বর্তমান জিহাদ নিয়ে এমন কিছু সংশয় আছে যেগুলো অনেকের মনেই ঘুরপাক খায়। এমনকি যারা জিহাদের কাজে জড়িত আছেন, তাদেরও অনেকের। অনেকে হয়তো কারো কাছে জিজ্ঞেস করেন, অনেকে করেন না। অনেকে করলেও সঠিক উত্তর পান না। আবার অনেকে হয়তো ভাবেন, আমরা হক্বের উপর আছি; অতকিছু বুঝার দরকার নেই!! যাহোক, এমন কয়েকটি সংশয়ের নিরসনের জন্যই এ লেখা। আল্লাহ তাআলার কাছে প্রার্থনা, তিনি যেন যথাযথ পেশ করার তাওফিক দান করেন। আমীন।
সংশয়-১: জিহাদ বলা হয় কাফেরদের সাথে যুদ্ধ করাকে; যেমনট ফুকাহায়ে কেরাম বলেছেন যে, কাফের আক্রমণ করলে যুদ্ধে বেড়িয়ে পড়া ফরয। আমরা বর্তমানে যা করছি- যেমন, দাওয়াত, তাসনিফ, মিডিয়া, অর্থ সংগ্রহ বা কিছু সামরিক ই’দাদ- এগুলো কি জিহাদ? এসবের দ্বারা কি জিহাদের ফরয দায়িত্ব আদায় হবে? এগুলোর দ্বারা কি জিহাদের সওয়াব পাওয়া যাবে?
সংশয়-২: ফুকাহায়ে কেরাম বলেছেন, কোন মুসলিম ভূখণ্ড আক্রান্ত হলে শত্রু প্রতিহত করার জন্য যুদ্ধে বেরিয়ে পড়া ফরয। কিন্তু কাফেররা কোন ভূখণ্ড দখল করে নিলে তা পুনঃরুদ্ধার করা ফরয- এমন কথা কি কেউ বলেছেন? কাজেই, ভারতে যখন ইংরেজরা আক্রমণ করেছিল তখন প্রতিহত করার জন্য জিহাদ ফরয ছিল। কিন্তু যখন তারা দখল করে নিয়ে গেছে তখন থেকে আর জিহাদ ফরয নয়। অন্যান্য ভূখণ্ডের বেলায়ও একই কথা।
সংশয়-৩: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সরাসরি ময়দানে নেমে কাফেরদের সাথে জিহাদ করেছেন। সাহাবায়ে কেরামও এমনই করেছেন। আমাদের আকাবিরগণও এমনই করেছেন। আমরা বর্তমানে যে লুকিয়ে লুকিয়ে – গেরিলা – জিহাদ করি, এটা কি জায়েয? ইসলাম তো যা করে প্রকাশ্যে করে। এভাবে লুকিয়ে কেন? এটা কি জিহাদ?
সংশয়-৪: ফুকাহায়ে কেরম লিখেছেন, যুদ্ধে যাওয়ার সামর্থ্য যাদের নেই, তাদের উপর জিহাদ ফরয নয়। বর্তমানে যেহেতু জালেম সরকার বা কাফেরদের বাধার কারণে আমরা জিহাদের ময়দানে যেতে সক্ষম নই, তাই আমাদের উপর জিহাদ ফরয নয়। তদ্রূপ শাম-ইরাকের মতো দূর ময়দানে যাওয়ার মতো আর্থিক সামর্থ্যও সকলের নেই। তাই তাদের উপর জিহাদ ফরয নয়।
জিহাদকে শুধু কিতালে সীমাবদ্ধ মনে করার অন্যতম একটা কারণ হতে পারে আমাদের ফিকহের কিতাবাদি। সাধারণ দৃষ্টিতে ফিকহের কিতাবাদি পড়লে মনে হবে, জিহাদ মানেই কিতাল। যেন কিতাল ছাড়া অন্য কিছু জিহাদ নয়। অবশ্য গভীর ও তাহকিকি দৃষ্টিতে পড়লে এমনটা মনে হওয়ার কথা না।
সালাফের যামানার জিহাদের সাথে আমাদের যামানার জিহাদের বেশ ব্যবধান আছে। সালাফের যামানায় ইসলামী বিশ্বের সবখানে ইসলামী শাসন ছিল। ইসলামী সীমানার অভ্যন্তরে কোথাও কোন কাফের আমান-নিরাপত্তা নেয়া ছাড়া প্রবেশ করারও সাহস পেত না। সালাফের যামানায় সাধারণত ইকদামি তথা আক্রমণাত্মক জিহাদ হতো। কাফেরদের ভূমিতে গিয়ে তাদেরকে ইসলাম বা জিযিয়া কবুলের দাওয়াত দেয়া হত। গ্রহণ না করলে কিতাল করা হতো। এটাই ছিল জিহাদ। কোন কাফের রাষ্ট্র সাধারণত ইসলামী ভূমির কোথাও হামলা করার সাহস পেত না। একান্ত যদি কোথাও করতোও, তাহলে করতে হতো সীমান্ত দিয়ে। তখনকার বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি ইসলামী শাসনের অধীনে ছিল। গোটা ইসলামী বিশ্বের উপর একসাথে হামলা করা তো কাফেরদের কল্পনাতেও আসতো না। বেশির চেয়ে বেশি দুর্বলতা বা উদাসীনতার সুযোগে সীমান্তের কোন অংশে হামলা করতে পারতো। তখনকার যুগে বিমান ছিল না। উপর দিয়ে মাঝখানে কোথাও হামলার সুযোগ ছিল না। হামলা করলে কোন সীমান্ত দিয়েই করতে হতো। আর এ হামলা প্রতিহত করতে হলে সীমান্তে গিয়েই করতে হতো। এ কারণে সাধারণত ফিকহের কিতাবাদিতে লিখা হয়েছে, কাফেররা মুসলিমদের কোন ভূখণ্ডে বা সীমান্তে হামলা করলে উক্ত হামলা প্রতিহত করতে পারে পরিমাণ মুসলমান যুদ্ধে বের হয়ে পড়া ফরয। যেহেতু হামলা সীমান্ত দিয়েই হতো আর প্রতিহত করতে হলে সীমান্তেই যেতে হতো এবং তা যুদ্ধের মাধ্যমেই করতে হতো, এ কারণে তখন জিহাদ বলতে অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ বের হয়ে পড়াকেই বুঝাতো।
স্পষ্ট যে, অর্ধ পৃথিবীব্যাপী এই ইসলামী বিশ্বের এক কোণে হামলা হলে দূরের মুসলমানদের এ ব্যাপারে কোন খবরই থাকতো না। তখনকার যুগে আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না। মূহুর্তের খবর মূহুর্তে পৌঁছানো যেত না। এ কারণে ফুকাহায়ে কেরাম লিখেছেন, জিহাদ ফরয হওয়ার জন্য ইলম তথা জানা শর্ত যে, অমুক অংশে হামলা হয়েছে এবং সেখানকার মুসলমানরা তা প্রতিহত করতে পারছে না। যাদের কাছে খবর পৌঁছবে না, তাদের উপর জিহাদ ফরয নয়। আর এটা তো সঙ্গত কথাই যে, যাদের জানাই নেই যে, হামলা হয়েছে, তাদের উপর জিহাদ আমরা কিভাবে ফরয বলতে পারি?!
দ্বিতীয়ত, শত মাইল পাড়ি দিয়ে সীমান্তে পৌঁছে যুদ্ধ করার মতো সামর্থ্য সকলের থাকতো না। এ কারণে ফুকাহায়ে কেরাম লিখেছেন, রাহ খরচ ও যুদ্ধের ব্যয়ভার বহনের সামর্থ্য যাদের নেই, তাদের উপর জিহাদ ফরয নয়। যেমনটা কুরআনে কারীমেও বলা হয়েছে। আর এটা তো যৌক্তিক কথাই যে, এত শত মাইল পাড়ি দেয়ার এবং সীমান্তে পৌঁছে নিজের যুদ্ধের ব্যয়ভার বহনের সামর্থ্য যাদের নেই, তাদের উপর আমরা জিহাদ ফরয বলতে পারি না। এ কারণে যারা জিহাদে যাওয়ার সামর্থ্য রাখতো না, তারা মুজাহিদদের পরিবার দেখাশুনা করতো। সামর্থ্যবানদের উদ্বুদ্ধ করতো। শারীরিকভাবে অক্ষম যারা, তারা সম্পদ থাকলে অন্যকে ঘোড়া, অস্ত্র, অর্থ ও সামানা-পত্র দিয়ে সহায়তা করতো। তাদের জন্য জিহাদে শরীক হওয়ার এটাই ছিল পথ।
সালাফের যমানায় এটা অসম্ভব ছিল যে, কাফেররা মুসলমানদের কোন ভূমি দখল করে রাজত্ব করবে। মুসলমানদের যেখানে বিশ্বজয়ের জয়গান, সেখানে মুসলমানদের ভূমি দখলে নেবে কাফেররা- এটা তো প্রায় অসম্ভব ছিল। বেশির চেয়ে বেশি দুর্বলতার সুযোগে হামলা করতে পারতো। ততক্ষণেই মুসলমানরা এদের প্রতিহত করতে বেড়িয়ে পড়বে। এখনকার মতো নির্লজ্জ হয়ে বসে থাকার মেজাজ ছিল না। কাফেররা দখলদারিত্ব বসাবার আগেই আযাদ হয়ে যাবে। এ কারণে ফিকহের কিতাবাদিতে সাধারণত এ কথা লিখেছে যে, কোন ভূখণ্ড আক্রান্ত হলে জিহাদ ফরযে আইন। এ কথা সাধারণত স্পষ্ট পাওয়া যায় না যে, কোন ভূখণ্ড কাফেররা দখল করে নিয়ে গেলে তা পুনরুদ্ধার ফরয। অধিকন্তু মুসলমানদের শান নয় যে, কোন কাফেরকে নিজেদের ভূমিতে দখলদারিত্ব কায়েম করতে দেবে আর তারা নাকে তেল দিয়ে ঘুমাবে। আক্রমণ হতেই দেবে না। কখনোও হয়ে গেলে সাথে সাথে প্রতিহত করবে। ব্যস এ পর্যন্তই। এ কারণে ফিকহের কিতাবাদিতে দখলকৃত ভূমি পুনরুদ্ধার করা ফরয- এ কথাটা সাধারণত স্পষ্ট পাওয়া যায় না। তাছাড়া যেহেতু আক্রমণ হলেই জিহাদ ফরয, তখন দখল করে নিয়ে গেলে যে পুনরুদ্ধার করা ফরয হবে- এটা সহজেই অনুমেয়। সামান্য বুঝসম্পন্ন ব্যক্তিই এটি বুঝতে পারবে। এ কারণে আর স্পষ্ট করে বলার দরকার পড়ে না। কিন্তু এ থেকেও কেউ কেউ ধোঁকায় পড়েছে যে, আক্রমণ হলে প্রতিহত করা ফরয, কিন্তু দখল করে নিয়ে গেলে পুনরুদ্ধার ফরয না। আসলে এটা তাদের বুঝের কমতি। যেখানে কাফেরকে কাফেরের রাষ্ট্রে রাজত্ব করতে দেয়াও জায়েয নয়, আক্রমণাত্মক জিহাদ করে তার শক্তি চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ইসলাম গ্রহণে বা জিযিয়া প্রদানে বাধ্য করা অত্যাবশ্যক- সেখানে মুসলিম ভূমিতে কিভাবে রাজত্ব করতে দেয়া জায়েয হবে? কিভাবে কোন মুসলিম ভূমি কাফেরের হাতে থাকতে দেয়া জায়েয হবে? বিষয়টি একেবারেই স্পষ্ট। এরপরও যারা বুঝে না, তাদের আসলে বুঝ নেই। আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন।
যাহোক, সালাফের যামানায় আক্রমণ হতো সীমান্ত দিয়ে। আক্রমণ প্রতিহত করতে সীমান্তে যেতে হতো। এ কারণে তখন জিহাদ (তথা সীমান্তে গিয়ে শত্রু প্রতিহত করা) ফরয হওয়ার জন্য কয়েকটা বিষয়ের জরুরত পড়তো-
ক. আক্রমণের সংবাদ পৌঁছা।
খ. সীমান্তে গিয়ে কিতাল করার মতো পর্যাপ্ত শারীরিক শক্তি ও সক্ষমতা থাকা।
গ. রাহ খরচ ও যুদ্ধের ব্যয়ভার বহনের সক্ষমতা থাকা।
পর্যাপ্ত শারীরিক ও আর্থিক সামর্থ্য না থাকলে জিহাদ ফরয বলা যেতো না। উভয় প্রকার সামর্থ্য থাকার পর জিহাদ যেটা হতো সেটা হল- সীমান্তে গিয়ে কিতাল। অধিকন্তু কাফেরদের দমনের কাজটা মূলত কিতালের মাধ্যমেই হয়। অন্য সব কিছু কিতালের প্রস্তুতি বা কিতালের সংশ্লিষ্ট বিষয়। এসব কারণে, জিহাদ বলতে সাধারণত কিতাল বুঝায়। ফুকাহায়ে কেরাম জিহাদ বলতে সাধারণত কিতালই বুঝিয়ে থাকেন। ‘আর জিহাদ ফরয নয়’ দ্বারা ‘কিতাল ও যুদ্ধ করা ফরয নয়’ উদ্দেশ্য নিয়ে থাকেন। এটা উদ্দেশ্য নয় যে- কিতাল ছাড়া আর কিছু জিহাদ নয়, কিংবা শারীরিক বা আর্থিক সামর্থ্য না থাকার কারণে যাদের উপর কিতালে বের হওয়া ফরয নয়, তাদের আর কোন দায়িত্ব নেই। এমনটা বুঝা ভুল। বরং বাস্তব হল:
- জিহাদ শুধু কিতালে সীমাবদ্ধ নয়। কিতালের প্রস্তুতিমূলক ও কিতালের সাথে সম্পৃক্ত প্রয়োজনীয় অন্যান্য কাজও জিহাদ।
- শক্তি সামর্থ্য না থাকার কারণে যাদের উপর কিতাল ও যুদ্ধ ফরয নয়, তাদেরও আরো অনেক দায়িত্ব রয়েছে। সেগুলো যথাযথ আদায় করলে তারাও জিহাদের সওয়াব পাবে। আদায় না করলে গুনাহগার হবে।
এ হল সংক্ষেপ কথা। সামনের পর্ব থেকে ইনশাআল্লাহ দলীলভিত্তিক আলোচনায় যাব।
সংশয়-১: জিহাদ বলা হয় কাফেরদের সাথে যুদ্ধ করাকে; যেমনট ফুকাহায়ে কেরাম বলেছেন যে, কাফের আক্রমণ করলে যুদ্ধে বেড়িয়ে পড়া ফরয। আমরা বর্তমানে যা করছি- যেমন, দাওয়াত, তাসনিফ, মিডিয়া, অর্থ সংগ্রহ বা কিছু সামরিক ই’দাদ- এগুলো কি জিহাদ? এসবের দ্বারা কি জিহাদের ফরয দায়িত্ব আদায় হবে? এগুলোর দ্বারা কি জিহাদের সওয়াব পাওয়া যাবে?
সংশয়-২: ফুকাহায়ে কেরাম বলেছেন, কোন মুসলিম ভূখণ্ড আক্রান্ত হলে শত্রু প্রতিহত করার জন্য যুদ্ধে বেরিয়ে পড়া ফরয। কিন্তু কাফেররা কোন ভূখণ্ড দখল করে নিলে তা পুনঃরুদ্ধার করা ফরয- এমন কথা কি কেউ বলেছেন? কাজেই, ভারতে যখন ইংরেজরা আক্রমণ করেছিল তখন প্রতিহত করার জন্য জিহাদ ফরয ছিল। কিন্তু যখন তারা দখল করে নিয়ে গেছে তখন থেকে আর জিহাদ ফরয নয়। অন্যান্য ভূখণ্ডের বেলায়ও একই কথা।
সংশয়-৩: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সরাসরি ময়দানে নেমে কাফেরদের সাথে জিহাদ করেছেন। সাহাবায়ে কেরামও এমনই করেছেন। আমাদের আকাবিরগণও এমনই করেছেন। আমরা বর্তমানে যে লুকিয়ে লুকিয়ে – গেরিলা – জিহাদ করি, এটা কি জায়েয? ইসলাম তো যা করে প্রকাশ্যে করে। এভাবে লুকিয়ে কেন? এটা কি জিহাদ?
সংশয়-৪: ফুকাহায়ে কেরম লিখেছেন, যুদ্ধে যাওয়ার সামর্থ্য যাদের নেই, তাদের উপর জিহাদ ফরয নয়। বর্তমানে যেহেতু জালেম সরকার বা কাফেরদের বাধার কারণে আমরা জিহাদের ময়দানে যেতে সক্ষম নই, তাই আমাদের উপর জিহাদ ফরয নয়। তদ্রূপ শাম-ইরাকের মতো দূর ময়দানে যাওয়ার মতো আর্থিক সামর্থ্যও সকলের নেই। তাই তাদের উপর জিহাদ ফরয নয়।
***
নিরসন
بسم الله الرحمن الرحيم
وصلى الله تعالى على خير خلقه محمد وآله وصحبه أجمعين. أما بعد
জিহাদ বললে সাধারণত যুদ্ধ-কিতাল বুঝে আসে। তবে এমনটা মনে করা সঙ্গত নয় যে, জিহাদ শুধু যুদ্ধেরই নাম; যুদ্ধ ছাড়া অন্য কিছু জিহাদ নয়। আসলে কুফরি শক্তি পরাস্ত করে ইসলামী খেলাফত কায়েমের জন্য কিতালসহ সংশ্লিষ্ট আরো যা কিছু আঞ্জাম দিতে হবে, সবগুলোই জিহাদ। জিহাদ শুধু কিতালে সীমাবদ্ধ নয়। জিহাদের সওয়াবও শুধু কিতালে সীমাবদ্ধ নয়। হ্যাঁ, কিতাল জিহাদের সর্বোচ্চ স্তর। তবে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কাজও জিহাদ। وصلى الله تعالى على خير خلقه محمد وآله وصحبه أجمعين. أما بعد
জিহাদকে শুধু কিতালে সীমাবদ্ধ মনে করার অন্যতম একটা কারণ হতে পারে আমাদের ফিকহের কিতাবাদি। সাধারণ দৃষ্টিতে ফিকহের কিতাবাদি পড়লে মনে হবে, জিহাদ মানেই কিতাল। যেন কিতাল ছাড়া অন্য কিছু জিহাদ নয়। অবশ্য গভীর ও তাহকিকি দৃষ্টিতে পড়লে এমনটা মনে হওয়ার কথা না।
***
সালাফের যামানার জিহাদের সাথে আমাদের যামানার জিহাদের বেশ ব্যবধান আছে। সালাফের যামানায় ইসলামী বিশ্বের সবখানে ইসলামী শাসন ছিল। ইসলামী সীমানার অভ্যন্তরে কোথাও কোন কাফের আমান-নিরাপত্তা নেয়া ছাড়া প্রবেশ করারও সাহস পেত না। সালাফের যামানায় সাধারণত ইকদামি তথা আক্রমণাত্মক জিহাদ হতো। কাফেরদের ভূমিতে গিয়ে তাদেরকে ইসলাম বা জিযিয়া কবুলের দাওয়াত দেয়া হত। গ্রহণ না করলে কিতাল করা হতো। এটাই ছিল জিহাদ। কোন কাফের রাষ্ট্র সাধারণত ইসলামী ভূমির কোথাও হামলা করার সাহস পেত না। একান্ত যদি কোথাও করতোও, তাহলে করতে হতো সীমান্ত দিয়ে। তখনকার বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি ইসলামী শাসনের অধীনে ছিল। গোটা ইসলামী বিশ্বের উপর একসাথে হামলা করা তো কাফেরদের কল্পনাতেও আসতো না। বেশির চেয়ে বেশি দুর্বলতা বা উদাসীনতার সুযোগে সীমান্তের কোন অংশে হামলা করতে পারতো। তখনকার যুগে বিমান ছিল না। উপর দিয়ে মাঝখানে কোথাও হামলার সুযোগ ছিল না। হামলা করলে কোন সীমান্ত দিয়েই করতে হতো। আর এ হামলা প্রতিহত করতে হলে সীমান্তে গিয়েই করতে হতো। এ কারণে সাধারণত ফিকহের কিতাবাদিতে লিখা হয়েছে, কাফেররা মুসলিমদের কোন ভূখণ্ডে বা সীমান্তে হামলা করলে উক্ত হামলা প্রতিহত করতে পারে পরিমাণ মুসলমান যুদ্ধে বের হয়ে পড়া ফরয। যেহেতু হামলা সীমান্ত দিয়েই হতো আর প্রতিহত করতে হলে সীমান্তেই যেতে হতো এবং তা যুদ্ধের মাধ্যমেই করতে হতো, এ কারণে তখন জিহাদ বলতে অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ বের হয়ে পড়াকেই বুঝাতো।
স্পষ্ট যে, অর্ধ পৃথিবীব্যাপী এই ইসলামী বিশ্বের এক কোণে হামলা হলে দূরের মুসলমানদের এ ব্যাপারে কোন খবরই থাকতো না। তখনকার যুগে আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না। মূহুর্তের খবর মূহুর্তে পৌঁছানো যেত না। এ কারণে ফুকাহায়ে কেরাম লিখেছেন, জিহাদ ফরয হওয়ার জন্য ইলম তথা জানা শর্ত যে, অমুক অংশে হামলা হয়েছে এবং সেখানকার মুসলমানরা তা প্রতিহত করতে পারছে না। যাদের কাছে খবর পৌঁছবে না, তাদের উপর জিহাদ ফরয নয়। আর এটা তো সঙ্গত কথাই যে, যাদের জানাই নেই যে, হামলা হয়েছে, তাদের উপর জিহাদ আমরা কিভাবে ফরয বলতে পারি?!
দ্বিতীয়ত, শত মাইল পাড়ি দিয়ে সীমান্তে পৌঁছে যুদ্ধ করার মতো সামর্থ্য সকলের থাকতো না। এ কারণে ফুকাহায়ে কেরাম লিখেছেন, রাহ খরচ ও যুদ্ধের ব্যয়ভার বহনের সামর্থ্য যাদের নেই, তাদের উপর জিহাদ ফরয নয়। যেমনটা কুরআনে কারীমেও বলা হয়েছে। আর এটা তো যৌক্তিক কথাই যে, এত শত মাইল পাড়ি দেয়ার এবং সীমান্তে পৌঁছে নিজের যুদ্ধের ব্যয়ভার বহনের সামর্থ্য যাদের নেই, তাদের উপর আমরা জিহাদ ফরয বলতে পারি না। এ কারণে যারা জিহাদে যাওয়ার সামর্থ্য রাখতো না, তারা মুজাহিদদের পরিবার দেখাশুনা করতো। সামর্থ্যবানদের উদ্বুদ্ধ করতো। শারীরিকভাবে অক্ষম যারা, তারা সম্পদ থাকলে অন্যকে ঘোড়া, অস্ত্র, অর্থ ও সামানা-পত্র দিয়ে সহায়তা করতো। তাদের জন্য জিহাদে শরীক হওয়ার এটাই ছিল পথ।
***
সালাফের যমানায় এটা অসম্ভব ছিল যে, কাফেররা মুসলমানদের কোন ভূমি দখল করে রাজত্ব করবে। মুসলমানদের যেখানে বিশ্বজয়ের জয়গান, সেখানে মুসলমানদের ভূমি দখলে নেবে কাফেররা- এটা তো প্রায় অসম্ভব ছিল। বেশির চেয়ে বেশি দুর্বলতার সুযোগে হামলা করতে পারতো। ততক্ষণেই মুসলমানরা এদের প্রতিহত করতে বেড়িয়ে পড়বে। এখনকার মতো নির্লজ্জ হয়ে বসে থাকার মেজাজ ছিল না। কাফেররা দখলদারিত্ব বসাবার আগেই আযাদ হয়ে যাবে। এ কারণে ফিকহের কিতাবাদিতে সাধারণত এ কথা লিখেছে যে, কোন ভূখণ্ড আক্রান্ত হলে জিহাদ ফরযে আইন। এ কথা সাধারণত স্পষ্ট পাওয়া যায় না যে, কোন ভূখণ্ড কাফেররা দখল করে নিয়ে গেলে তা পুনরুদ্ধার ফরয। অধিকন্তু মুসলমানদের শান নয় যে, কোন কাফেরকে নিজেদের ভূমিতে দখলদারিত্ব কায়েম করতে দেবে আর তারা নাকে তেল দিয়ে ঘুমাবে। আক্রমণ হতেই দেবে না। কখনোও হয়ে গেলে সাথে সাথে প্রতিহত করবে। ব্যস এ পর্যন্তই। এ কারণে ফিকহের কিতাবাদিতে দখলকৃত ভূমি পুনরুদ্ধার করা ফরয- এ কথাটা সাধারণত স্পষ্ট পাওয়া যায় না। তাছাড়া যেহেতু আক্রমণ হলেই জিহাদ ফরয, তখন দখল করে নিয়ে গেলে যে পুনরুদ্ধার করা ফরয হবে- এটা সহজেই অনুমেয়। সামান্য বুঝসম্পন্ন ব্যক্তিই এটি বুঝতে পারবে। এ কারণে আর স্পষ্ট করে বলার দরকার পড়ে না। কিন্তু এ থেকেও কেউ কেউ ধোঁকায় পড়েছে যে, আক্রমণ হলে প্রতিহত করা ফরয, কিন্তু দখল করে নিয়ে গেলে পুনরুদ্ধার ফরয না। আসলে এটা তাদের বুঝের কমতি। যেখানে কাফেরকে কাফেরের রাষ্ট্রে রাজত্ব করতে দেয়াও জায়েয নয়, আক্রমণাত্মক জিহাদ করে তার শক্তি চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ইসলাম গ্রহণে বা জিযিয়া প্রদানে বাধ্য করা অত্যাবশ্যক- সেখানে মুসলিম ভূমিতে কিভাবে রাজত্ব করতে দেয়া জায়েয হবে? কিভাবে কোন মুসলিম ভূমি কাফেরের হাতে থাকতে দেয়া জায়েয হবে? বিষয়টি একেবারেই স্পষ্ট। এরপরও যারা বুঝে না, তাদের আসলে বুঝ নেই। আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন।
***
যাহোক, সালাফের যামানায় আক্রমণ হতো সীমান্ত দিয়ে। আক্রমণ প্রতিহত করতে সীমান্তে যেতে হতো। এ কারণে তখন জিহাদ (তথা সীমান্তে গিয়ে শত্রু প্রতিহত করা) ফরয হওয়ার জন্য কয়েকটা বিষয়ের জরুরত পড়তো-
ক. আক্রমণের সংবাদ পৌঁছা।
খ. সীমান্তে গিয়ে কিতাল করার মতো পর্যাপ্ত শারীরিক শক্তি ও সক্ষমতা থাকা।
গ. রাহ খরচ ও যুদ্ধের ব্যয়ভার বহনের সক্ষমতা থাকা।
পর্যাপ্ত শারীরিক ও আর্থিক সামর্থ্য না থাকলে জিহাদ ফরয বলা যেতো না। উভয় প্রকার সামর্থ্য থাকার পর জিহাদ যেটা হতো সেটা হল- সীমান্তে গিয়ে কিতাল। অধিকন্তু কাফেরদের দমনের কাজটা মূলত কিতালের মাধ্যমেই হয়। অন্য সব কিছু কিতালের প্রস্তুতি বা কিতালের সংশ্লিষ্ট বিষয়। এসব কারণে, জিহাদ বলতে সাধারণত কিতাল বুঝায়। ফুকাহায়ে কেরাম জিহাদ বলতে সাধারণত কিতালই বুঝিয়ে থাকেন। ‘আর জিহাদ ফরয নয়’ দ্বারা ‘কিতাল ও যুদ্ধ করা ফরয নয়’ উদ্দেশ্য নিয়ে থাকেন। এটা উদ্দেশ্য নয় যে- কিতাল ছাড়া আর কিছু জিহাদ নয়, কিংবা শারীরিক বা আর্থিক সামর্থ্য না থাকার কারণে যাদের উপর কিতালে বের হওয়া ফরয নয়, তাদের আর কোন দায়িত্ব নেই। এমনটা বুঝা ভুল। বরং বাস্তব হল:
- জিহাদ শুধু কিতালে সীমাবদ্ধ নয়। কিতালের প্রস্তুতিমূলক ও কিতালের সাথে সম্পৃক্ত প্রয়োজনীয় অন্যান্য কাজও জিহাদ।
- শক্তি সামর্থ্য না থাকার কারণে যাদের উপর কিতাল ও যুদ্ধ ফরয নয়, তাদেরও আরো অনেক দায়িত্ব রয়েছে। সেগুলো যথাযথ আদায় করলে তারাও জিহাদের সওয়াব পাবে। আদায় না করলে গুনাহগার হবে।
এ হল সংক্ষেপ কথা। সামনের পর্ব থেকে ইনশাআল্লাহ দলীলভিত্তিক আলোচনায় যাব।
***
Comment