'তাওয়াক' এর গল্প
(শামের বরকতময় জিহাদের ময়দানে শাহাদাতবরণকারী এক মুজাহিদের ডায়েরি)
পর্ব: ৬
অনুবাদ: আশ-শাম মিডিয়া
শামের এক মুজাহিদের গল্প
(শামের বরকতময় জিহাদের ময়দানে শাহাদাতবরণকারী এক মুজাহিদের ডায়েরি)
পর্ব: ৬
অনুবাদ: আশ-শাম মিডিয়া
শামের এক মুজাহিদের গল্প
আজ একজন মুজাহিদ সিংহকে দেখতে গিয়েছিলাম৷ অনেক যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন তিনি৷ জিহাদের ছাপ তাঁর কপালের শোভা বাড়িয়েছে৷ চেহারা ইমানের আলোয় আলোকিত৷ কুরআনের আয়াতগুলো বাস্তব জীবনে প্রয়োগের বরকতে তাঁর অন্তরও উদ্ভাসিত৷
ভাই 'আবু ফারিস আনসারী' উজ্জল কপালের অধিকারী৷ আল্লাহর পথে কিছু কুরবানি করতে পারার আনন্দেই যেন তার ক্ষত এখনও রক্ত ঝরাচ্ছে৷ এ যেন সুন্দরী বৌ পাওয়ার আনন্দ!
তিনি এক হাত নিয়েই আমার সাথে দেখা করলেন৷ জানতে চেলাম কিভাবে আহত হয়েছেন৷ তিনি জানালেন, একটি বিস্ফোরক বুলেট তার হাতে লেগেছিল৷ ভেতরে ঢুকে সেটি বিস্ফোরিত হয়েছে৷
তার সাথে কথা বলার সময় প্রশান্তি ও তৃপ্তি অনুভব করছিলাম৷ মনে হচ্ছিল এমন একজন মহান ব্যক্তির সাথে বসে আছি, যার ব্যাপারে আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না৷ তার কাহিনী শুনতে অধৈর্য হয়ে পড়লাম৷ বললাম, 'আল্লাহর ওয়াস্তে আপনার আহত হওয়ার ঘটনা খুলে বলুন'৷
আবু ফারিস তার ঘটনা বললেন:
এক সপ্তাহ আগে আবহাওয়া অনেক ঠাণ্ডা ছিল৷ ঠাণ্ডায় সবকিছু জমে গিয়েছিল৷ আমরা শত্রুর অগ্রযাত্রা প্রতিহত করতে রিবাতে (আল্লাহর পথে প্রহরায়) নিয়োজিত ছিলাম৷ আমার রিবাতের নির্ধারিত সময় শেষ হলে বিশ্রাম নিতে ফিরে গেলাম৷ বিশ্রামের পয়েন্টে পৌঁছা মাত্রই জরূরী ভিত্তিতে বের হওয়ার নির্দেশ এল, কারণ শত্রু আরো এগিয়ে এসেছিল৷ গুলির বেল্টটা কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে আবার অস্ত্র তুলে নিলাম৷ ঠাণ্ডা ও শত্রুর গোলাবর্ষণের মধ্যে বেরিয়ে পড়লাম৷
শত্রুরা অগ্রসর হওয়ার প্রস্তুতি হিসাবে চতুর্দিক থেকে জংলি ও পাগলের মত গোলাবর্ষণ করছিল৷ সব ধরণের অস্ত্র থেকে ফায়ারিং হচ্ছিল৷ আমি গোলার আগুনের মধ্য দিয়েই হেঁটে গেলাম৷ এদিকে আমার হাত-পা ঠাণ্ডায় শুকিয়ে যাচ্ছিল৷
কঠিন পরিস্থিতিতে পড়ে গেলাম৷ পায়ে ভর করে দাঁড়িয়ে থাকাই আমার জন্য কষ্টকর হয়ে গেল৷ একদিকে ঠাণ্ডায় হাত-পা জমে যাচ্ছিল, অন্যদিকে গোলাবর্ষণ বুক কাঁপিয়ে দিচ্ছিল৷ দোটানায় পড়ে গেলাম৷ অগ্রসর হব না ফিরে যাব বুঝতে পারছিলাম না৷
এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে জান্নাত ও জান্নাতের নেয়ামতের কথা স্মরণ করলাম৷ সেগুলো মনে করলাম, যা আল্লাহ তাআলা প্রস্তুত করে রেখেছেন ধৈর্যধারণরকারীদের জন্য, আর তাদের জন্য যারা জিহাদের কাতারে অগ্রসর হতে থাকে এবং ডানে বামে ফেরে না৷ তারপর কালিমায়ে শাহাদাত পড়ে ঝুঁকি ও বিপদে পূর্ণ পথ অতিক্রম করলাম৷
যদি আমি অবিচল থাকি এবং অগ্রসর হই তাহলে আমার রাব্ব আমার ওপর সন্তুষ্ট হবেন- একথা ভেবে অগ্রসর হলাম৷ আমি চলতে লাগলাম৷ চতুর্দিক থেকে বৃষ্টির মত গোলাবর্ষণ হচ্ছিল৷ চলতে চলতে পূর্বের রিবাতের স্থানে এসে পৌঁছলাম৷... সেখানে দেয়ালের গায়ে একটা ফোকর ছিল, যার ভেতর দিয়ে ওপারে গিয়ে আমরা রিবাতের দায়িত্ব পালন করতাম৷ সেই ফোকরের কাছে গিয়ে ঢুকে পড়লাম৷ তাগুতের একদল সৈন্যের সামনে পড়ে গেলাম!..
আমি জানতাম না, শত্রুরা আমাদের রিবাতের স্থানে চলে এসেছে৷ সেখানে তাগুতের বাহিনী ও 'হিযবুল লাত' এর অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত মোট দশজন সদস্য ছিল ৷ তারা আমাকে দেখে ভয় পেয়ে গেল৷ আমার আকস্মিক উপস্থিতিতে এমনভাবে ঘাবড়ে গেল, যেন মালাকুল মাউত (মৃত্যুর ফেরেশতা) তাদের রূহ কবজ করতে এসেছে৷ সবাই অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে পালিয়ে গেল৷ আমি একা ছিলাম, কিন্তু আমার সাথে আমার রাব্ব এর সঙ্গ ছিল!...
এই পরীক্ষার মধ্যে শয়তান আরেকবার আমার কাছে এল৷ আমি পালিয়ে যেতে উদ্যত হলাম৷ তখন যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে যাওয়ার গোনাহের কথা স্মরণ করলাম৷ আর আমার রাব্ব এর সাথে কৃত বিক্রয়-চুক্তির কথাও মনে করলাম৷ তারপর ওদের দিকে অস্ত্র তাক করে ফায়ার শুরু করলাম!
আমার একটি গুলি ওদের একজনের পিঠে লাগল৷ মাটিতে পড়ে গেল সে৷ বাকিরা পালিয়ে গেল৷ ঝাকে ঝাকে বুলেট আমার দিকে ছুটে আসতে লাগল৷ একটি বিস্ফোরক বুলেট আমার হাতে আঘাত করল৷ আমি মাটিতে পড়ে গেলাম৷ রক্তক্ষরণ শুরু হল৷
আমি মাটিতে পড়ে ছিলাম আর রক্ত বয়ে যাচ্ছিল, এর মধ্যে আমার পাশে একটা বোমা পড়তে দেখলাম৷ মনে মনে বলললাম, 'এটা জান্নাতে যাবার বোমা!'
বোমাটি না ফেটে গড়িয়ে গেল৷ একটু দূরে গিয়ে বিস্ফোরিত হল৷ আমার কিছুই হল না!
আমি নিজের দেহটা বয়ে নিয়ে মেডিকেল পয়েন্টে পৌঁছলাম৷ আলহামদু লিল্লাহ, ভাইয়েরা আমাকে চিকিৎসা দিলেন৷ তারপর তারা অগ্রসর হয়ে শত্রুর অনেক ক্ষতিসাধন করেছিলেন৷ শত্রুপক্ষের নিহতদের সংখ্যা ছিল বিশের কাছাকাছি৷ এমনকি মুজাহিদদের শত্রুবাহিনীর লাশ মাড়িয়ে চলতে হচ্ছিল!
আমার এক সাথিভাই বলতেন, 'আমি আমার রাব্বের সাক্ষাত পেতে চাই'৷...
যখন যুদ্ধ শুরু হল, তিনি প্রথম সারিতেই ছিলেন৷ অত্যন্ত সাহসের সাথে লড়াই করছিলেন৷ শত্রুবাহিনীর অনেক ক্ষতিসাধন করলেন৷ হঠাৎ একটি বুলেট তাঁর পেটে লাগল৷ তিনি রক্তাক্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন৷
হঠাৎ যেন তাঁর মনে পড়ল, তাঁর ভাইয়েরা শত্রুর মোকাবেলা করছেন৷ আর বোনেরা ধর্ষিতা হচ্ছেন৷ তিনি উঠে দাঁড়িয়ে আবার ফায়ারিং শুরু করলেন৷ এদিকে তার পেট থেকে গলগল করে রক্ত ঝরছিল, কিন্তু তিনি ছিলেন অবিচল৷
নির্বোধরা তার দিকে আর পি জি রকেট ছুড়ল৷ তার হাত উড়ে গেল৷ পেট ফেটে গেল৷ পবিত্র রক্ত মাটির ওপর বয়ে যেতে লাগল৷ তার রুহ ওপরে উঠে গেল এই উম্মাহ-র যৌবনের গৌরব ফিরিয়ে আনতে৷
অশ্রু ঝরার মত ঘটনা হল, ভাইয়েরা তার হাতটি অন্য স্থানে পেয়েছিলেন৷ হাতটি দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল, অথচ তার তর্জনি একত্ববাদের সাক্ষ্যের চিহ্ন উঁচু করে রেখেছিল৷ ওহে ইতিহাস, এগুলো লিখে রাখ!
কাহিনী শেষে একটা অসিয়ত করতে চাই যাদের কাছে আমার কথাগুলো পৌঁছবে তাদেরকে৷ তারা যেন শামের অবস্থা ও দুর্দশা দেখে চিন্তিত না হয়৷ মানুষ কেন চিন্তিত হবে? আমরা তো দুইটি 'হুসনা'-র (সুন্দর পরিণামের) একটি পাব৷ হয় বিজয়, নয়তো শাহাদাত৷
আমার আরেকটি অসিয়ত, তারা যেন আমাদের জন্য অনেক দোয়া করে৷ আমরা এমন দুর্যোগের মধ্যে আছি, যা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না৷ শত্রু রাত-দিন আমাদের ওপর বোমাবর্ষণ করছে৷ সত্যনিষ্ঠ দোয়া ও আমল ছাড়া অন্য কিছুই আমাদের মুক্তি দিতে পারবে না৷ তাই শুধুই দোয়া চাই!
বন্ধু আবু ফারিসের সাথে আলিঙ্গন করে বের হলাম৷ আমি কোন কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না৷ প্রতিজ্ঞা করলাম, তার কাহিনী লিখে রাখব, যেন এই বীরদের কাহিনী ইতিহাসের পাতায় সংরক্ষিত থাকে৷
#অনুভব
তুমি দেখতে পাচ্ছ, তোমার উম্মাহকে নিধন করা হচ্ছে, উম্মাহ অধঃপতনের ইতিহাস রচনা করছে, অথচ তোমার কোন পরিবর্তন নেই! আল্লাহর কসম, বড় অপমানের কথা!
তুমি বৈধ ভোগবিলাসে ডুবে আছ, কখনো হারাম বিলাসিতায়ও ডুবে যাচ্ছ৷! তোমার অন্তর যেন পাথরের তৈরি!
তাওয়াক...!
Comment