|| জীবন পাথেয় ||
আল-কুরআনঃ মুসলিম জাতিসত্ত্বার প্রাণ
হাকীমুল ইসলাম ক্বারী মুহাম্মাদ তাইয়্যেব (রাহ.)
আল-কুরআনঃ মুসলিম জাতিসত্ত্বার প্রাণ
হাকীমুল ইসলাম ক্বারী মুহাম্মাদ তাইয়্যেব (রাহ.)
সম্মানিত বন্ধুগণ! আজকের এ দিনটি আমাদের সবার জন্য সীমাহীন আনন্দ ও খুশীর দিন। কারণ আজই আমাদের ক’জন শিশু-কিশোর কুরআনের হেফজ শেষ করে পাগড়ী ও সনদ লাভ করেছে। তাঁদের কচি হৃদয়ে আল্লাহর কালাম অংকিত হয়েছে। আর কুরআনে পাক যার হৃদয়ে স্থান পাবে সে মহা সৌভাগ্যবান বইকি। যেহেতু আল্লাহ পাকের বরকতময় সত্তা ও তাঁর মহান গুণাবলী নূরদীপ্ত ও জ্যোতির্ময়। বান্দা হল নিরেট এক অন্ধকার-পিণ্ড স্বরূপ। আর এ আধারা মানব জীবনে আল্লাহর নূর ও জ্যোতির প্রতিফলন মানবজাতির জন্য নিঃসন্দেহে এক মহা গৌরব। তেমনি কুরআনে কারীম এক মহা সৌভাগ্য ও বরকতের উৎস ধারা। গভীর মনে চিন্তা করলে বুঝে আসবে যে, এ কুরআন মানব জাতির আত্মিক জীবনী ও প্রাণ শক্তি বটে। জীবনের স্পন্দন সৃষ্টি করেছে এ কুরআন মানবধারায়। পৃথিবীর সকল জাতি গোষ্ঠীকে শিখিয়েছে সভ্যতা। অধঃপতিত আরব জাতিকে উন্নীত করেছে মানবতার স্বর্ণ শিখরে। এ বিষয়টির দিকে কুরআনে কারীমেরও ইঙ্গিত রয়েছেঃ
“হে নবী! আমি আপনার প্রতি আমার রুহ তথা নির্দেশ অবতীর্ণ করেছি।’’ এরপর ইরশাদ হয়েছেঃ
‘‘ইতিপূর্বে আপনি কিতাব ও ঈমান কী বিষয় তা জানতেন না।’’
এখানে কুরআন সম্পর্কে দুটি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথম, এ কুরআন আল্লাহ প্রদত্ত রুহ ও প্রাণ। দ্বিতীয়ত এ কুরআন জ্ঞান ও পূর্ণতার আধার। যার মর্ম এই দাঁড়ায় যে, ইলম ও জ্ঞানই মানব জীবনের পূর্ণতার মূল নিয়ামক। আমরা নিজস্ব পরিভাষায় বলে থাকি, রুহ এক অদৃশ্য শক্তি। শরীর তার পরশেই সচল হয়। শরীরের নিজস্ব চলন শক্তি নেই। রুহই হলো আসল চালিকা শক্তি। রুহের শক্তিতে শরীর সচল হয় আবার রুহ চলে গেলে শরীর পরিণত হয় মৃত লাশে। অনুরূপ কুরআনে কারীম আল্লাহ প্রদত্ত রুহ। বস্তুত এই রুহ মানব জীবনের সভ্যতা ও সজীবতার মূল নিয়ামক ও পরিচালক। আল্লাহ প্রদত্ত এই প্রাণ শক্তি আরব জাতির মাঝে প্রবিষ্ট হলে তারা সুসভ্যমণ্ডিত হয়। যে জাতির মাঝে মানবতাবোধ বলতে কিছুই অবশিষ্ট ছিল না, বিশ্বের দরবারে যাদের ছিলো না এতটুকু সম্মান, রাখালিয়া আর বর্বরতা ছিল যাদের একমাত্র পরিচয়। আর এই অসভ্য জাতিটিই কুরআন নামক অমীয় শক্তির পরশ পেয়ে জ্ঞান-গরিমায় শ্রেষ্ঠত্বের আসনে সমাসীন হয়। রবের পরিচয় লাভে তারা এগিয়ে গেলেন সবার আগে। মরুচারী বলে খ্যাত বর্বর জাতি পরিচিত হলেন আল্লাহর নবীর প্রিয়তম জীবন সাথী হিসেবে। পূর্বে তাঁদের নামোল্লেখ করা হতো অবজ্ঞাভরে। আর এখন তাঁরাই আল্লাহর সন্তুষ্টিপ্রাপ্ত বান্দা হিসেবে চির স্মরণীয়। কুরআনের আলোকছটায় তাঁদের মাধ্যমে পূর্বের আঁধার যুগের যবনিকাপাত হয়ে সূচনা হলো এক সর্বোত্তম যুগের। কুরআনের পরশে সাড়া পড়ে যায় স্থান, কাল ও পাত্র -সর্বস্থানে। এর পরশে সেই বর্বর মানুষগুলোর মাঝেও প্রচণ্ড শক্তি সঞ্চার হয়। আর সে শক্তিতে বলীয়ান হয়ে তাঁরা বিশ্বময় ছড়িয়ে দেন সভ্যতার আলোকমালা। পৃথিবীর মৃত্যু-বৎ মানবপুরীতে তাঁরা সৃষ্টি করেন প্রাণের হিল্লোল। পূর্বে এ আরব জাতি বর্বরতার তিমিরে পড়েছিলেন অচেতনভাবে। সে তিমিরাচ্ছন্ন অধঃপতিত জাতিটিই আজ জীবন সভ্যতার বিচারে সবার চেয়ে এগিয়ে। তাঁরা কুরআনের শক্তিমত্তায় বলীয়ান হয়ে উত্থানের পথে অগ্রসর হলে পর রোম পারস্যের গর্ব-অহমিকা লুটিয়ে পড়ল তাঁদের পদতলে। তবে সাহাবা (রাযি.) গণের মনে বীরত্ব প্রদর্শনের কোন অভিলাষ ছিল না। বরং তাঁদের জিহাদ ও কুরবানীর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল, বিশ্ব সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রোথিত সব অনাচারের মূলোৎপাটন। তাই তাঁদের এ জিহাদ ও কুরবানী হয়েছে স্বার্থক।
কাইসার ও কিসরা নিপীড়িত মানুষের উপর খোদায়ীত্বের দাবী করেছিল। প্রজাসাধারণ তাঁদের দরবারে এসে নত মস্তকে প্রণাম করতে বাধ্য ছিলো। কেউ খোদায়ীত্বের দাবী করল শুধু মুখে মুখে। আর অনেকে তার বাস্তবায়নপূর্বক প্রজাসাধারণের মাথায় উপাস্য সেজে বসল। প্রজাসাধারণকে বাধ্য করল এবং অহংকারের সাথে বললো, তোমাদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের সমাধান করে নাও আমাদের উপাসনা করে। ফলে একমাত্র আল্লাহ পাকের জন্য শোভনীয় ও নির্দিষ্ট শব্দগুলো রোম-পারস্যের দরবারে ব্যবহারের কুপ্রথা চালু হয়। প্রজাসাধারণ তাদের দৃষ্টিতে ছিল ক্রীতদাসতুল্য। তাদের অমানুষিক খাটুনীর বিনিময়ে অর্জিত সম্পদ কুক্ষিগত করে গুটি কতক সামন্ত প্রভু নির্মাণ করে বিলাস মহল। সাম্য, ইনসাফের ছিটেফোঁটাও ছিল না সে সমাজে। এ শোচনীয় লগ্নে সাহাবায়ে কেরাম (রাযি.) কেবল রাজ্য জয়ের লক্ষ্যে যুদ্ধ করেননি। ক্ষমতার লোভ-লালসাও তাঁদের ছিল না। একমাত্র আল্লাহর দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করতে, মানব সমাজে সাম্য ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার পথ কন্টকমুক্ত করতেই শুধু তাঁরা হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন। তখন রোম-পারস্য এ দুই অপশক্তি আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার পথে সবচেয়ে বড় বাঁধা হয়ে দাড়ায়। সাহাবাগণ (রাযি.) দেখলেন, এ অপশক্তিদ্বয়ের বিলুপ্তি সাধন পর্যন্ত ইসলামের পূণ্যময় আদর্শ বিশ্বজাহানে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। তা না হলে মানব সমাজে প্রভু ও দাসের বিভক্তিও ঘুঁচবে না। তাই তাঁরা বিশ্বময় শান্তি প্রতিষ্ঠায় হাতে তুলে নেন সাম্য ও ইনসাফের পয়গাম। আর সে সাম্য ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার পথে সর্বকঠিন বাঁধা সৃষ্টি করে রোম-পারস্য সাম্রাজ্যদ্বয়। ফলে সাহাবাগণ (রাযি.) তাদের তখ-তাউসে হানলেন প্রচণ্ড আঘাত। ভেঙ্গে দিলেন বহু প্রতাপশালী সাম্রাজ্যের ভীত। সব বাঁধা দূর হওয়ার পরই উডডীন হলো সাম্যের পতাকা। ইসলামের মুক্তিবাণী ছড়িয়ে পড়ল বিশ্বের প্রান্তে প্রান্তে। মানুষের দাসত্বে নিপিষ্ট নিঃস্ব-মানব সমাজ সুযোগ পেল প্রকৃত প্রতিপালকের বন্দেগী করার। সমাজে প্রতিষ্ঠিত হল সাম্য। এল জীবনের স্পন্দন! কুরআনকে রুই বলে আখ্যায়িত করার এই হল উদ্দেশ্য। আর রুহ হলো প্রাণের নাম, জীবনের মূলশক্তি। আর আল-কুরআন আত্মিক প্রাণের নাম। আর যে জাতি এ কুরআন নামক প্রাণের পরশ পাবে তাঁরা তাঁরাই প্রকৃত জীবন্ত হয়ে উঠবে। আর যারা তা থেকে বঞ্চিত তারা হল মৃত্যুপুরীর পঁচা লাশ। এবার আমাদের ভাববার পালা।
মুসলিম উম্মাহর বর্তমান হালচালঃ
কুরআনের এ প্রাণ শক্তি মুসলিম উম্মাহর মাঝে বিদ্যমান থাকাবস্থায় তাঁরা শিরোন্নত জাতি হিসেবে ছিল স্বীকৃত। আর এই আত্মিক প্রাণ শক্তি হারানোর পর থেকে শুরু হল তাদের গ্লানিকর জীবন। মুসলিম উম্মাহ ঠিক একটা ফুটবল সদৃশ। ফুটবলের স্বভাব হল, সেটা মাটিতে নিক্ষিপ্ত হলে উর্ধমুখী লাফিয়ে উঠবে। পরিমাণ মত বায়ু ভরা থাকলে বলের লম্ফ বেশী উচ্চ হবে। তবে এটা রবারের গুণে নয়। বরং রবার দ্বারা তৈরী গোলকের মধ্যে ঠেসে দেয়া পাম্প বা হাওয়ার কারসাজি। বল ফুটো হয়ে গেলে রবারটা চুপসে যাবে। কারণ লম্ফ-ঝম্ফের মূল কারণ যে হাওয়া তা উড়ে গেছে। মুসলিম জাতির অবস্থাও তদ্রুপ। যাবত তাঁরা কুরআনী প্রাণশক্তিতে বলীয়ান এবং ঈমান সচেতন থাকাবস্থায় কুফরী চক্রের শত নিপীড়নেও নিস্তেজ হয়ে পড়েনি। বরং অত্যাচারের প্রচণ্ডতার মুখে তাঁরা হয়েছেন আরও সোচ্চার, আরও প্রতিবাদী। এ কুরআনী শক্তি হারানোর পর পড়ে রইল তার শুধু ফাঁকা খোলসখানা। সবাই ত এখন মূল ঈমানী শক্তি রহিত নির্জীব নিঃসাড়।
মুসলমানদের অভিযোগ, কুফরী চক্র আমাদের উপর নিপীড়ন করছে, জ্বালিয়ে দিচ্ছে ঘরবাড়ী। অত্যাচার চালাচ্ছে। মুসলমানরা আজ নিপীড়িত হচ্ছে বহু দেশে। এ অত্যাচার ও নিপীড়নের শিকার হওয়ার কারণ আমরাই। দায়িত্বে দায়বদ্ধ আমরা, অন্যরা নয়। যেমন ধরুন, কোথাও মৃত লাশ পড়ে থাকলে, সবার দায়িত্ব হলো সেটা সমাধিস্থ করা; অন্যথায় বাতাসে পঁচা গন্ধ ছড়াবে। পরিবেশ নষ্ট করবে। আর মৃত লাশের বিহিত করাটা কোন অন্যায় নয়।
মুসলিম জাতি আজ বিশ্ব নেতৃত্ব অর্জন করতে চাইলে কুরআনী শক্তিতে উজ্জিবীত হতে হবে। তবেই কেবল অন্য কারো সাহস হবে না আমাদের প্রতি চোখ রাঙ্গিয়ে তাকানোর। নিঃসাড় হলে সবাই তার সৎকার করতে এগিয়ে আসবে। আমাদের অবস্থা এরূপ নয় কি? তাই ভুল শুধরিয়ে সঠিক পথে আসতে হবে।
সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মত কারাঃ
মুসলিম উম্মাহকেই খায়রে উম্মত বা শ্রেষ্ঠ জাতির খেতাবে ভূষিত করা হয়েছে। বিশ্ব-মানবকে তাঁরা সন্ধান দিবে সঠিক পথের, সাড়া জাগাবে প্রতিটি জীবনে। আর বর্তমানের চিত্র তার সম্পূর্ণ বিপরীত। ইমাম সাহেবই অচেতন হয়ে পড়ে আছেন। মুক্তাদির নামাজ কোন রসাতলে যাবে তা সহজেই অনুমেয়। ইমাম প্রবরের ওযু নষ্ট হলে নামাযে মুক্তাদীর একান্ত খুশু-খুজু সবই বেকার। ইমাম প্রবরের নামাজ শুদ্ধ হলে মুক্তাদীরও শুদ্ধ হবে।
অনুরূপ আজ মুসলিম উম্মাহর মাঝে ইনসাফ, সততা, সহনশীলতার অভাব, ফলে পৃথিবী জুড়ে চলছে অনাচার, মুসলমানদের ওপর ভিন জাতির অত্যাচার। এই অন্যায়ের দায়দায়িত্ব বর্তায় মুসলিম উম্মাহর উপর। আমাদের অনাচারের জন্য ভিন জাতি দায়ী নয়। নিজের সব কিছু সংশোধন ও পরিমার্জনের দায়িত্ব স্বয়ং ইমাম সাহেবেরই। মুক্তাদীর বিরুদ্ধে তার কোন অভিযোগ করা অযৌক্তিক। আর করলেও তা হবে হাস্যস্পদ। তখন পাল্টা মুক্তাদীরাই বলবে, আরে আপনার কারণেই তো আমাদের নামাজ নষ্ট হল।
তাই শ্রেষ্ঠত্বের যোগ্যতা অর্জন করুন। কারণ আপনারাই তো শ্রেষ্ঠ উম্মত খেতাবপ্রাপ্ত জাতি। আর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জিত হবে জীবনে কুরআনের বাস্তবায়ন ও কুরআনের শক্তি স্বীয় সত্তায় প্রবিষ্ট করানোর মাধ্যমে।
সফল আত্মশুদ্ধির হাতিয়ার আল-কুরআনঃ
হযরত ইমাম মালিক (রাহঃ) বলেনঃ “উম্মতের প্রথমাংশ ও শেষাংশের সংশোধন শুধু একই আদর্শ দ্বারা সম্ভব।’’ আর এ উম্মতের প্রথমাংশের সংশোধন হয়েছে আল-কুরআন দ্বারা। সাহাবী (রাযি.)-গণের লাইব্রেরীতে এবং সংগ্রহে আল কুরআন ছাড়া অন্য কোন গ্রন্থ ছিল না। এ মহা গ্রন্থের ভিত্তিতেই সূচীত হয়েছিল তাদের উন্নতি ও উত্থান। অতএব, উম্মতের প্রথম যাত্রীদল যে আদর্শের আলোকে সংশোধিত হয়েছেন উম্মতের শেষ দলকেও সে আদর্শের আলোকেই সংশোধিত হতে হবে। সে আদর্শ আল-কুরআন, যে ‘কুরআন’ জীবন পরিচালনার মূল নিয়ামক।
আল-কুরআনের এ প্রাণশক্তিতে উম্মত যতদিন উজ্জীবিত ছিল, ততদিন তাঁরা ছিল জীবন্ত-প্রাণবন্ত। যে জীবন এত উর্বর ও সজীব ছিলো যে, বদর রণাঙ্গনে মাত্র তিনশ' তেরজন মুজাহিদ আরবের ভাগ্য চাকার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন। আজ সে শক্তি নেই। তাই সংখ্যায় একশত কোটি হওয়া সত্ত্বেও কুফরী চক্র আমাদের উপর মোড়ালি করছে। পৃথিবীর চিত্র পাল্টে দেয়ার সে শক্তি নেই আজ আমাদের মাঝে।
সার কথাঃ জীবন-জাগরণে স্পন্দন সৃষ্টি করা আল-কুরআনের বৈশিষ্ট্য। আল-কুরআনের বাস্তবায়ন ছাড়া অবচেতন ভাব কাটবেনা। হাজারও কৌশল চালু করুন, তাতে কাজ হবে না। এ কুরআনই আপনাদের শক্তি ও সভ্যতার উৎস। আল কুরআন দীপ্ত কণ্ঠে ঘোষনা দিচ্ছেঃ
“তোমাদের মধ্যে যদি বিশজন দৃঢ়পদ ব্যক্তি থাকে, তবে জয়ী হবে দু'শোর মুকাবিলায়।” (আনফালঃ ৬৫ তম আয়াত)
এ প্রচণ্ড শক্তিমত্তা এলো কোত্থেকে? বিশজন দুইশতের বিরুদ্ধে লড়াই করে বিজয়ী হবে! এটা কোন কথার কথা বা প্রশংসাগাঁথা নয়। বরং সাহাবায়ে কেরাম কর্তৃক সংঘটিত বাস্তব ঘটনা। বস্তুত ইসলামে সংখ্যাধিক্যের গুরুত্ত্ব নেই। বরং আত্মিক প্রাণশক্তিই সেখানে বিবেচ্য। একজন শক্তিমান হাজারও দুর্বলকে টেক্কা দিতে পারে। তা কি অবাস্তব?
খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাযি.)-এর বীরত্বঃ
মাহান বিন ওয়ালীর সাথে মুসলমানদের লড়াই হয়। মুজাহিদ কমাণ্ডারদের মধ্যে খালিদ বিন ওয়ালিদও একজন। মুজাহিদদের সংখ্যা দশ হাজার আর দুশমন ষাট হাজার। শত্রু বাহিনীর এই সৈন্য সংখ্যার কথা মুসলিম বাহিনীর জানা ছিল না। তাই শক্রর অবস্থান ও সৈন্য সংখ্যার তথ্য সংগ্রহের জন্য ৩০০ মুজাহিদ বাছাই করা হল। এ গ্রুপের কমাণ্ডার হলেন হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ। তিনি সেনাপতি ওবায়দুল্লাহ ইবনুল জাররাহ (রাযি.)-কে বলেন, তিনশ ব্যক্তির দরকার নেই। আমার সাথে মাত্র ত্রিশজন মুজাহিদ দিন। তা-ই যথেষ্ট। সেনাপতি বলেন, ‘‘আপনার ঈমানী শক্তিকে মোবারকবাদ! তবে পৃথিবী যেহেতু একটি উপকরণ নির্ভরতান্ত্রিক জগৎ, তাই অন্তত ষাট জন মুজাহিদ নিয়ে যান।’’ বহু অনুরোধের পর হযরত খালিদ এতে রাজী হলেন। তিনি ষাট জন মুজাহিদকে নিয়ে অনুসন্ধানে বের হলেন। বাকী সকল মুজাহিদ ছাউনীতে অবস্থান করেন।
মাইল কয়েক যাওয়ার পর খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাযি.) জানতে পারেন, সম্মুখেই শত্রু ছাউনি। তাদের সংখ্যা ষাট হাজার। শক্তি ও সংখ্যা বলে তারা মুসলিম বাহিনীর পাঁচগুণ বেশী।
তখন হযরত খালিদ (রাযি.) তাঁর মুজাহিদ দলকে লক্ষ্য করে এক জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিলেন। বললেন, আমার মুজাহিদ ভাইয়েরা! শত্রু বাহিনী আমাদের সম্মুখে অবস্থান করছে। এখন আর মুজাহিদের জন্য পিছনে সংবাদ দেয়ার প্রয়োজন আছে? আমার মতে, পিছনে কোন সংবাদ না দিয়ে এই ষাটজন নিয়ে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ি। ওদের মুকাবিলায় এ ক‘জনই যথেষ্ট। সাহাবায়ে কেরাম (রাযি.) বললেন, তাই হোক।
আমরা তো এসেছি শাহাদাতের তামান্না নিয়ে। তাই শত্রুর সংখ্যাধিক্যে ভিত হব কেন। পিছনে সংবাদ দেয়ার প্রয়োজন কি!
খালিদ (রাযি.) মাত্র ষাট জন মুজাহিদকে সারি বেঁধে দাড় করালেন। অপরদিকে সুসজ্জিত ষাট হাজার শত্রু সেনা। ইরানী সেনাপতি মাহান অগ্রসর হয়ে বললো, ওহে খালিদ! আমাদের ধারণা ছিল, মুসলমানরা বেশ বুদ্ধিমান। এখন তোমাদের দেখে ভারী বোকা মনে হচ্ছে। ষাট হাজার সৈন্যের বিরুদ্ধে মাত্র ষাট জন নিয়ে যুদ্ধ করতে এসেছ! তোমরা ফিরে যাও। দয়া-দাক্ষিণ্যে তোমাদের ভরে দিব। প্রত্যেককে দু'মন খেজুর, অর্থ-কড়ি যা চাও সব দিব। এতে সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে তোমরা দিন কাটাতে পারবে। এই ভুখা-নাঙ্গা মানুষগুলোকে নিয়ে এসেছ কেন? কেন অযথা অত্যাচার করছ নিজেদের উপর। নিজ দেশে ফিরে যাও। তাতেই তোমাদের মঙ্গল।
খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাযি.) মাহানকে লক্ষ্য করে বললেন, ওহে মাহান! তুমি কমাণ্ডার না বক্তা। লজ্জা হয়না তোমার, যুদ্ধের ময়দানে বক্তৃতা দিয়ে ভিরুতার উপর প্রলেপ দিচ্ছ! আসলে তোমরা যুদ্ধ করতেই জাননা। খালিদ (রাযি.) এর কটাক্ষবান শুনে মাহান চরম রেগে উঠে। ষাট হাজার সৈন্যকে নির্দেশ দেয়, এই ষাটজনকে বন্দী কর।
নির্দেশ পাওয়া মাত্র ষাট জন মুজাহিদের উপর ষাট হাজার সৈন্য ঝাপিয়ে পড়ল। তখনই ফাঁক গলিয়ে ষাটজন নির্ভীক মুজাহিদ ঢুকে পড়েন ওই বিশাল সৈন্য সারীর ভিতরে। ঐতিহাসিকগণ বর্ণনা করেন, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মুসলিম মুজাহিদদের আর দেখা গেল না। ময়দান জুড়ে শুধু তরবারীর ঝনঝন শব্দ হচ্ছিল। তিন ঘন্টার ভিতরে ভাগ্যের চাকা ঘুরে গেল। ষাট জন মুজাহিদ বিজয়ী মাল্য ছিনিয়ে আনলেন ষাট হাজার সৈন্য থেকে। উপরন্তু কাফেরদেরকে বহুদূর পর্যন্ত তাড়িয়ে দিয়ে তাঁরা ছাউনীতে ফিরে এলেন।
ওদিকে দশ হাজার মুজাহিদ জিহাদে ঝাপিয়ে পড়ার সুতীব্র বাসনা নিয়ে অপেক্ষা করছেন। আর মাত্র ষাট হাজারকে কুপোকাত করে ফিরে এলেন মাত্র ষাট জনে।
ঈমানী শক্তিই মূল নিয়ামকঃ
মাত্র দশজন এক হাজারের উপর বিজয়ী হওয়াও কল্পকাহিনী নয়। এটা এক ঐতিহাসিক বাস্তবতা। সাহাবায়ে কেরাম কখনও শত্রুর সংখ্যাধিক্যে আর অস্ত্র বলে হিম্মত হারাননি। বলতে চাই যে, কিসের এ শক্তি। কোত্থেকে এল তা। হ্যা, এ শক্তি নবুওয়তের নূর ও বরকত। এ শক্তি ঐশী ও কুরআনি শক্তি। যে শক্তি সাহাবাদের মনে প্রবিষ্ট হয়ে ব্যক্তিকে করেছে হাজারের বিরুদ্ধে দুর্ধর্ষ। আর এ প্রাণ শক্তি উড়ে গেলে মুসলমান পরিণত হয় একটি গোস্ত পিণ্ডে। তাই শুধু তীর তলোয়ার ও দৈহিক শক্তি বলে আপনাদের বিজয় লাভ হবে না। বস্তুতঃ ঈমানী শক্তি বলেই তীর, তলোয়ার চালাতে হবে, তবেই বিজয় আসবে। পক্ষান্তরে সশস্ত্র অথচ মনোবলহীন ব্যক্তির তরবারী বেকার। মনোবল থাকলে তবেই অস্ত্র দিয়ে কাজ হবে। অন্তরই মূল চালক আর হৃদয় মন শক্তিশালী হয় ঈমান ও তাওহীদের পরশে। ঈমানের পরশেই মন শক্তিশালী হয়ে উঠে। সার কথা, জীবন সঞ্চারণ ও মৃত প্রাণে যিন্দেগীর ছোঁয়া এনে দেয়াই আল-কুরআনের কাজ।
অনুবাদঃ আহমাদ আল-ফিরােজী।
‘মাসিক জাগো মুজাহিদ’ সেপ্টেম্বর ১৯৯৪ সংখ্যা থেকে সংগৃহীত।
অনুলিখনঃ শেখ সালাবা। (সম্পাদিত)
Comment