দারসুল কুরআন
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
وَلَنَبْلُوَنَّكُم بِشَيْءٍ مِّنَ الْخَوْفِ وَالْجُوعِ وَنَقْصٍ مِّنَ الْأَمْوَالِ وَالْأَنفُسِ وَالثَّمَرَاتِ ۗ وَبَشِّرِ الصَّابِرِينَ
‘‘এবং অবশ্যই আমি তোমাদিগকে পরীক্ষা করবো কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, মাল ও জানের ক্ষতি ও ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে সুসংবাদ দাও সবরকারীদের।” (সূরা বাকারা: ১৫৫)
জান্নাত প্রভুর দেয়া নেয়ামত। সেকি এমনি এমনিই পাওয়া যায়? অনেক পথ পাড়ি দিয়েই তবে তা অর্জন করা সম্ভব। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন-
أَمْ حَسِبْتُمْ أَنْ تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَأْتِكُمْ مَثَلُ الَّذِينَ خَلَوْا مِنْ قَبْلِكُمْ مَسَّتْهُمُ الْبَأْسَاءُ وَالضَّرَّاءُ وَزُلْزِلُوا حَتَّى يَقُولَ الرَّسُولُ وَالَّذِينَ آمَنُوا مَعَهُ مَتَى نَصْرُ اللَّهِ أَلَا إِنَّ نَصْرَ اللَّهِ قَرِيبٌ
‘‘(হে মুমিনগণ!) তোমরা কি মনে করেছো, তোমরা জান্নাতে (এমনিতেই) প্রবেশ করবে; অথচ এখনও পর্যন্ত তোমাদের ওপর সেই রকম অবস্থা আসেনি, যেমনটা এসেছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর। তাদের ওপর এসেছিল অর্থসংকট ও দুঃখ-কষ্ট এবং তাদেরকে করা হয়েছিল প্রকম্পিত; এমনকি রাসূল এবং তাঁর ঈমানদার সঙ্গীগণ বলে উঠেছিল আল্লাহর সাহায্য কখন আসবে? মনে রেখো, আল্লাহর সাহায্য নিকটেই।” (সূরা বাকারা: ২১৪)
অপর এক আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন -
أَحَسِبَ النَّاسُ أَنْ يُتْرَكُوا أَنْ يَقُولُوا آمَنَّا وَهُمْ لَا يُفْتَنُونَ
‘‘মানুষ কি মনে করে ‘আমরা ঈমান এনেছি’ এ কথা বললেই তাদেরকে পরীক্ষা না করে ছেড়ে দেওয়া হবে? ” – (সূরা আনকাবূত: ২)
কেন এই পরীক্ষা?
সূরা বাকারার আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা স্পষ্টভাবে বলেছেন, অবশ্যই তিনি তার বান্দাদের পরীক্ষা নেবেন; নানাভাবে। যেন ঈমানের দাবিতে সত্যবাদী আর মিথ্যাবাদীদের মাঝে পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে যায়। কে ধৈর্যশীল আর কে ধৈর্যহারা তা চিহ্নিত হয়ে যায়। এটা মহান প্রভুর নীতি। অবশ্য এর বোধগম্য কারণও রয়েছে। মুমিনরা যদি সর্বদা স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন যাপন করেন, কষ্ট-মুসীবতের মুখোমুখি না হন - তাহলে দুরাচার বেড়ে যাবে; যা পরিণামে ধ্বংস ডেকে আনতে পারে। তবে প্রজ্ঞাময় আল্লাহ চান উভয়ের মধ্যকার ব্যবধান সুস্পষ্ট করে তুলতে। পরীক্ষার মাহাত্ম্য এখানেই। উদ্দেশ্য মোটেই তাদের বিতাড়িত করা নয়।
বান্দার সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা হলো রবের পথে স্বীয় প্রাণ বিসর্জন করা। যার ভাগ্যে এটা জুটে; সে তো ভাগ্যবান। যে সফলতা তাকে নবীদের পড়শি হওয়ার সুযোগ করে দেয় তার তুল্য কীসে? যাদের ভাগ্যে এটা না আসে তাদের পরীক্ষাও কিন্তু কম নয়!
পরীক্ষার বিবরণ অনেক আয়াতে এসেছে। যেমন, সূরা মুহাম্মাদে আল্লাহ তা’আলা বলেন –
وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ حَتَّىٰ نَعْلَمَ الْمُجَاهِدِينَ مِنكُمْ وَالصَّابِرِينَ وَنَبْلُوَ أَخْبَارَكُمْ ﴿٣١﴾
‘‘অবশ্যই আমি তোমাদের পরীক্ষা করবো। যেন স্পষ্ট করে তুলি, তোমাদের কারা মুজাহিদ আর ধৈর্যশীল এবং তোমাদের অবস্থাদিও যাচাই করে নিই।” (সূরা মুহাম্মদ: ৩১)
সূরা বাকারার উপরোক্ত আয়াতেও পরীক্ষার বিস্তারিত বিবরণ এসেছে।
আল্লাহ বলেন, অবশ্যই আমি তোমাদের পরীক্ষা নিব! কীভাবে? কিছু ভয় দিয়ে। কিছু ক্ষুধার পীড়ন দিয়ে। ধন-সম্পদের ক্ষতিসাধন করে। ফল-ফসলের ক্ষতি করে। এমনকি তোমাদের প্রিয়জনের জীবন অবসানের মাধ্যমে।
প্রকৃতপক্ষে, এ পরীক্ষার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা বান্দাকে প্রশিক্ষণ দিতে চান। কারণ, দ্বীনের সৈনিকদের বিপদাপদ ও সংকটাবস্থার মধ্য দিয়েই সামনে এগিয়ে যেতে হবে। কথায় আছে না ‘আগুনে পুড়িয়া সোনা খাঁটি হয় তবে।’।
হ্যাঁ, দ্বীনের পথে যখন কষ্ট-মুসীবত আসবে, তখন তার প্রতি ভালোবাসা গাঢ় হবে! তার মূল্য বুঝে আসবে। আর তখন দ্বীনের ওপর আঘাত আসলে, সে আঘাত তার অন্তরে যেয়ে লাগবে। দ্বীনের জন্যে এ কুরবানিই শত্রুদের ভাবতে বাধ্য করবে ‘এরা কীসের বলে মৃত্যুকে হাসিমুখে বরণ করে নেয়? কীসে এদের এতোটা ক্ষিপ্ত করে তুলে?’
হ্যাঁ, আল্লাহর সাহায্য তখনই অবিরল ধারায় বর্ষিত হয়। দলে দলে মানুষ কাফেলাবদ্ধ হতে ছুটে আসে। উমর, হামজা, খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এ আকর্ষণেই মাথা নুইয়ে দিয়েছেন সত্যের সম্মুখে।
সবচেয়ে বড় কথা হলো বিপদ-মুসীবত এলেই আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ক দৃঢ় হয়। মুমিন যখন দেখে, পুরো পৃথিবী তার বিরুদ্ধে; বাহ্যত সাহায্যের সকল পথ রুদ্ধ; তখন আল্লাহ তা‘আলার ওপর তার ভরসা শতগুণ বৃদ্ধি পায়। আর তখনই আল্লাহর মদদ অকল্পনীয়ভাবে আসে। গায়েবের দরজা যখন খুলে যায় তার দানটাও হয় অফুরান! যেমনটা পবিত্র কুরআনে বিবৃত হয়েছে, এভাবে ‘‘নিশ্চয়ই ধৈর্যশীলদের প্রতিদান দেয়া হয় অগুনতিভাবে।”
প্রশ্ন ওঠতে পারে, কষ্ট-পরীক্ষা যখন চরমে পৌঁছে; তখন ধৈর্যের বাঁধও তো দুর্বল হয়ে পড়া অস্বাভাবিক নয়?
বলি, কুরআন এর সহজ সমাধান বলে দিয়েছে –
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اسْتَعِينُوا بِالصَّبْرِ وَالصَّلَاةِ ۚ إِنَّ اللَّـهَ مَعَ الصَّابِرِينَ ﴿١٥٣﴾
‘‘হে মুমিনগণ! তোমরা ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো। নিশ্চিতই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে রয়েছেন।”
(সূরা বাকারা: ১৫৩)
হ্যাঁ, নামাজ এমন এক ইবাদত; যার মাধ্যমে খালেকের সাথে মাখলুকের সম্পর্ক স্থাপিত হয় অত্যন্ত নিবিড়ভাবে। নামাজই সবকিছুর চাবিকাঠি। আর এজন্যেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখনই কোন বিষয়ে চিন্তিত হতেন নামাজে দাঁড়িয়ে যেতেন।
প্রিয় ভাই! হীনবল হয়ো না, চিন্তিত হয়ো না! রব্বে মুহাম্মদের শপথ! তোমরাই বিজয়ী হবে! তাই পরিস্থিতি যত জটিল হোক; দুনিয়া তোমাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিক; বন্ধুরা-শত্রুরা এক কাতারে চলে যাক। রব তো আছেন তোমাদের সাথে! তাঁর কদমে সঁপে দাও নিজেদের! সাহায্য চাও সেই সত্তার কাছে; যিনি অসীম দাতা; পরম দয়ালু।
****************
( লেখাটি আল বালাগ ম্যাগাজিনের সংখ্যা ৩ থেকে সংগৃহীত ও অনূদিত)
( লেখাটি আল বালাগ ম্যাগাজিনের সংখ্যা ৩ থেকে সংগৃহীত ও অনূদিত)
Comment