১০ যেসব কাফেরকে হত্যা করা নিষেধ এবং এ নিষেধের ক্ষেত্র
ونهينا عن ... وقتلِ امرأةٍ وغيرِ مكلّفٍ وشيخٍ فانٍ وأعمى ومقعدٍ[1]؛ إلّا أن يكون أحدهم ذا رأيٍ في الحرب أو ملكًا “এবং বারণ করা হয়েছে মহিলা, গাইরে মুকাল্লাফ, শায়খে ফানি, অন্ধ এবং পঙ্গুদের হত্যা করতে। তবে তাদের কেউ যুদ্ধে নির্দেশনা-প্রদানকারী কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান হলে (হত্যা করা যাবে)।” |
ব্যাখ্যা
কাফেরদের মধ্য থেকে কাকে কাকে হত্যা করা নিষেধ এবং এ নিষেধাজ্ঞা কখন প্রযোজ্য- মুসান্নিফ রহ. এ ইবারাতে তার আলোচনা করেছেন।
হাদিসে মহিলা এবং নাবালেগ শিশুদের হত্যা করতে পরিষ্কার নিষেধ এসেছে। এছাড়া কয়েকটি জয়িফ হাদিসে আরও কয়েক শ্রেণীর কাফেরকে হত্যা করতে নিষেধ এসেছে। জয়িফগুলো যদি বাদ দিই, তাহলে এতটুকু পরিষ্কার যে, মহিলা ও নাবালেগ শিশুকে হত্যা করা নিষেধ।[2]
নাবালেগকে হত্যা করতে নিষেধ করা হয়েছে, কারণ সে গাইরে মুকাল্লাফ। অর্থাৎ সে এখনও ইলাহী বিধি বিধান পালনে আদিষ্ট হয়নি। এ দৃষ্টিকোণ থেকে পাগলকেও হত্যা করা নিষেধ। কারণ, সে-ও ইলাহী বিধি বিধান পালনে আদিষ্ট নয়। মুসান্নিফ রহ. এর বক্তব্যে وغيرِ مكلّفٍ দ্বারা এ দুই শ্রেণীর কাফের উদ্দেশ্য।[3]
মহিলা মুকাল্লাফ তথা ইলাহী বিধি বিধান পালনে আদিষ্ট হলেও, তাকে হত্যা করতে নিষেধ করা হয়েছে, কারণ: স্বভাবত মহিলাদের শারীরিক গঠন যুদ্ধ করার উপযোগী নয়। তাছাড়া কিছু ব্যতিক্রম বাদে মহিলারা যুদ্ধ করতে আসেও না। যুদ্ধের দায়িত্ব সাধারণত পুরুষরাই পালন করে এবং আল্লাহ তাআলা তাদের শারীরিক গঠন যুদ্ধের উপযোগী করে বানিয়েছেন। এ দৃষ্টিকোণ থেকে মহিলারা مقاتل তথা যুদ্ধে সক্ষমদের কাতারে পড়ে না, বরং عاجز তথা যুদ্ধে অক্ষমদের কাতারে পড়ে। পুরুষরা পরাজিত হলে মহিলাদের তরফ থেকে আর তেমন কোনো ক্ষয়-ক্ষতির আশঙ্কা নেই। এই একই কারণে মুসলিম মহিলাদের উপর সশস্ত্র কিতাল ফরয নয়।
যে কারণে মহিলাদের হত্যা করা নিষেধ, যেসব কাফেরের মধ্যে সে কারণটি পাওয়া যাবে, তাদেরকেও হত্যা করা নিষেধ হবে। এ দৃষ্টিকোণ থেকেই অন্ধ, পঙ্গু, প্যারালাইসিস জাতীয় কাফের এবং শায়খে ফানিকে হত্যা করা নিষেধ হবে।[4] কারণ, মহিলাদের মতো তারাও সাধারণত কিতাল করতে অক্ষম।
সংক্ষেপে: মহিলাদের হত্যা নিষেধ থেকে বুঝা গেল, শারীরিক কোনো প্রতিবন্ধকতার কারণে যারা সাধারণত কিতাল করতে সক্ষম নয়, তাদের হত্যা করা নিষেধ। এ দৃষ্টিকোণ থেকেই ফুকাহায়ে কেরাম আরও কয়েক শ্রেণীর কাফেরকে হত্যা করতে নিষেধ করেছেন।
অন্য কথায়: মহিলা ও নাবালেগ শিশুদের হত্যা নসের দ্বারা নিষেধ। অন্যদেরটা ইজতিহাদি। এ কারণে অন্য কাফেরদের কাকে হত্যা করা যাবে আর কাকে যাবে না এ ব্যাপারে ফুকাহায়ে কেরামের ইখতিলাফ রয়েছে। আমরা উপরে যে আলোচনা করলাম, তা হানাফি মাযহাবের সিদ্ধান্ত।
শায়খে ফানি
শায়খে ফানি হওয়ার জন্য তিনটি শর্ত:
ক. কিতাল করার মতো শারীরিক শক্তি নেই (যদিও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সব সুস্থ)।
খ. কাফেরদের সাথে মুসলিমদের যুদ্ধ বেঁধে গেলে চিৎকার করে নিজ দলকে উদ্বুদ্ধ করার মতো শক্তিও নেই।
গ. সন্তান জন্ম দেয়ার শক্তি নেই।
কোনো কাফের এতটুকু শক্তিহীনতার পর্যায়ে পৌঁছে গেলে, সুস্থ-মস্তিষ্ক-সম্পন্ন এবং অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সব সুস্থ হলেও তাকে হত্যা করা যাবে না।
إلّا أن يكون أحدهم ذا رأيٍ في الحرب أو ملكًا - তবে তাদের কেউ যুদ্ধে নির্দেশনা-প্রদানকারী কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান হলে হত্যা করা যাবে
অর্থাৎ শারীরিক প্রতিবন্ধীত্ব এবং অক্ষমতার কারণে যাদের হত্যা করা নিষেধ ছিল, তাদের কেউ যদি যুদ্ধ বিশেষজ্ঞ হয় এবং কাফের বাহিনিকে বুদ্ধি পরামর্শ ও নির্দেশনা দিয়ে সহায়তা করে, তাহলে তাকে হত্যা করা যাবে।
মুলতাকাল আবহুরে বলা হয়েছে,
أو ذا مال يحث به. –ملتقى الأبحر: 415
“কিংবা যদি সম্পদের অধিকারী হয়, যারা দ্বারা সে (নিজ বাহিনিকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে) উদ্বুদ্ধ করছে।”
“কিংবা যদি সম্পদের অধিকারী হয়, যারা দ্বারা সে (নিজ বাহিনিকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে) উদ্বুদ্ধ করছে।”
হিদায়াতে বলা হয়েছে,
وكذا يقتل من قاتل من هؤلاء دفعا لشره. –الهداية (2/ 381)
“এমনিভাবে তাদের কেউ সরাসরি যুদ্ধে চলে আসলে, অনিষ্ট দমনের স্বার্থে তাকেও হত্যা করা যাবে।”
তাদের কেউ রাষ্ট্র প্রধান হলে তাকেও হত্যা করা যাবে। কেননা, সরাসরি যুদ্ধ করা কিংবা বুদ্ধি পরামর্শ বা সম্পদ দিয়ে সহায়তা করার চেয়েও তার অনিষ্ট বেশি। রাষ্ট্র প্রধানকে হত্যা করে দেয়া সম্ভব হলে সাধারণত বাহিনির মনোবল দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। “এমনিভাবে তাদের কেউ সরাসরি যুদ্ধে চলে আসলে, অনিষ্ট দমনের স্বার্থে তাকেও হত্যা করা যাবে।”
সারকথা
# যেকোনো কাফের; পুরুষ হোক মহিলা হোক, সক্ষম হোক অক্ষম হোক: ক. মুসলিমদের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হলে, খ. সম্পদ দিয়ে গ. কিংবা বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে কাফের বাহিনিকে সহায়তা করলে ঘ. কিংবা সে রাষ্ট্র প্রধান হলে তাকে হত্যা করা জায়েয।
# সরাসরি যুদ্ধে না আসলে, বুদ্ধি পরামর্শ কিংবা ধন সম্পদ দিয়ে কাফের বাহিনিকে কোনো সহায়তা না করলে এবং রাষ্ট্র প্রধান না হলে: মহিলা, নাবালেগ শিশু ও শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী ও অক্ষম কাফেরদের হত্যা করা যাবে না।
# এছাড়া বাকি সকল বালেগ কাফেরকে হত্যা করা জায়েয- যদিও তারা যুদ্ধে না আসে। এক্ষেত্রে সামরিক ও বেসামরিক কাফেরের মাঝে কোনো তফাৎ নেই। ইসলামের দৃষ্টিতে সুস্থ মস্তিষ্ক-সম্পন্ন এবং শারীরিক প্রতিবন্ধী নয় এমন সকল বালেগ কাফের ‘মুকাতিল’ তথা সামরিক। (শারহুস সিয়ার, বাদায়িউস সানায়ি’)
বি.দ্র. ০১
সামরিক বেসামরিক সকল সুস্থ বালেগ কাফেরকে হত্যা করা যদিও জায়েয, তথাপি বিশেষ কোনো ফায়েদা বা জরুরত না থাকলে সাধারণ কাফেরদের হত্যা না করাই ভাল। নেতৃত্বস্থানীয় এবং সামরিক কাফেরদের টার্গেট করা উচিৎ। কোনো কোনো হাদিসে কৃষক, গোলাম ও মজদুরদের হত্যা করতে যে না করা হয়েছে, তা দ্বারা এটিই উদ্দেশ্য। অর্থাৎ মূলত হত্যা জায়েয, তবে জরুরত বা বিশেষ কোনো ফায়েদা না থাকলে হত্যা না করা ভাল। বিস্তারিত শারহুস সিয়ারে দ্রষ্টব্য।
বি.দ্র. ০২
যাদের হত্যা করা হবে না, তাদেরকে দারুল হারবে ছেড়েও আসবে না। বরং বন্দী করে দারুল ইসলামে নিয়ে আসবে। এরপর তাদের ক্ষেত্রে বিভিন্ন অপশন রয়েছে। ইমামুল মুসলিমিন মাসলাহাতের বিবেচনায় যেকোনোটি গ্রহণ করতে পারেন। যেমন:
ক. বালেগদের হত্যা করে দেয়া।
খ. গোলাম বাঁদি বানানো।
গ. জিযিয়া প্রদানের শর্তে যিম্মি বানানো।
ঘ. বন্দী বিনিময় করে মুসলিম বন্দীদের মুক্ত করা।
ঙ. প্রয়োজনে কিছু কাফেরকে মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেয়া।
চ. মাসলাহাত মনে করলে কোনো কাফেরকে বিনা মুক্তিপণেই ছেড়ে দেয়া।
গোলাম বাঁদি বানানো হয়তো বর্তমান হালে সহজ হবে না। বাকি অপশনগুলো মাসলাহাতের বিবেচনায় গ্রহণ করতে পারেন। এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা গনিমতের অধ্যায়ে আসবে ইনশাআল্লাহ।
***
[1] الْمُقْعَد بِضَمٍّ فَفَتْحٍ مَنْ لَا يَقْدِرُ عَلَى الْقِيَامِ. اهـ رد المحتار: 6\660 (... وَمُقْعَدٍ) أَيْ أَعْرَجَ فَتْحٌ. اهـ رد المحتار: 4\126
[2] যদি তারা কোনোভাবে যুদ্ধে শরীক না হয়। এ ব্যাপারে আলোচনা সামনে আসবে ইনশাআল্লাহ।
[3] البحر الرائق (5/ 84): وغير المكلف شامل للصبي والمجنون. اهـ
[4] শায়খে ফানির ব্যাখ্যা সামনে আসছে।
Comment