মালহামা ও তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ :
আরবি ভাষায় ‘আল-মালহামা’ (الملحمة) শব্দটির উৎসমূল হলো ‘লাহমুন’ (لحم) বা মাংস। এটার শাব্দিক অর্থ, মাংসঘর বা কসাইখানা। শেষ জমানায় সংঘটিত মালহামায় যেহেতু ব্যাপক নৃশংসতা ও ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড ঘটবে, যার কারণে বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে সারি সারি লাশ পড়ে থাকবে, তাই হাদিসে এটাকে বলা হয়েছে, ‘আল-মালহামা’ (الملحمة) বা তীব্র রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। কিছু বর্ণনায় এটাকে বলা হয়েছে, ‘আল-মালহামাতুল উযমা’ (الملحمة العظمى) বা বৃহত্তর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ এবং কিছু বর্ণনায় বলা হয়েছে, ‘আল-মালহামাতুল কুবরা’ (الملحمة الكبرى) বা সবচেয়ে বড় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। এটা আক্ষরিক অর্থেই ভয়ংকরতম এক কসাইখানা সদৃশ, যেখানে অসংখ্য মানুষকে নজিরবিহীনভাবে হত্যা করা হবে। এদের কেউ নিহত হবে ন্যায়ের পক্ষে থেকে, আর কেউ নিহত হবে অন্যায়ের পক্ষালম্বন করে।
আরবি ভাষায় ‘আল-মালহামা’ (الملحمة) শব্দটির বহুবচন হলো ‘আল-মালাহিম’ (الملاحم)। এ শব্দটি সাধারণত এপোক্যাল্যাপটিক বা যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং শেষ জমানার মহাযুদ্ধের ভবিষ্যদ্বাণী সম্পর্কিত বর্ণিত হাদিসসমূহের একটি পৃথক ধারা বোঝাতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যেমন বলা হয়- ‘কিতাবুল মালাহিম’ (كتاب الملاحم) বা যুদ্ধ-বিগ্রহসংক্রান্ত অধ্যায়। অনুরূপ বলা হয়- ‘আহাদিসুল মালাহিম’ (الملاحم أحاديث) বা যুদ্ধ-বিগ্রহসংক্রান্ত হাদিসসমূহ।
হাদিসের ভাষ্যানুসারে মালহামা হলো শেষ জমানায় সংঘটিত এমন একটি মহাযুদ্ধ, যেটাকে মানব-ইতিহাসের অন্যতম ভয়ংকর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বলে অভিহিত করা হয়েছে। খ্রিষ্টানরা তাদের ধর্মীয় গ্রন্থের উদ্ধৃতিতে এটাকে ‘মারিকাতু হারমাজিদুন’ (معركة هرمجدون) বা আর্মাগেডনের যুদ্ধ বলে অভিহিত করে থাকে। বিভিন্ন হাদিসের ভাষ্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, রক্তক্ষয়ী এ মহাযুদ্ধটি ইমাম মাহদির সময়ে দাজ্জালের আবির্ভাবের কিছুকাল আগে ঘটবে।
হাদিসের আলোকে মালহামার বিবরণ :
একাধিক সহিহ হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মালহামা সম্পর্কে বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন। হাদিসগুলোর ভাষ্য থেকে বুঝা যায় যে, মুসলিম ও খ্রিষ্টানরা সন্ধির মাধ্যমে একজোট হয়ে তৃতীয় একদল শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করে বিজয় লাভ করবে। সম্মিলিত জোটের বিজয়ের পর একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে জোটে ফাটল সৃষ্টি হবে এবং মুসলিম ও খ্রিষ্টানরা পৃথক হয়ে পরস্পরে যুদ্ধে লিপ্ত হবে। এটাকেই হাদিসে ‘আল-মালহামা’ বা তীব্র রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বলা হয়েছে। এ ঘটনার পূর্ণ বিবরণ সহিহ হাদিসসমূহে বর্ণিত হয়েছে।
ইমাম আবু দাউদ রাহিমাহুল্লাহ-সহ প্রমুখ মুহাদ্দিস সহিহ সনদে যু-মিখবার রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে বলতে শুনেছি- سَتُصَالِحُونَ الرُّومَ صُلْحًا آمِنًا، فَتَغْزُونَ أَنْتُمْ وَهُمْ عَدُوًّا مِنْ وَرَائِكُمْ، فَتُنْصَرُونَ، وَتَغْنَمُونَ، وَتَسْلَمُونَ، ثُمَّ تَرْجِعُونَ حَتَّى تَنْزِلُوا بِمَرْجٍ ذِي تُلُولٍ، فَيَرْفَعُ رَجُلٌ مِنْ أَهْلِ النَّصْرَانِيَّةِ الصَّلِيبَ، فَيَقُولُ: غَلَبَ الصَّلِيبُ، فَيَغْضَبُ رَجُلٌ مِنَ الْمُسْلِمِينَ، فَيَدُقُّهُ، فَعِنْدَ ذَلِكَ تَغْدِرُ الرُّومُ، وَتَجْمَعُ لِلْمَلْحَمَةِ. ‘অচিরেই তোমরা রোমানদের (অর্থাৎ খ্রিষ্টানদের) সঙ্গে সন্ধি করবে। অতঃপর তোমরা ও তারা একত্র হয়ে তোমাদের পশ্চাৎবর্তী একদল শত্রুর মোকাবেলা করবে। তোমরা তাতে বিজয়ী হবে, গনিমত (যুদ্ধলব্ধ সম্পদ) অর্জন করবে এবং নিরাপদে ফিরে আসবে। অবশেষে তোমরা টিলাযুক্ত একটি মাঠে (যাত্রাবিরতির জন্য) অবতরণ করবে। অতঃপর খ্রিষ্টানদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি ক্রুশ উপরে উত্তোলন করে বলবে, ক্রুশ বিজয়ী হয়েছে। এতে মুসলিমদের মধ্যকার এক ব্যক্তি উত্তেজিত হয়ে তাকে হত্যা করবে। তখন রোমানরা চুক্তি ভঙ্গ করবে এবং যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করবে।’ [সুনানু আবি দাউদ : ৪/১০৯, হাদিস নং ৪২৯২; মুসনাদু আহমাদ : ৩৮/২২৮, হাদিস নং ২৩১৫৭; মুসতাদরাকুল হাকিম : ৪/৪৬৭, হাদিস নং ৮২৯৯]
সহিহ ইবনি হিব্বান-সহ অন্য আরও কিছু হাদিসগ্রন্থের বর্ণনায় ঘটনাটি আরও বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে। ইমাম ইবনু হিব্বান রাহিমাহুল্লাহ-সহ প্রমুখ মুহাদ্দিস সহিহ সনদে যু-মিখবার রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে বলতে শুনেছি- تُصَالِحُونَ الرُّومَ صُلْحًا آمِنًا حَتَّى تَغْزُوا أَنْتُمْ وَهُمْ عَدُوًّا مِنْ وَرَائِهِمْ فَتُنْصَرُونَ وَتَغْنَمُونَ وَتَنْصَرِفُونَ حَتَّى تَنْزِلُوا بِمَرْجٍ ذِي تُلُولٍ، فَيَقُولُ قَائِلٌ مِنَ الرُّومِ: غَلَبَ الصَّلِيبُ، وَيَقُولُ قَائِلٌ مِنَ الْمُسْلِمِينَ: بَلِ اللَّهُ غَلَبَ فَيَثُورُ الْمُسْلِمُ إِلَى صَلِيبِهِمْ وَهُوَ مِنْهُ غَيْرُ بَعِيدٍ فَيَدُقُّهُ، وَتَثُورُ الرُّومُ إِلَى كَاسِرِ صَلِيبِهِمْ، فَيَضْرِبُونَ عُنُقَهُ، وَيَثُورُ الْمُسْلِمُونَ إِلَى أَسْلِحَتِهِمْ فَيَقْتَتِلُونَ، فَيُكْرِمُ اللَّهُ تِلْكَ الْعِصَابَةَ مِنَ الْمُسْلِمِينَ بِالشَّهَادَةِ، فَتَقُولُ الرُّومُ لِصَاحِبِ الرُّومِ: كَفَيْنَاكَ الْعَرَبَ، فَيَجْتَمِعُونَ لِلْمَلْحَمَةِ، فَيَأْتُونَكُمْ تَحْتَ ثَمَانِينَ غَايَةً تَحْتَ كُلِّ غَايَةٍ اثْنَا عَشَرَ أَلْفًا. ‘(ভবিষ্যতে) তোমরা রোমানদের (অর্থাৎ খ্রিষ্টানদের) সঙ্গে সন্ধি করবে। অতঃপর তোমরা ও তারা একত্র হয়ে তোমাদের পশ্চাৎবর্তী একদল শত্রুর মোকাবেলা করবে। তোমরা তাতে বিজয়ী হবে, গনিমত (যুদ্ধলব্ধ সম্পদ) অর্জন করবে এবং (বিজয়ীবেশে যুদ্ধ থেকে) ফিরে আসবে। অবশেষে তোমরা টিলাযুক্ত একটি মাঠে (যাত্রাবিরতির জন্য) অবতরণ করবে। অতঃপর রোমানদের মধ্য থেকে একজন মন্তব্যকারী বলে উঠবে, ক্রুশ বিজয়ী হয়েছে। আর মুসলিমদের মধ্য থেকে একজন মন্তব্যকারী বলে উঠবে, বরং আল্লাহ বিজয়ী হয়েছেন। অতঃপর মুসলিম ব্যক্তিটি উত্তেজিত হয়ে তাদের ক্রুশের ওপর আক্রমণ করে বসবে, যা তার সন্নিকটেই ছিল এবং সেটাকে সে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ফেলবে। এতে রোমানরা উত্তেজিত হয়ে ক্রুশ চূর্ণকারী মুসলিম ব্যক্তির ওপর আক্রমণ করবে এবং তাঁর গর্দানে আঘাত করে হত্যা করে ফেলবে। এটা দেখে মুসলিমরাও উত্তেজিত হয়ে হাতে অস্ত্র তুলে নেবে এবং পরস্পরে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়বে। অতঃপর আল্লাহ তাআলা মুসলিমদের এ দলকে শাহাদাতের মর্যাদা দান করবেন। তখন রোমান খ্রিষ্টানরা রোমের বাদশাহকে গিয়ে বলবে, আপনার পক্ষ থেকে আমরা আরবদের (পরাজিত করার) জন্য যথেষ্ট হয়েছি। অতঃপর তারা মালহামা বা তীব্র রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করবে। এরপর তারা আশিটি পতাকাতলে সমবেত হয়ে (চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য) তোমাদের নিকট আগমন করবে। প্রতিটি পতাকাতলে বারো হাজার করে সৈন্য থাকবে।’ [সহিহু ইবনি হিব্বান : ১৫/১০১, হাদিস নং ৬৭০৮; মুসতাদরাকুল হাকিম : ৪/৪৬৭, হাদিস নং ৮২৯৮; আল-মুজামুল কাবির, তাবারানি : ৪/২৩৬, হাদিস নং ৪২৩১]
ইমাম ইবনু আবি আসিম রাহিমাহুল্লাহ এর বর্ণনায় হাদিসটির শেষে অতিরিক্ত এ অংশটুকু এসেছে- قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: فَتِلْكَ الْمَلْحَمَةُ الْعُظْمَى ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আর এটাই হলো ‘আল-মালহামাতুল উযমা’ বা বৃহত্তর রক্তক্ষয়ী মহাযুদ্ধ।’ [আল-আহাদ ওয়াল-মাসানি : ৫/১২৩, হাদিস নং ২৬৬৩]
মালহামা বা ভয়ংকর রক্তক্ষয়ী মহাযুদ্ধ কখন শুরু হবে?
এ ব্যাপারে হাদিস থেকে জানা যায় যে, মালহামা শুরু হওয়ার আগে দুটি বিশেষ ঘটনা ঘটবে। এক. বাইতুল মাকদিস বা জেরুজালেম অঞ্চল আবাদ হবে, সেখানে ব্যাপক জনবসতি গড়ে উঠবে এবং বৈশ্বিক রাজনীতিতে তার গুরুত্ব অনেক বেড়ে যাবে। দুই. মদিনা শহর বিরান হয়ে পড়বে, সেখানে বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে এবং বৈশ্বিক রাজনীতিতে তার গুরুত্ব একেবারে কমে যাবে।
এ ব্যাপারে ইমাম আবু দাউদ রাহিমাহুল্লাহ-সহ প্রমুখ মুহাদ্দিস সহিহ সনদে মুআয বিন জাবাল রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন- عُمْرَانُ بَيْتِ الْمَقْدِسِ خَرَابُ يَثْرِبَ، وَخَرَابُ يَثْرِبَ خُرُوجُ الْمَلْحَمَةِ، وَخُرُوجُ الْمَلْحَمَةِ فَتْحُ قُسْطَنْطِينِيَّةَ، وَفَتْحُ الْقُسْطَنْطِينِيَّةِ خُرُوجُ الدَّجَّالِ، ثُمَّ ضَرَبَ بِيَدِهِ عَلَى فَخِذِ الَّذِي حَدَّثَهُ، - أَوْ مَنْكِبِهِ - ثُمَّ قَالَ: إِنَّ هَذَا لَحَقٌّ كَمَا أَنَّكَ هَاهُنَا، أَوْ كَمَا أَنَّكَ قَاعِدٌ، يَعْنِي مُعَاذَ بْنَ جَبَلٍ ‘বাইতুল মাকদিসে (অর্থাৎ জেরুজালেমে) বসতি নির্মাণ মদিনা বিপর্যয়ের কারণ হবে, মদিনার বিপর্যয় মালহামা (অর্থাৎ রক্তক্ষয়ী মহাযুদ্ধ) শুরুর কারণ হবে, মালহামার সূচনা কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের কারণ হবে আর কনস্টান্টিনোপলের বিজয় দাজ্জাল আবির্ভাবের কারণ হবে। অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যার নিকট হাদিসটি বর্ণনা করেছেন, তার ঊরুতে বা কাঁধে নিজের হাত দ্বারা মৃদু আঘাত করে বললেন, এটা নিশ্চিত সত্য, যেমন তোমার এখানে থাকাটা অথবা তোমার এখানে বসাটা বাস্তব। অর্থাৎ তিনি মুআয বিন জাবাল রাযিয়াল্লাহু আনহুর ঊরুতে বা কাঁধে মৃদু আঘাত করে কথাটি বলেছেন।’ [সুনানু আবি দাউদ : ৪/১১০, হাদিস নং ৪২৯৪; মুসনাদু আহমাদ : ৩৬/৪৩২, হাদিস নং ২২১২১; মুসান্নাফু ইবনি আবি শাইবা : ৭/৪৯০, হাদিস নং ৩৭৪৭৭]
মালহামা কোথায় সংঘটিত হবে?
এ ব্যাপারে হাদিসসমূহের ভাষ্য থেকে পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় যে, মালহামা সংঘটিত হবে শাম (বর্তমানের সিরিয়া, জর্ডান, ফিলিস্তিন প্রভৃতি) দেশে। মুসলিমদের অবস্থানস্থল হবে ‘গুতা’, যা দামেশক শহরের নিকটবর্তী একটি অঞ্চলের নাম। ইমাম আবু দাউদ রাহিমাহুল্লাহ-সহ প্রমুখ মুহাদ্দিস সহিহ সনদে আবু দারদা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন- إِنَّ فُسْطَاطَ الْمُسْلِمِينَ يَوْمَ الْمَلْحَمَةِ بِالْغُوطَةِ، إِلَى جَانِبِ مَدِينَةٍ يُقَالُ لَهَا: دِمَشْقُ، مِنْ خَيْرِ مَدَائِنِ الشَّامِ ‘মালহামা বা তীব্র রক্তক্ষয়ী মহাযুদ্ধের সময় মুসলিমদের শিবির স্থাপন করা হবে ’গুতা’ অঞ্চলে, যা শামের সর্বোত্তম নগরী দামেশক নামক শহরের পাশে অবস্থিত হবে।’ [সুনানু আবি দাউদ : ৪/১১১, হাদিস নং ৪২৯৮; মুসনাদু আহমাদ : ৩৬/৫৬, হাদিস নং ২১৭২৫; মুসনাদুশ শামিয়্যিন, তাবারানি : ১/৩৩৫, হাদিস নং ৫৮৯]
তাবারানি আরেকটি বর্ণনায় উপরিউক্ত হাদিসের শেষোক্ত কথাটি এভাবে এসেছে- فَهِيَ خَيْرُ مَسَاكِنِ النَّاسِ يَوْمَئِذٍ ‘সুতরাং সেসময় দামেশক শহরটি হবে লোকদের জন্য সর্বোত্তম আবাসস্থল।’ [মুসনাদুশ শামিয়্যিন, তাবারানি : ২/২৬৬, হাদিস নং ১৩১৩]
হাকিমের বর্ণনায় উপরিউক্ত হাদিসের শেষোক্ত কথাটি এভাবে এসেছে- خَيْرُ مَنَازِلِ الْمُسْلِمِينَ يَوْمَئِذٍ ‘সেসময় দামেশক শহরটি হবে মুসলিমদের জন্য সর্বোত্তম অবস্থানস্থল।’ [মুসতাদরাকুল হাকিম : ৪/৫৩২, হাদিস নং ৮৪৯৬]
আর রোমান খ্রিষ্টানদের মূল অবস্থানস্থল হবে দাবিক বা আমাক অঞ্চলে। এ দুটি হলো শামের হালব শহরের নিকটবর্তী দুটি অঞ্চলের নাম। ইমাম মুসলিম রাহিমাহুল্লাহ-সহ প্রমুখ মুহাদ্দিস আবু হুরাইরা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন- لَا تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى يَنْزِلَ الرُّومُ بِالْأَعْمَاقِ أَوْ بِدَابِقٍ ‘ততক্ষণ পর্যন্ত কিয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না রোমান খ্রিষ্টানরা আমাক অথবা দাবিক অঞ্চলে (মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য) অবস্থান করবে।’ [সহিহু মুসলিম : ৪/২২২১, হাদিস নং ২৮৯৭; সহিহু ইবনি হিব্বান : ১৫/২২৪, হাদিস নং ৬৮১৩; আস-সুনানুল ওয়ারিদা ফিল ফিতান : ৬/১১১৪, হাদিস নং ৫৯৮]
মালহামার বিবরণ ও ফলাফল :
সহিহ হাদিসসমূহে মালহামার পূর্ণ বিবরণ এবং এর ফলাফল বা শেষ পরিণতি সুস্পষ্ট ভাষায় বর্ণিত হয়েছে। ইমাম মুসলিম রাহিমাহুল্লাহ-সহ প্রমুখ মুহাদ্দিস আবু হুরাইরা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন- لَا تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى يَنْزِلَ الرُّومُ بِالْأَعْمَاقِ أَوْ بِدَابِقٍ، فَيَخْرُجُ إِلَيْهِمْ جَيْشٌ مِنَ الْمَدِينَةِ، مِنْ خِيَارِ أَهْلِ الْأَرْضِ يَوْمَئِذٍ، فَإِذَا تَصَافُّوا، قَالَتِ الرُّومُ: خَلُّوا بَيْنَنَا وَبَيْنَ الَّذِينَ سَبَوْا مِنَّا نُقَاتِلْهُمْ، فَيَقُولُ الْمُسْلِمُونَ: لَا، وَاللهِ لَا نُخَلِّي بَيْنَكُمْ وَبَيْنَ إِخْوَانِنَا، فَيُقَاتِلُونَهُمْ، فَيَنْهَزِمُ ثُلُثٌ لَا يَتُوبُ اللهُ عَلَيْهِمْ أَبَدًا، وَيُقْتَلُ ثُلُثُهُمْ، أَفْضَلُ الشُّهَدَاءِ عِنْدَ اللهِ، وَيَفْتَتِحُ الثُّلُثُ، لَا يُفْتَنُونَ أَبَدًا فَيَفْتَتِحُونَ قُسْطَنْطِينِيَّةَ، فَبَيْنَمَا هُمْ يَقْتَسِمُونَ الْغَنَائِمَ، قَدْ عَلَّقُوا سُيُوفَهُمْ بِالزَّيْتُونِ، إِذْ صَاحَ فِيهِمِ الشَّيْطَانُ: إِنَّ الْمَسِيحَ قَدْ خَلَفَكُمْ فِي أَهْلِيكُمْ، فَيَخْرُجُونَ، وَذَلِكَ بَاطِلٌ، فَإِذَا جَاءُوا الشَّأْمَ خَرَجَ، فَبَيْنَمَا هُمْ يُعِدُّونَ لِلْقِتَالِ، يُسَوُّونَ الصُّفُوفَ، إِذْ أُقِيمَتِ الصَّلَاةُ، فَيَنْزِلُ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَأَمَّهُمْ، فَإِذَا رَآهُ عَدُوُّ اللهِ، ذَابَ كَمَا يَذُوبُ الْمِلْحُ فِي الْمَاءِ، فَلَوْ تَرَكَهُ لَانْذَابَ حَتَّى يَهْلِكَ، وَلَكِنْ يَقْتُلُهُ اللهُ بِيَدِهِ، فَيُرِيهِمْ دَمَهُ فِي حَرْبَتِهِ ‘ততক্ষণ পর্যন্ত কিয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না রোমান খ্রিষ্টানরা আমাক অথবা দাবিক অঞ্চলে (মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য) অবস্থান করবে। তখন তাদের মোকাবেলায় (দামেশক) শহর থেকে তখনকার সময়ে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ লোকদের একটি বাহিনী বের হয়ে আসবে। তারপর উভয় দল যখন (যুদ্ধের জন্য) সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান হবে তখন রোমানগণ বলবে, তোমরা আমাদের মাঝে এবং ওই সমস্ত লোকদের মাঝে রাস্তা ছেড়ে দাও, যারা আমাদের লোকদেরকে বন্দী করেছে; আমরা তাদের সাথে যুদ্ধ করব। তখন মুসলিমগণ বলবে, আল্লাহর শপথ! এটা হতে পারে না। আমরা তোমাদের মাঝে এবং আমাদের ভাইদের মাঝে রাস্তা ছেড়ে দেবো না। পরিশেষে তারা তাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হবে। এ যুদ্ধে মুসলিমদের এক-তৃতীয়াংশ সৈন্য পরাস্ত (হয়ে পলায়নপর) হবে। আল্লাহ তাআলা কখনো তাদের তাওবা গ্রহণ করবেন না। আর তাদের এক-তৃতীয়াংশ নিহত হবে এবং তারা হবে আল্লাহ তাআলার নিকট সর্বোত্তম শহীদ। আর তাদের অপর তৃতীয়াংশ বিজয় লাভ করবে। তারা আর কখনো ফিতনায় আক্রান্ত হবে না। এরপর তারা কনস্টান্টিনোপল বিজয় করবে। বিজয়ের পর তারা নিজেদের তলোয়ার জাইতুন বৃক্ষে ঝুলিয়ে গনিমত (যুদ্ধলব্ধ সম্পদ) ভাগ করতে থাকবে। ইতোমধ্যে তাদের মাঝে শয়তান উচ্চঃস্বরে চিৎকার করে বলতে থাকবে, দাজ্জাল তোমাদের পেছনে তোমাদের পরিবার-পরিজনের মধ্যে চলে এসেছে। এ কথা শুনে মুসলিমরা সেখান থেকে বের হবে; অথচ এটা ছিল মিথ্যা সংবাদ। অতঃপর তারা যখন (ঘর-বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে) পুনরায় শামে এসে পৌঁছবে তখন (সত্যিসত্যিই) দাজ্জালের আগমন ঘটবে। অতঃপর মুসলিম বাহিনী যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করবে এবং সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান হতে শুরু করবে। ইতোমধ্যে সালাতের জন্য ইকামত দেওয়া হবে, আর এদিকে ঈসা আলাইহিস সালাম (আসমান থেকে ফেরেশতার কাঁধে ভর করে দামেশকের মসজিদের মিনারে) অবতরণ করবেন এবং তিনি সালাতে মুসলিম বাহিনীর ইমামতি করবেন। অতঃপর আল্লাহ তাআলার শত্রু (দাজ্জাল) যখন তাঁকে দেখতে পাবে তখন সে গলে যেতে থাকবে; যেভাবে পানিতে লবণ গলে যায়। যদি ঈসা আলাইহিস সালাম তাকে (অস্ত্র দিয়ে হত্যা না করে) এমনিতেই ছেড়ে দেন তবুও সে নিজে নিজেই বিগলিত হতে হতে নিঃশেষ হয়ে যাবে। কিন্তু আল্লাহ তাআলা ঈসা আলাইহিস সালাম এর হাতে তাকে হত্যা করবেন এবং তার (নিহত হওয়ার) রক্ত ঈসা আলাইহিস সালাম এর বর্শাতে তিনি তাদেরকে দেখিয়ে দেবেন।’ [সহিহু মুসলিম : ৪/২২২১, হাদিস নং ২৮৯৭; সহিহু ইবনি হিব্বান : ১৫/২২৪, হাদিস নং ৬৮১৩; মুসতাদরাকুল হাকিম : ৪/৫২৯, হাদিস নং ৮৪৮৬]
এ সহিহ হাদিস থেকে আমরা কয়েকটি বিষয় জানতে পারি। যথা :
ক. শেষ জমানার মালহামা সংঘটিত হবে শাম (বর্তমান সিরিয়া, জর্ডান, ফিলিস্তিন প্রভৃতি) অঞ্চলজুড়ে। যদিও এ যুদ্ধে পশ্চিমারাসহ অন্যান্য অঞ্চলের অনেকেও অংশগ্রহণ করবে, কিন্তু তখন মধ্যপ্রাচ্যই হবে যুদ্ধের মূলভূমি। রোমান খ্রিষ্টানরা মোট আশিটি পতাকাতলে জোটবদ্ধ হয়ে প্রায় দশ লক্ষের মতো সৈন্য জমায়েত করবে। রোমান সৈন্যদের হেডকোয়ার্টার হবে হালব শহরের নিকটবর্তী এলাকা আমাক অথবা দাবিকে; যেমনটি এ হাদিসে স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। আর মুসলিম সৈন্যদের হেডকোয়ার্টার হবে দামেশকের পার্শ্ববর্তী গুতা নামক এলাকায়; যেমনটি পূর্বে সহিহ সনদে আবু দাউদের বর্ণনায় বর্ণিত হয়েছে।
খ. মালহামা বা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ কেবল একটি হবে না; বরং অনেক দিন ধরে বিভিন্ন স্থানে একাধিক যুদ্ধ হবে; যেমনটি বিভিন্ন হাদিসে ‘মালাহিম’ (‘মালহামা’ এর বহুবচন) ব্যবহার করে ইঙ্গিত করা হয়েছে। তবে এসব মালহামার সর্বশেষ যুদ্ধটি হবে শামে, যেটাকে হাদিসে ‘আল-মালহামাতুল উযমা’ (الملحمة العظمى) বা বৃহত্তর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ এবং ‘আল-মালহামাতুল কুবরা’ (الملحمة الكبرى) বা সবচেয়ে বড় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বলে অভিহিত করা হয়েছে। মালহামার প্রখম দিককার যুদ্ধগুলোতে ইমাম মাহদি থাকবেন কি-না, সে ব্যাপারে আমরা কোনো বর্ণনা পাইনি। তবে মুসলিম শরিফের এ হাদিস থেকে বুঝা যায় যে, তিনি সর্বশেষ ‘আল-মালহামাতুল উযমা’-তে উপস্থিত থাকবেন। কেননা, হাদিসে বলা হয়েছে বৃহত্তর মালহামা সংঘটিত হওয়ার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই দাজ্জালের আবির্ভাব ঘটবে এবং তার কিছুকালের মধ্যেই ঈসা আলাইহিস সালাম অবতরণ করবেন। আর এ কথা স্বতঃসিদ্ধ যে, ইমাম মাহদির আগমন দাজ্জালের আবির্ভাব ও ঈসা আলাইহিস সালাম এর অবতরণের বেশ আগেই ঘটবে। তাই মালাহামার শুরুর দিকে ইমাম মাহদি থাকার বিষয়ে কোনো কিছু না পাওয়া গেলেও শেষের দিকে তাঁর থাকার ব্যাপারে বেশ শক্তিশালী ইঙ্গিত পাওয়া যায়। আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন।
গ. অনেক মানুষ অতিরিক্ত জজবার কারণে মালহামা নিয়ে অনেক আগ্রহী ও উচ্ছ্বসিত হলেও অন্যদিক থেকে এটা যে বেশ ভয়ংকর ব্যাপার, তা তাদের অনেকেরই জানা নেই। মালহামায় একে তো ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ঘটবে, যা দেখে অনেকে ঘাবড়ে যাবে। মুসলিমদের বৃহৎ একটি অংশ শহীদ হয়ে যাবে। মুখে অনেকে শহীদ হওয়ার কথা বললেও শক্তিশালী ঈমানের অধিকারী না হলে বাস্তব ময়দানে খুব অল্প মানুষই অবিচল থাকতে পারে। শক্তিশালী ঈমান ও আখিরাতের প্রতিদানের ব্যাপারে দৃঢ় বিশ্বাস থাকলে অবশ্য শহীদ হওয়াটা মারাত্মক কোনো ব্যাপার নয়; বরং জান্নাত-প্রত্যাশী মুমিনদের জন্য এটা অত্যন্ত আনন্দদায়ক বিষয়। কিন্তু যুদ্ধের বিভীষিকা দেখে যদি পালিয়ে আসতে হয় তাহলে তার চেয়ে হতভাগা আর কেউ হবে না। হাদিসে তাদের ব্যাপারে বলা হয়েছে- ‘আল্লাহ তাআলা কখনো তাদের তাওবা গ্রহণ করবেন না।’ এটার ব্যাখ্যায় ইমাম নববি রাহিমাহুল্লাহ বলেন, আল্লাহ তাআলা তাদের অন্তরে অনুশোচনা সৃষ্টি করবেন না, তাওবার জন্য তাদেরকে অনুপ্রেরণা দান করবেন না। [আল-মিনহাজ শারহু মুসলিম, নববি : ১৮/২১] সুতরাং তারা তাওবা ছাড়াই মৃত্যুবরণ করবে। অতএব মালহামা নিয়ে আগ্রহীদের জন্য অধিক গুরুত্বপূর্ণ হলো, নিজেদের ঈমানকে সুদৃঢ় করা এবং সে অনুসারে সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ করা।
ঘ. কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের আগে দাজ্জাল আসার কোনো আশঙ্কা নেই। হাদিস থেকে বুঝা যায়, প্রথমে মালহামা শুরু হবে। এরপর বিভিন্ন জায়গায় একটানা অনেক মালহামা সংঘটিত হওয়ার পর যখন সর্বশেষ ‘আল-মালহামাতুল উযমা’ বা বৃহত্তর রক্তক্ষয়ী মহাযুদ্ধ সংঘটিত হবে এবং এর কিছুকাল পরে মুসলিমরা কনস্টান্টিনোপল বিজয় করবে তখন দাজ্জালের আর্বিভাব ঘটবে। তাই দাজ্জাল আসার আগে অবশ্যই এ ঘটনাগুলো ঘটতে হবে, তারপরই সে আসবে। দাজ্জাল আসার আগে যে ভয়ংকর সব মালহামা সংঘটিত হবে, তাতে মুসলিমদের বিরাট একটি অংশ মারা পড়বে এবং অনেকে যুদ্ধ থেকে পলায়ন করে গুনাহের বোঝা মাথায় নিয়েই কবরে যাবে। তাই এ মুহূর্তে দাজ্জাল মোকাবেলার প্রস্তুতির চাইতে মালহামার সময় করণীয় কী, সেটা নির্ধারণ করাই অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এ ব্যাপারে কোনো মুসলিমের উদাসীন থাকা ঠিক নয়।
মালহামায় হতাহতের সংখ্যা হবে নজিরবিহীন :
শেষ জমানার মালহামায় যুদ্ধের ভয়াবহতা এত বেশি মারাত্মক হবে যে, সে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের প্রায় সবাই-ই মারা পড়বে। খুব অল্পসংখ্যক লোকই বেঁচে থাকবে। লাশের পরিমাণ এতে বেশি হবে যে, কোনো পাখি সে লাশের সারির পার্শ্ব দিয়ে অতিক্রম করতে চাইলে অতিক্রম করার আগেই মরে মাটিতে পড়ে যাবে। এ যুদ্ধে যারা বেঁচে থাকবে, তাদের কোনো আনন্দ বাকি থাকবে না, গনিমতের প্রতি কোনো আগ্রহ থাকবে না।
কেননা, পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়স্বজন প্রায় সবাই মারা পড়বে। এ যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেও স্বস্তি নেই। এরপর তারা আগের চেয়ে আরও ভয়াবহ এক ফিতনার সম্মুখীন হবে। কেননা, এ ঘটনার পরপরই দাজ্জাল বের হয়ে আসবে।
এ ব্যাপারে ইমাম মুসলিম রাহিমাহুল্লাহ-সহ প্রমুখ মুহাদ্দিস ইউসাইর বিন জাবির রাহিমাহুল্লাহ থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন- هَاجَتْ رِيحٌ حَمْرَاءُ بِالْكُوفَةِ، فَجَاءَ رَجُلٌ لَيْسَ لَهُ هِجِّيرَى إِلَّا: يَا عَبْدَ اللهِ بْنَ مَسْعُودٍ جَاءَتِ السَّاعَةُ، قَالَ: فَقَعَدَ وَكَانَ مُتَّكِئًا، فَقَالَ: إِنَّ السَّاعَةَ لَا تَقُومُ، حَتَّى لَا يُقْسَمَ مِيرَاثٌ، وَلَا يُفْرَحَ بِغَنِيمَةٍ، ثُمَّ قَالَ: بِيَدِهِ هَكَذَا - وَنَحَّاهَا نَحْوَ الشَّأْمِ - فَقَالَ: عَدُوٌّ يَجْمَعُونَ لِأَهْلِ الْإِسْلَامِ، وَيَجْمَعُ لَهُمْ أَهْلُ الْإِسْلَامِ، قُلْتُ: الرُّومَ تَعْنِي؟ قَالَ: نَعَمْ، وَتَكُونُ عِنْدَ ذَاكُمُ الْقِتَالِ رَدَّةٌ شَدِيدَةٌ، فَيَشْتَرِطُ الْمُسْلِمُونَ شُرْطَةً لِلْمَوْتِ لَا تَرْجِعُ إِلَّا غَالِبَةً، فَيَقْتَتِلُونَ حَتَّى يَحْجُزَ بَيْنَهُمُ اللَّيْلُ، فَيَفِيءُ هَؤُلَاءِ وَهَؤُلَاءِ، كُلٌّ غَيْرُ غَالِبٍ، وَتَفْنَى الشُّرْطَةُ، ثُمَّ يَشْتَرِطُ الْمُسْلِمُونَ شُرْطَةً لِلْمَوْتِ، لَا تَرْجِعُ إِلَّا غَالِبَةً، فَيَقْتَتِلُونَ حَتَّى يَحْجُزَ بَيْنَهُمُ اللَّيْلُ، فَيَفِيءُ هَؤُلَاءِ وَهَؤُلَاءِ، كُلٌّ غَيْرُ غَالِبٍ، وَتَفْنَى الشُّرْطَةُ، ثُمَّ يَشْتَرِطُ الْمُسْلِمُونَ شُرْطَةً لِلْمَوْتِ، لَا تَرْجِعُ إِلَّا غَالِبَةً، فَيَقْتَتِلُونَ حَتَّى يُمْسُوا، فَيَفِيءُ هَؤُلَاءِ وَهَؤُلَاءِ، كُلٌّ غَيْرُ غَالِبٍ، وَتَفْنَى الشُّرْطَةُ، فَإِذَا كَانَ يَوْمُ الرَّابِعِ، نَهَدَ إِلَيْهِمْ بَقِيَّةُ أَهْلِ الْإِسْلَامِ، فَيَجْعَلُ اللهُ الدَّبْرَةَ عَلَيْهِمْ، فَيَقْتُلُونَ مَقْتَلَةً - إِمَّا قَالَ لَا يُرَى مِثْلُهَا، وَإِمَّا قَالَ لَمْ يُرَ مِثْلُهَا - حَتَّى إِنَّ الطَّائِرَ لَيَمُرُّ بِجَنَبَاتِهِمْ، فَمَا يُخَلِّفُهُمْ حَتَّى يَخِرَّ مَيْتًا، فَيَتَعَادُّ بَنُو الْأَبِ، كَانُوا مِائَةً، فَلَا يَجِدُونَهُ بَقِيَ مِنْهُمْ إِلَّا الرَّجُلُ الْوَاحِدُ، فَبِأَيِّ غَنِيمَةٍ يُفْرَحُ؟ أَوْ أَيُّ مِيرَاثٍ يُقَاسَمُ، فَبَيْنَمَا هُمْ كَذَلِكَ إِذْ سَمِعُوا بِبَأْسٍ، هُوَ أَكْبَرُ مِنْ ذَلِكَ، فَجَاءَهُمُ الصَّرِيخُ، إِنَّ الدَّجَّالَ قَدْ خَلَفَهُمْ فِي ذَرَارِيِّهِمْ، فَيَرْفُضُونَ مَا فِي أَيْدِيهِمْ، وَيُقْبِلُونَ، فَيَبْعَثُونَ عَشَرَةَ فَوَارِسَ طَلِيعَةً، قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «إِنِّي لَأَعْرِفُ أَسْمَاءَهُمْ وَأَسْمَاءَ آبَائِهِمْ، وَأَلْوَانَ خُيُولِهِمْ، هُمْ خَيْرُ فَوَارِسَ عَلَى ظَهْرِ الْأَرْضِ يَوْمَئِذٍ - أَوْ مِنْ خَيْرِ فَوَارِسَ عَلَى ظَهْرِ الْأَرْضِ يَوْمَئِذٍ ‘একবার কুফা নগরীতে লাল ঝঞ্ঝাবিশিষ্ট বায়ু প্রবাহিত হলো। এমন সময় জনৈক লোক আসল, তার অবস্থা ছিল এমন যে, সে কেবল বলছিল, “হে আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ, কিয়ামত এসে গেছে।” বর্ণনাকারী বলেন, তিনি হেলান দেওয়া অবস্থায় ছিলেন, তার কথা শুনে তিনি উঠে বসলেন। অতঃপর বললেন, ততক্ষণ পর্যন্ত কিয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না মিরাসের সম্পদ বণ্টন করা হবে না (অর্থাৎ যুদ্ধে ব্যাপক হতাহত হওয়ায় মিরাস বণ্টনের মতো লোকই বেঁচে থাকবে না) এবং গনিমতের বিষয়ে আনন্দ প্রকাশ করা হবে না (অর্থাৎ যুদ্ধ শেষে গনিমত পেলেও পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়স্বজন সবাই মারা যাওয়ায় তার আনন্দ উদযাপন করার কোনো উপলক্ষ্য থাকবে না)। তারপর তিনি নিজ হাত দ্বারা শামের (অর্থাৎ বর্তমানের সিরিয়া, জর্ডান, ফিলিস্তিন প্রভৃতি অঞ্চলের) দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, এদিকে আল্লাহর শত্রুরা মুসলিমদের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য একত্র হবে এবং মুসলিমগণও তাদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য একত্র হবে। আমি বললাম, আল্লাহর শত্রু বলে কি আপনি রোমান (খ্রিষ্টান) সম্প্রদায়ের কথা বুঝাচ্ছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। আর সে যুদ্ধে কঠিন ঘাত-প্রতিঘাত হবে। তখন মুসলিমরা একটি দল অগ্রে প্রেরণ করবে। তারা শাহাদাতের তামান্না নিয়ে সম্মুখে এগিয়ে যাবে। প্রতিজ্ঞা থাকবে, বিজয় অর্জন করা ছাড়া তারা প্রত্যাবর্তন করবে না। এরপর তারা যুদ্ধে লিপ্ত হবে। যুদ্ধ করতে করতে একপর্যায়ে রাত এসে তাদের পৃথক করে দেবে। তারপর এই দল এবং ওই দল উভয় পক্ষের সৈন্যরা জয়লাভ করা ছাড়াই (নিজ নিজ শিবিরে) ফিরে যাবে। (প্রথম দিনে) যুদ্ধের জন্য মুসলিমদের অগ্রগামী দলটির সবাই শাহাদতবরণ করবে। অতঃপর পরবর্তী (দ্বিতীয়) দিন মুসলিমরা দ্বিতীয় আরেকটি দল অগ্রে প্রেরণ করবে। তারা শাহাদাতের তামান্না নিয়ে সম্মুখে এগিয়ে যাবে। প্রতিজ্ঞা থাকবে, বিজয় অর্জন করা ছাড়া তারা প্রত্যাবর্তন করবে না। এরপর তারা যুদ্ধে লিপ্ত হবে। যুদ্ধ করতে করতে একপর্যায়ে রাত এসে তাদের পৃথক করে দেবে। তারপর এই দল এবং ওই দল উভয় পক্ষের সৈন্যরা জয়লাভ করা ছাড়াই (নিজ নিজ শিবিরে) ফিরে যাবে। (দ্বিতীয় দিনেও) যুদ্ধের জন্য মুসলিমদের অগ্রগামী দলটির সবাই শাহাদতবরণ করবে। অতঃপর পরবর্তী (তৃতীয়) দিন মুসলিমরা তৃতীয় আরেকটি দল অগ্রে প্রেরণ করবে। তারা শাহাদাতের তামান্না নিয়ে সম্মুখে এগিয়ে যাবে। প্রতিজ্ঞা থাকবে, বিজয় অর্জন করা ছাড়া তারা প্রত্যাবর্তন করবে না। এরপর তারা যুদ্ধে লিপ্ত হবে। যুদ্ধ করতে করতে একপর্যায়ে তারা সন্ধ্যায় গিয়ে উপনীত হবে। তারপর এই দল এবং ওই দল উভয় পক্ষের সৈন্যরা জয়লাভ করা ছাড়াই (নিজ নিজ শিবিরে) ফিরে যাবে। (তৃতীয় দিনেও) যুদ্ধের জন্য মুসলিমদের অগ্রগামী দলটির সবাই শাহাদতবরণ করবে। অতঃপর যখন যুদ্ধের চতুর্থ দিন আসবে তখন অবশিষ্ট মুসলিমগণ সকলেই অগ্রসর হয়ে শত্রুদের ওপর একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়বে। ফলে আল্লাহ তাআলা সেদিন কাফিরদের ওপর পরাজয় চাপিয়ে দেবেন। তারপর মুসলিমরা (শত্রুদেরকে) এমনভাবে হত্যা করবে, যার কোনো নজির দেখা যায় না অথবা বলেছেন, যার নজির ইতোপূর্বে কখনো দেখা যায়নি। (যুদ্ধে লাশের সারি বিস্তৃত ময়দানজুড়ে এত বেশি পরিমাণে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকবে যে,) পরিশেষে তাদের পার্শ্বঘেষে পাখি উড়তে থাকবে, কিন্তু পাখি তাদেরকে অতিক্রম করতে করতে একপর্যায়ে মরে মাটিতে পড়ে যাবে। কোনো পিতার একশ সন্তান থাকলে (যুদ্ধশেষে) গুনে দেখার পর লোকেরা তাদের মধ্যে কেবল একজনকেই অবশিষ্ট (জীবিত) দেখতে পাবে। এমতাবস্থায় কেমন করে গনিমতের সম্পদ নিয়ে খুশি উদযাপন করা হবে? আর কীভাবেই বা মিরাসের সম্পদ ভাগ করা হবে? মুসলিমরা এভাবেই থাকাবস্থায় হঠাৎ করেই তারা আরেকটি বিপদের কথা শুনতে পাবে, যা আগের বিপদের চেয়েও অধিক ভয়ানক। তাদের কাছে এ আওয়াজ পৌঁছবে যে, দাজ্জাল তাদের পেছনে তাদের পরিবার-পরিজনের মধ্যে চলে এসেছে। এ সংবাদ শুনতেই তারা হাতের সমস্ত কিছু ফেলে দিয়ে সম্মুখপানে রওয়ানা হয়ে যাবে। অতঃপর তারা দশজন অশ্বারোহী ব্যক্তিকে সংবাদ সংগ্রাহক দল হিসেবে প্রেরণ করবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, দাজ্জালের খবর সংগ্রাহক দলের প্রতিটি লোকের নাম, তাদের বাপ-দাদার নাম এবং তাদের ঘোড়ার রং সম্পর্কেও আমি জ্ঞাত আছি। সেদিন তাঁরাই হবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অশ্বারোহী দল। অথবা বলেছেন, সেদিন তাঁরাই হবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অশ্বারোহী দলগুলো অন্যতম।’ [সহিহু মুসলিম : ৪/২২২৩, হাদিস নং ২৮৯৯; সহিহু ইবনি হিব্বান : ১৫/১৯১, হাদিস নং ৬৭৮৬; মুসনাদু আহমাদ : ৭/২২১, হাদিস নং ৪১৪৬]
ফুরাত নদীর স্বর্ণ নিয়ে যুদ্ধ কি মালহামার অংশ?
সহিহ হাদিসের বর্ণনায় এসেছে, শেষ জমানায় ফুরাত নদীর পানি শুকিয়ে সেখানে স্বর্ণের পাহাড় বের হয়ে আসবে। সেটা দখলে নেওয়ার জন্য মানব-ইতিহাসের ভয়ংকরতম যুদ্ধ সংঘটিত হবে। যেমন ইমাম মুসলিম রাহিমাহুল্লাহ-সহ প্রমুখ মুহাদ্দিস আবু হুরাইরা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
لَا تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى يَحْسِرَ الْفُرَاتُ عَنْ جَبَلٍ مِنْ ذَهَبٍ، يَقْتَتِلُ النَّاسُ عَلَيْهِ، فَيُقْتَلُ مِنْ كُلِّ مِائَةٍ، تِسْعَةٌ وَتِسْعُونَ، وَيَقُولُ كُلُّ رَجُلٍ مِنْهُمْ: لَعَلِّي أَكُونُ أَنَا الَّذِي أَنْجُو ‘ততক্ষণ পর্যন্ত কিয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না ফুরাত তার মধ্যস্থিত স্বর্ণের পাহাড় বের করে দেয়। লোকেরা এটার দখল নিয়ে যুদ্ধ করবে এবং প্রতি একশো লোকের মধ্যে নিরানব্বইজনই মৃত্যুবরণ করবে। তাদের প্রত্যেকেই (মনে মনে) বলবে, সম্ভবত আমিই একমাত্র (স্বর্ণ দখলে নিয়ে যুদ্ধের লেলিহান শিখা থেকে) নিষ্কৃতি লাভ করব।’ [সহিহু মুসলিম : ৪/২২১৯, হাদিস নং ২৮৯৪; সহিহু ইবনি হিব্বান : ১৫/৮৫-৮৬, হাদিস নং ৬৬৯১, ৬৬৯২; মুসনাদু আহমাদ : ১৪/১১৯, হাদিস নং ৮৩৮৮]
সহিহ বুখারির বর্ণনায় এবং সহিহ মুসলিমের অন্য আরেকটি বর্ণনায় হাদিসটি এভাবে বর্ণিত হয়েছে- يُوشِكُ الفُرَاتُ أَنْ يَحْسِرَ عَنْ كَنْزٍ مِنْ ذَهَبٍ، فَمَنْ حَضَرَهُ فَلاَ يَأْخُذْ مِنْهُ شَيْئًا ‘নিকট ভবিষ্যতে ফোরাত নদী তার ভূগর্ভস্থ সোনার খনি বের করে দেবে। অতএব সেসময় যে ব্যক্তি সেখানে উপস্থিত থাকবে সে যেন সেখানে থেকে কিছুই গ্রহণ না করে।’ [সহিহুল বুখারি : ৯/৫৮, হাদিস নং ৭১১৯; সহিহু মুসলিম : ৪/২২১৯-২২২০, হাদিস নং ২৮৯৪; সুনানু আবি দাউদ : ৪/১১৫, হাদিস নং ৪৩১৩]
এ হাদিস থেকে বুঝা যায়, শেষ জমানায় ফুরাত নদীর পানি শুকিয়ে যাবে এবং সেখানে স্বর্ণের পাহাড় ভেসে উঠবে। স্বর্ণের পাহাড় বলতে এখানে উদ্দেশ্য স্বর্ণমুদ্রা বা স্বর্ণের টুকরা বা স্বর্ণরেণু; যেমনটি হাফিয ইবনু হাজার আসকালানি রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন। [ফাতহুল বারি : ১৩/৮০] অর্থাৎ সেখানে বিশাল স্বর্ণের মজুত পাওয়া যাবে, যা দখল করার জন্য লোকেরা পরস্পরে যুদ্ধে লিপ্ত হবে। যুদ্ধের ভয়াবহতা কেমন হবে, তা সহিহ মুসলিমে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর এ কথাটি থেকে অনুমান করা যায়- ‘প্রতি একশো লোকের মধ্যে নিরানব্বইজনই মৃত্যুবরণ করবে।’ এরকম ভয়ানক যুদ্ধ সম্ভবত মানব-ইতিহাসে ইতোপূর্বে না কখনো হয়েছে, আর না ভবিষ্যতে কখনো হবে। এজন্যই সমকালীন অনেক বিশেষজ্ঞের মত হলো, এখানে ভয়ংকর রাসায়নিক বা পারমানবিক বা হাইড্রোজেন অস্ত্রের প্রয়োগ ঘটবে। কেননা, প্রচলিত সাধারণ অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ করলে ৯৯% মানুষ মারা যাওয়া সম্ভব না। তাই এটার সম্ভাবনাই বেশি যে, এ যুদ্ধে পারমানবিক অস্ত্রের মতো মানববিধ্বংসী কোনো অস্ত্রের ব্যবহার হবে। তবে এটা নিশ্চিত কোনো কথা নয়। হতে পারে, সাধারণ অস্ত্রের মাধ্যমেই এ পরিমাণ লোক নিহত হবে। কেননা, এটা পৃথিবীর অন্যান্য যুদ্ধ থেকে ভিন্নরকমের হবে। শেষ জমানার অনেক কিছুই সাধারণ নিয়ম থেকে ব্যতিক্রম হবে। তাই এ যুদ্ধে রাসায়নিক বা পারমানবিক বা হাইড্রোজেন অস্ত্রের প্রয়োগ হওয়াটা জরুরি নয়। হলেও হতে পারে, তবে হওয়াটা আবশ্যক নয়। মোটকথা, এটা সম্ভাবনা মাত্র, নিশ্চিত কিছু নয়। আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন। এ যুদ্ধটা শেষ জমানায় কিয়ামতের আগে ঘটার কথা পাওয়া গেলেও নির্দিষ্ট করে কখন হবে, সে ব্যাপারে হাদিসে স্পষ্ট কোনো ভাষ্য পাওয়া যায় না। তবে বিভিন্ন হাদিসের ইঙ্গিত ও মুহাদ্দিসদের কর্মপন্থা থেকে এ সম্ভাবনাই বেশি বুঝা যায় যে, যুদ্ধটি মালহামার সাথেই সম্পৃক্ত। অর্থাৎ মালহামা চলাকালীন ইমাম মাহদির সময়েই ফুরাত নদীর স্বর্ণ নিয়ে এ মহাযুদ্ধটি সংঘটিত হবে। এজন্যই ইমাম আবু দাউদ রাহিমাহুল্লাহ এ হাদিসটিকে ‘কিতাবুল মালাহিম’ (মালহামা বা যুদ্ধ-বিগ্রহসংক্রান্ত বুক) এর অধীনে ‘দাজ্জালের আবির্ভাব-সংক্রান্ত অধ্যায়’ এর ঠিক পূর্বে উল্লেখ করেছেন। এ থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় ফুরাত নদীতে স্বর্ণের পাহাড় বের হওয়ার ঘটনা মালহামার সময়ে ইমাম মাহদির যুগেই ঘটবে এবং এ ঘটনার কিছুকাল পরেই দাজ্জালের আবির্ভাব হবে। অনুরূপ কিছুক্ষণ পূর্বে উল্লিখিত সহিহ মুসলিমের হাদিসও ইঙ্গিত করে যে, এ যুদ্ধটি মালহামার সময়েই ঘটবে। কেননা, এখানেও প্রতি একশজনে নিরানব্বইজন মারা পড়বে; যেমনটি পূর্বে বর্ণিত মালহামায় প্রতি পরিবার বা গোত্রের একশজনের নিরানব্বইজন মারা পড়বে। তাই এ যুদ্ধটি মালহামা সংঘটনের কাছাকাছি সময়ে হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। হাফিয ইবনু হাজার আসকালানি রাহিমাহুল্লাহ এর মতও এদিকেই ইঙ্গিত করে। তিনি বলেন, ‘ইমাম ইবনু মাজাহ রাহিমাহুল্লাহ সাওবান রাযিয়াল্লাহু আনহু সূত্রে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন- “তোমাদের একটি সম্পদের খনির নিকট তিনজন লোক যুদ্ধে লিপ্ত হবে। তারা প্রত্যেকেই হবে খলিফার পুত্র। অবশেষে সেই খনিজ সম্পদ তাদের কারও দখলেই যাবে না।” তিনি (হাফিয ইবনু হাজার আসকালানি রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, হাদিসটিকে তিনি (ইমাম ইবনু মাজাহ রাহিমাহুল্লাহ) মাহদি-সংক্রান্ত অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন। সুতরাং এখানে খনিজ সম্পদ দ্বারা যদি ওই খনিজ সম্পদ উদ্দেশ্য হয়, যা এ (ফুরাত নদীর স্বর্ণ বের হওয়ার) অধ্যায়ে বলা হয়েছে, তাহলে এটা সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে যে, এ ঘটনা ইমাম মাহদির আত্মপ্রকাশের সময় ঘটবে। আর সেটা হলো দাজ্জালের আবির্ভাব ও (কিয়ামতের আগে ইয়ামান থেকে) আগুনের শিখা বের হওয়ার আগে। আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন।’ [ফাতহুল বারি : ১৩/৮১]
মালহামা ও তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যকার সম্পর্ক :
সমসাময়িক একদল গবেষক হাদিসে বর্ণিত ‘আল-মালহামাতুল কুবরা’-কে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হিসেবে আখ্যায়িত করতে চেয়েছেন। কেননা, মালহামায় মানব-ইতিহাসে নজিরবিহীনভাবে যে পরিমাণ হতাহত ও বিপর্যয় ঘটবে, তা একমাত্র তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাথেই সামঞ্জস্যপূর্ণ। বর্তমানে আধুনিক যেসব ভয়ংকর অস্ত্র ও মারণাস্ত্র রয়েছে, কেবল সেগুলোর ব্যবহার হলেই মানব-ইতিহাসের সর্ববৃহৎ বিপর্যয় ঘটার আশঙ্কা তৈরি হয়। এমন নানা যুক্তি দিয়ে একদল বিশ্লেষকের মত হলো, মালহামা আর তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ অভিন্ন জিনিস। অর্থাৎ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার অর্থই হলো মালহামার সূচনা। এ ব্যাখ্যায় বিশ্বাসীরা অধিক আগ্রহে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের অপেক্ষায় রয়েছে। কেননা, তাদের ধারণা অনুসারে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ তথা মালহামা শুরু হলেই খিলাফাহ ফিরে আসবে। যদিও হাদিসের কোথাও পাওয়া যায় না যে, মালহামা শুরু হলে খিলাফাহ ফিরে আসবে। বরং একাধিক হাদিসের ভাষ্য থেকে বুঝা যায়, মালহামার আগে পুরো পৃথিবী জুলুম-নির্যাতনে ভরপুর থাকবে। এরপর অনেকগুলো মহাযুদ্ধ এবং নজিরবিহীন কুরবানির পরই পৃথিবীতে খিলাফাহ ফিরে আসবে। এ ব্যাপারে আমার অন্য কোনো আর্টিকেলে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।
কিন্তু এ ব্যাপারে আমাদের পর্যবেক্ষণ হলো, সামগ্রিকভাবে মালহামার সাথে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধকে মেলানো সঠিক মনে হয় না। অর্থাৎ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও মালহামাকে এক ও অভিন্ন মনে করা ঠিক নয়। প্রথমত এ কারণে যে, হাদিসে মালহামার ভূমি হিসেবে সর্বদা শাম তথা সিরিয়া, জর্ডান, ফিলিস্তিন প্রভৃতি অঞ্চলের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ মধ্যপ্রাচ্যই হলো মালহামার মূল ভূমি। পক্ষান্তরে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ব্যাপারে ধারণা করা হয় যে, এটা সংঘটিত হবে বর্তমান পরাশক্তিগুলো যেমন আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড ইত্যাদি রাষ্ট্রের মাঝে। আর বলার অপেক্ষা রাখে না, এসব রাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্য থেকে অনেক দূরে অবস্থিত। দ্বিতীয়ত, মালহামা হলো সুনিশ্চিত একটি বিষয়, যা ঘটবেই ঘটবে ইনশাআল্লাহ। এটা অনেক সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। সে হিসেবে এটা আমাদের আকিদার অংশ। পক্ষান্তরে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ এমন নিশ্চিত কোনো বিষয় নয়। দুটি বিশ্বযুদ্ধ হয়েছে বলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ যে হতেই হবে, এমন কোনো কথা নেই। হাদিসেও তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে কোনো কিছু বলা হয়নি। এটা একটি সম্ভাব্য যুদ্ধ, যে ব্যাপারে বর্তমানে বিভিন্ন বিশ্লেষকগণ মত দিয়েছেন। এটা সংঘটিত হতেও পারে, আবার নাও হতে পারে। তাই নিশ্চিতভাবে মালহামা আর তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধকে অভিন্ন মনে করাটা স্পষ্ট ভুল। তৃতীয়ত, মালহামায় প্রতিপক্ষ দুটি হলো মুসলিম ও রোমান খ্রিষ্টান। প্রথমে তারা জোটবদ্ধভাবে তৃতীয় কোনো শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়ী হবে। এরপর জোটের মধ্যে বিজয়ের ক্রেডিট নিয়ে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হলে মুসলিম ও খ্রিষ্টানদের মধ্যে মালহামা বা তীব্র রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধ সংঘটিত হবে। পক্ষান্তরে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রতিপক্ষগুলো সবাই কাফির। এখন পর্যন্ত এখানে মুসলিমদের তেমন কোনো অন্তর্ভুক্তি নজরে পড়েনি। কোনো কোনো মুসলিম দেশ থাকলেও তারা অনুগামী হিসেবে আছে, মূল প্রতিপক্ষ হিসেবে নয়। তাই এ দৃষ্টিকোণ থেকেও মালহামা আর তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ এক নয়।
এমন আরও নানা কারণেই মালহামা আর তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধকে হুবহু এক ও অভিন্ন মনে করাটা ভুল। এ বিষয়টিতে অনেকেই ভুলভালভাবে ব্যাখ্যা করে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। আমরা এ লেখায় যেসব হাদিস উল্লেখ করেছি, তার সবগুলোই সহিহ। এসব সহিহ হাদিস সামনে রাখলে দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে যায় যে, মালহামা ও তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ দুটি ভিন্ন বিষয়। তবে হ্যাঁ, কথা এখনও শেষ হয়নি। এখানে আরও কিছু কথা আছে। আমরা মালহামা ও তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধকে হুবহু এক মনে করার বিরোধী। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ যদি সত্যিসত্যিই সংঘটিত হয় তাহলে সেটা মালহামার সূচনা বা মালহামার অংশ হওয়া অসম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাথে মালহামার আংশিক সম্পর্ক থাকলেও থাকতে পারে। কেননা, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে সেটার মোড় কখন কোনদিকে যাবে, তা কেউই বলতে পারে না। মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিস্তিন, সৌদিআরব, ইরান, ওদিকে ইসরাইল, মিশর, তুরস্ক এসব দেশের অংশগ্রহণে যুদ্ধের মোড় মধ্যপ্রাচ্যের দিকেও ফিরতে পারে। বিশেষত শামের একটি অঞ্চল বর্তমান সিরিয়ার রাজনৈতিক অবস্থা সচেতন কারও অজানা নয়। এসংক্রান্ত কিছু দুর্বল সনদের হাদিস আছে, যা সামনে রাখলে ভবিষ্যতে যুদ্ধের মূল ভূখণ্ড যে মধ্যপ্রাচ্যই হতে যাচ্ছে, তাতে সন্দেহ করার কোনো অবকাশ থাকে না। তবে সেটা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই, নাকি চলাকালীন, নাকি পরে হবে, সে ব্যাপারে এখনই আগাম কোনো সম্ভাবনার কথা বলা যাচ্ছে না। আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন।
সারকথা হলো, শেষ জমানায় মালহামা যে সংঘটিত হবে, সে ব্যাপারে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। কখন, কবে বা কোন সালে সে ব্যাপারে আমাদের কাছে নিশ্চিত কোনো জ্ঞানও নেই। তবে বিভিন্ন আলামত দৃষ্টে মনে হচ্ছে, সময়টা বেশ ঘনিয়ে আসছে। মালহামার সাথে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আংশিক সম্পর্ক থাকতে পারে, কিন্তু দুটি যে হুবহু এক যুদ্ধ নয়, সে ব্যাপারে বোধহয় পাঠকদের সন্দেহ-সংশয় দূর হয়েছে। মালহামায় প্রচলিত অস্ত্র ব্যবহৃত হবে না-কি পূর্বযুগের অস্ত্র ব্যবহৃত হবে, সে ব্যাপারেও নিশ্চিত করে কোথাও কিছু বলা হয়নি। দুটোরই সম্ভাবনা আছে। তবে অনেক আলিম মনে করেন, প্রথমে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাধ্যমে প্রচলিত সমরব্যবস্থা ভেঙে পড়বে এবং তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর মালহামা পূর্বযুগের অস্ত্রের মাধ্যমেই সংঘটিত হবে। এগুলো ধারণা মাত্র, এর কোনোটিই নিশ্চিত নয়। হাদিসে যতটুকু বলা হয়েছে, অতটুকুই কেবল নিশ্চিত, বাকিটা হলো সম্ভাবনা। আল্লাহ তাআলা-ই অধিক অবগত এবং তাঁর ইলমই পূর্ণাঙ্গ ও নিখুঁত।
--সংগৃহীত
আরবি ভাষায় ‘আল-মালহামা’ (الملحمة) শব্দটির উৎসমূল হলো ‘লাহমুন’ (لحم) বা মাংস। এটার শাব্দিক অর্থ, মাংসঘর বা কসাইখানা। শেষ জমানায় সংঘটিত মালহামায় যেহেতু ব্যাপক নৃশংসতা ও ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড ঘটবে, যার কারণে বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে সারি সারি লাশ পড়ে থাকবে, তাই হাদিসে এটাকে বলা হয়েছে, ‘আল-মালহামা’ (الملحمة) বা তীব্র রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। কিছু বর্ণনায় এটাকে বলা হয়েছে, ‘আল-মালহামাতুল উযমা’ (الملحمة العظمى) বা বৃহত্তর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ এবং কিছু বর্ণনায় বলা হয়েছে, ‘আল-মালহামাতুল কুবরা’ (الملحمة الكبرى) বা সবচেয়ে বড় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। এটা আক্ষরিক অর্থেই ভয়ংকরতম এক কসাইখানা সদৃশ, যেখানে অসংখ্য মানুষকে নজিরবিহীনভাবে হত্যা করা হবে। এদের কেউ নিহত হবে ন্যায়ের পক্ষে থেকে, আর কেউ নিহত হবে অন্যায়ের পক্ষালম্বন করে।
আরবি ভাষায় ‘আল-মালহামা’ (الملحمة) শব্দটির বহুবচন হলো ‘আল-মালাহিম’ (الملاحم)। এ শব্দটি সাধারণত এপোক্যাল্যাপটিক বা যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং শেষ জমানার মহাযুদ্ধের ভবিষ্যদ্বাণী সম্পর্কিত বর্ণিত হাদিসসমূহের একটি পৃথক ধারা বোঝাতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যেমন বলা হয়- ‘কিতাবুল মালাহিম’ (كتاب الملاحم) বা যুদ্ধ-বিগ্রহসংক্রান্ত অধ্যায়। অনুরূপ বলা হয়- ‘আহাদিসুল মালাহিম’ (الملاحم أحاديث) বা যুদ্ধ-বিগ্রহসংক্রান্ত হাদিসসমূহ।
হাদিসের ভাষ্যানুসারে মালহামা হলো শেষ জমানায় সংঘটিত এমন একটি মহাযুদ্ধ, যেটাকে মানব-ইতিহাসের অন্যতম ভয়ংকর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বলে অভিহিত করা হয়েছে। খ্রিষ্টানরা তাদের ধর্মীয় গ্রন্থের উদ্ধৃতিতে এটাকে ‘মারিকাতু হারমাজিদুন’ (معركة هرمجدون) বা আর্মাগেডনের যুদ্ধ বলে অভিহিত করে থাকে। বিভিন্ন হাদিসের ভাষ্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, রক্তক্ষয়ী এ মহাযুদ্ধটি ইমাম মাহদির সময়ে দাজ্জালের আবির্ভাবের কিছুকাল আগে ঘটবে।
হাদিসের আলোকে মালহামার বিবরণ :
একাধিক সহিহ হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মালহামা সম্পর্কে বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন। হাদিসগুলোর ভাষ্য থেকে বুঝা যায় যে, মুসলিম ও খ্রিষ্টানরা সন্ধির মাধ্যমে একজোট হয়ে তৃতীয় একদল শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করে বিজয় লাভ করবে। সম্মিলিত জোটের বিজয়ের পর একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে জোটে ফাটল সৃষ্টি হবে এবং মুসলিম ও খ্রিষ্টানরা পৃথক হয়ে পরস্পরে যুদ্ধে লিপ্ত হবে। এটাকেই হাদিসে ‘আল-মালহামা’ বা তীব্র রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বলা হয়েছে। এ ঘটনার পূর্ণ বিবরণ সহিহ হাদিসসমূহে বর্ণিত হয়েছে।
ইমাম আবু দাউদ রাহিমাহুল্লাহ-সহ প্রমুখ মুহাদ্দিস সহিহ সনদে যু-মিখবার রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে বলতে শুনেছি- سَتُصَالِحُونَ الرُّومَ صُلْحًا آمِنًا، فَتَغْزُونَ أَنْتُمْ وَهُمْ عَدُوًّا مِنْ وَرَائِكُمْ، فَتُنْصَرُونَ، وَتَغْنَمُونَ، وَتَسْلَمُونَ، ثُمَّ تَرْجِعُونَ حَتَّى تَنْزِلُوا بِمَرْجٍ ذِي تُلُولٍ، فَيَرْفَعُ رَجُلٌ مِنْ أَهْلِ النَّصْرَانِيَّةِ الصَّلِيبَ، فَيَقُولُ: غَلَبَ الصَّلِيبُ، فَيَغْضَبُ رَجُلٌ مِنَ الْمُسْلِمِينَ، فَيَدُقُّهُ، فَعِنْدَ ذَلِكَ تَغْدِرُ الرُّومُ، وَتَجْمَعُ لِلْمَلْحَمَةِ. ‘অচিরেই তোমরা রোমানদের (অর্থাৎ খ্রিষ্টানদের) সঙ্গে সন্ধি করবে। অতঃপর তোমরা ও তারা একত্র হয়ে তোমাদের পশ্চাৎবর্তী একদল শত্রুর মোকাবেলা করবে। তোমরা তাতে বিজয়ী হবে, গনিমত (যুদ্ধলব্ধ সম্পদ) অর্জন করবে এবং নিরাপদে ফিরে আসবে। অবশেষে তোমরা টিলাযুক্ত একটি মাঠে (যাত্রাবিরতির জন্য) অবতরণ করবে। অতঃপর খ্রিষ্টানদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি ক্রুশ উপরে উত্তোলন করে বলবে, ক্রুশ বিজয়ী হয়েছে। এতে মুসলিমদের মধ্যকার এক ব্যক্তি উত্তেজিত হয়ে তাকে হত্যা করবে। তখন রোমানরা চুক্তি ভঙ্গ করবে এবং যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করবে।’ [সুনানু আবি দাউদ : ৪/১০৯, হাদিস নং ৪২৯২; মুসনাদু আহমাদ : ৩৮/২২৮, হাদিস নং ২৩১৫৭; মুসতাদরাকুল হাকিম : ৪/৪৬৭, হাদিস নং ৮২৯৯]
সহিহ ইবনি হিব্বান-সহ অন্য আরও কিছু হাদিসগ্রন্থের বর্ণনায় ঘটনাটি আরও বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে। ইমাম ইবনু হিব্বান রাহিমাহুল্লাহ-সহ প্রমুখ মুহাদ্দিস সহিহ সনদে যু-মিখবার রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে বলতে শুনেছি- تُصَالِحُونَ الرُّومَ صُلْحًا آمِنًا حَتَّى تَغْزُوا أَنْتُمْ وَهُمْ عَدُوًّا مِنْ وَرَائِهِمْ فَتُنْصَرُونَ وَتَغْنَمُونَ وَتَنْصَرِفُونَ حَتَّى تَنْزِلُوا بِمَرْجٍ ذِي تُلُولٍ، فَيَقُولُ قَائِلٌ مِنَ الرُّومِ: غَلَبَ الصَّلِيبُ، وَيَقُولُ قَائِلٌ مِنَ الْمُسْلِمِينَ: بَلِ اللَّهُ غَلَبَ فَيَثُورُ الْمُسْلِمُ إِلَى صَلِيبِهِمْ وَهُوَ مِنْهُ غَيْرُ بَعِيدٍ فَيَدُقُّهُ، وَتَثُورُ الرُّومُ إِلَى كَاسِرِ صَلِيبِهِمْ، فَيَضْرِبُونَ عُنُقَهُ، وَيَثُورُ الْمُسْلِمُونَ إِلَى أَسْلِحَتِهِمْ فَيَقْتَتِلُونَ، فَيُكْرِمُ اللَّهُ تِلْكَ الْعِصَابَةَ مِنَ الْمُسْلِمِينَ بِالشَّهَادَةِ، فَتَقُولُ الرُّومُ لِصَاحِبِ الرُّومِ: كَفَيْنَاكَ الْعَرَبَ، فَيَجْتَمِعُونَ لِلْمَلْحَمَةِ، فَيَأْتُونَكُمْ تَحْتَ ثَمَانِينَ غَايَةً تَحْتَ كُلِّ غَايَةٍ اثْنَا عَشَرَ أَلْفًا. ‘(ভবিষ্যতে) তোমরা রোমানদের (অর্থাৎ খ্রিষ্টানদের) সঙ্গে সন্ধি করবে। অতঃপর তোমরা ও তারা একত্র হয়ে তোমাদের পশ্চাৎবর্তী একদল শত্রুর মোকাবেলা করবে। তোমরা তাতে বিজয়ী হবে, গনিমত (যুদ্ধলব্ধ সম্পদ) অর্জন করবে এবং (বিজয়ীবেশে যুদ্ধ থেকে) ফিরে আসবে। অবশেষে তোমরা টিলাযুক্ত একটি মাঠে (যাত্রাবিরতির জন্য) অবতরণ করবে। অতঃপর রোমানদের মধ্য থেকে একজন মন্তব্যকারী বলে উঠবে, ক্রুশ বিজয়ী হয়েছে। আর মুসলিমদের মধ্য থেকে একজন মন্তব্যকারী বলে উঠবে, বরং আল্লাহ বিজয়ী হয়েছেন। অতঃপর মুসলিম ব্যক্তিটি উত্তেজিত হয়ে তাদের ক্রুশের ওপর আক্রমণ করে বসবে, যা তার সন্নিকটেই ছিল এবং সেটাকে সে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ফেলবে। এতে রোমানরা উত্তেজিত হয়ে ক্রুশ চূর্ণকারী মুসলিম ব্যক্তির ওপর আক্রমণ করবে এবং তাঁর গর্দানে আঘাত করে হত্যা করে ফেলবে। এটা দেখে মুসলিমরাও উত্তেজিত হয়ে হাতে অস্ত্র তুলে নেবে এবং পরস্পরে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়বে। অতঃপর আল্লাহ তাআলা মুসলিমদের এ দলকে শাহাদাতের মর্যাদা দান করবেন। তখন রোমান খ্রিষ্টানরা রোমের বাদশাহকে গিয়ে বলবে, আপনার পক্ষ থেকে আমরা আরবদের (পরাজিত করার) জন্য যথেষ্ট হয়েছি। অতঃপর তারা মালহামা বা তীব্র রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করবে। এরপর তারা আশিটি পতাকাতলে সমবেত হয়ে (চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য) তোমাদের নিকট আগমন করবে। প্রতিটি পতাকাতলে বারো হাজার করে সৈন্য থাকবে।’ [সহিহু ইবনি হিব্বান : ১৫/১০১, হাদিস নং ৬৭০৮; মুসতাদরাকুল হাকিম : ৪/৪৬৭, হাদিস নং ৮২৯৮; আল-মুজামুল কাবির, তাবারানি : ৪/২৩৬, হাদিস নং ৪২৩১]
ইমাম ইবনু আবি আসিম রাহিমাহুল্লাহ এর বর্ণনায় হাদিসটির শেষে অতিরিক্ত এ অংশটুকু এসেছে- قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: فَتِلْكَ الْمَلْحَمَةُ الْعُظْمَى ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আর এটাই হলো ‘আল-মালহামাতুল উযমা’ বা বৃহত্তর রক্তক্ষয়ী মহাযুদ্ধ।’ [আল-আহাদ ওয়াল-মাসানি : ৫/১২৩, হাদিস নং ২৬৬৩]
মালহামা বা ভয়ংকর রক্তক্ষয়ী মহাযুদ্ধ কখন শুরু হবে?
এ ব্যাপারে হাদিস থেকে জানা যায় যে, মালহামা শুরু হওয়ার আগে দুটি বিশেষ ঘটনা ঘটবে। এক. বাইতুল মাকদিস বা জেরুজালেম অঞ্চল আবাদ হবে, সেখানে ব্যাপক জনবসতি গড়ে উঠবে এবং বৈশ্বিক রাজনীতিতে তার গুরুত্ব অনেক বেড়ে যাবে। দুই. মদিনা শহর বিরান হয়ে পড়বে, সেখানে বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে এবং বৈশ্বিক রাজনীতিতে তার গুরুত্ব একেবারে কমে যাবে।
এ ব্যাপারে ইমাম আবু দাউদ রাহিমাহুল্লাহ-সহ প্রমুখ মুহাদ্দিস সহিহ সনদে মুআয বিন জাবাল রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন- عُمْرَانُ بَيْتِ الْمَقْدِسِ خَرَابُ يَثْرِبَ، وَخَرَابُ يَثْرِبَ خُرُوجُ الْمَلْحَمَةِ، وَخُرُوجُ الْمَلْحَمَةِ فَتْحُ قُسْطَنْطِينِيَّةَ، وَفَتْحُ الْقُسْطَنْطِينِيَّةِ خُرُوجُ الدَّجَّالِ، ثُمَّ ضَرَبَ بِيَدِهِ عَلَى فَخِذِ الَّذِي حَدَّثَهُ، - أَوْ مَنْكِبِهِ - ثُمَّ قَالَ: إِنَّ هَذَا لَحَقٌّ كَمَا أَنَّكَ هَاهُنَا، أَوْ كَمَا أَنَّكَ قَاعِدٌ، يَعْنِي مُعَاذَ بْنَ جَبَلٍ ‘বাইতুল মাকদিসে (অর্থাৎ জেরুজালেমে) বসতি নির্মাণ মদিনা বিপর্যয়ের কারণ হবে, মদিনার বিপর্যয় মালহামা (অর্থাৎ রক্তক্ষয়ী মহাযুদ্ধ) শুরুর কারণ হবে, মালহামার সূচনা কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের কারণ হবে আর কনস্টান্টিনোপলের বিজয় দাজ্জাল আবির্ভাবের কারণ হবে। অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যার নিকট হাদিসটি বর্ণনা করেছেন, তার ঊরুতে বা কাঁধে নিজের হাত দ্বারা মৃদু আঘাত করে বললেন, এটা নিশ্চিত সত্য, যেমন তোমার এখানে থাকাটা অথবা তোমার এখানে বসাটা বাস্তব। অর্থাৎ তিনি মুআয বিন জাবাল রাযিয়াল্লাহু আনহুর ঊরুতে বা কাঁধে মৃদু আঘাত করে কথাটি বলেছেন।’ [সুনানু আবি দাউদ : ৪/১১০, হাদিস নং ৪২৯৪; মুসনাদু আহমাদ : ৩৬/৪৩২, হাদিস নং ২২১২১; মুসান্নাফু ইবনি আবি শাইবা : ৭/৪৯০, হাদিস নং ৩৭৪৭৭]
মালহামা কোথায় সংঘটিত হবে?
এ ব্যাপারে হাদিসসমূহের ভাষ্য থেকে পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় যে, মালহামা সংঘটিত হবে শাম (বর্তমানের সিরিয়া, জর্ডান, ফিলিস্তিন প্রভৃতি) দেশে। মুসলিমদের অবস্থানস্থল হবে ‘গুতা’, যা দামেশক শহরের নিকটবর্তী একটি অঞ্চলের নাম। ইমাম আবু দাউদ রাহিমাহুল্লাহ-সহ প্রমুখ মুহাদ্দিস সহিহ সনদে আবু দারদা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন- إِنَّ فُسْطَاطَ الْمُسْلِمِينَ يَوْمَ الْمَلْحَمَةِ بِالْغُوطَةِ، إِلَى جَانِبِ مَدِينَةٍ يُقَالُ لَهَا: دِمَشْقُ، مِنْ خَيْرِ مَدَائِنِ الشَّامِ ‘মালহামা বা তীব্র রক্তক্ষয়ী মহাযুদ্ধের সময় মুসলিমদের শিবির স্থাপন করা হবে ’গুতা’ অঞ্চলে, যা শামের সর্বোত্তম নগরী দামেশক নামক শহরের পাশে অবস্থিত হবে।’ [সুনানু আবি দাউদ : ৪/১১১, হাদিস নং ৪২৯৮; মুসনাদু আহমাদ : ৩৬/৫৬, হাদিস নং ২১৭২৫; মুসনাদুশ শামিয়্যিন, তাবারানি : ১/৩৩৫, হাদিস নং ৫৮৯]
তাবারানি আরেকটি বর্ণনায় উপরিউক্ত হাদিসের শেষোক্ত কথাটি এভাবে এসেছে- فَهِيَ خَيْرُ مَسَاكِنِ النَّاسِ يَوْمَئِذٍ ‘সুতরাং সেসময় দামেশক শহরটি হবে লোকদের জন্য সর্বোত্তম আবাসস্থল।’ [মুসনাদুশ শামিয়্যিন, তাবারানি : ২/২৬৬, হাদিস নং ১৩১৩]
হাকিমের বর্ণনায় উপরিউক্ত হাদিসের শেষোক্ত কথাটি এভাবে এসেছে- خَيْرُ مَنَازِلِ الْمُسْلِمِينَ يَوْمَئِذٍ ‘সেসময় দামেশক শহরটি হবে মুসলিমদের জন্য সর্বোত্তম অবস্থানস্থল।’ [মুসতাদরাকুল হাকিম : ৪/৫৩২, হাদিস নং ৮৪৯৬]
আর রোমান খ্রিষ্টানদের মূল অবস্থানস্থল হবে দাবিক বা আমাক অঞ্চলে। এ দুটি হলো শামের হালব শহরের নিকটবর্তী দুটি অঞ্চলের নাম। ইমাম মুসলিম রাহিমাহুল্লাহ-সহ প্রমুখ মুহাদ্দিস আবু হুরাইরা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন- لَا تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى يَنْزِلَ الرُّومُ بِالْأَعْمَاقِ أَوْ بِدَابِقٍ ‘ততক্ষণ পর্যন্ত কিয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না রোমান খ্রিষ্টানরা আমাক অথবা দাবিক অঞ্চলে (মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য) অবস্থান করবে।’ [সহিহু মুসলিম : ৪/২২২১, হাদিস নং ২৮৯৭; সহিহু ইবনি হিব্বান : ১৫/২২৪, হাদিস নং ৬৮১৩; আস-সুনানুল ওয়ারিদা ফিল ফিতান : ৬/১১১৪, হাদিস নং ৫৯৮]
মালহামার বিবরণ ও ফলাফল :
সহিহ হাদিসসমূহে মালহামার পূর্ণ বিবরণ এবং এর ফলাফল বা শেষ পরিণতি সুস্পষ্ট ভাষায় বর্ণিত হয়েছে। ইমাম মুসলিম রাহিমাহুল্লাহ-সহ প্রমুখ মুহাদ্দিস আবু হুরাইরা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন- لَا تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى يَنْزِلَ الرُّومُ بِالْأَعْمَاقِ أَوْ بِدَابِقٍ، فَيَخْرُجُ إِلَيْهِمْ جَيْشٌ مِنَ الْمَدِينَةِ، مِنْ خِيَارِ أَهْلِ الْأَرْضِ يَوْمَئِذٍ، فَإِذَا تَصَافُّوا، قَالَتِ الرُّومُ: خَلُّوا بَيْنَنَا وَبَيْنَ الَّذِينَ سَبَوْا مِنَّا نُقَاتِلْهُمْ، فَيَقُولُ الْمُسْلِمُونَ: لَا، وَاللهِ لَا نُخَلِّي بَيْنَكُمْ وَبَيْنَ إِخْوَانِنَا، فَيُقَاتِلُونَهُمْ، فَيَنْهَزِمُ ثُلُثٌ لَا يَتُوبُ اللهُ عَلَيْهِمْ أَبَدًا، وَيُقْتَلُ ثُلُثُهُمْ، أَفْضَلُ الشُّهَدَاءِ عِنْدَ اللهِ، وَيَفْتَتِحُ الثُّلُثُ، لَا يُفْتَنُونَ أَبَدًا فَيَفْتَتِحُونَ قُسْطَنْطِينِيَّةَ، فَبَيْنَمَا هُمْ يَقْتَسِمُونَ الْغَنَائِمَ، قَدْ عَلَّقُوا سُيُوفَهُمْ بِالزَّيْتُونِ، إِذْ صَاحَ فِيهِمِ الشَّيْطَانُ: إِنَّ الْمَسِيحَ قَدْ خَلَفَكُمْ فِي أَهْلِيكُمْ، فَيَخْرُجُونَ، وَذَلِكَ بَاطِلٌ، فَإِذَا جَاءُوا الشَّأْمَ خَرَجَ، فَبَيْنَمَا هُمْ يُعِدُّونَ لِلْقِتَالِ، يُسَوُّونَ الصُّفُوفَ، إِذْ أُقِيمَتِ الصَّلَاةُ، فَيَنْزِلُ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَأَمَّهُمْ، فَإِذَا رَآهُ عَدُوُّ اللهِ، ذَابَ كَمَا يَذُوبُ الْمِلْحُ فِي الْمَاءِ، فَلَوْ تَرَكَهُ لَانْذَابَ حَتَّى يَهْلِكَ، وَلَكِنْ يَقْتُلُهُ اللهُ بِيَدِهِ، فَيُرِيهِمْ دَمَهُ فِي حَرْبَتِهِ ‘ততক্ষণ পর্যন্ত কিয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না রোমান খ্রিষ্টানরা আমাক অথবা দাবিক অঞ্চলে (মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য) অবস্থান করবে। তখন তাদের মোকাবেলায় (দামেশক) শহর থেকে তখনকার সময়ে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ লোকদের একটি বাহিনী বের হয়ে আসবে। তারপর উভয় দল যখন (যুদ্ধের জন্য) সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান হবে তখন রোমানগণ বলবে, তোমরা আমাদের মাঝে এবং ওই সমস্ত লোকদের মাঝে রাস্তা ছেড়ে দাও, যারা আমাদের লোকদেরকে বন্দী করেছে; আমরা তাদের সাথে যুদ্ধ করব। তখন মুসলিমগণ বলবে, আল্লাহর শপথ! এটা হতে পারে না। আমরা তোমাদের মাঝে এবং আমাদের ভাইদের মাঝে রাস্তা ছেড়ে দেবো না। পরিশেষে তারা তাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হবে। এ যুদ্ধে মুসলিমদের এক-তৃতীয়াংশ সৈন্য পরাস্ত (হয়ে পলায়নপর) হবে। আল্লাহ তাআলা কখনো তাদের তাওবা গ্রহণ করবেন না। আর তাদের এক-তৃতীয়াংশ নিহত হবে এবং তারা হবে আল্লাহ তাআলার নিকট সর্বোত্তম শহীদ। আর তাদের অপর তৃতীয়াংশ বিজয় লাভ করবে। তারা আর কখনো ফিতনায় আক্রান্ত হবে না। এরপর তারা কনস্টান্টিনোপল বিজয় করবে। বিজয়ের পর তারা নিজেদের তলোয়ার জাইতুন বৃক্ষে ঝুলিয়ে গনিমত (যুদ্ধলব্ধ সম্পদ) ভাগ করতে থাকবে। ইতোমধ্যে তাদের মাঝে শয়তান উচ্চঃস্বরে চিৎকার করে বলতে থাকবে, দাজ্জাল তোমাদের পেছনে তোমাদের পরিবার-পরিজনের মধ্যে চলে এসেছে। এ কথা শুনে মুসলিমরা সেখান থেকে বের হবে; অথচ এটা ছিল মিথ্যা সংবাদ। অতঃপর তারা যখন (ঘর-বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে) পুনরায় শামে এসে পৌঁছবে তখন (সত্যিসত্যিই) দাজ্জালের আগমন ঘটবে। অতঃপর মুসলিম বাহিনী যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করবে এবং সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান হতে শুরু করবে। ইতোমধ্যে সালাতের জন্য ইকামত দেওয়া হবে, আর এদিকে ঈসা আলাইহিস সালাম (আসমান থেকে ফেরেশতার কাঁধে ভর করে দামেশকের মসজিদের মিনারে) অবতরণ করবেন এবং তিনি সালাতে মুসলিম বাহিনীর ইমামতি করবেন। অতঃপর আল্লাহ তাআলার শত্রু (দাজ্জাল) যখন তাঁকে দেখতে পাবে তখন সে গলে যেতে থাকবে; যেভাবে পানিতে লবণ গলে যায়। যদি ঈসা আলাইহিস সালাম তাকে (অস্ত্র দিয়ে হত্যা না করে) এমনিতেই ছেড়ে দেন তবুও সে নিজে নিজেই বিগলিত হতে হতে নিঃশেষ হয়ে যাবে। কিন্তু আল্লাহ তাআলা ঈসা আলাইহিস সালাম এর হাতে তাকে হত্যা করবেন এবং তার (নিহত হওয়ার) রক্ত ঈসা আলাইহিস সালাম এর বর্শাতে তিনি তাদেরকে দেখিয়ে দেবেন।’ [সহিহু মুসলিম : ৪/২২২১, হাদিস নং ২৮৯৭; সহিহু ইবনি হিব্বান : ১৫/২২৪, হাদিস নং ৬৮১৩; মুসতাদরাকুল হাকিম : ৪/৫২৯, হাদিস নং ৮৪৮৬]
এ সহিহ হাদিস থেকে আমরা কয়েকটি বিষয় জানতে পারি। যথা :
ক. শেষ জমানার মালহামা সংঘটিত হবে শাম (বর্তমান সিরিয়া, জর্ডান, ফিলিস্তিন প্রভৃতি) অঞ্চলজুড়ে। যদিও এ যুদ্ধে পশ্চিমারাসহ অন্যান্য অঞ্চলের অনেকেও অংশগ্রহণ করবে, কিন্তু তখন মধ্যপ্রাচ্যই হবে যুদ্ধের মূলভূমি। রোমান খ্রিষ্টানরা মোট আশিটি পতাকাতলে জোটবদ্ধ হয়ে প্রায় দশ লক্ষের মতো সৈন্য জমায়েত করবে। রোমান সৈন্যদের হেডকোয়ার্টার হবে হালব শহরের নিকটবর্তী এলাকা আমাক অথবা দাবিকে; যেমনটি এ হাদিসে স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। আর মুসলিম সৈন্যদের হেডকোয়ার্টার হবে দামেশকের পার্শ্ববর্তী গুতা নামক এলাকায়; যেমনটি পূর্বে সহিহ সনদে আবু দাউদের বর্ণনায় বর্ণিত হয়েছে।
খ. মালহামা বা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ কেবল একটি হবে না; বরং অনেক দিন ধরে বিভিন্ন স্থানে একাধিক যুদ্ধ হবে; যেমনটি বিভিন্ন হাদিসে ‘মালাহিম’ (‘মালহামা’ এর বহুবচন) ব্যবহার করে ইঙ্গিত করা হয়েছে। তবে এসব মালহামার সর্বশেষ যুদ্ধটি হবে শামে, যেটাকে হাদিসে ‘আল-মালহামাতুল উযমা’ (الملحمة العظمى) বা বৃহত্তর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ এবং ‘আল-মালহামাতুল কুবরা’ (الملحمة الكبرى) বা সবচেয়ে বড় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বলে অভিহিত করা হয়েছে। মালহামার প্রখম দিককার যুদ্ধগুলোতে ইমাম মাহদি থাকবেন কি-না, সে ব্যাপারে আমরা কোনো বর্ণনা পাইনি। তবে মুসলিম শরিফের এ হাদিস থেকে বুঝা যায় যে, তিনি সর্বশেষ ‘আল-মালহামাতুল উযমা’-তে উপস্থিত থাকবেন। কেননা, হাদিসে বলা হয়েছে বৃহত্তর মালহামা সংঘটিত হওয়ার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই দাজ্জালের আবির্ভাব ঘটবে এবং তার কিছুকালের মধ্যেই ঈসা আলাইহিস সালাম অবতরণ করবেন। আর এ কথা স্বতঃসিদ্ধ যে, ইমাম মাহদির আগমন দাজ্জালের আবির্ভাব ও ঈসা আলাইহিস সালাম এর অবতরণের বেশ আগেই ঘটবে। তাই মালাহামার শুরুর দিকে ইমাম মাহদি থাকার বিষয়ে কোনো কিছু না পাওয়া গেলেও শেষের দিকে তাঁর থাকার ব্যাপারে বেশ শক্তিশালী ইঙ্গিত পাওয়া যায়। আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন।
গ. অনেক মানুষ অতিরিক্ত জজবার কারণে মালহামা নিয়ে অনেক আগ্রহী ও উচ্ছ্বসিত হলেও অন্যদিক থেকে এটা যে বেশ ভয়ংকর ব্যাপার, তা তাদের অনেকেরই জানা নেই। মালহামায় একে তো ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ঘটবে, যা দেখে অনেকে ঘাবড়ে যাবে। মুসলিমদের বৃহৎ একটি অংশ শহীদ হয়ে যাবে। মুখে অনেকে শহীদ হওয়ার কথা বললেও শক্তিশালী ঈমানের অধিকারী না হলে বাস্তব ময়দানে খুব অল্প মানুষই অবিচল থাকতে পারে। শক্তিশালী ঈমান ও আখিরাতের প্রতিদানের ব্যাপারে দৃঢ় বিশ্বাস থাকলে অবশ্য শহীদ হওয়াটা মারাত্মক কোনো ব্যাপার নয়; বরং জান্নাত-প্রত্যাশী মুমিনদের জন্য এটা অত্যন্ত আনন্দদায়ক বিষয়। কিন্তু যুদ্ধের বিভীষিকা দেখে যদি পালিয়ে আসতে হয় তাহলে তার চেয়ে হতভাগা আর কেউ হবে না। হাদিসে তাদের ব্যাপারে বলা হয়েছে- ‘আল্লাহ তাআলা কখনো তাদের তাওবা গ্রহণ করবেন না।’ এটার ব্যাখ্যায় ইমাম নববি রাহিমাহুল্লাহ বলেন, আল্লাহ তাআলা তাদের অন্তরে অনুশোচনা সৃষ্টি করবেন না, তাওবার জন্য তাদেরকে অনুপ্রেরণা দান করবেন না। [আল-মিনহাজ শারহু মুসলিম, নববি : ১৮/২১] সুতরাং তারা তাওবা ছাড়াই মৃত্যুবরণ করবে। অতএব মালহামা নিয়ে আগ্রহীদের জন্য অধিক গুরুত্বপূর্ণ হলো, নিজেদের ঈমানকে সুদৃঢ় করা এবং সে অনুসারে সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ করা।
ঘ. কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের আগে দাজ্জাল আসার কোনো আশঙ্কা নেই। হাদিস থেকে বুঝা যায়, প্রথমে মালহামা শুরু হবে। এরপর বিভিন্ন জায়গায় একটানা অনেক মালহামা সংঘটিত হওয়ার পর যখন সর্বশেষ ‘আল-মালহামাতুল উযমা’ বা বৃহত্তর রক্তক্ষয়ী মহাযুদ্ধ সংঘটিত হবে এবং এর কিছুকাল পরে মুসলিমরা কনস্টান্টিনোপল বিজয় করবে তখন দাজ্জালের আর্বিভাব ঘটবে। তাই দাজ্জাল আসার আগে অবশ্যই এ ঘটনাগুলো ঘটতে হবে, তারপরই সে আসবে। দাজ্জাল আসার আগে যে ভয়ংকর সব মালহামা সংঘটিত হবে, তাতে মুসলিমদের বিরাট একটি অংশ মারা পড়বে এবং অনেকে যুদ্ধ থেকে পলায়ন করে গুনাহের বোঝা মাথায় নিয়েই কবরে যাবে। তাই এ মুহূর্তে দাজ্জাল মোকাবেলার প্রস্তুতির চাইতে মালহামার সময় করণীয় কী, সেটা নির্ধারণ করাই অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এ ব্যাপারে কোনো মুসলিমের উদাসীন থাকা ঠিক নয়।
মালহামায় হতাহতের সংখ্যা হবে নজিরবিহীন :
শেষ জমানার মালহামায় যুদ্ধের ভয়াবহতা এত বেশি মারাত্মক হবে যে, সে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের প্রায় সবাই-ই মারা পড়বে। খুব অল্পসংখ্যক লোকই বেঁচে থাকবে। লাশের পরিমাণ এতে বেশি হবে যে, কোনো পাখি সে লাশের সারির পার্শ্ব দিয়ে অতিক্রম করতে চাইলে অতিক্রম করার আগেই মরে মাটিতে পড়ে যাবে। এ যুদ্ধে যারা বেঁচে থাকবে, তাদের কোনো আনন্দ বাকি থাকবে না, গনিমতের প্রতি কোনো আগ্রহ থাকবে না।
কেননা, পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়স্বজন প্রায় সবাই মারা পড়বে। এ যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেও স্বস্তি নেই। এরপর তারা আগের চেয়ে আরও ভয়াবহ এক ফিতনার সম্মুখীন হবে। কেননা, এ ঘটনার পরপরই দাজ্জাল বের হয়ে আসবে।
এ ব্যাপারে ইমাম মুসলিম রাহিমাহুল্লাহ-সহ প্রমুখ মুহাদ্দিস ইউসাইর বিন জাবির রাহিমাহুল্লাহ থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন- هَاجَتْ رِيحٌ حَمْرَاءُ بِالْكُوفَةِ، فَجَاءَ رَجُلٌ لَيْسَ لَهُ هِجِّيرَى إِلَّا: يَا عَبْدَ اللهِ بْنَ مَسْعُودٍ جَاءَتِ السَّاعَةُ، قَالَ: فَقَعَدَ وَكَانَ مُتَّكِئًا، فَقَالَ: إِنَّ السَّاعَةَ لَا تَقُومُ، حَتَّى لَا يُقْسَمَ مِيرَاثٌ، وَلَا يُفْرَحَ بِغَنِيمَةٍ، ثُمَّ قَالَ: بِيَدِهِ هَكَذَا - وَنَحَّاهَا نَحْوَ الشَّأْمِ - فَقَالَ: عَدُوٌّ يَجْمَعُونَ لِأَهْلِ الْإِسْلَامِ، وَيَجْمَعُ لَهُمْ أَهْلُ الْإِسْلَامِ، قُلْتُ: الرُّومَ تَعْنِي؟ قَالَ: نَعَمْ، وَتَكُونُ عِنْدَ ذَاكُمُ الْقِتَالِ رَدَّةٌ شَدِيدَةٌ، فَيَشْتَرِطُ الْمُسْلِمُونَ شُرْطَةً لِلْمَوْتِ لَا تَرْجِعُ إِلَّا غَالِبَةً، فَيَقْتَتِلُونَ حَتَّى يَحْجُزَ بَيْنَهُمُ اللَّيْلُ، فَيَفِيءُ هَؤُلَاءِ وَهَؤُلَاءِ، كُلٌّ غَيْرُ غَالِبٍ، وَتَفْنَى الشُّرْطَةُ، ثُمَّ يَشْتَرِطُ الْمُسْلِمُونَ شُرْطَةً لِلْمَوْتِ، لَا تَرْجِعُ إِلَّا غَالِبَةً، فَيَقْتَتِلُونَ حَتَّى يَحْجُزَ بَيْنَهُمُ اللَّيْلُ، فَيَفِيءُ هَؤُلَاءِ وَهَؤُلَاءِ، كُلٌّ غَيْرُ غَالِبٍ، وَتَفْنَى الشُّرْطَةُ، ثُمَّ يَشْتَرِطُ الْمُسْلِمُونَ شُرْطَةً لِلْمَوْتِ، لَا تَرْجِعُ إِلَّا غَالِبَةً، فَيَقْتَتِلُونَ حَتَّى يُمْسُوا، فَيَفِيءُ هَؤُلَاءِ وَهَؤُلَاءِ، كُلٌّ غَيْرُ غَالِبٍ، وَتَفْنَى الشُّرْطَةُ، فَإِذَا كَانَ يَوْمُ الرَّابِعِ، نَهَدَ إِلَيْهِمْ بَقِيَّةُ أَهْلِ الْإِسْلَامِ، فَيَجْعَلُ اللهُ الدَّبْرَةَ عَلَيْهِمْ، فَيَقْتُلُونَ مَقْتَلَةً - إِمَّا قَالَ لَا يُرَى مِثْلُهَا، وَإِمَّا قَالَ لَمْ يُرَ مِثْلُهَا - حَتَّى إِنَّ الطَّائِرَ لَيَمُرُّ بِجَنَبَاتِهِمْ، فَمَا يُخَلِّفُهُمْ حَتَّى يَخِرَّ مَيْتًا، فَيَتَعَادُّ بَنُو الْأَبِ، كَانُوا مِائَةً، فَلَا يَجِدُونَهُ بَقِيَ مِنْهُمْ إِلَّا الرَّجُلُ الْوَاحِدُ، فَبِأَيِّ غَنِيمَةٍ يُفْرَحُ؟ أَوْ أَيُّ مِيرَاثٍ يُقَاسَمُ، فَبَيْنَمَا هُمْ كَذَلِكَ إِذْ سَمِعُوا بِبَأْسٍ، هُوَ أَكْبَرُ مِنْ ذَلِكَ، فَجَاءَهُمُ الصَّرِيخُ، إِنَّ الدَّجَّالَ قَدْ خَلَفَهُمْ فِي ذَرَارِيِّهِمْ، فَيَرْفُضُونَ مَا فِي أَيْدِيهِمْ، وَيُقْبِلُونَ، فَيَبْعَثُونَ عَشَرَةَ فَوَارِسَ طَلِيعَةً، قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «إِنِّي لَأَعْرِفُ أَسْمَاءَهُمْ وَأَسْمَاءَ آبَائِهِمْ، وَأَلْوَانَ خُيُولِهِمْ، هُمْ خَيْرُ فَوَارِسَ عَلَى ظَهْرِ الْأَرْضِ يَوْمَئِذٍ - أَوْ مِنْ خَيْرِ فَوَارِسَ عَلَى ظَهْرِ الْأَرْضِ يَوْمَئِذٍ ‘একবার কুফা নগরীতে লাল ঝঞ্ঝাবিশিষ্ট বায়ু প্রবাহিত হলো। এমন সময় জনৈক লোক আসল, তার অবস্থা ছিল এমন যে, সে কেবল বলছিল, “হে আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ, কিয়ামত এসে গেছে।” বর্ণনাকারী বলেন, তিনি হেলান দেওয়া অবস্থায় ছিলেন, তার কথা শুনে তিনি উঠে বসলেন। অতঃপর বললেন, ততক্ষণ পর্যন্ত কিয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না মিরাসের সম্পদ বণ্টন করা হবে না (অর্থাৎ যুদ্ধে ব্যাপক হতাহত হওয়ায় মিরাস বণ্টনের মতো লোকই বেঁচে থাকবে না) এবং গনিমতের বিষয়ে আনন্দ প্রকাশ করা হবে না (অর্থাৎ যুদ্ধ শেষে গনিমত পেলেও পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়স্বজন সবাই মারা যাওয়ায় তার আনন্দ উদযাপন করার কোনো উপলক্ষ্য থাকবে না)। তারপর তিনি নিজ হাত দ্বারা শামের (অর্থাৎ বর্তমানের সিরিয়া, জর্ডান, ফিলিস্তিন প্রভৃতি অঞ্চলের) দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, এদিকে আল্লাহর শত্রুরা মুসলিমদের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য একত্র হবে এবং মুসলিমগণও তাদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য একত্র হবে। আমি বললাম, আল্লাহর শত্রু বলে কি আপনি রোমান (খ্রিষ্টান) সম্প্রদায়ের কথা বুঝাচ্ছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। আর সে যুদ্ধে কঠিন ঘাত-প্রতিঘাত হবে। তখন মুসলিমরা একটি দল অগ্রে প্রেরণ করবে। তারা শাহাদাতের তামান্না নিয়ে সম্মুখে এগিয়ে যাবে। প্রতিজ্ঞা থাকবে, বিজয় অর্জন করা ছাড়া তারা প্রত্যাবর্তন করবে না। এরপর তারা যুদ্ধে লিপ্ত হবে। যুদ্ধ করতে করতে একপর্যায়ে রাত এসে তাদের পৃথক করে দেবে। তারপর এই দল এবং ওই দল উভয় পক্ষের সৈন্যরা জয়লাভ করা ছাড়াই (নিজ নিজ শিবিরে) ফিরে যাবে। (প্রথম দিনে) যুদ্ধের জন্য মুসলিমদের অগ্রগামী দলটির সবাই শাহাদতবরণ করবে। অতঃপর পরবর্তী (দ্বিতীয়) দিন মুসলিমরা দ্বিতীয় আরেকটি দল অগ্রে প্রেরণ করবে। তারা শাহাদাতের তামান্না নিয়ে সম্মুখে এগিয়ে যাবে। প্রতিজ্ঞা থাকবে, বিজয় অর্জন করা ছাড়া তারা প্রত্যাবর্তন করবে না। এরপর তারা যুদ্ধে লিপ্ত হবে। যুদ্ধ করতে করতে একপর্যায়ে রাত এসে তাদের পৃথক করে দেবে। তারপর এই দল এবং ওই দল উভয় পক্ষের সৈন্যরা জয়লাভ করা ছাড়াই (নিজ নিজ শিবিরে) ফিরে যাবে। (দ্বিতীয় দিনেও) যুদ্ধের জন্য মুসলিমদের অগ্রগামী দলটির সবাই শাহাদতবরণ করবে। অতঃপর পরবর্তী (তৃতীয়) দিন মুসলিমরা তৃতীয় আরেকটি দল অগ্রে প্রেরণ করবে। তারা শাহাদাতের তামান্না নিয়ে সম্মুখে এগিয়ে যাবে। প্রতিজ্ঞা থাকবে, বিজয় অর্জন করা ছাড়া তারা প্রত্যাবর্তন করবে না। এরপর তারা যুদ্ধে লিপ্ত হবে। যুদ্ধ করতে করতে একপর্যায়ে তারা সন্ধ্যায় গিয়ে উপনীত হবে। তারপর এই দল এবং ওই দল উভয় পক্ষের সৈন্যরা জয়লাভ করা ছাড়াই (নিজ নিজ শিবিরে) ফিরে যাবে। (তৃতীয় দিনেও) যুদ্ধের জন্য মুসলিমদের অগ্রগামী দলটির সবাই শাহাদতবরণ করবে। অতঃপর যখন যুদ্ধের চতুর্থ দিন আসবে তখন অবশিষ্ট মুসলিমগণ সকলেই অগ্রসর হয়ে শত্রুদের ওপর একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়বে। ফলে আল্লাহ তাআলা সেদিন কাফিরদের ওপর পরাজয় চাপিয়ে দেবেন। তারপর মুসলিমরা (শত্রুদেরকে) এমনভাবে হত্যা করবে, যার কোনো নজির দেখা যায় না অথবা বলেছেন, যার নজির ইতোপূর্বে কখনো দেখা যায়নি। (যুদ্ধে লাশের সারি বিস্তৃত ময়দানজুড়ে এত বেশি পরিমাণে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকবে যে,) পরিশেষে তাদের পার্শ্বঘেষে পাখি উড়তে থাকবে, কিন্তু পাখি তাদেরকে অতিক্রম করতে করতে একপর্যায়ে মরে মাটিতে পড়ে যাবে। কোনো পিতার একশ সন্তান থাকলে (যুদ্ধশেষে) গুনে দেখার পর লোকেরা তাদের মধ্যে কেবল একজনকেই অবশিষ্ট (জীবিত) দেখতে পাবে। এমতাবস্থায় কেমন করে গনিমতের সম্পদ নিয়ে খুশি উদযাপন করা হবে? আর কীভাবেই বা মিরাসের সম্পদ ভাগ করা হবে? মুসলিমরা এভাবেই থাকাবস্থায় হঠাৎ করেই তারা আরেকটি বিপদের কথা শুনতে পাবে, যা আগের বিপদের চেয়েও অধিক ভয়ানক। তাদের কাছে এ আওয়াজ পৌঁছবে যে, দাজ্জাল তাদের পেছনে তাদের পরিবার-পরিজনের মধ্যে চলে এসেছে। এ সংবাদ শুনতেই তারা হাতের সমস্ত কিছু ফেলে দিয়ে সম্মুখপানে রওয়ানা হয়ে যাবে। অতঃপর তারা দশজন অশ্বারোহী ব্যক্তিকে সংবাদ সংগ্রাহক দল হিসেবে প্রেরণ করবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, দাজ্জালের খবর সংগ্রাহক দলের প্রতিটি লোকের নাম, তাদের বাপ-দাদার নাম এবং তাদের ঘোড়ার রং সম্পর্কেও আমি জ্ঞাত আছি। সেদিন তাঁরাই হবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অশ্বারোহী দল। অথবা বলেছেন, সেদিন তাঁরাই হবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অশ্বারোহী দলগুলো অন্যতম।’ [সহিহু মুসলিম : ৪/২২২৩, হাদিস নং ২৮৯৯; সহিহু ইবনি হিব্বান : ১৫/১৯১, হাদিস নং ৬৭৮৬; মুসনাদু আহমাদ : ৭/২২১, হাদিস নং ৪১৪৬]
ফুরাত নদীর স্বর্ণ নিয়ে যুদ্ধ কি মালহামার অংশ?
সহিহ হাদিসের বর্ণনায় এসেছে, শেষ জমানায় ফুরাত নদীর পানি শুকিয়ে সেখানে স্বর্ণের পাহাড় বের হয়ে আসবে। সেটা দখলে নেওয়ার জন্য মানব-ইতিহাসের ভয়ংকরতম যুদ্ধ সংঘটিত হবে। যেমন ইমাম মুসলিম রাহিমাহুল্লাহ-সহ প্রমুখ মুহাদ্দিস আবু হুরাইরা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
لَا تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى يَحْسِرَ الْفُرَاتُ عَنْ جَبَلٍ مِنْ ذَهَبٍ، يَقْتَتِلُ النَّاسُ عَلَيْهِ، فَيُقْتَلُ مِنْ كُلِّ مِائَةٍ، تِسْعَةٌ وَتِسْعُونَ، وَيَقُولُ كُلُّ رَجُلٍ مِنْهُمْ: لَعَلِّي أَكُونُ أَنَا الَّذِي أَنْجُو ‘ততক্ষণ পর্যন্ত কিয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না ফুরাত তার মধ্যস্থিত স্বর্ণের পাহাড় বের করে দেয়। লোকেরা এটার দখল নিয়ে যুদ্ধ করবে এবং প্রতি একশো লোকের মধ্যে নিরানব্বইজনই মৃত্যুবরণ করবে। তাদের প্রত্যেকেই (মনে মনে) বলবে, সম্ভবত আমিই একমাত্র (স্বর্ণ দখলে নিয়ে যুদ্ধের লেলিহান শিখা থেকে) নিষ্কৃতি লাভ করব।’ [সহিহু মুসলিম : ৪/২২১৯, হাদিস নং ২৮৯৪; সহিহু ইবনি হিব্বান : ১৫/৮৫-৮৬, হাদিস নং ৬৬৯১, ৬৬৯২; মুসনাদু আহমাদ : ১৪/১১৯, হাদিস নং ৮৩৮৮]
সহিহ বুখারির বর্ণনায় এবং সহিহ মুসলিমের অন্য আরেকটি বর্ণনায় হাদিসটি এভাবে বর্ণিত হয়েছে- يُوشِكُ الفُرَاتُ أَنْ يَحْسِرَ عَنْ كَنْزٍ مِنْ ذَهَبٍ، فَمَنْ حَضَرَهُ فَلاَ يَأْخُذْ مِنْهُ شَيْئًا ‘নিকট ভবিষ্যতে ফোরাত নদী তার ভূগর্ভস্থ সোনার খনি বের করে দেবে। অতএব সেসময় যে ব্যক্তি সেখানে উপস্থিত থাকবে সে যেন সেখানে থেকে কিছুই গ্রহণ না করে।’ [সহিহুল বুখারি : ৯/৫৮, হাদিস নং ৭১১৯; সহিহু মুসলিম : ৪/২২১৯-২২২০, হাদিস নং ২৮৯৪; সুনানু আবি দাউদ : ৪/১১৫, হাদিস নং ৪৩১৩]
এ হাদিস থেকে বুঝা যায়, শেষ জমানায় ফুরাত নদীর পানি শুকিয়ে যাবে এবং সেখানে স্বর্ণের পাহাড় ভেসে উঠবে। স্বর্ণের পাহাড় বলতে এখানে উদ্দেশ্য স্বর্ণমুদ্রা বা স্বর্ণের টুকরা বা স্বর্ণরেণু; যেমনটি হাফিয ইবনু হাজার আসকালানি রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন। [ফাতহুল বারি : ১৩/৮০] অর্থাৎ সেখানে বিশাল স্বর্ণের মজুত পাওয়া যাবে, যা দখল করার জন্য লোকেরা পরস্পরে যুদ্ধে লিপ্ত হবে। যুদ্ধের ভয়াবহতা কেমন হবে, তা সহিহ মুসলিমে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর এ কথাটি থেকে অনুমান করা যায়- ‘প্রতি একশো লোকের মধ্যে নিরানব্বইজনই মৃত্যুবরণ করবে।’ এরকম ভয়ানক যুদ্ধ সম্ভবত মানব-ইতিহাসে ইতোপূর্বে না কখনো হয়েছে, আর না ভবিষ্যতে কখনো হবে। এজন্যই সমকালীন অনেক বিশেষজ্ঞের মত হলো, এখানে ভয়ংকর রাসায়নিক বা পারমানবিক বা হাইড্রোজেন অস্ত্রের প্রয়োগ ঘটবে। কেননা, প্রচলিত সাধারণ অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ করলে ৯৯% মানুষ মারা যাওয়া সম্ভব না। তাই এটার সম্ভাবনাই বেশি যে, এ যুদ্ধে পারমানবিক অস্ত্রের মতো মানববিধ্বংসী কোনো অস্ত্রের ব্যবহার হবে। তবে এটা নিশ্চিত কোনো কথা নয়। হতে পারে, সাধারণ অস্ত্রের মাধ্যমেই এ পরিমাণ লোক নিহত হবে। কেননা, এটা পৃথিবীর অন্যান্য যুদ্ধ থেকে ভিন্নরকমের হবে। শেষ জমানার অনেক কিছুই সাধারণ নিয়ম থেকে ব্যতিক্রম হবে। তাই এ যুদ্ধে রাসায়নিক বা পারমানবিক বা হাইড্রোজেন অস্ত্রের প্রয়োগ হওয়াটা জরুরি নয়। হলেও হতে পারে, তবে হওয়াটা আবশ্যক নয়। মোটকথা, এটা সম্ভাবনা মাত্র, নিশ্চিত কিছু নয়। আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন। এ যুদ্ধটা শেষ জমানায় কিয়ামতের আগে ঘটার কথা পাওয়া গেলেও নির্দিষ্ট করে কখন হবে, সে ব্যাপারে হাদিসে স্পষ্ট কোনো ভাষ্য পাওয়া যায় না। তবে বিভিন্ন হাদিসের ইঙ্গিত ও মুহাদ্দিসদের কর্মপন্থা থেকে এ সম্ভাবনাই বেশি বুঝা যায় যে, যুদ্ধটি মালহামার সাথেই সম্পৃক্ত। অর্থাৎ মালহামা চলাকালীন ইমাম মাহদির সময়েই ফুরাত নদীর স্বর্ণ নিয়ে এ মহাযুদ্ধটি সংঘটিত হবে। এজন্যই ইমাম আবু দাউদ রাহিমাহুল্লাহ এ হাদিসটিকে ‘কিতাবুল মালাহিম’ (মালহামা বা যুদ্ধ-বিগ্রহসংক্রান্ত বুক) এর অধীনে ‘দাজ্জালের আবির্ভাব-সংক্রান্ত অধ্যায়’ এর ঠিক পূর্বে উল্লেখ করেছেন। এ থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় ফুরাত নদীতে স্বর্ণের পাহাড় বের হওয়ার ঘটনা মালহামার সময়ে ইমাম মাহদির যুগেই ঘটবে এবং এ ঘটনার কিছুকাল পরেই দাজ্জালের আবির্ভাব হবে। অনুরূপ কিছুক্ষণ পূর্বে উল্লিখিত সহিহ মুসলিমের হাদিসও ইঙ্গিত করে যে, এ যুদ্ধটি মালহামার সময়েই ঘটবে। কেননা, এখানেও প্রতি একশজনে নিরানব্বইজন মারা পড়বে; যেমনটি পূর্বে বর্ণিত মালহামায় প্রতি পরিবার বা গোত্রের একশজনের নিরানব্বইজন মারা পড়বে। তাই এ যুদ্ধটি মালহামা সংঘটনের কাছাকাছি সময়ে হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। হাফিয ইবনু হাজার আসকালানি রাহিমাহুল্লাহ এর মতও এদিকেই ইঙ্গিত করে। তিনি বলেন, ‘ইমাম ইবনু মাজাহ রাহিমাহুল্লাহ সাওবান রাযিয়াল্লাহু আনহু সূত্রে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন- “তোমাদের একটি সম্পদের খনির নিকট তিনজন লোক যুদ্ধে লিপ্ত হবে। তারা প্রত্যেকেই হবে খলিফার পুত্র। অবশেষে সেই খনিজ সম্পদ তাদের কারও দখলেই যাবে না।” তিনি (হাফিয ইবনু হাজার আসকালানি রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, হাদিসটিকে তিনি (ইমাম ইবনু মাজাহ রাহিমাহুল্লাহ) মাহদি-সংক্রান্ত অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন। সুতরাং এখানে খনিজ সম্পদ দ্বারা যদি ওই খনিজ সম্পদ উদ্দেশ্য হয়, যা এ (ফুরাত নদীর স্বর্ণ বের হওয়ার) অধ্যায়ে বলা হয়েছে, তাহলে এটা সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে যে, এ ঘটনা ইমাম মাহদির আত্মপ্রকাশের সময় ঘটবে। আর সেটা হলো দাজ্জালের আবির্ভাব ও (কিয়ামতের আগে ইয়ামান থেকে) আগুনের শিখা বের হওয়ার আগে। আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন।’ [ফাতহুল বারি : ১৩/৮১]
মালহামা ও তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যকার সম্পর্ক :
সমসাময়িক একদল গবেষক হাদিসে বর্ণিত ‘আল-মালহামাতুল কুবরা’-কে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হিসেবে আখ্যায়িত করতে চেয়েছেন। কেননা, মালহামায় মানব-ইতিহাসে নজিরবিহীনভাবে যে পরিমাণ হতাহত ও বিপর্যয় ঘটবে, তা একমাত্র তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাথেই সামঞ্জস্যপূর্ণ। বর্তমানে আধুনিক যেসব ভয়ংকর অস্ত্র ও মারণাস্ত্র রয়েছে, কেবল সেগুলোর ব্যবহার হলেই মানব-ইতিহাসের সর্ববৃহৎ বিপর্যয় ঘটার আশঙ্কা তৈরি হয়। এমন নানা যুক্তি দিয়ে একদল বিশ্লেষকের মত হলো, মালহামা আর তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ অভিন্ন জিনিস। অর্থাৎ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার অর্থই হলো মালহামার সূচনা। এ ব্যাখ্যায় বিশ্বাসীরা অধিক আগ্রহে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের অপেক্ষায় রয়েছে। কেননা, তাদের ধারণা অনুসারে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ তথা মালহামা শুরু হলেই খিলাফাহ ফিরে আসবে। যদিও হাদিসের কোথাও পাওয়া যায় না যে, মালহামা শুরু হলে খিলাফাহ ফিরে আসবে। বরং একাধিক হাদিসের ভাষ্য থেকে বুঝা যায়, মালহামার আগে পুরো পৃথিবী জুলুম-নির্যাতনে ভরপুর থাকবে। এরপর অনেকগুলো মহাযুদ্ধ এবং নজিরবিহীন কুরবানির পরই পৃথিবীতে খিলাফাহ ফিরে আসবে। এ ব্যাপারে আমার অন্য কোনো আর্টিকেলে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।
কিন্তু এ ব্যাপারে আমাদের পর্যবেক্ষণ হলো, সামগ্রিকভাবে মালহামার সাথে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধকে মেলানো সঠিক মনে হয় না। অর্থাৎ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও মালহামাকে এক ও অভিন্ন মনে করা ঠিক নয়। প্রথমত এ কারণে যে, হাদিসে মালহামার ভূমি হিসেবে সর্বদা শাম তথা সিরিয়া, জর্ডান, ফিলিস্তিন প্রভৃতি অঞ্চলের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ মধ্যপ্রাচ্যই হলো মালহামার মূল ভূমি। পক্ষান্তরে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ব্যাপারে ধারণা করা হয় যে, এটা সংঘটিত হবে বর্তমান পরাশক্তিগুলো যেমন আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড ইত্যাদি রাষ্ট্রের মাঝে। আর বলার অপেক্ষা রাখে না, এসব রাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্য থেকে অনেক দূরে অবস্থিত। দ্বিতীয়ত, মালহামা হলো সুনিশ্চিত একটি বিষয়, যা ঘটবেই ঘটবে ইনশাআল্লাহ। এটা অনেক সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। সে হিসেবে এটা আমাদের আকিদার অংশ। পক্ষান্তরে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ এমন নিশ্চিত কোনো বিষয় নয়। দুটি বিশ্বযুদ্ধ হয়েছে বলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ যে হতেই হবে, এমন কোনো কথা নেই। হাদিসেও তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে কোনো কিছু বলা হয়নি। এটা একটি সম্ভাব্য যুদ্ধ, যে ব্যাপারে বর্তমানে বিভিন্ন বিশ্লেষকগণ মত দিয়েছেন। এটা সংঘটিত হতেও পারে, আবার নাও হতে পারে। তাই নিশ্চিতভাবে মালহামা আর তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধকে অভিন্ন মনে করাটা স্পষ্ট ভুল। তৃতীয়ত, মালহামায় প্রতিপক্ষ দুটি হলো মুসলিম ও রোমান খ্রিষ্টান। প্রথমে তারা জোটবদ্ধভাবে তৃতীয় কোনো শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়ী হবে। এরপর জোটের মধ্যে বিজয়ের ক্রেডিট নিয়ে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হলে মুসলিম ও খ্রিষ্টানদের মধ্যে মালহামা বা তীব্র রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধ সংঘটিত হবে। পক্ষান্তরে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রতিপক্ষগুলো সবাই কাফির। এখন পর্যন্ত এখানে মুসলিমদের তেমন কোনো অন্তর্ভুক্তি নজরে পড়েনি। কোনো কোনো মুসলিম দেশ থাকলেও তারা অনুগামী হিসেবে আছে, মূল প্রতিপক্ষ হিসেবে নয়। তাই এ দৃষ্টিকোণ থেকেও মালহামা আর তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ এক নয়।
এমন আরও নানা কারণেই মালহামা আর তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধকে হুবহু এক ও অভিন্ন মনে করাটা ভুল। এ বিষয়টিতে অনেকেই ভুলভালভাবে ব্যাখ্যা করে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। আমরা এ লেখায় যেসব হাদিস উল্লেখ করেছি, তার সবগুলোই সহিহ। এসব সহিহ হাদিস সামনে রাখলে দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে যায় যে, মালহামা ও তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ দুটি ভিন্ন বিষয়। তবে হ্যাঁ, কথা এখনও শেষ হয়নি। এখানে আরও কিছু কথা আছে। আমরা মালহামা ও তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধকে হুবহু এক মনে করার বিরোধী। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ যদি সত্যিসত্যিই সংঘটিত হয় তাহলে সেটা মালহামার সূচনা বা মালহামার অংশ হওয়া অসম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাথে মালহামার আংশিক সম্পর্ক থাকলেও থাকতে পারে। কেননা, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে সেটার মোড় কখন কোনদিকে যাবে, তা কেউই বলতে পারে না। মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিস্তিন, সৌদিআরব, ইরান, ওদিকে ইসরাইল, মিশর, তুরস্ক এসব দেশের অংশগ্রহণে যুদ্ধের মোড় মধ্যপ্রাচ্যের দিকেও ফিরতে পারে। বিশেষত শামের একটি অঞ্চল বর্তমান সিরিয়ার রাজনৈতিক অবস্থা সচেতন কারও অজানা নয়। এসংক্রান্ত কিছু দুর্বল সনদের হাদিস আছে, যা সামনে রাখলে ভবিষ্যতে যুদ্ধের মূল ভূখণ্ড যে মধ্যপ্রাচ্যই হতে যাচ্ছে, তাতে সন্দেহ করার কোনো অবকাশ থাকে না। তবে সেটা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই, নাকি চলাকালীন, নাকি পরে হবে, সে ব্যাপারে এখনই আগাম কোনো সম্ভাবনার কথা বলা যাচ্ছে না। আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন।
সারকথা হলো, শেষ জমানায় মালহামা যে সংঘটিত হবে, সে ব্যাপারে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। কখন, কবে বা কোন সালে সে ব্যাপারে আমাদের কাছে নিশ্চিত কোনো জ্ঞানও নেই। তবে বিভিন্ন আলামত দৃষ্টে মনে হচ্ছে, সময়টা বেশ ঘনিয়ে আসছে। মালহামার সাথে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আংশিক সম্পর্ক থাকতে পারে, কিন্তু দুটি যে হুবহু এক যুদ্ধ নয়, সে ব্যাপারে বোধহয় পাঠকদের সন্দেহ-সংশয় দূর হয়েছে। মালহামায় প্রচলিত অস্ত্র ব্যবহৃত হবে না-কি পূর্বযুগের অস্ত্র ব্যবহৃত হবে, সে ব্যাপারেও নিশ্চিত করে কোথাও কিছু বলা হয়নি। দুটোরই সম্ভাবনা আছে। তবে অনেক আলিম মনে করেন, প্রথমে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাধ্যমে প্রচলিত সমরব্যবস্থা ভেঙে পড়বে এবং তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর মালহামা পূর্বযুগের অস্ত্রের মাধ্যমেই সংঘটিত হবে। এগুলো ধারণা মাত্র, এর কোনোটিই নিশ্চিত নয়। হাদিসে যতটুকু বলা হয়েছে, অতটুকুই কেবল নিশ্চিত, বাকিটা হলো সম্ভাবনা। আল্লাহ তাআলা-ই অধিক অবগত এবং তাঁর ইলমই পূর্ণাঙ্গ ও নিখুঁত।
--সংগৃহীত
Comment