Announcement

Collapse
No announcement yet.

তাদাব্বুরে কুরআন!

Collapse
This is a sticky topic.
X
X
 
  • Filter
  • Time
  • Show
Clear All
new posts

  • তাদাব্বুরে কুরআন!

    بسم الله الرحمن الرحيم
    তাদাব্বুরে কুরআন!

    (১). তাদাব্বুর (تَدَبُّر) অর্থ গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করা। অনুধ্যান করা। সাধারণত কুরআন কারীমের আয়াত নিয়ে চিন্তাভাবনাকে তাদাব্বুর বলে।
    .
    (২). দাল-বা-রা (دبر) এই তিন হরফ যোগে গঠিত শব্দ কুরআন কারীমে সাত ধরনের শব্দে সর্বমোট ৪৪ বার এসেছে।এই শব্দমূলের মূল অর্থ: পেছন দিক। পরে আসা।
    .
    (৩). একটা কথা শুরুতেই বলে রাখি, কুরআন কারীম অর্থ না বুঝেও পড়াও একটা ইবাদত। প্রতি হরফে দশ নেকি।
    .
    (৪). কুরআন কারীম নাযিল করা হয়েছে, হেদায়াতের জন্যে। না বুঝলে কিভাবে হেদায়াত আসবে? সবাইকেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে কুরআন বোঝার মেহনত শুরু করা জরুরী।
    .
    (৫). কুরআন বোঝার মেহনত শুরু করার আগে কিছু ধাপ আছে। সেগুলো অতিক্রম না করে, কুরআন বুঝতে যাওয়া নিরাপদ নয়। ফলপ্রসূও নয়।
    .
    (৬). এই কুরআন ছোট্ট শিশু পড়ে, অবুঝ বালক পড়ে। কিছু না বুঝেই তারা পড়ে। তাবীল-তাদাব্বুর সম্পর্কে তাদের কোনও ধারনাই নেই। কিন্তু বড় হওয়ার পরও এভাবে না বুঝে পড়তে থাকা যুক্তিসঙ্গত নয়। ধর্মসঙ্গতও নয়। একটু একটু করে হলেও বোঝার মেহনত শুরু করা উচিত।
    .
    (৭). কুরআনের তাদাব্বুর সমস্ত শরীয়তের যাবতীয় ইলমের চাবিকাঠি। তাদাব্বুরের মাধ্যমে কুরআন থেকে কল্যাণকর দিক-নির্দেশনা লাভ করা যায়। ঈমান বৃদ্ধি পায়।
    .
    (৮). মানুষ ডাক্তারিবিদ্যার বই পড়ে, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বই পড়ে, অন্য আরো বিদ্যার বই পড়ে। বোঝার জন্যেই পড়ে। পঠিত বইয়ের তথ্যজ্ঞান নিজের মধ্যে ধারণ করার জন্যে পড়ে। তাহলে কুরআনকে কেন না বুঝে পড়া হবে? কুরআন থেকেই তো সত্য ও মিথ্যার জ্ঞান আহরণ করা হয়। ভাল ও মন্দের জ্ঞান লাভ হয়! ধর্ম অধর্ম চেনার উপায় জানা হয়।
    = কথা আছে, অন্য বই অর্থ বোঝা ছাড়া পড়ে কোনও লাভ নেই কিন্তু কুরআন অর্থ বোঝা ছাড়া পড়লেও সওয়াব মেলে। তাই বলে শুধু পড়ার সওয়াব নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা, কুরআনের হক আদায়ে যথেষ্ট নয়।
    .
    (৯). একটা পাহাড়ের কথা কল্পনা করি! যদি কুরআন তার উপর নাযিল হতো, সেটা ভয়ে ভারে চুরমার হয়ে যেতো। পাহাড়ের তুলনায় মানুষের হৃদয় ছোট্ট একটা দানার মতো। কতো কতো কুরআন পাঠ শোনে, তবুও কেন বিন্দুমাত্র প্রভাব পড়ে না? কারন একটাই , তাদাব্বুর করে না।
    .
    (১০). ধীরে ধীরে কুরআন পাঠই তাদাব্বুরের জন্যে সহায়ক। নবীজি সা. কিভাবে তিলাওয়াত করতে সেটা উম্মে সালামা রা. দেখিয়েছিলেন। সেটা ছিল ধীরে ধীরে তিলাওয়াত। প্রতিটি হরফকে আলাদা আলাদা করে স্পষ্ট তিলাওয়াত।
    -আনাস রা. বলেছেন: নবীজির তিলাওয়াত ছিল ধীরগতির। টেনে টেনে। থেমে থেমে।
    -ইবনে আবি মুলাইকা রহ. বলেছেন; আমি একবার ইবনে আব্বাস রা.-এর সাথে সফরে গিয়েছি। তিনি অর্ধেক রাত নামাজ পড়তেন। নামাযে কুরআন তিলাওয়াত করতেন, প্রতিটি হরফকে আলাদা করে উচ্চারণ করে। পড়তে পড়তে কাঁদতেন। দূর থেকেও তার ফোঁপানোর আওয়াজ ভেসে আসতো।
    .
    (১১). তাদাব্বুর করে করে কুরআন পড়ো। তাহলে অর্থ বুঝতে পারবে। কুরআনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাদাব্বুর করো। আমলের নিয়তে পড়ো। অমনোযোগী হয়ে পড়ো না। পরিপূর্ণ সচেতনতার সাথে পড়ো। কোনও আয়াতে সন্দেহ লাগলে আলিমের কাছে প্রশ্ন করে জেনে নাও।
    -ইবনে বায রহ.।
    .
    (১২). আজ কুরআনবিমুখ মানুষের ছড়াছড়ি। কুরআন মেনে চলা মানুষ আজ চারদিকে লাঞ্ছিত। কুরআনের দিকে আহবানকারী আজ উপেক্ষিত। এটা দেখে তুমি ভয় পেয়ে পিছিয়ে যেও না। প্রকৃত জ্ঞানী সাহসী ব্যক্তি সমালোচকদের ভয় পেয়ে পিছিয়ে যায় না।
    -শায়খ শানকীতি রহ.।
    .
    (১৩). কুরআন পাঠকারীর মূল ভূষণ হবে বিনয়। ন¤্রতা। এর দ্বারা তার চিত্ত উন্মুক্ত হবে। হৃদয় আলোকিত হবে। সালাফ একটা আয়াত নিয়েই পুরো রাত কাটিয়ে দিয়েছেন। তাদের কত রাত কেটে গেছে কুরআনের তাদাব্বুরে!
    -ইমাম নববী রহ.।
    .
    (১৪). একজন বুদ্ধিমান মুমিনের জন্যে কুরআন হবে আয়নার মতো। আয়নায় চেহারা দেখা যায়। সুন্দর অসুন্দর ফুটে ওঠে। কুরআন পাঠের সময়ও নিজের ভাল দিক মন্দ দিক স্পষ্ট হয়। কোনও আয়াতে ভাল একটা গুণের কথা আলোচিত হলে, আমার মধ্যে গুণটা আছে কি না, সেটা ধরা পড়ে। একজন মুমিন তিলাওয়াত করার সময়, ভয়ের আয়াত এলে ভয় পায়। আশার আয়াত এলে আশান্বিত হয়।
    কুরআনকে এভাবে পাঠ করলে, কুরআন হবে তার জন্যে সুপারিশকারী। সাক্ষী। বন্ধু। রক্ষাকবচ। আর সে নিজেও হয়ে উঠবে সবার জন্যে উপকারী বন্ধু। দুনিয়া ও আখেরাতে তার পিতামাতার উপর, তার সন্তানদের উপর নেমে আসবে কল্যাণ।
    - ইমাম আ-জুররী রহ.।
    .
    (১৫). দ্বীন হলো কল্যাণকামিতা। কার জন্যে? আল্লাহর জন্যে। রাসূলের জন্যে। কুরআনের জন্যে। মুসলিম ভাইয়ের জন্যে। কুরআনের জন্যে কল্যাণকামিতা হলো:
    -কুরআনের প্রতি তীব্র ভালবাসা থাকা। কুরআনের প্রতি অত্যন্ত সশ্রদ্ধ থাকা। কুরআন বোঝার প্রতি তীব্র আগ্রহ থাকা। কুরআন তাদাব্বুরের প্রতি গভীর মনোযোগ থাকা। কেন? আল্লাহ কী বলেছেন সেটা জানার জন্যে।
    .
    (১৬). একজন সাধারণ নসীহতকারীর কথা মানুষ বোঝে। তার পক্ষ থেকে কোনও চিঠি এলে তার মূলবার্তা উদ্ধার করতে পারে। বার্তা অনুযায়ী জীবন গড়ে। কুরআন কারীমের কল্যাণকামীও গুরুত্বের সাথে এর বাণী বোঝার চেষ্টা করে। আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা বাণীকে আমরা না বুঝে থাকি! এটা কি বুদ্ধিমানের কাজ?
    .
    (১৭). এক আরব অধ্যাপক বললেন:
    -আমার আব্বু ছিলেন হাসপাতালে। বয়সজনিত নানা রোগ উপসর্গ দেখা দিয়েছে। শরীরে বাসা বেঁধেছে নানা-অসুখবিসুখ। কথা বলতে পারেন না। ডাক্তার বেশি বেশি ঘুমুতে বলেছেন। কিন্তু আমি যখনই তাকে দেখতে যেতাম, তার হাতে কুরআন দেখতাম!
    -ডাক্তার আপনাকে বেশি বেশি ঘুমুতে বলেছেন!
    -বাছা, কুরআন পড়ার আনন্দে ঘুম আসে না!
    -কয়পারা পড়তে পারেন! সারা দিনে বেশি পড়া যায় না, সাত পারা পর্যন্ত হয়!
    আমি জানি, আব্বু প্রতিটি আয়াতকে কয়েকবার করে পড়েন। নিজেকে প্রশ্ন করেন। অনেকক্ষণ চুপ করে ভাবেন!
    .
    (১৮). প্রিয়তমকে যতটুকু ভালবাসি, তার কথাও সে পরিমাণে প্রিয় হয়। আল্লাহকে যতটা ভালবাসি তার কালামও সে পরিমাণে প্রিয় হবে আমার কাছে। কুরআন নিয়ে মেহনতের পরিমাণই বলে দিবে আমি আল্লাহকে কতোটা ভালবাসি!
    .
    (১৯). কুরআন নিয়ে থাকা মানে আল্লাহর সাথে ব্যবসায় নামা। আল্লাহ তা‘আলা এ-ব্যাবসায় কতো হারে লাভ দেবেন, সেটা বান্দা কল্পনাও করতে পারবে না। এই ব্যবসার ট্রেড লাইসেন্স শুধু দুনিয়াতেই নয়, আখেরাতেও এর মেয়াদকাল ব্যাপ্ত থাকবে। লাভ আসতে থাকবে দুনিয়া ছাড়িয়ে আখেরাতেও।
    .
    (২০). কুরআনের সুর কী চমৎকার! কী মোহনীয়! কী কমনীয়! পাথরহৃদয়কেও নরম করে দেয়। কোমল করে দেয়। ভিজিয়ে দেয়। কুরআনের সামনে কোনও অহংকারী দাম্ভিক টিকতে পারে না। কাফের মুনাফিক নাস্তিকও দাঁড়াতে পারে না। কুরআন হলো জীবন-নদী। প্রাণদায়িনী বারিধারা। উচ্ছল ঝরনা। আল্লাহর কাছ থেকে বয়ে এসে বান্দার হৃদয়সাগরে এসে মিলিত হয়। বান্দার হৃদয় হলো কুরআনের মিলন মোহনা। হৃদয়কে মুমিন বানায়। আল্লাহভীরু বানায়। হৃদয়কে নষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা করে। সব ধরনের কল্যাণ দিয়ে টইটম্বুর করে দেয়। এজন্য চাই কুরআন নিয়ে তাদাব্বুর!
    .
    (২১). পথ চলতে চলতে দ্বিধা তৈরি হলে, জীবনে সংকট দেখা দিলে, সাথে সাথে কুরআনের কাছে ফিরব। আল্লাহ কী বলেছেন, বোঝার চেষ্টা করবো। দূর হয়ে যাবে হয়রানি। দুশ্চিন্তা। মানুষ কষ্টের সময় আপনজনের কাছেই ফিরে আসে। আমাদের আপনজন আল্লাহ। তার কালাম হবে মাধ্যম।
    .
    (২২). কুরআন কারীমের স্বাদ পেতে হলে, জীবনটা গুনাহমুক্ত হতে হবে। গুনাহ হলো জংয়ের মতো। কলব আয়নার মতো। গুনাহর প্রভাবে কলবে কালিমা পড়ে যায়। কুরআন জংধরা কলবে প্রতিফলিত হয় না।
    .
    (২৩). তিলাওয়াতের সময় কাঁদা মুস্তাহাব। কান্না না এলে কান্নার ভান করা। অতীতের দুঃখ-শোকের কথা চিন্তা করে কান্না আনার চেষ্টা করা। যদি শোক-দুঃখের কথা কল্পনা করার পরও মনে দুঃখবোধও না আসে, তাহলে এই না আসার জন্যেই আগে কাঁদা দরকার! কারণ এটা আরও বড় বিপদ! পাথরহৃদয় মানুষের নিন্দা করা হয়েছে কুরআনে। হাদীসে।
    .
    (২৪). নফল ইবাদতের মাধ্যমে বান্দা তার রবের বেশি নৈকট্য অর্জন করতে পারে। কুরআন তিলাওয়াত শ্রেষ্ঠতম নফল। কুরআন শোনা, তাদাব্বুর করাও এর অন্তর্ভুক্ত। খাব্বাব রা. একলোককে বলেছিলেন:
    -যতটুকু সাধ্যে কুলোয় আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের চেষ্টা করো। আর আল্লাহর কালামই নৈকট্য লাভের কার্যকর মাধ্যম।
    .
    (২৫). মুসলিম উম্মাহর যখনি দুর্দিন আসবে, তার উচিত কুরআনের সাথে তার সম্পর্কটা কেমন প্রথমে যাচাই করে নেয়া। সাধারণত উম্মাহর সমস্যা আসা শুরু হয় কুরআনের সাথে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার মধ্য দিয়ে। আর কুরআনের তাদাব্বুর কমে গেলেই উম্মাহর উপর বিপদের ঘোর অমানিশা নেমে আসে। তখনো কিন্তু তিলাওয়াত ঠিকই চলতে থাকে। থাকে না শুধু ‘তাদাব্বুর’।
    .
    (২৬) নাগরিক জীবনে যত সমস্যা দেখা দেয়, এর অন্যতম কারণ হলো, কুরআন থেকে দূরে সরে যাওয়া। নিয়মিত কুরআনের সাথে লেগে থাকলে, যাবতীয় সন্দেহ দ্বিধা কাছেই ঘেঁষতে পারবে না। এমনিতেই সুখ নেমে আসবে।
    .
    (২৭). ইউসুফ বিন আসবাত রহ.-কে প্রশ্ন করা হল:
    -কুরআন খতমের পর কী দু‘আ করেন?
    -আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই। কারণ, খতম করার পর, ভাবতে বসি পুরো কুরআনের কোনও কোনও হুকুম আমি মান্য করেছি, কোনও কোনও হুকুম মান্য করতে পারিনি! হিশেব করলে দেখা যায়, অনেক হুকুম আমি মান্য করছি না! এজন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া চাড়া আর কোনও উপায় দেখি না! কারণ না মানার পরিমাণই যে বেশি!
    .
    (২৮). হেদায়াত চাইলে তাদাব্বুর করতেই হবে। কারণ ইলম ও হিদায়াত হলো তাদাব্বুরেরর অধীনস্থ বিষয়।
    .
    (২৯). পথহারা কেউ যদি পথ পাওয়ার উদ্দেশ্যে কুরআন নিয়ে বসে। তাদাব্বুরের মাধ্যমে পথের সন্ধান করে, তাহলে তার সামনে পথ খুলে যায়।
    .
    (৩০). বান্দার হেদায়াতের সাথে সম্পৃক্ত এমন প্রতিটি আয়াতের ব্যাখ্যাই কুরআনে দেয়া আছে। আমি বুঝতে না পারলে, ধরে নিতে হবে, আমার কোথাও অসম্পূর্ণতা আছে।
    .
    (৩১). মুসলিম বিশ্বে এমনকি অমুসলিম দেশে হাজার-হাজার মাদরাসা আছে। যেখানে কুরআন হেফয করানো হয। কিন্তু শুধু কুরআনের তাদাব্বুর নিয়ে ছাত্রদের মধ্যে কাজ করবে, এমন মাদরাসা বিরল।
    .
    (৩২). একজন মুসলমানকে যদি প্রশ্ন করা হয়:
    -আপনি কি বিশ্বাস করেন, কুরআন কারীম হলো বান্দার জন্যে হেদায়াত, নূর ও শিফা?
    -অবশ্যই বিশ্বাস করি!
    কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, বেশির ভাগ মুসলমান শুধু রমযান এলেই কুরআনের কথা স্মরণ করে। অনেকেই তো তাও করে না। যেন বাকী এগার মাস হেদায়াত নূর ও শিফার প্রয়োজন নেই।
    .
    (৩৩). পাপী হুদয়ের জন্যে, কুরআন তিলাওয়াত ও শ্রবণের চেয়ে বড় ওষুধ আর কিছু হতে পারে না।
    .
    (৩৪). হৃদয়কে নাড়া দেয় এমন করে কুরআন তিলাওয়াত করা উচিত। সূরা বা পারা শেষ করা যেন কোনওভাবেই উদ্দেশ্য না হয়। এজন্য কুরআনের রুটিনটা পারাভিত্তিক নয়, সময় ভিত্তিক হলে ভাল। আমি প্রতিদিন এতক্ষণ সময় কুরআন নিয়ে ফিকির করবো।
    .
    (৩৫). জাহেলের কথার চেয়ে আলেমের কথা শোনা ভাল। অন্যের কথা শোনার চেয়ে ¯স্নেহময় পিতার কথা শোনা ভাল। আল্লাহ হলেন সবচেয়ে বড় আলিম, সবেচেয়ে বেশি ¯স্নেহশীল। তার কথাও সবার চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাওয়ার কথা। তাদাব্বুরের সাথে, ভালবাসার সাথে।
    .
    (৩৬). মনোযোগের সাথে আল্লাহর কালাম, নবীজির কালাম শুনলে এবং তাদাব্বুর করলে, না বুঝে পারার কথা নয়। প্রথম দিনেই সব হয়ে এমন ভাবলে তো চলবে না! নিয়তান্ত্রিকভাবে এগুতে হবে।
    .
    (৩৭). কুরআন তাদাব্বুরের বড় এক বাধা হলো ‘গান’। সংগীত কলবকে হেদায়াতবিমুখ করে দেয়। কুরআনবিমুখ করে দেয়। কুরআন ও গান এক পাত্রে জমা হতে পারে না। গান মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে ‘প্রবৃত্তির’ পূজার। কুরআন মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে প্রবৃত্তির বিরোধিতার। কুরআন মানুষের মনে শুভবোধ তৈরী করে, গান তৈরী করে অশুভবোধ। কুরআন ডাকে হকের দিকে গান ডাকে বাতিলের দিকে। কুরআন ডাকে সত্যের দিকে গান ডাকে মিথ্যার দিকে। কুরআন ডাকে আল্লাহর দিকে, গান ডাকে তাগুতের দিকে।
    .
    (৩৮). ১৮৫ জন বন্দীর মধ্যে একটা জরিপ চালানো হয়েছিল। তাদেরকে শর্ত দেয়া হয়েছিল, কুরআন হেফয করতে পারলে মুক্তি দেয়া হবে। সাধারণভাবে সাজা ভোগ করে যেসব অপরাধী মুক্তি পেয়েছিল, তাদের অনেকেই পুরনায় কারাগারে এসেছে। আবার কোনও অপরাধ করে। কিন্তু হিফযের শর্ত পূরণ করে মুক্তি পাওয়া ব্যক্তিদের পুনরায় অপরাধ করে জেলে আসার হার ছিল শতকরা ০%।
    .
    (৩৯). কোনও আয়াত নিয়ে তদাব্বুর করতে বসলে, শুধু এই আয়াতেই দৃষ্টিটা সীমাবদ্ধ না রেখে, আগের পরের আয়াতের দিকেও গভীর মনোযোগের সাথে খেয়াল রাখা উচিত! তাতে কাঙ্খিত আয়াত বুঝতে সহজ হবে।
    .
    (৪০). কুরআন কারীম শুধু মুখস্থ তিলাওয়াত করলে সওয়াব আছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, শুধু তিলাওয়াতের জন্যে কুরআন নাযিল হয়নি।
    .
    (৪১). কুরআন পাঠের সময় তাজভীদের প্রতি লক্ষ্য রাখা জরুরী। কিন্তু তাজভীদ নিয়ে অতি ব্যস্ততা পাঠকারীকে আয়াতের অর্থ বুঝতে বাধা দেয়।
    .
    (৪২). আমি শায়খ শানকীতি রহ.-কে দেখেছি, তিনি প্রতি রাতে -শীত হোক গ্রীষ্ম হোক- নির্দিষ্ট পরিমাণে তিলাওয়াত করতেন। তাহাজ্জুদে। তিনি বলতেন: রাতের নামাযে পড়া ছাড়া, কুরআন বোঝা যায় না। বুঝলেও সে বুঝ স্থায়ী হয় না।
    শায়খ আতিয়া সালেম রহ.।
    .
    (৪৩). যে শিশু বা কিশোর বয়ঃপ্রাপ্তির আগেই কুরআন কারীম হিফয করে ফেলে, তাকে বাল্যকালেই আল্লাহর পক্ষ থেকে হেকমত দিয়ে দেয়া হলো
    -ইবনে আব্বাস!
    এই শিশুটার মধ্যে একজন নবীর গুণাবলী চলে আসে। ঈসা আ.-কেও শৈশবে হিকমত প্রদান করা হয়েছিল। একজন শিশু যদি কুরআন হিফযের কারণে এই মর্যাদা অর্জন করতে পারে, তাহলে যে কুরআনকে তাদাব্বুর করে বোঝার চেষ্টা করে ও কুরআনের বাতলানো পথে চলতে চেষ্টা করে, তার মর্যাদা কেমন হবে? তার মর্যাদা তো আরও বহুগুণে বেশি হওয়ার কথা!
    .
    (৪৪). একজন আরবের স্মৃতিচারণ:
    -আমি ট্রেনে করে যাচ্ছিলাম। পাশেই বসেছিলেন একজন তুর্কি ভদ্রলোক। দীর্ঘ পথযাত্রা। তিনি ব্যাগ থেকে কুরআন বের করে পড়তে শুরু করলেন। একটু পর কাদতে শুরু করলেন। আমি তাকে প্রশ্ন করলাম!
    -কেন কাঁদছেন? আপনি কুরআন কারীম বোঝেন?
    -জ্বি না, বুঝি না, তবুও কুরআন না বুঝে পড়লেও, মনে হয় কী যেন বুঝছি! কী যেন বুঝে যাচ্ছি! আফসোস হয়, আহা! যদি আরবীটা বুঝতে পারতাম! আচ্ছা আপনারা তো আরব, আমার সাথে কয়েকজন আরব থাকেন, তাদেরকেও কুরআন তিলাওয়াত করতে দেখি, কিন্তু তারা কুরআন বোঝেন, তবুও তারা কাঁদেন না কেন?
    .
    (৪৫). তোমরা আমাকে এসব ছাঁইপাশ বিদাতি কথাবার্তাপূর্ণ কিতাবপত্র সম্পর্কে প্রশ্ন করেছ! আমি বলছি শোন, এসব বই বর্জন করো! তোমরা সালাফের কিতাবাদি পড়! কুরআন পড়ো! আল্লাহর কিতাবে যদি তোমাদের উপদেশের জন্যে যথেষ্ট না হয়, তাহলে, এসব কিতাবে তোমাদের জন্যে গোমরাহী ছাড়া আর কিছু নেই
    -আবু যুরআ রাযী রহ.।
    .
    (৪৬). কুরআন কারীমে আল্লাহ তা‘আলা বারবার তাকিদ দিয়েছেন, তার কালাম দিয়েই যেন মানুষকে দাওয়াত দেয়া হয়।
     — — (وأَنْ أَتْلُوَا) এবং আমি যেন কুরআন তিলাওয়াত করি। নামল: ৯২।
     — — নবীজিকে আদেশ করা হয়েছে, তিনি যেন মানুষকে তিলাওয়াত করে শোনান। দাওয়াত দেন।
     — — (حَتّى يَسْمَعَ كَلامَ اللهِ) সে (বন্দী কাফের) আল্লাহর বাণী শোনা পর্যন্ত (আশ্রয় দেবে)। তাওবা ৬।
    কাফির বন্দী হলে, তাকেও কুরআন কারীম শোনানোর ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে। যাতে তার ঈমান আনার একটা সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়।
     — — (اتْلُ ما أُوْحِيَ إِلَيْك من الكِتابِ) (হে নবী!) ওহীর মাধ্যমে আপনার প্রতি যে কিতাব নাযিল করা হয়েছে, তা তিলাওয়াত করুন (আনকাবূত: ৪৫)।
    = এসব আয়াত পড়লে বোঝা যায়, কুরআন কারীমের মাধ্যমে দাওয়াত দিলে বেশি ফলপ্রসূ হয়। এবং নিছক পাঠ নয়, বুঝে বুঝে পাঠের দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে।
    .
    (৪৭). এক যুবককে চিনি। বড় ঘরের সন্তান। ধন-সম্পদে ভরপুর। প্রাণ ও প্রাচুর্য যেন উপচে পড়ছে। পরিবারের সবাই জাগতিকভাবে উচ্চশিক্ষিত। কিন্তু সে উজ্জল ব্যতিক্রম। কুরআনে হাফেয। ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত। পরিবারের ভোগ-বিলাসী যিন্দেগীর কিছুই তাকে স্পর্শ করতে পারে নি! বেশির ভাগ সময় কুরআন পড়ে। কুরআনের কথা বলে। কুরআনের দিকে দাওয়াত দেয়। যেহেতু আর্থিক চিন্তা নেই, পুরো সময়টা সে এ-কাজেই ব্যয় করতে পারে। আমি তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম:
    -তুমি কিভাবে এ-পথে পা বাড়াতে পারলে? পরিবারের প্রথায় আরামের জীবন ছেড়ে?
    -কিভাবে এসেছি ঠিক বলতে পারবো না! তবে আমার কাছে কিভাবে যেন কুরআনকে ভাল লেগে গিয়েছিল। আব্বু আমার জন্যে বিদেশ থেকে সুন্দর একটা কুরআন শরীফ এনেছিলেন। ওটা ছিল কারুকার্যখচিত। আব্বু ধার্মিক নন। কিন্তু তার কী মনে হয়েছিল, আল্লাহই ভালো বলতে পারবেন! সবার জন্যে দামী খেলনা এনেছেন। ব্যতিক্রমভাবে শুধু আমার জন্যেই কেন কুরআনখানা আনলেন! কুরআন শরীফ যখন কিনতে গেলেন, পাশে আরেকজন ক্রেতা ছিলেন। আব্বু দোকান থেকে বের হওয়ার উপক্রম হতেই পাশের ভদ্রলোক আব্বুকে প্রশ্ন করলেন:
    -কার জন্যেকিনলেন?
    -আমার ছোট্ট ছেলের জন্যে! কিনতে এসেছিলাম খেলনা! কিন্তু এত সুন্দর কুরআন শরীফ দেখে রেখে যেতে মন চাইল না!
    -বেশ করেছেন! আপনার ছেলেকে বলবেন:
    -তোমার অদেখা চাচ্চু বলেছেন, কুরআন কারীম বাইরে দেখতেই শুধু সুন্দর নয়, এর অর্থ আরও অনেক বেশি সুন্দর!
    .
    ব্যস! আব্বু ফিরে এসে হুবহু সেই চাচ্চুর কথা আমাকে বলেছেন। আমি আব্বুর কথা শোনার সাথে সাথে বললাম:
    -আব্বু! আমি কুরআনের অর্থ শিখব!
    আব্বু ভীষণ অবাক হলেন।সাথে সাথে বললেন: ঠিক আছে। তোমার দাদুর সাথে কথা বলে নিই!
    এরপর আর কী, কুরআন কারীম নিয়েই আছি।
    (শায়খ আবদুর রহমান আকল)।
    .
    (৪৮). বান্দা যখন খালেস নিয়তে আল্লাহর কালাম শোনে, আল্লাহ তাকে কালাম বোঝার তাওফীক দিয়ে দেন। তার কলবকে নূর দ্বারা পূর্ণ করে দেন (ইমাম কুরতুবী)।
    .
    (৪৯). কুরাআন আমার পক্ষের স্বাক্ষী হবে অথবা আমার বিপক্ষের স্বাক্ষী হবে (মুসলিম)।
    القرآن حُجَّةٌ لَكَ أَو عَلَيْك
    যাকে কুরআনের ইলম দান করা হয়েছে, কিন্তু সে এর দ্বারা উপকৃত হলো না, যে কুরআনের নিষেধসমূহ জানার পরও বিরত হল না, কুরআন তার বিরুদ্ধে স্বাক্ষী হবে (কুরতুবী)।
    .
    (৫০). অনেকে হৃদয়ের প্রশান্তির জন্যে, চিত্তশুদ্ধির জন্যে কসীদা শোনে, গান শোনে, সামা শোনে! এ-ধরনের লোকদের কুরআনের প্রতি আগ্রহ দিনদিন কমে যায়! এক সময় কুরআনের প্রতি ঘৃণাই জন্মে যায়। মনের শান্তির জন্যে বেশি বেশি গযল শোনাও ক্ষতিকর। কুরআনের প্রতি উদাসীনতা চলে আসে।
    .
    (৫১). ঈসা বিন ওয়ারদান রহ.-কে প্রশ্ন করা হল:
    -দুনিয়াতে আপনার একমাত্র চাওয়া কী?
    প্রশ্নটা শুনেই তিনি কেঁদে দিয়ে বললেন:
    -আমার চাওয়া হলো,, আমার বক্ষটা উন্মুক্ত করে দেয়া হবে, যাতে আমি দেখতে পারি, সারাজীবন কুরআন তিলাওয়াতের কী প্রভাব সেখানে পড়েছে!
    আমাদের সালাফগণ কুরআন কারীম নিয়ে এমনই বুঁদ ছিলেন।
    .
    (৫২). হাদীসে আছে, কুরআন শিক্ষাকারী ও শিক্ষাদানকারী ব্যক্তিই সর্বশ্রেষ্ঠ। এখানে শিক্ষা বলতে শুধু শব্দশিক্ষা নয়, বরং অর্থও উদ্দেশ্য। কারণ অর্থ শিক্ষার ফলেই ঈমানের বৃদ্ধি হয়। আবদুল্লাহ ইবনে উমার রা. বলেছেন:
    -আমরা আগে ঈমান শিখতাম তারপর কুরআন শিখতাম। ফলে আমাদের ঈমানে বৃদ্ধি ঘটতো। কিন্তু তোমরা এখন উল্টোটা করো। আগে শেখো কুরআন তারপর শেখো ঈমান।
    এজন্যই তারা একেকটা সূরা শিখতে দীর্ঘ দীর্ঘ সময় লাগিয়ে দিতেন।
    .
    (৫৩). কুরআন কারীমের প্রতিটি সূরা একটার সাথে আরেকটার যোগসূত্র আছে। এক আয়াতের সাথে আরেক আয়াতের সংযোগ আছে। সূরার প্রথম আয়াতের সাথে শেষ আয়াতের সংযোগ আছে। একসূরার শেষ আয়াতের সাথে পরের সূরার প্রথম আয়াতের সংযোগ আছে। এগুলো একটু চিন্তা করে করে তিলাওয়াত করলে, তাদাব্বুরটা সহজ হয়।
    .
    (৫৪). আল্লামা ইকবাল রহ. শেষ জীবনে তাদাব্বুরে কুরআনের প্রতি মুসলমানদেরকে উদ্বুদ্ধ করে বলতেন:
    -কুরআন কারীম নিছক একটা কিতাব নয়, তার চেয়েও বেশি কিছু।
    .
    (৫৫). কুরআন কারীমের সাথে গভীর সম্পর্ক রাখে এমন আলিম বর্তমানেও অনেক আছেন। একজন আলিম, বয়ান করতে গিয়ে, একটা বিষয় প্রমাণ করতে গিয়ে, বিভিন্ন আঙ্গিকে একশটা আয়াত উপস্থাপন করেছেন। শ্রোতাদের মনে হয়েছে, তাই তো, এ-বিষয়ে এতগুলো আয়াত আছে, আমাদের কল্পনাতেই ছিল না!
    .
    (৫৬). মানবজীবনের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হলো, আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে বলেছেন, জান্নাতের বিস্তৃতি আসমান-জমীনের সমান। কিন্তু অনেক মানুষ এই জান্নাতে একটা কদম রাখার স্থানও পাবে না।
    .
    (৫৭). কুরআন কারীমকে গানের সুরে প্রচার করার জন্যে একদল লোক উঠেপড়ে লেগেছে। এমনকি ইহুদি নাসারাদের পরিচালিত টিভি-রেডিওতেও এর বহুল প্রচার হচ্ছে। কারণ? তারা জানে, এই গীতালি কুরআন মৃতকে জীবিত করা তো দূরের কথা, যারা জীবিত আছে তাদেরকেও মৃত বানিয়ে ছাড়বে!
    .
    (৫৮). এটা স্বতঃসিদ্ধ বিষয়, কুরআন কারীমের ব্যাখ্যায় যত সুন্দর ভাষা, যত আকর্ষণীয় শব্দই ব্যবহার করা হোক, আল্লাহর কালামের সব ‘অর্থ’ প্রকাশ করা সম্ভব হবে না। বান্দার এ প্রয়াস হবে সিন্ধু থেকে বিন্দু আহরণের মতো। তাই একটা আয়াতের বাহ্যিক কিছু দিক বুঝে, সন্তুষ্ট হয়ে ভাবা ঠিক হবে না: এই আয়াতের সব বুঝে ফেলেছি। এই আয়াতে আর বোঝার কিছু বাকী নেই। এটা ভুল চিন্তা। একটা আয়াতের পুরোপুরি অর্থ অনুধাবন করতে পারা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। এজন্য বাহ্যিক অর্থ বোঝার পরও একটা আয়াত নিয়ে তাদাব্বুর চালিয়ে যেতে হবে।
    .
    (৫৯). কুরআন কারীমে ১৩০ বার ‘কলব’ শব্দটা উল্লেখ হয়েছে। কলবের সাথে ৩৬টারও বেশি ‘আমল’ ও গুণাবলীকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এতে করে কলবের গুরুত্ব বোঝা যায়। কলবই হলো শরীরের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের রাজা। মানুষ এই কলবের প্রতিই সবচেয়ে বেশি উদাসীন থাকে। কলবে পরিশুদ্ধ করার কোনও উদ্যোগ সে গ্রহণ করে না। অথচ শরীরের অন্যান্য অঙ্গ নিয়ে তার ভাবনার শেষ নেই। এই কলবকে ঠিক করার শ্রেষ্ঠ দাওয়াই হলো: কুরআন। তিলাওয়াত ও তাদাব্বুরের মাধ্যমে।
    .
    (৬০). কুরআন কারীম নাযিল করার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো:
    لِيَدَّبَّرُوا آيَاتِهِ وَلِيَتَذَكَّرَ أُولُو الْأَلْبَابِ
    যাতে মানুষ এর (আয়াতের) মধ্যে চিন্তা করে এবং যাতে বোধসম্পন্ন ব্যক্তিগণ উপদেশ গ্রহণ করে (সোয়াদ ২৯)।
    .
    (৬১). আমার ভীষণ অবাক লাগে, কুরআন তেলাওয়াত করে, অথচ তাদাব্বুর করে না, তাহলে যে কুরআন পাঠ করে কী মজা পায়?
    -ইবনে জারীর)।
    .
    (৬২). আমাদেরকে কুরআন কারীম দান করার উদ্দেশ্য হলো, আমরা কুরআন কারীম বুঝবো, বুঝ অনুযায়ী আমল করবো। যার এমন হিম্মত নেই সে প্রকৃত দ্বীনদারই নয় (সালাফ)।
    .
    (৬৩). কুরআন কারীমের আলোচনা করতে গেলে তিন শ্রেণীর মানুষ বের হয়:
    ক. কুরআন পাঠকে পরিত্যাগ করেছে। এদের বিরুদ্ধে নবীজি আল্লাহর কাছে অভিযোগ করেছেন।
    খ. কুরআন কারীম তিলাওয়াত করেন। তবে তাফসীর জানে না। তাদের জীবনে কুরআন কারীমের কোনও প্রভাবও দেখা যায় না।
    গ. কুরআন কারীম বোঝে। তাফসীরও বোঝে। কিন্তু তাদাব্বুর করে না।
    .
    (৬৪). যে তাদাব্বুর হৃদয়কে পরিবর্তন করে না, আমল পর্যন্ত নিয়ে যায় না, তা তাদাব্বুর হতে পারে না।
    হাসান বসরী রহ. বলেছেন ইলম দুই প্রকার:
    ক. কলবে বাস করে এমন ইলম। এটা উপকারী।
    গ. যবানে বা জিহ্বায় থাকে এমন ইলম। এটার জন্যে বান্দা আল্লাহর কাছে জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন হবে।
    .
    (৬৫). যারা আল্লাহর কিতাব তেলাওয়াত করে, নামায আদায় করে এবং আমি তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে (সৎকাজে) ব্যয় করে গোপনে ও প্রকাশ্যে, তারা এমন ব্যবসায়ের আশাবাদী, যাতে কখনও লোকসান হয় না (ফাতির ২৯)।
    إِنَّ الَّذِينَ يَتْلُونَ كِتَابَ اللَّهِ وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَأَنفَقُوا مِمَّا رَزَقْنَاهُمْ سِرًّا وَعَلَانِيَةً يَرْجُونَ تِجَارَةً لَّن تَبُورَ
    আল্লাহর কিতাব পাঠ করা লাভজনক ব্যবসা।
    .
    (৬৬). সবকিছুর যেমন প্রাণ আছে, কলবেরও প্রাণ আছে। কুরআন হলো সে প্রাণ। কুরআন কলবকে নূর হেদায়াত আদব প্রাণশক্তি সরবরাহ করে। হকের উপর অবিচলতা দান করে। অনেক আয়াতে এদিকে ইঙ্গিত আছে।
    .
    (৬৭). আমি মানুষের কল্যাণার্থে এসব দৃষ্টান্ত দিয়ে থাকি, কিন্তু তা বোঝে কেবল তারা, যারা জ্ঞানবান (আনকাবূত ৪৩)।
    وَتِلْكَ الْأَمْثَالُ نَضْرِبُهَا لِلنَّاسِ وَمَا يَعْقِلُهَا إِلَّا الْعَالِمُونَ
    তাদাব্বুরকারীদের প্রশংসা করা হয়েছে এই আয়াতে। তাদেকে জ্ঞানী বলেও স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। কারণ আল্লাহর বর্ণনা করা মেসাল (দৃষ্টান্ত) যে তারাই শুধু বোঝেন!
    .
    (৬৮). কিছু সময় একান্তে নিজের সাথে কাটাব। প্রশ্ন করবো, আমি কি তাদাব্বুর করি? এ-ব্যাপারে আমার শিথিলতা আছে? থাকলে আজ থেকে শুরু করবো। নিজে নিজে নয়। ওস্তাদের অধীনে। সালাফের রেখে যাওয়া আদর্শের উপর থেকে।
    .
    (৬৯). তাদাব্বুরের জন্যে ইখলাস ও নিয়তকে বিশুদ্ধ করা জরুরী। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
    -তাদেরকে কেবল এই আদেশই করা হয়েছিল যে, তারা আল্লাহর ইবাদত করবে, আনুগত্যকে একনিষ্ঠভাবে তাঁরই জন্যে খালেস রেখে (বায়্যিনা: ৫)।
    وما أمروا إلا ليعبدوا الله مخلصين له الدين حنفاء
    .
    (৭০). তাদাব্বুরের আগে নিয়ত করে নিতে হবে।
     — — আমাকে যেন সরল পথে পরিচালিত করা হয়। কারণ কুরআন হলো ঈমানদারদের জন্যে হোদায়ত ও রহমত (নামল ৭৭)।
    وَإِنَّهُ لَهُدًى وَرَحْمَةٌ لِّلْمُؤْمِنِينَ
    কুরআন কারীম আঁকড়ে ধরে থাকলেই আমরা সরল পথের উপর থাকতে পারবো। এটা নবীজি সা.-ও বলে গেছেন। আমি তোমাদের মাঝে দুটি বস্তু রেখে যাচ্ছি। সে দু’টি আঁকড়ে ধরলে কিছুতেই বিচ্যুত হবে না:
    ক. আল্লাহর কিতাব।
    খ. আমার সুন্নাত
    تركت فيكم شيئين لن تضلوا بعدهما : كتاب الله و سنتي
    .
    (৭১). তাদাব্বুরের সময় নিয়ত করবো, আমি যেন আল্লাহর পরিবারভুক্ত ও খাসলোক হতে পারি:
    إن لله أهلين من الناس قالوا من هم يا رسول الله قال أهل القرآن هم أهل الله وخاصته
    আল্লাহর পরিবারভুক্ত বিশেষ কিছু মানুষ আছে! তারা কারা? তারা আহলে কুরআন! (আহমাদ)।
    .
    (৭২). আমি কুরআন কারীম নিয়ে লেগে থাকছি, কুরআন কারীম আমার জন্যে সুপারিশকারী হয়:
     — — তোমরা কুরআন পড়ো। কারণ কুরআন কেয়ামতের দিন তার ধারকদের জন্যে সুপারিশকারী হবে (মুসলিম)।
    اقرؤوا القرآن فإنه يأتي يوم القيامة شفيعا لأصحاب
    কুরআনের তাদাব্বুর যে করে, তার চেয়ে বেশি কুরআনের ধারক আর কে হতে পারে?
    .
    (৭৩). তাদাব্বুরের সময় ভাবব, আল্লাহর যিকির দ্বারা আমি যেন প্রশান্তচিত্ত হতে পারি!
    الَّذِينَ آمَنُوا وَتَطْمَئِنُّ قُلُوبُهُم بِذِكْرِ اللَّهِ أَلَا بِذِكْرِ اللَّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ
    এরা সেই সব লোক, যারা ঈমান এনেছে এবং যাদের অন্তর আল্লাহর যিকিরে প্রশান্তি লাভ করে। স্মরণ রেখ, কেবল আল্লাহর যিকিরই সেই জিনিস, যা দ্বারা অন্তরে প্রশান্তি লাভ হয় (রা‘দ: ২৮)।
    .
    (৭৪). তাদাব্বুরের সময় নিয়ত করবো, আমি যেন যাবতীয় রোগ বালাই থেকে শিফা লাভ করি। কারণ কুরআন তো আমাদের জন্যে শি‘ফা।
    .
    (৭৫). তাদাব্বুরের সময় নিয়ত করবো, আমি যেন আনুগত্যের উপর অবিচল থাকতে পারি:
    كَذَٰلِكَ لِنُثَبِّتَ بِهِ فُؤَادَكَ ۖ وَرَتَّلْنَاهُ تَرْتِيلًا
    (হে নবী!) আমি এরূপ করেছি এর মাধ্যমে আপনার অন্তর মজবুত রাখার জন্যে আর আমি এটা পাঠ করিয়েছি থেমে থেমে (ফুরকান ৩২)।
    .
    (৭৬). তাদাব্বুরের আরেকটি মাধ্যম হলো শব্দের অর্থ বোঝা! তাদাব্বুরের জন্যে কুরআন কারীমের অর্থ বুঝতে হবে!
    وَلَقَدْ ضَرَبْنَا لِلنَّاسِ فِي هَٰذَا الْقُرْآنِ مِن كُلِّ مَثَلٍ لَّعَلَّهُمْ يَتَذَكَّرُونَ قُرْآنًا عَرَبِيًّا غَيْرَ ذِي عِوَجٍ لَّعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ
    -বস্তুত আমি এ কুরআনে মানুষের জন্যে সব রকমের দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছি, যাতে মানুষ শিক্ষা গ্রহণ করে। এটা আরবী কুরআন, এতে কোনও বক্রতা নেই, যাতে মানুষ তাকওয়া অবলম্বন করে (যুমার: ২৭-২৮)।
     — — আরবী না বুঝলে কিভাবে তাদাব্বুর করবে? একজন অত্যন্ত বড় আলিম বলেছেন: তিলাওয়াতের সময় কোনও আয়াত না বুঝতে পারলে, ভীষণভাবে মুষড়ে পড়ি। একজন আলিমের যদিএমন অনুভূতি হয়, আমার মতো যারা সাধারণ, তাদের কী অবস্থা হওয়া উচিত!
    .
    (৭৭). সাহাবায়ে কেরাম কোনও আয়াতের অর্থ বুঝতে না পারলে, থেমে যেতেন। না বুঝে সামনে অগ্রসর হতেন না। ইবনে যোবায়ের রা. বলেছেন, একটা আয়াত বুঝতে পারছিলাম না। নির্ঘুম রাত কেটে গেল। সকালে ইবনে আব্বাস রা. বুঝিয়ে দিয়েছেন। আয়তটি ছিল:
    وَمَا يُؤْمِنُ أَكْثَرُهُم بِاللَّهِ إِلَّا وَهُم مُّشْرِكُونَ
    তাদের মধ্যে অধিকাংশ লোকই এমন যে, তারা আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখলেও তা এভাবে যে, তাঁর সঙ্গে শরীক করে (ইউসুফ ১০৬)।
    .
    (৭৮). তাদাব্বুর করতে বসলে:
    ক. তাদাব্বুরের সময় মূল কুরআনের পাশে তরজমা ও তাফসীর আছে এমন ‘মুসহাফ’ নিয়ে বসা।
    খ. সাথে কাগজ রাখা। কোনও প্রশ্ন জাগলে সেটা টুকে রাখা। পরে জেনে নেয়ার জন্যে।
    গ. এভাবে পড়তে গিয়ে যদি একপৃষ্ঠা শেষ করতে যদি দীর্ঘ সময়ও লেগে যায় বিরক্ত না হওয়া।
    .
    (৭৯). তাদাব্বুরের জন্যে একটা আয়াতকে বারবার আওড়ানো।
    তামীম দারী রা. একটা আয়াত পড়তে পড়তে পুরো রাত কাটিয়ে দিয়েছেন;
    أَمْ حَسِبَ الَّذِينَ اجْتَرَحُوا السَّيِّئَاتِ أَنْ نَجْعَلَهُمْ كَالَّذِينَ آَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ سَوَاءً مَحْيَاهُمْ وَمَمَاتُهُمْ سَاءَ مَا يَحْكُمُونَ
    যারা অসৎ কার্যাবলীতে লিপ্ত হয়েছে, তারা কি ভেবেছে আমি তাদেরকে সেই সকল লোকের সম গণ্য করব, যারা ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে, ফলে তাদের জীবন ও মরণ একই রকম হয়ে যাবে? তারা যা সিদ্ধান্ত করে রেখেছে তা কতই না মন্দ (জাসিয়া: ২১)।
     — — সালাফের অভ্যেসই ছিল এমন। তারা একটি আয়াত নিয়ে রাত ভোর করে দিয়েছেন।
    .
    (৮০). কুরআন পাঠের সময় কল্পনা করা, আমি এখন ররেব কালাম পড়তে যাচ্ছি। আল্লাহর বড়ত্ব ও মহত্ব মনে হাজির রাখা। যদি পড়ার সময় তাদাব্বুরের দিকে মন না যায়, বারবার পড়তে থাকা। সায়ীদ ইবনু জোবায়ের রহ. একটা আয়াতকে বিশবারেরও বেশি পড়েছেন:
    وَاتَّقُوا يَوْمًا تُرْجَعُونَ فِيهِ إِلَى اللَّهِ
    এবং তোমরা সেই দিনকে ভয় কর, যখন তোমরা সকলে আল্লাহর কাছে ফিরে যাবে (বাকারা: ২৮১)।
    .
    (৮১). তাদাব্বুরের জন্যে তারতীরে সাথে পড়া। আলকামাহ খুব তাড়াহুড়ো করে কুরআন তিলাওয়াত করছিলেন। ইবনে মাসউদ দেখে বললেন:
    رتل فإنه زين القرآن
    তারতীলের সাথে ধীরে ধীরে তিলাওয়াত করো। কারণ এভাবে পড়ার মাঝেই কুরআনের সৌন্দর্য নিহিত! (বায়হাকী)।
    .
    (৮২). হাফসা রা. বলেছেন: আল্লাহর রাসূল থেমে থেমে তিলাওয়াত করতেন। তার তিলাওয়াত দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকতো (মুসলিম)।
    .
    (৮৩) আমি কুরআনকে আলাদা আলাদা অংশ করে দিয়েছি, যাতে আপনি মানুষের সামনে থেমে থেমে পড়তে পারেন আর আমি এটা নাযিল করেছি অল্প-অল্প করে (ইসরা: ১০৬)।
    وَقُرْآنًا فَرَقْنَاهُ لِتَقْرَأَهُ عَلَى النَّاسِ عَلَىٰ مُكْثٍ وَنَزَّلْنَاهُ تَنزِيلًا
    নাযিলই করা হয়েছে ধীরে ধীরে। এবং তিলাওয়াতও করতে হবে ধীরে ধীরে! থেমে থেমে!
    .
    (৮৪)তাদাব্বুর করতে বসলে, নিজেকে শুনিয়ে তিলাওয়াত করবো। বেশি জোরে নয় আবার। আবার ফিসফিস করেও নয়।
    -আপনি নিজের নামাজ বেশি উঁচু স্বরে পড়বেন না এবং অতি নিচু স্বরেও নয়; বরং উভয়ের মাঝামাঝি পন্থা অবলম্বন করবেন (ইসরা: ১১০)।
    وَلَا تَجْهَرْ بِصَلَاتِكَ وَلَا تُخَافِتْ بِهَا وَابْتَغِ بَيْنَ ذَلِكَ سَبِيلًا
    .
    (৮৫). হাদীস শরীফেও সুন্দর কথা আছে:
    مَا أَذِنَ اللَّهُ لِشَيْءٍ مَا أَذِنَ لِنَبِيٍّ حَسَنِ الصَّوْتِ يَتَغَنَّى بِالْقُرْآنِ ، يَجْهَرُ بِهِ
    নবী সুর করে জোর আওয়াজে কুরআন-পাঠ আল্লাহ তা‘আলা খুবই আগ্রহ করে শোনেন। অন্য কিছু এতটা আগ্রহের সাথে শোনেন না (মুত্তাফাক)।
    .
    (৮৬). একরাতে নবীজি বের হলেন। আবু বাকরকে দেখলেন নিন্মস্বরে নামাজে কুরআন তিলাওয়াত করছেন। উমারকে দেখলেন উচ্চ আওয়াজে নামাজে তিলাওয়াত করছেন। পরে আবু বকরকে বললেন
    -তোমাকে দেখলাম মৃদুস্বরে তিলাওয়াত করছ!
    -যার উদ্দেশ্যে তিলাওয়াত করছি, তিনি তো আস্তে বললেও শোনেন!
    -আর উমার! তোমাকে দেখলাম বেশ জোরে তিলাওয়াত করছ?
    -ঘুমন্তদের জাগিয়ে দেয়ার জন্যে, শয়তানকে তাড়িয়ে দেয়ার জন্যে!
    -আবু বাকর তুমি আরেকটু জোরে পড়বে! উমার তুমি আরেকটু নিচু আওয়াজে পড়বে! (তিরমিযি)
    .
    (৮৭). তাদাব্বুরের সময় সাধ্যানুযায়ী সুরেলা কণ্ঠে কুরআন পড়া।
    নবীজি সাহাবায়ে কেরামকে সুর করে কুরআন পাঠের প্রতি উদ্বুদ্ধ করতেন। যারা সুর করে কুরআন পাঠ করতেন, তাদের প্রশংসা করতেন।
    إن من أحسن الناس صوتا بالقرآن الذي إذا سمعتموه يقرأ حسبتموه يخشى الله
    -যার কুরআন পাঠ শুনলে মনে, সে আল্লাহকে ভয় করে করে পড়ছে, সেই সবচেয়ে সুন্দর তিলাওয়াতকারী (ইবনে মাজাহ)।
    .
    (৮৯). তোমরা কুরআন পড়ার সময় স্বরকে সুন্দর করো (আবু দাউদ)।
    زينوا القرآن بأصواتكم
    .
    (৯০). যে ব্যক্তি কুরআনকে সুন্দর করে পড়ে না, সে আমাদের দলভুক্তই নয় (মুসলিম)
    ليس منا من لم يتغن بالقرآن
    .
    (৯১). বারা বিন আযিব রা. বলেছেন:
    নবীজি ঈশার নামাজে সূরা ত্বীন পড়েছেন। তার চেয়ে সুন্দর স্বর আর কারো শুনিনি (মুত্তাফাক)।
    .
    (৯২). কুরআনকে সুন্দর করে পড়লে, ভাবটা হৃদয়ে ছাপ ফেলে। গলা সুন্দর না হলেও, সাধ্যমতো সুন্দর করার চেষ্টা করা।
    .
    (৯৩). আবু মুসা আশ‘আরী রা.-এর কুরআন পাঠ খুবই সুন্দর ছিল। নবীজি তার প্রশংসা করে বলেছেন:
    -তোমাকে দাউদী বাঁশীর সুরের কিছুটা দেয়া হয়েছে!
    -ইশ! ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি যদি জানতাম আপনি আমার কুরআন-পাঠ শুনছেন তাহলে আরও সুন্দর করে পড়ার চেষ্টা করতাম!
    .
    (৯৪). কুরআন কারীমকে সুর করে পড়া দু’প্রকার:
    ক. স্বাভাবিক সুর। কৃত্রিমতা নেই। এটা প্রশংসিত।
    খ. কৃত্রিম সুর। গানের মতো করে পড়া। এটা নিন্দনীয়।
    .
    (৯৫). তাদাব্বুরের জন্যে কুরআন পড়তে বসার আগে গুনাহমুক্ত হয়ে নেয়া। অহংকার হিংসা ও অন্যান্য আত্মিক রোগ থেকে শুদ্ধ হয়ে নেয়া। কারণ এগুলো হলো মরিচা। কুরআনকে কলবে প্রবেশ করতে দেয় না। কুরআন কারীমে আছে:
    سَأَصْرِفُ عَنْ آيَاتِيَ الَّذِينَ يَتَكَبَّرُونَ فِي الْأَرْضِ بِغَيْرِ الْحَقِّ
    পৃথিবীতে যারা অন্যায়ভাবে অহংকার প্রকাশ করে, তাদেরকে আমি আমার নিদর্শনাবলী হতে বিমুখ করে রাখব (আ‘রাফ: ১৪৬)।
    মনে অহংকার থাকলে কুরআনের আলো কলবে প্রবেশ করবে না।
    .
    (৯৬). ইবনে কুদামা রহ. বলেছেন:
    -কুরআন বোঝার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক তিনটি:
    ক. গুনাহে লেগে থাকা।
    খ. অহংকার থাকা।
    গ. প্রবৃত্তির পূজারী হওয়া।
    এগুলো কলবকে জং ধরিয়ে দেয়।
    .
    (৯৭). তাদাব্বুরের জন্যে কুরআন কারীমকে মুখস্থ পড়া। তাদাব্বুরের জন্যে এটা অত্যন্ত উপকারী।
    একজন দেখে পড়ে তাদাব্বুর করছে, আরেকজন মুখস্থ পড়ে তাদাব্বুর করছে, দু’জনের মধ্যে তুলনাই চলে না। মুখস্থ পড়ার মানে হলো, সে এর আগেও আয়াতটা বহুবার পড়ছে। এই আয়াতের সাথে তার সম্পর্ক অনেক পুরনো। গভীর।
    .
    (৯৮). আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
    بَلْ هُوَ آيَاتٌ بَيِّنَاتٌ فِي صُدُورِ الَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ
    প্রকৃতপক্ষে এ কুরআন এমন নিদর্শনাবলীর সমষ্টি, যা জ্ঞানপ্রাপ্তদের অন্তরে সুষ্পষ্ট (আনকাবূত ৪৯)।
    আল্লাহর আয়াত যাদের বক্ষে ধারণ করা আছে, তাদের চেয়ে সেরা আর কে হতে পারে!
    .
    (৯৯). নবীজি বলেছেন:
    لا حسد إلا في اثنتين : رجل آتاه الله القرآن فهو يقوم به آناء الليل و آناء النهار
    হিংসা নিন্দনীয়, তবে দু’টি ব্যাপারে হিংসা (গিবতা) চলতে পারে, তার একটি হলো:
    এক ব্যক্তিকে আল্লাহ তা‘আলা কুরআন দান করেছেন, সে রাতে ও দিনে কুরআন পড়েধ! (তাকে এ-কাজের জন্যে ঈর্ষা করা যেতে পারে) মুসলিম।
    .
    (১০০). সাহল বিন আবদুল্লাহ এক ছাত্রকে প্রশ্ন করলেন:
    -তুমি কুরআন হিফজ করেছ?
    -জ্বি না!
    -কুরআন হিফজ করে না এমন মুমিনের জন্যে আফসোস! কুরআন হিফজ না করলে সে দিয়ে সুর করবে, আনন্দ লাভ করবে?
    .
    (১০১). নিজের হিফজ থেকে মুখস্থ তাদাব্বুর করার বড় সুবিধা হলো, ইচ্ছেমতো যে কোনও সময় তাদাব্বুর করতে পারা। ইচ্ছেমতো কুরআন কারীম থেকে আয়াত বের করে আনতে পারা!
    হাঁ, দেখে দেখে পড়লে সওয়াব বেশি।
    প্রথমত, পড়ার ইবাদত
    দ্বিতীয়ত, কুরআন কারীমের দিকে তাকানোর ইবাদত।
    তবে আমরা বলছি তাদাব্বুরের কথা। তিলাওয়াতের কথা নয়। তাদাব্বুর মুখস্থ করাই বেশি ফলদায়ক। তবে কথা হল, আমার যদি দেখে দেখে তাদাব্বুর করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ হয়, তাহলে দেখে দেখে তাদাব্বুর করাই আমার জন্যে উত্তম। মুখস্থ পড়ার বাড়তি উপকার হলো, মনটা বিক্ষিপ্ত হওয়ার সুযোগ কম থাকে।
    .
    (১০২). তাদাব্বুরের জন্যে সহায়ক হলো, তাহাজ্জুদে কুরআন পাঠ।
    আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
    إِنَّ نَاشِئَةَ اللَّيْلِ هِيَ أَشَدُّ وَطْئًا وَأَقْوَمُ قِيلًا
    অবশ্যই রাত্রিকালের জাগরণ এমনই কর্ম যা দ্বারা কঠিনভাবে প্রবৃত্তির দলন হয় এবং কথাও বলা হয় উত্তমভাবে (মুযযাম্মিল ৬)।
    .
    (১০৩). রাতের গভীরে তিলাওয়াত সত্যিই প্রভাবশালী। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেছেন:
    أَمَّنْ هُوَ قَانِتٌ آنَاءَ اللَّيْلِ سَاجِدًا وَقَائِمًا يَحْذَرُ الْآخِرَةَ وَيَرْجُو رَحْمَةَ رَبِّهِ ۗ قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ
    তবে কি (এরূপ ব্যক্তি সেই ব্যক্তির সমতুল্য হতে পারে,) যে রাতের মুহূর্তগুলোর ইবাদত করে,কখনও সিজদাবস্থায়, কখনও দাঁড়িয়ে, যে আখেরাতকে ভয় করে এবং নিজ প্রতিপালকের রহমতের আশা করে? বল, যে ব্যক্তি জানে আর যে জানে না উভয়ে কি সমান? (যুমার: ৯)।
    .
    (১০৪). নবীজি সা. বলেছেন:
    الصيام و القرآن يشفعان للعبد يوم القيامة … يقول القرآن : رب منعته النوم بالليل فشفعني فيه فيشفعان
    সিয়াম ও কুরআন কেয়ামতের দিন বান্দার জন্যে সুপারিশ করবে। কুরআন বলবে: রাব্বি, আমি তাকে রাতে ঘুমুতে বাধা দিয়েছি, আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন! (আহমাদ)।
    .
    (১০৫). অন্তত দু‘রাকাত হলেও তাহাজ্জুদ পড়া দরকার। ছোট্ট একটা সূরা হলেও তাদাব্বুর করে করে তিলাওয়াত করতে খুব বেশি সময় লাগার কথা নয়!
    .
    (১০৬). তাদাব্বুরের স্তর আছে:
    চিন্তা-ভাবনা ও শিক্ষাগ্রহণ। কুরআন কারীমের বহু আয়াতে এদিকে ইশারা আছে:
    হয়তো তোমরা চিন্তা করবে (لعلكم تتفكرون)।
    চিন্তাশীল কওমের জন্যে রয়েছে নিদর্শনাবলী (لآيات لقوم يتفكرون)।
    .
    (১০৭). সূরা আলে ইমরানের শেষদিকের আয়াতগুলো নাযিল হলে, নবীজি কেঁদে দিয়ে বললেন;
    لقد نزلت عليَّ الليلة آية، ويل لمن قرأها ولم يتفكر فيها
    আজ রাতে আমার উপর একটা আয়াত (১৯০) নাযিল হয়েছে। দুর্ভোগ! যে এই আয়াত পড়বে অথচ আয়াতটা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করবে না!
    .
    (১০৮). ফিকর হলো কলবের আমল। কলবের নূর হলো চিন্তা-অনুধ্যান।
    তাদাব্বুর মানে একটা আয়াত নিয়ে চিন্তা করা। আয়াতের শব্দগুলো নিয়ে ভাবা। শব্দটা কী কী অর্থ হতে পারে!
    .
    (১০৯). আমি তাদাব্বুর করার সময় ভাববো, আমার অবস্থার সাথে সালাফের অবস্থা তুলনা করে দেখবো। একটা আয়াতে কোনও গুণাবলীর কথা বর্ণিত হলে, সেটা আমার মধ্যে আছে কি না, যাচাই করে দেখবো। নিজেকে প্রশ্ন করবো: আমি কি প্রকৃত মুমিন? সূরা আনফালের শুরুতে বলা মুনিনের গুণাবলী কি আমার মধ্যে আছে?
    .
    (১১০). তাদাব্বুরের আরেকটি স্তর হলো:
    কুরআন কারীম দ্বারা প্রভাবিত হওয়া ও হৃদয় বিগলিত হওয়া।
    আয়াত নিয়ে চিন্তা-ভাবনা ও তাদাব্বুরের পর আমার কলবে কোনও প্রভাব পড়ে? আমার চিত্তের কোনও ধরনের উত্তরণ ঘটেছে? চক্ষু অশ্রুসিক্ত হয়েছে? মনটা নরম হয়েছে?
    .
    (১১১). নবীজি মৃত্যুশয্যায় শায়িত। আবু বকরকে ইমামতি করার জন্যে খবর পাঠালেন। আয়েশা রা. বললেন:
    -আবু বকর কোমল হৃদয়ের মানুষ! নামায পড়াতে গেলে কান্না রোধ করতে পারবে না! (কুরআন পাঠ করতে গেলে, কান্না চলে আসবে)।
    .
    (১১২). হাসান বসরী রা. বলেছেন: মিষ্টতা খোঁজ তিন বস্তুতে! সালাতে, কুরআনে ও যিকিরে। যদি মিষ্টতা পাও, ভাল কথা। নইলে জেনে রাখ তোমার জন্যে আল্লাহর রহমতের দরজা বন্ধ! খোলার ব্যবস্থা করো!
    .
    (১১৩). তাদাব্বুরের আরেকটি স্তর হলো:
    সাড়াদান ও আনুগত্য! আমি যা পড়ছি, তা মানছি তো? আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
    اتبعوا ما أنزل إليكم من ربكم
    (হে মানুষ!) তোমাদের প্রতি তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে যে কিতাব নাযিল করা হয়েছে, তার অনুসরণ কর (আ‘রাফ: ৩)।
    .
    (১১৪). সাহাবায়ে কেরাম দশটা আয়াত শিখতেন। সেগুলোর উপর আমল না করে সামনে বাড়তেন না। তারা প্রতিটি আয়াত নিয়ে গভীর চিন্তা ভাবনা করতেন।
    .
    (১১৫). সুফিয়ান সাওরী রহ. বলেছেন: মায়েদার ৬৮তম আয়াতটাকে আমার অত্যন্ত ভারী মনে হতো:
    قُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لَسْتُمْ عَلَى شَيْءٍ حَتَّى تُقِيمُوا التَّوْرَاةَ وَالْإِنجِيلَ وَمَا أُنزِلَ إِلَيْكُم مِّن رَّبِّكُمْ
    বলে দাও, হে কিতাবীগণ! তোমরা যতক্ষণ পর্যন্ত তাওরাত ও ইঞ্জিল এবং (এখনও) যে কিতাব তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে তোমাদের উপর নাযিল করা হয়েছে, তার যথাযথ অনুসরণ না করবে, ততক্ষণ তোমাদের কোনও ভিত্তি নেই!
    এ-আয়াতে যথাযথ অনুসরণ মানে ‘বোঝা ও আমল করা! আমরা কি কুরআন কারীমকে যথাযথ বুঝছি? আমল করছি?
    .
    (১১৬). ইবনে মুফলিহ রহ. বলেছেন:
    তোমার ঘরে কুরআন কারীম আছে, আর তুমি কুরআনে বর্ণিত নিষেধাজ্ঞাগুলোতে দেদারসে লিপ্ত হচ্ছো, আমার ভয় হয়, তুমি এই আয়াতের হুমকির আওতায় চলে আসো কি না!
    فَنَبَذُوهُ وَرَاءَ ظُهُورِهِمْ
    অতঃপর তারা এ প্রতিশ্রুতিকে তাদের পেছন দিকে ছুড়ে মারে (আলে ইমরান ১৮৭)।
    .
    (১১৭). আমি কুরআন পড়ি কিন্তু মানি না, তাহলে আমি বড় জালিম:
    وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّن ذُكِّرَ بِآيَاتِ رَبِّهِ فَأَعْرَضَ عَنْهَا وَنَسِيَ مَا قَدَّمَتْ يَدَاهُ إِنَّا جَعَلْنَا عَلَىٰ قُلُوبِهِمْ أَكِنَّةً أَن يَفْقَهُوهُ وَفِي آذَانِهِمْ وَقْرًا وَإِن تَدْعُهُمْ إِلَى الْهُدَىٰ فَلَن يَهْتَدُوا إِذًا أَبَدًا
    সেই ব্যক্তি অপেক্ষা বড় জালেম আর কে হতে পারে, যাকে তার প্রতিপালকের আয়াতসমূহের মাধ্যমে উপদেশ দেওয়া হলে সে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং নিজ কৃতকর্মসমূহ ভুলে যায়? বস্তুত আমি (তাদের কৃতকর্মের কারণে) তাদের অন্তরের উপর ঘেরাটোপ লাগিয়ে দিয়েছি, যদ্দরুণ তারা এ কুরআন বুঝতে পারে না এবং তাদের কানে ছিপি এঁটে দিয়েছি। সুতরাং তুমি তাদেরকে হিদায়াতের দিকে ডাকলেও তারা কখনও সৎপথে আসবে না (কাহফ: ৫৭)।
    .
    (১১৮). তাদাব্বুর করলেই হবে না, কুরআনের হুকুমকে মাথা পেতে গ্রহণ করতে হবে:
    خُذُوا مَا آتَيْنَاكُم بِقُوَّةٍ وَاسْمَعُوا
    আমি তোমাদেরকে যা-কিছু দিয়েছি তা শক্ত করে ধর। এবং (যা-কিছু বলা হয়, তা) শোন (বাকারা ৯৩)।
    .
    (১১৯). আমরা কিভাবে কুরআন দ্বারা প্রভাবিত হতে পারি? কুরআনের প্রতি গভীর আস্থা ও অনুরাগ। বিশ্বাস করা, এই কুরআন আল্লাহর কালাম।
    .
    (১২০). পূত-পবিত্র গুনাহমুক্ত জীবন যাপন করা। যার কলবটা জীবন্ত সেই কুরআন দ্বারা প্রভাবিত হয়।
    إِنْ هُوَ إِلَّا ذِكْرٌ وَقُرْآنٌ مُّبِينٌ لِّيُنذِرَ مَن كَانَ حَيًّا
    এটা তো এক উপদেশবাণী এবং এমন কুরআন যা সত্যকে সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করে। যাতে প্রত্যেক জীবিতজনকে সতর্ক করে দেয় (ইয়াসীন ৬৯-৭০)।
    .
    (১২১). মনোযোগ দিয়ে কুরআন কারীম শোনা। তাহলে কলবটা নরম হবে। প্রভাবিত হবে। তাদাব্বুরটা আন্তরিক হবে।
    لِنَجْعَلَهَا لَكُمْ تَذْكِرَةً وَتَعِيَهَا أُذُنٌ وَاعِيَةٌ
    এই ঘটনাকে তোমাদের জন্য শিক্ষণীয় বানানোর জন্যে এবং যাতে এটা (শুনে) স্মরণ রাখে সেই কান, যা স্মরণ রাখতে সক্ষম (হাক্কাহ: ১২)।
    .
    (১২২). সুফিয়ান ইবনু উয়াইনা রহ. বলেছেন:
    -ইলমের সূচনা হলো শোনার মাধ্যমে। তারপর বোঝা তারপর মুখস্থ তারপর আমল তারপর প্রচার।
    আমি কোন ধাপে আছি? কুরআন কারীমকে শুধুই শুনছি? শুধুই মুখস্থ করছি? আমল করছি? প্রচার করছি?
    .
    (১২৩). কুরআন কারীমকে ভাল করে বুঝতে হলে ভাল করে শুনতে হবে:
    والذين اجتنبوا الطاغوت أن يعبدوها وأنابوا إلى الله لهم البشرى فبشر عباد الذين يستمعون القول فيتبعون أحسنه أولئك الذين هداهم الله وأولئك هم أولو الألباب
    যারা তাগুতের পূজা পরিহার করেছে ও আল্লাহর অভিমুখী হয়েছে, সুসংবাদ তাদেরই জন্য। সুতরাং আামার সেই বান্দাদেরকে সুসংবাদ শোনাও। যারা কথা শোনে মনোযোগ দিয়ে, অতঃপর তার মধ্যে যা-কিছু উত্তম তার অনুসরণ করে, তারাই এমন লোক, যাদেরকে আল্লাহ হেদায়াত দান করেছেন এবং তারাই বোধশক্তিসম্পন্ন (যুমার ১৭-১৮)।
    = এ-আয়াতে মনোযোগ দিয়ে শোনার কথা বলা হয়েছে।
    .
    (১২৪). আল্লাহর প্রশংসিত বান্দা কারা?
    وَالَّذِينَ إِذَا ذُكِّرُوا بِآيَاتِ رَبِّهِمْ لَمْ يَخِرُّوا عَلَيْهَا صُمًّا وَعُمْيَانًا
    এবং যখন তাদের প্রতিপালকের আয়াত দ্বারা তাদেরকে উপদেশ দেওয়া হয়, তখন তারা বধির ও অন্ধরূপে তার উপর পতিত হয় না (ফুরকান: ৭৩)।
    .
    (১২৫). মনোযোগ দিয়ে শোনা মুমিনের লক্ষণ পক্ষান্তরে কাফেরের লক্ষণ?
    كِتَابٌ فُصِّلَتْ آيَاتُهُ قُرْآنًا عَرَبِيًّا لِّقَوْمٍ يَعْلَمُونَ بَشِيرًا وَنَذِيرًا فَأَعْرَضَ أَكْثَرُهُمْ فَهُمْ لَا يَسْمَعُونَ
    আরবী কুরআনরূপে এটি এমন কিতাব, জ্ঞান অর্জনকারীদের জন্যে যার আয়াতসমূহ বিশদভাবে বিবৃত হয়েছে। এ কুরআন সুসংবাদদাতাও এবং সতর্ককারীও বটে। তা সত্ত্বেও তাদের অধিকাংশই মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। ফলে তারা শুনতে পায় না (ফুসসিলাত ৩-৪)।
    .
    (১২৬). কাফেররা সব সময়ই কুরআনবিমুখ:
    وَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا لا تَسْمَعُوا لِهَذَا الْقُرْآنِ وَالْغَوْا فِيهِ لَعَلَّكُمْ تَغْلِبُونَ
    এবং কাফেররা (একে অন্যকে) বলে, এই কুরআন শুনো না এবং এর (পাঠের) মাঝে হট্টগোল কর, যাতে তোমরা জয়ী থাক (ফুসসিলাত: ২৬)।
    .
    (১২৭). না শোনার মানসিকতার অধিকারীকে আল্লাহ হুমকি দিয়েছেন:
    وَيْلٌ لِّكُلِّ أَفَّاكٍ أَثِيمٍ يَسْمَعُ آيَاتِ اللَّهِ تُتْلَى عَلَيْهِ ثُمَّ يُصِرُّ مُسْتَكْبِرًا كَأَن لَّمْ يَسْمَعْهَا فَبَشِّرْهُ بِعَذَابٍ أَلِيمٍ
    দুর্গতি হোক প্রত্যেক এমন মিথ্যুক পাপিষ্ঠের- যে আল্লাহর আয়াতসমূহ শোনে, যখন তাকে পড়ে শোনানো হয়, কিন্তু তা সত্ত্বেও সে ঔদ্ধত্যের সাথে এমনভাবে (কুফরের উপর) অটল থাকে, যেন আয়াতসমূহ শোনেইনি। সুতরাং এমন ব্যক্তিকে যন্ত্রণাময় শাস্তির সুসংবাদ শোনাও (জাসিয়া: ৭-৮)।
    .
    (১২৮). তারা আল্লাহর আয়াত না শোনার কারণে অচিরেই অনুতপ্ত হবে। কিন্তু সেটা তাদের কোনও কাজে আসবে না:
    وَقَالُوا لَوْ كُنَّا نَسْمَعُ أَوْ نَعْقِلُ مَا كُنَّا فِي أَصْحَابِ السَّعِيرِ فَاعْتَرَفُوا بِذَنبِهِمْ
    এবং তারা বলবে, আমরা যদি শুনতাম এবং বুদ্ধিকে কাজে লাগাতাম, তবে (আজ) আমরা জাহান্নামীদের অন্তর্ভুক্ত হতাম না। এভাবে তারা নিজেরা নিজেদের গোনাহ স্বীকার করবে (মুলক ১০-১১)।
    .
    (২২৯). কুরআন কারীমকে উপেক্ষা করার মতো বড় পাপ আর হতে পারে না:
    وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّن ذُكِّرَ بِآيَاتِ رَبِّهِ ثُمَّ أَعْرَضَ عَنْهَا ۚ إِنَّا مِنَ الْمُجْرِمِينَ مُنتَقِمُونَ
    সেই ব্যক্তি অপেক্ষা বড় জালেম আর কে হতে পারে, যাকে তার প্রতিপালকের আয়াতসমূহ দ্বারা নসীহত করা হলে সে তা হতে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আমি অবশ্যই এরূপ জালেমদের থেকে বদলা নিয়ে ছাড়ব (সাজদা ২২)।
    .
    (১৩০). আল্লাহ আমার ডাকে কখন সাড়া দেবেন?
    إِنَّمَا يَسْتَجِيبُ الَّذِينَ يَسْمَعُونَ
    কথা তো কেবল তারাই মানতে পারে, যারা (সত্যের আকাঙ্খী হয়ে) শোনে (আনআম :৩৬)।
     — — — সত্যের অন্বেষী হয়ে শুনলে, উপকৃত হবেই।
    .
    (১৩১). আমি যদি মুমিন হই, তাহলে কুরআন আমার জন্যে। আমাকে মনে করতে হবে, কুরআন আমাকেই সম্বোধন করছে:
    لَقَدْ كَانَ فِي قَصَصِهِمْ عِبْرَةٌ لِّأُولِي الْأَلْبَابِ ۗ مَا كَانَ حَدِيثًا يُفْتَرَىٰ وَلَٰكِن تَصْدِيقَ الَّذِي بَيْنَ يَدَيْهِ وَتَفْصِيلَ كُلِّ شَيْءٍ وَهُدًى وَرَحْمَةً لِّقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ
    নিশ্চয়ই তাদের ঘটনায় বোধসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্যে শিক্ষা গ্রহণের উপাদান রয়েছে। এটা এমন কোনও বাণী নয়, যা মিছামিছি গড়ে নেয়া হয়েছে। বরং এটা এর পূর্ববর্তীদের কিতাবসমূহের সমর্থক, সবকিছুর বিশদ বিবরণ এবং যারা ঈমান আনে তাদের জন্যে হিদায়াত ও রহমতের উপকরণ (ইউসুফ: ১১১)।
    .
    (১৩২). ইবনে মাসউদ রা. বলেছেন:
    কুরআন তিলাওয়াতকালে যখনই তুমি দেখবে
    হে মুমিনগণ! (يا أيها الذين آمنوا)!
    তুমি পরিপূর্ণ সজাগ হয়ে যাবে। সামনে কী বিধান আসছে সেটার গ্রহণ করার জন্যে। আদেশ হলে মেনে নিবে। নিষেধ হলে বিরত থাকবে।
    .
    (১৩৩). ইবনে কুদামাহ বলেছেন:
    -কুরআন পাঠকারীর জানা উচিত, কুরআনের সম্বোধনের উদ্দেশ্য কী? হুমকিগুলোর উদ্দেশ্য কী? কুরআনের গল্পগুলো নিছক সময় কাটানোর জন্যে বিবৃত হয় নি। শিক্ষাগ্রহণ করার জন্যে বর্ণিত হয়েছে। মনে করবে, আমি দাস, মনিবের পক্ষ থেকে চিঠি এসেছে। সেটা পড়ছি।
    .
    (১৩৪). ইমাম গাযালী বলেছেন:
    -ভয়ের আয়াত পড়ার সময় এমন ভান করতে হবে, যেন ভয়ে মরে যাচ্ছি। আনন্দের আয়াত এলে এমন ভাব করতে হবে, যেন আনন্দে আকাশে উড়ছি! আল্লাহর গুণাবলীর আয়াত এলে মাথা নিচু করে দিতে হবে। আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের নিদর্শনস্বরূপ। কাফেরদের বৈশিষ্ট্য এলে, লজ্জার ভান করে আওয়াজ নিচু করে ফেলতে হবে। যেন তাদের এহেন কর্মকা-ে আমারও মাথা কাটা যাচ্ছে।
    .
    (১৩৫). প্রতিটি আয়াতেই আমি থামব। ভাবব। মুমিনদের বৈশিষ্ট্য হলে, চিন্তা করে দেখব, আমি কি গুণের অধিকারী? কাফির বা মন্দলোকদের বৈশিষ্ট্য হলে চিন্তা করবো, আমি নইতো! আল্লাহর বড়ত্বের বর্ণনা হলে, চিন্তা করব, আমি কি তা অনুভব করতে পারছি? আমার মনে কি গাইরুল্লাহর প্রতি ভালবাসা আছে?
    .
    (১৩৬). কুরআন তাদাব্বুরের ক্ষেত্রে আরেকটি বড় প্রতিবন্ধক হলো, তাজভীদের প্রতি অতিরিক্ত মনোযোগ! তাজভীদের সূক্ষাতিসূক্ষ ভুল বের করার প্রয়াস চালানো। হরফের মাখরাজের দিকে অতিরিক্ত নজর দিলে হরফের অর্থ বের হবে না। এ-ধরনের পড়া শয়তানের হাসির খোরাক হবে। এটা ঠিক, তাজভীদ অত্যন্ত জরুরী বিষয়। তাজভীদ কুরআন পাঠের অলংকার। তাজভীদ ঠিক করে পড়তে না পারলে গুনাহগার হবে। কিন্তু এটাই কুরআনের চূড়ান্ত লক্ষ্য নয়। তাজভীদ হলো মাধ্যম। তাদাব্বুরের স্তরে পৌঁছার সেতু। কুরআন পাঠের সময় শয়তানের একটা শক্তিশালী অস্ত্র হলো, সে তিলাওয়াতকারীর মনে দ্বিধা ঢুকিয়ে দেয়: হরফটা বোধ হয় সঠিকভাবে আদায় করা হয়নি! আবার শুদ্ধ করে পড়ি! হরফ শুদ্ধ করার দিকে তার মনোযোগ ফিরিয়ে, অর্থের দিক থেকে তার মনোযোগ ঘুরিয়ে দেয়।
    .
    (১৩৭). ইবনে মাসউদ রা. বলেছেন:
    -এক জমানা আসবে, ফকীহ কম হবে ক্বারী বেশি হবে। কুরআন কারীমের হরফ মুখস্থ করা হবে, কিন্তু তার বিধি-বিধান অবহেলিত থাকবে!
    .
    (১৩৮). তাদাব্বুরের আরেকটি প্রতিবন্ধক হলো:
    -কুরআন দ্বারা নিছক শিফা বা আরোগ্য লাভ করার নিয়ত করা।
    কিছু মানুষ কুরআন কারীমকে হোমিও-এলোপ্যাথির দোকান বানিয়ে রাখে। তারা মনে করে রোগ-বালাই থেকে শেফা দেয়ার জন্যেই কুরআন নাযিল হয়েছে। এটা ঠিক, কুরআন শারীরিক-মানসিক-বুদ্ধিবৃত্তিক সব ধরনের রোগ ভালো করার ক্ষমতা রাখে। তাই বলে আরোগ্য দান করাই কুরআনের প্রধান উদ্দেশ্য নয়।
    .
    (১৩৯). তিলাওয়াত করতে গিয়ে আল্লাহর নামগুলো সামনে পড়লেই থমকে গিয়ে ভাবা, এখানে অন্য নাম না এনে ঠিক এই নামই কেন আনা হল?
    .
    (১৪০). কোত্থেকে তাদাব্বুর শুরু করবো? উমার রা. বলেছেন:
    -তোমরা যদি কুরআন শিখতে চাও, ‘মুফাসসাল’ সুরা থেকে শুরু করো। কারন এগুলো ছোট ও সহজ।
    .
    (১৪১). ইবনে আব্বাস রা. বলেছেন:
    -নবীজি সা. যখন ইন্তেকাল করেন, তখন আমি দশ বছরের বালক। আমি সবে মুহকাম ও মুফাসসাল সূরাগুলো পড়ে শেষ করেছি।
    মুফাসসাল সূরা হলো: সূরা ক্বফ থেকে নাস পর্যন্ত। এ-সূরাগুলো দিয়ে পাঠ শুরু করার বেশ কিছু উপকারিতা রয়েছে:
    ক. কলবে ঈমান পোক্ত হয়। কারণ এগুলোতে প্রচুর পরিমাণে উপদেশমূলক আয়াত আছে।
    খ. ছোট ছোট আয়াত হওয়াতে বোঝার ক্ষেত্রেও সহায়ক। এসব আয়াতে শরীয়তের বিধিবিধানও খুব একটা নেই। বেশির ভাগই জান্নাত-জাহান্নামের বর্ণনা। নবী-রাসূলগণের ঘটনা।
    গ. আল্লাহর পরিচয়মূলক আয়াত আছে। আল্লাহর প্রতি ঈমানের কথা আছে।
    ঘ. রাসূলের ঈমানের কথা আছে।
    .
    (১৪২). তারা কি কুরআন সম্পর্কে চিন্তা করে না, নাকি অন্তরে লেগে আছে সেই তালা, যা অন্তরে লেগে থাকে? (মুহাম্মাদ: ২৪)।
    أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ الْقُرْآنَ أَمْ عَلَىٰ قُلُوبٍ أَقْفَالُهَا
    ক. এই আয়াত দ্বারা বোঝা যায়, কুরআন কারীম নিয়ে তাদাব্বুর করা ওয়াজিব (ইমাম শাওকানী)।
    খ. তাদাব্বুর ছেড়ে দেয়ার অর্থ কুরআনকে ছেড়ে দেয়া (ইবনে কাসীর)।
    গ. আমরা তাদাব্বুর কেন করবো তার উদ্দেশ্যও এই আয়াত থেকে বের করতে পারি।
    ঘ. তালাবদ্ধ হৃদয়ের অধিকারী হৃদয়ের মানুষরা তাদাব্বুর থেকে বিমুখ থাকে।
    ঙ. পরোক্ষভাবে মুনাফিকদের নিন্দা করা হয়েছে। কারণ তারা কুরআনের তাদাব্বুরকে উপেক্ষা করে থাকে।
    .
    (১৪৩). (হে রাসূল!) এটি এক বরকতময় কিতাব, যা আমি আপনার প্রতি নাযিল করেছি, যাতে মানুষ এর (আয়াতের) মধ্যে চিন্তা করে এবং যাতে বোধসম্পন্ন ব্যক্তিগণ উপদেশ গ্রহণ করে (সোয়াদ: ২৯)।
    كِتَابٌ أَنزَلْنَاهُ إِلَيْكَ مُبَارَكٌ لِّيَدَّبَّرُوا آيَاتِهِ وَلِيَتَذَكَّرَ أُولُو الْأَلْبَابِ
    অর্থাৎ: হে মুহাম্মাদ! আপনার কওমের মধ্য হতে যাদের প্রতি আমি এই কুরআন নাযিল করেছি, তারা যেন ‘তাদাব্বুর’ করে (তাবারী)।
    .
    (১৪৪). যাদেরকে আমি কিতাব দিয়েছি তারা যখন তা সেভাবে তিলাওয়াত করে, যেভাবে তিলাওয়াত করা উচিত তখন তারাই তার প্রতি (প্রকৃত) ঈমান রাখে (বাকারা: ১২১)।
    الَّذِينَ آتَيْنَاهُمُ الْكِتَابَ يَتْلُونَهُ حَقَّ تِلَاوَتِهِ أُولَٰئِكَ يُؤْمِنُونَ بِهِ
    যথার্থ তিলাওয়াত (حَقَّ تِلَاوَتِهِ) মানে? মুফাসসিরীনগণ বলেছেন, এর অর্থ ‘তাদাব্বুর’ করা ও সে অনুযায়ী আমল করা।
    .
    (১৪৫). এবং ধীর-স্থিরভাবে স্পষ্টরূপে কুরআন তিলাওয়াত কর
    وَرَتِّلِ الْقُرْآنَ تَرْتِيلا
    ক. এভাবে তিলাওয়াত করলে, কুরআন কারীম বুঝতে ও তাদাব্বুর করতে সহায়ক হবে (ইবনে কাসীর)।
    খ. ধীরে ধীরে তাদাব্বুরের সাথে পড়তে থাক (শাওকানী)।
    .
    (১৪৬). আল্লাহ কারও উপর সাধ্যের বাইরে দায়িত্ব অর্পণ করেন না (বাকারা: ২৮৬)।
    لا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْسًا إِلا وُسْعَهَا
    কুরআনের বিধি-বিধান বোঝা যদি আমাদের সাধ্যের বাইরে হতো, আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে তাদাব্বুরের হুকুম দিতেন না (ইবনে হাযম)।
    .
    (১৪৭). আল্লাহ তা‘আলা যাকে কল্যাণ দান করতে চান, তাকে দ্বীনের ‘তাফাক্কুহ’ (গভীর বুঝ) দান করেন (মুত্তাফাক)।
    من يرد الله به خيراً يفقه في الدين
    ওলামায়ে কেরাম বলেছেন: দ্বীনের ‘ফিকহ’-গভীর জ্ঞান হাসিলের সবচেয়ে বড় উপায় হলো, কুরআন কারীমের তাদাব্বুর।
    .
    (১৪৮). সাহাবায়ে কেরামের কুরআনি তাদাব্বুর ছিল ভিন্নধর্মী। তারা কতোটা মনোযোগ দিয়ে কুরআনের তাদাব্বুর করতেন, উমার রা. এর ঘটনা তার স্বাক্ষী। তিনি বারো বছর সময় ব্যয় করে সূরা বাকারা শিখেছেন। শেষ হওয়ার পর, আনন্দে উট যবেহ করেছেন (বায়হাকী)।
    .
    (১৪৯). আমরা তাফসীর বা তাদাব্বুরে বসলেও কত দ্রুত একেকটা সূরা শেষ হয়ে যায়। আমাদের তাদাব্বুর মানে ‘তরজমা’। বেশির চেয়ে বেশি সামান্য তাফসীর। ইবনে উমার রা. সূরা বাকারা নিয়ে আট বছর পড়ে ছিলেন। এই দীর্ঘ সময়টা তিনি সূরাটা শেখার পেছনে ব্যয় করেছেন (মুয়াত্তা)।
    .
    (১৫০). উমার রা. নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত করতেন। কোনও কোনও আয়াতের তাদাব্বুর তাকে ভীষণ বিহ্বল করে তুলতো। কাঁদতে কাঁদতে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসতো। কান্নার জন্যে দীর্ঘ সময় ঘর থেকে বের হতে পারতেন না। লোকজন মনে করতো তিনি অসুস্থ। সবাই দেখতে আসতো!
    .
    (১৫১). আমি সূরা ফাতিহা থেকে নিয়ে শেষ পর্যন্ত তিন তিনবার পড়ে শুনিয়েছি ইবনে আব্বাস রা.-কে। প্রতিটি আয়াত পড়া শেষ হলে থেমে আমি তাকে প্রশ্ন করেছি। আয়াতটা সম্পর্কে তার কাছ থেকে ইলম হাসিল করেছি
     — — মুজাহিদ রহ.)।
    .
    (১৫২). হিজরী চতুর্থ হিজরীর বিখ্যাত বুযুর্গ, আবুল আব্বাস বিন আতা রহ.। বেশি বেশি কুরআন খতম করতেন। একটা খতম শুরু করেছিলেন তাদাব্বুর করে করে শেষ করবেন। দশ বছরেরও বেশি সময় অতিবাহিত হয়েছে। খতম শেষ করার আগেই মালাকুল মাউত এসে হাজির হয়ে গেছেন।
    .
    (১৫৩). কুরআন তিলাওয়াত করার সময় মনোযোগটা ধরে রাখা। অর্থের দিকে খেয়াল করে করে তিলাওয়াত করা। কুরআন কারীম থেকে কিছু আহরণের চেষ্টা করা। ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেছেন:
    -যে ব্যক্তি হেদায়াতের প্রত্যাশী হয়ে কুরআনের তাদাব্বুরে নিয়োজিত হবে, তার সামনে হকের রাস্তা খুলে যাবে।
    .
    (১৫৪). তাদাব্বুর-তাফাক্কুর ছাড়া গড়গড় করে বেশি পরিমাণে তিলাওয়াত করা যায়। কিন্তু তাদাব্বুর ও গভীর চিন্তাভাবনা করে অল্প তিলাওয়াত করা আমার কাছে বেশি প্রিয়।
    -ইমাম আ-জুররি)।
    .
    (১৫৫). তাদাব্বুর ও তাফাক্কুরের সাথে তিলাওয়াত করা সুন্নাত। এটাই কুরআন তিলাওয়াতের অন্যতম প্রদান ও গুরুত্বপূর্ণ দিক। তাদাব্বুরমাখা তিলাওয়াতের মাধ্যমে বক্ষটা হেদায়াতের জন্যে প্রস্তুত হয়। হৃদয়টা রব্বানী নূরে নূরান্বিত হয়
    (আল্লামা সুয়ূতী)।
    .
    (১৫৬). যার মধ্যে ইলম নেই, ফাহম নেই, তাকওয়া নেই, তাদাব্বুর নেই, সে কুরআনের কোনও স্বাদই পায় না
    (ইমাম যারকাশী)।
    .
    (১৫৭). কুরআনের ইলম হলো শ্রেষ্ঠ ইলম। সুতরাং কুরআনের বুঝ (ফাহম)-ই হলো শ্রেষ্ঠ বুঝ
    (ইবনুল জাওযী)।
    .
    (১৫৮). কুরআনের তাদাব্বুর ছেড়ে দেয়া, কুরআনের অর্থ বোঝার চেষ্টা না করা, কুরআন সম্পর্কে জানাশোনা বাড়ানোর প্রতি আগ্রহী না হওয়াও একপ্রকার (هجر) বা কুরআন-ত্যাগ (ইবনুল কাইয়িম)।
    .
    (১৫৯). কুরআন কারীমের তাদাব্বুর যাবতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের চাবিকাঠি। এর মাধ্যমেই সমস্ত কল্যান লাভ হয়। এর মাধ্যমেই যাবতীয় ইলম আহরিত হয়। এর মাধ্যমেই ঈমান বৃদ্ধি পায়। ঈমানী বৃক্ষের শেকড় গভীরে প্রোথিত হয়
    (আল্লামা সা‘দী)।
    .
    (১৬০). কুরআনের তাদাব্বুর করা তোমার জন্যে অপরিহার্য। কুরআন কারীমের অর্থ বোঝা পর্যন্ত তোমাকে এটা চালিয়ে যেতে হবে। কুরআন কারীম আগাগোড়া পড়তে থাকো তাদাব্বুরের সাথে। আগ্রহ নিয়ে। আমলের নিয়তে
    (শায়খ বায)।
    .
    (১৬১). যে ব্যক্তি কুরআনের তাদাব্বুর করবে এবং বেশি বেশি তিলাওয়াত করবে, সে ব্যক্তি লাভবানদের গুণাবলী কী কী তা জানতে পারবে। ক্ষতিগ্রস্তদের গুণাবলী কী কী তাও সে বিস্তারিত জানতে পারবে
    (ইবনে বায)।
    .
    (১৬২). তোমাদের প্রত্যেক এমন ব্যক্তিকে (সতর্ক করছে), যে অগ্রগামী হতে বা পিছিয়ে পড়তে চায় (মুদ্দাসসির: ৩৭)।
    لِمَنْ شَاءَ مِنْكُمْ أَنْ يَتَقَدَّمَ أَوْ يَتَأَخَّرَ
    এই আয়াতটা তাদাব্বুর করে দেখ। তোমার সামনে স্পষ্ট হয়ে যাবে, কোনও অবস্থাতেই থেমে পড়া যাবে না। সর্বাবস্থাতেই নিজের ঈমানের খোঁজ-খবর রাখতে হবে। আমলের প্রতি নজর রাখতে হবে। পিছিয়ে পড়ার সম্ভাবনা প্রতিটি মুহূর্তেই!
    (শায়খ নাসের উমর)।
    এটাই কুরআনী আয়াত তাদাব্বুরের ফায়েদা। আমাকে সচেতন করিয়ে দেবে। আমার ভুলগুলো ভাঙিয়ে দেবে। আমাকে জাগিয়ে রাখবে।
    .
    (১৬৩). হে মুমিনগণ! তোমরা যদি আল্লাহর সঙ্গে তাকওয়ার নীতি অবলম্বন কর, তবে তিনি তোমাদেরকে (সত্য ও মিথ্যার মধ্যে) পার্থক্য করার শক্তি দেবেন (আনফাল: ২৯)।
    يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنْ تَتَّقُوا اللَّهَ يَجْعَلْ لَكُمْ فُرْقَانًا
    সত্য আর মিথ্যা পার্থক্য করা সহজ কাজ নয়। বর্তমানে মিথ্যা আসে নানামুখী রূপ নিয়ে। নিরূপণ করা কঠিন কোনটা হক আর কোনটা বাতিল! এই দুর্যোগে প্রকৃত ফুরকানই পারে আামাদের পথ দেখাতে। কুরআনই সেই ফুরকান। পথ দেখতে হলে তাদাব্বুর করতেই হবে।
    .
    (১৬৪). তোমাদের প্রতি আল্লাহর ফযল ও রহমত না হলে তোমাদের মধ্যে কেউ কখনও পাক-পবিত্র হতে পারত না (নূর ২১)।
    وَلَوْلَا فَضْلُ اللَّهِ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَتُهُ مَا زَكَىٰ مِنكُم مِّنْ أَحَدٍ أَبَدًا
    বান্দার প্রতি আল্লাহর অন্যতম রহমত ও ফযল কী? আল্লাহর কালামের তিলাওয়াত ও তাদাব্বুর।
    .
    (১৬৫). তিনি তো রহমানই, যিনি কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন (রহমান: ১-২)।
    الرحمن علم القرآن
    তার মানে কুরআন শিক্ষা দেয়াটাও আল্লাহর বড় এক রহমত। কুরআন নিয়ে তাদাব্বুর করা, কুরআন বোঝার জন্যে কিতাবাদি পড়া, কুরআনী রহস্য উদঘাটনের জন্যে সময় ব্যয় করা, রহমতেরই বহিঃপ্রকাশ।
    .
    (১৬৬). আল্লাহর যদি জানা থাকত তাদের মধ্যে কোন কল্যাণ আছে, তবে তিনি তাদেরকে অবশ্যই শোনার তাওফীক দিতেন (আনফাল: ২৩)।
    ولو علم الله فيهم خيراً لأسمعهم
    কুরআন কারীমের তাদাব্বুর না করার কারণ এই নয় তো, আল্লাহ আমাকে এই নেয়ামত থেকে বঞ্চিত করেছেন! তাদাব্বুর না করা, কুরআন কারীমের অর্থ বোঝার জন্যে চেষ্টা না করার পরিণতি কি হতে পারে, এই আয়াতের দিকে খেয়াল করলে, কিছুটা আঁচ করা যেতে পারে!
    .
    (১৬৭). যখন কুরআন পড়া হয় তখন তা মনোযোগ দিয়ে শোন এবং চুপ থাক, যাতে তোমাদের প্রতি রহমত হয় (আ‘রাফ: ২০৪)।
    وإذا قرئ القرآن فاستمعوا له وأنصتوا لعلكم ترحمون
    আল্লাহর রহমত, অন্তরে প্রশান্তি, সৌভাগ্য ও ঈমানের উপর অবিচলতা, রোগমুক্তি আসতে পারে, কুরআন কারীমের তিলাওয়াত মনোযোগ দিয়ে তাদাব্বুরের সাথে শোনার মাধ্যমে।
    .
    (১৬৮). আল্লাহর কিতাবের তাদাব্বুরের মাধ্যমে বান্দার ঈমান বৃদ্ধি পায়। আল্লাহর দরবারে তার মর্যাদাও বৃদ্ধি পায়। কুরআনের সাথে একজন মুমিনের সম্পর্ক যত গভীর হয়, মজবুত হয়, ততই রবের প্রতি তার ইয়াকীন ও আস্থা বাড়তে থাকে।
    .
    (১৬৯). কুরআন তাদাব্বুর করতে হলে, আগে কলবে কিছু বিষয়কে স্থান দিতে হবে: কুরআন কারীমের মহব্বত, তিলাওয়াতের প্রতি তীব্র আকর্ষণ, আমলের প্রতি দৃঢ় বাসনা। তাহলে আল্লাহ তা‘আলা আমার সামনে তার কুরআনি নেয়ামতের ভা-ার খুলে দিবেন। কুরআনের রহস্যের দ্বার উন্মোচিত করতে থাকবেন।
    .
    (১৭০). তাদাব্বুরের সাথে পড়লে আমরা দেখতে পাব, সূরা কাহফে ফিতনা থেকে বাঁচার চারটা উদাহরণ পেশ করা হয়েছে। দ্বীনের ফিতনা। মালের ফিতনা। ইলমের ফিতনা। রাজত্বের ফিতনা।
    .

    (চলমান)
    (কারটেজি পরবর্তী অংশের সাথে)
    ----------(বাকি অংশ নিচে)----------

  • #2
    ----------(বাকি অংশ)----------

    (১৭১). সূরা ক্বফ শুরু হয়েছে:
    ق والقرآن المجيد
    কাফ, কুরআন মাজীদের কসম!
    আর সূরা ক্বফ শেষ হয়েছে:
    فذكر بالقرآن من يخاف وعيد
    আমার সতর্কবাণীকে ভয় করে এমন প্রত্যেককে আপনি কুরআনের সাহায্যে উপদেশ দিতে থাকুন!
    এই সূরারই এক জায়গায় আছে:
    إن في ذلك لذكرى لمن كان له قلب أو ألقى السمع وهو شهيد
    নিশ্চয়ই এর ভেতর এমন ব্যক্তির জন্যে উপদেশ রয়েছে, যার আছে অন্তর কিংবা যে মনোযোগ দিয়ে কর্ণপাত করে (৩৭)।
    = আমরা উপদেশ গ্রহণ করতে হলে, তাদাব্বুর করতে হবে। কুরআন কারীমের বাণীর অর্থ উদ্ধারে গভীর অনুধ্যান করতে হবে। এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, কুরআন কারীম থেকে উপকৃত হওয়ার জন্যে দু’টি শর্ত:
    ক. জীবন্ত উন্মুখ হৃদয়!
    খ. জাগ্রত মস্তিষ্ক!
    আমাকে মনে রাখতে হবে, আমি যে তেলাওয়াত করছি, তা আল্লাহ তা‘আলা খোদ শুনছেন। ইবনে কুতাইবা এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন:
    -অর্থাৎ সে আল্লাহর কিতাব শ্রবণ করেছে সজাগ মনোযোগের সাথে, বোঝার সুতীব্র ইচ্ছা নিয়ে, অচেতন গাফেল হয়ে নয়। এ-আয়াত দ্বারা বোঝা যায়, আল্লাহর কালামকে গুরুত্ব দিয়ে না শুনলে, না পড়লে এর প্রভাব অন্তরে পড়বে না।
    .
    (১৭২). কুখ্যাত কুরাইশ নেতা, ওলীদ বিন মুগীরাহ। ঈমান নসীব হয়নি, কিন্তু কুরআনের সমঝদার। কুরআনের বিরোধিতা করতে এসে, কুরআন সম্পর্কে এক অবিস্মরণীয় উক্তি করে গেছে এই লোক:
    إن له حلاوة وإن عليه لطلاوة وإن أسفله لمورق وإن أعلاه لمثمر وإنه ليعلو ولا يعلا عليه
    -কুরআনের মধ্যে রয়েছে অন্য রকমের মিষ্টতা। কুরআনের বাহ্যিক রূপে আছে মনোহারিত্ব-লাবণ্য। কুরআনের উপরিভাগ ফলভারানত নিম্নভাগ পত্রপল্লবশোভিত! কুরআন বিজয়ী হয়, তার উপর জয়ী হওয়া যায় না।
    = একজন কাফের হয়ে কুরআনকে এভাবে বুঝল! কুরআনের চমৎকারিত্বকে এভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারল, আমরা মুসলমান হয়ে কী করছি?
    .
    (১৭৩). ইসলাম গ্রহণের আগে, জুবাইর ইবনু মুতঈম রা. যখন নবীজি সা.-এর মুখ থেকে কুরআন কারীমের তিলাওয়াত শুনলেন, তখনকার অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে বলেছেন:
    -আমার হৃদয়টা উড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল (كاد قلبي أن يطير)!
    তিনি কী এমন পেয়েছিলেন কুরআনের মধ্যে, আশায় আনন্দে তার মনটা উড়–উড়– হয়ে গিয়েছিল! অথবা অপার্থিব এক অনুভূতি তার হৃদয়জুড়ে ছেয়ে গিয়েছিল! তিনি (তখনো) একজন কাফের! তা সত্ত্বেও এমন নিখাদ আলোর ঝলক কিভাবে টের পেলেন! আমরা জন্মসূত্রে মুসলমান হয়ে দীর্ঘদিন কুরআনের সাথে জীবনযাপন করার পরও কেন এর ছিঁটেফোঁটা ‘ঝলক’ টের পাই না!
    .
    (১৭৪). জ্বিনেরা কুরআন কারীমকে প্রথম বার শুনেই কিভাবে এর মাহাত্ম্য টের পেয়ে গেলো? স্বগতোক্তি করে উঠলো:
    إنّا سمعنا قرآناً عجبا
    আমরা এক বিস্ময়কর কুরআন শুনে এসেছি (জ্বিন)!
    আমাদের এমন বোধ জাগে না কেন? আমরা উঠতে বসতেই কুরআন দেখি, কুরআন শুনি তবুও?
    .
    (১৭৫). কুরআন তাদাব্বুর বলতে আমরা বুঝি:
    ক. কুরআন কারীমের শব্দগুলোর অর্থ বোঝার চেষ্টা করা। এই চেষ্টার ফলে জীবনে আসে এক ইতিবাচক প্রভাব। আচরণে আসে অন্য রকম এক পরিবর্তনের ছোঁয়া।
    খ. আল্লাহ তা‘আলা আমাকে এই আয়াতে কী বলতে চেয়েছেন, তা বোঝার চেষ্টা করা। আগের ও পরের আয়াতগুলোর সাথে সম্পর্ক খোঁজার চেষ্টা করা।
    গ. আয়াতে সুসংবাদ থাকলে মনে খুশি খুশি ভাব ফুটিয়ে তোলা। দুঃসংবাদ থাকলে মনে ভীতাবস্থা সৃষ্টি করা। পূর্বেকার জাতিসমূহের ঘটনা থেকে শিক্ষাগ্রহণ করা।
    ঘ. কুরআনের সমস্ত কথাকে মনেপ্রাণে ইয়াকীন করা। সমস্ত আদেশকে মাথা পেতে নেয়া। যাবতীয় নিষেধাজ্ঞাকে মুখ বুজে মেনে নেয়া।
    .
    (১৭৬). মুমিন তো তারাই, যাদের সামনে আল্লাহকে স্মরণ করা হলে, তাদের হৃদয় ভীত হয়, যখন তাদের সামনে তাঁর আয়াতসমূহ পড়া হয়, তখন তা তাদের ঈমানের উন্নতি সাধন করে (আনফাল: ২)।
    إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيمَانًا
    যারা তাদাব্বুর করে, কুরআন কারীম দ্বারা প্রভাবিত হয়, তাদের প্রশংসা করেছেন আল্লাহ তা‘আলা।
    .
    (১৭৭). কুরআনের তাদাব্বুর ছেড়ে অহংকারের আলামত:
    -এরূপ ব্যক্তির সামনে যখন আমার আয়াতসমূহ পাঠ করা হয়, তখন সে দম্ভভরে মুখ ফিরিয়ে নেয়, যেন সে তা শুনতেই পায়নি, যেন তার কান দু’টিতে বধিরতা আছে (লুকমান: ৭)।
    وَإِذَا تُتْلَىٰ عَلَيْهِ آيَاتُنَا وَلَّىٰ مُسْتَكْبِرًا كَأَنْ لَمْ يَسْمَعْهَا كَأَنَّ فِي أُذُنَيْهِ وَقْرًا
    শুধু তাদাব্বুরই তারা বর্জন করে না, তাদের কানেও সমস্যা। কুরআনের আয়াত তারা শোনে সত্য কিন্তু কোনও আবেদন সৃষ্টি করে না। এটাকেই আল্লাহ তা‘আলা বধিরতা বলে আখ্যায়িত করেছেন।
    .
    (১৭৮). তাদাব্বুর ছেড়ে দেয়ার ভীতিকর দিক হলো, মানুষ নগন্য জড় পদার্থের চেয়েও হীন হয়ে পড়া:
    -আমি যদি এ কুরআনকে অবতীর্ণ করতাম কোনও পাহাড়ের উপর, তবে তুমি দেখতে তা আল্লাহর ভয়ে অবনত ও বিদীর্ণ হয়ে গেছে (হাশর ২১)।
    لَوْ أَنزَلْنَا هَٰذَا الْقُرْآنَ عَلَىٰ جَبَلٍ لَّرَأَيْتَهُ خَاشِعًا مُّتَصَدِّعًا مِّنْ خَشْيَةِ اللَّهِ
    বাক-বুদ্ধিহীন একটা পাহাড়ও কুরআনের ভয়ে বেসামাল হয়ে ওঠে! আর আমরা মানুষেরা!
    .
    (১৭৯). যাদের উপর তাওরাতের ভার অর্পণ করা হয়েছিল, অতঃপর তারা সে ভার বহন করতে পারেনি, তাদের দৃষ্টান্ত হল গাধা, যে বহু কিতাব বয়ে রেখেছে (জুমু‘আ: ৫)।
    مَثَلُ الَّذِينَ حُمِّلُوا التَّوْرَاةَ ثُمَّ لَمْ يَحْمِلُوهَا كَمَثَلِ الْحِمَارِ يَحْمِلُ أَسْفَاراً
    এ-আয়াতে তাওরাতের কথা বলা হলেও, পরোক্ষভাবে কুরআন কারীমও প্রসঙ্গক্রমে আলোচিত হয়েছে। যারা কুরআন কারীম শুধু মুখস্থ পড়ে, আমল করে না, তারাও গাধার মতো।
    .
    (১৮০). খারেজীদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো:
    يقرؤون القرآن لايجاوزر حناجرهم
    তারা কুরআন পড়বে সত্য কিন্তু তার শিক্ষা তাদের গলা দিয়ে নামবে না (মুসলিম)।
    তারা কুরআনের যথাযথ তাদাব্বুর করে না। কুরআনের হেদায়াত গ্রহণ করতে আগ্রহী নয়। মনগড়া ব্যখ্যা নিয়েই তারা সন্তুষ্ট।
    .
    (১৮১). কুরআন কারীমকে পরিত্যাগ করার শাস্তি ভয়াবহ। স্বয়ং নবীজি এমন লোকদের বিরুদ্ধে আল্লাহর দরবারে অভিযোগ করেছেন:
    يارب إن قومي اتخذوا هذا القرآن مهجورا
    ইয়া রাব! আমার সম্প্রদায় এ কুরআনকে বিলকুল পরিত্যাগ করেছিল (ফুরকান: ৩০)।
    পরিত্যাগ করা বলতে, কুরআনের প্রতি ঈমান এনেছে , কুরআন পড়েছে কিন্তু তাদাব্বুর করেনি। নিদেনপক্ষে কুরআন অনুযায়ী আমল করেনি। কুরআনের হালাল-হারাম মেনে চলেনি।
    .
    (১৮২). তাদাব্বুর মানে? ইলম অর্জনের জন্যে কুরআন পাঠ করা। ইলম মানে? আল্লাহকে চেনা। তার সম্পর্কে জানা। আল্লাহ সম্পর্কে প্রকৃত ইলম আমাকে ইস্তেগফার-অভিমুখী করে তুলবে।
    .
    (১৮৩). আল্লাহর ভয়ই প্রকৃত ইলম। আল্লাহ সম্পর্কে ধোঁকাগ্রস্ত হওয়াই প্রকৃত অজ্ঞতা
    (ইবনে মাসউদ রা.)।
    .
    (১৮৪). তোমরা ইলম হাসিল করতে চাইলে এই কুরআন ঘেঁটে দেখ, কারণ তাতেই আছে পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদের যাবতীয় ইলম
    (ইবনে মাসউদ)।
    .
    (১৮৫). তোমাদের পূর্বে যারা বিগত হয়েছেন, তারা কুরআন কারীমকে মনে করতেন, আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা চিঠি। তারা রাতের আঁধারে কুরআনের তাদাব্বুর করতেন। দিনের আলোতে কুরআনের বাস্তবায়নে নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন। তার ইলম অন্বেষণে ব্যপৃত রাখতেন
    (হাসান বিন আলি রা.)।
    .
    (১৮৬). তোমরা কুরআনকে আঁকড়ে ধর। কুরআন শেখো। তোমাদের সন্তানদেরকে কুরআন শিক্ষা দাও। কারণ তোমাদেরকে এ-ব্যাপারে প্রশ্ন করা হবে। এবং এজন্য তোমাদেরকে প্রতিদান দেয়া হবে। জ্ঞানীদের জন্যে উপদেশদাতা হিশেবে কুরআনই যথেষ্ট
    (ইবনে উমার রা.)।
    .
    (১৮৭). আল্লাহ তা‘আলা প্রতিটি আয়াত কেন নাযিল করেছেন, সেটা শিক্ষা দিতে ভালবাসেন। তিনি চান বান্দা প্রতিটি আয়াত পড়ে পড়ে তার উদ্দেশ্য খুঁজে বের করুক
    (হাসান বসরী)।
    .
    (১৮৮). তোমরা কুরআনকে আঁকড়ে ধরো। কুরআন হলো রহমানের সর্বশেষ কিতাব। তাতে আছে আকলের নির্যাস, প্রজ্ঞার আলো, যাবতীয় ইলমের উৎস
    (কা‘ব আহবার)।
    .
    (১৮৯). আমি কুরআন পাঠ করি। গভীর দৃষ্টিতে আয়াতসমূহের দিকে নজর বুলাই। আমার কাছে অবাক লাগে, কিভাবে কুরআনের হাফেজগন শান্তিতে ঘুমায়?
    (একজন সালাফ)।
    .
    (১৯০). কুরআনে হাফেজদেরকে দেখলে আমার অবাক লাগে, আল্লাহর কালাম পড়েও কিভাবে তারা দুনিয়াবী বিষয় নিয়ে ব্যস্ত হতে পারে? তারা যা তিলাওয়াত করে, তার অর্থ যদি তারা বুঝতো তাহলে এর স্বাদ অনুভব করতে পারতো। মুনাজাতে মজা পেতো। তাকে যে নেয়ামত দেয়া হয়েছে, তার প্রাপ্তির আনন্দে তার ঘুম দূর হয়ে যেতো
    (একজন সালাফ)।
    .
    (১৯১) কুরআন কারীম তিলাওয়াতের সময় যা মনে রাখা চাই:
    কুরআন পাঠ করবে আমলের নিয়তে।
    তুমি কুরআনকে এমন করে পড়ো, কুরআন-পাঠ যেন তোমাকে মন্দকাজ থেকে বিরত রাখে। যদি তোমাকে মন্দ কাজ থেকে বিরত না রাখে তাহলে তুমি প্রকৃত কুরআন-পাঠক নও
    (হাসান বিন আলি রা.)।
    .
    (১৯২). একটা আয়াত নিয়ে তাদাব্বুরের চুড়ান্ত রূপ হলো, সে আনুযায়ী আমল করা, কুরআনের হরফগুলোকে যথাযথভাবে উচ্চারন করলেই তাদাব্বুর হয়ে যায় না
    (হাসান বসরী)।
    .
    (১৯৩). হে কুরআনের বাহক! কুরআন কারীম তোমার কলবে কী রোপন করেছে? কারণ কুরআন হলো মুমিনের বসন্ত ঠিক বৃষ্টি যেমন মাটির বসন্ত! (মালিক বিন দীনার)।
    .
    (১৯৪). কুরআন কারীম আল্লাহর কাছে মুনাজাতের নিয়তে পড়া:
    তিলাওয়াতকারী পড়ার সময় মনে করবে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে দেখছেন। তার পড়া শুনছেন। নৈকট্যপ্রাপ্ত ফিরিশতাদের কাছে তার প্রশংসা করছেন। তাকে নিয়ে গর্ব করেন।
    .
    (১৯৫). তুমি যদি কুরআন কারীম দ্বারা পরিপূর্ণ উপকৃত হতে চাও, তাহলে তিলাওয়াত করা বা তিলাওয়াত শোনার সময় কলবকে পুরোপুরি সুস্থির করে নাও। তোমার তিলাওয়াত তুমি নিজেই মনোযোগ দিয়ে শোন! আল্লাহর সাথে কথা বলছো এমন তটস্থ ভাব ফুটিয়ে তুলবে
    (ইবনুল কাইয়িম)।
    .
    (১৯৬). আল্লাহর যথার্থ মর্যাদাবোধ যদি তোমার কলবে স্থান পেয়ে যায়, তাহলে আল্লাহর কালাম শোনা ও পড়ার চেয়ে অধিক সুস্বাদু সুমিষ্ট সম্মানিত সমুন্নত কোনও কিছু আর হতে পারে না
    (সালাফ)।
    .
    (১৯৭). কুরআন কারীম আল্লাহর কালাম। কুরআনের মধ্য দিয়েই আল্লাহ তা‘আলা ও তার পরিচয় আমাদের সামনে বিমূর্ত হয়ে ওঠে। এটা হতে পারে কয়েকভাবে:
    বড়ত্ব ও ভীতি প্রকাশের মাধ্যমে। ফলে আমাদের হৃদয় বিন¤্র আর নতজানু হয়।
    সৌন্দর্য ও পরিপূর্ণতা প্রকাশের মাধ্যমে। ফলে তার প্রতি মনটা পরম ভালবাসায় সিক্ত হয়ে পড়ে
    (ইবনুল কাইয়িম)।
    .
    (১৯৮). তাদাব্বুরে সহায়ক ভুমিকা পালন করতে পারে:
    সওয়াবের নিয়তে পড়লে ও পড়ালে। নবীজি বলেছেন:
    خيركم من تعلم القرآن وعلمه
    যে ব্যক্তি কুরআন কারীম শিক্ষা করে ও শিক্ষা দেয়, সে-ই সর্বোত্তম।
    .
    (১৯৯). শিফা বা আরোগ্য লাভের নিয়তে কুরআন কারীম পড়া। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
    يَا أَيُّهَا النَّاسُ قَدْ جَاءَتْكُم مَّوْعِظَةٌ مِّن رَّبِّكُمْ وَشِفَاءٌ لِّمَا فِي الصُّدُورِ وَهُدًى وَرَحْمَةٌ لِّلْمُؤْمِنِينَ
    হে মানুষ! তোমাদের কাছে এমন এক জিনিস এসেছে, যা তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে এক উপদেশ, অন্তরের রোগ-ব্যাধির উপশম এবং মুমিনদের পক্ষে হিদায়াত ও রহমত (ইউনুস: ৫৭)।
    .
    (২০০). কিভাবে তাদাব্বুর করব? জোরে স্পষ্ট আওয়াজে সুর করে তিলাওয়াত করার মাধ্যমে।
    ليس منّا من لم يتغن بالقرآن يجهر به
    যে ব্যক্তি কুরআনকে সুর করে ও জোর আওয়াজে পড়বে না, সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয় (বুখারী)।
    .
    (২০১). এক লোক সম্পর্কে ইবনে আব্বাসকে বলা হল:
    -ওমুক খুব দ্রুত কুরআন তিলাওয়াত করে!
    ইবনে আব্বাস সে লোককে বললেন:
    -তুমি যদি তিলাওয়াত করতেই চাও, তাহলে এমনভাবে তিলাওয়াত করো, যাতে তুমি তোমার নিজ কানে শুনতে পাও। তোমার হৃদয় দিয়ে যা পড়ছো অনুভব করতে পারো!
    .
    (২০২). তুমি যখন তিলাওয়াত করবে, তখন কান খাড়া করে রাখবে। তাহলে পড়াটা কলবে পৌঁছবে। আর কলব হলো কান ও জিহ্বার যোগসূত্র (ইবনে আবি লায়লা)।
    .
    (২০৩). তাদাব্বুর হতে পারে: তারতীলের সাথে পড়ার মাধ্যমে। তারতীল মানে, ধীরে ধীরে থেমে থেমে তিলাওয়াত।
    আয়েশা রা. বলেছেন:
    كان يقرأ السور فيرتلها حتى تكون أطول منها
    তিনি (নবীজি) তারতীলের সাথে সূরাগুলো তিলাওয়াত করতেন। আগের সূরার চেয়ে পরের সূরার তারতীল হতো আরো দীর্ঘ সময় নিয়ে (মুসলিম)।
    .
    (২০৪). হে বনী আদম! তোমার কলব কিভাবে কুরআন তিলাওয়াতের সময় নরম হবে, তোমার তো লক্ষ্য থাকে কখন সূরা শেষ করবে সেদিকে (হাসান বসরী)।
    .
    (২০৫). তাদাব্বুর হতে পারে:
    একটা আয়াতকে বারবার পড়ার মাধ্যমে। একবার পড়ার কিছুক্ষণ থেমে ভাবনা চিন্তা করে আবার আয়াতটা পড়ার মাধ্যমে। এভাবে বারবার অসংখ্যবার পড়ার মাধ্যমে। আবু যর রা. বলেছেন:
    -আল্লাহর রাসূল নামাযে দাড়ালেন। সুবহে সাদেক পর্যন্ত একটা শুধু একটা আয়াতই বারবার পড়লেন! আয়াতটা ছিল:
    إِن تُعَذِّبْهُمْ فَإِنَّهُمْ عِبَادُكَ وَإِن تَغْفِرْ لَهُمْ فَإِنَّكَ أَنتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ
    যদি আপনি তাদেরকে শাস্তি দেন তবে তারা তো আপনারই বান্দা আর যদি তাদেরকে ক্ষমা করেন, তবে নিশ্চয়ই আপনার ক্ষমতাও পরিপূর্ণ এবং হিকমতে পরিপূর্ণ (মায়িদা: ১১৮)।
    .
    (২০৬). হাসান বসরি রহ. একবার সারারাত ধরে একটা আয়াতই বারবার পড়েছেন:
    وَإِن تَعُدُّوا نِعْمَةَ اللَّهِ لَا تُحْصُوهَا إِنَّ اللَّهَ لَغَفُورٌ رَّحِيمٌ
    তোমরা যদি আল্লাহর নেয়ামতসমূহ গুণতে শুরু কর, তবে তা গুণে শেষ করতে পারবে না। বস্তুত আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু (নাহল: ১৮)।
    তার কাছে জানতে চাওয়া হল:
    -এই আয়াত কেন?
    -চোখ তুলে যেদিকেই তাকাই, শুধু নেয়ামত আর নেয়ামত! জানি না, দৃষ্টির আড়ালে আরও কত নেয়ামত লুকিয়ে আছে!
    .
    (২০৭). সারারাত দ্রুত পড়ে কুরআন খতমকরার চেয়ে, সূরা যিলযাল ও কারি‘আ বারবার তাদাব্বুর করে করে পড়া আমার কাছে অধিক প্রিয় (ইমাম কুরতুবী)।
    .
    (২০৮). একটা আয়াত বারবার পড়ার মধ্যে অনেক উপকারিতা:
    সালাফের অনুসরণ করা হবে। তারা এভাবে একটা আয়াতকে বারবার করে পড়তেন।
    বারবার পড়লে তাদাব্বুর করতে সুবিধা হয়। বুঝটা গভীর হয়। প্রথমবার না বুঝলে দ্বিতীয়বারে বোঝা যাবে। নইলে তৃতীয়বারে, নইলে চতুর্থবারে! প্রতিবারেই কিছু না কিছু বুঝ বাড়তেই থাকবে!
    বারবার পড়লে, আত্মার শুদ্ধি হবে। ময়লা থাকলে দূর হয়ে যাবে। ঈমান বৃদ্ধি পাবে। কুরআনের স্বাদ অনুভব হবে। কারণ বারবার পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে ‘গাফলত’ দূর হয়। গাফেল কলবে কুরআন প্রবেশ করে না।
    একটা আয়াতকে যতবার পড়বো, ততই আল্লাহর পক্ষ থেকে কিছু না কিছু ‘হেদায়াতের’ নেয়ামত আমার উপর বর্ষিত হতে থাকবে। ঈমানের নবতর কলি প্রস্ফুটিত হতে থাকবে।
    .
    (২০৯). তাদাব্বুর হতে পারে:
    আয়াতটাকে কোনও ভাবে সীরাতের সাথে সম্পৃক্ত করা যায় কি না, দেখা। সীরাত পাঠের মাধ্যমে কুরআনের আয়াতগুলো অনেক বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কুরআন বোঝার জন্যে সীরাতপাঠ অপরিহার্য।
    .
    (২১০). তাদাব্বুর হতে পারে:
    তিলাওয়াতের সাথে সাথে সাড়া দেয়া। আয়াতে যা বলা হয়েছে তা তৎক্ষণাত করা। নবীজি সা. অত্যন্ত ধীরে ধীরে তিলাওয়াত করতেন। আয়াদের দাবী পূরণ করে করে সামনে বাড়তেন। তাসবীহের আয়াত এলে, তাসবীহ পাঠ করে নিতেন। প্রার্থনার আয়াত এলে, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে নিতেন। পানাহ চাওয়ার আয়াত এলে, আল্লাহর কাছে পানাহ চেয়ে নিতেন।
    .
    (২১১). তাদাব্বুর হতে পারে:
    কুরআন পাঠের সময় শোকের কথা মনে করে, কান্নার ভান করা। আয়াতের অর্থের সাথে সাথে গলার স্বরও ওঠানামা করানে া। আয়াতের আবেগ যেন গলায় ফুটে ওঠে। প্রতিটি আয়াত পড়ার সময় খেয়াল করা, আমি এখন কোন ধরনের আয়াত পড়ছি, হাসির? কান্নার? আনন্দের? বেদনার? চাওয়ার ? পাওয়ার? ভয়ের? আশার? চিন্তার? দুশ্চিন্তার? জান্নাতের? জাহান্নামের? আমলের? আদেশের? নিষেধের?
    .
    (২১২). কুরআন পাঠের সময় কান্না হলো বিনয় প্রকাশের মাধ্যম। এটা আল্লাহভিমুখী বান্দাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কান্না আনার একটা উপায় হলো: সামনে জাহান্নামের ভয়াবহ অবস্থার কথা কল্পনা করা। কবরের ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা ভাবনায় আনা। সে তুলনায় আমার নগন্য আমল ও স্বল্প প্রস্তুতির কথা ভাবা।
    .
    (২১৩). তাদাব্বুর হতে পারে:
    পড়ার সময় খেয়াল করা, কুরআন কারীমের প্রতিটি আয়াতের লক্ষ্য আমি নিজেই। ইমাম কুরতুবি বলেছেন:
    -যার কাছে কুরআন পৌঁছল, তার সাথে যেন আল্লাহ স্বয়ং কথা বললেন।
    .
    (২১৪). উরওয়া বিন যোবায়ের বলেন:
    -আমি দাদু (আসমা রা.)-এর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, সাহাবীগন কুরআন তিলাওয়াত শুনলে কেমন হতো তাদের অবস্থা?
    -ঠিক যেমনটা কুরআন কারীম বলেছে: (تدمع عيونهم وتقشعر جلودهم) তাদের চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠতো। তারা প্রকম্পিত হয়ে উঠত!
    তিনি দু’টি আয়াতের দিকে ইশারা করেছিলেন:
    প্রথম আয়াত: এবং রাসূলের প্রতি যে কালাম নাযিল হয়েছে তারা যখন তা শোনে, তখন তারা যেহেতু সত্য চিনে ফেলেছে, সেহেতু তাদের চোখসমূহকে দেখবে যে, তা থেকে অশ্রু প্রবাহিত হচ্ছে (মায়িদা: ৮৩)।
    وَإِذَا سَمِعُوا مَا أُنْزِلَ إِلَى الرَّسُولِ تَرَى أَعْيُنَهُمْ تَفِيضُ مِنَ الدَّمْعِ مِمَّا عَرَفُوا مِنَ الْحَقِّ
    দ্বিতীয় আয়াত: আল্লাহ নাযিল করেছেন উত্তম বাণী-এমন এক কিতাব যার বিষয়বস্তুসমূহ পরস্পর সুসমঞ্জস, যার বক্তব্যসমূহ বারবার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। যাদের অন্তরে তাদের প্রতিপালকের ভয় আছে, তারা এর দ্বারা প্রকম্পিত হয়। তারপর তাদের দেহ-মন বিগলিত হয়ে আল্লাহর স্মরণে ঝুঁকে পড়ে (যুমার: ২৩)।
    .
    (২১৫). আবদুল্লাহ ইবনে শাদ্দাদ রহ. বলেন:
    -আমি ফজরের নামাজের সময় ছিল শেষ কাতারে। সেখান থেকেই উমার রা.-এর ফোঁপানোর আওয়াজ শুনতে পেয়েছি। তিনি সূরা ইউসুফ তিলাওয়াত করছিলেন নামাজে। পড়তে পড়তে:
    قَالَ إِنَّمَا أَشْكُو بَثِّي وَحُزْنِي إِلَى اللَّهِ
    ইয়াকুব বলল, আমি আমার দুঃখ ও বেদনার অভিযোগ (তোমাদের কাছে নয়) কেবল আল্লাহরই কাছে করছি (ইউসুফ: ৮৬)।
    পর্যন্ত পৌঁছলেন। আর কান্না ধরে রাখতে পারলেন না।
    .
    (২১৬). আবদুল্লাহ ইবনে উমার রা. সূরা মুতাফফিফীন পড়তে পড়তে:
    يوم يقوم الناس لرب العالمين
    যে দিন সমস্ত মানুষ রাব্বুল আলামীনের সামনে দাঁড়াবে (৬)।
    পর্যন্ত পৌঁছলেন। আর সামনে বাড়তে পারলেন না। কান্নায় ভেঙে পড়লেন।
    .
    আমি কুরআন কারীম তিলাওয়াত করার সময় কী করি? কখনো কেঁদেছি? হেসেছি? মন খারাপ করেছি? আয়াতের প্রভাবে?
    .
    তাদাব্বুর নিয়ে যা বলার ছিল, তার চারভাগের একভাগ মাত্র বলতে পেরেছি। আলহামদুলিল্লাহ! বাকী কথার জন্যে আরো মেহনত লাগবে। ইনশাআল্লাহ!

    মূল লেখকঃ
    শাইখ আতিকউল্লাহ
    তারিখঃ ১৮-০৩-১৭

    Comment


    • #3
      আল্লাহ তায়ালা আপনার মেহনতকে কবুল করুন,আমিন।
      ’’হয়তো শরিয়াহ, নয়তো শাহাদাহ,,

      Comment


      • #4
        আলহামদুলিল্লাহ
        আসুক না যত বাধাঁ যত ঝর সাইক্লোন কিতালের পথে মোরা চলবোই

        Comment


        • #5
          মাশাল্লাহ খুব উপকারী পোস্ট
          জিহাদই হলো মুমিন ও মুনাফিকের মাঝে
          পার্থক্যকারী একটি ইবাদাহ

          Comment

          Working...
          X