০৫ কিতালপূর্ব দাওয়াত: ইসলাম ও জিযিয়া
فإن حاصرناهم ندعوهم إلى الإسلام. فإن أسلموا؛ وإلّا إلى الجزية. فإن قبلوا فلهم ما لنا وعليهم ما علينا. ولا نقاتل من لم تبلغه الدّعوة إلى الإسلام. وندعو ندبًا من بلغته. وإلّا نستعين بالله تعالى ونحاربهم. “কাফেরদের (কোনো দুর্গ বা এলাকা) অবরোধ করার পর: ১. (প্রথমে) ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দেবো। মুসলমান হয়ে গেলে তো ভাল। ২. অন্যথায় জিযিয়া (প্রদান করে যিম্মি হয়ে বসবাস)- এর দাওয়াত দেবো। তাতে সম্মত হলে (তারা দারুল ইসলামের বাসিন্দা ও নাগরিক হয়ে যাবে), (জান-মাল ক্ষতির শিকার হলে) যেমন সুবিচার আমরা (মুসলমানরা পরস্পর) পেয়ে থাকি তারাও পাবে, (কারো জান মালের ক্ষতি করলে) যেমন বিচার (ও শাস্তি) আমাদের উপর বর্তায়, তাদের উপরও বর্তাবে। যাদের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছেনি, (দাওয়াত না দিয়ে) তাদের বিরুদ্ধে কিতাল করবো না। যাদের কাছে দাওয়াত পৌঁছেছে, মুস্তাহাবরূপে তাদেরকে (আবারও) দাওয়াত দেবো। ৩. অন্যথায় (অর্থাৎ জিযিয়া প্রদান করত যিম্মি হতে সম্মত না হলে) আল্লাহ তাআলার সাহায্য প্রার্থনা করে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হবো।” |
ব্যাখ্যা
এখান থেকে মুসান্নিফ রহ. كيفية القتال তথা কিতালের প্রক্রিয়ার বিবরণ শুরু করেছেন। অর্থাৎ কিতাল শুরুর আগে করণীয় কি? কিতালের সময় করণীয় কি? কাকে হত্যা করা যাবে, কাকে যাবে না? কেমন অস্ত্র ব্যবহার করা যাবে? কি কি ধ্বংস করা যাবে? – ইত্যাদি।
কিতাল শুরুর পূর্বে: ইসলাম ও যিম্মি হওয়ার দাওয়াত
কিতাল শুরুর পূর্বে কাজ হচ্ছে, কাফেরদেরকে দাওয়াত দেয়া। মুসলিম শরীফে বুরায়দা রাদি.র হাদিসে এ দাওয়াতের মৌলিক পয়েন্টগুলোর ইজমালি বিবরণ এসেছে।
প্রথমত তাদের সামনে ইসলামের সত্যতা এবং সৌন্দর্য তুলে ধরা হবে। ইসলাম মানার কল্যাণ এবং না মানার ক্ষতি ইত্যাদি তুলে ধরা হবে এবং ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হয়ে যাওয়ার আহ্বান জানানো হবে। হয়ে গেলে তো ভাল। তারা আমাদের ভাই হয়ে যাবে। তাদের ভূমি দারুল ইসলামে পরিণত হবে। শরীয়াহর ছায়াতলে চলে আসবে। আল্লাহর বিধান অনুযায়ী শাসিত হবে।
মুসলমান হতে রাজি না হলে জিযিয়ার দাওয়াত দেয়া হবে। জিযিয়ার দাওয়াত বলতে উদ্দেশ্য: আহলে যিম্মার পুরো নেজামটা তুলে ধরা। (আলজিহাদ ওয়াল কিতাল, খায়র হাইকল)
অর্থাৎ তাদের অবগত করা যে, যদি তোমরা মুসলমান হতে না চাও, তাহলে তোমাদের ভূমি আমাদের দায়িত্বে সমর্পণ কর। তোমাদের ভূমি দারুল ইসলামের অন্তর্ভুক্ত হবে। আল্লাহর বিধান অনুযায়ী শাসিত হবে। তোমরা তোমাদের আপন আপন মালিকানায় মুসলমানদের অধীনে সুখে শান্তিতে বসবাস করবে। নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পারবে। তবে তোমাদের মুআমালা, লেনদেন, ব্যবসা-বাণিজ্য মুসলমানদের মতো ইসলামী বিধান মতে চলবে। তোমাদের জান-মাল ও ইজ্জত-আব্রুর নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব আমাদের। বিনিময়ে তোমরা মাথাপিছু জিযিয়া দিবে আর তোমাদের যমিনে খারাজ আরোপিত হবে। জিযিয়া কাদের উপর বর্তাবে এবং বৎসরে কত করে, এমনিভাবে খারাজের পরিমাণ ও নিয়মাবলী কি হবে তাদের জানানো হবে।
মোটকথা, একজন অমুসলিম দারুল ইসলামে যিম্মি হয়ে বসবাস করতে কেমন বিধি বিধান; মোটামুটি তাদের জানানো হবে এবং যিম্মি হতে আহ্বান জানানো হবে। যদি তারা তাতে সম্মত হয়ে যায় তো ভাল। অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে কিতাল করা হবে। যখন তারা আল্লাহর দ্বীন গ্রহণ করে মুসলমান হতেও রাজি হলো না, এমনকি আল্লাহর দ্বীনের অধীনস্থ হয়ে যিম্মিরূপে বসবাস করতেও রাজি হলো না: তখন দুনিয়াতে স্বাধীনভাবে ফিরে বেড়ানোর অধিকার তাদের নেই। যমিন আল্লাহর। মাখলুক আল্লাহর। শাসনও চলবে আল্লাহর।
দাওয়াতের বিধান
উপরোল্লিখিত দাওয়াত যে কাফের ভূমিতে পৌঁছে গেছে, তাদের নতুন করে দাওয়াত দেয়া আবশ্যক নয়। যে ভূমিতে পৌঁছেনি, তাদের দাওয়াত দেয়া ওয়াজিব। দাওয়াত না দিয়ে কিতাল করা নাজায়েয।
যদি শুধু ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে থাকে, যিম্মি হয়ে বসবাসের বিষয়টি না পৌঁছে থাকে, তাহলে এ বিষয়টি অবগত করতে হবে। নইলে কিতাল জায়েয হবে না। হতে পারে যিম্মি হয়ে থাকার সুযোগ আছে বিষয়টি জানতে পারলে তারা যিম্মি হতে সম্মত হয়ে যেতো।
যাদের কাছে ইসলাম ও জিযিয়া উভয় দাওয়াত কোনোভাবে পৌঁছে গেছে (হুকমি দাওয়াত) বা আমরা নিজেরা তাদের উভয় প্রকার দাওয়াত ইতিমধ্যে দিয়েছি (হাকিকি দাওয়াত): তাদের নতুন করে দাওয়াত দেয়া হবে কি?
এ বিষয়টি মুসলিমদের কল্যাণ অকল্যাণের সাথে জড়িত। যদি এমন হয় যে,
ক. দাওয়াত দিলে মুসলমানদের ক্ষতির কোনো আশঙ্কা নেই।
খ. এবং কাফেররা দাওয়াত কবুল করতে পারে আশা আছে।
এই দুই শর্ত পাওয়া গেলে আবারও দাওয়াত দেয়া মুস্তাহাব। কিতাবাদিতে যেখানে দাওয়াত দেয়া মুস্তাহাব বলা হয়েছে, সেখানে এ দুই শর্ত সাপেক্ষে মুস্তাহাব উদ্দেশ্য।
পক্ষান্তরে যদি নতুন করে দাওয়াত দিতে গেলে মুসলমানদের ক্ষতির আশঙ্কা হয় -যেমন কাফেররা সতর্ক হয়ে যাবে, প্রস্তুতি নিয়ে নিবে কিংবা মুসলিমদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জাল বুনবে, ফলে তাদের বাগে আনা অত সহজ হবে না- তাহলে নতুন করে দাওয়াত দেয়া যাবে না।
এমনিভাবে যদি বুঝা যায় যে, তাদের নতুন করে দাওয়াত দেয়াতে কোনে ফায়েদা নেই, তারা দাওয়াত কবুল করবে না: তাহলেও দাওয়াত দেয়া মুস্তাহাব হবে না। বরং সুযোগ বুঝে এদের উপর অতর্কিত হামলা করাই মুনাসিব।
***
বি.দ্র. ০১ ফিকহের কিতাবাদিতে সাধারণত বলা হয়, কাফেরদের অবরোধ করার পর দাওয়াত দেয়া হবে। আসলে এটি জরুরী নয়। দাওয়াতের প্রক্রিয়া আগে থেকেই চলতে থাকতে পারে। যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন কাফের শাসকের কাছে চিঠি ও দাঈ পাঠিয়ে দাওয়াত দিয়েছেন। অনেক সময় কাফেরদের প্রতিনিধি দল ইসলাম সম্পর্কে জানতে, আলোচনা করতে মদীনায় এসেছে। দাওয়াতের কাজটি এভাবেও সম্পন্ন হয়ে যেতে পারে। যদি কোনো কাফের কওমের সাথে এ ধরনের দাওয়াতের পর্ব আগে সম্পন্ন না হয়ে থাকে, বরং আচানক আমরা তাদের ভূমিতে গিয়ে অবরোধ আরোপ করে বসেছি, তখনকার কথা ফিকহের কিতাবাদিতে বলা হয়েছে যে, এদেরকে দাওয়াত দেয়া ওয়াজিব। আগে থেকে যাদের সাথে দাওয়াতের পর্ব সম্পন্ন হয়ে আছে, তাদের নতুন করে দাওয়াত দেয়া আবশ্যক নয়। উপরোক্ত দুই শর্ত পাওয়া গেলে মুস্তাহাব।
বি.দ্র. ০২ প্রতিটি কাফেরের কাছে দাওয়াত পৌঁছানো জরুরী নয়। দায়িত্বশীলদের কাছে পৌঁছানোই যথেষ্ট, যারা চাইলে তাদের জনগণের কাছে পৌঁছাতে পারে। যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাফের শাসক ও গভর্নরদের কাছে চিঠি ও দাঈ পাঠিয়ে দাওয়াত দিতেন। জনগণ দায়িত্বশীলদের অনুগামী। রোম পারস্য এ ধরনের দাওয়াতের মাধ্যমেই বিজয় হয়েছে, প্রতিটি কাফেরের কাছে দাওয়াত পৌঁছানো হয়নি। (আলজিহাদ ওয়াল কিতাল, খায়র হাইকল)
বি.দ্র. ০৩ দাওয়াত পৌঁছানোর পর কাফেররা যদি বিচার বিবেচনা করে দেখার জন্য কিছু সময় চায়, তাহলে মুনাসিব মতো আমরা একটা সময় বেঁধে দেবো। এর মধ্যে ইসলাম বা জিযিয়া কবুলের সিদ্ধান্ত নিলে ভাল, অন্যথায় কিতাল হবে। যেমন তিন দিন, এক সপ্তাহ বা একটু বেশ কম। খুব একটা দীর্ঘ সময় দেয়া হবে না, যে সময়ে আমাদের অনর্থক বসে থাকতে হবে, অপরদিকে তারা কোনো ষড়যন্ত্র বিছানোর সুযোগ পেয়ে যেতে পারে। (আলজিহাদ ওয়াল কিতাল, খায়র হাইকল)
বি.দ্র. ০৪ দাওয়াতের উপরোক্ত বিধান ইকদামি জিহাদের ক্ষেত্রে, যখন আমরা কাফেরদের ভূমি দখল করতে হামলা করতে যাচ্ছি। পক্ষান্তরে যদি তারা আমাদের ভূমিতে হামলা করে বসে, তাহলে দাওয়াতের বিধান নেই। এ সময় কাজ: মুসলিম ভূমি হতে শত্রু বিতাড়ন। (শারহুস সিয়ার, আহকামু আহলিযম্মিাহ)
এর একটা উদাহরণ দেয়া যায়: হাদিসে সাপ মারার আগে সাপতে সতর্ক করতে বলা হয়েছে। কারণ, হতে পারে সেটা সাপ নয়, জিন। কিন্তু কোনো সাপ যদি অকস্মাৎ আপনার কোলে পড়ে যায়, তাহলে আপনি আগে কাপড় ঝাড়া দিয়ে সাপটি দূরে ফেলবেন। কাফেররাও সাপতুল্য। তাদের বিষয়টিও এমনই। আমাদের ঘাড়ে এসে পড়ে গেলে আগে পিটিয়ে বিতাড়িত করা হবে। ওয়াল্লাহু আ’লাম।
***
Comment