বর্তমান মুসলিমপ্রধাণ রাস্ট্রগুলো দারুল হারব কেন?
ফকিহুন নফস রশিদ আহমাদ গাঙ্গুহি রহঃ
মুফতি আব্দুল ওয়াহহাব রহঃ
ডাউনলোড
অনুবাদকের কথাঃ
দারুল ইসলাম ও দারুল হরবের মাসআলা ইসলামী শরীয়তের একটি বুনিয়াদী মাসআলা যার উপর আরোও অসংখ্য মাসআলার ভিত্তি। ফিকহ তথা ইসলামী আইন শাস্ত্রের প্রায় সকল কিতাবে এর আলোচনা রয়েছে এবং এর উপর ভিত্তি করে অসংখ্য অগণিত মাসআলা বর্ণিত হয়েছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উসমানী খেলাফতের পতনের পর যখন কাফেররা বিশাল খেলাফতকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে একেক অংশে মুসলিম নামধারী একেক মুরতাদকে শাসন ক্ষমতায় বসায় তখন নতুন করে এ মাসআলার আলোচনার প্র্রয়োজন পড়ে।
কেননা আইম্মায়ে কেরাম একমত যে, ইসলামী শাসনাধীন কোন রাষ্ট্র কাফের বা মুরতাদরা দখল করে নিয়ে তাতে কুফরী তথা শরীয়ত বিরোধী বিধান চালু করে দিলে এবং মুসলমানরা তাদের থেকে তা উদ্ধার করে ইসলামী শাসন জারি করতে অক্ষম হয়ে পড়লে উক্ত রাষ্ট্র আর দারুল ইসলাম তথা ইসলামী রাষ্ট্র থাকে না, বরং দারুল কুফর তথা কুফরী রাষ্ট্র হয়ে যায়। এ ব্যাপারে আইম্মায়ে কেরামের মাঝে কোন দ্বিমত নেই।
এ হিসেবে বর্তমানে শরীয়ত বিরোধী কুফরী আইন দ্বারা শাসিত মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সবগুলো আইম্মায়ে কেরামের সকলের ঐক্যমতে দারুল হরব।
মাসআলাটির গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার প্রতি লক্ষ্য করে অনেকেই এ ব্যাপারে কম বেশ লেখালেখি করেছেন।
এ সংক্রান্ত যে সব লেখা আমার পড়া হয়েছে সেগুলোর মধ্যে আমার ক্ষুদ্র দৃষ্টিতে অত্যন্ত তাহকীকী, বিশ্লেষণধর্মী ও সংশয় নিরসক মনে হয়েছে ফকীহুন নফস, আবু হানিফায়ে যমান, কুতুবুল ইরশাদ হযরত রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী (রহ.) এর ঐ ফতোয়াটি যা তিনি ইংরেজদের দখলে থাকা তৎকালীন উপমহাদেশকে দারুল হরব ফতোয়া দিয়ে জারি করেছিলেন।
১৮০৬ সালে শাহ আব্দুল আজীজ (রহ.) উপমহাদেশকে দারুল হরব ফতোয়া দিয়েছিলেন। কালের বিবর্তনে সেই ইংরেজ শাসনামলেই কেউ কেউ উপমহাদেশ দারুল হরব হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করে। তখন গাঙ্গুহী (রহ.) পুনরায় উপমহাদেশকে দারুল হরব ঘোষণা করে দলীল-প্রমাণ ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সমৃদ্ধ দীর্ঘ এক ফতোয়া জারি করেন। এই পুস্তিকায় এই ফতোয়ারই অনুবাদ করা হয়েছে।
গাঙ্গুহী (রহ.) যদিও শুধু উপমহাদেশকে দারুল হরব ঘোষণা করে এই ফতোয়া দিয়েছিলেন, কিন্তু কালের বিবর্তনে আজ সমগ্র মুসলিম বিশ্বের উপর এই ফতোয়া প্রযোজ্য হয়ে পড়েছে। মুরতাদদের দখলে থাকা সবগুলো মুসলিম রাষ্ট্র আজ এই ফতোয়ার আলোকে দারুল হরব প্রমাণিত হয়েছে।
কেউ কেউ হয়তো বলবেন, এসব রাষ্ট্রকে দারুল হরব বানানোর কী প্রয়োজন আপনাদের ?
উত্তরে বলবো, নতুন করে দারুল হরব বানাচ্ছি না। পূর্ব থেকে দারুল হরব হয়েই ছিল। আমরা শুধু প্রকাশ করছি এবং তা দ্বীনী দায়িত্ব মনে করেই করছি।
যদি এটা আমাদের অপরাধ হয় তাহলে মুরতাদকে মুরতাদ বলাও অপরাধ হবে! জালেমের বিরোদ্ধে কথা বলাও অপরাধ হবে! দ্বীন ধ্বংস হতে দেখেও দ্বীনের দুশমনদের বিরুদ্ধে কথা বলা অপরাধ হবে! আর যদি এগুলো অপরাধ না হয় তাহলে দারুল হরবকে দারুল হরব বলা অপরাধ হবে কেন ?
তাছাড়া আমরা নিজেদের থেকে কিছু বলছি না। আমাদের আইম্মা ও আকাবিরগণ যা বলে গেছেন সেই আলোকেই বলছি। কাজেই সমালোচক ভাইদের প্রতি অনুরোধ আপনারা দলীল ছাড়া কোন সমালোচনা করবেন না। যা বলবেন দলীল দিয়ে বলবেন।
মূল ফতোয়াটি ফারসী ভাষায় লিখিত। বিশিষ্ট সাধারণ সকলের ফায়েদার প্রতি খেয়াল করে মুফতী শফী (রহ.) উর্দুতে এর তরজমা করে দিয়েছেন। আমি এ উর্দু তরজমা থেকেই তরজমা করেছি। উর্দু তরজমাটি “জাওয়াহিরুল ফিকহ” এর পঞ্চম খন্ডে ছাপানো আছে। “তা’লীফাতে রশীদিয়্যাহ্” তে উর্দু তরজমা সহ মূল ফতোয়াটি ছাপা আছে। “বাক্বায়া ফাতাওয়া রশীদিয়্যাহ্” তে সূদীর্ঘ যে সওয়ালের জওয়াবে তিনি ফতোয়াটি লিখেছিন সেই সওয়াল সহ ছাপা আছে। আপনারা চাইলে এ সব কিতাবে দেখে নিতে পারেন।
মুফতী শফী (রহ.) তরজমার শুরতে ফতোয়ার ডকুমেন্ট এবং দারুল হরব দারুল ইসলাম মাসআলার গুরুত্ব সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত একটি ভূমিকা লিখেছেন। আমি সেটিরও তরজমা করে মূল ফতোয়ার শুরতে জুড়ে দিয়েছি।
মূল ফতোয়ায় বিভিন্ন কিতাব থেকে ৯/১০টি আরবী ইবারত [বক্তব্য] আনা হয়েছ। গাঙ্গুহী (রহ.) সেগুলোর কোন তরজমা করেননি। মুফতী শফী (রহ.) সেগুলোর তরজমা করেছেন। আমি সে তরজমাই বহাল রেখেছি।
তবে ফতোয়ার শেষ দিকে “রদ্দুল মুহতার” থেকে যে দুইটি ইবারত আনা হয়েছে তাতে ছাপাজনিত ভূল লক্ষ্য করা গেছে। এ জন্য মূল কিতাব দেখে শুদ্ধ ইবারত এনে সে অনুযায়ী তরজমা করে দিয়েছি।
ফতোয়াটি বুঝার সুবিধার্থে ফাঁকে ফাঁকে আমার নিজের পক্ষ থেকে ব্যাখ্যামূলক দু’ চার শব্দ সংযোজন করেছি। সেগুলোকে আলাদাভাবে বুঝানোর জন্য থার্ড ব্র্যাকেট [] ব্যবহার করেছি। মুফতী শফী (রহ.) নিজের থেকে যা বাড়িয়েছেন তা ফার্স্ট ব্র্যাকেট () এ দেয়া হয়েছে।
হযরত গাঙ্গুহী (রহ.)মূল ফতোয়ার কোন নাম দেননি। সহজতার জন্য মুফতী শফী (রহ.) এর নাম রেখেছেন-
(فيصلة الأعلام في دار الحرب و دار الإسلام)
[দারুল হরব এবং দারুল ইসলামের ব্যাপারে মহামনীষীগণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত]
পরিশেষে আল্লাহ্ তাআলার কাছে প্রার্থনা তিনি যেন মূল ফতোয়া এবং তার উর্দু তরজমার সাথে আমার এ বাংলা তরজমাকেও কবুল করে নেন এবং আমাদেরকে বর্তমান বিশ্বের দারুল ইসলাম ও দারুল হরবগুলো সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভের তাওফীক দান করেন। আমীন!
– মুফতি আব্দুল ওয়াহহাব
মুফতী শফী (রহ.) এর ভূমিকাঃ
হিন্দুস্তানে যেহেতু মুসলিম-অমুসলিম উভয়েরই বসবাস, হুকুমত এবং ক্ষমতা রয়েছে ; আবার এ সবের পরিবর্তনের সাথে সাথে ইসলামের অনেক বিধান পরিবর্তন ও ভিন্ন হয়ে যায়-এ কারণে হিন্দুস্তান দারুল ইসলাম না দারুল হরব এই মাসআলা দীর্ঘ দিন ধরে আলোচিত হয়ে আসছে।
এই ধারাবাহিকতায় আজ হিন্দুস্তান দারুল হরব হওয়ার ব্যাপারে কুতুবে আলম, যামানার জুনাইদ [বাগদাদী], যুগের আবু হানিফা হযরত মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী (রহ.) এর ঐ ফতোয়াটি প্রচার করা হচ্ছে যা তিনি তাঁর কোন আহলে ইলম শাগরেদের প্রশ্নের জওয়াবে মুফাসসাল [বিস্তারিত] এবং মকাম্মাল [পরিপূর্ণ] করে লিখেছিলেন।
হযরত মামদূহ [অর্থাৎ প্রশংসার্হ গাঙ্গুহী (রহ.)] এর সাহেবযাদা হযরাতুল আল্লামা মাওলানা হাকীম মাসউদ আহমদ সাহেব রহমাতুল্লাহি আলাইহি ফতোয়াটির এক কপি আমাকে দিয়েছিলেন। তাছাড়া হযরতের অনেক আত্নীয় এবং শাগরেদের নিকট ফতোয়াটির কপি বিদ্যমান রয়েছে।
এই মাসআলার [অর্থাৎ দারুল ইসলাম–দারুল হরব মাসআলার] জরুরত এবং শরীয়তের দৃষ্টিতে এর গুরুত্বঃ
যারা ফিকহ [তথা ইসলামী আইন শাস্ত্র] ও ফতোয়ার সাথে সম্পর্ক রাখেন তাদের নিকট অস্পষ্ট নয় যে, নামায-রোযা, হজ্ব-যাকাত, বিবাহ-তালাক, (বিশেষত : ক্রয়-বিক্রয় ও ইজারা) এবং অন্যান্য মুআমালা সহ ফিকহের প্রায় সকল অধ্যায়ের অসংখ্য শরয়ী মাসআলা দারুল ইসলামে এক রকম, দারুল হরবে অন্য রকম।
এ কারণে যদি বলা হয়, “শরীয়তের আহকামের একটা বিশাল বড় অংশ এমন রয়েছে যেগুলোর উপর আমল করার জন্য প্রথমে বসবাসরত রাষ্ট্র কি দারুল ইসলাম না দারুল হরব তা নির্ণয় করে নেয়া পূর্বশর্ত” তাহলে তা সম্পূর্ণ সঠিক।
এ কারণেই দীর্ঘ দিন ধরে হিন্দুস্তানী ওলামাদের নিকট এই মাসআলা আলোচিত হয়ে আসছে।
কুতুবে আলম হযরত মাওলানা গাঙ্গুহী – কুদ্দিসা সিররুহু – এর নিকটও এই মাসআলা জিজ্ঞাসা করা হয়। হযরত সময়ের প্রয়োজনের প্রতি লক্ষ্য করে আপন অভ্যাসের বিপরীত অত্যন্ত ব্যাখ্যাবহুল এবং বিস্তারিত এক জওয়াব [অর্থাৎ ফতোয়া] লেখেন।
আলহামদু লিল্লাহ্ ফতোয়াটি আহক্বারের হাতে [অর্থাৎ মুফতী শফী (রহ.) এর হাতে] পৌঁছেছে। ‘আল-মুফতী’ পত্রিকা সেটি প্রকাশ করার সৌভাগ্য অর্জন করেছে।
(নোট):
মূল ফতোয়াটি ফার্সী ভাষায় [লিখিত]। বিশিষ্ট-সাধারণ সকলের ফায়েদার প্রতি খেয়াল করে আহক্বার [অর্থাৎ মুফতী শফী (রহ.)] মূল ফতোয়াটি হুবহু বহাল রেখে সাথে তার উর্দু তরজমা লিখে দিয়েছে। আল্লাহ্ তাআলা মূল ফতোয়ার মতো একেও [অর্থাৎ উর্দু তরজমাকেও] মকবূল ও মুফীদ [উপকারী] বানান। আমীন!
হযরত [গাঙ্গুহী (রহ.)] মূল ফতোয়ার কোন নাম দেননি। সহজতার জন্য আহক্বার এর নাম রেখেছে-
(فيصلة الأعلام في دار الحرب و دار الإسلام)
[দারুল হরব এবং দারুল ইসলামের ব্যাপারে মহামনীষীগণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত]
না কারায়ে খালায়েক্বঃ বান্দা মুহাম্মদ শফী
২৯রবিউস সানী, ১৩৫২হি. [মোতাবেক ১৯৩৩ইং.]
[মূল ফতোয়া]
(হিন্দুস্তান কি দারুল হরব ?)
(সওয়ালঃ)
হজরত ওলামায়ে কেরাম এবং মুফতিয়ানে ইসলামের খেদমতে আরজ এই যে, শরীয়তের অনেক আহকাম দারুল ইসলাম এবং দারুল হরবের ভিন্নতার উপর নির্ভরশীল যা হযরত ওলামায়ে কেরামের নিকট অস্পষ্ট নয়।
অতএব, বর্তমান যুগের ওলামায়ে কেরাম এই মাসআলাতে কী বলেন যে, হিন্দুস্তান যা আজ সকল দিক থেকে নাসারাদের দখলদারিত্ব এবং হুকুমতের অধীন, শরীয়তের দৃষ্টিতে তাকে দারুল হরব বলা হবে নাকি দারুল ইসলাম?
(জওয়াবঃ)
প্রথমে এ কথা জেনে নেয়া চাই যে, কোন রাষ্ট্র বা কোন শহর দারুল ইসলাম বা দারুল হরব হওয়ার ভিত্তি হচ্ছে, তার উপর বিজয় কি মুসলমানদের না কাফেরদের।
এ হিসেবে যে শহর মুসলমানদের হুকুমতের অধীনে তা দারুল ইসলাম।
‘জামিউর রুমুজ’ এ আছে-
“دار الإسلام ما يجري فيه حكم إمام المسلمين وكانوا فيه آمنين، ودار الحرب ما خافوا فيه من الكافرين.” انتهى
“দারুল ইসলাম ঐ রাষ্ট্র যাতে মুসলমানদের ইমামের হুকুম চলে এবং মুসলমানরা সেখানে নিরাপদ। আর দারুল হরব হচ্ছে ঐ রাষ্ট্র যেখানে মুসলমানরা কাফেরদের থেকে তাদের তাদের জান ও মালের উপর আশংকায় থাকে।”
‘দুররে মুখতার’[1] এ আছে
“سئل قارئ الهداية عن البحر الملح : أ من دار الحرب أو الإسلام ؟ أجاب : أنه ليس من أحد القبيلين، لأنه لا قهر لأحد عليه.” انتهى
“ক্বারিউল হিদায়াকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ‘সমুদ্র দারুল হরবেরঅন্তর্ভূক্ত না’কি দারুল ইসলামের অন্তর্ভূক্ত’?
তিনি জওয়াব দেন, ‘তা[অর্থাৎ সমূদ্র] উভয়ের কোনটারই অন্তর্ভুক্ত নয়। কেননা এর উপর কারোই পরিপূর্ণ দখলদারিত্ব নেই।’ ”
এই ইবারত [বক্তব্য] আনার দ্বারা আমার উদ্দেশ্য [এ কথা বুঝানো যে], কোন রাষ্ট্র দারুল ইসলাম বা দারুল হরব হওয়ার একমাত্র ভিত্তি ইসলাম বা কুফরের বিজয়ের উপর। যদিও সমূদ্রের ব্যাপারে গ্রহণযোগ্য মত হচ্ছে,তা দারুল হরবের অন্তর্ভূক্ত।
কিন্ত ঐ ভূমি যা কাফের ও মুসলমান উভয়ের সমান দখলদারিত্বে রয়েছে তাকে দারুল ইসলামই বলা হবে। কেননা প্রসিদ্ধ মূলনীতি-
“الإسلام يَعلو، ولا يُعلى”
“(ইসলাম বিজয়ী থাকে পরাজিত হয় না)” এর দাবী এটাই।
তবে উক্ত ভূমিকে [অর্থাৎ যা কাফের ও মুসলমান উভয়ের সমান দখলদারিত্বে রয়েছে] দারুল ইসলাম এ শর্ত সাপেক্ষে বলা হবে যে, তাতে কোন ইসলামী শাসকের কব্জা এবং দখলদারিত্ব রয়েছে।
নতুবা উক্ত রাষ্ট্রকে কেবল এ হিসেবেই দারুল ইসলাম বলে দেয়া হবে না যে, তাতে মুসলমানরা বসবাস করে কিংবা কাফেরদের অনুমতিক্রমে শাআয়েরে দ্বীন পালন করতে পারে।
কোন [কাফের রাষ্ট্র দারুল ইসলাম গণ্য হওয়ার ক্ষেত্রে উক্ত] রাষ্ট্রে শুধু মুসলমানদের বসবাস করতে পারা কিংবা কাফেরদের অনুমতিক্রমে শাআয়েরে দ্বীন পালন করতে পারার কোন গ্রহণযোগ্যতা নেই।
তদ্রূপ [ইসলামী শাসনাধীন] কোন রাষ্ট্রে কাফেরদের বসবাস করা কিংবা মুসলমানদের অনুমতিক্রমে বা তাদের গাফলতির সুযোগে সেখানে শাআয়েরে কুফর যাহের করার কারণে তা দারুল ইসলাম হওয়ার মাঝে কোন বাধা সৃষ্টি করবে না।
কেননা এ উভয় ক্ষেত্রেই বিজয় ঐ সব লোকের নয়। আর[দারুল ইসলাম বা দারুল হরব হওয়ার] ভিত্তি তো হচ্ছে বিজয়ের উপর। শুধু বসবাস বা [শাআয়েরে দ্বীন] যাহের করার উপর নয়।
এ কারণেই তো যিম্মী কাফেররা মুসলমানদের অনুমতিক্রমে দারুল ইসলামে বসবাস করে এবং তাদের শাআয়েরগুলো পালনও করে । কিন্তু দারুল ইসলাম তার আপন অবস্থায় দারুল ইসলামই থেকে যায়।
তদ্রূপ মুসলমানরা দারুল কুফরে যায় এবং তাদের শাআয়েরগুলো পালনও করে। কিন্তু শুধু এতটুকুর কারণে ঐ রাষ্ট্র দারুল হরব হওয়া থেকে বের হয়ে যায় না।
তোমরা কি দেখ না – মক্কা বিজয়ের পূর্বে যখন মক্কা মুকাররামা দারুল হরব ছিল তখন ফখরে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উমরাতুল ক্বাজার সময় এক বিশাল বাহিনী সহ মক্কা মুয়াজ্জমায় উপস্থিত হয়ে ছিলেন।
জামায়াত, নামাজ, উমরা ও অন্যান্য শাআয়ের ঘোষণা দিয়ে পালন করেছিলেন। তাঁর সাথে এমন বিশাল বাহিনী ছিল যে, কাফেরদেরকে পরাজিত-পরাভূত করতে পারতেন। কেননা উমরাতুল ক্বাজার পূর্বে হুদায়বিয়ার সময় ঐ পরিমাণ বাহিনী নিয়ে মক্কা মুয়াজ্জামার উপর চড়াও হওয়ার প্রতিাজ্ঞা করেছিলেন। কিন্তু খোঁজ-খবর নেয়ার পর যখন হযরত উসমান (রা.) এর হত্যার ঘটনা মিথ্যা প্রমাণিত হলো তখন উক্ত প্রতিজ্ঞা ত্যাগ করা হয়।
মোট কথা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে এমন বিশাল বাহিনী ছিল যে, তিনি কাফেরদেরকে পরাজিত-পরাভূত করতে পারতেন। কিন্তু মক্কায় প্রবেশ এবং শাআয়ের আদায় যেহেতু কাফেরদের অনুমতিক্রমে হয়েছিল এ কারণে মক্কা মুয়াজ্জমাকে উক্ত তিন দিনের জন্য দারুল ইসলাম গণ্য করা হয়নি বরং পূর্বের মতো দারুল হরব হিসেবেই বহাল ছিল। কেননা মক্কায় প্রবেশ এবং ইসলাম যাহের করা [কাফেরদের] অনুমতির ভিত্তিতে ছিল, বিজয়ের ভিত্তিতে ছিলনা।
সারকথা, এ ব্যাপারে মূলনীতি হলোঃ
দারুল হরব ঐ ভূখন্ড যা কাফেরদের আয়ত্বাধীন। আর দারুল ইসালাম ঐ ভূখন্ড যা মুসলমানদের আয়ত্বাধীন। যদিও এক দারে অন্য দারের লোক দখলদারিত্ব এবং প্রভাব-প্রতিপত্তি ব্যতীত বসবাস করে।
যেমন- দারুল ইসালামে কাফের এবং দারুল হারবে মুসলমানরা দখলদারিত্ব এবং প্রভাব-প্রতিপত্তি ব্যতীত বসবাস করে।
আর যে রাষ্ট্রে মুসলমান-কাফের উভয়েরই দখলদারিত্ব রয়েছে তাকেও দারুল ইসালাম বলেই গণ্য করা হবে।
এই উসূল ও মূলনীতিকে খুব ভালভাবে আত্নস্থ করে নেয়া চাই। কেননা এ সংক্রান্ত [অর্থাৎ দারুল ইসলাম ও দারুল হরব সংক্রান্ত] সকল মাসআলা এ উসূল থেকেই বের হয় এবং এ অধ্যায়ের ফুরুয়ী তথা শাখা গত সকল বিধান এ মূলনীতির উপরই প্রতিষ্ঠিত।
(মুসলমানদের দারুল হরব বিজয়)
এর পর আরেকটি মাসআলা শুনে রাখা চাই।তা হচ্ছে-
যে রাষ্ট্র মূলত দারুল হরব এবং দারুল কুফর ছিল এরপর মুসলমানরা তা বিজয় করে এবং ইসলামের হুকুম আহকাম তাতে জারি করে এর ব্যাপারে ওলামাগণ একমত যে, তা এখন দারুল ইসলাম হয়ে গেছে।
কেননা এর উপর মুসলমানদের বিজয় এবং প্রভাব প্রতিপত্তি কায়েম হয়েছে। যদি কোন দিক থেকে কাফেরদের প্রভাব কিছুটা বাকি থেকেও থাকে তবুও “الإسلام يَعلو، ولا يُعلى”(ইসলাম বিজয়ী থাকে ,পরাজিত হয়না) এই মূলনীতি হিসেবে তা সকলের ঐক্যমতে দারুল ইসলাম হয়ে গেছে, যেমনটা একটু পূর্বে স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে।
এর পর এ বিষয়টিও স্পষ্ট করে দেয়া চাই যে, যদি ঐ [কাফের] রাষ্ট্রে মুসলমানদের প্রবেশ এবং ইসলামী আহকাম জারি করা উক্ত রাষ্ট্র বিজয় করার দ্বারা না হয়, তাহলে ঐ রাষ্ট্র দারুল হরব হওয়ার ব্যাপারে কোনই তফাৎ সৃষ্টি হবে না। অন্যথায় জার্মানী, রাশিয়া, ফ্রান্স, চীন এবং অন্যান্য রাষ্ট্র যা নাসারা কিংবা ভূতপূঁজারীদের দখলে আছে সবগুলোই দারুল ইসলাম বলার উপযুক্ত হয়ে যেত।
সারা দুনিয়ার কোথাও দারুল হরবের কোন নাম নিশানাই থাকতোনা। কেননা সব কাফের রাষ্ট্রেই মুসলমানরা কাফেরদের অনুমতিক্রমে ইসলামী হুকুম আহকাম পালন করছে। আর এ তো সুস্পষ্ট যে, বর্তমান হালতে সমগ্র দুনিয়াকে দারুল ইসলাম বলে দেয়া সম্পূর্ণই বাতিল।
(দারুল ইসলামের উপর কাফেরদের কব্জাঃ)
যে রাষ্ট্র বা শহর দারুল ইসলাম ছিল অতঃপর কাফেররা তা দখল করে নেয়- যদি তার উপর থেকে মুসলমানদের দখলদারিত্ব সম্পূর্ণ শেষ হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে তা এখন দারুল হরবের হুকুমে চলে যাবে।
আর যদি এমন হয় যে, কাফেরদের দখলদারিত্ব তো কায়েম হয়েছে কিন্তু কোন কোন দিক থেকে ইসলামের দখলদারিত্বও বাকি রয়েছে তাহলে তাকে এখনোও দারুল ইসলামই বলা হবে। দারুল হরব বলা হবে না।
এতটুকু কথার মধ্যে সকল ইমাম একমত।
তবে এ ব্যাপারে মতভেদ আছে যে, ইসলামের দখল দারিত্ব সম্পূর্ণ শেষ হয়ে যাওয়ার সীমা কী?
সাহেবাইন অর্থাৎ ইমাম আবু ইউসূফ (রহ.) এবং ইমাম মুহাম্মদ (রহ.) বলেন, যখন কাফেররা প্রকাশ্যে কুফরী বিধান জারি করে দেয় এবং মুসলমানরা কাফেরদের অনুমতি ব্যতীত নিজস্ব শক্তি বলে ইসলামী আহকাম জারি করতে না পারে তখন ইসলামের দখলদারিত্ব সম্পূর্ণ শেষ হয়ে যায় এবং উক্ত রাষ্ট্র দারুল হরবের হুকুমে চলে যায়।
তবে হ্যাঁ, যদি মুসলমান কাফের উভয়ই তাদের আপন আপন শক্তি বলে নিজেদের আহকাম জারি করতে পারে তাহলে এখনো উক্ত রাষ্ট্র থেকে ইসলামের দখলদারিত্ব শেষ হয়ে যায়নি এবং উক্ত রাষ্ট্রকে দারুল হরবও বলা যাবে না।
আর যখন কাফেররা নিজস্ব শক্তি বলে প্রকাশ্যে তাদের বিধান জারি করে এবং মুসলমানরা কাফেরদের অনুমতি ব্যতীত প্রকাশ্যে তাদের আহকাম জারি করার সামর্থ্য না রাখে তাহলে তার উপর থেকে ইসলামের দখলদারিত্ব সম্পূর্ণ শেষ হয়ে গেছে।
কিয়াসের দাবি এটাই যা সাহেবাইন (রহ.) বলেছেন।
কেননা যখন কাফেররা এই পরিমাণ দখলদারিত্ব কায়েম করে ফেলল যে, কুফরী বিধান নিজস্ব শক্তি বলে জারি করতে পারছে, আর মুসলমানরা এই পরিমাণ অক্ষম ও পরাজিত হল যে, নিজেদের [ইসলামী] আহকাম জারি করতে পারছেনা এবং যে কুফরী বিধান মুসলমানদের জন্য লজ্জা ও অপমানের বিষয় তা দূর করতে পারছেনা, তখন আর ইসলামের কী বাকি আছে যার কারণে ঐ রাষ্ট্রকে দারুল ইসলাম বলা যায় ?
বরং ঐ সূরতে কাফেরদের দখলদারিত্ব সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে এবং বাস্তবিকই ঐ রাষ্ট্র দারুল হারবে পরিণত হয়েছে।
কিন্তু আবু হানিফা (রহ.) তাঁর সূক্ষ্ম দৃষ্টির ভিত্তিতে ইসতিহসান[2] স্বরূপ বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত ইসলামের বিজয়ের একটা নিদর্শনও পাওয়া যাবে, কিংবা কাফেরদের দখলদারিত্বে এমন কোন দুর্বলতা অনুভূত হবে যার কারণে কাফেরদেরকে হটিয়ে দেয়া মুসলমানদের জন্য কোন মুশকিল বিষয় হবেনা ততক্ষণ পর্যন্ত ঐ রাষ্ট্র দারুল হরব হয়ে গেছে বলে হুকুম না লাগানো চাই।
এ কারণেই আবু হানিফা (রহ.) [কাফেরদের দখলকৃত] উক্ত [ইসলামী] রাষ্ট্র দারুল হরব হওয়ার জন্য অতিরিক্ত দু’টি শর্ত আরোপ করেন।
প্রথম শর্তঃ
যে দারুল ইসলাম কাফেররা দখল করে নিয়েছে তা দারুল হরবেরসাথে মিলিত হতে হবে। দারুল হরব এবং তার মাঝখানে দারুল ইসলামের কোন রাষ্ট্র বা শহর বিদ্যমান না থাকতে হবে। কেননা এ ভাবে দারুল হরবেরসাথে মিলিত হওয়া এবং দারুল ইসলাম থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে স্পষ্টতই তা পূর্ণরূপে কাফেরদের কব্জায় চলে গেছে। তাদের হাত থেকে একে মুক্ত করা মুশকিল হয়ে পড়েছে।
এই মাসআলার দৃষ্টান্ত হচ্ছে –
কাফেররা মুসলমানদের মাল [ছিনিয়ে] নিয়ে গেলে তার দুই অবস্থাঃ
এক) তাদের দেশে নিয়ে গিয়ে পরিপূর্ণ কব্জা করে ফেলা।
এ সূরতে উক্ত মাল তাদের মালিকানাধীন [হয়ে গেছে বলে] ধরা হবে।
দুই) এখনো তাদের নিজেদের দেশে নিয়ে যেতে পারেনি এবং এর উপর তাদের পরিপূর্ণ কব্জা কায়েম করতে পারেনি।
এ অবস্থায় উক্ত মাল তার মালিকের মালিকানা থেকে বের হয়নি এবং কাফেরদের মালিকানায় প্রবেশ করেনি।
এই মাসআলা ফিকহের সমস্ত কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে।
‘হিদায়া’(২/৫৮১) তে আছে-
“و إذا غلبوا على أموالنا و أحرزوها بدارهم ملكوها…الخ”
“যদি কাফেররা আমাদের মাল দখল করে তাদের দেশে নিয়ে যায় তাহলে তারা এর মালিক হয়ে যাবে।”
‘হিদায়া’(২/৫৮১) তে আরো আছে-
“غير أن الاستيلاء لا يتحقق إلا بالإحراز بالدار، لأنه عبارة عن الاقتدار على المحل حالًا و مآلًا…الخ”
“যতক্ষণ পর্যন্ত কাফেররা [আমাদের থেকে দখলকৃত] মাল তাদের দেশে না নিয়ে যেতে পারবে ততক্ষণ পর্যন্ত তাতে তাদের কব্জা কায়েম হবে না।
কেননা [কোন বস্তুর উপর] কব্জা [লাভের অর্থ] হচ্ছে বর্তমানেও [উক্ত] বস্তুর উপর [ইচ্ছা মত হস্তক্ষেপের] সামর্থ্য থাকা এবং বাহ্যিক অবস্থাদৃষ্টে ভবিষ্যতেও তা বহাল থাকবে বলে মনে হওয়া।”
তদ্রুপ কাফেররা যদি [মুসলমানদের] কোন ভূমি বা শহর তাদের দেশে নিয়ে গিয়ে তার উপর পরিপূর্ণ কব্জা কায়েম করে ফেলে তাহলে উক্ত ভূখন্ড পরিপূর্ণরূপে কাফেরদের দখলে চলে গেছে [বলে ধরা হবে]।
আর ভূমি তাদের দেশে নিয়ে যাওয়ার সূরত তো এটাই হতে পারে যে, তা দারুল হরবের সাথে মিলিত হবে এবং দারুল ইসলাম থেকে বিচ্ছিন্ন হবে।
আর যতক্ষণ পর্যন্ত এমনটা না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত তাতে মুসলমানদের কব্জা কায়েম রয়েছে বলে ধরা হবে।
এই কব্জা যদি দুর্বলও হয় তবুও “الإسلام يَعلو، ولا يُعلى” “(ইসলাম বিজয়ী থাকে , পরাজিত হয় না।)” এর দাবি এটাই যে , উক্ত ভূখন্ড দারুল ইসলাম হিসেবে বহাল থাকবে।
অতএব, এ শর্তের সারকথা এটাই দাঁড়ালো – কাফেরদের কব্জা এবং মুসলমানদের পরাজয়। যেমনটা শুরুতে মূলনীতি হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
দ্বিতীয় শর্তঃ
ইমামে আজমের নিকট দ্বিতীয় শর্তটি হচ্ছে, মুসলমান শাসক মুসলমানদেরকে ইসলামের কারণে এবং কাফের প্রজাদেরকে যিম্মি হওয়ার কারণে যে আমান [নিরাপত্তা] দিয়েছিলেন তা বাতিল হয়ে যাওয়া। কোন ব্যক্তি পূর্বোক্ত আমানের কারণে নিজের জান-মালের উপর নিরাপদ না থাকা।
অর্থাৎ ‘মুসলমান শাসকের দেয়া আমানের কারণে সকলেই যেমন আশংকা মুক্ত ছিল, তাদের জান-মালের উপর কারো জুলুম করার সুযোগ ছিল না’- তেমন আর না থাকা।
আর এ তো সুস্পষ্ট যে, মুসলিম শাসকের শক্তি, দাপট ও প্রভাব-প্রতিপত্তি ব্যতীত এই পর্যায়ের আমান অর্জিত হওয়া সম্ভব নয়।
মোটকথা – উক্ত আমান আর বাকি না থাকা, বরং তা বেকার হয়ে যাওয়া। দখলদার কাফেরদের কতৃক তাদের কানূন অনুযায়ী প্রদত্ত আমানই নিরাপত্তার একমাত্র সম্বল হওয়া।
আর এ তো সুস্পষ্ট যে, মুসলিম শাসকের প্রদত্ত আমান দ্বারা যতদিন জালেমের জুলুমের ভয় বিদূরীত থাকবে, ততদিন পর্যন্ত মুসলিম শাসকের শক্তি ও দাপট বহাল রয়েছে বলে ধরা হবে। যখন এসব কিছু আর থাকছে না, বরং কাফেরদের প্রদত্ত আমানের উপরই কেবল নির্ভর করতে হচ্ছে তখন পূর্বের আমান বাতিল হয়ে গেছে।
সারকথাঃ
ইমামে আজমের নিকট প্রকাশ্যে কুফরী বিধান জারি করার সাথে সাথে যখন এ দুই শর্তও পাওয়া যাবে তখন সর্বদিক থেকে কাফেরদের দখলদারিত্ব কায়েম হয়েছে বলে ধরা হবে এবং মুসলমানদের শক্তি ও দাপট সম্পূর্ণ শেষ হয়ে গেছে বলে গণ্য হবে।
তখন অসহায় উক্ত ভূখন্ড দারুল হরব হয়ে গেছে বলে হুকুম দেয়া হবে।
বিবেকবানরা এ থেকেও বুঝতে পারছেন যে, এই [দ্বিতীয়] শর্তের ভিত্তিও শক্তি ও দখলদারিত্বের উপরই। শুরুতে মূলনীতির মধ্যে যা ব্যাখ্যা করে দেয়া হয়েছে।
এবার [দারুল ইসলাম-দারুল হরব সংক্রান্ত] ফুকাহায়ে কেরামের রিওয়ায়াত [বর্ণনা] এবং ইবারাত [বক্তব্য] সমূহ শোনা চাই। কেননা সেগুলোর কোন কোনটা থেকে বান্দার উপরোল্লিখিত আলোচনার দলীল পাওয়া যাবে এবং কোন কোনটা থেকে এই মাসআলা সংক্রান্ত রিওয়াত গুলোর হাকীকত [স্বরূপ] স্পষ্ট হয়ে যাবে।
‘ফাতাওয়া আলমগীর’(২/২৪৮) তে আছে-
“قال محمد – رحمه الله تعالى – في الزيادات: إنما تصير دار الإسلام دار الحرب عند أبي حنيفة – رحمه الله تعالى – بشروط ثلاثة، أحدها: إجراء أحكام الكفار على سبيل الاشتهار ، وأن لا يحكم فيها بحكم الإسلام، والثاني: أن تكون متصلة بدار الحرب ، لا يتخلل بينهما بلد من بلاد الإسلام، والثالث: أن لا يبقى فيها مؤمن ولا ذمي آمنا بأمانه الأول الذي كان ثابتا قبل استيلاء الكفار، للمسلم بإسلامه وللذمي بعقد الذمة، وصورة المسألة على ثلاثة أوجه :
إما أن يغلب أهل الحرب على دار من دورنا، أو ارتد أهل مصر وغلبوا وأجروا أحكام الكفر،
أو نقض أهل الذمة العهد وتغلبوا على دارهم، ففي كل من هذه الصور لا تصير دار حرب إلا بثلاثة شروط، وقال أبو يوسف ومحمد – رحمهما الله تعالى – بشرط واحد لا غير، وهو : إظهار أحكام الكفر، وهو القياس .”انتهى
“ইমাম মুহাম্মদ (রহ.) ‘আয-যিয়াদাত’ নামক কিতাবে বলেন,
আবু হানিফা (রহ.) এর মতে [কোন] দারুল ইসলাম [কে কাফেররা দখল করে নিলে তা] দারুল হরব হবে কয়েকটি শর্তেঃ
এক) প্রকাশ্যে কুফরী বিধান জারি করা এবং ইসলামী আহকাম জারি না থাকা।
দুই) উক্ত ভূখন্ড দারুল হরবের সাথে মিলিত থাকা। দারুল হরব এবং তার মাঝখানে দারুল ইসলামের কোন শহর বিদ্যমান না থাকা।
তিন) কাফেরদের দখলদারিত্বের পূর্বে মুসলমানদের জন্য তাদের ইসলামের কারণে এবং যিম্মি কাফেরদের তাদের যিম্মার চুক্তির মাধ্যমে যে আমান ছিল সেই আমানের বলে [এখন আর] কোন মুসলমান বা যিম্মি নিরাপদ না থাকা।
দারুল ইসলাম দারুল হরব হওয়ার সূরত তিনটিঃ
১. হারবী কাফেররা দারুল ইসলামের কোন ভূখন্ড দখল করে নেয়া।
২. কোন শহরের মুসলমানরা মুরতাদ হয়ে গিয়ে উক্ত শহর দখল করে নেয়া এবং তাতে কুফরী বিধান জারি করে দেয়া।
৩. যিম্মি কাফেররা তাদের যিম্মার চুক্তি ভঙ্গ করে তাদের বসবাসরত দারুল ইসলামের উক্ত ভূখন্ড দখল করে নেয়া।
এই তিন সূরতের কোন সূরতেই [আবু হানিফা (রহ.) এর মতে] [উপরোক্ত] তিন শর্ত ব্যতীত দারুল ইসলাম দারুল হরব হবে না।
কিন্তু আবু ইউসূফ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এবং মুহাম্মাদ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এর নিকট কেবল এক শর্ত পাওয়া গেলেই দারুল হরব হয়ে যাবে।
আর তা হচ্ছে- কুফরী বিধান জারি করা। আর কিয়াসের দাবি এটাই।”
‘জামিউর রুমুজ’ কিতাবে আছে-
“فأما صيرورتها دار الحرب فعنده بشرائط،
أحدها : إجراء أحكام الكفر اشتهارًا، بأن يحكم الحاكم بحكمهم، ولا يرجعون إلى قضاة المسلمين، كما فى البحر،
“والثاني : اتصال بدار الحرب بحيث لا يكون بينهما بلدة من بلاد الإسلام ما يلحقهم المدد منها…الخ
“দারুল ইসলাম দারুল হরব হওয়া আবু হানিফা (রহ.) এর নিকট তিন শর্তের উপর মাওকূফঃ
এক) প্রকাশ্যে কুফরী বিধান জারি করা। অর্থাৎ বিচারকরা কুফরী বিধান দিয়ে বিচার ফায়সালা করা। মুসলমান বিচারক [যারা ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী ফায়সালা করেন] তাদের নিকট যাওয়া লোকজনের জন্য সম্ভব না হওয়া। যেমনটা ‘আল-বাহরুর রায়েক্ব’ এ বলা হয়েছে।
দুই) উক্ত ভূখন্ড দারুল হরবেরসাথে এমন ভাবে মিলিত থাকা যে, মাঝখানে দারুল ইসলামের কোন শহর প্রতিবন্ধক নেই যেখান থেকে [দখলদার কাফেরদেরকে হটানোর জন্য] ঐ ভূখন্ডের মুসলমানদের কাছে সাহায্য পৌঁছতে পারে।”
জামিউর রুমুজের উক্ত রিওয়ায়াত থেকে দুটি বিষয় বুঝা গেলঃ
এক) ইসলামী আহকাম জারি করার দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে আপন শক্তিও দাপটের সাথে জারি করা। কাফেরদের অনুমতিক্রমে কোন মতে জামাআত সহ নামাজ ও জুমআ আদায় করতে পারা উদ্দেশ্য নয়।
কেননা জামিউর রুমুজের ইবারতে বলা হয়েছে-
” يحكم بحكمهم، ولا يرجعون إلى قضاة المسلمين.”
“কাফেরদের বিধান দ্বারা বিচার ফায়সালা করা হয়। লোকজন মুসলিম বিচারক [যারা শরীয়ত অনুযায়ী ফায়সালা করেন] তাদের নিকট যাওয়ার সামর্থ্য রাখেনা।”
অর্থাৎ মুসলিম বিচারকদের কোন প্রকার শক্তি ও প্রভাব বাকি নেই যে, লোকজন তাদের নিকট বিচার নিয়ে যেতে পারে।
এমনি ভাবে দারুল হারবে মুসলমানদের ইসলামী আহকাম জারি করা কেবল ঐ সূরতেই তাকে দারুল ইসলাম বানাতে পারে যখন এই আহকাম জারি মুসলমানদের নিজস্ব শক্তি ও দাপটে হয়।
এ বিষয়টি একেবারেই সুস্পষ্ট।
মোটকথা ইসলামী আহকাম জারি বা কুফরী বিধান জারি প্রত্যেকটাই নিজস্ব শক্তি ও দাপটে হলেই কেবল গ্রহণ যোগ্য হবে। শুধু প্রকাশ্যে আদায় করতে পারলেই গ্রহণ যোগ্য হয়ে যাবে না।
[দুই)] দ্বিতীয় যে বিষয়টি জামিউর রুমুজের ইবারত থেকে বুঝা যাচ্ছে তা হলো-
দারুল হরবের সাথে মিলিত থাকার যে শর্ত আবু হানিফা (রহ.) এর নিকট জরুরী তার দ্বারাও ঐ শক্তিও দাপটই উদ্দেশ্য। কেননা দারুল হরবের সাথে মিলিত থাকার সূরতে সেখানে মুসলমানদের সাহায্য পৌঁছতে পারবে না।
পক্ষান্তরে দারুল হরব থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার সূরতে মুসলমানদের জন্য তাকে মুক্ত করতে পারার সম্ভাবনা প্রকট। একারণেই ইসলামের শক্তি বহাল রয়েছে বলে ধরা হবে।
‘খিযানাতুল মুফতীন’ কিতাবে আছে-
دار الإسلام لا تصير دار الحرب إلا بإجراء أحكام الشرك فيها، وأن تكون متصلة بدار الحرب، لايكون بينها وبين دار الحرب مصر للمسلمين، وأن لا يبقى فيها مسلم أو ذمي آمنًا بالأمان الأول، وأن لا يبقى فيها مسلم أو ذمي آمنًا على نفسه إلا بأمان المشركين
“[কাফেররা] কোন দারুল ইসলাম [কে দখল করে নিলেও] ততক্ষণ পর্যন্ত [তা] দারুল হরব হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না –
– তাতে প্রকাশ্যে কুফরী বিধান জারি করা হয়।
– উক্ত ভূখন্ড দারুল হরবের সাথে মিলিত হয়। দারুল হরব এবং তার মাঝখানে মুসলমানদের কোন শহর প্রতিবন্ধক না থাকে।
– কোন মুসলমান ও যিম্মি তার পূর্বের আমানের বলে নিরাপদ না থাকে। কাফেরদের প্রদত্ত আমান ব্যতীত কোন মুসলমান বা যিম্মি নিজের ব্যাপারে আশংকা মুক্ত না থাকে।”
‘ফাতাওয়া বাযযাযিয়্যা’(৩/১৭১) তে আছে-
“قال السيد الإمام : والبلاد التي في أيدي الكفرة اليوم لا شك أنها بلاد الإسلام بعدُ، لأنه لم يظهر فيها أحكام الكفر، بل القضاة المسلمون.”
“সায়্যিদ ইমাম (রহ.) বলেন- বর্তমানে যেসব রাষ্ট্র কাফেরদের কব্জায় আছে নিঃসন্দেহে এখন পর্যন্ত সেগুলো দারুল ইসলামই রয়ে গেছে। কেননা সেগুলোতে কুফরী বিধান চালু হয়নি। বরং সেখানকার শাসক এবং বিচারকগণ মুসলমান।”
দেখা উচিৎ- [কাফেরদের দখলকৃত] ঐ রাষ্ট্রগুলো দারুল ইসলাম হিসেবে বাকি থাকার দলীল এই দেয়া হয়েছে যে, ‘সেখানকার শাসক এবং বিচারকগণ মুসলমান। সেখানে ইসলামী আহকাম আগের মতোই চালু রয়েছে।’
দলীলে একথা বলা হয়নি, লোকজন সেখানে নামাজ পড়ে, জুমআ আদায় করে।
কেননা আহকাম জারি দ্বারা ঐ জারি উদ্দেশ্য যা ক্ষমতা এবং শক্তি বলে হয়।
কাফের শাসকের সম্মতি ও অনুমতিক্রমে দ্বীনের বিধি-বিধান ও শাআয়ের আদায় করতে পারা উদ্দেশ্য নয়।
‘রদ্দুল মুহতার’ (২/১৪৪) এ আছে-
في معراج الدراية عن المبسوط : البلاد التي في أيدي الكفار بلاد الإسلام لا بلاد الحرب ، لأنهم لم يظهروا فيها حكم الكفر بل القضاة والولاة مسلمون، يطيعونهم عن ضرورة أو بدونها،
وكل مصر فيه والٍ من جهتهم يجوز له إقامة الجمع والأعياد والحد وتقليد القضاة لاستيلاء المسلم عليهم،
فلو الولاة كفارا يجوز للمسلمين إقامة الجمعة ، ويصير القاضي قاضيا بتراضي المسلمين ، ويجب عليهم أن يلتمسوا واليا مسلما
“‘মি’রাজুদ দিরায়া’ তে মাবসূত থেকে বর্ণিত আছে- [বর্তমানে] যেসব ভূখন্ড কাফেরদের কব্জায় আছে সেগুলো দারুল ইসলাম, দারুল কুফর নয়। কেননা তারা ঐ সব ভূখন্ডে কুফরী বিধান জারি করেনি। বরং সেখানকার শাসকও বিচারকগণ মুসলমান। তারা [অর্থাৎ সেখানকার মুসলমান শাসক ও বিচারকগণ] জরুরত বশত বা জরুরত ছাড়াই তাদের [অর্থাৎকাফেরদের] আনুগত্য করে।
আর প্রত্যেক ঐ শহর যাতে তাদের [মুসলমানদের] পক্ষ থেকে নিযুক্ত গভর্নর রয়েছে তার [গভর্নরের] জন্য জুমআ, ঈদ ও হদ [তথা শরীয়ত নির্ধারিত শাস্তি] সমূহ কায়েম করা এবং কাজী [বিচারক] নিয়োগ দেয়া জায়েয। কেননা [এখানে] তাদের [মুসলমানদের] উপর ক্ষমতাও শাসন মুসলমান শাসকের।
আর যদি শাসকরা কাফের হয় তবুও মুসলমানদের জন্য [তাদের অধীনে] জুমআ, ঈদ কায়েম করা জায়েয।
আর মুসলমানদের পারস্পরিক সন্তুষ্টির ভিত্তিতে [নির্বাচিত] কাজী [বিচারক] [শরীয়তের দৃষ্টিতেও] কাজী হয়ে যাবে।
দারুল হরবের মুসলমানদের উপর একজন মুসলমান শাসক তালাশ করা (এবং তার মাধ্যমে নিজেদের মুআমালা সমূহের বিচার ফায়সালা করানো) ওয়াজিব।”
‘রদ্দুল মুহতার’(৪/১৭৫) এ আরো বলা হয়েছে-
قلت: وبهذا ظهر أن ما في الشام من جبل تيم الله … وبعض البلاد التابعة كلُّها دار إسلام، لأنها وإن كانت لها حكام دروز أو نصارى، ولهم قضاة على دينهم … لكنهم تحت حكم ولاة أمورنا، وبلاد الإسلام محيطة ببلادهم من كل جانب، وإذا أراد ولي الأمر تنفيذ أحكامنا فيهم نفذها.” انتهى
“আমি বলি [অর্থাৎ আল্লামা শামী বলেন] [পূর্বোক্ত] এ [আলোচনা] থেকে বুঝে আসে যে, শামের ‘তাইমুল্লাহ্’ পাহাড় এবং এর অন্তর্গত আরো কতক শহর সবগুলোই দারুল ইসলাম।
কেননা সেগুলোর শাসক যদিও দারুয বা নাসারা এবং তাদের নিজেদের ধর্মীয় বিচারকও রয়েছে, কিন্তু তারা সকলেই আমাদের মুসলমান শাসকদের অধীনস্থ।
দারুল ইসলাম চতুর্দিক থেকে তাদের এলাকাকে বেষ্টন করে রেখেছে। মুসলমান শাসকগণ যখনই চাইবেন তাদের উপর আমাদের [শরীয়তের] আহকাম জারি করে দিতে পারবেন।”
এই দুই রিওয়ায়াত থেকে স্পষ্ট যে, কাফেররা কোন [ইসলামী শাসনাধীন] রাষ্ট্র দখল করে নেয়ার পর [তা] দারুল ইসলাম হিসেবে বাকি থাকার জন্য ইসলামী আহকাম জারি থাকার যে শর্ত, তার দ্বারা এটাই উদ্দেশ্য যে, ক্ষমতা ও দাপটের সাথে ইসলামী আহকাম জারি করা যাচ্ছে।
তদ্রূপ দারুল হারবে ইসলামী আহকাম জারি করার দ্বারা তখনই তা দারুল হরব হওয়া থেকে বের হবে যখন এই আহকাম জারি করা ক্ষমতা ও দাপটের সাথে হবে। এই নয় যে, দারুল হরবের শাসক তার নিজ অনুমতিক্রমে ইসলামী আহকাম জারি করে দেয়।
সারকথাঃ
ইমামে আজম (রহ.) এর উপরোক্ত তিন শর্ত এবং সাহেবাইন (রহ.) এর এক শর্তের দ্বারা উদ্দেশ্য একটাই। অর্থাৎ ক্ষমতা ও দাপট। যদিও তা কোন কোন দিক থেকে হয় [ সর্বদিক থেকে না হয়।]
কিন্তু ওলামায়ে ইসলামের কেউই একথা বলেন না যে- ‘কোন ব্যক্তি যদি কাফের রাষ্ট্রে কাফেরদের সুস্পষ্ট অনুমতিতে বা তাদের উদাসীনতার কারণে শাআয়েরে ইসলাম প্রকাশ্যে পালন করে তাহলে উক্ত রাষ্ট্র দারুল ইসলাম হয়ে যাবে।’
আল্লাহর পানাহ্! [কিছুতেই তারা এমন কথা বলতে পারেন না।] কেননা এধরণের খেয়াল তাফাক্কুহ্ [তথা দ্বীনের সমঝ ও বুঝ] থেকে সম্পূর্ণ দূরে।
***
(হিন্দুস্তানের হালতঃ)
যখন মূলনীতি গত দিক থেকে এই মাসআলার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলো তখন হিন্দুস্তানের হালতের ব্যাপারে নিজেই ফিকির করে দেখ [কোন দারুল ইসলাম দারুল হরব হওয়ার জন্য যেসব শর্ত উল্লেখ করা হয়েছে এখানে সেগুলো কত জোরালো ভাবেই না পাওয়া যাচ্ছে।]
[প্রথম শর্ত কীভাবে পাওয়া যাচ্ছে দেখ] এখানে নাসারা কাফেরদের বিধান কী পরিমাণ শক্তি এবং দাপটের সাথে চলছে !! যদি সাধারণ কোন কালেক্টরও হুকুম জারি করে যে, ‘মসজিদে জামাত করতে পারবেনা’ তাহলে বিশিষ্ট-সাধারণ কারোই এ সামর্থ্য নেই যে, জামাত আদায় করবে।
আর জুমআ, ঈদ এবং শরীয়তের আরো কিছু বুনিয়াদী বিষয়ের উপর আমল যা এখানে হচ্ছে তা কেবল তাদের এই আইনের কারণে যে, ‘প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিজ ধর্মের ব্যাপারে স্বাধীন। এ ব্যাপারে কারো হস্তক্ষেপ করার অধিকারনেই’।
[দ্বিতীয় শর্ত কীভাবে পাওয়া যাচ্ছে দেখ] মুসলিম শাসকগণ প্রদত্ত যে আমান এখানকার বাসিন্দাদের ছিল এখন তার কোন নাম নিশানাও নেই। কোন বিবেকবান বলতে পারবে, বাদশাহ শাহ আলম যে আমান আমাদেরকে দিয়েছিলেন আমরা সেই আমানের দ্বারা আজও নিরাপত্তার সাথে বসে আছি ?!
বরং কাফেরদের থেকে নতুন আমান নেয়া হয়েছে। নাসারাদের দেয়া এ আমানের মাধ্যমেই হিন্দুস্তানের সকল প্রজা এখানে বসবাস করছে।
আর [তৃতীয় শর্ত অর্থাৎ ‘দারুল হরবের সাথে মিলিত থাকা’এর ব্যাপারে কথা হচ্ছে] দারুল হরবের সাথে মিলিত থাকা বড় বড় এলাকার জন্য শর্ত নয়। গ্রাম, শহর এবং এমন [ছোট] এলাকার জন্য শর্ত। যার উদ্দেশ্য কেবল এতটুকু যে, ওখানে [দারুল ইসলাম থেকে] সাহায্য পৌঁছা সহজ।
যদি কেউ বলে, ‘রোম [অর্থাৎ তুরস্ক] বা কাবুলের [অর্থাৎ আফগানিস্তানের] শাসকের পক্ষ থেকে সাহায্য আসলে কাফেরদেরকে হিন্দুস্তান থেকে হটানো সম্ভব’ তাহলে আল্লাহর পানাহ্! এ ধরণের মন্তব্য কোনক্রমেই সঠিক নয়। হিন্দুস্তান থেকে তাদেরকে হটানো অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার। অনেক বড় জিহাদ এবং বিশাল যুদ্ধ সামগ্রীর প্রয়োজন।
মোট কথা হিন্দুস্তানে কাফেরদের দখলদারিত্ব এই পরিমাণ কায়েম হয়েছে যে, কোন সময় কোন দারুল হরবে কাফেরদের এর চেয়ে বেশী দখলদারিত্ব হয় না।
আর ইসালামী শাআয়ের যা এখানে মুসলমানরা পালন করছে তা কেবল তাদের [কাফেরদের] অনুমতিক্রমে হচ্ছে। নতুবা মুসলমানদের চেয়ে অসহায় নাগরিক কেউ নেই। হুকুমতে হিন্দুদেরও তো কিছুটা প্রভাব আছে, কিন্তু মুসলমানদের তাও নেই।
তবে হ্যাঁ, টুংক, রামপুর, ভূপাল এবং অন্যান্য রাজ্য যেখানকার শাসকরা কাফেরদের দ্বারা পরাজিত হওয়া সত্বেও নিজেদের বিধি-বিধান [অর্থাৎ ইসলামী বিধি-বিধান] জারি রাখতে পারছেন সেগুলোকে দারুল ইসলাম বলা যেতে পারে। যেমনটা ‘দুররে মুখতার’ ও অন্যান্য কিতাবের রিওয়ায়াত থেকে বুঝা যাচ্ছে। فقط والله سبحانه و تعالى أعلم.
বান্দা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী।
[রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী (রহ.) এর ফতোয়া এখানে শেষ হয়েছে।]
[ফতোয়ার অনুবাদ শেষ করার পর মুফতী শফী (রহ.) বলেন] আল্লাহ তাআলার প্রশংসা যে, তাঁর ইহসানে ‘দারুল হরব’ রিসালাটির উর্দু তরজমা সম্পন্ন হলো। আল্লাহ তাআলা মূল ফতোয়ার সাথে একেও [অর্থাৎ উর্দু তরজমাকেও] মাকবূল এবং নাফে’ [অর্থাৎ উপকারী] বানান। আমীন!
والحمد لله الذي بعزته و جلاله تتم الصالحات.
বান্দা মুহাম্মদ শফী দেউবন্দী
আফাল্লাহু আনহু [আল্লাহ্ তাকে মাফ করুন]
বর্তমান মুসলিম রাষ্ট্রগুলো দারুল হরব কেন?
রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী (রহ.) যে অবস্থার প্রেক্ষিতে ইংরেজদের দখলে থাকা তৎকালীন হিন্দুস্তান তথা বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান সহ গোটা ভারতীয় উপমহাদেশকে দারুল হরব ফতোয়া দিয়েছিলেন, আজ মুসলিম নামধারী মুরতাদ শাসকদের দখলে থাকা মুসলিম রাষ্ট্র সমূহে হুবহু ঐ অবস্থা বরং তার চেয়ে আরোও নাজুক অবস্থা বিদ্যমান। অতএব, তৎকালীন হিন্দুস্তানের মতো বর্তমানে মুরতাদদের দখলে থাকা মুসলিম রাষ্ট্রসমূহও দারুল হরব।
রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী (রহ.) এর উক্ত ফতোয়াটি যদি বর্তমান মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের উপর প্রয়োগ করি তাহলে কোন বেশ কম ছাড়াই হুবহু তা এসব রাষ্ট্রের উপর ফিট হয়ে যাবে।
আসুন দেখি এসব মুসলিম রাষ্ট্রে ফতোয়াটি কিভাবে আরোপিত হয়-
“বর্তমান মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর হালতঃ
যখন মূলনীতি গত দিক থেকে এই মাসআলার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলো তখন বর্তমান মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর হালতের ব্যাপারে নিজেই ফিকির করে দেখ [কোন দারুল ইসলাম দারুল হরব হওয়ার জন্য যেসব শর্ত উল্লেখ করা হয়েছে এখানে সেগুলো কত জোরালো ভাবেই না পাওয়া যাচ্ছে।]
[প্রথম শর্ত কীভাবে পাওয়া যাচ্ছে দেখুন] এখানে মুরতাদ কাফেরদের বিধান কী পরিমাণ শক্তি এবং দাপটের সাথে চলছে !!
যদি সরকারী দলের সাধারণ কোন নেতাও হুকুম জারি করে যে, ‘মসজিদে জামাত করতে পারবেনা’ তাহলে বিশিষ্ট-সাধারণ কারোই এ সামর্থ্য নেই যে, জামাত আদায় করবে।
আর জুমআ, ঈদ এবং শরীয়তের আরো কিছু বুনিয়াদী বিষয়ের উপর আমল যা এখানে হচ্ছে তা কেবল তাদের এই আইনের কারণে যে, ‘প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিজ ধর্মের ব্যাপারে স্বাধীন। এ ব্যাপারে কারো হস্তক্ষেপ করার অধিকারনেই’।
[দ্বিতীয় শর্ত কীভাবে পাওয়া যাচ্ছে দেখুন] মুসলিম শাসকগণ প্রদত্ত যে আমান এখানকার বাসিন্দাদের ছিল এখন তার কোন নাম নিশানাও নেই।
কোন বিবেকবান বলতে পারবে, উসমানী খলীফাগণ কিংবা অন্যান্য মুসলিম শাসকগণ যে আমান আমাদেরকে দিয়েছিলেন আমরা সেই আমানের দ্বারা আজও নিরাপত্তার সাথে বসে আছি ?!
বরং মুরতাদদের থেকে নতুন আমান নেয়া হয়েছে। মুরতাদদের দেয়া এ আমানের মাধ্যমেই বর্তমান মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সকল নাগরিক সেগুলোতে বসবাস করছে।
আর [তৃতীয় শর্ত অর্থাৎ ‘দারুল হরবের সাথে মিলিত থাকা’এর ব্যাপারে কথা হচ্ছে] দারুল হরবের সাথে মিলিত থাকা বড় বড় এলাকার জন্য শর্ত নয়। গ্রাম, শহর এবং এমন [ছোট] এলাকার জন্য শর্ত। যার উদ্দেশ্য কেবল এতটুকু যে, ওখানে [দারুল ইসলাম থেকে] সাহায্য পৌঁছা সহজ।
যদি কেউ বলে, মোল্লা উমর এবং শায়খ উসামার পক্ষ থেকে সাহায্য আসলে মুরতাদদেরকে মুসলিম রাষ্ট্রগুলো থেকে হটানো সম্ভব’ তাহলে আল্লাহর পানাহ্! এ ধরণের মন্তব্য কোনক্রমেই সঠিক নয়। মুসলিম রাষ্ট্রগুলো থেকে তাদেরকে হটানো অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার। অনেক বড় জিহাদ এবং বিশাল যুদ্ধ সামগ্রীর প্রয়োজন।
মোট কথা বর্তমান মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে মুরতাদদের দখলদারিত্ব এই পরিমাণ কায়েম হয়েছে যে, কোন সময় কোন দারুল হরবে কাফেরদের এর চেয়ে বেশী দখলদারিত্ব হয় না।
আর ইসালামী শাআয়ের যা এখানে মুসলমানরা পালন করছে তা কেবল তাদের [মুরতাদদের] অনুমতিক্রমে হচ্ছে। নতুবা মুসলমানদের চেয়ে অসহায় নাগরিক কেউ নেই। হুকুমতে শিয়া, হিন্দু, নাস্তিক ও অন্যান্য কাফেরদের তো অনেক প্রভাব আছে, কিন্তু মুসলমানদের কিছুই নেই।
তবে হ্যাঁ, আফগান, সোমালিয়া, ইয়ামান, শাম, ইরাক ও অন্যান্য ভূখন্ডের যেসব অংশ কাফেরদের থেকে উদ্ধার করে ইসলামী বিধি-বিধান জারি রাখা যাচ্ছে সেগুলোকে দারুল ইসলাম বলা যেতে পারে। যেমনটা ‘দুররে মুখতার’ ও অন্যান্য কিতাবের রিওয়ায়াত থেকে বুঝা যাচ্ছে। فقط والله سبحانه و تعالى أعلم.”
[উল্লেখ্য যে, মোল্লা উমর (রহ.) এবং শায়খ উসামা (রহ.) এর ওফাত হয়ে গেছে। এখানে শুধু বুঝানোর উদ্দেশ্যে উল্লেখ করা হয়েছে।]
আপনারা ভাল করে লক্ষ্য করে দেখুন গাঙ্গুহী (রহ.) এর ফতোয়াটি বর্তমান মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর উপর হুবহু আরোপিত হয় কি না ?
শুধু যে আরোপিত হয় তা-ই না, বরং বর্তমান মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর হালত তৎকালীন উপমহাদেশের চেয়ে আরো খারাপ।
তৎকালীন উপমহাদেশে তো কাফেররা দখল করে নেয়ার পরও এমন কিছু রাজ্য ছিল যেখানে শরয়ী শাসন জারি ছিল। তাছাড়া দুর্বল হলেও উসমানী খেলাফত তখনও কায়েম ছিল।
কিন্তু পরবর্তীতে কাফের ও মুরতাদরা মিলে মুসলিম রাষ্ট্র গুলোকে ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয়ার পর কোথাও ইসলামী শাসন জারি ছিল না। আফগানিস্তানে যাও কিছু ছিল পরপর আমেরিকা তাও শেষ করে দেয়।
আর বর্তমানে যে কয়টা ভূখন্ড মুজাহিদদের দখলে আছে তা কাফের ও মুরতাদদের বিরোদ্ধে দীর্ঘ দিনের যুদ্ধ এবং সমূদ্রসম রক্ত ঝরানোর ফসল। এছাড়া আর কোথাও ইসলামী শাসন কায়েম নেই। সর্বত্রই কুফরী শাসন চলছে।
বরং মুরতাদরা ইসলামকে মিটিয়ে দেয়ার জন্য আন্তর্জাতিক কুফরী শক্তির সাথে জোট গঠন করেছে। এক্ষেত্রে কাফের মুরতাদরা তাদের সবটুকু সামর্থ্য ব্যয় করছে। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, পুঁজিবাদ, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, নাস্তিকতা অকল্পনীয় বেগে মুসলিম প্রজন্মকে কুফর, ইরতিদাদ ও ইলহাদের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
হয়তো অদূর ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতি দাঁড়াবে যে, মুসলিম দাবিদারদের অর্ধেক বা অধিকাংশই শরীয়তের দৃষ্টিতে ইসলামের গন্ডি থেকে বেরিয়ে গিয়ে মুরতাদ হয়ে পড়েছে। নাউযুবিল্লাহি মিন যালিক!
এমন ভয়াবহ কুফর এবং কুফরী শাসন বিরাজমান থাকা সত্বেও এসব রাষ্ট্রকে দারুল ইসলাম তথা ইসলামী রাষ্ট্র মনে করা শরীয়ত এবং বিবেকবুদ্ধির সম্পূর্ণ পরিপন্থি।
আল্লাহ্ তাআলা আমাদেরকে সহীহ বুঝ দান করুন এবং সীরাতে মুসতাকীমের উপর কায়েম রাখুন। আমীন!
وصلى الله تعالى على خير خلقه محمد و على آله و أصحابه أجمعين
বান্দা আব্দুল ওয়াহহাব।
[1] [সম্ভবত ‘দুররে মুখতার’ না হয়ে ‘রদ্দুল মুহতার’ হবে । কেননা নিম্নোক্ত ইবারত ‘রদ্দুল মুহতার’(৪/১৬০) এ পেয়েছি, ‘দুররে মুখতার’ এ পাইনি।] –
[2] উল্লেখ্য যে, ইসতিহসান বলা হয়ঃ যে মাসআলাতে একাধিক কিয়াসের সম্ভাবনা আছে সেখানে তুলনামূলক অধিক শক্তিশালী দলীলের ভিত্তিতে একটা কিয়াসকে তারজীহ তথা প্রাধান্য দেয়া।
ফকিহুন নফস রশিদ আহমাদ গাঙ্গুহি রহঃ
মুফতি আব্দুল ওয়াহহাব রহঃ
ডাউনলোড
অনুবাদকের কথাঃ
দারুল ইসলাম ও দারুল হরবের মাসআলা ইসলামী শরীয়তের একটি বুনিয়াদী মাসআলা যার উপর আরোও অসংখ্য মাসআলার ভিত্তি। ফিকহ তথা ইসলামী আইন শাস্ত্রের প্রায় সকল কিতাবে এর আলোচনা রয়েছে এবং এর উপর ভিত্তি করে অসংখ্য অগণিত মাসআলা বর্ণিত হয়েছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উসমানী খেলাফতের পতনের পর যখন কাফেররা বিশাল খেলাফতকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে একেক অংশে মুসলিম নামধারী একেক মুরতাদকে শাসন ক্ষমতায় বসায় তখন নতুন করে এ মাসআলার আলোচনার প্র্রয়োজন পড়ে।
কেননা আইম্মায়ে কেরাম একমত যে, ইসলামী শাসনাধীন কোন রাষ্ট্র কাফের বা মুরতাদরা দখল করে নিয়ে তাতে কুফরী তথা শরীয়ত বিরোধী বিধান চালু করে দিলে এবং মুসলমানরা তাদের থেকে তা উদ্ধার করে ইসলামী শাসন জারি করতে অক্ষম হয়ে পড়লে উক্ত রাষ্ট্র আর দারুল ইসলাম তথা ইসলামী রাষ্ট্র থাকে না, বরং দারুল কুফর তথা কুফরী রাষ্ট্র হয়ে যায়। এ ব্যাপারে আইম্মায়ে কেরামের মাঝে কোন দ্বিমত নেই।
এ হিসেবে বর্তমানে শরীয়ত বিরোধী কুফরী আইন দ্বারা শাসিত মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সবগুলো আইম্মায়ে কেরামের সকলের ঐক্যমতে দারুল হরব।
মাসআলাটির গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার প্রতি লক্ষ্য করে অনেকেই এ ব্যাপারে কম বেশ লেখালেখি করেছেন।
এ সংক্রান্ত যে সব লেখা আমার পড়া হয়েছে সেগুলোর মধ্যে আমার ক্ষুদ্র দৃষ্টিতে অত্যন্ত তাহকীকী, বিশ্লেষণধর্মী ও সংশয় নিরসক মনে হয়েছে ফকীহুন নফস, আবু হানিফায়ে যমান, কুতুবুল ইরশাদ হযরত রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী (রহ.) এর ঐ ফতোয়াটি যা তিনি ইংরেজদের দখলে থাকা তৎকালীন উপমহাদেশকে দারুল হরব ফতোয়া দিয়ে জারি করেছিলেন।
১৮০৬ সালে শাহ আব্দুল আজীজ (রহ.) উপমহাদেশকে দারুল হরব ফতোয়া দিয়েছিলেন। কালের বিবর্তনে সেই ইংরেজ শাসনামলেই কেউ কেউ উপমহাদেশ দারুল হরব হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করে। তখন গাঙ্গুহী (রহ.) পুনরায় উপমহাদেশকে দারুল হরব ঘোষণা করে দলীল-প্রমাণ ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সমৃদ্ধ দীর্ঘ এক ফতোয়া জারি করেন। এই পুস্তিকায় এই ফতোয়ারই অনুবাদ করা হয়েছে।
গাঙ্গুহী (রহ.) যদিও শুধু উপমহাদেশকে দারুল হরব ঘোষণা করে এই ফতোয়া দিয়েছিলেন, কিন্তু কালের বিবর্তনে আজ সমগ্র মুসলিম বিশ্বের উপর এই ফতোয়া প্রযোজ্য হয়ে পড়েছে। মুরতাদদের দখলে থাকা সবগুলো মুসলিম রাষ্ট্র আজ এই ফতোয়ার আলোকে দারুল হরব প্রমাণিত হয়েছে।
কেউ কেউ হয়তো বলবেন, এসব রাষ্ট্রকে দারুল হরব বানানোর কী প্রয়োজন আপনাদের ?
উত্তরে বলবো, নতুন করে দারুল হরব বানাচ্ছি না। পূর্ব থেকে দারুল হরব হয়েই ছিল। আমরা শুধু প্রকাশ করছি এবং তা দ্বীনী দায়িত্ব মনে করেই করছি।
যদি এটা আমাদের অপরাধ হয় তাহলে মুরতাদকে মুরতাদ বলাও অপরাধ হবে! জালেমের বিরোদ্ধে কথা বলাও অপরাধ হবে! দ্বীন ধ্বংস হতে দেখেও দ্বীনের দুশমনদের বিরুদ্ধে কথা বলা অপরাধ হবে! আর যদি এগুলো অপরাধ না হয় তাহলে দারুল হরবকে দারুল হরব বলা অপরাধ হবে কেন ?
তাছাড়া আমরা নিজেদের থেকে কিছু বলছি না। আমাদের আইম্মা ও আকাবিরগণ যা বলে গেছেন সেই আলোকেই বলছি। কাজেই সমালোচক ভাইদের প্রতি অনুরোধ আপনারা দলীল ছাড়া কোন সমালোচনা করবেন না। যা বলবেন দলীল দিয়ে বলবেন।
মূল ফতোয়াটি ফারসী ভাষায় লিখিত। বিশিষ্ট সাধারণ সকলের ফায়েদার প্রতি খেয়াল করে মুফতী শফী (রহ.) উর্দুতে এর তরজমা করে দিয়েছেন। আমি এ উর্দু তরজমা থেকেই তরজমা করেছি। উর্দু তরজমাটি “জাওয়াহিরুল ফিকহ” এর পঞ্চম খন্ডে ছাপানো আছে। “তা’লীফাতে রশীদিয়্যাহ্” তে উর্দু তরজমা সহ মূল ফতোয়াটি ছাপা আছে। “বাক্বায়া ফাতাওয়া রশীদিয়্যাহ্” তে সূদীর্ঘ যে সওয়ালের জওয়াবে তিনি ফতোয়াটি লিখেছিন সেই সওয়াল সহ ছাপা আছে। আপনারা চাইলে এ সব কিতাবে দেখে নিতে পারেন।
মুফতী শফী (রহ.) তরজমার শুরতে ফতোয়ার ডকুমেন্ট এবং দারুল হরব দারুল ইসলাম মাসআলার গুরুত্ব সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত একটি ভূমিকা লিখেছেন। আমি সেটিরও তরজমা করে মূল ফতোয়ার শুরতে জুড়ে দিয়েছি।
মূল ফতোয়ায় বিভিন্ন কিতাব থেকে ৯/১০টি আরবী ইবারত [বক্তব্য] আনা হয়েছ। গাঙ্গুহী (রহ.) সেগুলোর কোন তরজমা করেননি। মুফতী শফী (রহ.) সেগুলোর তরজমা করেছেন। আমি সে তরজমাই বহাল রেখেছি।
তবে ফতোয়ার শেষ দিকে “রদ্দুল মুহতার” থেকে যে দুইটি ইবারত আনা হয়েছে তাতে ছাপাজনিত ভূল লক্ষ্য করা গেছে। এ জন্য মূল কিতাব দেখে শুদ্ধ ইবারত এনে সে অনুযায়ী তরজমা করে দিয়েছি।
ফতোয়াটি বুঝার সুবিধার্থে ফাঁকে ফাঁকে আমার নিজের পক্ষ থেকে ব্যাখ্যামূলক দু’ চার শব্দ সংযোজন করেছি। সেগুলোকে আলাদাভাবে বুঝানোর জন্য থার্ড ব্র্যাকেট [] ব্যবহার করেছি। মুফতী শফী (রহ.) নিজের থেকে যা বাড়িয়েছেন তা ফার্স্ট ব্র্যাকেট () এ দেয়া হয়েছে।
হযরত গাঙ্গুহী (রহ.)মূল ফতোয়ার কোন নাম দেননি। সহজতার জন্য মুফতী শফী (রহ.) এর নাম রেখেছেন-
(فيصلة الأعلام في دار الحرب و دار الإسلام)
[দারুল হরব এবং দারুল ইসলামের ব্যাপারে মহামনীষীগণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত]
পরিশেষে আল্লাহ্ তাআলার কাছে প্রার্থনা তিনি যেন মূল ফতোয়া এবং তার উর্দু তরজমার সাথে আমার এ বাংলা তরজমাকেও কবুল করে নেন এবং আমাদেরকে বর্তমান বিশ্বের দারুল ইসলাম ও দারুল হরবগুলো সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভের তাওফীক দান করেন। আমীন!
– মুফতি আব্দুল ওয়াহহাব
মুফতী শফী (রহ.) এর ভূমিকাঃ
হিন্দুস্তানে যেহেতু মুসলিম-অমুসলিম উভয়েরই বসবাস, হুকুমত এবং ক্ষমতা রয়েছে ; আবার এ সবের পরিবর্তনের সাথে সাথে ইসলামের অনেক বিধান পরিবর্তন ও ভিন্ন হয়ে যায়-এ কারণে হিন্দুস্তান দারুল ইসলাম না দারুল হরব এই মাসআলা দীর্ঘ দিন ধরে আলোচিত হয়ে আসছে।
এই ধারাবাহিকতায় আজ হিন্দুস্তান দারুল হরব হওয়ার ব্যাপারে কুতুবে আলম, যামানার জুনাইদ [বাগদাদী], যুগের আবু হানিফা হযরত মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী (রহ.) এর ঐ ফতোয়াটি প্রচার করা হচ্ছে যা তিনি তাঁর কোন আহলে ইলম শাগরেদের প্রশ্নের জওয়াবে মুফাসসাল [বিস্তারিত] এবং মকাম্মাল [পরিপূর্ণ] করে লিখেছিলেন।
হযরত মামদূহ [অর্থাৎ প্রশংসার্হ গাঙ্গুহী (রহ.)] এর সাহেবযাদা হযরাতুল আল্লামা মাওলানা হাকীম মাসউদ আহমদ সাহেব রহমাতুল্লাহি আলাইহি ফতোয়াটির এক কপি আমাকে দিয়েছিলেন। তাছাড়া হযরতের অনেক আত্নীয় এবং শাগরেদের নিকট ফতোয়াটির কপি বিদ্যমান রয়েছে।
এই মাসআলার [অর্থাৎ দারুল ইসলাম–দারুল হরব মাসআলার] জরুরত এবং শরীয়তের দৃষ্টিতে এর গুরুত্বঃ
যারা ফিকহ [তথা ইসলামী আইন শাস্ত্র] ও ফতোয়ার সাথে সম্পর্ক রাখেন তাদের নিকট অস্পষ্ট নয় যে, নামায-রোযা, হজ্ব-যাকাত, বিবাহ-তালাক, (বিশেষত : ক্রয়-বিক্রয় ও ইজারা) এবং অন্যান্য মুআমালা সহ ফিকহের প্রায় সকল অধ্যায়ের অসংখ্য শরয়ী মাসআলা দারুল ইসলামে এক রকম, দারুল হরবে অন্য রকম।
এ কারণে যদি বলা হয়, “শরীয়তের আহকামের একটা বিশাল বড় অংশ এমন রয়েছে যেগুলোর উপর আমল করার জন্য প্রথমে বসবাসরত রাষ্ট্র কি দারুল ইসলাম না দারুল হরব তা নির্ণয় করে নেয়া পূর্বশর্ত” তাহলে তা সম্পূর্ণ সঠিক।
এ কারণেই দীর্ঘ দিন ধরে হিন্দুস্তানী ওলামাদের নিকট এই মাসআলা আলোচিত হয়ে আসছে।
কুতুবে আলম হযরত মাওলানা গাঙ্গুহী – কুদ্দিসা সিররুহু – এর নিকটও এই মাসআলা জিজ্ঞাসা করা হয়। হযরত সময়ের প্রয়োজনের প্রতি লক্ষ্য করে আপন অভ্যাসের বিপরীত অত্যন্ত ব্যাখ্যাবহুল এবং বিস্তারিত এক জওয়াব [অর্থাৎ ফতোয়া] লেখেন।
আলহামদু লিল্লাহ্ ফতোয়াটি আহক্বারের হাতে [অর্থাৎ মুফতী শফী (রহ.) এর হাতে] পৌঁছেছে। ‘আল-মুফতী’ পত্রিকা সেটি প্রকাশ করার সৌভাগ্য অর্জন করেছে।
(নোট):
মূল ফতোয়াটি ফার্সী ভাষায় [লিখিত]। বিশিষ্ট-সাধারণ সকলের ফায়েদার প্রতি খেয়াল করে আহক্বার [অর্থাৎ মুফতী শফী (রহ.)] মূল ফতোয়াটি হুবহু বহাল রেখে সাথে তার উর্দু তরজমা লিখে দিয়েছে। আল্লাহ্ তাআলা মূল ফতোয়ার মতো একেও [অর্থাৎ উর্দু তরজমাকেও] মকবূল ও মুফীদ [উপকারী] বানান। আমীন!
হযরত [গাঙ্গুহী (রহ.)] মূল ফতোয়ার কোন নাম দেননি। সহজতার জন্য আহক্বার এর নাম রেখেছে-
(فيصلة الأعلام في دار الحرب و دار الإسلام)
[দারুল হরব এবং দারুল ইসলামের ব্যাপারে মহামনীষীগণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত]
না কারায়ে খালায়েক্বঃ বান্দা মুহাম্মদ শফী
২৯রবিউস সানী, ১৩৫২হি. [মোতাবেক ১৯৩৩ইং.]
[মূল ফতোয়া]
(হিন্দুস্তান কি দারুল হরব ?)
(সওয়ালঃ)
হজরত ওলামায়ে কেরাম এবং মুফতিয়ানে ইসলামের খেদমতে আরজ এই যে, শরীয়তের অনেক আহকাম দারুল ইসলাম এবং দারুল হরবের ভিন্নতার উপর নির্ভরশীল যা হযরত ওলামায়ে কেরামের নিকট অস্পষ্ট নয়।
অতএব, বর্তমান যুগের ওলামায়ে কেরাম এই মাসআলাতে কী বলেন যে, হিন্দুস্তান যা আজ সকল দিক থেকে নাসারাদের দখলদারিত্ব এবং হুকুমতের অধীন, শরীয়তের দৃষ্টিতে তাকে দারুল হরব বলা হবে নাকি দারুল ইসলাম?
(জওয়াবঃ)
প্রথমে এ কথা জেনে নেয়া চাই যে, কোন রাষ্ট্র বা কোন শহর দারুল ইসলাম বা দারুল হরব হওয়ার ভিত্তি হচ্ছে, তার উপর বিজয় কি মুসলমানদের না কাফেরদের।
এ হিসেবে যে শহর মুসলমানদের হুকুমতের অধীনে তা দারুল ইসলাম।
‘জামিউর রুমুজ’ এ আছে-
“دار الإسلام ما يجري فيه حكم إمام المسلمين وكانوا فيه آمنين، ودار الحرب ما خافوا فيه من الكافرين.” انتهى
“দারুল ইসলাম ঐ রাষ্ট্র যাতে মুসলমানদের ইমামের হুকুম চলে এবং মুসলমানরা সেখানে নিরাপদ। আর দারুল হরব হচ্ছে ঐ রাষ্ট্র যেখানে মুসলমানরা কাফেরদের থেকে তাদের তাদের জান ও মালের উপর আশংকায় থাকে।”
‘দুররে মুখতার’[1] এ আছে
“سئل قارئ الهداية عن البحر الملح : أ من دار الحرب أو الإسلام ؟ أجاب : أنه ليس من أحد القبيلين، لأنه لا قهر لأحد عليه.” انتهى
“ক্বারিউল হিদায়াকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ‘সমুদ্র দারুল হরবেরঅন্তর্ভূক্ত না’কি দারুল ইসলামের অন্তর্ভূক্ত’?
তিনি জওয়াব দেন, ‘তা[অর্থাৎ সমূদ্র] উভয়ের কোনটারই অন্তর্ভুক্ত নয়। কেননা এর উপর কারোই পরিপূর্ণ দখলদারিত্ব নেই।’ ”
এই ইবারত [বক্তব্য] আনার দ্বারা আমার উদ্দেশ্য [এ কথা বুঝানো যে], কোন রাষ্ট্র দারুল ইসলাম বা দারুল হরব হওয়ার একমাত্র ভিত্তি ইসলাম বা কুফরের বিজয়ের উপর। যদিও সমূদ্রের ব্যাপারে গ্রহণযোগ্য মত হচ্ছে,তা দারুল হরবের অন্তর্ভূক্ত।
কিন্ত ঐ ভূমি যা কাফের ও মুসলমান উভয়ের সমান দখলদারিত্বে রয়েছে তাকে দারুল ইসলামই বলা হবে। কেননা প্রসিদ্ধ মূলনীতি-
“الإسلام يَعلو، ولا يُعلى”
“(ইসলাম বিজয়ী থাকে পরাজিত হয় না)” এর দাবী এটাই।
তবে উক্ত ভূমিকে [অর্থাৎ যা কাফের ও মুসলমান উভয়ের সমান দখলদারিত্বে রয়েছে] দারুল ইসলাম এ শর্ত সাপেক্ষে বলা হবে যে, তাতে কোন ইসলামী শাসকের কব্জা এবং দখলদারিত্ব রয়েছে।
নতুবা উক্ত রাষ্ট্রকে কেবল এ হিসেবেই দারুল ইসলাম বলে দেয়া হবে না যে, তাতে মুসলমানরা বসবাস করে কিংবা কাফেরদের অনুমতিক্রমে শাআয়েরে দ্বীন পালন করতে পারে।
কোন [কাফের রাষ্ট্র দারুল ইসলাম গণ্য হওয়ার ক্ষেত্রে উক্ত] রাষ্ট্রে শুধু মুসলমানদের বসবাস করতে পারা কিংবা কাফেরদের অনুমতিক্রমে শাআয়েরে দ্বীন পালন করতে পারার কোন গ্রহণযোগ্যতা নেই।
তদ্রূপ [ইসলামী শাসনাধীন] কোন রাষ্ট্রে কাফেরদের বসবাস করা কিংবা মুসলমানদের অনুমতিক্রমে বা তাদের গাফলতির সুযোগে সেখানে শাআয়েরে কুফর যাহের করার কারণে তা দারুল ইসলাম হওয়ার মাঝে কোন বাধা সৃষ্টি করবে না।
কেননা এ উভয় ক্ষেত্রেই বিজয় ঐ সব লোকের নয়। আর[দারুল ইসলাম বা দারুল হরব হওয়ার] ভিত্তি তো হচ্ছে বিজয়ের উপর। শুধু বসবাস বা [শাআয়েরে দ্বীন] যাহের করার উপর নয়।
এ কারণেই তো যিম্মী কাফেররা মুসলমানদের অনুমতিক্রমে দারুল ইসলামে বসবাস করে এবং তাদের শাআয়েরগুলো পালনও করে । কিন্তু দারুল ইসলাম তার আপন অবস্থায় দারুল ইসলামই থেকে যায়।
তদ্রূপ মুসলমানরা দারুল কুফরে যায় এবং তাদের শাআয়েরগুলো পালনও করে। কিন্তু শুধু এতটুকুর কারণে ঐ রাষ্ট্র দারুল হরব হওয়া থেকে বের হয়ে যায় না।
তোমরা কি দেখ না – মক্কা বিজয়ের পূর্বে যখন মক্কা মুকাররামা দারুল হরব ছিল তখন ফখরে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উমরাতুল ক্বাজার সময় এক বিশাল বাহিনী সহ মক্কা মুয়াজ্জমায় উপস্থিত হয়ে ছিলেন।
জামায়াত, নামাজ, উমরা ও অন্যান্য শাআয়ের ঘোষণা দিয়ে পালন করেছিলেন। তাঁর সাথে এমন বিশাল বাহিনী ছিল যে, কাফেরদেরকে পরাজিত-পরাভূত করতে পারতেন। কেননা উমরাতুল ক্বাজার পূর্বে হুদায়বিয়ার সময় ঐ পরিমাণ বাহিনী নিয়ে মক্কা মুয়াজ্জামার উপর চড়াও হওয়ার প্রতিাজ্ঞা করেছিলেন। কিন্তু খোঁজ-খবর নেয়ার পর যখন হযরত উসমান (রা.) এর হত্যার ঘটনা মিথ্যা প্রমাণিত হলো তখন উক্ত প্রতিজ্ঞা ত্যাগ করা হয়।
মোট কথা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে এমন বিশাল বাহিনী ছিল যে, তিনি কাফেরদেরকে পরাজিত-পরাভূত করতে পারতেন। কিন্তু মক্কায় প্রবেশ এবং শাআয়ের আদায় যেহেতু কাফেরদের অনুমতিক্রমে হয়েছিল এ কারণে মক্কা মুয়াজ্জমাকে উক্ত তিন দিনের জন্য দারুল ইসলাম গণ্য করা হয়নি বরং পূর্বের মতো দারুল হরব হিসেবেই বহাল ছিল। কেননা মক্কায় প্রবেশ এবং ইসলাম যাহের করা [কাফেরদের] অনুমতির ভিত্তিতে ছিল, বিজয়ের ভিত্তিতে ছিলনা।
সারকথা, এ ব্যাপারে মূলনীতি হলোঃ
দারুল হরব ঐ ভূখন্ড যা কাফেরদের আয়ত্বাধীন। আর দারুল ইসালাম ঐ ভূখন্ড যা মুসলমানদের আয়ত্বাধীন। যদিও এক দারে অন্য দারের লোক দখলদারিত্ব এবং প্রভাব-প্রতিপত্তি ব্যতীত বসবাস করে।
যেমন- দারুল ইসালামে কাফের এবং দারুল হারবে মুসলমানরা দখলদারিত্ব এবং প্রভাব-প্রতিপত্তি ব্যতীত বসবাস করে।
আর যে রাষ্ট্রে মুসলমান-কাফের উভয়েরই দখলদারিত্ব রয়েছে তাকেও দারুল ইসালাম বলেই গণ্য করা হবে।
এই উসূল ও মূলনীতিকে খুব ভালভাবে আত্নস্থ করে নেয়া চাই। কেননা এ সংক্রান্ত [অর্থাৎ দারুল ইসলাম ও দারুল হরব সংক্রান্ত] সকল মাসআলা এ উসূল থেকেই বের হয় এবং এ অধ্যায়ের ফুরুয়ী তথা শাখা গত সকল বিধান এ মূলনীতির উপরই প্রতিষ্ঠিত।
(মুসলমানদের দারুল হরব বিজয়)
এর পর আরেকটি মাসআলা শুনে রাখা চাই।তা হচ্ছে-
যে রাষ্ট্র মূলত দারুল হরব এবং দারুল কুফর ছিল এরপর মুসলমানরা তা বিজয় করে এবং ইসলামের হুকুম আহকাম তাতে জারি করে এর ব্যাপারে ওলামাগণ একমত যে, তা এখন দারুল ইসলাম হয়ে গেছে।
কেননা এর উপর মুসলমানদের বিজয় এবং প্রভাব প্রতিপত্তি কায়েম হয়েছে। যদি কোন দিক থেকে কাফেরদের প্রভাব কিছুটা বাকি থেকেও থাকে তবুও “الإسلام يَعلو، ولا يُعلى”(ইসলাম বিজয়ী থাকে ,পরাজিত হয়না) এই মূলনীতি হিসেবে তা সকলের ঐক্যমতে দারুল ইসলাম হয়ে গেছে, যেমনটা একটু পূর্বে স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে।
এর পর এ বিষয়টিও স্পষ্ট করে দেয়া চাই যে, যদি ঐ [কাফের] রাষ্ট্রে মুসলমানদের প্রবেশ এবং ইসলামী আহকাম জারি করা উক্ত রাষ্ট্র বিজয় করার দ্বারা না হয়, তাহলে ঐ রাষ্ট্র দারুল হরব হওয়ার ব্যাপারে কোনই তফাৎ সৃষ্টি হবে না। অন্যথায় জার্মানী, রাশিয়া, ফ্রান্স, চীন এবং অন্যান্য রাষ্ট্র যা নাসারা কিংবা ভূতপূঁজারীদের দখলে আছে সবগুলোই দারুল ইসলাম বলার উপযুক্ত হয়ে যেত।
সারা দুনিয়ার কোথাও দারুল হরবের কোন নাম নিশানাই থাকতোনা। কেননা সব কাফের রাষ্ট্রেই মুসলমানরা কাফেরদের অনুমতিক্রমে ইসলামী হুকুম আহকাম পালন করছে। আর এ তো সুস্পষ্ট যে, বর্তমান হালতে সমগ্র দুনিয়াকে দারুল ইসলাম বলে দেয়া সম্পূর্ণই বাতিল।
(দারুল ইসলামের উপর কাফেরদের কব্জাঃ)
যে রাষ্ট্র বা শহর দারুল ইসলাম ছিল অতঃপর কাফেররা তা দখল করে নেয়- যদি তার উপর থেকে মুসলমানদের দখলদারিত্ব সম্পূর্ণ শেষ হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে তা এখন দারুল হরবের হুকুমে চলে যাবে।
আর যদি এমন হয় যে, কাফেরদের দখলদারিত্ব তো কায়েম হয়েছে কিন্তু কোন কোন দিক থেকে ইসলামের দখলদারিত্বও বাকি রয়েছে তাহলে তাকে এখনোও দারুল ইসলামই বলা হবে। দারুল হরব বলা হবে না।
এতটুকু কথার মধ্যে সকল ইমাম একমত।
তবে এ ব্যাপারে মতভেদ আছে যে, ইসলামের দখল দারিত্ব সম্পূর্ণ শেষ হয়ে যাওয়ার সীমা কী?
সাহেবাইন অর্থাৎ ইমাম আবু ইউসূফ (রহ.) এবং ইমাম মুহাম্মদ (রহ.) বলেন, যখন কাফেররা প্রকাশ্যে কুফরী বিধান জারি করে দেয় এবং মুসলমানরা কাফেরদের অনুমতি ব্যতীত নিজস্ব শক্তি বলে ইসলামী আহকাম জারি করতে না পারে তখন ইসলামের দখলদারিত্ব সম্পূর্ণ শেষ হয়ে যায় এবং উক্ত রাষ্ট্র দারুল হরবের হুকুমে চলে যায়।
তবে হ্যাঁ, যদি মুসলমান কাফের উভয়ই তাদের আপন আপন শক্তি বলে নিজেদের আহকাম জারি করতে পারে তাহলে এখনো উক্ত রাষ্ট্র থেকে ইসলামের দখলদারিত্ব শেষ হয়ে যায়নি এবং উক্ত রাষ্ট্রকে দারুল হরবও বলা যাবে না।
আর যখন কাফেররা নিজস্ব শক্তি বলে প্রকাশ্যে তাদের বিধান জারি করে এবং মুসলমানরা কাফেরদের অনুমতি ব্যতীত প্রকাশ্যে তাদের আহকাম জারি করার সামর্থ্য না রাখে তাহলে তার উপর থেকে ইসলামের দখলদারিত্ব সম্পূর্ণ শেষ হয়ে গেছে।
কিয়াসের দাবি এটাই যা সাহেবাইন (রহ.) বলেছেন।
কেননা যখন কাফেররা এই পরিমাণ দখলদারিত্ব কায়েম করে ফেলল যে, কুফরী বিধান নিজস্ব শক্তি বলে জারি করতে পারছে, আর মুসলমানরা এই পরিমাণ অক্ষম ও পরাজিত হল যে, নিজেদের [ইসলামী] আহকাম জারি করতে পারছেনা এবং যে কুফরী বিধান মুসলমানদের জন্য লজ্জা ও অপমানের বিষয় তা দূর করতে পারছেনা, তখন আর ইসলামের কী বাকি আছে যার কারণে ঐ রাষ্ট্রকে দারুল ইসলাম বলা যায় ?
বরং ঐ সূরতে কাফেরদের দখলদারিত্ব সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে এবং বাস্তবিকই ঐ রাষ্ট্র দারুল হারবে পরিণত হয়েছে।
কিন্তু আবু হানিফা (রহ.) তাঁর সূক্ষ্ম দৃষ্টির ভিত্তিতে ইসতিহসান[2] স্বরূপ বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত ইসলামের বিজয়ের একটা নিদর্শনও পাওয়া যাবে, কিংবা কাফেরদের দখলদারিত্বে এমন কোন দুর্বলতা অনুভূত হবে যার কারণে কাফেরদেরকে হটিয়ে দেয়া মুসলমানদের জন্য কোন মুশকিল বিষয় হবেনা ততক্ষণ পর্যন্ত ঐ রাষ্ট্র দারুল হরব হয়ে গেছে বলে হুকুম না লাগানো চাই।
এ কারণেই আবু হানিফা (রহ.) [কাফেরদের দখলকৃত] উক্ত [ইসলামী] রাষ্ট্র দারুল হরব হওয়ার জন্য অতিরিক্ত দু’টি শর্ত আরোপ করেন।
প্রথম শর্তঃ
যে দারুল ইসলাম কাফেররা দখল করে নিয়েছে তা দারুল হরবেরসাথে মিলিত হতে হবে। দারুল হরব এবং তার মাঝখানে দারুল ইসলামের কোন রাষ্ট্র বা শহর বিদ্যমান না থাকতে হবে। কেননা এ ভাবে দারুল হরবেরসাথে মিলিত হওয়া এবং দারুল ইসলাম থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে স্পষ্টতই তা পূর্ণরূপে কাফেরদের কব্জায় চলে গেছে। তাদের হাত থেকে একে মুক্ত করা মুশকিল হয়ে পড়েছে।
এই মাসআলার দৃষ্টান্ত হচ্ছে –
কাফেররা মুসলমানদের মাল [ছিনিয়ে] নিয়ে গেলে তার দুই অবস্থাঃ
এক) তাদের দেশে নিয়ে গিয়ে পরিপূর্ণ কব্জা করে ফেলা।
এ সূরতে উক্ত মাল তাদের মালিকানাধীন [হয়ে গেছে বলে] ধরা হবে।
দুই) এখনো তাদের নিজেদের দেশে নিয়ে যেতে পারেনি এবং এর উপর তাদের পরিপূর্ণ কব্জা কায়েম করতে পারেনি।
এ অবস্থায় উক্ত মাল তার মালিকের মালিকানা থেকে বের হয়নি এবং কাফেরদের মালিকানায় প্রবেশ করেনি।
এই মাসআলা ফিকহের সমস্ত কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে।
‘হিদায়া’(২/৫৮১) তে আছে-
“و إذا غلبوا على أموالنا و أحرزوها بدارهم ملكوها…الخ”
“যদি কাফেররা আমাদের মাল দখল করে তাদের দেশে নিয়ে যায় তাহলে তারা এর মালিক হয়ে যাবে।”
‘হিদায়া’(২/৫৮১) তে আরো আছে-
“غير أن الاستيلاء لا يتحقق إلا بالإحراز بالدار، لأنه عبارة عن الاقتدار على المحل حالًا و مآلًا…الخ”
“যতক্ষণ পর্যন্ত কাফেররা [আমাদের থেকে দখলকৃত] মাল তাদের দেশে না নিয়ে যেতে পারবে ততক্ষণ পর্যন্ত তাতে তাদের কব্জা কায়েম হবে না।
কেননা [কোন বস্তুর উপর] কব্জা [লাভের অর্থ] হচ্ছে বর্তমানেও [উক্ত] বস্তুর উপর [ইচ্ছা মত হস্তক্ষেপের] সামর্থ্য থাকা এবং বাহ্যিক অবস্থাদৃষ্টে ভবিষ্যতেও তা বহাল থাকবে বলে মনে হওয়া।”
তদ্রুপ কাফেররা যদি [মুসলমানদের] কোন ভূমি বা শহর তাদের দেশে নিয়ে গিয়ে তার উপর পরিপূর্ণ কব্জা কায়েম করে ফেলে তাহলে উক্ত ভূখন্ড পরিপূর্ণরূপে কাফেরদের দখলে চলে গেছে [বলে ধরা হবে]।
আর ভূমি তাদের দেশে নিয়ে যাওয়ার সূরত তো এটাই হতে পারে যে, তা দারুল হরবের সাথে মিলিত হবে এবং দারুল ইসলাম থেকে বিচ্ছিন্ন হবে।
আর যতক্ষণ পর্যন্ত এমনটা না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত তাতে মুসলমানদের কব্জা কায়েম রয়েছে বলে ধরা হবে।
এই কব্জা যদি দুর্বলও হয় তবুও “الإسلام يَعلو، ولا يُعلى” “(ইসলাম বিজয়ী থাকে , পরাজিত হয় না।)” এর দাবি এটাই যে , উক্ত ভূখন্ড দারুল ইসলাম হিসেবে বহাল থাকবে।
অতএব, এ শর্তের সারকথা এটাই দাঁড়ালো – কাফেরদের কব্জা এবং মুসলমানদের পরাজয়। যেমনটা শুরুতে মূলনীতি হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
দ্বিতীয় শর্তঃ
ইমামে আজমের নিকট দ্বিতীয় শর্তটি হচ্ছে, মুসলমান শাসক মুসলমানদেরকে ইসলামের কারণে এবং কাফের প্রজাদেরকে যিম্মি হওয়ার কারণে যে আমান [নিরাপত্তা] দিয়েছিলেন তা বাতিল হয়ে যাওয়া। কোন ব্যক্তি পূর্বোক্ত আমানের কারণে নিজের জান-মালের উপর নিরাপদ না থাকা।
অর্থাৎ ‘মুসলমান শাসকের দেয়া আমানের কারণে সকলেই যেমন আশংকা মুক্ত ছিল, তাদের জান-মালের উপর কারো জুলুম করার সুযোগ ছিল না’- তেমন আর না থাকা।
আর এ তো সুস্পষ্ট যে, মুসলিম শাসকের শক্তি, দাপট ও প্রভাব-প্রতিপত্তি ব্যতীত এই পর্যায়ের আমান অর্জিত হওয়া সম্ভব নয়।
মোটকথা – উক্ত আমান আর বাকি না থাকা, বরং তা বেকার হয়ে যাওয়া। দখলদার কাফেরদের কতৃক তাদের কানূন অনুযায়ী প্রদত্ত আমানই নিরাপত্তার একমাত্র সম্বল হওয়া।
আর এ তো সুস্পষ্ট যে, মুসলিম শাসকের প্রদত্ত আমান দ্বারা যতদিন জালেমের জুলুমের ভয় বিদূরীত থাকবে, ততদিন পর্যন্ত মুসলিম শাসকের শক্তি ও দাপট বহাল রয়েছে বলে ধরা হবে। যখন এসব কিছু আর থাকছে না, বরং কাফেরদের প্রদত্ত আমানের উপরই কেবল নির্ভর করতে হচ্ছে তখন পূর্বের আমান বাতিল হয়ে গেছে।
সারকথাঃ
ইমামে আজমের নিকট প্রকাশ্যে কুফরী বিধান জারি করার সাথে সাথে যখন এ দুই শর্তও পাওয়া যাবে তখন সর্বদিক থেকে কাফেরদের দখলদারিত্ব কায়েম হয়েছে বলে ধরা হবে এবং মুসলমানদের শক্তি ও দাপট সম্পূর্ণ শেষ হয়ে গেছে বলে গণ্য হবে।
তখন অসহায় উক্ত ভূখন্ড দারুল হরব হয়ে গেছে বলে হুকুম দেয়া হবে।
বিবেকবানরা এ থেকেও বুঝতে পারছেন যে, এই [দ্বিতীয়] শর্তের ভিত্তিও শক্তি ও দখলদারিত্বের উপরই। শুরুতে মূলনীতির মধ্যে যা ব্যাখ্যা করে দেয়া হয়েছে।
এবার [দারুল ইসলাম-দারুল হরব সংক্রান্ত] ফুকাহায়ে কেরামের রিওয়ায়াত [বর্ণনা] এবং ইবারাত [বক্তব্য] সমূহ শোনা চাই। কেননা সেগুলোর কোন কোনটা থেকে বান্দার উপরোল্লিখিত আলোচনার দলীল পাওয়া যাবে এবং কোন কোনটা থেকে এই মাসআলা সংক্রান্ত রিওয়াত গুলোর হাকীকত [স্বরূপ] স্পষ্ট হয়ে যাবে।
‘ফাতাওয়া আলমগীর’(২/২৪৮) তে আছে-
“قال محمد – رحمه الله تعالى – في الزيادات: إنما تصير دار الإسلام دار الحرب عند أبي حنيفة – رحمه الله تعالى – بشروط ثلاثة، أحدها: إجراء أحكام الكفار على سبيل الاشتهار ، وأن لا يحكم فيها بحكم الإسلام، والثاني: أن تكون متصلة بدار الحرب ، لا يتخلل بينهما بلد من بلاد الإسلام، والثالث: أن لا يبقى فيها مؤمن ولا ذمي آمنا بأمانه الأول الذي كان ثابتا قبل استيلاء الكفار، للمسلم بإسلامه وللذمي بعقد الذمة، وصورة المسألة على ثلاثة أوجه :
إما أن يغلب أهل الحرب على دار من دورنا، أو ارتد أهل مصر وغلبوا وأجروا أحكام الكفر،
أو نقض أهل الذمة العهد وتغلبوا على دارهم، ففي كل من هذه الصور لا تصير دار حرب إلا بثلاثة شروط، وقال أبو يوسف ومحمد – رحمهما الله تعالى – بشرط واحد لا غير، وهو : إظهار أحكام الكفر، وهو القياس .”انتهى
“ইমাম মুহাম্মদ (রহ.) ‘আয-যিয়াদাত’ নামক কিতাবে বলেন,
আবু হানিফা (রহ.) এর মতে [কোন] দারুল ইসলাম [কে কাফেররা দখল করে নিলে তা] দারুল হরব হবে কয়েকটি শর্তেঃ
এক) প্রকাশ্যে কুফরী বিধান জারি করা এবং ইসলামী আহকাম জারি না থাকা।
দুই) উক্ত ভূখন্ড দারুল হরবের সাথে মিলিত থাকা। দারুল হরব এবং তার মাঝখানে দারুল ইসলামের কোন শহর বিদ্যমান না থাকা।
তিন) কাফেরদের দখলদারিত্বের পূর্বে মুসলমানদের জন্য তাদের ইসলামের কারণে এবং যিম্মি কাফেরদের তাদের যিম্মার চুক্তির মাধ্যমে যে আমান ছিল সেই আমানের বলে [এখন আর] কোন মুসলমান বা যিম্মি নিরাপদ না থাকা।
দারুল ইসলাম দারুল হরব হওয়ার সূরত তিনটিঃ
১. হারবী কাফেররা দারুল ইসলামের কোন ভূখন্ড দখল করে নেয়া।
২. কোন শহরের মুসলমানরা মুরতাদ হয়ে গিয়ে উক্ত শহর দখল করে নেয়া এবং তাতে কুফরী বিধান জারি করে দেয়া।
৩. যিম্মি কাফেররা তাদের যিম্মার চুক্তি ভঙ্গ করে তাদের বসবাসরত দারুল ইসলামের উক্ত ভূখন্ড দখল করে নেয়া।
এই তিন সূরতের কোন সূরতেই [আবু হানিফা (রহ.) এর মতে] [উপরোক্ত] তিন শর্ত ব্যতীত দারুল ইসলাম দারুল হরব হবে না।
কিন্তু আবু ইউসূফ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এবং মুহাম্মাদ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এর নিকট কেবল এক শর্ত পাওয়া গেলেই দারুল হরব হয়ে যাবে।
আর তা হচ্ছে- কুফরী বিধান জারি করা। আর কিয়াসের দাবি এটাই।”
‘জামিউর রুমুজ’ কিতাবে আছে-
“فأما صيرورتها دار الحرب فعنده بشرائط،
أحدها : إجراء أحكام الكفر اشتهارًا، بأن يحكم الحاكم بحكمهم، ولا يرجعون إلى قضاة المسلمين، كما فى البحر،
“والثاني : اتصال بدار الحرب بحيث لا يكون بينهما بلدة من بلاد الإسلام ما يلحقهم المدد منها…الخ
“দারুল ইসলাম দারুল হরব হওয়া আবু হানিফা (রহ.) এর নিকট তিন শর্তের উপর মাওকূফঃ
এক) প্রকাশ্যে কুফরী বিধান জারি করা। অর্থাৎ বিচারকরা কুফরী বিধান দিয়ে বিচার ফায়সালা করা। মুসলমান বিচারক [যারা ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী ফায়সালা করেন] তাদের নিকট যাওয়া লোকজনের জন্য সম্ভব না হওয়া। যেমনটা ‘আল-বাহরুর রায়েক্ব’ এ বলা হয়েছে।
দুই) উক্ত ভূখন্ড দারুল হরবেরসাথে এমন ভাবে মিলিত থাকা যে, মাঝখানে দারুল ইসলামের কোন শহর প্রতিবন্ধক নেই যেখান থেকে [দখলদার কাফেরদেরকে হটানোর জন্য] ঐ ভূখন্ডের মুসলমানদের কাছে সাহায্য পৌঁছতে পারে।”
জামিউর রুমুজের উক্ত রিওয়ায়াত থেকে দুটি বিষয় বুঝা গেলঃ
এক) ইসলামী আহকাম জারি করার দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে আপন শক্তিও দাপটের সাথে জারি করা। কাফেরদের অনুমতিক্রমে কোন মতে জামাআত সহ নামাজ ও জুমআ আদায় করতে পারা উদ্দেশ্য নয়।
কেননা জামিউর রুমুজের ইবারতে বলা হয়েছে-
” يحكم بحكمهم، ولا يرجعون إلى قضاة المسلمين.”
“কাফেরদের বিধান দ্বারা বিচার ফায়সালা করা হয়। লোকজন মুসলিম বিচারক [যারা শরীয়ত অনুযায়ী ফায়সালা করেন] তাদের নিকট যাওয়ার সামর্থ্য রাখেনা।”
অর্থাৎ মুসলিম বিচারকদের কোন প্রকার শক্তি ও প্রভাব বাকি নেই যে, লোকজন তাদের নিকট বিচার নিয়ে যেতে পারে।
এমনি ভাবে দারুল হারবে মুসলমানদের ইসলামী আহকাম জারি করা কেবল ঐ সূরতেই তাকে দারুল ইসলাম বানাতে পারে যখন এই আহকাম জারি মুসলমানদের নিজস্ব শক্তি ও দাপটে হয়।
এ বিষয়টি একেবারেই সুস্পষ্ট।
মোটকথা ইসলামী আহকাম জারি বা কুফরী বিধান জারি প্রত্যেকটাই নিজস্ব শক্তি ও দাপটে হলেই কেবল গ্রহণ যোগ্য হবে। শুধু প্রকাশ্যে আদায় করতে পারলেই গ্রহণ যোগ্য হয়ে যাবে না।
[দুই)] দ্বিতীয় যে বিষয়টি জামিউর রুমুজের ইবারত থেকে বুঝা যাচ্ছে তা হলো-
দারুল হরবের সাথে মিলিত থাকার যে শর্ত আবু হানিফা (রহ.) এর নিকট জরুরী তার দ্বারাও ঐ শক্তিও দাপটই উদ্দেশ্য। কেননা দারুল হরবের সাথে মিলিত থাকার সূরতে সেখানে মুসলমানদের সাহায্য পৌঁছতে পারবে না।
পক্ষান্তরে দারুল হরব থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার সূরতে মুসলমানদের জন্য তাকে মুক্ত করতে পারার সম্ভাবনা প্রকট। একারণেই ইসলামের শক্তি বহাল রয়েছে বলে ধরা হবে।
‘খিযানাতুল মুফতীন’ কিতাবে আছে-
دار الإسلام لا تصير دار الحرب إلا بإجراء أحكام الشرك فيها، وأن تكون متصلة بدار الحرب، لايكون بينها وبين دار الحرب مصر للمسلمين، وأن لا يبقى فيها مسلم أو ذمي آمنًا بالأمان الأول، وأن لا يبقى فيها مسلم أو ذمي آمنًا على نفسه إلا بأمان المشركين
“[কাফেররা] কোন দারুল ইসলাম [কে দখল করে নিলেও] ততক্ষণ পর্যন্ত [তা] দারুল হরব হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না –
– তাতে প্রকাশ্যে কুফরী বিধান জারি করা হয়।
– উক্ত ভূখন্ড দারুল হরবের সাথে মিলিত হয়। দারুল হরব এবং তার মাঝখানে মুসলমানদের কোন শহর প্রতিবন্ধক না থাকে।
– কোন মুসলমান ও যিম্মি তার পূর্বের আমানের বলে নিরাপদ না থাকে। কাফেরদের প্রদত্ত আমান ব্যতীত কোন মুসলমান বা যিম্মি নিজের ব্যাপারে আশংকা মুক্ত না থাকে।”
‘ফাতাওয়া বাযযাযিয়্যা’(৩/১৭১) তে আছে-
“قال السيد الإمام : والبلاد التي في أيدي الكفرة اليوم لا شك أنها بلاد الإسلام بعدُ، لأنه لم يظهر فيها أحكام الكفر، بل القضاة المسلمون.”
“সায়্যিদ ইমাম (রহ.) বলেন- বর্তমানে যেসব রাষ্ট্র কাফেরদের কব্জায় আছে নিঃসন্দেহে এখন পর্যন্ত সেগুলো দারুল ইসলামই রয়ে গেছে। কেননা সেগুলোতে কুফরী বিধান চালু হয়নি। বরং সেখানকার শাসক এবং বিচারকগণ মুসলমান।”
দেখা উচিৎ- [কাফেরদের দখলকৃত] ঐ রাষ্ট্রগুলো দারুল ইসলাম হিসেবে বাকি থাকার দলীল এই দেয়া হয়েছে যে, ‘সেখানকার শাসক এবং বিচারকগণ মুসলমান। সেখানে ইসলামী আহকাম আগের মতোই চালু রয়েছে।’
দলীলে একথা বলা হয়নি, লোকজন সেখানে নামাজ পড়ে, জুমআ আদায় করে।
কেননা আহকাম জারি দ্বারা ঐ জারি উদ্দেশ্য যা ক্ষমতা এবং শক্তি বলে হয়।
কাফের শাসকের সম্মতি ও অনুমতিক্রমে দ্বীনের বিধি-বিধান ও শাআয়ের আদায় করতে পারা উদ্দেশ্য নয়।
‘রদ্দুল মুহতার’ (২/১৪৪) এ আছে-
في معراج الدراية عن المبسوط : البلاد التي في أيدي الكفار بلاد الإسلام لا بلاد الحرب ، لأنهم لم يظهروا فيها حكم الكفر بل القضاة والولاة مسلمون، يطيعونهم عن ضرورة أو بدونها،
وكل مصر فيه والٍ من جهتهم يجوز له إقامة الجمع والأعياد والحد وتقليد القضاة لاستيلاء المسلم عليهم،
فلو الولاة كفارا يجوز للمسلمين إقامة الجمعة ، ويصير القاضي قاضيا بتراضي المسلمين ، ويجب عليهم أن يلتمسوا واليا مسلما
“‘মি’রাজুদ দিরায়া’ তে মাবসূত থেকে বর্ণিত আছে- [বর্তমানে] যেসব ভূখন্ড কাফেরদের কব্জায় আছে সেগুলো দারুল ইসলাম, দারুল কুফর নয়। কেননা তারা ঐ সব ভূখন্ডে কুফরী বিধান জারি করেনি। বরং সেখানকার শাসকও বিচারকগণ মুসলমান। তারা [অর্থাৎ সেখানকার মুসলমান শাসক ও বিচারকগণ] জরুরত বশত বা জরুরত ছাড়াই তাদের [অর্থাৎকাফেরদের] আনুগত্য করে।
আর প্রত্যেক ঐ শহর যাতে তাদের [মুসলমানদের] পক্ষ থেকে নিযুক্ত গভর্নর রয়েছে তার [গভর্নরের] জন্য জুমআ, ঈদ ও হদ [তথা শরীয়ত নির্ধারিত শাস্তি] সমূহ কায়েম করা এবং কাজী [বিচারক] নিয়োগ দেয়া জায়েয। কেননা [এখানে] তাদের [মুসলমানদের] উপর ক্ষমতাও শাসন মুসলমান শাসকের।
আর যদি শাসকরা কাফের হয় তবুও মুসলমানদের জন্য [তাদের অধীনে] জুমআ, ঈদ কায়েম করা জায়েয।
আর মুসলমানদের পারস্পরিক সন্তুষ্টির ভিত্তিতে [নির্বাচিত] কাজী [বিচারক] [শরীয়তের দৃষ্টিতেও] কাজী হয়ে যাবে।
দারুল হরবের মুসলমানদের উপর একজন মুসলমান শাসক তালাশ করা (এবং তার মাধ্যমে নিজেদের মুআমালা সমূহের বিচার ফায়সালা করানো) ওয়াজিব।”
‘রদ্দুল মুহতার’(৪/১৭৫) এ আরো বলা হয়েছে-
قلت: وبهذا ظهر أن ما في الشام من جبل تيم الله … وبعض البلاد التابعة كلُّها دار إسلام، لأنها وإن كانت لها حكام دروز أو نصارى، ولهم قضاة على دينهم … لكنهم تحت حكم ولاة أمورنا، وبلاد الإسلام محيطة ببلادهم من كل جانب، وإذا أراد ولي الأمر تنفيذ أحكامنا فيهم نفذها.” انتهى
“আমি বলি [অর্থাৎ আল্লামা শামী বলেন] [পূর্বোক্ত] এ [আলোচনা] থেকে বুঝে আসে যে, শামের ‘তাইমুল্লাহ্’ পাহাড় এবং এর অন্তর্গত আরো কতক শহর সবগুলোই দারুল ইসলাম।
কেননা সেগুলোর শাসক যদিও দারুয বা নাসারা এবং তাদের নিজেদের ধর্মীয় বিচারকও রয়েছে, কিন্তু তারা সকলেই আমাদের মুসলমান শাসকদের অধীনস্থ।
দারুল ইসলাম চতুর্দিক থেকে তাদের এলাকাকে বেষ্টন করে রেখেছে। মুসলমান শাসকগণ যখনই চাইবেন তাদের উপর আমাদের [শরীয়তের] আহকাম জারি করে দিতে পারবেন।”
এই দুই রিওয়ায়াত থেকে স্পষ্ট যে, কাফেররা কোন [ইসলামী শাসনাধীন] রাষ্ট্র দখল করে নেয়ার পর [তা] দারুল ইসলাম হিসেবে বাকি থাকার জন্য ইসলামী আহকাম জারি থাকার যে শর্ত, তার দ্বারা এটাই উদ্দেশ্য যে, ক্ষমতা ও দাপটের সাথে ইসলামী আহকাম জারি করা যাচ্ছে।
তদ্রূপ দারুল হারবে ইসলামী আহকাম জারি করার দ্বারা তখনই তা দারুল হরব হওয়া থেকে বের হবে যখন এই আহকাম জারি করা ক্ষমতা ও দাপটের সাথে হবে। এই নয় যে, দারুল হরবের শাসক তার নিজ অনুমতিক্রমে ইসলামী আহকাম জারি করে দেয়।
সারকথাঃ
ইমামে আজম (রহ.) এর উপরোক্ত তিন শর্ত এবং সাহেবাইন (রহ.) এর এক শর্তের দ্বারা উদ্দেশ্য একটাই। অর্থাৎ ক্ষমতা ও দাপট। যদিও তা কোন কোন দিক থেকে হয় [ সর্বদিক থেকে না হয়।]
কিন্তু ওলামায়ে ইসলামের কেউই একথা বলেন না যে- ‘কোন ব্যক্তি যদি কাফের রাষ্ট্রে কাফেরদের সুস্পষ্ট অনুমতিতে বা তাদের উদাসীনতার কারণে শাআয়েরে ইসলাম প্রকাশ্যে পালন করে তাহলে উক্ত রাষ্ট্র দারুল ইসলাম হয়ে যাবে।’
আল্লাহর পানাহ্! [কিছুতেই তারা এমন কথা বলতে পারেন না।] কেননা এধরণের খেয়াল তাফাক্কুহ্ [তথা দ্বীনের সমঝ ও বুঝ] থেকে সম্পূর্ণ দূরে।
***
(হিন্দুস্তানের হালতঃ)
যখন মূলনীতি গত দিক থেকে এই মাসআলার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলো তখন হিন্দুস্তানের হালতের ব্যাপারে নিজেই ফিকির করে দেখ [কোন দারুল ইসলাম দারুল হরব হওয়ার জন্য যেসব শর্ত উল্লেখ করা হয়েছে এখানে সেগুলো কত জোরালো ভাবেই না পাওয়া যাচ্ছে।]
[প্রথম শর্ত কীভাবে পাওয়া যাচ্ছে দেখ] এখানে নাসারা কাফেরদের বিধান কী পরিমাণ শক্তি এবং দাপটের সাথে চলছে !! যদি সাধারণ কোন কালেক্টরও হুকুম জারি করে যে, ‘মসজিদে জামাত করতে পারবেনা’ তাহলে বিশিষ্ট-সাধারণ কারোই এ সামর্থ্য নেই যে, জামাত আদায় করবে।
আর জুমআ, ঈদ এবং শরীয়তের আরো কিছু বুনিয়াদী বিষয়ের উপর আমল যা এখানে হচ্ছে তা কেবল তাদের এই আইনের কারণে যে, ‘প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিজ ধর্মের ব্যাপারে স্বাধীন। এ ব্যাপারে কারো হস্তক্ষেপ করার অধিকারনেই’।
[দ্বিতীয় শর্ত কীভাবে পাওয়া যাচ্ছে দেখ] মুসলিম শাসকগণ প্রদত্ত যে আমান এখানকার বাসিন্দাদের ছিল এখন তার কোন নাম নিশানাও নেই। কোন বিবেকবান বলতে পারবে, বাদশাহ শাহ আলম যে আমান আমাদেরকে দিয়েছিলেন আমরা সেই আমানের দ্বারা আজও নিরাপত্তার সাথে বসে আছি ?!
বরং কাফেরদের থেকে নতুন আমান নেয়া হয়েছে। নাসারাদের দেয়া এ আমানের মাধ্যমেই হিন্দুস্তানের সকল প্রজা এখানে বসবাস করছে।
আর [তৃতীয় শর্ত অর্থাৎ ‘দারুল হরবের সাথে মিলিত থাকা’এর ব্যাপারে কথা হচ্ছে] দারুল হরবের সাথে মিলিত থাকা বড় বড় এলাকার জন্য শর্ত নয়। গ্রাম, শহর এবং এমন [ছোট] এলাকার জন্য শর্ত। যার উদ্দেশ্য কেবল এতটুকু যে, ওখানে [দারুল ইসলাম থেকে] সাহায্য পৌঁছা সহজ।
যদি কেউ বলে, ‘রোম [অর্থাৎ তুরস্ক] বা কাবুলের [অর্থাৎ আফগানিস্তানের] শাসকের পক্ষ থেকে সাহায্য আসলে কাফেরদেরকে হিন্দুস্তান থেকে হটানো সম্ভব’ তাহলে আল্লাহর পানাহ্! এ ধরণের মন্তব্য কোনক্রমেই সঠিক নয়। হিন্দুস্তান থেকে তাদেরকে হটানো অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার। অনেক বড় জিহাদ এবং বিশাল যুদ্ধ সামগ্রীর প্রয়োজন।
মোট কথা হিন্দুস্তানে কাফেরদের দখলদারিত্ব এই পরিমাণ কায়েম হয়েছে যে, কোন সময় কোন দারুল হরবে কাফেরদের এর চেয়ে বেশী দখলদারিত্ব হয় না।
আর ইসালামী শাআয়ের যা এখানে মুসলমানরা পালন করছে তা কেবল তাদের [কাফেরদের] অনুমতিক্রমে হচ্ছে। নতুবা মুসলমানদের চেয়ে অসহায় নাগরিক কেউ নেই। হুকুমতে হিন্দুদেরও তো কিছুটা প্রভাব আছে, কিন্তু মুসলমানদের তাও নেই।
তবে হ্যাঁ, টুংক, রামপুর, ভূপাল এবং অন্যান্য রাজ্য যেখানকার শাসকরা কাফেরদের দ্বারা পরাজিত হওয়া সত্বেও নিজেদের বিধি-বিধান [অর্থাৎ ইসলামী বিধি-বিধান] জারি রাখতে পারছেন সেগুলোকে দারুল ইসলাম বলা যেতে পারে। যেমনটা ‘দুররে মুখতার’ ও অন্যান্য কিতাবের রিওয়ায়াত থেকে বুঝা যাচ্ছে। فقط والله سبحانه و تعالى أعلم.
বান্দা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী।
[রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী (রহ.) এর ফতোয়া এখানে শেষ হয়েছে।]
[ফতোয়ার অনুবাদ শেষ করার পর মুফতী শফী (রহ.) বলেন] আল্লাহ তাআলার প্রশংসা যে, তাঁর ইহসানে ‘দারুল হরব’ রিসালাটির উর্দু তরজমা সম্পন্ন হলো। আল্লাহ তাআলা মূল ফতোয়ার সাথে একেও [অর্থাৎ উর্দু তরজমাকেও] মাকবূল এবং নাফে’ [অর্থাৎ উপকারী] বানান। আমীন!
والحمد لله الذي بعزته و جلاله تتم الصالحات.
বান্দা মুহাম্মদ শফী দেউবন্দী
আফাল্লাহু আনহু [আল্লাহ্ তাকে মাফ করুন]
বর্তমান মুসলিম রাষ্ট্রগুলো দারুল হরব কেন?
রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী (রহ.) যে অবস্থার প্রেক্ষিতে ইংরেজদের দখলে থাকা তৎকালীন হিন্দুস্তান তথা বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান সহ গোটা ভারতীয় উপমহাদেশকে দারুল হরব ফতোয়া দিয়েছিলেন, আজ মুসলিম নামধারী মুরতাদ শাসকদের দখলে থাকা মুসলিম রাষ্ট্র সমূহে হুবহু ঐ অবস্থা বরং তার চেয়ে আরোও নাজুক অবস্থা বিদ্যমান। অতএব, তৎকালীন হিন্দুস্তানের মতো বর্তমানে মুরতাদদের দখলে থাকা মুসলিম রাষ্ট্রসমূহও দারুল হরব।
রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী (রহ.) এর উক্ত ফতোয়াটি যদি বর্তমান মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের উপর প্রয়োগ করি তাহলে কোন বেশ কম ছাড়াই হুবহু তা এসব রাষ্ট্রের উপর ফিট হয়ে যাবে।
আসুন দেখি এসব মুসলিম রাষ্ট্রে ফতোয়াটি কিভাবে আরোপিত হয়-
“বর্তমান মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর হালতঃ
যখন মূলনীতি গত দিক থেকে এই মাসআলার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলো তখন বর্তমান মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর হালতের ব্যাপারে নিজেই ফিকির করে দেখ [কোন দারুল ইসলাম দারুল হরব হওয়ার জন্য যেসব শর্ত উল্লেখ করা হয়েছে এখানে সেগুলো কত জোরালো ভাবেই না পাওয়া যাচ্ছে।]
[প্রথম শর্ত কীভাবে পাওয়া যাচ্ছে দেখুন] এখানে মুরতাদ কাফেরদের বিধান কী পরিমাণ শক্তি এবং দাপটের সাথে চলছে !!
যদি সরকারী দলের সাধারণ কোন নেতাও হুকুম জারি করে যে, ‘মসজিদে জামাত করতে পারবেনা’ তাহলে বিশিষ্ট-সাধারণ কারোই এ সামর্থ্য নেই যে, জামাত আদায় করবে।
আর জুমআ, ঈদ এবং শরীয়তের আরো কিছু বুনিয়াদী বিষয়ের উপর আমল যা এখানে হচ্ছে তা কেবল তাদের এই আইনের কারণে যে, ‘প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিজ ধর্মের ব্যাপারে স্বাধীন। এ ব্যাপারে কারো হস্তক্ষেপ করার অধিকারনেই’।
[দ্বিতীয় শর্ত কীভাবে পাওয়া যাচ্ছে দেখুন] মুসলিম শাসকগণ প্রদত্ত যে আমান এখানকার বাসিন্দাদের ছিল এখন তার কোন নাম নিশানাও নেই।
কোন বিবেকবান বলতে পারবে, উসমানী খলীফাগণ কিংবা অন্যান্য মুসলিম শাসকগণ যে আমান আমাদেরকে দিয়েছিলেন আমরা সেই আমানের দ্বারা আজও নিরাপত্তার সাথে বসে আছি ?!
বরং মুরতাদদের থেকে নতুন আমান নেয়া হয়েছে। মুরতাদদের দেয়া এ আমানের মাধ্যমেই বর্তমান মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সকল নাগরিক সেগুলোতে বসবাস করছে।
আর [তৃতীয় শর্ত অর্থাৎ ‘দারুল হরবের সাথে মিলিত থাকা’এর ব্যাপারে কথা হচ্ছে] দারুল হরবের সাথে মিলিত থাকা বড় বড় এলাকার জন্য শর্ত নয়। গ্রাম, শহর এবং এমন [ছোট] এলাকার জন্য শর্ত। যার উদ্দেশ্য কেবল এতটুকু যে, ওখানে [দারুল ইসলাম থেকে] সাহায্য পৌঁছা সহজ।
যদি কেউ বলে, মোল্লা উমর এবং শায়খ উসামার পক্ষ থেকে সাহায্য আসলে মুরতাদদেরকে মুসলিম রাষ্ট্রগুলো থেকে হটানো সম্ভব’ তাহলে আল্লাহর পানাহ্! এ ধরণের মন্তব্য কোনক্রমেই সঠিক নয়। মুসলিম রাষ্ট্রগুলো থেকে তাদেরকে হটানো অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার। অনেক বড় জিহাদ এবং বিশাল যুদ্ধ সামগ্রীর প্রয়োজন।
মোট কথা বর্তমান মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে মুরতাদদের দখলদারিত্ব এই পরিমাণ কায়েম হয়েছে যে, কোন সময় কোন দারুল হরবে কাফেরদের এর চেয়ে বেশী দখলদারিত্ব হয় না।
আর ইসালামী শাআয়ের যা এখানে মুসলমানরা পালন করছে তা কেবল তাদের [মুরতাদদের] অনুমতিক্রমে হচ্ছে। নতুবা মুসলমানদের চেয়ে অসহায় নাগরিক কেউ নেই। হুকুমতে শিয়া, হিন্দু, নাস্তিক ও অন্যান্য কাফেরদের তো অনেক প্রভাব আছে, কিন্তু মুসলমানদের কিছুই নেই।
তবে হ্যাঁ, আফগান, সোমালিয়া, ইয়ামান, শাম, ইরাক ও অন্যান্য ভূখন্ডের যেসব অংশ কাফেরদের থেকে উদ্ধার করে ইসলামী বিধি-বিধান জারি রাখা যাচ্ছে সেগুলোকে দারুল ইসলাম বলা যেতে পারে। যেমনটা ‘দুররে মুখতার’ ও অন্যান্য কিতাবের রিওয়ায়াত থেকে বুঝা যাচ্ছে। فقط والله سبحانه و تعالى أعلم.”
[উল্লেখ্য যে, মোল্লা উমর (রহ.) এবং শায়খ উসামা (রহ.) এর ওফাত হয়ে গেছে। এখানে শুধু বুঝানোর উদ্দেশ্যে উল্লেখ করা হয়েছে।]
আপনারা ভাল করে লক্ষ্য করে দেখুন গাঙ্গুহী (রহ.) এর ফতোয়াটি বর্তমান মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর উপর হুবহু আরোপিত হয় কি না ?
শুধু যে আরোপিত হয় তা-ই না, বরং বর্তমান মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর হালত তৎকালীন উপমহাদেশের চেয়ে আরো খারাপ।
তৎকালীন উপমহাদেশে তো কাফেররা দখল করে নেয়ার পরও এমন কিছু রাজ্য ছিল যেখানে শরয়ী শাসন জারি ছিল। তাছাড়া দুর্বল হলেও উসমানী খেলাফত তখনও কায়েম ছিল।
কিন্তু পরবর্তীতে কাফের ও মুরতাদরা মিলে মুসলিম রাষ্ট্র গুলোকে ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয়ার পর কোথাও ইসলামী শাসন জারি ছিল না। আফগানিস্তানে যাও কিছু ছিল পরপর আমেরিকা তাও শেষ করে দেয়।
আর বর্তমানে যে কয়টা ভূখন্ড মুজাহিদদের দখলে আছে তা কাফের ও মুরতাদদের বিরোদ্ধে দীর্ঘ দিনের যুদ্ধ এবং সমূদ্রসম রক্ত ঝরানোর ফসল। এছাড়া আর কোথাও ইসলামী শাসন কায়েম নেই। সর্বত্রই কুফরী শাসন চলছে।
বরং মুরতাদরা ইসলামকে মিটিয়ে দেয়ার জন্য আন্তর্জাতিক কুফরী শক্তির সাথে জোট গঠন করেছে। এক্ষেত্রে কাফের মুরতাদরা তাদের সবটুকু সামর্থ্য ব্যয় করছে। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, পুঁজিবাদ, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, নাস্তিকতা অকল্পনীয় বেগে মুসলিম প্রজন্মকে কুফর, ইরতিদাদ ও ইলহাদের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
হয়তো অদূর ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতি দাঁড়াবে যে, মুসলিম দাবিদারদের অর্ধেক বা অধিকাংশই শরীয়তের দৃষ্টিতে ইসলামের গন্ডি থেকে বেরিয়ে গিয়ে মুরতাদ হয়ে পড়েছে। নাউযুবিল্লাহি মিন যালিক!
এমন ভয়াবহ কুফর এবং কুফরী শাসন বিরাজমান থাকা সত্বেও এসব রাষ্ট্রকে দারুল ইসলাম তথা ইসলামী রাষ্ট্র মনে করা শরীয়ত এবং বিবেকবুদ্ধির সম্পূর্ণ পরিপন্থি।
আল্লাহ্ তাআলা আমাদেরকে সহীহ বুঝ দান করুন এবং সীরাতে মুসতাকীমের উপর কায়েম রাখুন। আমীন!
وصلى الله تعالى على خير خلقه محمد و على آله و أصحابه أجمعين
বান্দা আব্দুল ওয়াহহাব।
[1] [সম্ভবত ‘দুররে মুখতার’ না হয়ে ‘রদ্দুল মুহতার’ হবে । কেননা নিম্নোক্ত ইবারত ‘রদ্দুল মুহতার’(৪/১৬০) এ পেয়েছি, ‘দুররে মুখতার’ এ পাইনি।] –
[2] উল্লেখ্য যে, ইসতিহসান বলা হয়ঃ যে মাসআলাতে একাধিক কিয়াসের সম্ভাবনা আছে সেখানে তুলনামূলক অধিক শক্তিশালী দলীলের ভিত্তিতে একটা কিয়াসকে তারজীহ তথা প্রাধান্য দেয়া।
Comment