সংশয় নিরসন সিরিজ_ *জিহাদ সিরিজ_ ষষ্ঠ সংশয়: নফসের জিহাদই কি আসল জিহাদ?
একের পর এক মুসলিম ভূমি আক্রান্ত হচ্ছে। বিরান হয়ে যাচ্ছে মুসলিম জনপদ। ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে দ্বীনের মর্যাদা। বাতাসে ভেসে আসছে সম্ভ্রমহারা মা-বোনদের করুণ আর্তচিৎকার। বোমার আঘাতে ছিন্ন ভিন্ন হচ্ছে ফুলের মতো শিশুতের কোমল শরীর। জিহাদ ফরজে আইন হয়ে গেছে প্রতিটি মুসলিম নর-নারীর ওপর। এমতাবস্থায় সে ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে আছে। আল্লাহর জিকির করছে চোখ-কান বন্ধ করে। নিমগ্ন আছে আত্মশুদ্ধির সাধনায়। আর বলছে, আমি প্রকৃত জিহাদে আছি। উত্তম জিহাদ আমিই করছি।
নফসের জিহাদই তো আসল জিহাদ। হাদিসে এটিকেই বড় জিহাদ বলা হয়েছে। আমরা যেহেতু খানকাহ ও পির-মুরিদির মাধ্যমে নফসের জিহাদে আত্মনিয়োগ করেছি, তাই বগ জিহাদ ছেড়ে আমাদের ছোট জিহাদ করার দরকার নেই। একশ্রেণির পথভ্রষ্ট সুফি নিজের মুরিদদেরকে খানকায় আটকে রাখার জন্য এই ধরনের সংশয় ও বিভ্রান্তি ছড়িয়ে থাকে। চলুন, শরিয়তের আলোকে এই দাবি কতটুকু সঠিক দেখা যাক?
*সংশয় নিরসন*
কথিত আছে, যে, রাসূলﷺতাবুক যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তনকালে ইরশাদ করেছেন:
قَدِمْتُمْ خَيْرَ مَقْدَمٍ ٭ مِنَ الْجِهَادِ الأَصْغَرِ إِلَی الْجِهَادِ الْأَكْبَرِ٭ قَالُوْا٭ وَمَا الْجِهَادُ الْأَكْبَرُ؟ قَالَ مُجَاهَدَةُ الْعَبْدِ هَوَاهُ
'তোমাদের আগমন শুভা হোক! তোমরা ছোট জিহাদ থেকে প্রত্যাবর্তন করে বড় জিহাদের দিকে ফির আসলে। সাহাবায়ে কিরাম রাযিঅাল্লাহু আনহু জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল, বড় জিহাদ কোনটি? প্রত্যুত্তরে রাসূলﷺবললেন, বান্দার নফসের সাথে সংগ্রাম করা।'(আজ-জুহদুল কাবির, বাইহাকি:৩৯৪)
প্রথমর আমরা হাদিসটির মান যাচাই করব। দেখা যাক, এটি সম্পর্কে হাদিসশাস্ত্রের ইমামগণের মতামত কী?
হাদিসটির তাহকিক:
ইমাম জাহাবি রহিমাহুল্লাহ বলেন, এটি ইবরাহিম বিন আবি আবলার বাণী: রাসূলুল্লাহﷺ-এর হাদিস নয়।'
(সিয়ারু আলামিন নুবালা:১১/৩৯৫)
ইবনে হাজার আসকালানি রহিমাহুল্লাহ সরাসরি এটিকে জাল ও বানোয়াট বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি এ হাদিসের ব্যাপারে 'তাসদিদুল কাওস' কিতাবে বলেন, এই কথাটি লোকমুখে প্রসিদ্ধ হাদিস। কিন্তু এটি মূলত ইবরাহিম বিন আবি আবলা এর উক্তি, রাসুলুল্লাহﷺ-এর হাদিস নয়।
(কাশফুল খাফা ওয়া মুজিবুল ইলবাস: ১/৪৮৬)
ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহিমাহুল্লাহ এই হাদিসটির ব্যাপারে বলেন, এর কোনো ভিত্তি নেই।
(মাজমুউল ফাতাওয়া: ১১/১৯৭)
ইমাম বাইহাকি রহিমাহুল্লাহ হাদিসটি বর্ণনা করে বলেছেন, এই হাদিসের সনদ দুর্বল।
(আজ-জুহদুল কাবির: হাদিস নং ৩৮৪)
ইমাম জামালুদ্দিন জাইলায়ি রহিমাহুল্লাহ হাদিসটি সম্পর্কে বলেন, এটি নিতান্ত দুর্বল এবং মুহাদ্দিসদের নিকট অপরিচিত।(তাখরিজু আহাদিসিল কাশশাফ: ২/৩৯৫; আদ্দুরারুল মুনতাসিরা: ১/১১)
সুতরাং বোঝা গেল, হাদিসটি জাল বা অগ্রহণযোগ্য। এই হাদিস দিয়ে দলিল দেওয়া কোনোভাবেই সহিহ হবে না। তাছাড়া হাদিসটি পবিত্র কুরআনের সঙ্গে সাংঘর্ষিকও বটে; অথচ বিশুদ্ধ হাদিস কখনো কুরআনের সাথে সাংঘর্ষিক হয় না।
আল্লাহ তাআল্লাহ বলেন:
فَضَّلَ اللهُ الْمُجَاهِدِينَ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ عَلَی الْقَاعِدِينَ دَرَجَةً
'যারা জান-মাল দিয়ে জিহাদ করে আল্লাহ তাদের যারা ঘরে বসে থাকে তাদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন।'
(সূরা নিসা: ৯৫)
অপর আয়াতে বলেন:
الَّذِينَ آمَنُوا وَهَاجَرُوا وَجَاهَدُوا فِي سَبِيلِ اللهِ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ أَعْظَمُ دَرَجَةً عِنْدَ اللهِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْفَائِزُونَ
'যারা ইমন আনে, হিজরত করে এবং নিজেদের সম্পদ ও জীবন দ্বারা আল্লাহর পথে জিহাদ করে তারা আল্লাহর নিকট মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ। আর তারাই হলো সফলকাম।'(সূরা তাওবা:২০)
এই জাল হাদিসটির বক্তব্য পরিত্যাজ্য হওয়ার আরও একটি কারণ হলো, এখানে বলা হচ্ছে, সাহাবিগণ ছোট জিহাদ অর্থাৎ ময়দানের লড়াই থেকে বড় জিহাদ অর্থাৎ প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধের দিকে প্রত্যাবর্তন করেছেন। এখন প্রশ্ন হলো, সাহাবিদের জিহাদ কি এমন ছিল যে, এতে শরিয়তের সীমারেখা, আত্মশুদ্ধি ও কুপ্রবৃত্তির বিরোধিতার প্রতি লক্ষ্য রাখা হতো না? বরং মদিনায় ফিরে এসে আত্মশুদ্ধি ও মুজাহাদায় নিমগ্ন হতেন? এটি তো স্পষ্ট ভ্রান্ত একটি কথা! বস্তুত জিহাদের মাঝে কী পরিমাণ মুজাহাদা ও কুপ্রবৃত্তির বিরোধিতা করতে হয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নিজের জান-মাল উৎসর্গ করার চেয়ে বড় মুজাহাদা ও আত্মশুদ্ধি আর কীসে হতে পারে?! ঘরবাড়ি ও পরিবার-পরিজন সব কিছু ছেড়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রণাঙ্গনে চলে যাওয়া কার পক্ষে সম্ভব? জীবনের মায়া, সম্পদের ভালোবাসা, স্ত্রী-সন্তানের মহাব্বত বিসর্জন দিয়ে নফস ও প্রবৃত্তিকে দু'পায়ে পিষে না ফেলতে পারলে জিহাদে যাওয়া কীভাবে সম্ভব?
আল্লাহ তাআলা বলেন:
كُتِبَ عَلَيْكُمْ الْقِتَالُ وَهُوَ كُرْهٌ لَكُمْ
'তোমাদের ওপর জিহাদ ফরজ করা হয়েছে, যদিও তা তোমাদের নিকট অপ্রিয়।'(সূরা বাকারা: ২১৬)
অতএব, প্রমাণিত হলো, এই হাদিসটি সনদের বিচারে জাল ও বানোয়াট এবং অর্থের বিচারেও কুরআনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় অগ্রহণযোগ্য।
জিহাদে আকবর বা বড় জিহাত কী?
সিরিজের প্রথম পর্বে আমরা জিহাদের শাব্দিক ও পারিভাষিক অর্থ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। বিভিন্ন হাদিসে নফস ও প্রবৃত্তির বিরোধিতাকে জিহাদ বলা হলেও তা পারিভাষিক জিহাদ নয়। এটি আভিধানিক অর্থে জিহাদ। আর ইবাদতের ক্ষেত্রে পারিভাষিক ও শরয়ি অর্থই প্রযোজ্য। জিহাদে আকবার কী, তা নিয়ে এখানে লম্বা আলোচনার সুযোগ নেই। শুধু দুটি উদ্ধৃতি দিয়েই শেষ করব।
আল্লামা শাওকানি রহিমাহুল্লাহ (وَجَاهِدُوا فِي اللهِ حَقَّ جِهَادِهِ) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন:
وَجَاهِدُوا فِي اللهِ أَيْ٭ فِي ذَاتِهِ وَمِنْ أَجْلِهِ ٭ وَالْمُرَادُ بِهِ الْجِهَادُ الْأَكْبَرُ وَهُوَ الْغَزْوُ لِلْكُفَّارِ وَمُدَافَعَتُهُمْ إِذَا غَزَوْا بِلَادَ الْمُسْلِمِينَ
'অর্থাৎ তোমরা জিহাদ করো আল্লাহর পথে এবং আল্লাহর জন্য। এখানে জিহাদ বলে জিহাদের আকবারের কথাই বোঝানো হয়েছে। আর জিহাদে আকবার হলো, কাফিরদের বিরুদ্ধে লড়াই করা এবং কাফিররা মুসলমানদের শহরে হামলা করলে তাদের প্রতিহত করা।'(ফাহুল কাদির:৩/৫৫৬)
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহিমাহুল্লাহ বলেন:
وَأَمَّا قِتَالُ الدَّفْعِ عَنِ الْحُرْمَةِ وَالدِّيْنِ فَوَاجِبٌ إِجْمَاعًا٭ فَالْعَدُوُّ الصَّائِلُ الَّذِيْ يُفْسِدُ الدِّيْنَ وَالدُّنْيَا لَا شَيْءَ أَوْجَبُ بَعْدَ الْإِيْمَانِ مِنْ دَفْعِهِ٭ فَلَا يُشْتَرَطُ لَهُ شَرْطٌ بَلْ يُدْفَعُ بِحَسَبِ الْإِمْكَانِ
'মুসলমানদের মর্যাদা ও দ্বীনের হিফাজতের জন্য আগ্রাসী শত্রুকে প্রতিহত করা সর্বসম্মতিক্রমে ফরজ। যে আগ্রাসী শত্রু মুসলমানদের দ্বীন ও দুনিয়া উভয়টিকে ধ্বংস করে, ইমান আনার পর তাকে প্রতিরোধ করার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ কোনো ফরজ নেই। আর এর জন্য কোনো শর্তও প্রযোজ্য নয়; বরং সামর্থ্য অনুযায়ী প্রতিরোধ করতে হবে। '(আল-ফাতাওয়াল মিসরিয়্যা :৪/৫০৮)
লক্ষ করুন, শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহিমাহুল্লাহ স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে, ইমান আনার পর মুসলিমদের ভূমি থেকে আগ্রাসী শত্রুকে প্রতিরোধ করার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ কোনো ফরজ নেই।
(দুই)
অনেকে আবার এই হাদিস দিয়েও দলিল দিয়ে থাকেন:
الْمُجَاهِدُ مَنْ جَاهَدَ نَفْسَهُ
'মুজাহিদ সেই যে নিজের নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ করে।'(মুসনাদে আহমাদ: ২৩৯৫৮)
অন্য রিওয়ায়েতে এসেছে:
أَفْضَلُ الْجِهَادِ مَنْ جَاهَدَ نَفْسَهُ فِیْ ذَاتِ اللهِ عَزَّوَجَلَّ
'সর্বোত্তম জিহাদ হলো আল্লাহ বিধানের ব্যাপারে নফসের সাথে জিহাদ করা।'(তাবারানি: ১৩/৫৯৬)
এই সহিহ হাদিস দুটির সাথে পূর্বোল্লিখিত জাল হাদিসের পার্থক্য হলো, এখানে সরাসরি নফসের বিরুদ্ধে জিহাদকে কাফিরদের বিরুদ্ধে জিহাদের তুলনায় বড় জিহাদ হিসাবে উল্লেখ করা হয়নি। শুধু বলা হয়েছে অন্তরের জিহাদ সর্বোত্তম জিহাদ।
এখন প্রশ্ন হলো, নফসের জিহাদ বলতে আমরা কি বুঝাব? আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে নফস যা অপছন্দ করে তা আদায় করাই অন্তরের জিহাদ বলে গণ্য হবে, তাই না? যদি তাই হয় তবে শুনে রাখুন,
আল্লাহ তাআলা নিজেই বলেছেন :
كُتِبَ عَلَيْكُمُ الْقِتَالُ وَهُوَ كُرْهٌ لَكُمْ
'তোমাদের উপর জিহাদকে ফরজ করা হয়েছে, যদিও তোমাদের নিকট তা অপছন্দনীয়।'(সূরা বাকারা: ২১৬)
অন্য কোনো আমলের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা একথা বলেননি। সুতরাং যত ইবাদত আছে তার মধ্যে কাফিরদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা মানুষের নফসের কাছে সবচেয়ে বেশি অপছন্দনীয়। তাই যারা কাফিরদের বিরুদ্ধে জিহাদ করছে, তারাই নফসের বিরুদ্ধে সর্বাপেক্ষা বেশি জিহাদ করছে।
বস্তুত নফসের বিরুদ্ধে একজন মুজাহিদের মুজাহাদার কোনো তুলনাই হতে পারে না। কারণ, সে সবচেয়ে প্রিয় বস্তু নিজের জীবনকে কুরবান করার জন্য ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ে। নিজের কষ্টার্জিত ধনসম্পদ আল্লাহর রাস্তায় দেদারসে বিলিয়ে দেয়। নিজের প্রিয় স্ত্রী ও সন্তানদের ফেলে, শান্তির বসতভিটা ছেড়ে, জীবনের সব সুখস্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে সে আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার জন্য বেরিয়ে পড়ে বিপদসংকুল পথে। যেখানে পদে পদে ভয়, শষ্কা, কষ্ট আর কুরবানির মহড়া চলে।
(তিন)
কোনো ব্যক্তি ইমানের রুকনসমূহকে স্বীকার করে না। সে বলে, মুমিন হওয়ার জন্য তাওহিদ, রিসালাত, আখিরাত ইত্যাদির ওপর ইমান আনার কোনো প্রয়োজন নেই। বরং প্রকৃত মুমিন তো সে, যার থেকে মানুষের জান-মাল নিরাপদ থাকে। আর দলিল পেশ করে এই হাদিস দিয়ে:
اَلْمُؤْمِنُ مَنْ أَمِنَهُ النَّاسُ عَلَی أَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ
'প্রকৃত মুমিন হলো ওই ব্যক্তি, যার থেকে মানুষের জান-মাল নিরাপদ থাকে।'(সুনানে ইবনে মাজাহ:৩৯৩৪)
অথবা কেউ যদি বলে, মুসলমান হওয়ার জন্য ইসলামের রুকন ও শর্তসমূহ পূরণ করার দরকার নেই। কেউ যদি আপন হাত ও জিহ্বা দ্বারা মুসলমানদের কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকে, তাহলেই সে প্রকৃত মুসলিম।
কারণ, রাসুলুল্লাহ ﷺবলেছেন :
اَلْمُسْلِمُ مَنْ سَلِمَ الْْمُسْلِمُوْنَ مِنْ لِسَانِهِ وَيَدِهِ
'প্রকৃত মুসলিম তো সে, যার মুখ ও হাত থেকে অপর মুসলমানরা নিরাপদ থাকে।'(সহিহ বুখারি: ১০)
অতএব, এগুণটি থাকলেই সে প্রকৃত মুমিন হয়ে যাবে। তার সালাত, সওম, জাকাত, হজ ইত্যাদির ঝামেলায় যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।
এখন আপনিই বলুন, এই ভ্রান্ত আকিদায় বিশ্বাসী লোকের ব্যাপারে আপনি কী বলবেন? আপনি নিশ্চয় বলবেন, লোকটি হাদিসের বিকৃত ব্যাখ্যা দিচ্ছে। এর আসল অর্থ হলো, ইমান ও ইসলামের রুকন ও শর্তসমূহ পূর্ণ করার পর ইমান ও ইসলাম পরিপূর্ণ হওয়ার জন্য এসব বলা হয়েছে। অর্থাৎ পরিপূর্ণ মুমিন হওয়ার জন্য শুধু ইমানের রুকন ও শর্তসমূহ পূর্ণ করলেই হবে না; বরং তার থেকে মানুষের জান-মালও নিরাপদ থাকতে হবে। নইলে সে পরিপূর্ণ মুমিন হতে পারবে না। পরবর্তী হাদিসের ক্ষেত্রেও একই কথা।
সুতরাং(الْمُجَاهِدُ مَنْ جَاهَدَ نَفْسَهُ) এই হাদিসটির মর্ম হলো, প্রকৃত মুজাহিদ হলো সে, যে তার নফসকে আল্লাহর আনুগত্যে নিয়োজিত করে। আল্লাহর সকল হুকুম ও বিধান বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নেয়। কাফিরদের বিরুদ্ধে জান-মাল দিয়ে জিহাদ করে; যদিও তা তার নফসের কাছে অপছন্দনীয় হয়।
(চার)
একের পর এক মুসলিম ভূমি আক্রান্ত হচ্ছে। বিরান হয়ে যাচ্ছে মুসলিম জনপদ। ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে দ্বীনের মর্যাদা। বাতাসে ভেসে আসছে সম্ভ্রমহারা মা-বোনদের করুণ আর্তচিৎকার। বোমার আঘাতে ছিন্ন ভিন্ন হচ্ছে ফুলের মতো শিশুতের কোমল শরীর। জিহাদ ফরজে আইন হয়ে গেছে প্রতিটি মুসলিম নর-নারীর ওপর। এমতাবস্থায় সে ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে আছে। আল্লাহর জিকির করছে চোখ-কান বন্ধ করে। নিমগ্ন আছে আত্মশুদ্ধির সাধনায়। আর বলছে, আমি প্রকৃত জিহাদে আছি। উত্তম জিহাদ আমিই করছি। একটু চিন্তা করে দেখুন! এটি কি নফসের জিহাদ না নফসের পুজা? এটি কি ইবলিসের ধোঁকা নয়? আল্লাহ তাআলা আমাদের হিফাজত করুন।
পরিশেষে আল্লাহর কাছে দুআ করি, তিনি যেন আমাদের বিভ্রান্তিকর সব সংশয় থেকে হিফাজত করেন এবং আমাদেরকে সিরাতে মুসতাকিমের ওপর অটল অবিচল রাখেন। আমিন। ইয়া রব্বাল আলামিন।
একের পর এক মুসলিম ভূমি আক্রান্ত হচ্ছে। বিরান হয়ে যাচ্ছে মুসলিম জনপদ। ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে দ্বীনের মর্যাদা। বাতাসে ভেসে আসছে সম্ভ্রমহারা মা-বোনদের করুণ আর্তচিৎকার। বোমার আঘাতে ছিন্ন ভিন্ন হচ্ছে ফুলের মতো শিশুতের কোমল শরীর। জিহাদ ফরজে আইন হয়ে গেছে প্রতিটি মুসলিম নর-নারীর ওপর। এমতাবস্থায় সে ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে আছে। আল্লাহর জিকির করছে চোখ-কান বন্ধ করে। নিমগ্ন আছে আত্মশুদ্ধির সাধনায়। আর বলছে, আমি প্রকৃত জিহাদে আছি। উত্তম জিহাদ আমিই করছি।
নফসের জিহাদই তো আসল জিহাদ। হাদিসে এটিকেই বড় জিহাদ বলা হয়েছে। আমরা যেহেতু খানকাহ ও পির-মুরিদির মাধ্যমে নফসের জিহাদে আত্মনিয়োগ করেছি, তাই বগ জিহাদ ছেড়ে আমাদের ছোট জিহাদ করার দরকার নেই। একশ্রেণির পথভ্রষ্ট সুফি নিজের মুরিদদেরকে খানকায় আটকে রাখার জন্য এই ধরনের সংশয় ও বিভ্রান্তি ছড়িয়ে থাকে। চলুন, শরিয়তের আলোকে এই দাবি কতটুকু সঠিক দেখা যাক?
*সংশয় নিরসন*
কথিত আছে, যে, রাসূলﷺতাবুক যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তনকালে ইরশাদ করেছেন:
قَدِمْتُمْ خَيْرَ مَقْدَمٍ ٭ مِنَ الْجِهَادِ الأَصْغَرِ إِلَی الْجِهَادِ الْأَكْبَرِ٭ قَالُوْا٭ وَمَا الْجِهَادُ الْأَكْبَرُ؟ قَالَ مُجَاهَدَةُ الْعَبْدِ هَوَاهُ
'তোমাদের আগমন শুভা হোক! তোমরা ছোট জিহাদ থেকে প্রত্যাবর্তন করে বড় জিহাদের দিকে ফির আসলে। সাহাবায়ে কিরাম রাযিঅাল্লাহু আনহু জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল, বড় জিহাদ কোনটি? প্রত্যুত্তরে রাসূলﷺবললেন, বান্দার নফসের সাথে সংগ্রাম করা।'(আজ-জুহদুল কাবির, বাইহাকি:৩৯৪)
প্রথমর আমরা হাদিসটির মান যাচাই করব। দেখা যাক, এটি সম্পর্কে হাদিসশাস্ত্রের ইমামগণের মতামত কী?
হাদিসটির তাহকিক:
ইমাম জাহাবি রহিমাহুল্লাহ বলেন, এটি ইবরাহিম বিন আবি আবলার বাণী: রাসূলুল্লাহﷺ-এর হাদিস নয়।'
(সিয়ারু আলামিন নুবালা:১১/৩৯৫)
ইবনে হাজার আসকালানি রহিমাহুল্লাহ সরাসরি এটিকে জাল ও বানোয়াট বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি এ হাদিসের ব্যাপারে 'তাসদিদুল কাওস' কিতাবে বলেন, এই কথাটি লোকমুখে প্রসিদ্ধ হাদিস। কিন্তু এটি মূলত ইবরাহিম বিন আবি আবলা এর উক্তি, রাসুলুল্লাহﷺ-এর হাদিস নয়।
(কাশফুল খাফা ওয়া মুজিবুল ইলবাস: ১/৪৮৬)
ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহিমাহুল্লাহ এই হাদিসটির ব্যাপারে বলেন, এর কোনো ভিত্তি নেই।
(মাজমুউল ফাতাওয়া: ১১/১৯৭)
ইমাম বাইহাকি রহিমাহুল্লাহ হাদিসটি বর্ণনা করে বলেছেন, এই হাদিসের সনদ দুর্বল।
(আজ-জুহদুল কাবির: হাদিস নং ৩৮৪)
ইমাম জামালুদ্দিন জাইলায়ি রহিমাহুল্লাহ হাদিসটি সম্পর্কে বলেন, এটি নিতান্ত দুর্বল এবং মুহাদ্দিসদের নিকট অপরিচিত।(তাখরিজু আহাদিসিল কাশশাফ: ২/৩৯৫; আদ্দুরারুল মুনতাসিরা: ১/১১)
সুতরাং বোঝা গেল, হাদিসটি জাল বা অগ্রহণযোগ্য। এই হাদিস দিয়ে দলিল দেওয়া কোনোভাবেই সহিহ হবে না। তাছাড়া হাদিসটি পবিত্র কুরআনের সঙ্গে সাংঘর্ষিকও বটে; অথচ বিশুদ্ধ হাদিস কখনো কুরআনের সাথে সাংঘর্ষিক হয় না।
আল্লাহ তাআল্লাহ বলেন:
فَضَّلَ اللهُ الْمُجَاهِدِينَ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ عَلَی الْقَاعِدِينَ دَرَجَةً
'যারা জান-মাল দিয়ে জিহাদ করে আল্লাহ তাদের যারা ঘরে বসে থাকে তাদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন।'
(সূরা নিসা: ৯৫)
অপর আয়াতে বলেন:
الَّذِينَ آمَنُوا وَهَاجَرُوا وَجَاهَدُوا فِي سَبِيلِ اللهِ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ أَعْظَمُ دَرَجَةً عِنْدَ اللهِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْفَائِزُونَ
'যারা ইমন আনে, হিজরত করে এবং নিজেদের সম্পদ ও জীবন দ্বারা আল্লাহর পথে জিহাদ করে তারা আল্লাহর নিকট মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ। আর তারাই হলো সফলকাম।'(সূরা তাওবা:২০)
এই জাল হাদিসটির বক্তব্য পরিত্যাজ্য হওয়ার আরও একটি কারণ হলো, এখানে বলা হচ্ছে, সাহাবিগণ ছোট জিহাদ অর্থাৎ ময়দানের লড়াই থেকে বড় জিহাদ অর্থাৎ প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধের দিকে প্রত্যাবর্তন করেছেন। এখন প্রশ্ন হলো, সাহাবিদের জিহাদ কি এমন ছিল যে, এতে শরিয়তের সীমারেখা, আত্মশুদ্ধি ও কুপ্রবৃত্তির বিরোধিতার প্রতি লক্ষ্য রাখা হতো না? বরং মদিনায় ফিরে এসে আত্মশুদ্ধি ও মুজাহাদায় নিমগ্ন হতেন? এটি তো স্পষ্ট ভ্রান্ত একটি কথা! বস্তুত জিহাদের মাঝে কী পরিমাণ মুজাহাদা ও কুপ্রবৃত্তির বিরোধিতা করতে হয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নিজের জান-মাল উৎসর্গ করার চেয়ে বড় মুজাহাদা ও আত্মশুদ্ধি আর কীসে হতে পারে?! ঘরবাড়ি ও পরিবার-পরিজন সব কিছু ছেড়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রণাঙ্গনে চলে যাওয়া কার পক্ষে সম্ভব? জীবনের মায়া, সম্পদের ভালোবাসা, স্ত্রী-সন্তানের মহাব্বত বিসর্জন দিয়ে নফস ও প্রবৃত্তিকে দু'পায়ে পিষে না ফেলতে পারলে জিহাদে যাওয়া কীভাবে সম্ভব?
আল্লাহ তাআলা বলেন:
كُتِبَ عَلَيْكُمْ الْقِتَالُ وَهُوَ كُرْهٌ لَكُمْ
'তোমাদের ওপর জিহাদ ফরজ করা হয়েছে, যদিও তা তোমাদের নিকট অপ্রিয়।'(সূরা বাকারা: ২১৬)
অতএব, প্রমাণিত হলো, এই হাদিসটি সনদের বিচারে জাল ও বানোয়াট এবং অর্থের বিচারেও কুরআনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় অগ্রহণযোগ্য।
জিহাদে আকবর বা বড় জিহাত কী?
সিরিজের প্রথম পর্বে আমরা জিহাদের শাব্দিক ও পারিভাষিক অর্থ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। বিভিন্ন হাদিসে নফস ও প্রবৃত্তির বিরোধিতাকে জিহাদ বলা হলেও তা পারিভাষিক জিহাদ নয়। এটি আভিধানিক অর্থে জিহাদ। আর ইবাদতের ক্ষেত্রে পারিভাষিক ও শরয়ি অর্থই প্রযোজ্য। জিহাদে আকবার কী, তা নিয়ে এখানে লম্বা আলোচনার সুযোগ নেই। শুধু দুটি উদ্ধৃতি দিয়েই শেষ করব।
আল্লামা শাওকানি রহিমাহুল্লাহ (وَجَاهِدُوا فِي اللهِ حَقَّ جِهَادِهِ) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন:
وَجَاهِدُوا فِي اللهِ أَيْ٭ فِي ذَاتِهِ وَمِنْ أَجْلِهِ ٭ وَالْمُرَادُ بِهِ الْجِهَادُ الْأَكْبَرُ وَهُوَ الْغَزْوُ لِلْكُفَّارِ وَمُدَافَعَتُهُمْ إِذَا غَزَوْا بِلَادَ الْمُسْلِمِينَ
'অর্থাৎ তোমরা জিহাদ করো আল্লাহর পথে এবং আল্লাহর জন্য। এখানে জিহাদ বলে জিহাদের আকবারের কথাই বোঝানো হয়েছে। আর জিহাদে আকবার হলো, কাফিরদের বিরুদ্ধে লড়াই করা এবং কাফিররা মুসলমানদের শহরে হামলা করলে তাদের প্রতিহত করা।'(ফাহুল কাদির:৩/৫৫৬)
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহিমাহুল্লাহ বলেন:
وَأَمَّا قِتَالُ الدَّفْعِ عَنِ الْحُرْمَةِ وَالدِّيْنِ فَوَاجِبٌ إِجْمَاعًا٭ فَالْعَدُوُّ الصَّائِلُ الَّذِيْ يُفْسِدُ الدِّيْنَ وَالدُّنْيَا لَا شَيْءَ أَوْجَبُ بَعْدَ الْإِيْمَانِ مِنْ دَفْعِهِ٭ فَلَا يُشْتَرَطُ لَهُ شَرْطٌ بَلْ يُدْفَعُ بِحَسَبِ الْإِمْكَانِ
'মুসলমানদের মর্যাদা ও দ্বীনের হিফাজতের জন্য আগ্রাসী শত্রুকে প্রতিহত করা সর্বসম্মতিক্রমে ফরজ। যে আগ্রাসী শত্রু মুসলমানদের দ্বীন ও দুনিয়া উভয়টিকে ধ্বংস করে, ইমান আনার পর তাকে প্রতিরোধ করার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ কোনো ফরজ নেই। আর এর জন্য কোনো শর্তও প্রযোজ্য নয়; বরং সামর্থ্য অনুযায়ী প্রতিরোধ করতে হবে। '(আল-ফাতাওয়াল মিসরিয়্যা :৪/৫০৮)
লক্ষ করুন, শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহিমাহুল্লাহ স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে, ইমান আনার পর মুসলিমদের ভূমি থেকে আগ্রাসী শত্রুকে প্রতিরোধ করার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ কোনো ফরজ নেই।
(দুই)
অনেকে আবার এই হাদিস দিয়েও দলিল দিয়ে থাকেন:
الْمُجَاهِدُ مَنْ جَاهَدَ نَفْسَهُ
'মুজাহিদ সেই যে নিজের নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ করে।'(মুসনাদে আহমাদ: ২৩৯৫৮)
অন্য রিওয়ায়েতে এসেছে:
أَفْضَلُ الْجِهَادِ مَنْ جَاهَدَ نَفْسَهُ فِیْ ذَاتِ اللهِ عَزَّوَجَلَّ
'সর্বোত্তম জিহাদ হলো আল্লাহ বিধানের ব্যাপারে নফসের সাথে জিহাদ করা।'(তাবারানি: ১৩/৫৯৬)
এই সহিহ হাদিস দুটির সাথে পূর্বোল্লিখিত জাল হাদিসের পার্থক্য হলো, এখানে সরাসরি নফসের বিরুদ্ধে জিহাদকে কাফিরদের বিরুদ্ধে জিহাদের তুলনায় বড় জিহাদ হিসাবে উল্লেখ করা হয়নি। শুধু বলা হয়েছে অন্তরের জিহাদ সর্বোত্তম জিহাদ।
এখন প্রশ্ন হলো, নফসের জিহাদ বলতে আমরা কি বুঝাব? আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে নফস যা অপছন্দ করে তা আদায় করাই অন্তরের জিহাদ বলে গণ্য হবে, তাই না? যদি তাই হয় তবে শুনে রাখুন,
আল্লাহ তাআলা নিজেই বলেছেন :
كُتِبَ عَلَيْكُمُ الْقِتَالُ وَهُوَ كُرْهٌ لَكُمْ
'তোমাদের উপর জিহাদকে ফরজ করা হয়েছে, যদিও তোমাদের নিকট তা অপছন্দনীয়।'(সূরা বাকারা: ২১৬)
অন্য কোনো আমলের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা একথা বলেননি। সুতরাং যত ইবাদত আছে তার মধ্যে কাফিরদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা মানুষের নফসের কাছে সবচেয়ে বেশি অপছন্দনীয়। তাই যারা কাফিরদের বিরুদ্ধে জিহাদ করছে, তারাই নফসের বিরুদ্ধে সর্বাপেক্ষা বেশি জিহাদ করছে।
বস্তুত নফসের বিরুদ্ধে একজন মুজাহিদের মুজাহাদার কোনো তুলনাই হতে পারে না। কারণ, সে সবচেয়ে প্রিয় বস্তু নিজের জীবনকে কুরবান করার জন্য ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ে। নিজের কষ্টার্জিত ধনসম্পদ আল্লাহর রাস্তায় দেদারসে বিলিয়ে দেয়। নিজের প্রিয় স্ত্রী ও সন্তানদের ফেলে, শান্তির বসতভিটা ছেড়ে, জীবনের সব সুখস্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে সে আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার জন্য বেরিয়ে পড়ে বিপদসংকুল পথে। যেখানে পদে পদে ভয়, শষ্কা, কষ্ট আর কুরবানির মহড়া চলে।
(তিন)
কোনো ব্যক্তি ইমানের রুকনসমূহকে স্বীকার করে না। সে বলে, মুমিন হওয়ার জন্য তাওহিদ, রিসালাত, আখিরাত ইত্যাদির ওপর ইমান আনার কোনো প্রয়োজন নেই। বরং প্রকৃত মুমিন তো সে, যার থেকে মানুষের জান-মাল নিরাপদ থাকে। আর দলিল পেশ করে এই হাদিস দিয়ে:
اَلْمُؤْمِنُ مَنْ أَمِنَهُ النَّاسُ عَلَی أَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ
'প্রকৃত মুমিন হলো ওই ব্যক্তি, যার থেকে মানুষের জান-মাল নিরাপদ থাকে।'(সুনানে ইবনে মাজাহ:৩৯৩৪)
অথবা কেউ যদি বলে, মুসলমান হওয়ার জন্য ইসলামের রুকন ও শর্তসমূহ পূরণ করার দরকার নেই। কেউ যদি আপন হাত ও জিহ্বা দ্বারা মুসলমানদের কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকে, তাহলেই সে প্রকৃত মুসলিম।
কারণ, রাসুলুল্লাহ ﷺবলেছেন :
اَلْمُسْلِمُ مَنْ سَلِمَ الْْمُسْلِمُوْنَ مِنْ لِسَانِهِ وَيَدِهِ
'প্রকৃত মুসলিম তো সে, যার মুখ ও হাত থেকে অপর মুসলমানরা নিরাপদ থাকে।'(সহিহ বুখারি: ১০)
অতএব, এগুণটি থাকলেই সে প্রকৃত মুমিন হয়ে যাবে। তার সালাত, সওম, জাকাত, হজ ইত্যাদির ঝামেলায় যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।
এখন আপনিই বলুন, এই ভ্রান্ত আকিদায় বিশ্বাসী লোকের ব্যাপারে আপনি কী বলবেন? আপনি নিশ্চয় বলবেন, লোকটি হাদিসের বিকৃত ব্যাখ্যা দিচ্ছে। এর আসল অর্থ হলো, ইমান ও ইসলামের রুকন ও শর্তসমূহ পূর্ণ করার পর ইমান ও ইসলাম পরিপূর্ণ হওয়ার জন্য এসব বলা হয়েছে। অর্থাৎ পরিপূর্ণ মুমিন হওয়ার জন্য শুধু ইমানের রুকন ও শর্তসমূহ পূর্ণ করলেই হবে না; বরং তার থেকে মানুষের জান-মালও নিরাপদ থাকতে হবে। নইলে সে পরিপূর্ণ মুমিন হতে পারবে না। পরবর্তী হাদিসের ক্ষেত্রেও একই কথা।
সুতরাং(الْمُجَاهِدُ مَنْ جَاهَدَ نَفْسَهُ) এই হাদিসটির মর্ম হলো, প্রকৃত মুজাহিদ হলো সে, যে তার নফসকে আল্লাহর আনুগত্যে নিয়োজিত করে। আল্লাহর সকল হুকুম ও বিধান বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নেয়। কাফিরদের বিরুদ্ধে জান-মাল দিয়ে জিহাদ করে; যদিও তা তার নফসের কাছে অপছন্দনীয় হয়।
(চার)
একের পর এক মুসলিম ভূমি আক্রান্ত হচ্ছে। বিরান হয়ে যাচ্ছে মুসলিম জনপদ। ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে দ্বীনের মর্যাদা। বাতাসে ভেসে আসছে সম্ভ্রমহারা মা-বোনদের করুণ আর্তচিৎকার। বোমার আঘাতে ছিন্ন ভিন্ন হচ্ছে ফুলের মতো শিশুতের কোমল শরীর। জিহাদ ফরজে আইন হয়ে গেছে প্রতিটি মুসলিম নর-নারীর ওপর। এমতাবস্থায় সে ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে আছে। আল্লাহর জিকির করছে চোখ-কান বন্ধ করে। নিমগ্ন আছে আত্মশুদ্ধির সাধনায়। আর বলছে, আমি প্রকৃত জিহাদে আছি। উত্তম জিহাদ আমিই করছি। একটু চিন্তা করে দেখুন! এটি কি নফসের জিহাদ না নফসের পুজা? এটি কি ইবলিসের ধোঁকা নয়? আল্লাহ তাআলা আমাদের হিফাজত করুন।
পরিশেষে আল্লাহর কাছে দুআ করি, তিনি যেন আমাদের বিভ্রান্তিকর সব সংশয় থেকে হিফাজত করেন এবং আমাদেরকে সিরাতে মুসতাকিমের ওপর অটল অবিচল রাখেন। আমিন। ইয়া রব্বাল আলামিন।