বক্তব্য ০৮: [এরপর হুজুর আলোচনা করেছেন যে, সিয়াসাতের ব্যাপারে নতুন আবিষ্কৃত এসব রায় কিছু লোক গোটা কওমি মাদ্রাসার উপর মুসাল্লাত করতে চাচ্ছে। তারা মনে করছে, এগুলো প্রকাশ না করলে কিতমানে ইলমের গুনাহ হবে। অপরদিকে সাধারণ তালিবুল ইলমরা এসব মাওয়াদ হাতে পেয়ে মনে করছে তারা মুহাক্কিক হয়ে গেছে, তাহকিক তাদের হাতে চলে এসেছে।
এরপর হুজুর প্রসঙ্গ এনেছেন যে, যারা এ ধরনের তাজদিদ তাহকিকের দাবি করছে, তাজদিদ-তাহকিক তো পরের কথা, এসব বিষয়ে তাদের পড়াশুনাই অনেক নাকেস-অসম্পূর্ণ।
কিতমানে ইলম প্রসঙ্গে হুজুর একটা ঘটনার উদ্ধৃতিও টেনেছেন যে, এক লোক সা’দপন্থী। সব আলেম একদিকে হওয়া সত্বেও সে সা’দপন্থী, অন্যথায় তার না’কি কিতমানে ইলমের গুনাহ হবে।]
অভিব্যক্তি
তালিবুল ইলমরা নিজেদের মুহাক্কিক মনে করার ব্যাপারে আলোচনা আগে কিছুটা গেছে। পেছনে বলে এসেছি যে, এই প্রবণতাটা আসলে এক দিনে তৈয়ার হয়নি। জিহাদ-কিতাল-সিয়াসত-খিলাফতই শুধু না, যুগের আরও দশটা সমস্যার ব্যাপারে আসাতিযায়ে কেরামের বিশাল এক কাফেলার দীর্ঘদিনের অসচেতনতা তালিবুল ইলমরা দেখছে। দেখেছে প্রথাসর্বস্ব গতানুগতিকতা। আরও দেখেছে ধামাচাপা দেওয়ার জোর প্রচেষ্টা। দেখেছে সাধারণ ও কমন কিছু বিষয়ে গভীর ও সূক্ষ্ম তাহকিক আর প্রয়োজনীয় ও নাজুক অনেক বিষয়ে রহস্যজনক উদাসীনতা।
এসব বিষয় দেখতে দেখতে এক সময় তালিবুল ইলমরা আসাতিযায়ে কেরামের অনেকের ব্যাপারে আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। বিশেষত জিহাদ কিতাল সিয়াসত খেলাফতের বিষয়ে যখন দুনিয়াতে একটা নতুন জোয়ার বয়ে চলেছে, তখন তালিবুল ইলমদের সাথে অনেক উস্তাদের আচরণ, কট্টরপন্থী গাইরে মুকাল্লিদ লা মাজহাবি সম্প্রদায় কিংবা মাজারপূজারিদের সাথে আচরণের চেয়েও অনেক বেশি দ্বিপাক্ষিক অমানবিক অবস্থা ধারণ করেছে। যার ফলে ঘুনেধরা আস্থার প্রাসাদটা আরও দ্রুত ধ্বসে পড়েছে।
আসাতিযায়ে কেরাম যদি এ ধরনের আবেগের নাজুক মূহুর্তগুলোতে দরদি অভিভাবকত্বের পরিচয় দিতেন, শান্তভাবে তালিবুল ইলমদের মানসিকতা বুঝতেন, তাদের মতামতগুলো জানতেন, বিষয়গুলোকে মানসাব-মাকাম ও উস্তাদ-শাগরিদের শাসনমূলক অবস্থান থেকে না দেখে বরং বাস্তব দুনিয়া ও সহীহ ইলমী দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার-বিশ্লেষণ করতেন: তাহলে আশাকরি পরিস্থিতির এতো অবনতি হতো না।
এর বিপরীতে জিহাদের বিষয়ে কথা বলেন এমন অনেক উস্তাদকে তারা দেখেছে, তারা বাস্তব দুনিয়া সামনে রেখে কথা বলছেন, গতানুগতিক না। বিশেষত যখন জিহাদের অনেক বিষয়ের ব্যাপারেই ফিকহের কিতাবাদিতে ‘বিল ইত্তিফাক’ ‘বিল ইজমা’ বলা আছে। আছে কুরআনে কারীমের আবেগময়ী বর্ণনা। হাদিস ও সীরাতে আছে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জিহাদি জীবনে সুবিস্তৃত বিবরণ, যা দেখলে মনে হয় যেন ঘোড়া আর তরবারি দিয়েই বিশ্বনবীকে প্রেরণ করা হয়েছে। সাহাবা তাবিয়িনের জীবনের ইলমী দিকটির অন্তরালে জিহাদি একটি জীবনও যে ছিল সেটাও অনেকে দেখেছে।
পাশাপাশি জিহাদের কথা বলার কারণে কিভাবে যে তাগুতের রোষানলে পড়তে হচ্ছে; এর বিপরীতে যারা জিহাদ বিকৃত করে চলেছে, সরকারকে কড়া হুমকি ধমকি দিতে থাকার পরও যে তাগুতি সুযোগ সুবিধা কিভাবে তাদের শামিলে হাল হচ্ছে: এসব দেখতে দেখতে তালিবুল ইলমদের মন মানসে অবচেতনভাবেই মাজলুম জিহাদের একটা মায়া পয়দা হয়ে গেছে। জিহাদের পক্ষে যারা বলে তাদেরকে আপনজন ভাবতে শুরু করেছে। কারণ, স্বাভাবিক মানবিক গুণ যাদের আছে, মাজলুমের প্রতি এক রকম দরদ তাদের থাকেই।
পাশাপাশি নেট দুনিয়ার বিস্তৃতির কারণে বাস্তব জিহাদি ময়দানের দৃশ্যপট ও লেখা লেখি তালিবুল ইলমদের হাতে চলে আসছে, যেগুলো তাদেরকে যাদুর মতো আকৃষ্ট করে ফেলেছে। সাহাবাদের মতো জীবন দেয়ার একটা মানসিকতা আবার মাথাচাড়া দিয়ে জেগে উঠেছে।
এসব কিছুর ফলশ্রুতিতে: জিহাদের পক্ষে হলেই তাহকিক, বিপক্ষে হলেই গতানুগতিক …. এমন একটা মানসিকতা তৈয়ার হয়ে গেছে।
বাছবিচার না করে ঢালাওভাবে জিহাদের পক্ষে হলেই গ্রহণ করে নেয়ার এ মানসিকতা যদিও ঝুঁকিপূর্ণ, কিন্তু আমাদের অবহেলা অসচেতনতাই এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী। এককভাবে তালিবুল ইলমদের দোষারোপ করার কোনো সুযোগ নেই। আর করেও কোনো লাভ নেই। বরং দোষারোপের মাত্রা যত বাড়ছে বিপরীত প্রতিক্রিয়াও তত বাড়ছে।
দ্বিতীয়ত হুজুর বলেছেন, এসব নব আবিষ্কৃত বিষয়ের প্রচারে আমরা লেগে গেছি অথচ এসব বিষয়ে পর্যাপ্ত জানাশুনাই আমাদের নেই।
একথা বাস্তব যে, জিহাদের ব্যাপারে পড়াশুনার চেয়ে কথা বলার অভ্যাস অনেকের বেশি। তবে ঢালাওভাবে একথা বলার সুযোগ নেই যে, জিহাদের প্রচারে যারা আছে, জিহাদের ব্যাপারে যথাযথ পড়াশুনা জানাশুনা তাদের বিলকুলই নেই।
এখানে একটি বিষয় না বলে পারছি না: জিহাদের প্রচার প্রসার যারা করে, জিহাদের ব্যাপারে তাদের তো পড়াশুনা কিছু না কিছু আছে, কিন্তু বিপরীত শ্রেণির অবস্থাটা কি? তাদের পড়াশুনা কতটুকু? বাস্তব দুনিয়া সম্পর্কে জানাশুনা কতটুকু?
জিহাদের কড়া সমালোচনা যখন হুজুর করছেন, তখন এর বিপরীত শ্রেণিটির বিষয়ে কিছু কথা বলাও মনে হয় দরকার ছিল। যারা জিহাদকে বাপ দাদার সম্পত্তি বানিয়ে নিয়ে যুগের পর যুগ এর অপব্যাখ্যা করে আল্লাহর দ্বীনের বিকৃতি ঘটিয়ে আসছে, তাদের ব্যাপারে কিছু না বলে, যারা এ ফরযটার জন্য ঘর বাড়ি ছেড়ে ফেরারি জীবন বেঁচে নিয়েছেন, এককভাবে তাদের সমালোচনা করাটা কেমন?
বিশেষত যখন উৎসাহ দিয়ে জিহাদের প্রতি পাগলপারা করে তোলা উলামাদের স্বতন্ত্র দায়িত্ব বলে নসসে কুরআনি দ্বারা প্রমাণিত, সেখানে যারা জিহাদে নেমেছে এককভাবে তাদের সমালোচনা মানব বিবেককে প্রশ্নবিদ্ধ করা অস্বাভাবিক না।
আসল কথা কি: দ্বীন বিকৃতি দেখতে দেখতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। বেনামাযি হলেও শুকরের গোশত খাওয়ানো যাবে না। কারণ? অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। নইলে শুকরের গোশত খাওয়ার চেয়ে নামায তরকের গুনাহ অনেক বেশি।
বক্তব্য ০৯: [জিহাদ বিষয়ক আয়াত, আহাদিস ও আসারের জামে’ মানে’ মুতালাআ করিনি। সিরাত মুতালাআ করিনি। সাহাবায়ে কেরামের যামানা থেকে সায়্যিদ আহমাদ শহীদ পর্যন্ত মুজাহিদিনে উম্মতের সীরাতের জামে মানে মুতালাআ করিনি। সায়্যিদ আহমদ শহীদের পর যেখানে যেখানে সহীহ তরিকায় জিহাদ হয়েছে সেগুলোর ইতিহাস মুতালাআ করিনি। শুধু শরহুস সিয়ারিল কাবির পাঁচ খণ্ড পড়ে ফেলেছি এতেই আমি মুহাক্কিক হয়ে গিয়েছি। উস্তাদদের থেকে আ’লাম হয়ে গিয়েছি।]
অভিব্যক্তি
মৌলিকভাবে এখানে দু’টি পয়েন্ট একটু আলোচনায় আনা দরকার:
এক. উস্তাদ থেকে নিজেকে আ’লাম মনে করা
হুজুর যদি মাখসুস কোনো শাগরেদ ও মাখসুস কোনো উস্তাদ উদ্দেশ্য নিয়ে থাকেন, তাহলে হয়তো ঠিক আছে যে, শুধু শরহুস সিয়ার পড়েই উস্তাদ থেকে আ’লাম হয়ে গেছে ধারণা করা গলদ। কিন্তু আমরা যদি অধিকাংশের হাল বিবেচনা করি, তাহলে বলতে হবে, জিহাদের ব্যাপারে শাগরেদদের তো কিছু পড়াশুনা আছে, অনেক উস্তাদের তাও নেই। অনেক শাগরেদ তো মাশাআল্লাহ শরহুস সিয়ার আংশিক কিংবা পুরোটা পড়েছে, কিন্তু অনেক উস্তাদ কুদুরি থেকে পর্যন্ত বাবুল জিহাদ পড়েনি। এ ধরনের ক্ষেত্রে যদি জিহাদের বিষয়ে বিশেষ কোনো শাগরেদ বিশেষ কোনো উস্তাদের তুলনায় নিজেকে আ’লাম মনে করে, তাহলে ধারণাটা কি গলদ হবে? বিশেষত যখন ইলম তাজাযযি কবুল করে?
দুই. জামে মানে মুতালাআ
হুজুর হয়তো রাগের হালে বলেছেন, নয়তো মাসআলার জন্য কি এমন জামে মানে মুতালাআ শর্ত? যদি শর্ত হয়, তাহলে দেশের শতকরা একজন আলেমের একভাগ মাসআলাও কি এ ধরনের মুতালাআর পর বের হচ্ছে? তাহলে কি দেশের মোটামুটি সব আলেমের সব মাসআলাই সমালোচনার যোগ্য নয়? তাহলে শুধু জিহাদের উপর কেন আপত্তি? দেশের প্রায় সব দারুল ইফতা ফিকহের কিতাবাদি দেখে ফতোয়া দেয়। প্রত্যেক মাসআলায় আয়াত, আহাদিস, আসার, সিরাত ও তারিখ বিততাফসিল মুতালাআ করে তারপর ফতোয়া দেয় এমন কোনো দারুল ইফতা এদেশে এখন পর্যন্ত আছে বলে আমাদের জানা নেই। স্বয়ং মারকাযুদ দাওয়াহও হয়তো এমন দাবি করতে পারবে না। তাহলে এ পয়েন্টটা সামনে এনে জিহাদিদের সমালোচনা কিভাবে হতে পারে? যতটুকু বুঝতে পারছি, হুজুর রাগের হালে বলেছেন।
অধিকন্তু আয়াত, আহাদিস, আসার, সীরাত, তারিখ এবং হাল যামানা বিততাফসিল সামনে রেখেই আলহামদুলিল্লাহ মুজাহিদগণ কাজ করে যাচ্ছেন। এসব কিছু সামনে রেখেই মুজাহিদগণ কর্মপন্থা নির্ধারণ করেছেন। কিন্তু আমরা করি কি, দুয়েকজনের কিছু উগ্র আচরণ দেখেই গোটা জিহাদি জামাতকে মাপতে শুরু করি। এমনই যদি হয় তাহলে দুনিয়ার কোনো হক জামাত টিকবে না। স্বয়ং মারকাযুদ দাওয়ার দুয়েকজন ফুজালা থেকেই যদি জঙ্গিবাদ প্রমাণিত হয় তাহলে কি মারকাযুদ দাওয়াহ রাজি হবেন যে আমরা বলবো, মারকাযুদ দাওয়াহ জঙ্গিবাদের কারখানা? কিন্তু জিহাদের ব্যাপারটা এলেই আমরা কেন জানি তিলকে তাল বানাই। কেঁচো খুঁড়তে সাপ বের করি। উদুর পিন্ডি বুদুর ঘাড়ে চাপাই।
প্রশ্ন হতে পারে, জিহাদি কাফেলার প্রত্যেক সদস্য কি এমন মুতালাআ, এমন জানাশুনা রাখে?
আমি প্রশ্ন করবো, কোনো কাফেলার হার ফরদের জন্য কি তা জরুরী?
মৌলিকভাবে পরিচালক ও নীতি নির্ধারক যারা থাকেন, বিস্তৃত জানাশুনা তাদেরই থাকে। বাকি সদস্যদের জানাশুনার একটা সীমা থাকে। যিনি যে বিভাগে যে কাজ করেন, সে অনুপাতে তার জানাশুনা থাকে। সবার সব জানা থাকে না, দরকারও পড়ে না। আপনি কি দাবি করতে পারেন, নববী যামানা থেকে এখন পর্যন্ত অনুসরণযোগ্য হক জিহাদ যতগুলো হয়েছে সবগুলো জিহাদের সব সদস্যের আয়াত, আহাদিস, আসার, সীরাত, তারিখ বিততাফসিল জানা ছিল? না শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে এটি জরুরী, না বাস্তব দুনিয়ায় কাজ এভাবে হয়। এটি হয়তো রাগের হালতে হুজুর বলেছেন, নতুবা এটি কোনো ইলমী উসূলী কথা না; না শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে, না বাস্তবতার নিরিখে।
(চলমান ইনশাআল্লাহ ...)
এরপর হুজুর প্রসঙ্গ এনেছেন যে, যারা এ ধরনের তাজদিদ তাহকিকের দাবি করছে, তাজদিদ-তাহকিক তো পরের কথা, এসব বিষয়ে তাদের পড়াশুনাই অনেক নাকেস-অসম্পূর্ণ।
কিতমানে ইলম প্রসঙ্গে হুজুর একটা ঘটনার উদ্ধৃতিও টেনেছেন যে, এক লোক সা’দপন্থী। সব আলেম একদিকে হওয়া সত্বেও সে সা’দপন্থী, অন্যথায় তার না’কি কিতমানে ইলমের গুনাহ হবে।]
অভিব্যক্তি
তালিবুল ইলমরা নিজেদের মুহাক্কিক মনে করার ব্যাপারে আলোচনা আগে কিছুটা গেছে। পেছনে বলে এসেছি যে, এই প্রবণতাটা আসলে এক দিনে তৈয়ার হয়নি। জিহাদ-কিতাল-সিয়াসত-খিলাফতই শুধু না, যুগের আরও দশটা সমস্যার ব্যাপারে আসাতিযায়ে কেরামের বিশাল এক কাফেলার দীর্ঘদিনের অসচেতনতা তালিবুল ইলমরা দেখছে। দেখেছে প্রথাসর্বস্ব গতানুগতিকতা। আরও দেখেছে ধামাচাপা দেওয়ার জোর প্রচেষ্টা। দেখেছে সাধারণ ও কমন কিছু বিষয়ে গভীর ও সূক্ষ্ম তাহকিক আর প্রয়োজনীয় ও নাজুক অনেক বিষয়ে রহস্যজনক উদাসীনতা।
এসব বিষয় দেখতে দেখতে এক সময় তালিবুল ইলমরা আসাতিযায়ে কেরামের অনেকের ব্যাপারে আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। বিশেষত জিহাদ কিতাল সিয়াসত খেলাফতের বিষয়ে যখন দুনিয়াতে একটা নতুন জোয়ার বয়ে চলেছে, তখন তালিবুল ইলমদের সাথে অনেক উস্তাদের আচরণ, কট্টরপন্থী গাইরে মুকাল্লিদ লা মাজহাবি সম্প্রদায় কিংবা মাজারপূজারিদের সাথে আচরণের চেয়েও অনেক বেশি দ্বিপাক্ষিক অমানবিক অবস্থা ধারণ করেছে। যার ফলে ঘুনেধরা আস্থার প্রাসাদটা আরও দ্রুত ধ্বসে পড়েছে।
আসাতিযায়ে কেরাম যদি এ ধরনের আবেগের নাজুক মূহুর্তগুলোতে দরদি অভিভাবকত্বের পরিচয় দিতেন, শান্তভাবে তালিবুল ইলমদের মানসিকতা বুঝতেন, তাদের মতামতগুলো জানতেন, বিষয়গুলোকে মানসাব-মাকাম ও উস্তাদ-শাগরিদের শাসনমূলক অবস্থান থেকে না দেখে বরং বাস্তব দুনিয়া ও সহীহ ইলমী দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার-বিশ্লেষণ করতেন: তাহলে আশাকরি পরিস্থিতির এতো অবনতি হতো না।
এর বিপরীতে জিহাদের বিষয়ে কথা বলেন এমন অনেক উস্তাদকে তারা দেখেছে, তারা বাস্তব দুনিয়া সামনে রেখে কথা বলছেন, গতানুগতিক না। বিশেষত যখন জিহাদের অনেক বিষয়ের ব্যাপারেই ফিকহের কিতাবাদিতে ‘বিল ইত্তিফাক’ ‘বিল ইজমা’ বলা আছে। আছে কুরআনে কারীমের আবেগময়ী বর্ণনা। হাদিস ও সীরাতে আছে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জিহাদি জীবনে সুবিস্তৃত বিবরণ, যা দেখলে মনে হয় যেন ঘোড়া আর তরবারি দিয়েই বিশ্বনবীকে প্রেরণ করা হয়েছে। সাহাবা তাবিয়িনের জীবনের ইলমী দিকটির অন্তরালে জিহাদি একটি জীবনও যে ছিল সেটাও অনেকে দেখেছে।
পাশাপাশি জিহাদের কথা বলার কারণে কিভাবে যে তাগুতের রোষানলে পড়তে হচ্ছে; এর বিপরীতে যারা জিহাদ বিকৃত করে চলেছে, সরকারকে কড়া হুমকি ধমকি দিতে থাকার পরও যে তাগুতি সুযোগ সুবিধা কিভাবে তাদের শামিলে হাল হচ্ছে: এসব দেখতে দেখতে তালিবুল ইলমদের মন মানসে অবচেতনভাবেই মাজলুম জিহাদের একটা মায়া পয়দা হয়ে গেছে। জিহাদের পক্ষে যারা বলে তাদেরকে আপনজন ভাবতে শুরু করেছে। কারণ, স্বাভাবিক মানবিক গুণ যাদের আছে, মাজলুমের প্রতি এক রকম দরদ তাদের থাকেই।
পাশাপাশি নেট দুনিয়ার বিস্তৃতির কারণে বাস্তব জিহাদি ময়দানের দৃশ্যপট ও লেখা লেখি তালিবুল ইলমদের হাতে চলে আসছে, যেগুলো তাদেরকে যাদুর মতো আকৃষ্ট করে ফেলেছে। সাহাবাদের মতো জীবন দেয়ার একটা মানসিকতা আবার মাথাচাড়া দিয়ে জেগে উঠেছে।
এসব কিছুর ফলশ্রুতিতে: জিহাদের পক্ষে হলেই তাহকিক, বিপক্ষে হলেই গতানুগতিক …. এমন একটা মানসিকতা তৈয়ার হয়ে গেছে।
বাছবিচার না করে ঢালাওভাবে জিহাদের পক্ষে হলেই গ্রহণ করে নেয়ার এ মানসিকতা যদিও ঝুঁকিপূর্ণ, কিন্তু আমাদের অবহেলা অসচেতনতাই এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী। এককভাবে তালিবুল ইলমদের দোষারোপ করার কোনো সুযোগ নেই। আর করেও কোনো লাভ নেই। বরং দোষারোপের মাত্রা যত বাড়ছে বিপরীত প্রতিক্রিয়াও তত বাড়ছে।
***
দ্বিতীয়ত হুজুর বলেছেন, এসব নব আবিষ্কৃত বিষয়ের প্রচারে আমরা লেগে গেছি অথচ এসব বিষয়ে পর্যাপ্ত জানাশুনাই আমাদের নেই।
একথা বাস্তব যে, জিহাদের ব্যাপারে পড়াশুনার চেয়ে কথা বলার অভ্যাস অনেকের বেশি। তবে ঢালাওভাবে একথা বলার সুযোগ নেই যে, জিহাদের প্রচারে যারা আছে, জিহাদের ব্যাপারে যথাযথ পড়াশুনা জানাশুনা তাদের বিলকুলই নেই।
এখানে একটি বিষয় না বলে পারছি না: জিহাদের প্রচার প্রসার যারা করে, জিহাদের ব্যাপারে তাদের তো পড়াশুনা কিছু না কিছু আছে, কিন্তু বিপরীত শ্রেণির অবস্থাটা কি? তাদের পড়াশুনা কতটুকু? বাস্তব দুনিয়া সম্পর্কে জানাশুনা কতটুকু?
জিহাদের কড়া সমালোচনা যখন হুজুর করছেন, তখন এর বিপরীত শ্রেণিটির বিষয়ে কিছু কথা বলাও মনে হয় দরকার ছিল। যারা জিহাদকে বাপ দাদার সম্পত্তি বানিয়ে নিয়ে যুগের পর যুগ এর অপব্যাখ্যা করে আল্লাহর দ্বীনের বিকৃতি ঘটিয়ে আসছে, তাদের ব্যাপারে কিছু না বলে, যারা এ ফরযটার জন্য ঘর বাড়ি ছেড়ে ফেরারি জীবন বেঁচে নিয়েছেন, এককভাবে তাদের সমালোচনা করাটা কেমন?
বিশেষত যখন উৎসাহ দিয়ে জিহাদের প্রতি পাগলপারা করে তোলা উলামাদের স্বতন্ত্র দায়িত্ব বলে নসসে কুরআনি দ্বারা প্রমাণিত, সেখানে যারা জিহাদে নেমেছে এককভাবে তাদের সমালোচনা মানব বিবেককে প্রশ্নবিদ্ধ করা অস্বাভাবিক না।
আসল কথা কি: দ্বীন বিকৃতি দেখতে দেখতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। বেনামাযি হলেও শুকরের গোশত খাওয়ানো যাবে না। কারণ? অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। নইলে শুকরের গোশত খাওয়ার চেয়ে নামায তরকের গুনাহ অনেক বেশি।
বক্তব্য ০৯: [জিহাদ বিষয়ক আয়াত, আহাদিস ও আসারের জামে’ মানে’ মুতালাআ করিনি। সিরাত মুতালাআ করিনি। সাহাবায়ে কেরামের যামানা থেকে সায়্যিদ আহমাদ শহীদ পর্যন্ত মুজাহিদিনে উম্মতের সীরাতের জামে মানে মুতালাআ করিনি। সায়্যিদ আহমদ শহীদের পর যেখানে যেখানে সহীহ তরিকায় জিহাদ হয়েছে সেগুলোর ইতিহাস মুতালাআ করিনি। শুধু শরহুস সিয়ারিল কাবির পাঁচ খণ্ড পড়ে ফেলেছি এতেই আমি মুহাক্কিক হয়ে গিয়েছি। উস্তাদদের থেকে আ’লাম হয়ে গিয়েছি।]
অভিব্যক্তি
মৌলিকভাবে এখানে দু’টি পয়েন্ট একটু আলোচনায় আনা দরকার:
এক. উস্তাদ থেকে নিজেকে আ’লাম মনে করা
হুজুর যদি মাখসুস কোনো শাগরেদ ও মাখসুস কোনো উস্তাদ উদ্দেশ্য নিয়ে থাকেন, তাহলে হয়তো ঠিক আছে যে, শুধু শরহুস সিয়ার পড়েই উস্তাদ থেকে আ’লাম হয়ে গেছে ধারণা করা গলদ। কিন্তু আমরা যদি অধিকাংশের হাল বিবেচনা করি, তাহলে বলতে হবে, জিহাদের ব্যাপারে শাগরেদদের তো কিছু পড়াশুনা আছে, অনেক উস্তাদের তাও নেই। অনেক শাগরেদ তো মাশাআল্লাহ শরহুস সিয়ার আংশিক কিংবা পুরোটা পড়েছে, কিন্তু অনেক উস্তাদ কুদুরি থেকে পর্যন্ত বাবুল জিহাদ পড়েনি। এ ধরনের ক্ষেত্রে যদি জিহাদের বিষয়ে বিশেষ কোনো শাগরেদ বিশেষ কোনো উস্তাদের তুলনায় নিজেকে আ’লাম মনে করে, তাহলে ধারণাটা কি গলদ হবে? বিশেষত যখন ইলম তাজাযযি কবুল করে?
দুই. জামে মানে মুতালাআ
হুজুর হয়তো রাগের হালে বলেছেন, নয়তো মাসআলার জন্য কি এমন জামে মানে মুতালাআ শর্ত? যদি শর্ত হয়, তাহলে দেশের শতকরা একজন আলেমের একভাগ মাসআলাও কি এ ধরনের মুতালাআর পর বের হচ্ছে? তাহলে কি দেশের মোটামুটি সব আলেমের সব মাসআলাই সমালোচনার যোগ্য নয়? তাহলে শুধু জিহাদের উপর কেন আপত্তি? দেশের প্রায় সব দারুল ইফতা ফিকহের কিতাবাদি দেখে ফতোয়া দেয়। প্রত্যেক মাসআলায় আয়াত, আহাদিস, আসার, সিরাত ও তারিখ বিততাফসিল মুতালাআ করে তারপর ফতোয়া দেয় এমন কোনো দারুল ইফতা এদেশে এখন পর্যন্ত আছে বলে আমাদের জানা নেই। স্বয়ং মারকাযুদ দাওয়াহও হয়তো এমন দাবি করতে পারবে না। তাহলে এ পয়েন্টটা সামনে এনে জিহাদিদের সমালোচনা কিভাবে হতে পারে? যতটুকু বুঝতে পারছি, হুজুর রাগের হালে বলেছেন।
অধিকন্তু আয়াত, আহাদিস, আসার, সীরাত, তারিখ এবং হাল যামানা বিততাফসিল সামনে রেখেই আলহামদুলিল্লাহ মুজাহিদগণ কাজ করে যাচ্ছেন। এসব কিছু সামনে রেখেই মুজাহিদগণ কর্মপন্থা নির্ধারণ করেছেন। কিন্তু আমরা করি কি, দুয়েকজনের কিছু উগ্র আচরণ দেখেই গোটা জিহাদি জামাতকে মাপতে শুরু করি। এমনই যদি হয় তাহলে দুনিয়ার কোনো হক জামাত টিকবে না। স্বয়ং মারকাযুদ দাওয়ার দুয়েকজন ফুজালা থেকেই যদি জঙ্গিবাদ প্রমাণিত হয় তাহলে কি মারকাযুদ দাওয়াহ রাজি হবেন যে আমরা বলবো, মারকাযুদ দাওয়াহ জঙ্গিবাদের কারখানা? কিন্তু জিহাদের ব্যাপারটা এলেই আমরা কেন জানি তিলকে তাল বানাই। কেঁচো খুঁড়তে সাপ বের করি। উদুর পিন্ডি বুদুর ঘাড়ে চাপাই।
প্রশ্ন হতে পারে, জিহাদি কাফেলার প্রত্যেক সদস্য কি এমন মুতালাআ, এমন জানাশুনা রাখে?
আমি প্রশ্ন করবো, কোনো কাফেলার হার ফরদের জন্য কি তা জরুরী?
মৌলিকভাবে পরিচালক ও নীতি নির্ধারক যারা থাকেন, বিস্তৃত জানাশুনা তাদেরই থাকে। বাকি সদস্যদের জানাশুনার একটা সীমা থাকে। যিনি যে বিভাগে যে কাজ করেন, সে অনুপাতে তার জানাশুনা থাকে। সবার সব জানা থাকে না, দরকারও পড়ে না। আপনি কি দাবি করতে পারেন, নববী যামানা থেকে এখন পর্যন্ত অনুসরণযোগ্য হক জিহাদ যতগুলো হয়েছে সবগুলো জিহাদের সব সদস্যের আয়াত, আহাদিস, আসার, সীরাত, তারিখ বিততাফসিল জানা ছিল? না শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে এটি জরুরী, না বাস্তব দুনিয়ায় কাজ এভাবে হয়। এটি হয়তো রাগের হালতে হুজুর বলেছেন, নতুবা এটি কোনো ইলমী উসূলী কথা না; না শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে, না বাস্তবতার নিরিখে।
(চলমান ইনশাআল্লাহ ...)
Comment