জিহাদ আল্লাহর হক এবং খালেস ইবাদাত
জিহাদ হক্কুল্লাহ তথা আল্লাহ তাআলার হক এবং একটি খালেস ইবাদাত।
ইবনে নুজাইম রহ. (৯৭০ হি.) বলেন,
وَأَمَّا الْجِهَادُ، فَمِنْ أَعْظَمِ الْعِبَادَاتِ. – الأشباه والنظائر لابن نجيم (ص: 20)
“আর জিহাদ তো সবচেয়ে বড় ইবাদাতসমূহের অন্তর্ভুক্ত এক সুমহান ইবাদাত।” –আলআশবাহ: ২০
“আর জিহাদ তো সবচেয়ে বড় ইবাদাতসমূহের অন্তর্ভুক্ত এক সুমহান ইবাদাত।” –আলআশবাহ: ২০
শরীয়তের বিধান চারভাগে বিভক্ত:
১. হক্কুল্লাহ তথা আল্লাহর হক।
২. হক্কুল ইবাদ তথা বান্দার হক।
৩. যার মাঝে হক্কুল্লাহ এবং হক্কুল ইবাদ উভয়ই রয়েছে তবে হক্কুল্লাহর দিকটি গালেব (অগ্রগণ্য)।
৪. যার মাঝে হক্কুল্লাহ এবং হক্কুল ইবাদ উভয়ই রয়েছে তবে হক্কুল ইবাদের দিকটি গালেব (অগ্রগণ্য)।
হক্কুল ইবাদ
যেমন কেউ কারও কোনো জিনিস নষ্ট করে ফেললো। এর জরিমানা আদায় করা মালিকের হক। ইচ্ছা করলে আদায় করতে পারে। ইচ্ছা করলে পূর্ণ বা আংশিক মাফও করে দিতে পারে। যেহেত এটি বান্দার হক তাই আদায় করা না করা বা মাফ করে দেয়া বান্দার ইখতিয়ার।
হক্কুল্লাহ
পক্ষান্তরে নামায, রোযা, যাকাত, হজ্ব- এগুলো আল্লাহর হক। এগুলো কেউ মাফ করতে পারবে না। বিনিময় নিয়েও না, বিনিময় ছাড়াও না।
যেমন এলিট পরিবারের কোনো মা যদি তার এস এস সি পরীক্ষার্থী মেয়েকে বলে: ‘মা, তোর রোযা রাখার দরকার নাই। পরীক্ষার ক্ষতি হবে। তুই শুকিয়ে যাবি’ – মায়ের নিষেধের দ্বারা তার উপর থেকে রোযার দায়িত্ব রহিত হবে না। কারণ, এটি আল্লাহর হক। আল্লাহ তাআলা রোযা রাখতে আদেশ দিয়েছেন। কোনো পিতা মাতা তা মাফ করতে পারবে না।
কিংবা কোনো পীর তার মুরিদদের বললো, ‘আমার দরবারে নজর-নিয়ায পেশ করলে নামায রোযা সব মাফ। সবার দায়িত্ব আমি নিয়ে নিলাম’। - এমন ঠিকাদারি নেয়ার অধিকারও কারও নাই।
হুদুদ আল্লাহর হক
এমনিভাবে আল্লাহ তাআলার আরেকটি হক হচ্ছে: হুদুদ। যিনা, চুরি, রাহাজানি ও মদপানের শাস্তি। শরয়ী সাক্ষ – প্রমাণের মাধ্যমে প্রমাণিত হওয়ার পর কেউ তা মাফ করতে পারবে না। এইসব অপরাধের শাস্তি প্রয়োগ আল্লাহ তাআলার নিজের অধিকার। কোনো বান্দার অধিকার নেই তা ক্ষমা করার বা বাতিল করার।
ছেলে মেয়ে যিনা করে যদি একে অপর থেকে মাফ নিয়ে নেয় এবং একে অপরকে মাফ করে দেয় তাহলে এ কারণে যিনার শাস্তি বাতিল হবে না। কারণ, যিনার শাস্তি কায়েম করা আল্লাহর হক। যিনা প্রমাণিত হওয়ার পর কেউ তা মাফ করার অধিকার রাখে না। তারা নিজেরাও একে অপর থেকে এ শাস্তি মাফ করিয়ে নিতে পারবে না।
মক্কা বিজয়ের সময় এক মহিলা চুরি করে ধরা পড়ে। সম্ভ্রান্ত বংশের মহিলা হওয়ায় হাত কাটা তাদের মান-সম্মানের প্রশ্ন ছিল। গোত্রের লোকেরা তখন হযরত উসামা রাদি.কে হাত না কাটতে সুপারিশের জন্য রাসূলের কাছে পাঠায়। সাথে সাথে রাসূলের চেহারার রং পরিবর্তন হয়ে যায় এবং অসন্তুষ্ট হয়ে তিরস্কার করে বলেন,
أتشفع في حد من حدود الله. –صحيح البخاري: 6406
“আল্লাহ তাআলার এক সুনির্ধারিত শাস্তি বাতিল করতে তুমি সুপারিশ করতে এসেছো?!” –সহীহ বোখারি: ৬৪০৬
“আল্লাহ তাআলার এক সুনির্ধারিত শাস্তি বাতিল করতে তুমি সুপারিশ করতে এসেছো?!” –সহীহ বোখারি: ৬৪০৬
এরপর সবাইকে ডেকে ভাষণ দেন এবং দৃঢ়চিত্তে ঘোষণা করেন,
وأيم الله لو أن فاطمة بنت محمد سرقت لقطع محمد يدها. –صحيح البخاري: 6406
“আল্লাহর কসম, যদি মুহাম্মাদের মেয়ে ফাতেমাও চুরি করতো, তাহলে মুহাম্মাদ তার হাতও কেটে দিতো।” –সহীহ বোখারি: ৬৪০৬
এই হচ্ছে আল্লাহর হক। যা মাফ করা বা বাতিল করার অধিকার কারও নেই। “আল্লাহর কসম, যদি মুহাম্মাদের মেয়ে ফাতেমাও চুরি করতো, তাহলে মুহাম্মাদ তার হাতও কেটে দিতো।” –সহীহ বোখারি: ৬৪০৬
ইবনুল হুমাম রহ. (৮৬১ হি.) বলেন,
الْحَدَّ حَقُّ اللَّهِ تَعَالَى لِأَنَّ الْمَقْصِدَ مِنْهَا إخْلَاءُ الْعَالِمِ عَنْ الْفَسَادِ، وَلِهَذَا لَا يَسْقُطُ بِإِسْقَاطِ الْعَبْدِ. -فتح القدير للكمال ابن الهمام (5/ 235)
“হদ আল্লাহ তাআলার হক। … তাই বান্দা মাফ করে দেয়ার দ্বারা তা মাফ হবে না।” –ফাতহুল কাদির: ৫/২৩৫
“হদ আল্লাহ তাআলার হক। … তাই বান্দা মাফ করে দেয়ার দ্বারা তা মাফ হবে না।” –ফাতহুল কাদির: ৫/২৩৫
জিহাদ আল্লাহর হক
আল্লাহ তাআলার এমনই একটি হক হচ্ছে জিহাদ।
গনিমতের খুমুসের আলোচনা প্রসঙ্গে ইবনুল হুমাম রহ. (৮৬১ হি.) বলেন,
هُوَ مَالُ اللَّهِ؛ لِأَنَّ الْجِهَادَ حَقُّهُ. - فتح القدير للكمال ابن الهمام (5/ 506)
“(খুমুস যাকাতের মতো ময়লা নয়, বরং) তা আল্লাহর মাল। কেননা, জিহাদ আল্লাহর হক।” –ফাতহুল কাদির: ৫/৫০৬
“(খুমুস যাকাতের মতো ময়লা নয়, বরং) তা আল্লাহর মাল। কেননা, জিহাদ আল্লাহর হক।” –ফাতহুল কাদির: ৫/৫০৬
কাজেই জিহাদের মাধ্যমে যে সম্পদ লাভ হয়েছে তা সম্মানীত সম্পদ। এ সম্পদ কারও কামাই নয়। আল্লাহ তাআলা চাইলে তা পুড়িয়ে ফেলার বিধান দিতে পারতেন – যেমনটা পূর্ববর্তী উম্মতদের ক্ষেত্রে ছিল। তবে এ উম্মতকে আল্লাহ তাআলা সম্মান দিয়েছেন। গনিমত হালাল করেছেন। চারভাগ নিজেরা নিতে বলেছেন আর এক ভাগ বাইতুল মালে জমা দিতে বলেছেন।
জিহাদ খালেস ইবাদাত
আল্লাহর হকের বিভিন্ন ভাগ রয়েছে। যেমন হুদুদ আল্লাহর হক। তবে তা শাস্তির শ্রেণীভুক্ত। পক্ষান্তরে নামায আল্লাহর হক। তবে তা ইবাদাত এবং খালেস ইবাদাতের শ্রেণীভু্ক্ত। এই খালেস ইবাদাতের শ্রেণীভুক্ত একটি হচ্ছে জিহাদ। অর্থাৎ জিহাদ সাধারণ কোনো ইবাদাত নয়, বরং নামায যেমন একটি খালেস ইবাদাত, জিহাদও ঠিক তেমনি।
আমরা ইবাদাত বলতে সাধারণত মনে করি নামায রোযা জাতীয় জিনিস। কাফের যবাই করাও যে ইবাদাত হতে পারে আমাদের কল্পনায় তা আসে না। কিন্তু আশ্চর্যের কিছুই নেই। যে আল্লাহ অবলা গরু যবাই করাকে ইবাদাত বানাতে পারেন, তিনি খোদাদ্রোহী পাপিষ্ট কাফেরকে যবাই করা ইবাদাত বানাবেন তাতে আশ্চর্যের কি আছে।
ইবনে নুজাইম রহ. এর কথাটা আবারও স্বরণ করিয়ে দিই:
وَأَمَّا الْجِهَادُ، فَمِنْ أَعْظَمِ الْعِبَادَاتِ. – الأشباه والنظائر لابن نجيم (ص: 20)
“আর জিহাদ তো সবচেয়ে বড় ইবাদাতসমূহের অন্তর্ভুক্ত এক সুমহান ইবাদাত।” –আলআশবাহ: ২০
“আর জিহাদ তো সবচেয়ে বড় ইবাদাতসমূহের অন্তর্ভুক্ত এক সুমহান ইবাদাত।” –আলআশবাহ: ২০
সারকথা
# জিহাদ নামায রোযার মতোই একটি খালেস ও সুমহান ইবাদাত; ফিতনা বা সন্ত্রাস নয়। সাজদা দেয়া যেমন ইবাদাত, কাফেরের বুকে খঞ্জর চালানোও তেমনি ইবাদাত।
# জিহাদ একান্ত আল্লাহ তাআলার নিজের হক। এতে দখল দেয়ার অধিকার কারও নেই; যেমন নেই নামায রোযায় দখল দেয়ার।
এ জিহাদ কেউ পরিবর্তন করতে পারবে না। জিহাদ বাদ দিয়ে ভিন্ন কিছুকে তার স্থলাভিষিক্ত করতে পারবে না।
কোনো পিতা মাতা তার সন্তানের উপর থেকে জিহাদ মাফ করতে পারবে না।
কোনো রাষ্ট্র প্রধান এ জিহাদের বিধান বাদ দিতে পারবে না, নিষিদ্ধ করতে পারবে না।
***
Comment