কুরআন কি তার রহস্য ভান্ডার আপনার সামনে খুলে দিয়েছে?
আমরা প্রত্যেকেই জীবনে অনেক বই পড়ি। তার মধ্যে কিছু বই আছে যাতে থাকে তথ্য বা ইতিহাস, যা থেকে যে কেহই উপকৃত হতে পারে। আবার কিছু বই আছে প্রেক্টিক্যাল বা বাস্তবায়নধর্মী, সেগুলো থেকে শুধু সেই সমস্ত ব্যক্তিরাই বুঝে ও উপকৃত হতে পারে যারা সেই বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করবে।
ডাক্তারী বিদ্যার ক্ষেত্রেই লক্ষ্য করুন, আমাদের সাভাবিক জীবনের সাথে সম্পর্কিত সাধারণ পরামর্শ আমরা বুঝতে পারলেও ডাক্তারী বিষয়ের বিস্তারিত ও জটিল বিষয়গুলো আমরা যারা ডাক্তার নই তারা কিছুই বুঝব না, কিছু ইংরেজি শব্দ বুঝলেও সেগুলো থেকে কোন উপকার অর্জন করা সম্ভব নয়। আমরা কখনোই অপারেশন বাঁ সার্জারি করার দুঃসাহস করতে পারব না।
ঠিক তেমনি ভাবে পদার্থবিজ্ঞান বা জীববিজ্ঞান সহ পৃথিবীর সমস্ত প্রেক্টিক্যাল বিদ্যার বই পরে শুধু শাব্দিক অর্থ বুঝলেও নিগূড় বাস্তবতা বুঝা সম্ভব নয়। কারণ এই বিষয়গুলোই এমন যা আপনি বই পরে কিছু নীতিমালা জানলেও বাস্তবায়ন ছাড়া মূল অনুভূতি, অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান অর্জন সম্ভব নয়।
কুরআনের ব্যপারে আমরা সবাই বলি এটা হচ্ছে “পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান”। জীবন বিধানের অর্থ কি? কখনো কি চিন্তা করেছেন? ‘বাস্তব জীবনের পূর্ণাঙ্গ গাইড লাইন’ দ্বারা কুরআন আমাদেরকে কী বার্তা দিচ্ছে তা কি ভেবে দেখেছি? কেন কুরআনকে একেবারে নাজিল করা হয় নি? কেন ২৩ বছরের ধীর্ঘ সময়ে আস্তে আস্তে নাজিল হয়েছে?
কুরআনকে দীর্ঘ সময়ে অবতীর্ণ করার কারণ হচ্ছে এই মহান কিতাব শুধু তথ্য বাঁ ইতিহাস বর্ণনার জন্যে নাজিল করা হয় নি। বরং মানুষের জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে বাস্তব সমাধান হিসেবে অবতরণ করা হয়েছে। আপনি কুরআনের প্রতিটা আয়াতের শানে নুজুলের দিকে খেয়াল করলেই বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে যাবে। কুরআনের কোন অবস্থায় কোন আয়াত কী সমাধান নিয়ে আলোচিত হয়েছে তা নিয়ে সালাফরা অনেক বিশাল বিশাল কিতাব লিখেছেন, উদাহারণ স্বরূপ কিছু উল্ল্যেখ করা যায়।
নববী যুগের শুরুতে যখন সাহাবীরা মাত্র জাহিলিয়্যাতের জীবন থেকে ইসলামের পথে এসেছ, সেই সময়ের মাক্কী আয়াতগুলোর দিকে লক্ষে করলে দেখবেন সেই সময়ে বাস্তব জীবনে যা প্রয়োজন সেই বিধানগুলোই নাজিল করা হয়েছে।
ঈমান ও আকীদা নিয়ে আয়াত নাজিল হয়েছে, আল্লাহর ভয় ও আল্লাহর মা’রেফাত নিয়ে আয়াত নাজিল হয়েছে। এরপর বিশ্ব জগত নিয়ে তাদের ভ্রান্ত ধারনা দূর করার জন্যে আসমান জমিনের ব্যাপারে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আয়াত নাজিল হয়েছে, এই পৃথিবী ও সমস্ত মাখলুকাত যে একমাত্র আল্লাহ তায়ালারই ইবাদাত করে, তা বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে। যাতে বেশি বেশি ফিকিরের মাধ্যমে ঈমানকে দৃঢ় করতে পারেন।
সেই সাথে দুনিয়ার জীবন ও আখেরাতের জীবনের বাস্তবতা নিয়ে অনেক আয়াত নাজিল হয়েছে, যাতে তারা জাহিলিয়্যাতের শুরুতে দুনিয়ার মহাব্বত দূর করে আখেরাতের দিকে ধাবিত হতে পারেন। এরপর মানুষের নফস, শয়তানের ধোঁকা ও সেগুলো থেকে বাঁচার পদ্ধতি নিয়ে বিশাল আলোচনা হয়েছে, এগুলোর অধিকাংশই মাক্কী সূরাগুলোতে রয়েছে।
এরপর দ্বীনের দাওয়াত ছড়িয়ে দেয়ার আদেশ নাজিল হল এবং কীভাবে দ্বীনের দাওয়াত দিবে তার নীতিমালাও বর্ণনা করা হয়েছে। মূসা আ. সহ অন্যান্য নবীদের কাহিনী থেকে উদাহারণ দিয়ে বাস্তবিকভাবে বুঝিয়ে দেয়া হল কীভাবে
হিকমতের সাথে দাওয়াহ দিতে হবে। এরপর যখন দাওয়াতের ক্ষেত্রে বিপদের সম্মুখীন হচ্ছিলেন, তখন একদিকে ধৈর্য ও সবরের আয়াত ও পূর্বের নবীদের বিপদের ঘটনাগুলো নাজিল হচ্ছিল। অন্যদিকে বিপদে সবরের ফলে জান্নাতে কী ধরনের নেয়ামত ভোগ করবে তার আগ্রহ দেখানো হচ্ছিল ও দ্বীনের কাজ ছেড়ে দিলে জাহান্নামের ভয়াবহ শাস্তির ভয় দেখানো হচ্ছিল।
এরপর মাদীনাতে যাওয়ার পর শুরুতে জিহাদের অনুমতি আসল, সাহাবীদের মধ্যের ভ্রাতৃত্বের আদেশ আসল এবং রাষ্ট্র গঠনের প্রাথমিক বিধানগুলো নাজিল হল। যুদ্ধ সমূহে সাহাবীরা কীভাবে বিজয়ী হবে ও পূর্বের নবীরা কীভাবে আল্লাহর সাহায্য পেয়েছে তার আয়াত নাজিল হয়েছে। আস্তে আস্তে যখন মুসলিমদের শক্তি বৃদ্ধি পেয়েছে তখন প্রতিরোধ যুদ্ধ ও সর্বশেষ ব্যপক আক্রমণের আদেশ এসেছে। সেই সাথে ইসলামী রাষ্ট্রের বিধানগুলো যখন যে বিধান বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে তখন সেটাই নাজিল হয়েছে।
অন্যদিকে সাহাবাদের বিভিন্ন ঘটনা প্রেক্ষিতে সেই বিষয়ের সমাধান নাজিল হচ্ছিল। বদরে কেন বিজয় হয়েছিল তার আয়াত নাজিল হয়েছে, উহুদে কেন পরাজয় এসেছে, আহযাবের যুদ্ধে মুসলিমদের মনের অবস্থা ও কাফেরদের হালত নিয়ে বিস্তারিত নির্দেশনা এসেছে। আবার কিছু সাহাবী যখন জিহাদ থেকে পিছনে ছিল তখন শাস্তির আয়াত নাজিল হয়েছে, ইসলামের কিছুটা বিজয় শুরু হওয়ার পর যখন মুনাফিকরা চক্রান্ত শুরু করে তখন তাদের আলামত নিয়ে বিস্তারিত নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এইভাবে জীবনের প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে বাস্তবিক সমাধান হিসেবে কুরআন নাজিল হয়েছে। শুধু কুরআনে কারীম নয়, আল্লাহর নবীর হাদীসগুলোও জীবনের বাকে বাকে ছড়িয়ে থাকা প্রত্যেকটা ঘটনা প্রেক্ষিতেই বর্ণিত হয়েছে।
এখন একটু চিন্তা করে দেখুন তো, বাস্তব পরিবেশে যাওয়া ছাড়া কী এগুলো গভীরংভাবে বুঝা সম্ভব? যে কোন দিন বিপদে পরেনি, সে কি বিপদে কিভাবে ঈমান বাড়ে বা ঈমানের পরীক্ষা হয় সেই আয়াত বুঝবে? যে কোন দিন ত্বাগুতের সামনে দাঁড়ায় নি তার পক্ষে কি মুসা আ. এর ফেরাউনের সামনে দাঁড়ানোর অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝা সম্ভব? যে কোন দিন জেলে যায় নি সে কীভাবে ইউসুফ আ. এর ঘটনা সঠিক অনুধাবন করবে শুধু কিছু শাব্দিক অনুবাদ ছাড়া? যারা কোন দিন জিহাদে যায় নি তারা কীভাবে জিহাদের ইলম ও ফিকহ বুঝতে পারবে?
সেই সাথে কুরআনের একটা গুরুত্বপূর্ণ আদেশ হচ্ছে, এই দ্বীনকে সমস্ত দ্বীনের উপর বিজয় করা। যদি ভালোভাবে ফিকির করেন তো দেখবেন আল্লাহ তায়ালা ইসলামের বিধানগুলোকে এমন ভাবে তৈরি করেছেন যার অধিকাংশই দ্বীন প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া পূর্ণভাবে
পালন ও বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এই জন্যে আল্লাহ তায়ালা সাহাবাদেরকে প্রতিপালনের পরিবেশ সেই ভাবেই করেছেন, যেভাবে তাদের জন্যে কুরআনকে জীবনে সঠিক বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। মাক্কী জীবনে কাফেরদের প্রচন্ড নির্যাতন সত্ত্বেও দ্বীনের দাওয়াহ ছড়িয়ে দেয়া ও মাদানী জীবনে জান-মাল বিলিয়ে দিয়ে সেই দ্বীনকে পূরা দুনিয়াতে প্রতিষ্ঠা করার জিহাদ করা, এটাই সাহাবাদের জীবন-যাপনের মূল পরিবেশ।
তাই বর্তমানেই আমাদের সেই পরিবেশেই যেতে হবে যে পরিবেশে কুরআন নাজিল হয়েছে, যেই পরিবেশে সাহাবারা কুরআন বুঝেছেন। কারণ সেই বাস্তব পরিবেশ ছাড়া এই মহান জীবন বিধান শুধু কিছু শাব্দিক অর্থ ছাড়া আর কিছুই বুঝা সম্ভব নয়। আর বর্তমানে শুধুমাত্র মুজাহিদীনে কেরাম সেই পরিবেশে বাস করেন যেই পরিবেশে কুরআন নাজিল হয়েছে, যে পরিবেশে সাহাবীরা আস্তে আস্তে দ্বীন বুঝেছেন ও জীবনে বাস্তবায়ন করেছেন। এই জন্যে দ্বীনের এমন অসংখ্য বিধান রয়েছে যা সঠিকভাবে জিহাদের ফরজ আদায়কারী মুজাহিদরা ছাড়া অন্য কেহই বুঝে না, এমনকি গভীর গবেষনার মাধ্যমেও বুঝা সম্ভব হয় না। আর বাকি অন্যান্য বিধানের পূর্ণ হাকিকতও একমাত্র তাদের সামনেই স্পষ্ট হয়ে উঠে।
সাইয়্যেদ কুতুব শহীদ রাহিমাহুল্লাহ তার কালজয়ী তাফসিরে এই বিষয়টাই স্পষ্ট করে উল্ল্যেখ করেছেনঃ “আমরা দেখতে পাই, কুরআন তার রহস্যকে কেবল তাদের জন্যই খুলে দেয় যারা তাকে সঙ্গী করে রণাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং কুরআন দ্বারা বড় জিহাদে লিপ্ত হয়। কারণ এরাই একমাত্র ঐসকল ভাগ্যবান লোক যারা সেই পরিবেশে বসবাস করে যেই পরিবেশে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে”।
আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলেছেনঃ
رَضُوا بِأَن يَكُونُوا مَعَ الْخَوَالِفِ وَطُبِعَ عَلَىٰ قُلُوبِهِمْ فَهُمْ لَا يَفْقَهُونَ [٩:٨٧]
তারা পেছনে পড়ে থাকা লোকদের সাথে থেকে যেতে পেরে আনন্দিত হয়েছে এবং মোহর এঁটে দেয়া হয়েছে তাদের অন্তরসমূহের উপর। বস্তুতঃ তারা বোঝে না।
অর্থাৎ যারা জিহাদ থেকে বসে থাকে তাদের অন্তরে মহর এঁটে দেয়া হয়, আর যার অন্তরে মহর মেরে দেয়া হয় সে কিভাবে কুরআন বুঝবে? তাই আল্লাহ তায়ালাই বলছেন, জিহাদ থেকে বসে থাকা ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার আহকাম-নসিহাহ, জীবনের ভাল-মন্দ বুঝে না।
একদিন এক ভাই বলেছিলেন, “আমার কাছে মনে হয় কুরআনের রহস্যগুলো বিভিন্ন কাজ ও ঘটনার দ্বারা চাপা দেয়া রয়েছে। আপনি যখন সেই কাজ করবেন বা ঘটনার সম্মুখিন হবেন, শুধু তখনই তা আপনার সামনে খুলে যাবে ও পূর্ণ বুঝ অর্জিত হবে”। তাই তিনি ইচ্ছাকৃত বিভিন্ন কঠিন কাজ করতেন ও বিভিন্ন পরিবেশে যেতেন যাতে কুরানকে আরো ভালভাবে বুঝিতে পারেন।
আল্লাহ তায়ালা যেন আমাদেরকে সারা জীবন পূর্ণাঙ্গভাবে জিহাদের পথে থাকার তাওফীক দান করেন, অন্তরগুলোকে কুরআনের জন্যে খুলে দেন।
হে আল্লাহ, জীবন তো একটাই, মৃত্যুর পরে তো আবার ফিরে এসে দ্বীনের কাজ করতে পারব না। তাই স্বল্প জীবনেই সর্বোচ্চ দ্বীনের খেদমত করার তাওফীক দান করুন। আমীন।
Comment