আল্লাহ তা’আলা কুরআনে সূরা আল-ইমরানের ১৫৬ নং আয়াতে বলছেন,
এবং ১৬৮ নং আয়াতে বলছেন,
উপরের আয়াতগুলোতে মুনাফিকদের ব্যাপারে বলা হয়েছে, যখন তারা উহুদের ময়দানে যুদ্ধ করতে না গিয়ে মুসলিম বাহিনী থেকে বের হয়ে গেলো। তারা যুদ্ধরত মু’মিনদের দেখে মনে মনে ভাবতে থাকলো যে, দ্বীন কায়েমের সংগ্রাম থেকে দূরে ও নিরাপদ আশ্রয়ে থাকার মধ্যেই আছে সকল ‘হিকমাহ’। অপরদিকে মু’মিনদের যারা দ্বীনকে রক্ষা করা ও বিজয়ী করে তোলার জন্য নিজের প্রাণ পর্যন্ত বিলিয়ে দিতে রাজি আছে, তারা যেন আছে ভ্রান্তির পথে! এটাই ছিল মুনাফিকদের চিন্তাভাবনার নমুনা।
সত্যের দিকে মানুষকে ডাকতে গেলে কষ্ট ও বিপর্যয় নেমে আসবেই, এবং এই কষ্ট সহ্য করতে পারাটাই একজন প্রকৃত সত্যান্বেষীর পরিচয়। ইবন আল-কায়্যিম দ্বীনের প্রচারে একজন দা’ঈর প্রচেষ্টার সর্বোচ্চ স্তরের দিকে আলোকপাত করতে গিয়ে বলছেনঃ “(দা’ঈর পক্ষে সর্বোচ্চ ত্যাগ হল) আল্লাহর রাস্তায় দাওয়াত দিতে গিয়ে যাবতীয় বিপর্যয় ও মানুষের দ্বারা সৃষ্ট বাধা-বিপত্তি কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের জন্য সহ্য করে যাওয়া”। এছাড়াও আল্লাহ তাআলা কুরআনের সূরা আল-আসরে আমাদেরকে দ্বীনের প্রচার ও শিক্ষাদানের পথে সব বাধা-বিপত্তিতে ধৈর্যশীল হতে জোর দিয়ে বলেছেনঃ
“সময়ের শপথ! মানুষ ভ্রান্তির মধ্যে আছে; কেবল তারা ব্যতীত যারা ঈমান এনেছে, সৎকাজ করে, সত্যের প্রচারক, আর ধৈর্যধারণে উৎসাহ দান করে।” [সূরা আল-আসর]
অতএব একজন মুসলিম যেচে পড়ে কষ্ট ও বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে না সেটাই স্বাভাবিক, কিন্তু যদি এমন হয় সত্যপ্রচারের পথে বাঁধা-বিপত্তির সম্মুখীন না হয়ে আর কোন উপায় নেই, তবে একজন মু’মিন হাত গুটিয়ে বসে না থেকে স্বেচ্ছায় সে পথেই এগিয়ে যাবে। কেননা আলোচিত আয়াতগুলোর মাধ্যমে এটাই প্রমাণিত হয় যে, দ্বীন প্রচারের জন্য সকল কষ্ট মেনে নেয়ার এই ইচ্ছাই তার ঈমান ও নিফাকের মধ্যে পার্থক্যকারী।
আরাম-আয়েশের দিকে ঝুঁকে পড়া, নিরাপদ জীবন চাওয়া, এগুলো আমাদের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। স্বয়ং আ’ইশা (রা) রাসূলুল্লাহ ﷺ এর ব্যাপারে বলছেন, “তাঁর সামনে যখন দুটো রাস্তা খোলা থাকত, তখন তিনি দুটোর মাঝে সহজটাই বেছে নিতেন, যদি না সেই সহজ পথে আল্লাহর অবাধ্যতা থাকে”। কিন্তু যখন এমন হত, দ্বীন প্রচার করতে গিয়ে কুফ্ফারদের কাছ থেকে কিছু ক্ষতির সম্মুখীন হতেই হবে এবং নিজের আরাম-আয়েশকে বিসর্জন দিতে হবে, তখন কি তিনি আরাম-আয়েশকে প্রাধান্য দিতেন? নিজেকেই জিজ্ঞেস করুন।
তিনি বা আর অন্য কোন নবী কি কখনো নিজেদের নিরাপত্তা ও আরাম-আয়েশের কথা ভেবে সত্য প্রচারে পিছু হটেছিলেন? আজকাল ইসলামের অনেক দা’ঈ সত্য গোপন করার পিছনে একটি খোঁড়া যুক্তি খাঁড়া করান যে, “এটা করলে তাদেরকে অচিরেই শত্রুর হাতে ধ্বংস হতে হবে, বরং এ থেকে বিরত থাকলে আগত দিনগুলোতে তারা দ্বীনের উপকারে আসতে পারবেন।" নবীদের কেউ কি এসব খোঁড়া অজুহাত দিতেন? কক্ষনো না, একবারও না।
বদরের সেই দিনে রাসূলুল্লাহ(সা) এর কথা স্মরণ করে দেখুন, যুদ্ধের পূর্বে তিনি আল্লাহর কাছে কী ফরিয়াদ জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন,
“হে আল্লাহ! মু’মিনদের এই দল যদি ধ্বংসপ্রাপ্ত ও পরাজিত হয়, তোমার ইবাদাত করার জন্য আর কেউই অবশিষ্ট থাকবে না।"
অন্য ভাবে বলা যায়, তিনি জানতেন এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ মানে মু’মিনদের জীবন নয়, খোদ ইসলামের অস্তিত্বকেও হুমকির মুখে ঠেলে দেওয়া, আরাম-আয়েশ পরিত্যাগের বিষয়টি বাদই দিলাম। কিন্তু রাসূলুল্লাহ ﷺ কি কিছু বিপদের আশংকায় সাহাবীদেরকে নিজেদের মালামাল গুটিয়ে মদীনায় ফিরে যাওয়ার কথা একটিবারের জন্যেও মুখে এনেছিলেন? তিনি এমনটি করেননি, বরং নির্ভীকচিত্তে সামনে এগিয়ে গিয়েছিলেন, মুশরিকদের মোকাবেলা করেছেন এবং তাকে পরিপূর্ণ বিজয় দান করে হয়েছিল । এই ঘটনাই সকল পরিস্থিতিতে তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তার পরিচয় দেয়, এবং আমাদের নিজেদের চিন্তার ধরণ কেমন হওয়া উচিত সে ব্যাপারে আমাদেরকে দিকনির্দেশনা দেয়।
সমগ্র পৃথিবী আজ পুঁজিবাদীদের ‘যার যার তার তার’ (every man for himself) চিন্তাধারা দ্বারা বশীভূত, যা একজন মানুষকে তার স্বার্থোদ্ধারের জন্য যেকোন কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করে। আলোচ্য আয়াতগুলোতে আমরা মুনাফিকদের মুখেও ঠিক একই ধাঁচের কথা শুনতে পাই, “সত্য প্রচারের পথে যদি শত্রু পক্ষ হতে ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে, তবে নিজের গা বাঁচিয়ে চল”। তারা নিজেরা তো সেই পথে যাবেই না, বরং যারা কিনা মু’মিন, নিজেদের দুনিয়াবী আরাম আয়েশের প্রতি যাদের মোহ নেই, আল্লাহর দ্বীনের প্রতিই তাদের ভালবাসা, তাদের ব্যাপারে তারা মুরুব্বিয়ানা ফলাবে, তাদের উপহাস করবে আর তাদেরকে উগ্র ধর্মান্ধ মনে করবে। তাদের মতে জিহাদের ময়দানে “বেঘোরে প্রাণ দেয়ার” কোন মানে নেই, যখন কিনা ঘরে বসে থাকলেই থেকে ত্বাগুতের ছোবল থেকে নিশ্চিন্তে থাকা যায়! দ্বীনের খাতিরে জান-মাল বিলিয়ে দেওয়া এদের চোখে নেহায়েত অপচয় বলে ঠেকে, আর তাই তারা ‘সহজ’, ‘হিকমাহপূর্ণ’ ও ‘বাস্তবসম্মত’ - এই শব্দগুচ্ছের আড়ালে এমন এক আরামের পথ বেছে নেয়, যে পথে কোন বিতর্ক বা আদর্শের দ্বন্দ্বের ঠোকাঠুকি নেই। এটাই অতীত ও বর্তমানের মুনাফিকদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য, তারা সর্বদা আত্মোৎসর্গের তুলনায় আত্মরক্ষা করতেই সদা তৎপর।
ইবনে আব্বাস একবার বলেছিলেন যে,“আল্লাহর রাসূল ﷺ ছিলেন সবচেয়ে দয়াশীল ব্যক্তি”। দেখা যায় তাঁর দয়ার উদাহরণ দেখাতে গিয়ে আমরা দরিদ্রদের প্রতি তাঁর দানশীলতার উদাহারণ টেনে আনি, অথচ আরেকটি দৃষ্টিকোণ থেকে এর উদাহরণ দেয়া যায় যেটি নিয়ে আমরা সচরাচর ভাবি না, আর তা হলো সত্যের প্রচারে কোন বাধা-বিপত্তি দ্বারা অবদমিত না হয়ে তাঁর নিজের সুযোগ-সুবিধা, আরাম-আয়েশকে বিসর্জন দেয়া। অর্থাৎ মুনাফিকের বৈশিষ্ট্য যেখানে স্বার্থপরতা, আর নবী-রাসূল ও তাঁদের অনুসারীদের বৈশিষ্ট্য হবে নিঃস্বার্থতা। পশ্চিমা বিশ্বের মুসলিম সংগঠন, নেতা, দা’ঈ, এমনকি সাধারণ মুসলিম- প্রত্যেকের উচিত নিজেদের দিকে একবার ফিরে দেখা, নিজেদের কে প্রশ্ন করা পুঁজিবাদী ধ্যানধারণার প্রভাববলয় থেকে কি তারা নিজেদের দ্বীনের কাজকর্মকে মুক্ত রাখতে পেরেছেন? তাঁরা কি পেরেছেন দ্বীনের মূলনীতিগুলোকে সততার সাথে আঁকড়ে ধরে রাখতে? নাকি নিজের গা বাঁচানোটাই তাদের কাছে মুখ্য? যদি বলা হয় "আরাম-আয়েশ অথবা দ্বীনের কল্যাণে ঝুঁকি" - এ দুয়ের মাঝে যেকোনো একটি বেছে নাও - তবে তারা কোনটিকে বেছে নিতে প্রস্তুত? তাঁরা কি নিজেদের ক্ষণস্থায়ী চাহিদাকে অধিক গুরুত্ব দেবেন, নাকি আল্লাহর দ্বীনের বিশুদ্ধতা রক্ষা ও সঠিকভাবে একে তুলে ধরার প্রয়াসে আত্মনিয়োগের মাধ্যমে দ্বীনের দীর্ঘস্থায়ী উদ্দেশ্য সাধনে নিয়োজিত হবেন? তাঁরা কি মুনাফিকদের আলোচ্য বৈশিষ্ট্যগুলোর প্রতিফলন নিজেদের মাঝে ঘটাবেন, নাকি আল্লাহর রাসূল ﷺ এর পথকে বেছে নিবেন? কোনটি বেছে নেবেন তারা? আদর্শ নাকি আত্মরক্ষা?
সুরা আল-বুরুজ এর "আসহাবুল উখদুদ" (গর্তের অধিবাসী) গল্পটির ব্যাপারে সাইয়্যিদ কুতুব বলেছিলেনঃ
"গল্পের ঈমানদার মানুষগুলো নিজেদের ঈমানকে বিক্রি করে দিয়ে দুনিয়ার জীবন লাভ করতে পারত সত্যি, কিন্তু তাতে তাদের আর পুরো মানবজাতির লাভ থেকে ক্ষতির পাল্লাটাই কি অনেক বেশি ভারি হত না? তারা বেঁচে থাকলেও তারা একসময় পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যেতেনই, সাথে তারা একটি মহাসত্যকে গলা টিপে হত্যা করত, (কিন্তু ঈমানের জন্য নিজের জান বিসর্জন দিয়ে তারা সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করে তবেই দুনিয়া থেকে বিদায় নিল)। ঈমান ছাড়া জীবন মূল্যহীন, আর স্বাধীনতা ছাড়া জীবন হয় মর্যাদাহীন। আর যালিমরা যখন মানুষদের শরীর ও আত্মার উপর আধিপত্য ফলায়, পুরো জীবনটাই তখন হয়ে যায় মৃত, নষ্ট, দূষিত।"
طارقمهنا
তারিক্ব মেহান্না
প্লাইমাউথ কারেকশনাল ফ্যাসিলিটি
আইসোলেশন ইউনিট - সেল #১০৮
"হে মু’মিনগণ! তোমরা তাদের মত হয়ো না, যারা কুফরি করে এবং তাদের ভাই-বন্ধুগণ যখন বিদেশে সফর করে কিংবা কোথাও যুদ্ধে লিপ্ত হয় তাদের সম্বন্ধে বলে, ‘তারা আমাদের কাছে থাকলে মরত না, নিহতও হত না'।”
এবং ১৬৮ নং আয়াতে বলছেন,
"...যারা (ঘরে) বসে থেকে নিজেদের ভাইয়ের সম্বন্ধে বলতে লাগলো, আমাদের কথা মত চললে তারা নিহত হত না..."
উপরের আয়াতগুলোতে মুনাফিকদের ব্যাপারে বলা হয়েছে, যখন তারা উহুদের ময়দানে যুদ্ধ করতে না গিয়ে মুসলিম বাহিনী থেকে বের হয়ে গেলো। তারা যুদ্ধরত মু’মিনদের দেখে মনে মনে ভাবতে থাকলো যে, দ্বীন কায়েমের সংগ্রাম থেকে দূরে ও নিরাপদ আশ্রয়ে থাকার মধ্যেই আছে সকল ‘হিকমাহ’। অপরদিকে মু’মিনদের যারা দ্বীনকে রক্ষা করা ও বিজয়ী করে তোলার জন্য নিজের প্রাণ পর্যন্ত বিলিয়ে দিতে রাজি আছে, তারা যেন আছে ভ্রান্তির পথে! এটাই ছিল মুনাফিকদের চিন্তাভাবনার নমুনা।
সত্যের দিকে মানুষকে ডাকতে গেলে কষ্ট ও বিপর্যয় নেমে আসবেই, এবং এই কষ্ট সহ্য করতে পারাটাই একজন প্রকৃত সত্যান্বেষীর পরিচয়। ইবন আল-কায়্যিম দ্বীনের প্রচারে একজন দা’ঈর প্রচেষ্টার সর্বোচ্চ স্তরের দিকে আলোকপাত করতে গিয়ে বলছেনঃ “(দা’ঈর পক্ষে সর্বোচ্চ ত্যাগ হল) আল্লাহর রাস্তায় দাওয়াত দিতে গিয়ে যাবতীয় বিপর্যয় ও মানুষের দ্বারা সৃষ্ট বাধা-বিপত্তি কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের জন্য সহ্য করে যাওয়া”। এছাড়াও আল্লাহ তাআলা কুরআনের সূরা আল-আসরে আমাদেরকে দ্বীনের প্রচার ও শিক্ষাদানের পথে সব বাধা-বিপত্তিতে ধৈর্যশীল হতে জোর দিয়ে বলেছেনঃ
“সময়ের শপথ! মানুষ ভ্রান্তির মধ্যে আছে; কেবল তারা ব্যতীত যারা ঈমান এনেছে, সৎকাজ করে, সত্যের প্রচারক, আর ধৈর্যধারণে উৎসাহ দান করে।” [সূরা আল-আসর]
অতএব একজন মুসলিম যেচে পড়ে কষ্ট ও বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে না সেটাই স্বাভাবিক, কিন্তু যদি এমন হয় সত্যপ্রচারের পথে বাঁধা-বিপত্তির সম্মুখীন না হয়ে আর কোন উপায় নেই, তবে একজন মু’মিন হাত গুটিয়ে বসে না থেকে স্বেচ্ছায় সে পথেই এগিয়ে যাবে। কেননা আলোচিত আয়াতগুলোর মাধ্যমে এটাই প্রমাণিত হয় যে, দ্বীন প্রচারের জন্য সকল কষ্ট মেনে নেয়ার এই ইচ্ছাই তার ঈমান ও নিফাকের মধ্যে পার্থক্যকারী।
আরাম-আয়েশের দিকে ঝুঁকে পড়া, নিরাপদ জীবন চাওয়া, এগুলো আমাদের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। স্বয়ং আ’ইশা (রা) রাসূলুল্লাহ ﷺ এর ব্যাপারে বলছেন, “তাঁর সামনে যখন দুটো রাস্তা খোলা থাকত, তখন তিনি দুটোর মাঝে সহজটাই বেছে নিতেন, যদি না সেই সহজ পথে আল্লাহর অবাধ্যতা থাকে”। কিন্তু যখন এমন হত, দ্বীন প্রচার করতে গিয়ে কুফ্ফারদের কাছ থেকে কিছু ক্ষতির সম্মুখীন হতেই হবে এবং নিজের আরাম-আয়েশকে বিসর্জন দিতে হবে, তখন কি তিনি আরাম-আয়েশকে প্রাধান্য দিতেন? নিজেকেই জিজ্ঞেস করুন।
তিনি বা আর অন্য কোন নবী কি কখনো নিজেদের নিরাপত্তা ও আরাম-আয়েশের কথা ভেবে সত্য প্রচারে পিছু হটেছিলেন? আজকাল ইসলামের অনেক দা’ঈ সত্য গোপন করার পিছনে একটি খোঁড়া যুক্তি খাঁড়া করান যে, “এটা করলে তাদেরকে অচিরেই শত্রুর হাতে ধ্বংস হতে হবে, বরং এ থেকে বিরত থাকলে আগত দিনগুলোতে তারা দ্বীনের উপকারে আসতে পারবেন।" নবীদের কেউ কি এসব খোঁড়া অজুহাত দিতেন? কক্ষনো না, একবারও না।
বদরের সেই দিনে রাসূলুল্লাহ(সা) এর কথা স্মরণ করে দেখুন, যুদ্ধের পূর্বে তিনি আল্লাহর কাছে কী ফরিয়াদ জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন,
“হে আল্লাহ! মু’মিনদের এই দল যদি ধ্বংসপ্রাপ্ত ও পরাজিত হয়, তোমার ইবাদাত করার জন্য আর কেউই অবশিষ্ট থাকবে না।"
অন্য ভাবে বলা যায়, তিনি জানতেন এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ মানে মু’মিনদের জীবন নয়, খোদ ইসলামের অস্তিত্বকেও হুমকির মুখে ঠেলে দেওয়া, আরাম-আয়েশ পরিত্যাগের বিষয়টি বাদই দিলাম। কিন্তু রাসূলুল্লাহ ﷺ কি কিছু বিপদের আশংকায় সাহাবীদেরকে নিজেদের মালামাল গুটিয়ে মদীনায় ফিরে যাওয়ার কথা একটিবারের জন্যেও মুখে এনেছিলেন? তিনি এমনটি করেননি, বরং নির্ভীকচিত্তে সামনে এগিয়ে গিয়েছিলেন, মুশরিকদের মোকাবেলা করেছেন এবং তাকে পরিপূর্ণ বিজয় দান করে হয়েছিল । এই ঘটনাই সকল পরিস্থিতিতে তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তার পরিচয় দেয়, এবং আমাদের নিজেদের চিন্তার ধরণ কেমন হওয়া উচিত সে ব্যাপারে আমাদেরকে দিকনির্দেশনা দেয়।
সমগ্র পৃথিবী আজ পুঁজিবাদীদের ‘যার যার তার তার’ (every man for himself) চিন্তাধারা দ্বারা বশীভূত, যা একজন মানুষকে তার স্বার্থোদ্ধারের জন্য যেকোন কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করে। আলোচ্য আয়াতগুলোতে আমরা মুনাফিকদের মুখেও ঠিক একই ধাঁচের কথা শুনতে পাই, “সত্য প্রচারের পথে যদি শত্রু পক্ষ হতে ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে, তবে নিজের গা বাঁচিয়ে চল”। তারা নিজেরা তো সেই পথে যাবেই না, বরং যারা কিনা মু’মিন, নিজেদের দুনিয়াবী আরাম আয়েশের প্রতি যাদের মোহ নেই, আল্লাহর দ্বীনের প্রতিই তাদের ভালবাসা, তাদের ব্যাপারে তারা মুরুব্বিয়ানা ফলাবে, তাদের উপহাস করবে আর তাদেরকে উগ্র ধর্মান্ধ মনে করবে। তাদের মতে জিহাদের ময়দানে “বেঘোরে প্রাণ দেয়ার” কোন মানে নেই, যখন কিনা ঘরে বসে থাকলেই থেকে ত্বাগুতের ছোবল থেকে নিশ্চিন্তে থাকা যায়! দ্বীনের খাতিরে জান-মাল বিলিয়ে দেওয়া এদের চোখে নেহায়েত অপচয় বলে ঠেকে, আর তাই তারা ‘সহজ’, ‘হিকমাহপূর্ণ’ ও ‘বাস্তবসম্মত’ - এই শব্দগুচ্ছের আড়ালে এমন এক আরামের পথ বেছে নেয়, যে পথে কোন বিতর্ক বা আদর্শের দ্বন্দ্বের ঠোকাঠুকি নেই। এটাই অতীত ও বর্তমানের মুনাফিকদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য, তারা সর্বদা আত্মোৎসর্গের তুলনায় আত্মরক্ষা করতেই সদা তৎপর।
ইবনে আব্বাস একবার বলেছিলেন যে,“আল্লাহর রাসূল ﷺ ছিলেন সবচেয়ে দয়াশীল ব্যক্তি”। দেখা যায় তাঁর দয়ার উদাহরণ দেখাতে গিয়ে আমরা দরিদ্রদের প্রতি তাঁর দানশীলতার উদাহারণ টেনে আনি, অথচ আরেকটি দৃষ্টিকোণ থেকে এর উদাহরণ দেয়া যায় যেটি নিয়ে আমরা সচরাচর ভাবি না, আর তা হলো সত্যের প্রচারে কোন বাধা-বিপত্তি দ্বারা অবদমিত না হয়ে তাঁর নিজের সুযোগ-সুবিধা, আরাম-আয়েশকে বিসর্জন দেয়া। অর্থাৎ মুনাফিকের বৈশিষ্ট্য যেখানে স্বার্থপরতা, আর নবী-রাসূল ও তাঁদের অনুসারীদের বৈশিষ্ট্য হবে নিঃস্বার্থতা। পশ্চিমা বিশ্বের মুসলিম সংগঠন, নেতা, দা’ঈ, এমনকি সাধারণ মুসলিম- প্রত্যেকের উচিত নিজেদের দিকে একবার ফিরে দেখা, নিজেদের কে প্রশ্ন করা পুঁজিবাদী ধ্যানধারণার প্রভাববলয় থেকে কি তারা নিজেদের দ্বীনের কাজকর্মকে মুক্ত রাখতে পেরেছেন? তাঁরা কি পেরেছেন দ্বীনের মূলনীতিগুলোকে সততার সাথে আঁকড়ে ধরে রাখতে? নাকি নিজের গা বাঁচানোটাই তাদের কাছে মুখ্য? যদি বলা হয় "আরাম-আয়েশ অথবা দ্বীনের কল্যাণে ঝুঁকি" - এ দুয়ের মাঝে যেকোনো একটি বেছে নাও - তবে তারা কোনটিকে বেছে নিতে প্রস্তুত? তাঁরা কি নিজেদের ক্ষণস্থায়ী চাহিদাকে অধিক গুরুত্ব দেবেন, নাকি আল্লাহর দ্বীনের বিশুদ্ধতা রক্ষা ও সঠিকভাবে একে তুলে ধরার প্রয়াসে আত্মনিয়োগের মাধ্যমে দ্বীনের দীর্ঘস্থায়ী উদ্দেশ্য সাধনে নিয়োজিত হবেন? তাঁরা কি মুনাফিকদের আলোচ্য বৈশিষ্ট্যগুলোর প্রতিফলন নিজেদের মাঝে ঘটাবেন, নাকি আল্লাহর রাসূল ﷺ এর পথকে বেছে নিবেন? কোনটি বেছে নেবেন তারা? আদর্শ নাকি আত্মরক্ষা?
সুরা আল-বুরুজ এর "আসহাবুল উখদুদ" (গর্তের অধিবাসী) গল্পটির ব্যাপারে সাইয়্যিদ কুতুব বলেছিলেনঃ
"গল্পের ঈমানদার মানুষগুলো নিজেদের ঈমানকে বিক্রি করে দিয়ে দুনিয়ার জীবন লাভ করতে পারত সত্যি, কিন্তু তাতে তাদের আর পুরো মানবজাতির লাভ থেকে ক্ষতির পাল্লাটাই কি অনেক বেশি ভারি হত না? তারা বেঁচে থাকলেও তারা একসময় পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যেতেনই, সাথে তারা একটি মহাসত্যকে গলা টিপে হত্যা করত, (কিন্তু ঈমানের জন্য নিজের জান বিসর্জন দিয়ে তারা সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করে তবেই দুনিয়া থেকে বিদায় নিল)। ঈমান ছাড়া জীবন মূল্যহীন, আর স্বাধীনতা ছাড়া জীবন হয় মর্যাদাহীন। আর যালিমরা যখন মানুষদের শরীর ও আত্মার উপর আধিপত্য ফলায়, পুরো জীবনটাই তখন হয়ে যায় মৃত, নষ্ট, দূষিত।"
طارقمهنا
তারিক্ব মেহান্না
প্লাইমাউথ কারেকশনাল ফ্যাসিলিটি
আইসোলেশন ইউনিট - সেল #১০৮
Comment