১.
অক্টোবর ১০, ২০১৫। দিবাগত রাত। উধামপুর ভারত।
শ্রীনগর-জম্মু হাইওয়ে দিয়ে কাশ্মীরগামী ট্রাকে বসা তিন মুসলিম। ২৪ বছর বয়সী জাহিদ আহমেদ ভাটের হাতে স্টিয়ারিং হুইল। মাত্র আগের দিনই হিন্দু অধ্যুষিত উধামপুড়ে একটি গরুর মৃতদেহ পাওয়া গেছে। দেবতার মৃত্যুতে হিন্দুরা ফুঁসছে। জাহিদ আর তার দুই সাথীর অতো শত জানা নেই। ওদের কাছে এটা জাস্ট আরেকটা ডেলিভারি। রুটিন। মাল পৌছে বাড়ি গিয়ে ঘুমাবার চিন্তায় একটু আধটু ঘুমের আবেশ হয়তো তখন নেমে এসেছে বাকি দুজনের চোখে। কিন্তু জাহিদের তো রাস্তা থেকে চোখ সরাবার সুযোগ নেই। ঘুমাবার আগে পাড়ি দিতে হবে আরো অনেক মাইল।
.
একেবেঁকে ছুটে চলা হাইওয়ের একটা বাঁকের কাছে কিছু লোকের সমাগম। অজানা আশঙ্কায় জাহিদের হৃদস্পন্দনের গতি একটু দ্রুত হয়। বাঁকের কাছে এসে ধীরে ধীরে গতি কমায় ট্রাকের।
.
ভাঙ্গা কাঁচের শব্দ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই চারপাশে ছড়িয়ে পড়লো আগুন। পেট্রল বোমার কমলা শিখা চারপাশ থেকে ঘিরে ধরছে জাহিদকে। এরই মধ্যে মৃত দেবতার শোকে উন্মত্তের মতো ট্রাকের উপর চড়াও হয়েছে গাভীপূজারীরা। নিজের চামড়া পোড়ার বোটকা গন্ধ পাচ্ছে জাহিদ। দুই সঙ্গীর একজনকে দেখতে পাচ্ছে। পাগলের মতো চেচাচ্ছে লোকটা। আরেকজন সম্ভবত পালাতে পেরেছে। দেখা যাচ্ছে না।
.
জাহিদ চেষ্টা করলো নিজেকে বের করার। আগুন যে চারদিক থেকে ঘিরে আছে। অচিন্তনীয় জ্বলুনি শুরু হয়েছে সারা শরীরে। বাড়ির কথা মনে পড়ছে। ব্যাথা যে এতো তীব্র হতে পারে, জাহিদের জানা ছিল না। মা’র মুখটা মনে পড়ছে। চারদিকে ধোঁয়া। আবছা আবছাভাবে জয়ধ্বনি আর উল্লাসের শব্দ কানে আসছে। মাংস পোড়ার তীব্র গন্ধ। আচ্ছা মালগুলো কি ঠিক আছে? নাকি এরা লুট করবে?
.
মা’র মুখটা মনে পড়ছে। সারা শরীর জ্বলছে। ইয়া আল্লাহ্*! এ কষ্ট তো সহ্য করা যায় না। নিশ্বাস নেয়া যাচ্ছে না, মনে হচ্ছে ফুসফুসে জলন্ত আগুন ঢুকে গেছে...তারপর...অন্ধকার।
.
.
উধামপুর গ্রামের মৃত দেবতার মালিক পরে পুলিশকে জানায়, গরুটার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল। জাহিদের হয় নি। জাহিদের শরীরের ৭০% পুড়ে গিয়েছিল। একদিন অসহ্য কষ্ট সহ্য করার পর ওর মৃত্যু হয়। হিন্দু জনতা ট্রাকে আক্রমণ করেছিল কারণ তাদের ধারণা ছিল ট্রাকে করে গরুর গোশত পাচার করা হচ্ছে।
.
ট্রাকে কোন গরুর মাংস ছিল না। জাহিদের আগে উত্তর প্রদেশের দাদরি গ্রামে লুকিয়ে গরুর গোশত খাবার “অপরাধে” ৫০ বছর বয়সী মুহাম্মাদ আখলাককে পিটিয়ে হত্যা করে হিন্দু জনতা। আখলাকের বাসার ফ্রিজ থেকে পুলিশ, আলামত হিসেবে গোশত নিয়ে যায় পরীক্ষার জন্য। ফ্রিজের গোশত ছিল খাসীর। হিমাচল প্রদেশের নোমানকে পিটিয়ে হত্যা করা হয় গরু পাচারের অপরাধে। ছয় সপ্তাহের মধ্যে তিনজন মুসলিমকে গো-মাতার নিমিত্তে বলী দেয়া হয়। সবশেষে নভেম্বরে, মণিপুরের কেইরাও মাক্তিং গ্রামের মুহাম্মাদ হাসমাত আলিকে গরু পাচারের অভিযোগে হিন্দুরা পিটিয়ে হত্যা করে। মুহাম্মাদ হাসমাত আলি ছিলেন স্থানীয় মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল। গরু বা অন্য কোন কিছু বা কোন দেবতা পাচারের সাথে তার কোন সম্পর্ক ছিল না।
.
এর আগে সেপ্টেম্বরে উত্তর প্রদেশে মন্দিরের সিড়িতে গুরুর গোশত ছুড়ে দেয় বোরকা পরিহিত এক লোক। পালানোর সময় পুলিশের হাতে ধরা পরা এই লোক বিজেপির অঙ্গ সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের [আরএসএস] সদস্য।
.
ও হ্যা, পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি গরুর গোশত রপ্তানি করা হয় ভারত থেকে। রপ্তানীকারণ প্রতিষ্ঠানগুলো অধিকাংশই হিন্দু মালিকানাধীন। আর প্রতি বছর কুরবানীর সময়, সীমান্ত দিয়ে আসা লাখ লাখ দেবতার দিকে তাকালে, মা’র প্রতি তাদের দরদটা ভালোই আঁচ করা যায়।
.
.
২.
৩ ডিসেম্বর, ২০১৫। অখিল ভারত হিন্দু মহাসভার প্রেসিডেন্ট কমলেশ তিওয়ারি একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে রাসূলুল্লাহ ﷺ সম্পর্কে জঘন্য কটূক্তি করে। ক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে মুসলিমরা। উত্তরপ্রদেশের মুযাফফার নগড়ে এক লাখেরও বেশি মুসলিম কমলেশ তিওয়ারির ফাঁসির দাবিতে বিক্ষোভ করে। বিজনোরের মুসলিমরা কমলেশ তিওয়ারির শিরচ্ছেদের জন্য ৫১ লাখ রুপি পুরষ্কার ঘোষণা করেছে। তিওয়ারি এখন বর্তমানে জেলে আছে।
.
.
৩.
১৯৭১ সাল, ঢাকা বাংলাদেশ। রেসকোর্স ময়দান। ৯ মাস যুদ্ধের পর পাকিস্তান বাহিনী আত্বসমর্পণ করবে। টেবিলে বসে আছেন বারতীয় সেনাবাহিনীর জগজিত সিং অরোরা, আর পাকিস্তানের এ.এ.কে নিয়াজী। মেজর জেনারেল ওসমানীকে দেখা যাচ্ছে না। দিল্লীতে বসে, হাস্যোজ্জোল ইন্দিরা গান্ধী বলে উঠলেনঃ “হাযার সাল কা বাদলা লে লিয়া!”
.
হাজার সাল আগে তো পাকিস্তান ছিল না, “ইন্দিরাজি” কাঁদের বিরুদ্ধে বদলা নেয়ার কথা বললেন?
.
২৫ ডিসেম্বর, ২০১৫।
আল-জাজিরার সাথে সাক্ষাতকারে বিজেপি জেনারেল সেক্রেটারি রাম মাধাভ জানালেন, “ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ আবারো একত্রিত হবে, এবং অখন্ড ভারত [হিন্দুতভা/Hindutva] আবারো প্রতিষ্ঠিত হবে। আরএসএস এখনো এই লক্ষ্যে বিশ্বাস করে”। বিজেপীর জেনারেল সেক্রেটারি এবং আরএসএস সদস্য মাধাভ আরো জানিয়েছে, ভারতের শুধুমাত্র একটি সংস্কৃতি, একটি ঐতিহ্য এবং একটি আইডেন্টিটি আছে – আর তা হল “হিন্দু সংস্কৃতি”।
.
.
৪.
২১ ডিসেম্বর, ২০১৫। অযোধ্যায় দুই ট্রাক ইট এসে পৌছেছে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মুখপাত্র শারদ শর্মা জানিয়েছে এই পাথরগুলোর জন্য “শিলা পূজা” সম্পন্ন করা হয়েছে। পূজা করেছেন রাম জানাম ভূমি নিবাসের প্রেসিডেন্ট, নৃত্য গোপাল দাস। এই পাথরগুলো আনা হয়েছে বাবরি মাসজিদের ধ্বংসাবশেষের জায়গায় “রাম মন্দির নির্মাণের জন্য। ছয় মাস আগে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ সমগ্র ভারত থেকে রাম মন্দিরের জন্য শিলা/ইট সংগ্রহের ক্যাম্পেইন শুরু করে। ইউপি সরকার বলেছে “রাম মন্দির” নিরমানের বিষয়টি বিচারাধীন হওয়ায় এ মুহূর্তে এরকম কোন পদক্ষেপ নেয়া যাবে না। নৃত্য গোপাল দাসের দাবি মোদী সরকার এই ব্যাপারে তাদেরকে “গ্রীন সিগনালঃ দিয়েছে।
.
.
৫.
উত্তর প্রদেশ, ভারত।
“ইসলাম অর্থ অজ্ঞানতা। ইসলাম হল অন্ধকার। আজ এরা [মুসলিমরা] এক মৃত ধর্মের লাশ কাঁধে নিয়ে ঘুরছে, আর এখন সেই লাশ থেকে গন্ধ ছড়াচ্ছে...আমরা চাই ভারতের যতো মানুষ হিন্দু ধর্ম ছেড়ে ইসলামে গিয়েছে তারা যেন আবার ইসলাম থেকে ফিরে আসে। সেটা যেভাবেই হোক। আমরা চাই তারা অজ্ঞানতা থেকে আলোর দিকে আসুক। আমরা চাই তারা জিহাদ ছেড়ে দিক। আমরা চাই তারা আমাদের পবিত্র গো-মাতা যারা আমাদের নিরাপদে রেখেছেন, তাদের মারা ছেড়ে দিক।“
ইন্টারভিউয়ারের দিকে তাকিয়ে চাপা উত্তেজনার সাথে কথাগুলো বললো স্বামী নরসিংহ আনন্দ সরস্বতী।
.
নিজেদের এই চাওয়াগুলো পূরণ করার জন্য স্বামী সরস্বতী কিশোর-যুবকদের ট্রেইনিং দিচ্ছেন অস্ত্রচালনার। সাথে সঙ্গী হিসেবে পেয়েছেন অখন্ড হিন্দুস্তান মোর্চা, হিন্দু স্বভিমান সঙ্ঘসহ, তার মতো মতাদর্শে বিশ্বাসী আরো অনেককেই। ওয়াটস অ্যাপ, ভাইবার এর মতো মেসেঞ্জার সার্ভিস গুলোর মাধ্যমে সরস্বতীদের প্রতিটি মেসেজ মুহূর্তেই পৌঁছে যাচ্ছে লাখ লাখ হিন্দুর কাছে। গ্রামে গ্রামে গড়ে উঠেছে ট্রেইনিং সেন্টার যেখানে অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তারা হিন্দু কিশোর-কিশোরীদের কুস্তি, দেশীয় অস্ত্র চালনা এবং আগ্নেয়াস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। তাদের কাছে কি কি আগ্নেয়াস্ত্র আছে, এই প্রশ্নের জবাবে হিন্দু স্বভিমান সংঘের অনিল ইয়াদাভ বলছে, এখন আমাদের কাছে অস্ত্র না থাকলেও, গৃহযুদ্ধ যখন শুরু হবে তখন সরকারই আমাদের অস্ত্র দেবে। আর তাই মুসলিমদের বিরুদ্ধে, জিহাদিদের বিরুদ্ধে কিভাবে অস্ত্র চালাতে হবে, আমরা সে ট্রেইনিং এখনি দেয়া শুরু করেছি। https://www.youtube.com/watch?v=nu7KcnIY6D8
.
গৃহযুদ্ধ হব কি না, তা নিয়ে স্বামী সরস্বতী, কিম্বা অনিল ইদাভের মতো লোকদের মধ্যে কোন সংশয় নেই। যুদ্ধ হবে কি না সে প্রশ্ন এখন অবান্তর, প্রশ্ন হল, যুদ্ধ কখন হবে। তাই এখন থেকেই প্রস্তুতি। আর যুদ্ধ শুরুর আগে মহড়া হিসেবে চলছে গো-মাতা হত্যার অজুহাতে মুসলিম হত্যা। হিন্দু মেয়েরা মুসলিম ছেলেদের বিয়ে করার জন্য ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছে, তাই “লাভ জিহাদ” [এদের ভাষায় লাও জিহাদ] মোকাবেলার জন্য, কলেজে কলেজে মুসলিমদের ছেলেদের পিটিয়ে বেড়ানো।
.
.
.
লেখাটা বড় হয়ে গেলো। এই সবগুলো বিষয়কে এক সূত্রে গেঁথে কম কথায় কি বলা যায় চিন্তা করছিলাম। হঠাৎ কাশ্মীরিদের খুব প্রিয় একটি নাশীদের কথা মনে পড়লো। সবগুলো বিষয়কে এক সূত্রে গেঁথে, আমাদের কি করণীয় তা এই নাশীদের এক লাইনে বলে দেয়া আছেঃ
.
“জাগো জাগো সুবহা হুয়ি”
.
.
অন্ধকার সবচেয়ে গাঢ় হয়ে আসে ভোরের ঠিক আগে। এ জমাটবাধা অন্ধকার দেখে অনেকে ভাবতে শুরু করেন, ভোর হতে হয়তো অনেক দেরি। হয়তো এ রাত কখনো শেষ হবে না। কিন্তু যখন ভোর আসে তখন ভোরের সোনালী আলোয় জমাটবাধা অন্ধকারের কোন চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় না। এ অন্ধকার যতোই গাঢ় হোক না কেন, ভোর আসছে। ভোর সন্নিকটে কিন্তু আগে আমাদের চোখ খুলতে হবে। আগে আমাদের জাগতে হবে। নইলে ভোর আমাদের পেড়িয়ে যাবে, আর আমরা অন্ধকারেই পড়ে থাকবো।
.
.
আল্লাহ্* আযযা ওয়া জাল বলেছেনঃ
.
“আপনি সব মানুষের চাইতে মুসলমানদের অধিক শত্রু (হিসেবে) ইহুদী ও মুশরিকদেরকে পাবেন...” [আল-মায়’ইদা]
.
.
[হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত] রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ
.
.
“ অবশ্যই আমাদের একটি দল হিন্দুস্তানের সাথে যুদ্ধ করবে, আল্লাহ্ সেই দলের যোদ্ধাদের সফলতা দান করবেন, আর তারা রাজাদের শিকল/বেড়ি দিয়ে টেনে আনবে । এবং আল্লাহ্ সেই যোদ্ধাদের ক্ষমা করে দিবেন (এই বরকতময় যুদ্ধের দরুন)”। এবং সে মুসলিমেরা ফিরে আসবে তারা ঈসা ইবন-ই-মারিয়াম কে সিরিয়ায়(শাম) পাবে ।
.
.
হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন - “আমি যদি সেই গাযওয়া পেতাম, তাহলে আমার সকল নতুন ও পুরাতন সামগ্রী বিক্রি করে দিতাম এবং এতে অংশগ্রহণ করতাম । যখন আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আমাদের সফলতা দান করতেন এবং আমরা ফিরতাম, তখন আমি একজন মুক্ত আবু হুরায়রা হতাম; যে কিনা সিরিয়ায় হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকে পাবার গর্ব নিয়ে ফিরত।
.
হে মুহাম্মাদ ﷺ ! সেটা আমার গভীর ইচ্ছা যে আমি ঈসা আলাইহিস সালাম এর এত নিকটবর্তী হতে পারতাম, আমি তাকে বলতে পারতাম যে আমি মুহাম্মাদ ﷺ এর একজন সাহাবী ।”
.
বর্ণনাকারী বলেন যে হযরত মুহাম্মাদ ﷺ মুচকি হাসলেন এবং বললেনঃ
‘খুব কঠিন, খুব কঠিন’।“
[ইমাম আহমাদ(রঃ) ‘মুসনাদ’, ইমাম নিসাই(রঃ) ‘আস সুনান আল মুজতাবা’,শায়খ নাসিরুদ্দিন আলবানী(রঃ) হাদিসটিকে সহীহ বলেছেন]
.
.
ভোর আসছে, বি'যনিল্লাহ আযযা ওয়া জাল।
.
জাগো জাগো সুবহা হুয়ি!
জাগো জাগো সুবহা হুয়ি!
_ সংগৃহীত আল্লাহ লেখককে উত্তম জাযা দান করুন আমীন
অক্টোবর ১০, ২০১৫। দিবাগত রাত। উধামপুর ভারত।
শ্রীনগর-জম্মু হাইওয়ে দিয়ে কাশ্মীরগামী ট্রাকে বসা তিন মুসলিম। ২৪ বছর বয়সী জাহিদ আহমেদ ভাটের হাতে স্টিয়ারিং হুইল। মাত্র আগের দিনই হিন্দু অধ্যুষিত উধামপুড়ে একটি গরুর মৃতদেহ পাওয়া গেছে। দেবতার মৃত্যুতে হিন্দুরা ফুঁসছে। জাহিদ আর তার দুই সাথীর অতো শত জানা নেই। ওদের কাছে এটা জাস্ট আরেকটা ডেলিভারি। রুটিন। মাল পৌছে বাড়ি গিয়ে ঘুমাবার চিন্তায় একটু আধটু ঘুমের আবেশ হয়তো তখন নেমে এসেছে বাকি দুজনের চোখে। কিন্তু জাহিদের তো রাস্তা থেকে চোখ সরাবার সুযোগ নেই। ঘুমাবার আগে পাড়ি দিতে হবে আরো অনেক মাইল।
.
একেবেঁকে ছুটে চলা হাইওয়ের একটা বাঁকের কাছে কিছু লোকের সমাগম। অজানা আশঙ্কায় জাহিদের হৃদস্পন্দনের গতি একটু দ্রুত হয়। বাঁকের কাছে এসে ধীরে ধীরে গতি কমায় ট্রাকের।
.
ভাঙ্গা কাঁচের শব্দ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই চারপাশে ছড়িয়ে পড়লো আগুন। পেট্রল বোমার কমলা শিখা চারপাশ থেকে ঘিরে ধরছে জাহিদকে। এরই মধ্যে মৃত দেবতার শোকে উন্মত্তের মতো ট্রাকের উপর চড়াও হয়েছে গাভীপূজারীরা। নিজের চামড়া পোড়ার বোটকা গন্ধ পাচ্ছে জাহিদ। দুই সঙ্গীর একজনকে দেখতে পাচ্ছে। পাগলের মতো চেচাচ্ছে লোকটা। আরেকজন সম্ভবত পালাতে পেরেছে। দেখা যাচ্ছে না।
.
জাহিদ চেষ্টা করলো নিজেকে বের করার। আগুন যে চারদিক থেকে ঘিরে আছে। অচিন্তনীয় জ্বলুনি শুরু হয়েছে সারা শরীরে। বাড়ির কথা মনে পড়ছে। ব্যাথা যে এতো তীব্র হতে পারে, জাহিদের জানা ছিল না। মা’র মুখটা মনে পড়ছে। চারদিকে ধোঁয়া। আবছা আবছাভাবে জয়ধ্বনি আর উল্লাসের শব্দ কানে আসছে। মাংস পোড়ার তীব্র গন্ধ। আচ্ছা মালগুলো কি ঠিক আছে? নাকি এরা লুট করবে?
.
মা’র মুখটা মনে পড়ছে। সারা শরীর জ্বলছে। ইয়া আল্লাহ্*! এ কষ্ট তো সহ্য করা যায় না। নিশ্বাস নেয়া যাচ্ছে না, মনে হচ্ছে ফুসফুসে জলন্ত আগুন ঢুকে গেছে...তারপর...অন্ধকার।
.
.
উধামপুর গ্রামের মৃত দেবতার মালিক পরে পুলিশকে জানায়, গরুটার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল। জাহিদের হয় নি। জাহিদের শরীরের ৭০% পুড়ে গিয়েছিল। একদিন অসহ্য কষ্ট সহ্য করার পর ওর মৃত্যু হয়। হিন্দু জনতা ট্রাকে আক্রমণ করেছিল কারণ তাদের ধারণা ছিল ট্রাকে করে গরুর গোশত পাচার করা হচ্ছে।
.
ট্রাকে কোন গরুর মাংস ছিল না। জাহিদের আগে উত্তর প্রদেশের দাদরি গ্রামে লুকিয়ে গরুর গোশত খাবার “অপরাধে” ৫০ বছর বয়সী মুহাম্মাদ আখলাককে পিটিয়ে হত্যা করে হিন্দু জনতা। আখলাকের বাসার ফ্রিজ থেকে পুলিশ, আলামত হিসেবে গোশত নিয়ে যায় পরীক্ষার জন্য। ফ্রিজের গোশত ছিল খাসীর। হিমাচল প্রদেশের নোমানকে পিটিয়ে হত্যা করা হয় গরু পাচারের অপরাধে। ছয় সপ্তাহের মধ্যে তিনজন মুসলিমকে গো-মাতার নিমিত্তে বলী দেয়া হয়। সবশেষে নভেম্বরে, মণিপুরের কেইরাও মাক্তিং গ্রামের মুহাম্মাদ হাসমাত আলিকে গরু পাচারের অভিযোগে হিন্দুরা পিটিয়ে হত্যা করে। মুহাম্মাদ হাসমাত আলি ছিলেন স্থানীয় মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল। গরু বা অন্য কোন কিছু বা কোন দেবতা পাচারের সাথে তার কোন সম্পর্ক ছিল না।
.
এর আগে সেপ্টেম্বরে উত্তর প্রদেশে মন্দিরের সিড়িতে গুরুর গোশত ছুড়ে দেয় বোরকা পরিহিত এক লোক। পালানোর সময় পুলিশের হাতে ধরা পরা এই লোক বিজেপির অঙ্গ সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের [আরএসএস] সদস্য।
.
ও হ্যা, পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি গরুর গোশত রপ্তানি করা হয় ভারত থেকে। রপ্তানীকারণ প্রতিষ্ঠানগুলো অধিকাংশই হিন্দু মালিকানাধীন। আর প্রতি বছর কুরবানীর সময়, সীমান্ত দিয়ে আসা লাখ লাখ দেবতার দিকে তাকালে, মা’র প্রতি তাদের দরদটা ভালোই আঁচ করা যায়।
.
.
২.
৩ ডিসেম্বর, ২০১৫। অখিল ভারত হিন্দু মহাসভার প্রেসিডেন্ট কমলেশ তিওয়ারি একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে রাসূলুল্লাহ ﷺ সম্পর্কে জঘন্য কটূক্তি করে। ক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে মুসলিমরা। উত্তরপ্রদেশের মুযাফফার নগড়ে এক লাখেরও বেশি মুসলিম কমলেশ তিওয়ারির ফাঁসির দাবিতে বিক্ষোভ করে। বিজনোরের মুসলিমরা কমলেশ তিওয়ারির শিরচ্ছেদের জন্য ৫১ লাখ রুপি পুরষ্কার ঘোষণা করেছে। তিওয়ারি এখন বর্তমানে জেলে আছে।
.
.
৩.
১৯৭১ সাল, ঢাকা বাংলাদেশ। রেসকোর্স ময়দান। ৯ মাস যুদ্ধের পর পাকিস্তান বাহিনী আত্বসমর্পণ করবে। টেবিলে বসে আছেন বারতীয় সেনাবাহিনীর জগজিত সিং অরোরা, আর পাকিস্তানের এ.এ.কে নিয়াজী। মেজর জেনারেল ওসমানীকে দেখা যাচ্ছে না। দিল্লীতে বসে, হাস্যোজ্জোল ইন্দিরা গান্ধী বলে উঠলেনঃ “হাযার সাল কা বাদলা লে লিয়া!”
.
হাজার সাল আগে তো পাকিস্তান ছিল না, “ইন্দিরাজি” কাঁদের বিরুদ্ধে বদলা নেয়ার কথা বললেন?
.
২৫ ডিসেম্বর, ২০১৫।
আল-জাজিরার সাথে সাক্ষাতকারে বিজেপি জেনারেল সেক্রেটারি রাম মাধাভ জানালেন, “ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ আবারো একত্রিত হবে, এবং অখন্ড ভারত [হিন্দুতভা/Hindutva] আবারো প্রতিষ্ঠিত হবে। আরএসএস এখনো এই লক্ষ্যে বিশ্বাস করে”। বিজেপীর জেনারেল সেক্রেটারি এবং আরএসএস সদস্য মাধাভ আরো জানিয়েছে, ভারতের শুধুমাত্র একটি সংস্কৃতি, একটি ঐতিহ্য এবং একটি আইডেন্টিটি আছে – আর তা হল “হিন্দু সংস্কৃতি”।
.
.
৪.
২১ ডিসেম্বর, ২০১৫। অযোধ্যায় দুই ট্রাক ইট এসে পৌছেছে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মুখপাত্র শারদ শর্মা জানিয়েছে এই পাথরগুলোর জন্য “শিলা পূজা” সম্পন্ন করা হয়েছে। পূজা করেছেন রাম জানাম ভূমি নিবাসের প্রেসিডেন্ট, নৃত্য গোপাল দাস। এই পাথরগুলো আনা হয়েছে বাবরি মাসজিদের ধ্বংসাবশেষের জায়গায় “রাম মন্দির নির্মাণের জন্য। ছয় মাস আগে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ সমগ্র ভারত থেকে রাম মন্দিরের জন্য শিলা/ইট সংগ্রহের ক্যাম্পেইন শুরু করে। ইউপি সরকার বলেছে “রাম মন্দির” নিরমানের বিষয়টি বিচারাধীন হওয়ায় এ মুহূর্তে এরকম কোন পদক্ষেপ নেয়া যাবে না। নৃত্য গোপাল দাসের দাবি মোদী সরকার এই ব্যাপারে তাদেরকে “গ্রীন সিগনালঃ দিয়েছে।
.
.
৫.
উত্তর প্রদেশ, ভারত।
“ইসলাম অর্থ অজ্ঞানতা। ইসলাম হল অন্ধকার। আজ এরা [মুসলিমরা] এক মৃত ধর্মের লাশ কাঁধে নিয়ে ঘুরছে, আর এখন সেই লাশ থেকে গন্ধ ছড়াচ্ছে...আমরা চাই ভারতের যতো মানুষ হিন্দু ধর্ম ছেড়ে ইসলামে গিয়েছে তারা যেন আবার ইসলাম থেকে ফিরে আসে। সেটা যেভাবেই হোক। আমরা চাই তারা অজ্ঞানতা থেকে আলোর দিকে আসুক। আমরা চাই তারা জিহাদ ছেড়ে দিক। আমরা চাই তারা আমাদের পবিত্র গো-মাতা যারা আমাদের নিরাপদে রেখেছেন, তাদের মারা ছেড়ে দিক।“
ইন্টারভিউয়ারের দিকে তাকিয়ে চাপা উত্তেজনার সাথে কথাগুলো বললো স্বামী নরসিংহ আনন্দ সরস্বতী।
.
নিজেদের এই চাওয়াগুলো পূরণ করার জন্য স্বামী সরস্বতী কিশোর-যুবকদের ট্রেইনিং দিচ্ছেন অস্ত্রচালনার। সাথে সঙ্গী হিসেবে পেয়েছেন অখন্ড হিন্দুস্তান মোর্চা, হিন্দু স্বভিমান সঙ্ঘসহ, তার মতো মতাদর্শে বিশ্বাসী আরো অনেককেই। ওয়াটস অ্যাপ, ভাইবার এর মতো মেসেঞ্জার সার্ভিস গুলোর মাধ্যমে সরস্বতীদের প্রতিটি মেসেজ মুহূর্তেই পৌঁছে যাচ্ছে লাখ লাখ হিন্দুর কাছে। গ্রামে গ্রামে গড়ে উঠেছে ট্রেইনিং সেন্টার যেখানে অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তারা হিন্দু কিশোর-কিশোরীদের কুস্তি, দেশীয় অস্ত্র চালনা এবং আগ্নেয়াস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। তাদের কাছে কি কি আগ্নেয়াস্ত্র আছে, এই প্রশ্নের জবাবে হিন্দু স্বভিমান সংঘের অনিল ইয়াদাভ বলছে, এখন আমাদের কাছে অস্ত্র না থাকলেও, গৃহযুদ্ধ যখন শুরু হবে তখন সরকারই আমাদের অস্ত্র দেবে। আর তাই মুসলিমদের বিরুদ্ধে, জিহাদিদের বিরুদ্ধে কিভাবে অস্ত্র চালাতে হবে, আমরা সে ট্রেইনিং এখনি দেয়া শুরু করেছি। https://www.youtube.com/watch?v=nu7KcnIY6D8
.
গৃহযুদ্ধ হব কি না, তা নিয়ে স্বামী সরস্বতী, কিম্বা অনিল ইদাভের মতো লোকদের মধ্যে কোন সংশয় নেই। যুদ্ধ হবে কি না সে প্রশ্ন এখন অবান্তর, প্রশ্ন হল, যুদ্ধ কখন হবে। তাই এখন থেকেই প্রস্তুতি। আর যুদ্ধ শুরুর আগে মহড়া হিসেবে চলছে গো-মাতা হত্যার অজুহাতে মুসলিম হত্যা। হিন্দু মেয়েরা মুসলিম ছেলেদের বিয়ে করার জন্য ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছে, তাই “লাভ জিহাদ” [এদের ভাষায় লাও জিহাদ] মোকাবেলার জন্য, কলেজে কলেজে মুসলিমদের ছেলেদের পিটিয়ে বেড়ানো।
.
.
.
লেখাটা বড় হয়ে গেলো। এই সবগুলো বিষয়কে এক সূত্রে গেঁথে কম কথায় কি বলা যায় চিন্তা করছিলাম। হঠাৎ কাশ্মীরিদের খুব প্রিয় একটি নাশীদের কথা মনে পড়লো। সবগুলো বিষয়কে এক সূত্রে গেঁথে, আমাদের কি করণীয় তা এই নাশীদের এক লাইনে বলে দেয়া আছেঃ
.
“জাগো জাগো সুবহা হুয়ি”
.
.
অন্ধকার সবচেয়ে গাঢ় হয়ে আসে ভোরের ঠিক আগে। এ জমাটবাধা অন্ধকার দেখে অনেকে ভাবতে শুরু করেন, ভোর হতে হয়তো অনেক দেরি। হয়তো এ রাত কখনো শেষ হবে না। কিন্তু যখন ভোর আসে তখন ভোরের সোনালী আলোয় জমাটবাধা অন্ধকারের কোন চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় না। এ অন্ধকার যতোই গাঢ় হোক না কেন, ভোর আসছে। ভোর সন্নিকটে কিন্তু আগে আমাদের চোখ খুলতে হবে। আগে আমাদের জাগতে হবে। নইলে ভোর আমাদের পেড়িয়ে যাবে, আর আমরা অন্ধকারেই পড়ে থাকবো।
.
.
আল্লাহ্* আযযা ওয়া জাল বলেছেনঃ
.
“আপনি সব মানুষের চাইতে মুসলমানদের অধিক শত্রু (হিসেবে) ইহুদী ও মুশরিকদেরকে পাবেন...” [আল-মায়’ইদা]
.
.
[হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত] রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ
.
.
“ অবশ্যই আমাদের একটি দল হিন্দুস্তানের সাথে যুদ্ধ করবে, আল্লাহ্ সেই দলের যোদ্ধাদের সফলতা দান করবেন, আর তারা রাজাদের শিকল/বেড়ি দিয়ে টেনে আনবে । এবং আল্লাহ্ সেই যোদ্ধাদের ক্ষমা করে দিবেন (এই বরকতময় যুদ্ধের দরুন)”। এবং সে মুসলিমেরা ফিরে আসবে তারা ঈসা ইবন-ই-মারিয়াম কে সিরিয়ায়(শাম) পাবে ।
.
.
হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন - “আমি যদি সেই গাযওয়া পেতাম, তাহলে আমার সকল নতুন ও পুরাতন সামগ্রী বিক্রি করে দিতাম এবং এতে অংশগ্রহণ করতাম । যখন আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আমাদের সফলতা দান করতেন এবং আমরা ফিরতাম, তখন আমি একজন মুক্ত আবু হুরায়রা হতাম; যে কিনা সিরিয়ায় হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকে পাবার গর্ব নিয়ে ফিরত।
.
হে মুহাম্মাদ ﷺ ! সেটা আমার গভীর ইচ্ছা যে আমি ঈসা আলাইহিস সালাম এর এত নিকটবর্তী হতে পারতাম, আমি তাকে বলতে পারতাম যে আমি মুহাম্মাদ ﷺ এর একজন সাহাবী ।”
.
বর্ণনাকারী বলেন যে হযরত মুহাম্মাদ ﷺ মুচকি হাসলেন এবং বললেনঃ
‘খুব কঠিন, খুব কঠিন’।“
[ইমাম আহমাদ(রঃ) ‘মুসনাদ’, ইমাম নিসাই(রঃ) ‘আস সুনান আল মুজতাবা’,শায়খ নাসিরুদ্দিন আলবানী(রঃ) হাদিসটিকে সহীহ বলেছেন]
.
.
ভোর আসছে, বি'যনিল্লাহ আযযা ওয়া জাল।
.
জাগো জাগো সুবহা হুয়ি!
জাগো জাগো সুবহা হুয়ি!
_ সংগৃহীত আল্লাহ লেখককে উত্তম জাযা দান করুন আমীন
Comment