অনুবাদকের কথা
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার জন্য কারণ তিনিই আমাদের এই বইটি অনুবাদের সুযোগ দিয়েছেন এবং অনুবাদটি সম্পন্ন করতে সাহায্য করেছেন। তাঁর সাহায্য ব্যতীত এই কাজ সম্পন্ন করা ছিল অসম্ভব।
শুরুতেই যে কথাগুলি বলতে চাই তা হলো; এক. বইটি অনুবাদের সময় কোন আরবী শব্দের যথার্থ বাংলা সমার্থক না পাওয়া গেলে সেক্ষেত্রে আরবী শব্দই ব্যবহার করা হয়েছে। দুই. কুরআনের আয়াতের ক্ষেত্রে একটি মনে রাখতে হবে যে, এটি আল্লাহর বাণী, কোন ভাষাতেই একে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব নয়। আমরা শুধু এর অর্থ অনুবাদ করতে সক্ষম। এই অনুবাদের জন্য আমরা মূলত ইসলামী ফাউন্ডেশনের আল কুরআনুল কারীমের বঙ্গানুবাদ ব্যবহার করেছি। তিন. হাদীসের ক্ষেত্রেও সরাসরী আরবী ছাড়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী অটুট রাখা সম্ভব নয়। সুতরাং পাঠকদের মনে রাখতে হবে যে, হাদীসের অনুবাদ হাদীস নয়, এটি শুধুমাত্র হাদীসের অর্থ। এক্ষেত্রেও আমরা অধিকাংশ হাদীস ইসলামী ফাউন্ডেশনের অনুবাদকৃত সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম থেকে ব্যবহার করেছি, যেসব ক্ষেত্রে অনুবাদকৃত হাদীস পাওয়া সম্ভব হয়নি, সেসব ক্ষেত্রে আমরা যথাসম্ভব চেষ্টা করেছি হাদীসের অর্থের সাথে সঙ্গতি রাখতে। তাই আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের নিকট আমাদের দু‘আ তিনি যেন আমাদের আন্তরিকতা কবুল করেন এবং আমাদের ভুলভ্রান্তি ক্ষমা করেন, তিনি ছাড়া আমাদের আর কোন ক্ষমাকারী নেই ।
লেখকের এই বইটি লেখার উদ্দেশ্য ছিল, আল্লাহ্ তা‘আলার একটি হুকুম পালন করা, “এবং মু’মিনদেরকে (জিহাদের জন্য) উদ্বুদ্ধ কর”। আল্লাহ্ তার প্রচেষ্টা কবুল করুন এবং তাকে হিফাজত করুন। লেখকের তুলনায় আমাদের প্রচেষ্টা তো নগণ্য, তারপরও আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার আয়াত আমাদের প্রেরণা দেয়,
مَا كَانَ لِأَهْلِ الْمَدِينَةِ وَمَنْ حَوْلَهُمْ مِنَ الْأَعْرَابِ أَنْ يَتَخَلَّفُوا عَنْ رَسُولِ اللَّهِ وَلا يَرْغَبُوا بِأَنْفُسِهِمْ عَنْ نَفْسِهِ ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ لا يُصِيبُهُمْ ظَمَأٌ وَلا نَصَبٌ وَلا مَخْمَصَةٌ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَلا يَطَئُونَ مَوْطِئًا يَغِيظُ الْكُفَّارَ وَلا يَنَالُونَ مِنْ عَدُوٍّ نَيْلًا إِلا كُتِبَ لَهُمْ بِهِ عَمَلٌ صَالِحٌ إِنَّ اللَّهَ لا يُضِيعُ أَجْرَ الْمُحْسِنِينَ * وَلا يُنْفِقُونَ نَفَقَةً صَغِيرَةً وَلا كَبِيرَةً وَلا يَقْطَعُونَ وَادِيًا إِلا كُتِبَ لَهُمْ لِيَجْزِيَهُمُ اللَّهُ أَحْسَنَ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ *
“…এটা এজন্য যে আল্লাহর পথে যে তৃষ্ণা, ক্লান্তি এবং ক্ষুধা তাদের স্পর্শ করে এবং তাদের এমন পদক্ষেপ যা কাফিরদের ক্রোধের উদ্রেক করে এবং শত্রুদের নিকট থেকে তারা যা কিছু প্রাপ্ত হয়- তার প্রত্যেকটির বিনিময়ে তাদের জন্য লিখিত হয় নেক আমল। নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ সৎকর্মশীলদের প্রতিদান নষ্ট করেন না। আর তারা অল্পবিস্তর যা কিছু ব্যয় করে, যত প্রান্তর তারা অতিক্রম করে, তা সবই তাদের নামে লেখা হয়, যেন আল্লাহ্ তাদের সৎকর্মসমুহের উত্তম বিনিময় প্রদান করেন।” [সূরা আত-তাওবাহ ৯ঃ ১২০-১২১]
ইয়া রাব্বুল ’আলামীন আপনি আমাদের এই প্রচেষ্টা কবুল করুন, যা আপনারই সহায়তায় সম্পন্ন হয়েছে; আমাদের নিয়্যতকে বিশুদ্ধ করুন এবং আমাদেরকে মুজাহিদদের অন্তর্ভুক্ত করুন। হে গাফুরুর রাহীম! এই অনুবাদ করতে গিয়ে আমরা যে গাফিলতী ও সময় ক্ষেপন করেছি তার জন্য আমাদের ক্ষমা করুন এবং যে সকল ভুল ভ্রান্তি আমাদের গাফিলতিতে এবং শয়তানের প্ররোচনায় হয়েছে, সেগুলো ক্ষমা করুন; আপনি ছাড়া ক্ষমা করার আর কেউ নাই। আমীন।
سُبْحـانَكَ اللّهُـمَّ وَبِحَمدِك، أَشْهَـدُ أَنْ لا إِلهَ إِلاّ أَنْتَ أَسْتَغْفِرُكَ وَأَتوبُ إِلَـيْك.
প্রথম অধ্যায়ঃ সৃষ্টির উদ্দেশ্য
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেছেনঃ
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلا لِيَعْبُدُونِ
“আমি জ্বীন ও মানুষকে সৃষ্টি করেছি কেবলমাত্র এজন্য যে, যেন তারা আমারই ইবাদত করে।” (সূরা যারিয়াত ৫১ঃ ৫৬)
আল্লাহর রাসূলগণ যে দাওয়াত নিয়ে এসেছিলেন তারই বহিঃপ্রকাশ হলো ইবাদত। এই দুনিয়ার বুকে এমন কোন জাতি নেই যাদের কাছে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা রাসূল পাঠাননি। তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা) বলেনঃ
وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اُعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ
“আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই কোন না কোন রাসূল প্রেরণ করেছি, এ নির্দেশ প্রচারের জন্য যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাগুত থেকে দূরে থাক…..” (সূরা নাহল ১৬ঃ ৩৬)
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা) আরও বলেনঃ
إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ بِالْحَقِّ بَشِيرًا وَنَذِيرًا
“…..আর এমন কোন উম্মত ছিল না যাদের মধ্যে কোন সতর্ককারী আসেনি।” (সূরা ফাতির ৩৫ঃ ২৪)
এর দ্বারা আল্লাহ্, সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা, তাঁর হুজ্জাহ (প্রমাণ) প্রতিষ্ঠিত রেখেছেন, আদম (আঃ) থেকে শুরু করে কিয়ামত পর্যন্ত। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেনঃ
رُسُلًا مُبَشِّرِينَ وَمُنْذِرِينَ لِئَلا يَكُونَ لِلنَّاسِ عَلَى اللَّهِ حُجَّةٌ بَعْدَ الرُّسُلِ
“সুংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে রাসূলদের আমি এজন্য প্রেরণ করেছি যাতে রাসূলদের আগমণের পর মানুষের কোন ওজর আপত্তি না থাকে। আল্লাহ্ পরাক্রমশালী, হিকমাত সম্পন্ন।” (সূরা নিসা ৪ঃ ১৬৫)
নাবীগণকে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা তাদের সমসাময়িক বংশসমুহের মধ্য থেকেই আবির্ভূত করেছেন। তাদের অনুপস্থিতিতে তাদের অনুসারীগণ এই কার্যক্রম চালিয়ে যান। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেনঃ
وَمَا كَانَ رَبُّكَ مُهْلِكَ الْقُرَى حَتَّى يَبْعَثَ فِي أُمِّهَا رَسُولًا يَتْلُو عَلَيْهِمْ آَيَاتِنَا
“আর আপনার রব জনপদসমূহ ধ্বংস করেন না, যে পর্যন্ত না তিনি তার কেন্দ্রস্থলে রাসূল প্রেরণ করেন, যিনি তাদের কাছে আমার আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করেন।” (সূরা কাসাস ২৮ঃ ৫৯)
সুতরাং রাসূলগণের মৃত্যুর পর তাদের অনুসারীগণ এই দাওয়াত অব্যাহত রাখেন যাতে সৃষ্টিকুল আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার হুজ্জাহ থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়। আর এজন্যই রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “তোমরা যারা উপস্থিত আছো তারা পৌঁছে দাও (এই বাণী) তাদের কাছে যারা (এখানে) অনুপস্থিত”। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ “আমার তরফ থেকে যদি একটি আয়াতও হয় পৌঁছে দাও”। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ “আলেমগণ নাবীদের উত্তরাধিকারী”। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরও বলেনঃ “আমার উম্মতের একটি দল (তা’ইফাহ) নিরন্তর আল্লাহ্র হুকুমের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে”। উল্লেখিত সকল হাদীসই সহীহ।
ইবাদতের হুকুম হলো শারীয়াহ ভিত্তিক। অর্থাৎ নাবীদের জবান দ্বারা আল্লাহ্ তা‘আলা এসব হুকুম প্রণয়ণ করেছেন। আর এই শারীয়াহ গ্রহণ করা না করার সিদ্ধান্ত মানুষের। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার শারীয়াহ, যা তাঁর রাসূলগণের জবান দ্বারা বিবৃত, সকল সৃষ্টই মানবে এমনটি আবশ্যক নয়। কেউ চাইলে শারীয়াহ মানবে আর না চাইলে মানবে না।
দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ আল্লাহর সৃষ্টি দুই ভাগে বিভক্ত — মু’মিন ও কাফির
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেছেনঃ
شَاءَ رَبُّكَ لَجَعَلَ النَّاسَ أُمَّةً وَاحِدَةً وَلا يَزَالُونَ مُخْتَلِفِينَ * إِلا مَنْ رَحِمَ رَبُّكَ وَلِذَلِكَ خَلَقَهُمْ
“তোমার রব ইচ্ছা করলে সমস্ত মানুষকে এক উম্মত করতে পারতেন, কিন্তু তারা মতভেদ করতেই থাকবে। তবে তারা নয়, যাদেরকে তোমার রব দয়া করেন এবং তিনি তাদেরকে এজন্যই সৃষ্টি করেছেন।”(সূরা হূদ ১১ঃ ১১৮-১১৯)
ইবনে কাসীর (রহিমাহুল্লাহ) তাঁর প্রসিদ্ধ তাফসীরে এই আয়াতের ব্যাখ্যা করেছেন; আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা মানুষকে এমনভাবেই সৃষ্টি করেছেন যাতে তাদের মাঝে ধর্ম ও বিশ্বাসের মতভেদ থাকবে।
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা) বলেনঃ
إِنَّ الَّذِينَ حَقَّتْ عَلَيْهِمْ كَلِمَةُ رَبِّكَ لا يُؤْمِنُونَ * وَلَوْ جَاءَتْهُمْ كُلُّ آَيَةٍ
“নিশ্চয়ই যাদের ব্যাপারে তোমার রবের বাক্য সাব্যস্ত হয়ে গিয়েছে, তারা ঈমান আনবে না, যদিও তাদের কাছে প্রত্যেকটি নিদর্শন আসে …” (সূরা ইউনুস ১০ঃ ৯৬-৯৭)
এরপরই তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা) বলেছেনঃ
وَلَوْ شَاءَ رَبُّكَ لامَنَ مَنْ فِي الْأَرْضِ كُلُّهُمْ جَمِيعًا أَفَأَنْتَ تُكْرِهُ النَّاسَ حَتَّى يَكُونُوا مُؤْمِنِينَ *
“তোমার রব ইচ্ছা করলে পৃথিবীতে যারা আছে তারা সকলে অবশ্যই ঈমান আনতো; তবে কি তুমি মু’মিন হওয়ার জন্য মানুষের উপর জবরদস্তি করবে?” (সূরা ইউনুস ১০ঃ ৯৯)
সুতরাং আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার ইচ্ছায় তাঁর সৃষ্টিসমূহ দু’টি ভাগে বিভক্তঃ মু’মিন এবং কাফির। এটি তাঁর বিশেষ ইচ্ছা; এ বিষয়ে বির্তকের কোন অবকাশ নেই।
আল্লাহ্ তা‘আলা বলেনঃ
إِنَّمَا أَمْرُهُ إِذَا أَرَادَ شَيْئًا أَنْ يَقُولَ لَهُ كُنْ فَيَكُونُ
“তাঁর ব্যাপার শুধু এই, তিনি যখন কোন কিছু ইচ্ছা করেন, তিনি সেটাকে বলেনঃ ‘হও’, ফলে সেটা হয়ে যায়।” (সূরা ইয়াসীন ৩৬ঃ ৮২)
তিনি সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেনঃ
وَكَانَ أَمْرُ اللَّهِ قَدَرًا مَقْدُورًا
“…আল্লাহর বিধান সুর্নিধারিত।” (সূরা আহ্যাব ৩৩ঃ ৩৮)
সুতরাং আল্লাহর সমগ্র সৃষ্টি মু’মিন আর কাফির এই দু’টি ভাগে বিভক্ত। যেমন আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেনঃ
هُوَ الَّذِي خَلَقَكُمْ فَمِنْكُمْ كَافِرٌ وَمِنْكُمْ مُؤْمِنٌ
“তিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তোমাদের মধ্যে কেউ হয় কাফের এবং তোমাদের মধ্যে কেউ হয় মু’মিন।” (সূরা তাগাবুন ৬৪ঃ ২)
তবে প্রাথমিক অবস্থায়, আদম (আঃ) এর সময় থেকে, সম্পূর্ণ মানবজাতি মু’মিন ছিল। পরবর্তিতে তার বংশধরদের মাঝে র্শিকের আবির্ভাব ঘটে। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা জানিয়েছেনঃ
وَمَا كَانَ النَّاسُ إِلا أُمَّةً وَاحِدَةً فَاخْتَلَفُوا
“মানুষ ছিল একই উম্মত, পরে তারা মতভেদ সৃষ্টি করে।” (সূরা ইউনুস ১০ঃ ১৯)
ইবনে কাসীর থেকে বর্ণিত, “ইবনে আব্বাস (রদিয়াল্লাহু আনহু) বলেছেন, ‘আদম এবং নূহ (আঃ) এর মধ্যবর্তী সময়ে ১০টি প্রজন্ম ছিল যারা সকলেই ছিল ইসলামের উপর। এরপর মানুষের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি হয় এবং মূর্তি, মধ্যস্ততাকারী (মাধ্যম) এবং দেব-দেবীর পূজা শুরু হয়। যার প্রেক্ষিতে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা তাঁর আয়াত, তাঁর ব্যাখ্যা, তাঁর প্রমাণ ও অকাট্য দলীলসহ রাসূলগণকে প্রেরণ করেনঃ
إِذْ أَنْتُمْ بِالْعُدْوَةِ الدُّنْيَا وَهُمْ بِالْعُدْوَةِ الْقُصْوَى وَالرَّكْبُ أَسْفَلَ مِنْكُمْ وَلَوْ تَوَاعَدْتُمْ لاخْتَلَفْتُمْ فِي الْمِيعَادِ وَلَكِنْ لِيَقْضِيَ اللَّهُ أَمْرًا كَانَ مَفْعُولًا لِيَهْلِكَ مَنْ هَلَكَ عَنْ بَيِّنَةٍ وَيَحْيَا مَنْ حَيَّ عَنْ بَيِّنَةٍ وَإِنَّ اللَّهَ لَسَمِيعٌ عَلِيمٌ
“…যাতে যারা ধ্বংস হবে তারা যেন সত্যাসত্য স্পষ্ট প্রকাশের পর ধ্বংস হয় এবং যারা জীবিত থাকবে তারা যেন সত্যাসত্য প্রকাশের পর জীবিত থাকে।” (সূরা আনফাল ৮ঃ ৪২)
আমার বক্তব্যঃ আদম (আঃ)-এর বংশধরগণ যখন কুফুরিতে লিপ্ত হয়েছে তখন আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা তাঁর রাসূলগণকে পাঠিয়েছেন। একথা তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা) তাঁর কিতাবে উল্লেখ করেছেনঃ
كَانَ النَّاسُ أُمَّةً وَاحِدَةً فَبَعَثَ اللَّهُ النَّبِيِّينَ مُبَشِّرِينَ وَمُنْذِرِينَ وَأَنْزَلَ مَعَهُمُ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ لِيَحْكُمَ بَيْنَ النَّاسِ فِيمَا اخْتَلَفُوا فِيهِ
“সমস্ত মানুষ ছিল একই উম্মত। অতঃপর আল্লাহ্ নাবীগণকে সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী রূপে প্রেরণ করেন। মানুষেরা যে বিষয়ে মতভেদ করত তাদের মধ্যে সে বিষয়ে মীমাংসার জন্য তিনি তাদের সাথে সত্যসহ কিতাব অবর্তীণ করেন।” (সূরা বাকারা ২ঃ ২১৩)
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা স্পষ্ট দলীল প্রমাণসহ রাসূলগণকে প্রেরণ করার পরও মতভেদ সৃষ্টি হয়েছে এবং মানুষ মু’মিন ও কাফির এ বিভক্ত হয়েছে এবং উভয় দলের মাঝে সংঘর্ষ হয়েছে। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেছেনঃ
تِلْكَ الرُّسُلُ فَضَّلْنَا بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ ….. وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا اقْتَتَلَ الَّذِينَ مِنْ بَعْدِهِمْ مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَتْهُمُ الْبَيِّنَاتُ وَلَكِنِ اخْتَلَفُوا فَمِنْهُمْ مَنْ آَمَنَ وَمِنْهُمْ مَنْ كَفَرَ وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا اقْتَتَلُوا وَلَكِنَّ اللَّهَ يَفْعَلُ مَا يُرِيدُ
“এই রাসূলগণ, তাদের মধ্যে কাউকে কারো উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি….. আল্লাহ্ ইচ্ছা করলে তাদের পরবর্তীরা তাদের নিকট স্পষ্ট প্রমাণ সমাগত হওয়ার পরেও পারস্পরিক যুদ্ধ বিগ্রহে লিপ্ত হত না; কিন্তু তাদের মধ্যে মতভেদ ঘটল। ফলে তাদের মধ্যে কতক ঈমান আনল এবং কতক কুফরি করল। আল্লাহ্ ইচ্ছা করলে তারা পারস্পরিক যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত হত না; কিন্তু আল্লাহ্ তাই করেন যা তাঁর ইচ্ছা।” (সূরা বাকারা ২ঃ ২৫৩)
এমন কোন নাবী ছিলেন না যাদের কেউ অস্বীকার করেনি। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), কিয়ামতের দিনে এমনও কিছু নাবীর উপস্থিতির কথা বলেছেন, “এবং একজন নাবী আসবে যার সাথে(উম্মাত) কেউ থাকবে না”।
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা এমনই কিছু দৃষ্টান্ত আমাদের জন্য বর্ণনা করেছেনঃ
وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا إِلَى ثَمُودَ أَخَاهُمْ صَالِحًا أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ فَإِذَا هُمْ فَرِيقَانِ يَخْتَصِمُونَ
“আমি অবশ্যই সামুদ সম্প্রদায়ের নিকট তাহাদের ভ্রাতা সালিহকে পাঠিয়েছিলাম এই আদেশসহ, ‘তোমরা আল্লাহর ‘ইবাদত কর,’ কিন্তু তারা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে বির্তকে লিপ্ত হল।” (সূরা ২৭ঃ ৪৫)
সুতরাং যখনই তিনি তাদেরকে শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদতের দিকে ডাকলেন তখনই তারা দু’টি দলে বিভক্ত হয়ে গেল এবং তাদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি হলো। এটি অব্যাহত থাকে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দ্বারা (নবুয়্যতের) সীলমোহর এঁটে দেয়া পর্যন্ত। তিনি আসার পর তাকে কেন্দ্র করে মানুষ মু’মিন ও কাফির এ বিভক্ত হয়, হাদীসে রয়েছে, “এবং মুহাম্মাদ হলো মানুষের মাঝে বিভেদ সৃষ্টিকারী।” এই বিভক্তিই কিয়ামতের পূর্ব পর্যন্ত বিরাজ করবে।
যদিও আল্লাহর ইচ্ছাতেই মানুষ মু’মিন ও কাফির এ বিভক্ত হয় এবং এটিই ঘটবে; আমরা বিশ্বাস করি যে, প্রতিটি সৃষ্টি তার কর্মের জন্য জবাবদিহি করবে যা সে স্বয়ং করেছে। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেছেনঃ
وَمَا تُجْزَوْنَ إِلا مَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ
“এবং তোমরা যা কর তারই প্রতিফল পাবে।” (সূরা সাফফাত ৩৭ঃ ৩৯)
আমরা এটাও বিশ্বাস করি যে, আল্লাহ্ কারো প্রতি অবিচার করেন না। তিনি, সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা, বলেনঃ
إِنَّ اللَّهَ لا يَظْلِمُ النَّاسَ شَيْئًا وَلَكِنَّ النَّاسَ أَنْفُسَهُمْ يَظْلِمُونَ
“নিশ্চয়ই আল্লাহ্ মানুষের প্রতি কোন যুলুম করেন না, বরং মানুষই নিজেদের প্রতি যুলুম করে থাকে।”
(সূরা ইউনুস ১০ঃ ৪৪)
হাদীস কুদসীতে পাওয়া যায়ঃ আল্লাহ্ বলেনঃ “হে আমার বান্দাগণ! আমি যুলুমকে আমার জন্য হারাম করেছি এবং তোমাদের জন্যও এটি হারাম করেছি; সুতরাং তোমরা যুলুম কর না।” (সহীহ্ মুসলিম)
[ইনশাআল্লাহ্* চলবে]
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার জন্য কারণ তিনিই আমাদের এই বইটি অনুবাদের সুযোগ দিয়েছেন এবং অনুবাদটি সম্পন্ন করতে সাহায্য করেছেন। তাঁর সাহায্য ব্যতীত এই কাজ সম্পন্ন করা ছিল অসম্ভব।
শুরুতেই যে কথাগুলি বলতে চাই তা হলো; এক. বইটি অনুবাদের সময় কোন আরবী শব্দের যথার্থ বাংলা সমার্থক না পাওয়া গেলে সেক্ষেত্রে আরবী শব্দই ব্যবহার করা হয়েছে। দুই. কুরআনের আয়াতের ক্ষেত্রে একটি মনে রাখতে হবে যে, এটি আল্লাহর বাণী, কোন ভাষাতেই একে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব নয়। আমরা শুধু এর অর্থ অনুবাদ করতে সক্ষম। এই অনুবাদের জন্য আমরা মূলত ইসলামী ফাউন্ডেশনের আল কুরআনুল কারীমের বঙ্গানুবাদ ব্যবহার করেছি। তিন. হাদীসের ক্ষেত্রেও সরাসরী আরবী ছাড়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী অটুট রাখা সম্ভব নয়। সুতরাং পাঠকদের মনে রাখতে হবে যে, হাদীসের অনুবাদ হাদীস নয়, এটি শুধুমাত্র হাদীসের অর্থ। এক্ষেত্রেও আমরা অধিকাংশ হাদীস ইসলামী ফাউন্ডেশনের অনুবাদকৃত সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম থেকে ব্যবহার করেছি, যেসব ক্ষেত্রে অনুবাদকৃত হাদীস পাওয়া সম্ভব হয়নি, সেসব ক্ষেত্রে আমরা যথাসম্ভব চেষ্টা করেছি হাদীসের অর্থের সাথে সঙ্গতি রাখতে। তাই আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের নিকট আমাদের দু‘আ তিনি যেন আমাদের আন্তরিকতা কবুল করেন এবং আমাদের ভুলভ্রান্তি ক্ষমা করেন, তিনি ছাড়া আমাদের আর কোন ক্ষমাকারী নেই ।
লেখকের এই বইটি লেখার উদ্দেশ্য ছিল, আল্লাহ্ তা‘আলার একটি হুকুম পালন করা, “এবং মু’মিনদেরকে (জিহাদের জন্য) উদ্বুদ্ধ কর”। আল্লাহ্ তার প্রচেষ্টা কবুল করুন এবং তাকে হিফাজত করুন। লেখকের তুলনায় আমাদের প্রচেষ্টা তো নগণ্য, তারপরও আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার আয়াত আমাদের প্রেরণা দেয়,
مَا كَانَ لِأَهْلِ الْمَدِينَةِ وَمَنْ حَوْلَهُمْ مِنَ الْأَعْرَابِ أَنْ يَتَخَلَّفُوا عَنْ رَسُولِ اللَّهِ وَلا يَرْغَبُوا بِأَنْفُسِهِمْ عَنْ نَفْسِهِ ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ لا يُصِيبُهُمْ ظَمَأٌ وَلا نَصَبٌ وَلا مَخْمَصَةٌ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَلا يَطَئُونَ مَوْطِئًا يَغِيظُ الْكُفَّارَ وَلا يَنَالُونَ مِنْ عَدُوٍّ نَيْلًا إِلا كُتِبَ لَهُمْ بِهِ عَمَلٌ صَالِحٌ إِنَّ اللَّهَ لا يُضِيعُ أَجْرَ الْمُحْسِنِينَ * وَلا يُنْفِقُونَ نَفَقَةً صَغِيرَةً وَلا كَبِيرَةً وَلا يَقْطَعُونَ وَادِيًا إِلا كُتِبَ لَهُمْ لِيَجْزِيَهُمُ اللَّهُ أَحْسَنَ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ *
“…এটা এজন্য যে আল্লাহর পথে যে তৃষ্ণা, ক্লান্তি এবং ক্ষুধা তাদের স্পর্শ করে এবং তাদের এমন পদক্ষেপ যা কাফিরদের ক্রোধের উদ্রেক করে এবং শত্রুদের নিকট থেকে তারা যা কিছু প্রাপ্ত হয়- তার প্রত্যেকটির বিনিময়ে তাদের জন্য লিখিত হয় নেক আমল। নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ সৎকর্মশীলদের প্রতিদান নষ্ট করেন না। আর তারা অল্পবিস্তর যা কিছু ব্যয় করে, যত প্রান্তর তারা অতিক্রম করে, তা সবই তাদের নামে লেখা হয়, যেন আল্লাহ্ তাদের সৎকর্মসমুহের উত্তম বিনিময় প্রদান করেন।” [সূরা আত-তাওবাহ ৯ঃ ১২০-১২১]
ইয়া রাব্বুল ’আলামীন আপনি আমাদের এই প্রচেষ্টা কবুল করুন, যা আপনারই সহায়তায় সম্পন্ন হয়েছে; আমাদের নিয়্যতকে বিশুদ্ধ করুন এবং আমাদেরকে মুজাহিদদের অন্তর্ভুক্ত করুন। হে গাফুরুর রাহীম! এই অনুবাদ করতে গিয়ে আমরা যে গাফিলতী ও সময় ক্ষেপন করেছি তার জন্য আমাদের ক্ষমা করুন এবং যে সকল ভুল ভ্রান্তি আমাদের গাফিলতিতে এবং শয়তানের প্ররোচনায় হয়েছে, সেগুলো ক্ষমা করুন; আপনি ছাড়া ক্ষমা করার আর কেউ নাই। আমীন।
سُبْحـانَكَ اللّهُـمَّ وَبِحَمدِك، أَشْهَـدُ أَنْ لا إِلهَ إِلاّ أَنْتَ أَسْتَغْفِرُكَ وَأَتوبُ إِلَـيْك.
প্রথম অধ্যায়ঃ সৃষ্টির উদ্দেশ্য
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেছেনঃ
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلا لِيَعْبُدُونِ
“আমি জ্বীন ও মানুষকে সৃষ্টি করেছি কেবলমাত্র এজন্য যে, যেন তারা আমারই ইবাদত করে।” (সূরা যারিয়াত ৫১ঃ ৫৬)
আল্লাহর রাসূলগণ যে দাওয়াত নিয়ে এসেছিলেন তারই বহিঃপ্রকাশ হলো ইবাদত। এই দুনিয়ার বুকে এমন কোন জাতি নেই যাদের কাছে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা রাসূল পাঠাননি। তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা) বলেনঃ
وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اُعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ
“আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই কোন না কোন রাসূল প্রেরণ করেছি, এ নির্দেশ প্রচারের জন্য যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাগুত থেকে দূরে থাক…..” (সূরা নাহল ১৬ঃ ৩৬)
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা) আরও বলেনঃ
إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ بِالْحَقِّ بَشِيرًا وَنَذِيرًا
“…..আর এমন কোন উম্মত ছিল না যাদের মধ্যে কোন সতর্ককারী আসেনি।” (সূরা ফাতির ৩৫ঃ ২৪)
এর দ্বারা আল্লাহ্, সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা, তাঁর হুজ্জাহ (প্রমাণ) প্রতিষ্ঠিত রেখেছেন, আদম (আঃ) থেকে শুরু করে কিয়ামত পর্যন্ত। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেনঃ
رُسُلًا مُبَشِّرِينَ وَمُنْذِرِينَ لِئَلا يَكُونَ لِلنَّاسِ عَلَى اللَّهِ حُجَّةٌ بَعْدَ الرُّسُلِ
“সুংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে রাসূলদের আমি এজন্য প্রেরণ করেছি যাতে রাসূলদের আগমণের পর মানুষের কোন ওজর আপত্তি না থাকে। আল্লাহ্ পরাক্রমশালী, হিকমাত সম্পন্ন।” (সূরা নিসা ৪ঃ ১৬৫)
নাবীগণকে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা তাদের সমসাময়িক বংশসমুহের মধ্য থেকেই আবির্ভূত করেছেন। তাদের অনুপস্থিতিতে তাদের অনুসারীগণ এই কার্যক্রম চালিয়ে যান। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেনঃ
وَمَا كَانَ رَبُّكَ مُهْلِكَ الْقُرَى حَتَّى يَبْعَثَ فِي أُمِّهَا رَسُولًا يَتْلُو عَلَيْهِمْ آَيَاتِنَا
“আর আপনার রব জনপদসমূহ ধ্বংস করেন না, যে পর্যন্ত না তিনি তার কেন্দ্রস্থলে রাসূল প্রেরণ করেন, যিনি তাদের কাছে আমার আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করেন।” (সূরা কাসাস ২৮ঃ ৫৯)
সুতরাং রাসূলগণের মৃত্যুর পর তাদের অনুসারীগণ এই দাওয়াত অব্যাহত রাখেন যাতে সৃষ্টিকুল আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার হুজ্জাহ থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়। আর এজন্যই রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “তোমরা যারা উপস্থিত আছো তারা পৌঁছে দাও (এই বাণী) তাদের কাছে যারা (এখানে) অনুপস্থিত”। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ “আমার তরফ থেকে যদি একটি আয়াতও হয় পৌঁছে দাও”। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ “আলেমগণ নাবীদের উত্তরাধিকারী”। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরও বলেনঃ “আমার উম্মতের একটি দল (তা’ইফাহ) নিরন্তর আল্লাহ্র হুকুমের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে”। উল্লেখিত সকল হাদীসই সহীহ।
ইবাদতের হুকুম হলো শারীয়াহ ভিত্তিক। অর্থাৎ নাবীদের জবান দ্বারা আল্লাহ্ তা‘আলা এসব হুকুম প্রণয়ণ করেছেন। আর এই শারীয়াহ গ্রহণ করা না করার সিদ্ধান্ত মানুষের। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার শারীয়াহ, যা তাঁর রাসূলগণের জবান দ্বারা বিবৃত, সকল সৃষ্টই মানবে এমনটি আবশ্যক নয়। কেউ চাইলে শারীয়াহ মানবে আর না চাইলে মানবে না।
দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ আল্লাহর সৃষ্টি দুই ভাগে বিভক্ত — মু’মিন ও কাফির
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেছেনঃ
شَاءَ رَبُّكَ لَجَعَلَ النَّاسَ أُمَّةً وَاحِدَةً وَلا يَزَالُونَ مُخْتَلِفِينَ * إِلا مَنْ رَحِمَ رَبُّكَ وَلِذَلِكَ خَلَقَهُمْ
“তোমার রব ইচ্ছা করলে সমস্ত মানুষকে এক উম্মত করতে পারতেন, কিন্তু তারা মতভেদ করতেই থাকবে। তবে তারা নয়, যাদেরকে তোমার রব দয়া করেন এবং তিনি তাদেরকে এজন্যই সৃষ্টি করেছেন।”(সূরা হূদ ১১ঃ ১১৮-১১৯)
ইবনে কাসীর (রহিমাহুল্লাহ) তাঁর প্রসিদ্ধ তাফসীরে এই আয়াতের ব্যাখ্যা করেছেন; আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা মানুষকে এমনভাবেই সৃষ্টি করেছেন যাতে তাদের মাঝে ধর্ম ও বিশ্বাসের মতভেদ থাকবে।
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা) বলেনঃ
إِنَّ الَّذِينَ حَقَّتْ عَلَيْهِمْ كَلِمَةُ رَبِّكَ لا يُؤْمِنُونَ * وَلَوْ جَاءَتْهُمْ كُلُّ آَيَةٍ
“নিশ্চয়ই যাদের ব্যাপারে তোমার রবের বাক্য সাব্যস্ত হয়ে গিয়েছে, তারা ঈমান আনবে না, যদিও তাদের কাছে প্রত্যেকটি নিদর্শন আসে …” (সূরা ইউনুস ১০ঃ ৯৬-৯৭)
এরপরই তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা) বলেছেনঃ
وَلَوْ شَاءَ رَبُّكَ لامَنَ مَنْ فِي الْأَرْضِ كُلُّهُمْ جَمِيعًا أَفَأَنْتَ تُكْرِهُ النَّاسَ حَتَّى يَكُونُوا مُؤْمِنِينَ *
“তোমার রব ইচ্ছা করলে পৃথিবীতে যারা আছে তারা সকলে অবশ্যই ঈমান আনতো; তবে কি তুমি মু’মিন হওয়ার জন্য মানুষের উপর জবরদস্তি করবে?” (সূরা ইউনুস ১০ঃ ৯৯)
সুতরাং আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার ইচ্ছায় তাঁর সৃষ্টিসমূহ দু’টি ভাগে বিভক্তঃ মু’মিন এবং কাফির। এটি তাঁর বিশেষ ইচ্ছা; এ বিষয়ে বির্তকের কোন অবকাশ নেই।
আল্লাহ্ তা‘আলা বলেনঃ
إِنَّمَا أَمْرُهُ إِذَا أَرَادَ شَيْئًا أَنْ يَقُولَ لَهُ كُنْ فَيَكُونُ
“তাঁর ব্যাপার শুধু এই, তিনি যখন কোন কিছু ইচ্ছা করেন, তিনি সেটাকে বলেনঃ ‘হও’, ফলে সেটা হয়ে যায়।” (সূরা ইয়াসীন ৩৬ঃ ৮২)
তিনি সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেনঃ
وَكَانَ أَمْرُ اللَّهِ قَدَرًا مَقْدُورًا
“…আল্লাহর বিধান সুর্নিধারিত।” (সূরা আহ্যাব ৩৩ঃ ৩৮)
সুতরাং আল্লাহর সমগ্র সৃষ্টি মু’মিন আর কাফির এই দু’টি ভাগে বিভক্ত। যেমন আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেনঃ
هُوَ الَّذِي خَلَقَكُمْ فَمِنْكُمْ كَافِرٌ وَمِنْكُمْ مُؤْمِنٌ
“তিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তোমাদের মধ্যে কেউ হয় কাফের এবং তোমাদের মধ্যে কেউ হয় মু’মিন।” (সূরা তাগাবুন ৬৪ঃ ২)
তবে প্রাথমিক অবস্থায়, আদম (আঃ) এর সময় থেকে, সম্পূর্ণ মানবজাতি মু’মিন ছিল। পরবর্তিতে তার বংশধরদের মাঝে র্শিকের আবির্ভাব ঘটে। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা জানিয়েছেনঃ
وَمَا كَانَ النَّاسُ إِلا أُمَّةً وَاحِدَةً فَاخْتَلَفُوا
“মানুষ ছিল একই উম্মত, পরে তারা মতভেদ সৃষ্টি করে।” (সূরা ইউনুস ১০ঃ ১৯)
ইবনে কাসীর থেকে বর্ণিত, “ইবনে আব্বাস (রদিয়াল্লাহু আনহু) বলেছেন, ‘আদম এবং নূহ (আঃ) এর মধ্যবর্তী সময়ে ১০টি প্রজন্ম ছিল যারা সকলেই ছিল ইসলামের উপর। এরপর মানুষের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি হয় এবং মূর্তি, মধ্যস্ততাকারী (মাধ্যম) এবং দেব-দেবীর পূজা শুরু হয়। যার প্রেক্ষিতে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা তাঁর আয়াত, তাঁর ব্যাখ্যা, তাঁর প্রমাণ ও অকাট্য দলীলসহ রাসূলগণকে প্রেরণ করেনঃ
إِذْ أَنْتُمْ بِالْعُدْوَةِ الدُّنْيَا وَهُمْ بِالْعُدْوَةِ الْقُصْوَى وَالرَّكْبُ أَسْفَلَ مِنْكُمْ وَلَوْ تَوَاعَدْتُمْ لاخْتَلَفْتُمْ فِي الْمِيعَادِ وَلَكِنْ لِيَقْضِيَ اللَّهُ أَمْرًا كَانَ مَفْعُولًا لِيَهْلِكَ مَنْ هَلَكَ عَنْ بَيِّنَةٍ وَيَحْيَا مَنْ حَيَّ عَنْ بَيِّنَةٍ وَإِنَّ اللَّهَ لَسَمِيعٌ عَلِيمٌ
“…যাতে যারা ধ্বংস হবে তারা যেন সত্যাসত্য স্পষ্ট প্রকাশের পর ধ্বংস হয় এবং যারা জীবিত থাকবে তারা যেন সত্যাসত্য প্রকাশের পর জীবিত থাকে।” (সূরা আনফাল ৮ঃ ৪২)
আমার বক্তব্যঃ আদম (আঃ)-এর বংশধরগণ যখন কুফুরিতে লিপ্ত হয়েছে তখন আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা তাঁর রাসূলগণকে পাঠিয়েছেন। একথা তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা) তাঁর কিতাবে উল্লেখ করেছেনঃ
كَانَ النَّاسُ أُمَّةً وَاحِدَةً فَبَعَثَ اللَّهُ النَّبِيِّينَ مُبَشِّرِينَ وَمُنْذِرِينَ وَأَنْزَلَ مَعَهُمُ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ لِيَحْكُمَ بَيْنَ النَّاسِ فِيمَا اخْتَلَفُوا فِيهِ
“সমস্ত মানুষ ছিল একই উম্মত। অতঃপর আল্লাহ্ নাবীগণকে সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী রূপে প্রেরণ করেন। মানুষেরা যে বিষয়ে মতভেদ করত তাদের মধ্যে সে বিষয়ে মীমাংসার জন্য তিনি তাদের সাথে সত্যসহ কিতাব অবর্তীণ করেন।” (সূরা বাকারা ২ঃ ২১৩)
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা স্পষ্ট দলীল প্রমাণসহ রাসূলগণকে প্রেরণ করার পরও মতভেদ সৃষ্টি হয়েছে এবং মানুষ মু’মিন ও কাফির এ বিভক্ত হয়েছে এবং উভয় দলের মাঝে সংঘর্ষ হয়েছে। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেছেনঃ
تِلْكَ الرُّسُلُ فَضَّلْنَا بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ ….. وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا اقْتَتَلَ الَّذِينَ مِنْ بَعْدِهِمْ مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَتْهُمُ الْبَيِّنَاتُ وَلَكِنِ اخْتَلَفُوا فَمِنْهُمْ مَنْ آَمَنَ وَمِنْهُمْ مَنْ كَفَرَ وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا اقْتَتَلُوا وَلَكِنَّ اللَّهَ يَفْعَلُ مَا يُرِيدُ
“এই রাসূলগণ, তাদের মধ্যে কাউকে কারো উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি….. আল্লাহ্ ইচ্ছা করলে তাদের পরবর্তীরা তাদের নিকট স্পষ্ট প্রমাণ সমাগত হওয়ার পরেও পারস্পরিক যুদ্ধ বিগ্রহে লিপ্ত হত না; কিন্তু তাদের মধ্যে মতভেদ ঘটল। ফলে তাদের মধ্যে কতক ঈমান আনল এবং কতক কুফরি করল। আল্লাহ্ ইচ্ছা করলে তারা পারস্পরিক যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত হত না; কিন্তু আল্লাহ্ তাই করেন যা তাঁর ইচ্ছা।” (সূরা বাকারা ২ঃ ২৫৩)
এমন কোন নাবী ছিলেন না যাদের কেউ অস্বীকার করেনি। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), কিয়ামতের দিনে এমনও কিছু নাবীর উপস্থিতির কথা বলেছেন, “এবং একজন নাবী আসবে যার সাথে(উম্মাত) কেউ থাকবে না”।
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা এমনই কিছু দৃষ্টান্ত আমাদের জন্য বর্ণনা করেছেনঃ
وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا إِلَى ثَمُودَ أَخَاهُمْ صَالِحًا أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ فَإِذَا هُمْ فَرِيقَانِ يَخْتَصِمُونَ
“আমি অবশ্যই সামুদ সম্প্রদায়ের নিকট তাহাদের ভ্রাতা সালিহকে পাঠিয়েছিলাম এই আদেশসহ, ‘তোমরা আল্লাহর ‘ইবাদত কর,’ কিন্তু তারা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে বির্তকে লিপ্ত হল।” (সূরা ২৭ঃ ৪৫)
সুতরাং যখনই তিনি তাদেরকে শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদতের দিকে ডাকলেন তখনই তারা দু’টি দলে বিভক্ত হয়ে গেল এবং তাদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি হলো। এটি অব্যাহত থাকে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দ্বারা (নবুয়্যতের) সীলমোহর এঁটে দেয়া পর্যন্ত। তিনি আসার পর তাকে কেন্দ্র করে মানুষ মু’মিন ও কাফির এ বিভক্ত হয়, হাদীসে রয়েছে, “এবং মুহাম্মাদ হলো মানুষের মাঝে বিভেদ সৃষ্টিকারী।” এই বিভক্তিই কিয়ামতের পূর্ব পর্যন্ত বিরাজ করবে।
যদিও আল্লাহর ইচ্ছাতেই মানুষ মু’মিন ও কাফির এ বিভক্ত হয় এবং এটিই ঘটবে; আমরা বিশ্বাস করি যে, প্রতিটি সৃষ্টি তার কর্মের জন্য জবাবদিহি করবে যা সে স্বয়ং করেছে। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেছেনঃ
وَمَا تُجْزَوْنَ إِلا مَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ
“এবং তোমরা যা কর তারই প্রতিফল পাবে।” (সূরা সাফফাত ৩৭ঃ ৩৯)
আমরা এটাও বিশ্বাস করি যে, আল্লাহ্ কারো প্রতি অবিচার করেন না। তিনি, সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা, বলেনঃ
إِنَّ اللَّهَ لا يَظْلِمُ النَّاسَ شَيْئًا وَلَكِنَّ النَّاسَ أَنْفُسَهُمْ يَظْلِمُونَ
“নিশ্চয়ই আল্লাহ্ মানুষের প্রতি কোন যুলুম করেন না, বরং মানুষই নিজেদের প্রতি যুলুম করে থাকে।”
(সূরা ইউনুস ১০ঃ ৪৪)
হাদীস কুদসীতে পাওয়া যায়ঃ আল্লাহ্ বলেনঃ “হে আমার বান্দাগণ! আমি যুলুমকে আমার জন্য হারাম করেছি এবং তোমাদের জন্যও এটি হারাম করেছি; সুতরাং তোমরা যুলুম কর না।” (সহীহ্ মুসলিম)
[ইনশাআল্লাহ্* চলবে]
Comment