জিহাদে অনুৎসাহিত করা মুনাফিকদের সিফাত
আল্লাহ তায়ালা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আদেশ করেছেন মুমিনদের জিহাদে উদ্বুদ্ধ করতে। ইরশাদ হয়েছে,
يَاأَيُّهَا النَّبِيُّ حَرِّضِ الْمُؤْمِنِينَ عَلَى الْقِتَالِ
‘হে নবী! মুমিনদের যুদ্ধের প্রতি উদ্বুদ্ধ করো। -সুরা আনফাল: ৬৫
অপর আয়াতে বলা হয়েছে, দুটি কাজ করলে আল্লাহ তায়ালা কাফেরদের শক্তি শেষ করে দিবেন,
ক. নিজে জিহাদ করা।
খ. মুমিনদের জিহাদের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা। কারণ জিহাদ একটি সংঘবদ্ধ কাজ। একা একা জিহাদ করা সম্ভব না, এজন্য একটি বাহিনী দরকার। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
فَقَاتِلْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ لَا تُكَلَّفُ إِلَّا نَفْسَكَ وَحَرِّضِ الْمُؤْمِنِينَ عَسَى اللَّهُ أَنْ يَكُفَّ بَأْسَ الَّذِينَ كَفَرُوا وَاللَّهُ أَشَدُّ بَأْسًا وَأَشَدُّ تَنْكِيلًا
‘সুতরাং (হে নবী!) তুমি আল্লাহর পথে যুদ্ধ করো। তোমার উপর তোমার নিজের ছাড়া অন্য কারোও দায়ভার নেই। অবশ্য মুমিনদেরকে উৎসাহ দিতে থাকো। অসম্ভব নয় যে, আল্লাহ কাফিরদের যুদ্ধ ক্ষমতা চূর্ণ করে দিবেন। আল্লাহর শক্তি সর্বাপেক্ষা প্রচণ্ড এবং তার শাস্তি অতি কঠোর।’ -সূরা নিসা: ৮৪
তাই নবীর অনুসারীদের বিশেষকরে নবীর ওয়ারিশ আলেমগণের দায়িত্ব হলো মুমিনদের জিহাদের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা। কিন্তু বর্তমানে দুঃখজনকভাবে সাধারণ মুসলিমদের পাশাপাশি আলেমগণও বিভিন্নভাবে জিহাদের প্রতি মুমিনদের নিরুৎসাহিত করছেন। নানা মনগড়া শর্ত আরোপ করে জিহাদের পথে বাঁধা সৃষ্টি করছেন। অথচ জিহাদে বাঁধা দেয়া, জিহাদের প্রতি নিরুৎসাহিত করা তো মুনাফিকদের সিফাত, যা আলেম তো দূরের কথা একজন সাধারণ মুসলমানের মাঝেও না থাকা কাম্য। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
قَدْ يَعْلَمُ اللَّهُ الْمُعَوِّقِينَ مِنْكُمْ وَالْقَائِلِينَ لِإِخْوَانِهِمْ هَلُمَّ إِلَيْنَا وَلَا يَأْتُونَ الْبَأْسَ إِلَّا قَلِيلًا أَشِحَّةً عَلَيْكُمْ
‘আল্লাহ তাদেরকে ভালো করেই জানেন, তোমাদের মধ্যে যারা (জিহাদে) বাধা সৃষ্টি করে এবং নিজ ভাইদেরকে বলে, আমাদের কাছে চলে এসো। আর তারা নিজেরা তো যুদ্ধে আসেই না; আসলেও তা অতি সামান্য। (এবং তাও তোমাদের গনিমতের) প্রতি লালায়িত হয়ে।’ -সূরা আহযাব: ১৮-১৯
অপর আয়াতে ইরশাদ হয়েছে,
وَإِنَّ مِنْكُمْ لَمَنْ لَيُبَطِّئَنَّ فَإِنْ أَصَابَتْكُمْ مُصِيبَةٌ قَالَ قَدْ أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيَّ إِذْ لَمْ أَكُنْ مَعَهُمْ شَهِيدًا وَلَئِنْ أَصَابَكُمْ فَضْلٌ مِنَ اللَّهِ لَيَقُولَنَّ كَأَنْ لَمْ تَكُنْ بَيْنَكُمْ وَبَيْنَهُ مَوَدَّةٌ يَالَيْتَنِي كُنْتُ مَعَهُمْ فَأَفُوزَ فَوْزًا عَظِيمًا
‘নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে এমন কেউও থাকবে, যে নিজেও (জিহাদে বের হতে) গড়িমসি করবে, অপরকেও নিরুৎসাহিত করবে। তারপর (জিহাদ কালে) তোমাদের কোনও মসিবত দেখা দিলে বলবে, আল্লাহ আমার উপর বড় অনুগ্রহ করেছেন যে, আমি তাদের সাথে উপস্থিত ছিলাম না। আর আল্লাহর পক্ষ হতে তোমরা কোন অনুগ্রহ (বিজয় ও গনিমতের মাল) লাভ করলে সে বলবে -যেন তোমাদের ও তার মধ্যে কখনোও কোন সম্পৃীতি ছিল না- ‘হায় যদি আমিও তাদের সঙ্গে থাকতাম, তবে আমার ভাগ্যেও অনেক কিছু জুটতো।’ -সূরা নিসা: ৭২-৭৩ তাফসীরে ইবনে কাসীর: ২/৩৫৭
অন্যত্র বলা হয়েছে,
فَرِحَ الْمُخَلَّفُونَ بِمَقْعَدِهِمْ خِلَافَ رَسُولِ اللَّهِ وَكَرِهُوا أَنْ يُجَاهِدُوا بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَقَالُوا لَا تَنْفِرُوا فِي الْحَرِّ قُلْ نَارُ جَهَنَّمَ أَشَدُّ حَرًّا لَوْ كَانُوا يَفْقَهُونَ
‘যাদেরকে (তাবুক যুদ্ধ হতে) পিছনে থাকতে দেয়া হয়েছিল, তারা রাসূলুল্লাহর যাওয়ার পর (নিজ গৃহে) বসে থাকাতে আনন্দ লাভ করলো। আর আল্লাহর পথে নিজেদের জান-মাল দ্বারা জিহাদ করা তাদের কাছে অপছন্দ ছিল। তারা বলেছিল, এই গরমে বের হয়ো না। বল, উত্তাপে জাহান্নামের আগুন তীব্রতর। যদি তারা বুঝতো!’ –সূরা তাওবা: ৮১
আরো ইরশাদ হয়েছে,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ كَفَرُوا وَقَالُوا لِإِخْوَانِهِمْ إِذَا ضَرَبُوا فِي الْأَرْضِ أَوْ كَانُوا غُزًّى لَوْ كَانُوا عِنْدَنَا مَا مَاتُوا وَمَا قُتِلُوا لِيَجْعَلَ اللَّهُ ذَلِكَ حَسْرَةً فِي قُلُوبِهِمْ وَاللَّهُ يُحْيِي وَيُمِيتُ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ
‘হে মুমিনগণ! সেই সব লোকের মতো হয়ে যেও না, যারা কুফর অবলম্বন করেছে এবং তাদের ভাইয়েরা যখন কোনও দেশে সফর করে কিংবা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে, তখন তাদের সম্পর্কে তারা বলে, তারা আমাদের সঙ্গে থাকলে মারা যেতো না এবং নিহতও হতো না। (তাদের এ কথার) পরিণাম তো (কেবল) এই যে, এরূপ কথাকে আল্লাহ তাদের অন্তরের আক্ষেপে পরিণত করেন। (নচেৎ) জীবন ও মৃত্যু তো আল্লাহই দেন। আর তোমরা যে কর্মই করো, আল্লাহ তা দেখছেন।’ -সূরা আলে ইমরান: ১৫৬
আয়াতের তাফসীরে আল্লামা শানকিতি রহ. বলেন,
ذكر في هذه الآية الكريمة أن المنافقين إذا مات بعض إخوانهم يقولون: لو أطاعونا فلم يخرجوا إلى الغزو ما قتلوا، ولم يبين هنا هل يقولون لهم ذلك قبل السفر إلى الغزو ليثبطوهم أو لا؟ … ولكنه بين في آيات أخر أنهم يقولون لهم ذلك قبل الغزو ليثبطوهم كقوله: وقالوا لا تنفروا في الحر الآية، وقوله: قد يعلم الله المعوقين منكم والقائلين لإخوانهم هلم إلينا، وقوله: وإن منكم لمن ليبطئن، إلى غير ذلك من الآيات. (أضواء البيان في إيضاح القرآن بالقرآن: 1/214)
‘এই আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে, যখন মুনাফিকদের কোন ভাই মারা যায় তখন তারা বলে, তারা জিহাদে না যাওয়ার ব্যাপারে আমাদের কথা মানলে নিহত হতো না। তারা জিহাদে যাওয়ার পূর্বে তাদেরকে কি কথা বলতো, তা উক্ত আয়াতে উল্লেখ করা হয়নি। ….. কিন্তু অন্যান্য আয়াতে স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে যে, তারা তাদেরকে জিহাদে যেতে বারণ করতো। যেমন এক আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তারা বলেছিল, এই গরমে বের হয়ো না।’ অপর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ তাদেরকে ভালো করেই জানেন, তোমাদের মধ্যে যারা (জিহাদে) বাধা সৃষ্টি করে এবং নিজ ভাইদেরকে বলে, আমাদের কাছে চলে এসো।’ অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে এমন কেউও থাকবে, যে নিজেও (জিহাদে বের হতে) গড়িমসি করবে, অপরকেও নিরুৎসাহিত করবে।’ –আযওয়াউল বয়ান: ১/২১৪
يَاأَهْلَ يَثْرِبَ لَا مُقَامَ لَكُمْ فَارْجِعُوا
‘হে ইয়াসরিববাসী! (পুরো আরবের মোকাবেলায়) তোমাদের টিকে থাকার উপায় নেই। সুতরাং ফিরে চলে যাও।’ -সূরা আহযাব: ১৩; আততাহরীর ওয়ান তানভীর: ২১/২৮৪
এ আয়াত হতে বুঝে আসে, ‘কাফেরদের মোকাবেলার মত শক্তি আমাদের নেই’- এ কথা বলে জিহাদের প্রতি নিরুৎসাহিত করাও মুনাফিকদের সিফাত। পক্ষান্তরে নবী ও তার ওয়ারিশদের সিফাত হলো, কাফেরদের শক্তিসামর্থ্য কে মুমিনদের দৃষ্টিতে হেয় করে তোলা। প্রবন্ধের শুরুতে সুরা আনফালের যে আয়াতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মুমিনদের জিহাদের প্রতি উদ্বুদ্ধ করার আদেশ দেয়া হয়েছে, সেই আয়াতের পরের অংশে, নবী কি বলে মুমিনদের যুদ্ধের প্রতি উদ্বুদ্ধ করবেন, তাও বলে দেয়া হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, মুমিনদের শক্তি-সংখ্যা কম হলেও আল্লাহ তায়ালার সাহায্যে তারা বিজয় লাভ করবেন। অথচ কি আশ্চর্য আজ আমরা কিছু নামধারী আলেমকে দেখছি, তারা ঠিক মুনাফিকদের মতোই কাফেরদের শক্তির ভয় দেখিয়ে আমাদেরকে জিহাদের প্রতি নিরুৎসাহিত করছেন! আয়াতের পরের অংশ দেখুন,
إِنْ يَكُنْ مِنْكُمْ عِشْرُونَ صَابِرُونَ يَغْلِبُوا مِائَتَيْنِ وَإِنْ يَكُنْ مِنْكُمْ مِائَةٌ يَغْلِبُوا أَلْفًا مِنَ الَّذِينَ كَفَرُوا بِأَنَّهُمْ قَوْمٌ لَا يَفْقَهُونَ
‘তোমাদের মধ্যে যদি বিশজন ধৈর্যশীল লোক থাকে, তবে তারা দুশো জনের উপর জয়ী হবে। তোমাদের মধ্যে যদি একশো জন থাকে, তবে তারা এক হাজার কাফেরের উপর জয়ী হবে। কেননা তারা এমন এক সম্প্রদায় যারা বুঝ-সমঝ রাখে না। –আনফাল: ৬৬
আয়াতের তাফসীরে আল্লামা তাকী উসমানী দা.বা. বলেন, ‘যেহেতু সঠিক বুঝ রাখে না তাই ইসলামও গ্রহণ করে না। আর ইসলাম গ্রহণ না করার কারণে আল্লাহ তায়ালার গায়েবী সাহায্য থেকে বঞ্চিত থাকে এবং নিজেদের দশগুণ বেশি শক্তি থাকা সত্ত্বেও মুসলিমদের কাছে পরাস্ত হয়।’ -তাওযিহুল কুরআন: ১/৫১০
Comment