তাবলিগ ও চলমান তাবলিগী জামাতের আলোচনা নতুন কোনো বিষয় নয়। এ শব্দ দুটির সাথে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। এ শব্দদয়ের শাব্দিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আমাদের সকলেরই কম বেশি জানা। প্রয়োজন হলো তাবলিগ নামক শরয়ি পরিভাষাটির সত্যিকার রূপরেখা সম্পর্কে খানিকটা ধারণা লাভ করা। যাতে মিথ্যার প্রলেপ থেকে ইসলামের এই পরিভাষাটিকে সংরক্ষণ করা যায়। যাতে হিতাহিত জ্ঞানহীন অতি উৎসাহিত গুটিকতেক লোকের মিথ্যা্ প্রলাপ হতে বেঁচে থাকা যায়। যারা কিছু মুখস্ত বুলি আওড়িয়ে আজ কুরআনের অনেক বাস্তবতা হতে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করছে। যারা আজ আল্লাহর কোরআনের উপর গুটি কতেক কিতাব ও রচনাকে প্রাধান্য দিচ্ছে।
একটি বিষয় আমাদের ভালোভাবে অনুধাবন করা উচিত যে, আমরা মানুষ, আর মানুষ হিসাবে মানবিক দুর্বলতা আমাদের মধ্যে থা্কতেই পাড়ে? নীতি ও আদর্শের বাহিরে গিয়ে আমরা অনেক কিছুই করে থাকি। কিন্তু আসমান জমিনের অধিপতি মহামহীয়ান আল্লাহ মানবিক দুর্বলতা কি? তাঁর মধ্যে কোনো প্রকার দুর্বলতাই ক্রিয়াশীল নয় বরং তিনি সর্ব প্রকার দুর্বলতা হতে মুক্ত ও পবিত্র। লাইনচ্যুত হওয়া কিংবা আদর্শচ্যুত হওয়া আল্লাহ তায়ালার পক্ষে সম্ভবপর নয়। তিনি সর্বদা তার আদেশ ও আদর্শকেই ফলো করেন। তাঁর নীতি ও আদর্শের উপরই অটল-অবিচল থাকেন। কোরআন খুললে এর অনেক দৃষ্টান্ত আমরা খুঁজে পাই। কোরআনুল কারিমে আল্লাহ তায়ালা এ বিষয়টিকে অত্যন্ত পরিস্কার ভাবেই তুলে ধরেছেন।
ইসলামের শুরুলগ্নে ইসলামের শত্রুরা ওহীর এ আলোকে নিভিয়ে ফেলতে তাদের কোনো চেষ্টায় তারা ত্রুটি করেনি। ইসলাম নামক অনন্য এ জীবনদর্শনকে তাদের খেয়াল-খুশির সাথে একাকার করে ফেলতে কোনো প্রন্থাই তারা তাদের গবেষণার বাহিরে রাখেনি। এক পর্য়ায় তারা মক্কায় একটি কুপ্রস্তাবের প্রোফাগান্ডা চড়িয়ে দিল। মক্কার অলিতে গলিতে তারা আপসকামিতার এক অশুভ সুর তুলল। যার পরিপেক্ষিতে মক্কার কাফেরগণ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে এসে এ প্রস্তাবনা পেশ করলো যে, এক বছর আমার সবাই মিলে আল্লাহর ইবাদাত করবো এবং পরবর্তী বছর আমরা সবাই মিলে মূর্তিপূজা করবো। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তাদের উল্লেখিত প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করে সাথে সাথেই আয়াত নাজিল করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন: হে নবী্ আপনি বলুন যে, তোমাদের জন্যে তোমাদের ধর্ম, আর আমার জন্যে আমার ধর্ম। সূরা কাফিরূন। উক্ত আয়াতখানি এ ব্যপারে পরিস্কার যে, আল্লাহ তায়ালা তাঁর আদেশ ও আদর্শে একদম অটল-অবিচল।
কিন্তু আপসকামিতায় মত্ত মুসলিমজাতির কাছে এ জাতীয় প্রস্তাবনা হয়তো আজ কোনো বিষয়ই না। কারণ দীর্ঘকাল যাবৎ মুসলিমজাতি কুফূরি শক্তির জাকজমক আর সামরিক মহড়ার তেজদৃপ্তির মাঝে বসবাস করার ধরুন আজ তারা ইসলামের পরিপূর্ণ বিজয়াবেসের পরিবর্তে কেবল আপসকামিতার স্বপ্নেই শুধু বিভোর রয়েছি। যে আপসকামিতা আজ আমাদের মধ্যে মহামাড়ির আকার ধারণ করেছে। যে আপসকামিতাই আজ আমাদের দ্বীনি কর্মসূচীকে কলষিত করছে। যে আপসকামিতা আজ আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে ম্লান করে দিচ্ছে। যে আপসকামিতাই আজ তাবলিগ নামক শরিয়তের গুরুত্বপূর্ণ একটি পরিভাষাকে শরয়ি-মানদন্ডের বাহিরে পৌঁছে দিয়েছে।
নতুবা কেন?, আজ এ পৃথিবীর খোলা আকাশের নিচে তাবলিগী কর্মসূচী নিয়ে বিচরণকারী হাজার হাজার মুবাল্লিগীনদের মধ্যে সাহাবাদের অনুরূপ আপসহীন, সত্যিকার, সত্যবাদী কোনো মুবাল্লিগ পাওয়া যায় না। কেন আজ?, তাদের মধ্যে ইমানী তেজদৃপ্তি আর অগ্নিশীখার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় না। কেন আজ?, তাদের মধ্যে বিশ্বমানবতাকে টেনে-হেঁচড়ে হলেও ইহকালিন-পরকালিন মুক্তির পথে নিয়ে আসার মতন যথাপোযুক্ত কোনো কর্মসূচী লক্ষ্য করা যায় না। সারা পৃথিবী আজ জালিমশাহীর শতভাগ কড়ায়েত্তে চলে যাওয়ার পরও, কেন আজ তারা তাদের বিরুদ্ধে হায়দারি হুক্কার পুনোরাই উচ্চারণ করে না। কেন আ্জ?, তারা জীবনের মোহ-মায়াকে পেছনে ফেলে হলেও সত্যকালিমার দাওয়াত নিয়ে রাজা-বাদশাহদের দার-দুয়ারে গাস্ত করে না?
অতচ আমরা জানি যে, জীবনের সর্বক্ষেত্রেই ইসলামের রূপরেখা ফেট্রিকেলি, অভিনব, মানসম্মত। ইসলাম বাহ্যিক-অভ্যতরীণ উভয় দিক থেকেই সৌন্দর্য় মন্ডিত। ইসলাম লক্ষ্যে-উদ্দেশ্যে ও কর্মসূচী নির্ধারণের ক্ষেত্রে নিখুত। লক্ষ্যভ্রষ্টতা কিংবা ব্যর্থকর্মসূচীর দ্বায়ভার ইসলাম গ্রহণ করতে কিছুতেই প্রস্তুত নয়। একজন মুমিন জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য থেকে লাইনচ্যুত হয়ে উদ্ভান্ত পথিকের ন্যায় জীবন যাপন করুক, ইসলাম তা কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। ঠিব তদ্ররূপ সঙ্গবদ্ধভাবে মুমিনদের কোনো জামাত ত্রুটিযুক্ত, লক্ষ্যভ্রষ্ট কোনো কর্মসূচী নিয়ে এগিয়ে যাক, ইসলাম এরও অনুমোদ প্রদান করে না। এক কথায় ব্যক্তিগত জীবনে যেমন একজন মুমিন সুনির্দিষ্ট বিধিমালায় বিধিবদ্ধ, জামাতগত বা সামুষ্ঠিক জীবনের ক্ষেত্রেও সকল মুসলমান সুনির্দিষ্ট নীতিমালায় আবদ্ধ। কেউ চাইলেই ইসলাম ও মুসলমানদের মধ্যে কোনো জামাত তৈরি করতে পারবে না। ইচ্ছা করলেই মুসলমানরা যে কোনো জামাতের সাথে একিভূত হতে পারবে না। যেমন ইচ্ছা করলেই কেউ ইসলামিক জামাতের মৌলিক কোনো নীতিমালায় পরিবর্তন আনতে পারবে না। এক কথায় উল্লিখিত বিষয়সমূহ আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক নির্ধারিত ও পূর্বাপরিকল্পিত।
তা ছাড়াও সঠিক কর্মপ্রন্থা-কর্মসূচীর দিক দিয়ে যে জাতি যতটুক সুসংহত বাহ্যিক ফলাফলের দিক দিয়ে তারা ততোবেশি উন্নত। আর তাই, সর্বাগ্রাসি কুফুরি শক্তির কাছে মুসলিম জাতির পরাজয় বরণের পর পরেই, মুসলিম জাতির সর্বিক বিজয়ের জন্যে তাদের মাঝে সঠিক কর্মপ্রন্থা ও কর্মসূচী সম্পূর্ণ একটি দাওয়াতি মিশনেরই অত্যাধিক প্রয়োজন ছিল। হাজারে হাজারে না হলেও তাদের মাঝে এমন কিছু দায়ী ও মুবাল্লিগ তৈরির প্রয়োজন ছিল, যারা সত্যিই আল্লাহর দ্বীনের একেকজন আপসহীন মুবাল্লিগ। যারা অসত্য-অন্যায়ের বিরুদ্ধে সত্যিই শক্তিশালী এক লাঠিয়াল বাহিণী। যারা কাজে কর্মে, সব দিক দিয়েই একজন মুনিন। জীবনের সর্বক্ষেত্রেই যারা আল্লাহর প্রেরিত সেই সত্যিকার খলিফার একজন বাস্তব প্রতিচ্ছবি। যারা আল্লাহর ইচ্ছা-অভিপায়কে মানুষের মাঝে দেখিয়ে যাবে, কোরবানির জন্তুর ন্যায় মরে হলেও। যারা সর্বক্ষেত্রেই ইসলামের আলোকে ছড়িয়ে দিবে, জোনাকির ন্যায় মিটিমিটিভাবে জ্বলে হলেও। যারা বিশ্বমানবতাকে জুলুমবাজ নীতি আর দর্শনের ভেড়াজাল থেকে মুক্ত করবে, অবশেষ রক্তবৃন্দুর বিনিময়ে হলেও। যারা কুফুরি শক্তির মূলে কম্পন তৈরি করবে, নিজেদের সবটুকু শক্তি-সামথ্যের প্রয়োজনে হলেও।
কিন্তু চলমান এ তাবলিগী জামাতকে কোনো পরিমাপ যন্ত্রের মাধ্যমেই আমরা ইসলামের তাবলিগ নামক পরিভাষাটির সত্যিকার ধারক বাহক রূপে মাপতে পারি না। এ জামাতের কর্মসূচী নিয়ে পুরো পৃথিবী জুড়ে বিচরণকারী হাজার হাজার দায়ী-মুবাল্লিগদেরকে কোনো পরীক্ষার মাধ্যমেই আমরা সাহাবাদের মতন আপসহীন, সত্যিকার, সত্যবাদি মুবাল্লিগিনদের অনুরূপ দেখতে পাই না। কারণ ওহীর কালি কোরআন দ্বারা আল্লাহ তায়ালা একজন দায়ীর যে সকল গুণাবলি ও চিত্র আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন এর সাথে চলমান তাবলিগী জামাতের কোনো মিল আমরা খুঁজে পাই না। উদাহরণ স্বরূপ একটি অমিল এখানে আমরা তুলে ধরছি। আল্লাহ তায়ালা বলেন:
الذين يبلّغون رسلت اللّه ويخشونه ولا سخشون أحدا إلّا اللّه ، وكفي باللّه حسيبا
তরজমা: যারা আল্লাহ ভীতির সাথে আল্লাহর পয়গামসমূহ পৌঁছেয়ে দেয়, তারা শুধু আল্লাহকেই ভয় করে। আর (তাদের জন্যে) আল্লাহ তায়ালাই যথেষ্ট।(আহযাব-৩৯)অর্থাৎ এ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা নবী-রাসূলদের একটি গুণ উল্লেখ করেছেন যে, নবী-রাসূলগণ আল্লাহ ভীতির সাথে মানুষের মাঝে আল্লাহর বাণীসমূহ পৌঁছে দিতেন। কিন্তু তারা আল্লাহকে ছাড়া অন্য কাউকে কোনো রূপ ভয় করতেন না। যা কিনা ধারাবাহিকভাবে নবী-রাসূলদের অনুসারী অনুগামীদের ক্ষেত্রেও প্রজোয্য যে, তাঁরাও যখন নবী-রাসূদের আনিত দ্বীন ও শরিয়ত মানুষদের মাঝে পৌঁছে দিবেন তখন আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকেই তারা ভয় পাবেন না। তা ছাড়াও আল্লাহ ব্যতিত অন্য কাউকে ভয় না করা, একজন মুমিনের অন্যতম একটি গুণ। যে গুণটি একজন দায়ীর ক্ষেত্রে আরো বিশেষভাবে লক্ষণীয়। অর্থাৎ একজন দায়ী/মুবাল্লিগ কাপুরুষ ও ভীতু হবে না। বরং সৎ সাহসের অধিকারী নির্ভয় হবে। আর নির্ভয়ভাবেই আল্লাহর দ্বীনকে মানুষের মাঝে পৌঁছে দিবে।
কিন্তু হযরত মাওলানা ইলিয়াস রহ: কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত তাবলিগ জামাতের সার্বিক ক্রিয়া-কর্ম, প্রন্থা-প্রদ্ধতি, কর্মশালা-কর্মসূচীর দিকে গভীরভাবে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে কিছুতেই এ জামাতের কর্মী সদস্যদের মধ্যে উল্লেখিত বৈশিষ্ট্যের কিদয়াংশও খুঁজে পাওয়া যায় না। কোরআনের দৃষ্টিতে যে বৈশিষ্ট্যটি একজন দায়ীর জন্যে অতীভ গুরুত্বপূর্ণ। কোরআনের আলোকে যে বৈশিষ্ট্য ব্যতিত একজন দায়ীর প্রকৃত চিত্র অঙ্কন করা প্রায় অসম্ভব। আর উল্লিখিত বৈশিষ্টের অনুপস্থিতিই আজ তাদেরকে তাগুতি সমাজ ব্যবস্তার ব্যপারে কিছু বলা ও করার বিষয়টিকে নিজেদের দৃষ্টি সীমার বাহিরে রাখতে বাধ্য করেছে। যে বৈশিষ্টের অনুপস্থিতিই আজ তাদেরকে তাগুতি শক্তির সামনে বোবা শয়তানের বেস ধারণ করতে বাধ্য করেছে। যে বৈশিষ্টের শূন্যতাই আজ তাদেরকে আপসকামী কর্মসূচী হাতে নিতে প্রেরণা যোগিয়েছে। (চলবে.. ইনশাল্লাহ)
Comment