০৬ কি ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করা যাবে এবং কি কি ধ্বংস করা যাবে
وإلّا نستعين بالله تعالى ونحاربهم بنصب المجانيق، وحرقهم، وغرقهم، وقطع أشجارهم، وإفساد زروعهم، ورميهم وإن تترّسوا ببعضنا ونقصدهم “(জিযিয়া প্রদানে যিম্মি হয়ে বাস করতে সম্মত) না হলে আল্লাহ তাআলার কাছে (তাদের বিরুদ্ধে) সাহায্য প্রার্থনা করে যুদ্ধ শুরু করবো। (প্রয়োজনে) মানজানিক (ক্ষেপণাস্ত্র) স্থাপন করবো। তাদের জ্বালিয়ে দিবো। ডুবিয়ে দিবো। তাদের গাছ (বাগান) কেটে (উজাড় করে) দিবো। (ক্ষেত-মাঠের) ফসল নষ্ট করে দিবো। আমাদের কতক মুসলমানকে মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে সামনে ধরলেও তাদের (অর্থাৎ কাফেরদের) উপর (তীর-বর্শা বা আগুন-পাথর) নিক্ষেপ করে চলবো। তবে (বাহ্যত তা গিয়ে মুসলিমদের উপর পড়লেও নিক্ষেপের দ্বারা) আমাদের টার্গেট থাকবে কাফেররা (মুসলিমরা নয়)।” |
মুসান্নিফ রহ. এখানে কাফেরদের বিরুদ্ধে কি ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করা যাবে এবং তাদের কি কি ধ্বংস করা যাবে তার আলোচনা করেছেন।
প্রথমে মনে রাখতে হবে: আমরা এখন এমনসব কাফেরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে, যারা না আল্লাহর দ্বীন কবুল করেছে, না আল্লাহর দ্বীনের অধীনস্থ হয়ে বসবাস করতে সম্মত হয়েছে। উভয়টি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার কারণে তাদের জান-মাল মুবাহ ও হালাল হয়ে গেছে। তাদের বশীভূত করতে দুনিয়ার স্বাভাবিক রণকৌশল অনুযায়ী সমরবিশেষজ্ঞগণ যে ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করা মুনাসিব ও উপযোগী এবং উদ্দেশ্য হাসিলের পথে সহায়ক মনে করেন; ব্যবহার করা যাবে। যা কিছু ধ্বংস করা প্রয়োজন মনে করেন ধ্বংস করা যাবে।
স্বয়ং কাফেরদের যখন হত্যা করে ফেলা জায়েয হচ্ছে, তখন তাদের সম্পদের ব্যাপারে আর কি কথা থাকতে পারে! সম্পদের মূল্য তো জীবনের চেয়ে বেশি না।
বরং মুসলিমদের নিজেদের জান-মালই যখন বিলিয়ে দিতে হচ্ছে, তখন কাফেরদের জান মালের ব্যাপারে আর কি কথা থাকতে পারে!
তবে মনে রাখতে হবে: আমাদের মূল উদ্দেশ্য কাফেরদের হত্যা করে নির্মূল করে ফেলা বা তাদের সহায় সম্পদ ধ্বংস করে নিঃশেষ করে ফেলা নয়। বরং মূল উদ্দেশ্য তাদের শক্তি খর্ব করা। যাতে তারা বাধ্য হয়ে শেষে হয় ইসলাম গ্রহণ করে, কিংবা অন্তত তাদের রাষ্ট্র আমাদের হাতে সমর্পণ করে আমাদের বশ্যতা স্বীকার করে। এ উদ্দেশ্য হাসিল হতে যতটুকু হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসাযজ্ঞ প্রয়োজন করা যাবে। এর বেশি নিষ্প্রোয়োজন।
***
উপরোক্ত মূলনীতি বুঝার পর এবার মুসান্নিফ রহ. এর শব্দগুলোর ব্যাখ্যায় আসা যাক:
بنصب المجانيق– মানজানিক স্থাপন করবো: মানজানিক বলা হয় তখনকার যুগে ব্যবহৃত এক বিশেষ প্রকারের ক্ষেপণাস্ত্র জাতীয় যুদ্ধাস্ত্র, যা দিয়ে বড় বড় পাথর ও আগুন নিক্ষেপ করা হতো। সাধারণত দুর্গ ও দুর্গ-প্রাচীর বা নগর-প্রাচীরে ভাঙন ও ফাটল ধরাতে এগুলো ব্যবহার করা হতো। আধুনিক ট্যাংক, কামান এবং গোলা ও মিসাইল নিক্ষেপক আবিষ্কার হওয়ার পর পুরোনো সেই মানজানিক এখন আর ব্যবহার হয় না।
মানজানিক থেকে নিক্ষিপ্ত পাথরে যখন প্রাচীর ও স্থাপনা ধ্বসে পড়তো, এসবের নিচে চাপা পড়ে মহিলা, শিশু ও অতিবৃদ্ধ যাদের হত্যা করা স্বাভাবিক অবস্থায় নিষেধ, তারাও মারা পড়বে- এটাই স্বাভাবিক।
মানজানিকের পাথরের আঘাতে অনেকে থেঁতলে যাবে।
নিক্ষিপ্ত আগুনে অনেকে ভস্ম হয়ে যাবে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে তায়েফবাসীর বিরুদ্ধে মানজানিক স্থাপন করেছেন। সাহাবায়ে কেরাম বিভিন্ন যুদ্ধে মানজানিক ব্যবহার করেছেন। এ থেকে বুঝা গেল:
* স্বাভাবিক অবস্থায় যাদের হত্যা করা নিষেধ, বিধ্বংসী অস্ত্রের কবলে অনিচ্ছাকৃত মারা গেলে সমস্যা নেই।
* স্বাভাবিক অবস্থায় আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে হত্যা করা নিষেধ হলেও, বিধ্বংসী অস্ত্রের কবলে অনিচ্ছাকৃত পুড়ে মারা গেলে সমস্যা নেই।
* স্বাভাবিক অবস্থায় থেঁতলিয়ে মারা বা অঙ্গ-বিকৃতি ঘটানো নিষেধ হলেও, বিধ্বংসী অস্ত্রের কবলে অনিচ্ছাকৃত থেঁতলে গেলে বা অঙ্গ-বিকৃতি ঘটলে গেলে সমস্যা নেই।
উপরোক্ত নীতি অনুযায়ী: আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র, বোমা, বারুদ, মিসাইল ও বিস্ফোরক ব্যবহারে কোনো সমস্যা নেই। কাফেরদের বশীভূত করতে যতটুকু প্রয়োজন ব্যবহার করা যাবে।
অবশ্য কোনো কাফেরকে বন্দী করে আনার পর আগুনে পুড়িয়ে, ট্যাংকের নিচে চাপা দিয়ে, পানিতে ডুবিয়ে, শরীরে বোমা বেঁধে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বা গাছের সাথে বেঁধে মিসাইল নিক্ষেপে হত্যা করা (হানাফি মাযহাব মতে) জায়েয হবে না। বরং তরবারির আঘাতে বা গুলি করে ইহসানের সাথে স্বাভাবিকভাবে হত্যা করতে হবে।
وحرقهم – তাদের পুড়িয়ে দিবো: অর্থাৎ যুদ্ধাবস্থায় তাদের উপর মানজানিক, ট্যাংক, কামান বা অন্য কিছুর মাধ্যমে আগুন বা বিস্ফোরক নিক্ষেপ করা যাবে। এতে তারা ভস্ম হয়ে গেলেও সমস্যা নেই। অবশ্য বন্দী করে আনার পর আগুনে পুড়িয়ে মারা যাবে না, যেমনটা আগের পয়েন্টে বলা হয়েছে।
এমনিভাবে তাদের বাড়িঘর, স্থাপনা, মিল-ফ্যাক্টরি, অফিস-আদালত, ব্যাংক-ব্যালেন্স ইত্যাদিতে অগ্নি সংযোগ করতেও সমস্যা নেই।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইয়াহুদি গোত্র বনু নজিরের বাগানে অগ্নি সংযোগ করেছিলেন।
উসামা রাদি.কে তৎকালীন খ্রিস্টান শাসিত ফিলিস্তিনের উবনায় অগ্নি সংযোগ করতে আদেশ দিয়েছিলেন। সহীহাইনসহ অন্যান্য কিতাবে এসব ঘটনার বিস্তারিত আলোচনা আছে।
কারণ, এ অগ্নি সংযোগে তাদের সম্পদ ধ্বংস হবে এবং তারা দুর্বল হয়ে পড়বে। আর তাদের দুর্বল করাই আমাদের টার্গেট।
অবশ্য- যেমনটা শুরুতে বলা হয়েছে- যখন বিজয় নিশ্চিত হয়ে যাবে, এসব সম্পদ বিজিত হয়ে আমাদের হাতে চলে আসার পথে আর কোনো বাধা থাকবে না: তখন কোনো কিছু ধ্বংস করা জায়েয হবে না। কারণ, তখন এগুলো ধ্বংস করার অর্থ বিনা কারণে আমাদের নিজস্ব সম্পদ ধ্বংস করা, আর তা নিষেধ। (ফাতহুল কাদির, শামি)
وغرقهم – তাদের ডুবিয়ে দিবো: অর্থাৎ তাদের পরাস্ত করতে যদি বাঁধ কেটে দিয়ে বা অন্য কোনোভাবে তাদের বা তাদের বাড়িঘর, স্থাপনা ইত্যাদি ডুবিয়ে দেয়া সহায়ক মনে হয়, করা যাবে।
وقطع أشجارهم – তাদের গাছ বাগান কেটে উজাড় করে ফেলবো: অর্থাৎ তাদের পরাস্ত করতে যদি তাদের গাছ-গাছালি, বাগান ইত্যাদি কেটে ফেলা সহায়ক মনে হয়, কেটে ফেলা যাবে; যদিও ফলজ গাছ হয় এবং গাছে ফল বিদ্যমান থাকে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইয়াহুদি গোত্র বনু নজিরের খেজুর বাগান কেটে দিয়েছেন। এর সমর্থনে সূরা হাশরের ৫ নং আয়াত নাযিল হয়:
مَا قَطَعْتُمْ مِنْ لِينَةٍ أَوْ تَرَكْتُمُوهَا قَائِمَةً عَلَى أُصُولِهَا فَبِإِذْنِ اللَّهِ وَلِيُخْزِيَ الْفَاسِقِينَ. –الحشر: 5
وإفسادزروعهم– তাদের ক্ষেত মাঠের ফল ফসল নষ্ট করে দিবো: অর্থাৎ তাদের পরাস্ত করার পথে সহায়ক হলে তাদের ফল ফসল নষ্ট করে ফেলা যাবে। যেমন ফসলের ক্ষেতে আগুন ধরিয়ে দিলাম। বাঁধ কেটে ফসল ডুবিয়ে দিলাম। বিষ প্রয়োগে পানি, মাছ ইত্যাদি নষ্ট করে দিলাম (মাবসূত)। মোটকথা: তাদের শক্তি খর্ব করে তাদের পরাস্ত করতে এবং তাদের ভূমি দখল করে তা দারুল ইসলামের অন্তর্ভুক্ত করতে যতটুকু ধ্বংসাযজ্ঞ চালানো দরকার, চালানো যাবে। পরিশেষে যখন কাফেরদের শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাবে, আমাদের বিজয় নিশ্চিত হয়ে যাবে: তখন আর কোনো কিছু ধ্বংস করা যাবে না। কারণ, তখন কোনো কিছু ধ্বংস করার অর্থ আমাদের নিজস্ব সম্পদ বিনা কারণে ধ্বংস করা করা। আর বিনা কারণে সম্পদ নষ্ট করা নিষেধ (সহীহ মুসলিম)।
***
বি.দ্র. কাফেরদের দুর্গ বা সেনা ক্যাম্পে বা অন্য যেকোনো জায়গায়, যেখানে আমরা হামলা করা দরকার মনে করে হামলা করতে যাচ্ছি, সেখানে যদি কোনো মুসলিম বন্দী থাকে বা কোনো ব্যবসায়ী বা অন্য কোনো মুসলিম সেখানে বিদ্যমান থাকে, আর মনে হয় যে, হামলা করলে উক্ত মুসলিম মারা পড়বে, আবার তাকে বাঁচিয়ে হামলা করা সম্ভবও নয়: তাহলে আমরা হামলা করে দিবো। মুসলিম হত্যা আমাদের উদ্দেশ্য থাকবে না। ঘটনাক্রমে তারা মারা পড়লে আমাদের গুনাহ হবে না। এর বিনিময়ে কোনো জরিমানা বা দিয়াতও দিতে হবে না। অবশ্য যখন মুসলিমকে বাঁচিয়ে হামলা করা সম্ভব, তখন এমনভাবে হামলা করা যাবে না যে, মুসলিম মারা পড়ে। কাফেরদের নারী, শিশু ও অতিবৃদ্ধ যাদেরকে স্বাভাবিক অবস্থায় হত্যা করা নিষেধ, তাদের ব্যাপারেও একই কথা।
***
কিতাবুস সিয়ার: কানযুদ দাকায়িক: ০১ ভূমিকা ও জিহাদের হুকুম
https://dawahilallah.com/forum/%E0%A...A7%81%E0%A6%AE
কিতাবুস সিয়ার: কানযুদ দাকায়িক: ০২ যাদের উপর জিহাদ ফরয নয়
https://dawahilallah.com/forum/%E0%A...A6%A8%E0%A7%9F
কিতাবুস সিয়ার: কানযুদ দাকায়িক: ০৩ মুসলিম ভূমিতে আগ্রাসন হলে জিহাদ ফরযে আইন
https://dawahilallah.com/forum/%E0%A...A6%87%E0%A6%A8
কিতাবুস সিয়ার: কানযুদ দাকায়িক: ০৪ অভিযান প্রস্তুতির জন্য জনসাধারণের উপর চাঁদা ধার্য করার হুকুম
https://dawahilallah.com/forum/%E0%A...A7%81%E0%A6%AE
কিতাবুস সিয়ার: কানযুদ দাকায়িক: ০৫ কিতালপূর্ব দাওয়াত: ইসলাম ও জিযিয়া
Comment