যাব"। তারা শেষ পর্যন্ত দৃঢ়পদ ছিলেন, যেমনটা তারা এ মৃত্যুর সংবাদ শোনার আগেও ছিলেন। মুশরিক কর্তৃক অবরুদ্ধ অবস্থায় মুসা’আবের মুখ নিঃসৃত এ কথাগুলো সেই লড়াইয়ের মাধ্যমে পূর্ণতা লাভ করে এবং আল্লাহ কুরআনে এ কথাটি উল্লেখ করার মাধ্যমে মুস’আবের এ কথাটির প্রতি সমর্থন জানান যা ইসলামের সঠিক দা’ওয়াহর অনুসারীদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।
কোন কিছু বিশ্বাস করা বা কিছু অনুসরণ করার পেছনে একজন মানুষ বিভিন্ন কারণে উদ্বুদ্ধ হতে পারে, যেমন মুসলিমদের ক্ষেত্রে যদি আমরা চিন্তা করি আমরা দেখবঃ
- কিছু মানুষ আছে এমন, যারা সংখ্যাগরিষ্ঠের দলে থাকতে পছন্দ করে, তারা স্রোতে গা ভাসায় এবং আর দশজনের মত করে চলতে চায়, তারা এমন একটা মানহাজ বা পদ্ধতির অনুসরণ করে যা তার বন্ধু এবং পরিচিতরা মেনে চলছে।
- কেউ কেউ নিজেদের আক্বীদা-বিশ্বাস এবং মানহাজ নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে থাকে, একটি ব্যর্থ হলে আরেকটি যাচাই করে, তাদের "এ-সপ্তাহের-সেরা-আকর্ষণ" খুঁজতে ব্যস্ত!
- কেউ কেউ আছে যারা আবেগচালিত, যেমন একটা লেকচার বা প্রেসেন্টেশন দেখে তাদের আবেগ তুঙ্গে উঠে যায় আবার পরে নেমে যায়।
- কেউ কেউ আছে যারা একটি বিশেষ মানহাজ বা পদ্ধতি অনুসরণ করে কোন বিশেষ ব্যাক্তিত্বের প্রতি তার ভাল-লাগার অনুভূতি থেকে।
শেষোক্ত কারণটিই ব্যাখ্যা করে কেন রাসূল ﷺ এর মৃত্যুর নিছক গুজব শুনেই একদল সাহাবী আশাহত হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। এই আয়াতটি মানবীয় এই দূর্বলতার প্রতি ইঙ্গিত করে এবং আমাদেরকে শিক্ষা দেয় যে, যদি আমরা আমাদের হৃদয়কে ইসলামের যে মূল মেসেজ বা আদর্শ, তার প্রতি অনুরক্ত বা আকৃষ্ট না হয়ে যদি আমরা কোন বিশেষ ব্যাক্তি বা দলের প্রতি আসক্ত হই, তবে তুচ্ছ চাপের মুখেই আমরা হার মানব এবং পশ্চাদপসরণ করে বসব। যদিও আমরা আল্লাহর রাসূল ﷺ কে একজন নবী হিসেবে অবশ্যই ভালবাসি কেননা তিনি আমাদের কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহীর মাধ্যমে ইসলামের বাণী ও পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছেন, তা সত্ত্বেও ইসলামের যে শিক্ষাবস্তু তার প্রতি আমাদের ভালবাসা না থাকলে আমরা টিকে থাকতে পারব না।
ইসলামের প্রতি আমাদের ভালবাসা ব্যাক্তিকেন্দ্রিক হওয়া চলবে না, আর সে কারণেই, উহুদের দিনে বেশ কিছু সাহাবী ছিলেন যারা রাসূল (সাঃ) এর মৃত্যুর গুজব শুনে পিছপা হননি, বরং বলে উঠেছিলেন, "যদি তিনি মারা যান, তবে যে উদ্দেশ্যে তিনি লড়েছেন, আমরাও সে উদ্দেশ্যে লড়ে যাব", সহজ ভাষায় বললে, "তিনি মারা গেছেন তো কি হয়েছে? তিনি আমাদেরকে যা শিখিয়েছন আমরা সেটা অনুসরণ করেছি, ব্যাক্তি হিসেবে তাকে আমরা অনুসরণ করি নি, বরং অনুসরণ করেছি একজন নবী হিসেবে। তিনি একজন নবী, এর বেশি কিছু তিনি নন।" আর এ কারণেই, সাত বছর পরে যখন রাসূল ﷺ সত্যিই মারা যান, সেদিন আবু বকর ﷺ উঠে দাঁড়িয়ে সকলকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন,
"তোমাদের মধ্যে যারা মুহাম্মদের ইবাদাত করত, (জেনে রাখ) মুহাম্মদ মারা গেছে, আর তোমরা যারা আল্লাহর ইবাদাত কর, (জেনে রাখ), আল্লাহ চিরঞ্জীব এবং তার কোন মৃত্যু নেই"। এরপর তিনি এই আয়াতটি আবৃত্তি করেন। তিনি এ কথাগুলো বলেছিলেন এই বিষয়ের উপর গুরুত্ব দিতে যে, আমরা ইসলামের সত্য আদর্শের কারণে মুসলিম, কোন বিশেষ ব্যাক্তিত্বের প্রতি অনুরাগ বা মোহ থেকে নয়।
পশ্চিমা সমাজে ব্যাক্তিপূজা অত্যন্ত প্রবল, হোক তা মিউজিক স্টার, মুভি স্টার বা আর যেকোন ধরণের খ্যাতিমান লোক। ভাল করে লক্ষ করলে দেখা যাবে, এই অভ্যাসটি ইসলামী দা’ওয়াহ প্রতিষ্ঠানগুলোকেও পর্যন্ত আক্রান্ত করেছে, যেসব প্রতিষ্ঠানে "সুপারস্টার শেখ বা স্কলার" এর একটি কালচারের জন্ম হয়েছে, যা জাহেলী সমাজের "সেলিব্রেটি-পূজা"র বিকল্পরূপে আবির্ভূত হয়ে ব্যাক্তিপূজার যে ধারা তাকে ইসলামী ছদ্মবেশে বজায় রেখেছে। এই ধরণের ধারার বিপদ দ্বিমাত্রিক,
এক, এ ধরণের শাইখ বা ‘আলিমের উচ্চারিত যেকোন কথাকে চূড়ান্ত এবং বিতর্কের উর্ধ্বে হিসেবে ধরা হয় যাকে কোনভাবেই চ্যালেঞ্জ করা যাবে না, যদিও ইসলামের সত্য উদঘাটন ও প্রচারের অধিকার কোন বিশেষ দলভুক্ত আলিম বা কোর্স ইন্সট্রাক্টরদের একচেটিয়া সম্পত্তি নয়!
এবং দুই, কোন শাইখ বা নেতার প্রতি যদি তাদের অনুসারীদের গভীর ভক্তি এবং অযাচিত আসক্তি থাকে, তাহলে আরো যে সমস্যাটি হতে পারে তা হল, যদি তারা তাদের অবস্থান থেকে সরে আসে, কিংবা গ্রেপ্তার হয় কিংবা তাদের মৃত্যু ঘটে, তখন তাদের অনুসারী পথের দিশা হারিয়ে ফেলে এবং পিছু হটতে আরম্ভ করে, ঠিক যেমনটা হয়েছিল কিছু সাহাবীর ক্ষেত্রে, তারা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর মৃত্যুর খবর শুনে পশ্চাদপসরণ করেছিলেন উহুদের ময়দান থেকে।
সমস্যার সমাধান হল একটি মুক্ত, সমালোচক, বিশ্লেষনধর্মী এবং অনুসন্ধিৎসু মনের অধিকারী হওয়া, যা আপনার আর সত্যের মাঝে কোন বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে না, সে সত্য যেখান থেকেই আসুক না কেন। আপনার এ ধরণের ইতিবাচক মন আপনাকে সত্য গ্রহণে সাহায্য করবে কেবল তা সত্য বলেই, কে সেই সত্য বলছে তা আপনার কাছে আর মুখ্য হয়ে দাঁড়াবে না। যেমন করে আল-ইমাম আহমাদ বলছিলেন, "একজন মানুষের জ্ঞানের ঘাটতি থাকে তখনই, যখন সে অন্য কাউকে অন্ধ ভাবে বিশ্বাস করে"। এবং সম্ভবত এ কারণেই, ইমাম আহমদ তার "মুসনাদ" থেকে হাদীসের ক্লাস নেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতেন এবং তার মতগুলোকে লিখে রাখতে খুব জোরালোভাবে নিরুৎসাহিত করতেন। তিনি চাইতেন তার ছাত্রদের সাথে তার ব্যাক্তিত্ব এবং তার মতামতের প্রতি যেন ভক্তি না হয়, বরং তা যেন হয় কুরআন এবং সুন্নাহর সাথে।
এটা খুবই দুঃখজনক, প্রাথমিক পর্যায়ে অনেক মুসলিম যারা বেশ উৎসাহী এবং উদ্যমী থাকে, তারা এই আয়াতের মূলভাব হৃদয়ঙ্গম করতে ব্যর্থ হয়, পরবর্তীতে যা হয়, তা হল তারা একের পর এক মানহাজের মাঝে গড়াগড়িতে পতিত হয়। আজকে তারা সালাফি, কালকে সুফী বা আশ’আরি, আরেকটা দিন হয়তো আসবে যেদিন তারা পুরো দ্বীনকেই পরিত্যাগ করে ফেলবে। এর সবকিছুর পেছনে ফিরে তাকালে যে সমস্যাটি আমরা আবিষ্কার করব তা হল, তারা ইসলামের দা’ওয়াহর পথে তারা প্রবেশ করেছে অত্যন্ত ভাসাভাসা এবং ক্ষণিকের প্রণোদনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে। প্রবল দ্রুততার সাথে বারবার নিজেদের রঙ বদলাবার পেছনে যে কারণ তা হল তারা সত্যকে সঠিক কারণের ভিত্তিতে গ্রহণ না করে অন্য ভিত্তি বা পথে গ্রহণ করেছে, যেমন ব্যাক্তিবিশেষের প্রতি অপরিমিত শ্রদ্ধাবোধ কিংবা অন্য কোন কারণে, কিন্তু যে ব্যাপারটি তাদের ঘাটতি ছিল তা হল ইসলামী শিক্ষার বিষয়বস্তুর উপর দৃঢ় বিশ্বাস এবং গভীর উপলব্ধি না থাকা।
কাজেই, আপনাকে সাবধান হতে হবে যেন কোন ব্যাক্তিবিশেষের প্রতি আপনার অতিভক্তি এবং অপরিমিতি শ্রদ্ধাবোধ না থাকে। মানুষ বদলায়, এবং তারা মারা যায়। তাই, আপনাকে অধ্যয়ন করতে হবে, ভালবাসতে হবে, এবং ইসলামী দা’ওয়াহর মূল যে মেসেজ, একমাত্র সেটাই আপনাকে আন্তরিকভাবে উদ্বুদ্ধ করবে এবং প্রেরণা যোগাবে, এবং সাথে অবশ্যই এই দা’ওয়াহর মূল উৎসের প্রতিই আপনাকে আন্তরিক হতে হবে, কেননা, মানুষের মৃত্যু ঘটে, আদর্শের কোন পরিবর্তন বা মৃত্যু নেই।
طارقمهنا
তারিক্ব মেহান্না
প্লাইমাউথ কারেকশনাল ফ্যাসিলিটি
আইসোলেশন ইউনিট - সেল #১০৮
“আর মুহাম্মদ একজন রসূল বৈ কিছু নন! তাঁর পূর্বেও বহু রসূল অতিবাহিত হয়ে গেছেন। অতএব তিনি যদি মারা যান অথবা নিহত হন, তবে কি তোমরা পশ্চাদপসরণ করবে? …"
কুরআনে হাতেগোণা অল্প কিছু আয়াত আছে, যে আয়াতের শব্দগুলো কোন সাহাবার মুখে প্রথমে উচ্চারিত হয়েছিল এবং পরে আল্লাহ কুরআনে ওহী হিসেবে সেগুলোকে নাযিল করেন। এই আয়াতটি তেমনই একটি আয়াত। এটি হল সেই দিনের কথা, যেদিন মুস’আব বিন ‘উমায়েরকে উহুদের দিনে মুশরিকরা চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছিল, তিনি দেখছিলেন রাসূল (সাঃ) কে ও মুশরিকরা ঘিরে ফেলেছে। রাসূল (সাঃ) কে এমন একটি বিপদাপন্ন পরিস্থিতিতে দেখে তিনি নিজেকে নিজে তখন বলে উঠেছিলেন,
"আর মুহাম্মদ একজন রসূল বৈ কিছু নন! তাঁর পূর্বেও বহু রসূল অতিবাহিত হয়ে গেছেন"
এই কথাগুলোই পরবর্তীতে সূরা আল ইমরানের আয়াত হিসেবে নাযিল হয়। মুস’আবকে সেদিন মুশরিকরা হত্যা করেছিল, কিন্তু গুজব ছড়িয়ে পড়ে মুস’আব নয়, রাসূলুল্লাহ ﷺ কে মুশরিকরা হত্যা করেছে। এই ভুয়া তথ্যটি যখন সাহাবাদের কাছে পৌঁছল তখন তারা তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ল। তাদের মধ্যে একটি দল এতটাই বিষাদগ্রস্ত পেল এবং মনোবলহীন হয়ে পড়ল যে তারা পুরোপুরি হাল ছেড়ে দিল, কেউ কেউ পালিয়ে মুনাফিক্বদের দলে যোগ দিল।
আর কেউ ছিল অনড়, তারা বলল, "যদি আল্লাহর নবী মারা গিয়ে থাকেন, তবে যে উদ্দেশ্যে তিনি যুদ্ধ করে গেছেন, সে উদ্দেশ্য সাধনে আমরাও লড়াই করে যাব"। তারা শেষ পর্যন্ত দৃঢ়পদ ছিলেন, যেমনটা তারা এ মৃত্যুর সংবাদ শোনার আগেও ছিলেন। মুশরিক কর্তৃক অবরুদ্ধ অবস্থায় মুসা’আবের মুখ নিঃসৃত এ কথাগুলো সেই লড়াইয়ের মাধ্যমে পূর্ণতা লাভ করে এবং আল্লাহ কুরআনে এ কথাটি উল্লেখ করার মাধ্যমে মুস’আবের এ কথাটির প্রতি সমর্থন জানান যা ইসলামের সঠিক দা’ওয়াহর অনুসারীদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।
কোন কিছু বিশ্বাস করা বা কিছু অনুসরণ করার পেছনে একজন মানুষ বিভিন্ন কারণে উদ্বুদ্ধ হতে পারে, যেমন মুসলিমদের ক্ষেত্রে যদি আমরা চিন্তা করি আমরা দেখবঃ
- কিছু মানুষ আছে এমন, যারা সংখ্যাগরিষ্ঠের দলে থাকতে পছন্দ করে, তারা স্রোতে গা ভাসায় এবং আর দশজনের মত করে চলতে চায়, তারা এমন একটা মানহাজ বা পদ্ধতির অনুসরণ করে যা তার বন্ধু এবং পরিচিতরা মেনে চলছে।
- কেউ কেউ নিজেদের আক্বীদা-বিশ্বাস এবং মানহাজ নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে থাকে, একটি ব্যর্থ হলে আরেকটি যাচাই করে, তাদের "এ-সপ্তাহের-সেরা-আকর্ষণ" খুঁজতে ব্যস্ত!
- কেউ কেউ আছে যারা আবেগচালিত, যেমন একটা লেকচার বা প্রেসেন্টেশন দেখে তাদের আবেগ তুঙ্গে উঠে যায় আবার পরে নেমে যায়।
- কেউ কেউ আছে যারা একটি বিশেষ মানহাজ বা পদ্ধতি অনুসরণ করে কোন বিশেষ ব্যাক্তিত্বের প্রতি তার ভাল-লাগার অনুভূতি থেকে।
শেষোক্ত কারণটিই ব্যাখ্যা করে কেন রাসূল ﷺ এর মৃত্যুর নিছক গুজব শুনেই একদল সাহাবী আশাহত হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। এই আয়াতটি মানবীয় এই দূর্বলতার প্রতি ইঙ্গিত করে এবং আমাদেরকে শিক্ষা দেয় যে, যদি আমরা আমাদের হৃদয়কে ইসলামের যে মূল মেসেজ বা আদর্শ, তার প্রতি অনুরক্ত বা আকৃষ্ট না হয়ে যদি আমরা কোন বিশেষ ব্যাক্তি বা দলের প্রতি আসক্ত হই, তবে তুচ্ছ চাপের মুখেই আমরা হার মানব এবং পশ্চাদপসরণ করে বসব। যদিও আমরা আল্লাহর রাসূল ﷺ কে একজন নবী হিসেবে অবশ্যই ভালবাসি কেননা তিনি আমাদের কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহীর মাধ্যমে ইসলামের বাণী ও পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছেন, তা সত্ত্বেও ইসলামের যে শিক্ষাবস্তু তার প্রতি আমাদের ভালবাসা না থাকলে আমরা টিকে থাকতে পারব না।
ইসলামের প্রতি আমাদের ভালবাসা ব্যাক্তিকেন্দ্রিক হওয়া চলবে না, আর সে কারণেই, উহুদের দিনে বেশ কিছু সাহাবী ছিলেন যারা রাসূল (সাঃ) এর মৃত্যুর গুজব শুনে পিছপা হননি, বরং বলে উঠেছিলেন, "যদি তিনি মারা যান, তবে যে উদ্দেশ্যে তিনি লড়েছেন, আমরাও সে উদ্দেশ্যে লড়ে যাব", সহজ ভাষায় বললে, "তিনি মারা গেছেন তো কি হয়েছে? তিনি আমাদেরকে যা শিখিয়েছন আমরা সেটা অনুসরণ করেছি, ব্যাক্তি হিসেবে তাকে আমরা অনুসরণ করি নি, বরং অনুসরণ করেছি একজন নবী হিসেবে। তিনি একজন নবী, এর বেশি কিছু তিনি নন।" আর এ কারণেই, সাত বছর পরে যখন রাসূল ﷺ সত্যিই মারা যান, সেদিন আবু বকর ﷺ উঠে দাঁড়িয়ে সকলকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন,
"তোমাদের মধ্যে যারা মুহাম্মদের ইবাদাত করত, (জেনে রাখ) মুহাম্মদ মারা গেছে, আর তোমরা যারা আল্লাহর ইবাদাত কর, (জেনে রাখ), আল্লাহ চিরঞ্জীব এবং তার কোন মৃত্যু নেই"। এরপর তিনি এই আয়াতটি আবৃত্তি করেন। তিনি এ কথাগুলো বলেছিলেন এই বিষয়ের উপর গুরুত্ব দিতে যে, আমরা ইসলামের সত্য আদর্শের কারণে মুসলিম, কোন বিশেষ ব্যাক্তিত্বের প্রতি অনুরাগ বা মোহ থেকে নয়।
পশ্চিমা সমাজে ব্যাক্তিপূজা অত্যন্ত প্রবল, হোক তা মিউজিক স্টার, মুভি স্টার বা আর যেকোন ধরণের খ্যাতিমান লোক। ভাল করে লক্ষ করলে দেখা যাবে, এই অভ্যাসটি ইসলামী দা’ওয়াহ প্রতিষ্ঠানগুলোকেও পর্যন্ত আক্রান্ত করেছে, যেসব প্রতিষ্ঠানে "সুপারস্টার শেখ বা স্কলার" এর একটি কালচারের জন্ম হয়েছে, যা জাহেলী সমাজের "সেলিব্রেটি-পূজা"র বিকল্পরূপে আবির্ভূত হয়ে ব্যাক্তিপূজার যে ধারা তাকে ইসলামী ছদ্মবেশে বজায় রেখেছে। এই ধরণের ধারার বিপদ দ্বিমাত্রিক,
এক, এ ধরণের শাইখ বা ‘আলিমের উচ্চারিত যেকোন কথাকে চূড়ান্ত এবং বিতর্কের উর্ধ্বে হিসেবে ধরা হয় যাকে কোনভাবেই চ্যালেঞ্জ করা যাবে না, যদিও ইসলামের সত্য উদঘাটন ও প্রচারের অধিকার কোন বিশেষ দলভুক্ত আলিম বা কোর্স ইন্সট্রাক্টরদের একচেটিয়া সম্পত্তি নয়!
এবং দুই, কোন শাইখ বা নেতার প্রতি যদি তাদের অনুসারীদের গভীর ভক্তি এবং অযাচিত আসক্তি থাকে, তাহলে আরো যে সমস্যাটি হতে পারে তা হল, যদি তারা তাদের অবস্থান থেকে সরে আসে, কিংবা গ্রেপ্তার হয় কিংবা তাদের মৃত্যু ঘটে, তখন তাদের অনুসারী পথের দিশা হারিয়ে ফেলে এবং পিছু হটতে আরম্ভ করে, ঠিক যেমনটা হয়েছিল কিছু সাহাবীর ক্ষেত্রে, তারা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর মৃত্যুর খবর শুনে পশ্চাদপসরণ করেছিলেন উহুদের ময়দান থেকে।
সমস্যার সমাধান হল একটি মুক্ত, সমালোচক, বিশ্লেষনধর্মী এবং অনুসন্ধিৎসু মনের অধিকারী হওয়া, যা আপনার আর সত্যের মাঝে কোন বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে না, সে সত্য যেখান থেকেই আসুক না কেন। আপনার এ ধরণের ইতিবাচক মন আপনাকে সত্য গ্রহণে সাহায্য করবে কেবল তা সত্য বলেই, কে সেই সত্য বলছে তা আপনার কাছে আর মুখ্য হয়ে দাঁড়াবে না। যেমন করে আল-ইমাম আহমাদ বলছিলেন, "একজন মানুষের জ্ঞানের ঘাটতি থাকে তখনই, যখন সে অন্য কাউকে অন্ধ ভাবে বিশ্বাস করে"। এবং সম্ভবত এ কারণেই, ইমাম আহমদ তার "মুসনাদ" থেকে হাদীসের ক্লাস নেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতেন এবং তার মতগুলোকে লিখে রাখতে খুব জোরালোভাবে নিরুৎসাহিত করতেন। তিনি চাইতেন তার ছাত্রদের সাথে তার ব্যাক্তিত্ব এবং তার মতামতের প্রতি যেন ভক্তি না হয়, বরং তা যেন হয় কুরআন এবং সুন্নাহর সাথে।
এটা খুবই দুঃখজনক, প্রাথমিক পর্যায়ে অনেক মুসলিম যারা বেশ উৎসাহী এবং উদ্যমী থাকে, তারা এই আয়াতের মূলভাব হৃদয়ঙ্গম করতে ব্যর্থ হয়, পরবর্তীতে যা হয়, তা হল তারা একের পর এক মানহাজের মাঝে গড়াগড়িতে পতিত হয়। আজকে তারা সালাফি, কালকে সুফী বা আশ’আরি, আরেকটা দিন হয়তো আসবে যেদিন তারা পুরো দ্বীনকেই পরিত্যাগ করে ফেলবে। এর সবকিছুর পেছনে ফিরে তাকালে যে সমস্যাটি আমরা আবিষ্কার করব তা হল, তারা ইসলামের দা’ওয়াহর পথে তারা প্রবেশ করেছে অত্যন্ত ভাসাভাসা এবং ক্ষণিকের প্রণোদনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে। প্রবল দ্রুততার সাথে বারবার নিজেদের রঙ বদলাবার পেছনে যে কারণ তা হল তারা সত্যকে সঠিক কারণের ভিত্তিতে গ্রহণ না করে অন্য ভিত্তি বা পথে গ্রহণ করেছে, যেমন ব্যাক্তিবিশেষের প্রতি অপরিমিত শ্রদ্ধাবোধ কিংবা অন্য কোন কারণে, কিন্তু যে ব্যাপারটি তাদের ঘাটতি ছিল তা হল ইসলামী শিক্ষার বিষয়বস্তুর উপর দৃঢ় বিশ্বাস এবং গভীর উপলব্ধি না থাকা।
কাজেই, আপনাকে সাবধান হতে হবে যেন কোন ব্যাক্তিবিশেষের প্রতি আপনার অতিভক্তি এবং অপরিমিতি শ্রদ্ধাবোধ না থাকে। মানুষ বদলায়, এবং তারা মারা যায়। তাই, আপনাকে অধ্যয়ন করতে হবে, ভালবাসতে হবে, এবং ইসলামী দা’ওয়াহর মূল যে মেসেজ, একমাত্র সেটাই আপনাকে আন্তরিকভাবে উদ্বুদ্ধ করবে এবং প্রেরণা যোগাবে, এবং সাথে অবশ্যই এই দা’ওয়াহর মূল উৎসের প্রতিই আপনাকে আন্তরিক হতে হবে, কেননা, মানুষের মৃত্যু ঘটে, আদর্শের কোন পরিবর্তন বা মৃত্যু নেই।
طارقمهنا
তারিক্ব মেহান্না
প্লাইমাউথ কারেকশনাল ফ্যাসিলিটি
আইসোলেশন ইউনিট - সেল #১০৮
Comment