সংশয় নিরসন সিরিজ _ জিহাদ সিরিজঃ- চতুর্থ সংশয় আমাদের সামর্থ্য নেই; তাই জিহাদ নাজায়িজ।
পৃথিবীর ইতিহাসে যত জিহাদ সংগঠত হয়েছে প্রায় সবগুলোতেই মুসলমানরা সংখ্যায় শক্তিতে কমছিল। এটি কোনো নতুন গঠনা নয়, সংখ্যায় সল্প আর শক্তিতে দুর্বল হওয়া মুসলমানরাই জিহাদের মাধ্যমে পৃথিবীর তাপত শক্তিকে পরাজিত করেছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জিহাদের মাধ্যমে নিজেদের দ্বীন, ভূমি ও মর্যাদা হিফাজত করেছে। যখনই তারা জিহাদে ঝাঁপিয়ে পরেছে আল্লাহর সাহায্যে তাঁরা বিজয় লাভ করেছে। হারানো ভূমি পূরনায় উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে।
* জিহাদ করার জন্য তো শক্তি-সামর্থ্য থাকতে হবে। সামর্থ্যহীনের ওপর জিহাদ ফরজ নয়। তাছাড়া কাফিরদের তুলনায় মুসলমানদে সমরশক্তি নেই বললেই চলে। সমান সমান না হোক, অন্তত কাছাকাছি শক্তি তো থাকা চাই। অতএব, যতদিন মুসলমানরা শক্তি অর্জন করতে পারবে না, ততদিন তাদের জন্য জিহাদের দায়িত্ব আদায় করা ফরজ হবে না।
♦ সংশয় নিরসন♦
* আমাদের সামর্থ্য নেই, তাই আমাদের ওপর জিহাদ ফরজ নয়' এটি অনেক প্রাচীন ও বহুল প্রচলিত সংশয়। জিহাদ পরিত্যাগের পক্ষে এটি একটি মোক্ষম অজুহাত। চলুন, শরিয়ার মূলনীতির আলোকে বিষয়টি যাচাই করে দেখা যাক।
{{এক}}
★ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সামর্থ্য আছে কিনা তা নির্ধারণ করবে শরিয়ত। শরিয়ত যাকে সামর্থ্যবান মনে করে সে সামর্থ্যবান; যদিও সে নিজেকে সামর্থ্যহীন মনে করে।
* আল্লাহ তাআলা বলেন:
اِنْفِرُوا خِفَافًا وَثِقَالًا وَجَاهِدُوا بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ فِي سَبِيلِ اللهِ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَِكُمْ إِنْ كُُنْتُمْ تَعْلَمُونَ
** অভিযানে বের হয়ে পড়ো হালকা রণসম্ভার নিয়ে বা ভারী রণসম্ভার নিয়ে এবং জিহাদ করো আল্লাহর পথে তোমাদের সম্পদ ও জীবন দ্বারা। এটিই তোমাদের জন্য শ্রেয়, যদি তোমারা জানতে! ( সূরা তাওবা: ৪১)
" অন্য আয়াতে তিনি বলেন :
تُؤْمِنُونَ بِا للَّهِ وَرَسُولِهِ وَتُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ الله بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ
" তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে এবং তোমাদের ধন-সম্পদ ও জীবন দ্বারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে।' ( সূরা সাফ: ১১)
★ এছাড়াও আরও বহু আয়াত ও হাদিসের আলোকে বোঝা যায়, জিহাদের সামর্থ্য দুই প্রকার:
<<১>>
জিহাদ বিন নাফ্স বা সশরীরে যুদ্ধ করার সামর্থ্য।
<<২>>
জিহাদ বিল মাল বা জিহাদের কাজে মাল ব্যয় করার সামর্থ্য।
" যার উভয় প্রকারের সামর্থ্য আছে, তার জন্য উভয়টা ফরজ। আর যার একটার সামর্থ্য আছে তার জন্য একটা ফরজ।
* উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম জাসসাস রহিমাহুল্লাহ বলেন:
فَأَوْجَبَ فَرْضَ الْجِهَادِ بِالْمَالِ وَالنَفْسِ جَمِيعًا٭ فَمَنْ كَانَ لَهُ مَالٌ وَهُوَ مَريْضٌ أَوْ مُقْعَدٌ أَوْ ضَعِيفٌ لَا يَصْلُحُ لِلْقِتَالِ فَعَلَيْهِ الْجِهَادُ بِمَالِهِ بِأَنْ يُعْطِيَهُ غَيْرَهُ فَيَغْزُو بِهِ٭ كَمَا أَنَّ مَنْ لَهُ قُوَّةٌ وَجَلَدٌ٭ وَأَمْكَنَهُ الْجِهَادُ بِنَفْسِهِ كَانَ عَلَيْهِ الْجِهَادُ بِنَفْسِهِ٭ وَإنْ لَمْ يِكُنْ ذَا مَالٍ وَيَسَارٍ بَعْدَ أَنْ يَجِدَ مَا يَبْلُغُهُ٭ وَمَنْ قَوِيَ عَلَی الْقِتَالِ٭ وَلَهُ مَالٌ فَعَلَيْهِ الْجِهَادُ بِالنَفْسِ وَالْمَالِ
" আল্লাহ তাআলা মাল ও জান উভয়টি দিয়ে জিহাদ করাকে ফরজ করেছেন। যার মাল আছে, কিন্তু সে অসুস্থ কিংবা পঙ্গু অথবা দুর্বল, যার ফলে সে যুদ্ধের সামর্থ্য রাখে না, তার জন্য মাল দিয়ে জিহাদ করা ফরজ। আর তা এভাবে যে, সে অন্যকে মাল দিয়ে দেবে এবং সে এই মাল দিয়ে যুদ্ধ করবে। আর যার শারীরিক সামর্থ্য ও দৃঢ়তা আছে এবং যুদ্ধ করতে সক্ষম, সে যদি সম্পদশালী ও প্রাচুর্যের অধিকারী নাও হয়, তবুও জিহাদে পৌঁছার মতো ব্যবস্থা হয়ে গেলে তাকে যুদ্ধে শরিক হতে হবে। আর সম্পদশালী ও যুদ্ধে সক্ষম ব্যক্তির জন্য জীবন ও সম্পদ উভয়টি দিয়ে জিহাদ করা ফরজ।' ( আহকামুল কুরআন: ৩/১৫১)
** শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যা রহিমাহুল্লাহ বলেন:
وَالْعَاجِزُ عَنْ الْجِهَادِ بِنَفْسِهِ يَجِبُ عَلَيْهِ الْجِهَادُ بِمَالِهِ فِي أَصَحَ قَوْلَي الْعُلَمَاءِ وَهُوَ إِحْدََی الرِّوَايَتَيْنِ عَنْ أَحْمَدَ٭ فَإِنَّ اللهَ أَمَرَ بِالْجِهَادِ بِالْمَالِ وَالنَّفْسِ فِي غَيْرِ مَوْضِعِ مِنْ الْقُرْآنِ وَقَظْ فَالَ اللهُ تَعَالَ٭ فَاتَّقُوا اللهَ مَا اسْتَطَعْتُمْ ٭ وَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّی اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمِ٭ إِذَا أََمَرْ تُكُمْ بِأَمْرِ فَأْتُوا مِنْهُ مَا اسْتَطَعْتُمْ٭ أَخْرَجَاهُ فِي الصَّحِيحَيْنِ فَمَنْ عَجَزَ عَنْ الجِهَادِ بِالْبَدَنِ لَمْ يَسْقُطْ عَنْهُ الْجِهَادُ بِالْمَالِ كَمَا أَنَّ مَنْ عَجَزَ عَنْ الْجِهَادِ بِالْمَالِ لَمْ يَسْقُطْ عَنْهُ الْجِهَادُ بِالْبَدَنِ
" উলামায়ে কেরামের বিশুদ্ধতর মত অনুযায়ী, শারীরিকভাবে অক্ষম ব্যক্তিকে তার মাল দিয়ে জিহাদ করতে হবে। এক বর্ণনানুযায়ী ইমাম আহমদ রহিমাহুল্লাহ -এরও একই মত। কেননা, আল্লাহ তাআলা কুরআনের একাধিক জায়গায় মাল ও জান উভয়টা দিয়ে জিহাদ করতে বলেছেন। আল্লাহ তাআলা আরও বলেছেন, "তোমরা সামর্থ্যানুযায়ী আল্লাহকে ভয় করো।" রাসূল সাল্লাল্লাহু অালাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, "যখন আমি তোমাদেরকে কোনো কিছুর আদেশ দিই, তার যতটুকু সাধ্যে কুলোয় ততটুকু করো।" ইমাম বুখারি ও মুসলিম সহিহাইনে হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। অতএব যে ব্যক্তি শারীরিক জিহাদে অক্ষম, তার, জন্য মালের জিহাদ মাফ হয়ে যাবে না। অনুরূপভাবে যে মাল দিয়ে জিহাদ করতে অক্ষম, তার জন্য শারীরিক জিহাদ মাফ হয়ে যাবে না। ' (মাজমুউল ফাতাওয়া: ২৮/৮৭)
** তিনি আরও বলেন:
فَمَنْ كَانَ لَهُ مَالٌ وَهُوَ عَاجِزٌ بِبَدَنِهِ فَلْيَغْزُ بِمَالِهِ ٭ فَفِي الصَّحِيحَيْنِ عَنْ النَّبِيِّ صَلَّی اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَّهُ قَالَ مَنْ جَهَّزَ غَازِيًا فَقَدْ غَزا وَمَنْ خَلَفَهُ فِي أَهْلِهِ بِخَيْرِ فَقَدْ غَزَا ٭ وَمَنْ كَانَ قَادِرًا بِبَدَنِهِ وَهُوَفَقِيرٌ فَلْيَأْخُذْ مِنْ أَمْوَالِ الْمُسْلِمِينَ مَا يَتَجَهَّزُ بِهِ سَوَاءٌ كَانَ الْمَأْ خُوذُ زَكَاة أَوْ صِلَةً أَوْ مِنْ بَيْتِ الْمَالِ أَوْغَيْرِ ذَلِكَ
" যার মাল আছে, কিন্তু শারীরিকভাবে জিহাদ করতে অক্ষম, সে মাল দিয়ে জিহাদ করবে। সহিহাইনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণতি আছে, "যে ব্যক্তি কোনো মুজাহিদকে যুদ্ধসরঞ্জাম সরবরাহ করল, সেও যুদ্ধ করল। যে ব্যক্তি মুজাহিদদের অবর্তমানে তার পরিবারের উত্তমরূপে দেখাশোনা করল সেও যুদ্ধ করল। আর যে শারীরিকভাবে সক্ষম কিন্তু গরিব, সে যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ অন্য মুসলমানদের থেকে গ্রহণ করবে। চাই উক্ত সম্পদ জাকাত হোক, দান হোক, বাইতুল মাল থেকে হোক বা অন্য কোনো উৎস থেকে হোক।' (মাজমুউল ফাতাওয়া: ২৮/৪২১)
## এখন দেখা যাক, শরিয়ত কাদেরকে বর্ণিত দুই প্রকারের সামর্থ্যে সামর্থ্যবান মনে করে।
* এই কথা স্পষ্ট যে, শরয়ি ওজর থেকে মুক্ত প্রতিটি বালেগ পুরুষকেই শরিয়ত সামর্থ্যবান বলে গণ্য করে। অতএব, শরিয়াহ-বর্ণিত ওজরবিশিষ্ট লোক ব্যতীত বাকি সকল বালেগ পুরুষের ওপর জিহাদ ফরজ।
* এখন জানতে হবে, ওজরবিশিষ্ট লোক করা, যাদের ওপর জিহাদ ফরজ নয়?
٭আল্লাহ তাআলা বলেন:
لَيْسَ عَلی الْأَعْمَی حَرَجٌ وَلَا عَلَی الْأَعْرَجِ حَرَجٌ وَلَا عَلَی الْمَريضِ حَرَجٌ
'(জিহাদে অংশগ্রহণ না করাতে) অন্ধের জন্য কোনো গুনাহ নেই; খোঁড়ার জন্য কোনো গুনাহ নেই এবং রুগ্ন ব্যক্তির জন্যও কোনো গুনাহ নেই।' (সূরা ফাতহ: ১৭)
অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন:
لَيْسَ عَلی الضُّعَفَاءِ وَلَا عَلَی الْمَرْضَی وَلَا عَلَی الَّذِينَ لَا يَجِدُونَ مَا يُنْفِقُونَ حَرَجٌ
'দুর্বল লোকদের (জিহাদে না যাওয়াতে) কোনো গুনাহ নেই। এবং অসুস্থ লোকদেরও কোনো গুনাহ নেই। আর সেই সকল লোকদেরও কোনো গুনাহ নেই, যাদের কাছে খরচ করার মতো কিছুই নেই।' (সূরা তাওবা: ৯১)
## এই দুই আয়াতসহ অন্যান্য আয়াত, হাদিস ও শরিয়তের মূলনীতির আলোকে ফুকাহায়ে কিরাম নিম্নাক্ত কয়েক শ্রেণির ব্যক্তিকে মাজুর বা সামর্থ্যহীন বলে গণ্য করেছেন।
১. অন্ধ। ২. খোঁড়া। ৩. অত্যধিক রুগ্ন। ৪. অতিশয় দূর্বল। ৫. অতি বৃদ্ধ। ৬. পঙ্গু। ৭. যাদের কাছে জিহাদের ময়দানে উপস্থিত হওয়ার, তাতে অর্থকড়ি খরচ করার এবং বাহন সংগ্রহ করার সার্থ্য নেই।
★★ উল্লেখ্য যে, এই সকল ব্যক্তি তখনই মাজুর ও অক্ষম বলে গণ্য হবে, যখন এসব ওজর ও সমস্যা এমন পর্যায়ের হবে যে, তাদের পক্ষে যুদ্ধ করা একেবারেই সম্ভব নয়। অতএব, হালকা ঝাপসা দেখে, সামান্য খোঁড়া কিন্তু যুদ্ধে সক্ষম, হালকা অসুস্থ, বৃদ্ধ তবে যুদ্ধ করতে পারে, হাত-পায়ে ঈষৎ বিকলাঙ্গতা আছে কিন্তু যুদ্ধে সক্ষম এ ধরনের লোক অক্ষম হিসেবে গণ্য হবে না।
( দেখুন, বাদাইউস সানায়ি: ৬/৫৮-৫৯; ফাতাওয়ায়ে শামি: ৬/২০১-২০৫; আল-মুগনি: ১০/৩৬৭)
বিশেষ দ্রষ্টব্য:
আগের জামানায় জিহাদের জন্য ইসলামি রাষ্ট্রের সীমানা পার হয়ে কাফিরদের দেশে যেতে হতো, তাই অনেকেরই এই সামর্থ্য থাকত না। বর্তমানে জিহাদের জন্য ইউরোপ-আমেরিকা যাওয়ার দরকার নেই। অনেকের নিজ দেশেই জিহাদ ফরজ হয়ে আছে। আশেপাশেই জিহাদের কার্যক্রম চলছে। তাই নিজ ঘরে থেকেই জিহাদের চলমান কাজে অংশগ্রহণ করা সম্ভব। তাছাড়া বর্তমানে এমন মানুষ খুব কমই পাওয়া যাবে, যারা অর্থকড়ির অভাবে জিহাদে শরিক হতে পারছে না। বরং বাস্তবতা হচ্ছে, জিহাদের জন্য বারবার দাওয়াত দেওয়ার পরও তারা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। এরা কোনোভাবেই মাজুর বা সামর্থ্যহীন নয়।
কয়েকটি প্রশ্ন:
যারা লাখ লাখ টাকা খরচ করে বারবার নফল হজ করতে যায়, তারা কি সামর্থ্যহীন?
যারা আলিশান বাড়ি-গাড়ি করছেন, তারা কি সামর্থ্যহীন?
যাদের ফ্ল্যাট-বাসা দৃষ্টিনন্দন ফার্নিচারে ভরপুর, তারা কি সামর্থ্যহীন?
যারা দামি ব্রান্ডের প্রাইভেটকারে চলা ফেরা করেন, তারা কি সামর্থ্যহীন?
যাদের জীবনে প্রাচুর্যের শেষ নেই, তারা কি সামর্থ্যহীন?
যারা ঘরের ফ্লোরে তো বটেই টয়লেটেও টাইলস লাগিয়েছেন, তারা কি সামর্থ্যহীন?
যারা অন্ধ, খোঁড়া, রুগ্ন, অতিশয় দুর্বল, বৃদ্ধ কিংবা পঙ্গু নয়, তারা কি সামর্থ্যহীন?
সামর্থ্যহীন লোকদের কী করণীয়?
যারা পূর্বোক্ত ওজরের কারণে জিহাদে অংশগ্রহণ করতে পারেনি, জিহাদের দায়িত্বমুক্তির জন্য তাদের অবশ্য পালনীয় দুটি দায়িত্ব আছে :
১. আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের তথা দ্বীনের কল্যণকামিতা।
২. ইহসান ও সত্যনিষ্ঠতা।
★★ যেমনটি আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজিদে বলেছেন :
لَيْسَ عَلَی الضُّعَفَاءِ وَلَا عَلَی الْمَرْضَی وَلَا عَلَی الَّذِينَ لَا يَجِدُونَ مَا يُنْفِقُونَ حَرَجٌ إِذَا نَصَحُوا لِلَّهِ وَرَسُولِهِ مَا عَلَی الْمُحْسِنِيِنَ مِنْ سَبِيلٍ وَاللهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ
" দুর্বল লোকদের ( জিহাদে না যাওয়াতে) কোনো গুনাহ নেই এবং অসুস্থ লোকদেরও কোনো গুনাহ নেই। আর সেই সকল লোকদেরও কোনো গুনাহ নেই, যাদের কাছে খরচ করার মতো কিছু নেই, যদি তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কল্যাণকামী হয়। যারা মুহসিন বা সৎকর্মপরায়ণ তাদের সম্পর্কে অভিযোগের কোনো হেতু নেই। আল্লাহ ক্ষামাশীল, পরম দয়ালু।' (সূরা তাওবা : ৯১)
** কল্যাণকামিতা এবং ইহসান বা সত্যনিষ্ঠতা কাকে বলে?
কল্যাণকামিতা হলো, অন্তরকে কোনো বিষয়ের ব্যাপারে খালেস, বিশুদ্ধ ও নির্ভেজাল করা।
ইহসান হলো, কোনো কিছুকে সুন্দর ও সুচারুরূপে সম্পাদন করা এবং উত্তম ও সত্যনিষ্ঠ আচরণ করা।
** এতএব সামর্থ্যহীন ব্যক্তি তখনই মুক্তি পাবে, যখন সে জিহাদের প্রতি আন্তরিক থাকবে, মুজাহিদদের কল্যাণকামী হবে এবং কিতাল ও দ্বীনের সৈনিকদের প্রতি নির্ভেজাল ভালোবাস রাখবে। আর তা শুধু মুখে দাবি করলেই চলবে না, তার বেশ কিছু দায়িত্বও রয়েছে।
## কল্যাণকামিতা ও সত্যনিষ্ঠতা যেভাবে আদায় হবে-
★★ ইমাম জাসসাস রহিমাহুল্লাহ বলেন:
وَكَانَ عُذْرُ هَؤُلَاءِ وَمَدْحُهُمْ بِشَرِيطَةِ النُّصْحِ لِلَّهِ وَرَسُولِهِ ٭ لِأَنَّ مَنْ تَخَلَّفَ مِنْهُمْ وَهُوَ غَيْرُ نَاصِحِ لِلَّهِ وَرَسُولِهِ بَلْ يُرِيدُ التَّضْرِيبَ وَالسَّعْيَ فِي إِفْسَادِ قُلُوبِ مَنْ بِالْمَدِينَةِ لَكَانَ مَذْمُومًا مُسْتَحِقًّا لِلْعِقَابِ٭ وَمِنْ النُّصْحِ لِلَّهِ تَعَالَی حَثُّ الْمُسْلِمِينَ عَلَی الْجِهَادِ وَتَرْغِيبُهُمْ فِيهِ وَالسَّعْيُ فِي إِصْلَاحِ ذَاتِ بَيْنِهِمْ وَنَحْوِهِ مِمَّا يَعُودُ بِالنَّفْعِ عَلَی الدِّين٭ وَيَكُونُ مَعَ ذَلِكَ مُخَلِّصًا لِعَمَلِهِ مِنْ الغِغِشِّ٭ لِأَنَّ ذَلِكَ هُوَ النُّصْحُ٭ وَمِنْهُ التَّوْبَةُ النَّصُوحُ
" তাদের ওজর কবুল করা হবে এবং তারা প্রশংসিত হবে আল্লাহ ও তার রাসূলের কল্যাণকামিতার শর্তে। কেননা, তাদের মধ্য থেকে যে জিহাদ থেকে পেছনে রয়ে গেল আর তার অবস্থা এমন যে, সে কল্যাণকামী নয়; বরং সে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায়, শহরস্থ লোকদের অন্তরে ফাটল ধরানোর চেষ্টা চালায়, তবে সে তিরস্কৃত ও শাস্তির উপযুক্ত হবে। আর মুসলমানদের জিহাদে উদ্বুদ্ধ করা, তাদের সামনে জিহাদের গুরুত্ব ও ফজিলত তুলে ধরা এবং তাদের পারস্পরিক অবস্থা পরিশুদ্ধ করার প্রয়াস চালানো এগুলোও আল্লাহ তাআলার কল্যাণকামিতার অন্তর্ভুক্ত। এছাড়াও এই জাতীয় অন্যান্য কাজ, যার দ্বারা দ্বীনের উপকার হয়। পাশাপাশি তাকে এক্ষেত্রে কপটতা থেকে মুক্ত থাকতে হবে। কেননা, প্রকৃত কল্যাণকামিতা একেই বলে। আর এ অর্থেই বলা হয়, তাওবাতুন নাসুহা বা নির্ভেজাল তাওবা।' ( আহকামুল কুরআন: ৩/১৮৬)
★★ ইমাম রাজি রহিমাহুল্লাহ বলেন:
وَهُوَ قَوْلُهُ ٭ إِذَا نَصَحُوا لِلَّهِ وَرَسُولِهِ وَمَعْنَاهُ أَنَّهُمْ إِذَا أَقَامُوا فِي الْبَلَدِ احْتَرَزُوا عَنْ إِلْقَاءِ الْأَرَاجِيفِ٭ وَعَنْ إِثَارَةِ الْفِتَنِ٭ وَسَعَوْافِي إِيصَالِ الْخيْرِ إِلَی الْمُجَاهِدِينَ الَّذِينَ سَافَرُوا٭ إِمَّا بِأَنْ يَقُومُوا بِأَنْ يَقُومُوا بِإصْلَاحِ مُهِمَّتِ بُيُوتِهِمْ٭ وَإِمَّا بِأَنْ يَسْعَوْا فِي إِصَالِ الْأَخْبَارِ السَّارَّةِ مِنْ بُيُو تِهِمْ إِلَيْهِمْ٭ فَإِنَّ جُمْاَةَ هَذِهِ لْأُمُورِ جَارِيَةٌ مَجْرَیَ الْإِعَانَةِ عَلَی الْجِهَادِ
"আল্লাহ তাআলার বাণী( إِذَا نَصَحُوا لِلّهِ وَرَسُولِهِ) এর অর্থ হলো, তারা শহরে অবস্থানকালে গুজব, মিথ্যা ও মনগড়া খবর ছাড়ানো থেকে এবং ফিতনা ছড়ানো থেকে বিরত থাকবে। যেসব মুজাহিদ জিহাদে গিয়েছে তাদের উপকার করার চেষ্টা করবে। তা হতে পারে তাদের পরিবার-পরিজনের খুশির সংবাদগুলো মুজাহিদদের কাছে পৌঁছানোর মাধ্যমে। কেননা, এসব বিষয় জিহাদে সহায়তার অন্তর্ভুক্ত।' ( তাফসিরে রাজি: ৮/১১৯)
★★ ইমাম ইবনে কাসির রহিমাহুল্লাহ বলেন:
فَلَيْسَ عَلَی هَؤُلَاءِ حَرَجِ إِذَا قَعَدُوا وَنَصَحُوا فِي حَالِ قُعُودِهِمْ٭ وَلَمْ يُرْجِفُوا بِالنَّاسِ٭ وَلَمْ يُثَبِّطوهم٭ وَهُمْ مُحْسِنُونَ فِي حَالِهِمْ هَذَا
" অতএব তাদের (মাজুরদের) কোনো গুনাহ হবে না, যখন তারা (ওজরবশত) জিহাদে অংশগ্রহণ না করলেও এ অবস্থায় (জিহাদের ব্যাপারে) কল্যাণকামী হয়, লোকদের মাঝে ভীতি ছড়িয়ে তাদের সন্ত্রস্ত না করে, তাদেরকে জিহাদে নিরুৎসাহিত না করে এবং তাদের এই অবস্থায় সত্যনিষ্ঠ হয়।' (তাফসিরে ইবনে কাসির: ৪/১৯৮)
** ইমাম কুরতুবি রহিমাহুল্লাহ বলেন:
إِذَا نَصَحُوا لِلَّهِ وَرَسُولِهِ٭ إِذَا عَرَفُوا الْحَقَّ وَأَحَبُّوا أَوْلِيَاءَهُ وَأَبْغَضُوا أَعْدَاءَهُ
"যদি তারা আল্লাহ ও তার রাসূলের কল্যাণকামী হয় অর্থাৎ হক ও সত্যকে জানে, সত্যপথের পথিকদের ভালোবাসে এবং সত্যের দুশমনদের প্রতি বিদ্বেষ রাখে।'( তাফসিরে কুরতুবি: ৮/২২৬)
## আল্লামা সাদি রহিমাহুল্লাহ কল্যাণকামিতার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন:
' এই নিয়ত ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞা রাখবে যে, যখনই সামর্থ্য হবে জিহাদে অংশগ্রহণ করবে।'( তাফসিরে সাদি: ৩৪৭পৃ.)
@@এখানে আমরা কল্যাণকামিতায় পরিচায়ক বেশ কিছু করণীয় পেলাম। যথা:
১. হক জিহাদ কোনটি তা জানা।
২. হকপন্থী মুজাহিদদের প্রতি মুহাব্বত রাখা।
৩. তাদের দুশমনদের প্রতি বিদ্বেষ রাখা।
৪. পাকাপোক্ত নিয়ত ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞা রাখা যে, যখনই সামর্থ্য হবে জিহাদে শরিক হবে।
৫. মুজাহিদদের প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের খোঁজখবর রাখা এবং তা সরবরাহে যথাসাধ্য সহায়তা রাখা।
৬. মুজাহিদদের পরিবারের দেখভাল করা।
৭. পরিবার-পরিজনের খুশির সংবাদগুলো তাদের কাছে পোঁছানোর মাধ্যমে তাদের উপকার করার চেষ্টা করা।
৮. মুসলমানদেরকে জিহাদে উৎসাহী করে তোলা এবং জিহাদের জন্য তারগিব দেওয়া। তাদেরকে দৃঢ়চিত্ত ও সাহসী করে তোলা।
৯. তাদের পারস্পরিক অবস্থা সংশোধনের প্রয়াস চালানো।
১০. গুজব, মিথ্যা ও মনগড়া খবর ছড়ানো থেকে বিরত থাকা।
১১. ফিতনা ছড়ানো থেকে বিরত থাকা।
১২. বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করা।
১৩. লোকদের অন্তরে ফাটল ধরানোর চেষ্টা না করা।
১৪. কাউকে জিহাদের প্রতি নিরুৎসাহী না করা।
★★আমাদের অবস্থা কী?
** আমরা নিজেদের সামর্থ্যহীন মনে করলেও শরিয়তের দৃষ্টিতে দুয়েকজন ছাড়া আমাদের কেউই সামর্থ্যহীন নয়। কিছুক্ষণের জন্য যদি ধরেও নিই আমরা সামর্থ্যহীন তাহলে কি আমরা সামর্থ্যহীনদের জন্য শরিয়া-প্রদত্ত করণীয় কাজগুলো করছি? কল্যাণকামিতার দায়িত্ব আদায় করছি? বরং উল্টো আমাদের অনেক দুর্ভাগা ভাই জিহাদের বিকৃত ব্যাখ্যা দিচ্ছে, মুজাহিদদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটাচ্ছে, তাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করছে। আসতাগফিরুল্লাহ! এহেন জঘন্য কর্মে তো বেইমান হয়ে যাওয়ার আশষ্কা আছে। আল্লাহ আমাদের হিফাজত করুন।
{{দুই}}
★★ এ পর্যায়ে এসে হয়তো বলা হবে, মেনে নিলাম আমরা মাজুর বা সামর্থ্যহীন নই এবং আমাদের ওপর জিহাদ ফরজ। কিন্তু কাফিরদের মোকাবেলা করার জন্য আমাদের শক্তি কোথায়? তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করার সক্ষমতা আমাদের নেই। কোথায় তাদের শক্তি আর কোথায় আমাদের শক্তি?
" আমাদের সক্ষমতা নেই' কথাটি পুরোপুরি সঠিক নয়। আমরা মূলত জিহাদি কার্যক্রম ছেড়ে আত্মপ্রতিষ্ঠার ধান্দায় ব্যস্ত আছি। শয়তান ও তার দোসররা কাফিরদের শক্তিকে আমাদের সামনে বড় করে দেখিয়েছে। ময়দানে অবর্তীণ হওয়ার পর যে আল্লাহর নুসরত ও সাহায্য আসে তা আমরা ভুলে গেছি। বেশি দূরে যেতে হবে না, সুপার পাওয়ার রাশিয়া আফগান মোল্লাদের মার খেয়ে পালিয়েছে বেশি দিন হয়নি। তার অল্প কয়েক বছর পরেই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে আবার হামলা করে আরেক সুপার পাওয়ার আমেরিকা। রাশিয়া পালিয়েছে পনেরো বছরের মাথায় আর আঠারো বছরের মাথায় এসে আমেরিকাও এখন পালানোর পথ খুঁজছে। এর চেয়ে স্পষ্ট নজির আর কী লাগে? কীসের শক্তি আছে আফগানিদের হাতে?
অতএব, আমাদের শক্তি নেই কথাটি ঠিক নয়। সারা দুনিয়ার মুসলমানগণ যদি আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী নিজেদের জান-মাল কুরবান করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়, তাহলে দুনিয়ার কুফরি শক্তি তাদের সামনে দুদিনও টিকতে পারবে না। তারপরও যদি মেনে নেওয়া হয় যে, আমরা মোকাবেলায় সক্ষম নই, তাহলে এমতাবস্থায় আমাদের করণীয় কী? উদ্ভূত পরিস্থিতিতে শরিয়ত আমাদের কী করতে বলে? এখন আমাদের কাজ কি ঘরে বসে থাকা?
আমাদের অনেকেই মনে করেন যে, জিহাদ মানে অস্ত্র নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া। যারা জিহাদের কথা বলেন, তারাও আবেগের বশে অনেক সময় বিষয়টি এভাবেই তুলে ধরেন। জিহাদপ্রেমী অনেক ভাই মনে করেন, আমাদের যেহেতু সক্ষমতা নেই, তাই আমাদের ওপর জিহাদ ফরজই হয়নি। আবার অনেকে মনে করেন, ফরজ তো হয়েছে, কিন্তু শক্তি না থাকার কারণে তা আদায় করা ফরজ হয়নি।
আসলে এই উভয় প্রান্তিকতার কোনোটিই সঠিক নয়। শক্তি থাক বা না থাক এই মুহূর্তেই মাঠে নামতে হবে' এটা যেমন ঠিক নয়, তেমনি শক্তি নেই তাই জিহাদও ফরজ নয়' এটাও সঠিক নয়।
এমতাবস্থায় শরিয়তের বিধান হচ্ছে ই'দাদ বা যুদ্ধের সক্ষমতা অর্জনের প্রচেষ্টা চালানো। ইদাদ ফরজ হওয়ার ব্যাপারে উম্মতের কারও দ্বিমত নেই। ই'দাদ যখন এমন পর্যায়ে পৌঁছাবে যে, সশস্ত্র লড়াইয়ের সক্ষমতা অর্জিত হয়ে যাবে তখন জিহাদ শুরু করবে ই'দাদ। অজু নেই বলে যেমন সালাত তরক করার সুযোগ নেই, তেমনি সক্ষমতা নেই বলে জিহাদ পরিত্যাগ করারও কোনো সুযোগ নেই। সুতরাং সক্ষমতা নেই বলে বসে থাকা আত্মপ্রবঞ্চনা ছাড়া কিছু নয়।
** আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَأَعِدُّوا لَهُمْ مَا اسْتَطَعْتُمْ مِنْ قُوَّةٍ وَمِنْ رِبَاطِ الْخَيْلِ تُرْهِبُونَ بِهِ عَدُوَّ اللهِ وَعَدُوَّكُمْ
" তোমরা তাদের মোকাবিলার জন্য যথাসাধ্য শক্তি ও অশ্ববাহিনী প্রস্তুত রাখবে। এর মাধ্যমে তোমরা ভীতসন্ত্রস্ত রাখবে আল্লাহর শত্রুকে এবং তোমাদের শত্রুকে।' (সূরা আনফাল: ৬০)
** এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম জাসসাস রহিমাহুল্লাহ বলেন:
أَمَرَ اللهُ تَعَالَی الْمُؤْمِنِينَ فِي هَذِهِ الْآيَةِ بِإِعْدَادِ السِّلَاحِ وَالْكُرَاعِ قَبْلَ وَقْتِ الْقِتَالِ إِرْهَابًا لِلْعَدُوِّ وَالتَّقَدُّمِ فِي ارْتِبَاطِ الْخَيْلِ اسْتِعْدَادًا لِقِتَالِ الْمُشْرِكِينَ
" আল্লাহ তাআল এই আয়াতে দুশমনদের ভীত-সন্ত্রস্ত রাখতে এবং কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পূর্বপ্রস্তুতিরূপে ইমানদারদের যুদ্ধের সময় আসার আগেই অস্ত্রশস্ত্র ও ঘোড়া প্রস্তুতকরণ এবং অশ্ববাহিনী গঠনে অগ্রগামিতা অর্জনের নির্দেশ দিয়েছেন।'( আহকামুল কুরআন: ৩/৮৮)
♦♦ই'দাদ দুই প্রকার।♦♦
১. ই'দাদে ইমানি বা শরয়ি দলিলের আলোকে জিহাদ বোঝা এবং সংশ্লিষ্ট মাসআলা-মাসায়িল শেখা।
২. ই'দাদে আসকারি বা সামরিক প্রস্তুতি।
* কুরআন-সুন্নাহর সুস্পষ্ট ভাষ্য ও উম্মাহর ঐকমত্যে উভয় প্রকার ই'দাদই ফরজ। আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন। আমরা প্রথম প্রকারের ই'দাদও ছেড়ে দিয়েছি; অথচ এটি করতে আমাদের কোনো বাধা নেই। চিন্তা করে দেখুন, ইমানের অবস্থা কত শোচনীয় হলে আর দ্বীনের প্রতি কতটুকু অবহেলা থাকলে এটি সম্ভব!
* আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَلوْأَرَادُوا الْخُرُوجَ لَأَعَدُّوا لَهُ عُدَّةً وَلَكِنْ كَرِهَ اللهُ انْبِعَاثَهُمْ فَثَبَّطَهُمْ وَقِيلَ اقْعُدُوا مَعَ الْقَاعِدِينَ
" তাদের যদি সত্যিই(জিহাদে) বের হওয়ার ইচ্ছা থাকত, তাহলে তারা এর জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করত। কিন্তু তাদের অভিযাত্রা আল্লাহর মনঃপুত ছিল না। সুতরাং তিনি তাদেরকে বিরত রাখলেন এবং তাদেরকে বলা হলো, যারা বসে থাকে তাদের সঙ্গে তোমরাও বসে থাকো।'( সূরা তাওবা: ৪৬)
★★ আফসোস!
এই আয়াতের সম্বোধন কি আমাদের বিদ্যমান অবস্থাকে নির্দেশ করছে না? আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন। আমল করার তাওফিক দিন। নিফাক থেকে হিফাজত করুন।
{{তিন}}
** যদি বলা হয়, আমাদের মোটেও শক্তি নেই, তবে তা একটি অবান্তর দাবি। হ্যাঁ, এ কথা ঠিক যে, আমাদের শক্তি তাদের চেয়ে অনেক কম। কিন্তু শক্তির সমতা তো জিহাদের জন্য শর্ত নয়। বিশেষ করে দিফায়ি জিহাদ বা প্রতিরোধমূলক যুদ্ধের জন্য তো মোটেই শর্ত নয়।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, শক্তি কোনোদিন বিজয় দেয় না। বিজয়ের জন্য শক্তি শর্ত নয়; বরং ইমান ও সবর শর্ত। এই দুই শর্ত পূর্ণ করতে পারলেই আল্লাহ বিজয় দান করার প্রতিশ্রুতা দিয়েছেন। নিশ্চয় আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য।
## আল্লাহ তাআলা বলেন:
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنْ تَنْصُرُوا اللهَ يَنْصُرْكُمْ وَيُثّبِتْ أَقْدَامَكُمْ
" হে মুমিনগণ, তোমরা যদি আল্লাহকে সাহায্য করো, তাহলে তিনি তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের অবস্থান সুদৃঢ় করবেন।' (সূরা মুহাম্মাদ: ৭)
وَإِنْ تَصْبِرُوا وَتَتَّقُوا لَا يَضُرُّكُمْ كَيْدُهُمْ شَيْئًا
" যদি তোমরা ধৈর্যশীল হও এবং মুত্তাকি হও, তবে তাদের ষড়যন্ত্র তোমাদের কিছুই ক্ষতি করতে পারবে না।'( সূরা আলি-ইমরান: ১২০)
لَقَدْ نَصَرَكُمُ اللهُ فِي مَوَاطِنَ كَثِيرةٍ وَيَوْمَ حُنَيْنٍ إِذْ أَعْجَبَتْكُمْ كَثْرَتُكُمْ فَلَمْ تُغْنِ عَنْكُمْ شَيْئًا
" আল্লাহ তাআলা তো তোমাদের সাহায্য করেছেন বহু ক্ষেত্রে এবং হুনাইনের যুদ্ধের দিনেও, যখন তোমাদের উৎফুল্ল করেছিল তোমাদের সংখ্যাধিক্য; কিন্তু তা তোমাদের কোনো কাজে আসেনি।' ( সূরা তাওবা:২৫)
كَمْ مِنْ فِئَةٍ قَلِيلَةٍ غَلَبَتْ فِئَةً كَثِيرَةً بِإِذْنِ اللهِ وَالله مَعَ الصَّابِرِينَ
" আল্লাহর হুকুমে কত ক্ষুদ্র দল কত বৃহৎ দলকে পরাভূত করেছে! আর আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।'
(সূরা বকারা:২৪৯)
{{চার}}
** সহিহ মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে:
لَا تَزَالُ طائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِی يُقَاتِلُونَ عَلَی الْحَقِّ ظَاهِرِينَ إِلَی يَوْمِ الْقِيَامَةِ
" আমার উম্মতের একদল লোক সত্য দ্বীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত থেকে কিয়ামত পর্যন্ত বাতিলের বিরুদ্ধে লড়তে থাকবে।'( সহিহ মুসলিম: ৪১২)
★★ এখানে(طَائِفَةٌ) শব্দ এসেছে। এর অর্থ মানুষের মধ্য থেকে একটি দল। এতে বোঝা যায় তারা সংখ্যায় কম হবে। আর যুগে যুগে এই অল্প সংখ্যক মানুষের দলটিই বিজয় হবে। সুতরাং সংখ্যায় ও শক্তিতে কম হওয়া এটিই সত্যপথের পথিকদের অনিকার্য বৈশিষ্ট্য। এতে হতাশ হওয়ার কিছু নেই।
{{পাঁচ}}
*পৃথিবীর ইতিহাসে যত জিহাদ সংঘটিত হয়েছে প্রায় সবগুলোতেই মুসলমানরা সংখ্যায় ও শক্তিতে দুর্বল মুসলমানরাই জিহাদের মাধ্যমে পৃথিবীর তাবৎ শক্তিকে পরাজিত করেছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জিহাদের মাধ্যমে নিজেদের দ্বীন, ভূমি ও মর্যাদার হিফাজত করেছে। যখনই তারা জিহাদে ঝাঁপিয়ে পড়েছে আল্লাহর সাহায্যে তারা বিজয় লাভ করেছে। হারানো ভূমি পুনরোদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে। জিহাদের কারণে কখনো তারা ক্ষতির সম্মুখীন হয়নি। ইতিহাসে যতবারই ইসলাম ও মুসলমানদের ওপর বিপর্যয় নেমে এসেছে, জিহাদ পরিত্যাগের কারণেই নেমে এসেছে। আমাদের বর্তমান বিপর্যয়ের মৌলিক করণ জিহাদ পরিত্যাগ।
গাজওয়ায়ে বদর থেকে শুরু হয়েছে জিহাদের পবিত্র ইতিহাস। রাসুলুল্লাহর নেতৃত্বে প্রায় নিরস্ত্র ৩১৩ জন মুজাহিদের মাধ্যমে উদ্বোধন হয় এই অভিযাত্রার। শত্রু শিবিরে ছিল এক হাজারেরও অধিক-পূর্ণ সশস্ত্র সৈন্য। এরপর উহুদ, খন্দক, তাবুক হয়ে চলতে থাকে এই ধারা। খুলাফায়ে রাশিদিনের যুগে সংগঠিত ইয়ারমুক যুদ্ধে মুসলমানদের সৈন্য সংখ্যা ছিল মাত্র ২৪,০০০ আর রোমানদের সংখ্যা ছিল ২,৪০,০০০। কাদিসিয়ার যুদ্ধে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩৬,০০০ আর কাফিরদের সংখ্যা ছিল দুই লক্ষাধিক। সামরিক সরঞ্জামেও তারা সমৃদ্ধ ছিল। মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু অভিযান, তারিক বিন জিয়াদের আন্দালুস বিজয়, আইনে জালুতের যুদ্ধ, হিত্তিনের যুদ্ধ, মাহমুদ গজনবির ভারত আক্রমণসহ মুসলমানদের যত বিজয়াভিযান ইতাহাসের পাতায় সংরক্ষিত আছে, সবগুলো অভিযানে মুসলমানরা সামরিক শক্তিতে কাফিরদের চেয়ে বহুগুণে দুর্বল ছিল।
আমাদের আকাবিরের মধ্যে সাইয়েদ আহমদ বেরলবি রহিমাহুল্লাহ-এর নাম এখানে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। ইজ হাব্বাত রিহুল ইমান' গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে যে, ইংরেজ, শিখ ও মারাঠা বাহিনী যখন ইসলামকে চিরতরে নিশ্চিহৃ করে দিতে উদ্যত হয় এবং মুসলমানদের ব্যাপকহারে নিধন করতে শুরু করে তখন সাইয়েদ আহমাদ বেরলবি রহিমাহুল্লাহ মুসলমানদের সংগঠিত করতে লেগে যান। মাওলানা ইসমাইল শহিদ রহিমাহুল্লাহ ও মাওলানা আব্দুল হাই রহিমাহুল্লাহ - এর মতো যশস্বী আলিমরা তাঁর সহযোগী হন। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি জিহাদের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন। তিনি যখন লাহোরের মহারাজার বিরুদ্ধে প্রথম অস্ত্র ধরেন তখন তার সাথে ছিল ৭০০ মুজাহিদ। পক্ষান্তরে শত্রুশিবিরে ছিল ৭,০০০ সৈনিক। এই অসম লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত মুজাহিদরাই বিজয়ী হয়। কী ছিল তখন আমাদের এই পুণ্যাত্মা পূর্বসূরিদের হাতে?! জিহাদের এই অমর সিপাহসালার বালাকোট প্রান্তরে শহিদ হন। তাঁর সাথে শহিদ হন মাওলানা ইসমাইল রহিমাহুল্লাহ। তাদের এই জিহাদ কি তবে অবৈধ জিহাদ ছিল?
অনুরূপভাবে হজরত কাসেম নানুতুবি রহিমাহুল্লাহ, হাজি ইমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মক্কি রহিমাহুল্লাহ, রশিদ আহমদ গাঙ্গহি রহিমাহুল্লাহ, প্রমুখ বীর মুজাহিদগণ যখন শামেলির প্রান্তরে ব্রিটিশ বাহিনীর মুখোমুখি হন, তখন তাদের কীসের শক্তি ছিল? সুসংগঠিত ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মতো কী ছিল তাদের?
সর্বশেষ নিরস্ত্র আফগান মুজাহিদদের হাতে বিশ্বের সর্বাধুনিক অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত সুপার পাওয়ার সোভিয়েত ইউনিয়নের লজ্জাজনক পরাজয় এই ধারাবাহিকতারই ফসল। দীর্ঘ পনেরো বছরের যুদ্ধে রুশ হায়েনারা এতটাই পর্যদুস্ত হয়ে পড়েছিল যে, তাদের সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। কী ছিল আফগান মুজাহিদদের হাতে? কিছুই ছিল না। কেবল ছিল ইমান ও সবর। রুশদের বিদায়ের পর অল্প সময়ের ব্যবধানে আরেক সুপার পাওয়ার আমেরিকা হামলা করে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইমারতে ইসলামিয়া আফগানিস্তানে। আলহামদুলিল্লাহ! আঠারো বছরের যুদ্ধ শেষে আমেরিকাও পালানোর রাস্তা খুঁজছে। বিশ্বজুড়ে আজ মুজাহিদরা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। আফ্রিকা মহাদেশে তাদের ধারাবাহিক বিজয়াভিযান সমূহ তার সুস্পষ্ট প্রমাণ। আল্লাহর রহমতে জাজিরাতুল আরব, সিরিয়া, লেবানন, তিউনিসিয়া, ইরাক, ইয়েমেন ও কাশ্মীরসহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে আজ মুজাহিদরা তাদের শক্তিমত্তা ও সাহসের স্বাক্ষর রাখছে। দ্রুত প্রস্তুত হচ্ছে ইমাম মাহদির সৈন্যবাহিনী।
সুতরাং বদর, উহুদ, ইয়ারমুক, কাদিসিয়া, আইনে জালুত আর হিত্তিন যে এ যুগেও সংগঠিত হতে পারে, তা আমাদের সামনে পরিষ্কার। চোখের সামনে এত স্পষ্ট দৃষ্টান্ত থাকার পরও যারা শক্তিহীনতার অজুহাত দিয়ে ঘরে বসে থাকার সুযোগ খুঁজেন, তাদের হিদায়াতের জন্য দুআ করা ছাড়া আর কিই-বা করার থাকে!
পরিশেষে বলব, আমরা যদি প্রকৃত মুমিন হতে চাই এবং আখিরাতে মুক্তি পেতে চাই তাহলে নিজেদেরকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের শরিয়তের সামনে পরিপূর্ণভাবে সমর্পণ করতে হবে। বিভিন্ন অজুহাত খাড়া করে দ্বীনকে বিকৃত করার মতো জঘন্য অপরাধ যেন আমরা না করি। সবসময় দুআ করি, আল্লাহ যেন আমাদের হকের ওপর অটল রাখেন। ইমানি দুর্বলতার কারণে যদি আমরা জিহাদে অংশগ্রহণ করতে নাও পারি, অন্তত জিহাদের বিরোধিতা কিংবা বিকৃতিতে লিপ্ত হয়ে নিজেদের ইমান যেন নষ্ট না করি। আল্লাহ তাআলা আমাদের সিরাতে মুসতাকিমের ওপর অবিচল রাখুন। আমিন।
Comment