দি ট্রিপল এজেন্ট অ্যান্ড ডেডলিয়েস্ট ডে ফর সিআইএ - এসপিওনাজ কনফ্লিক্ট আল কায়েদা বনাম সিআইএ।
৩০শে ডিসেম্বর, ২০০৯। FOB চ্যাপম্যান, খোস্ত, আফগানিস্তান।
খোস্ত। যেদিকে চোখ যায় শুধুই শুকনো পাথর আর বালিয়াড়িময় প্রান্তর। দূরদূরান্ত পর্যন্ত চোখে পড়ে না কোনো জনবসতি। মাত্র কয়েক ঘন্টার দূরত্বে আবার পাকিস্তান সীমান্ত। এরকমই একটা অবস্থানে নির্মিত ফরওয়ার্ড অপারেটিং বেস চ্যাপম্যান। কুখ্যাত সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি এর ঘাঁটি।
এইমূহুর্তে ঘাঁটির প্রবেশমুখের সামনে বেশ কয়েকজন ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছেন। দূর থেকে দেখার সুযোগ থাকলে হয়তো কেউ বুঝতে পারতেন, এরা সবাই বিশেষ কারো আগমনের অপেক্ষায় রয়েছেন। এদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গুপ্তচর জগতে তারকা স্বরূপ। প্রত্যেককে ল্যাংলি ও হোয়াইট হাউজের কর্তাব্যক্তিরা অত্যন্ত শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখেন। অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা উভয় দিক থেকেই তারা সিআইএ এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। অবশেষে হয়তো এই গুপ্তচরদের অপেক্ষার পালা শেষ হতে চলেছে, কারণ এইমাত্র দিগন্তের কাছে ধূলোর ঝড় তুলেছে একটি গাড়ি! অতিথি হাজির হলেন!
কে এই অতিথি? যাকে স্বাগত জানাতে ওয়াশিংটন ও ল্যাংলিকে পৃথিবীর আরেকপ্রান্তে ধু ধু বালিয়াড়িময় প্রান্তরে এত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের পাঠাতে হলো? জানতে হলে চলুন, চলে যাই জর্দানে।
হুমাম খলিল আল-বালাওয়ি। ই স রা য়ে লে র কারণে বাস্তুহারা লাখো ফিলিস্তিনি শরণার্থীর একজন। পরিবার দেশ ছেড়েছে ১৯৪৮ এ যখন আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ আরম্ভ হয় সেসময়টায়। এরপর দীর্ঘদিন কুয়েতে বসবাস করছিলেন তার পরিবার। হঠাৎই একদিন সাদ্দাম হুসেইন কুয়েতে হামলা করে বসেন। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চলে আসে ত্রাণকর্তার ভূমিকা নিয়ে। সাদ্দামকে কুয়েত থেকে হটিয়ে দেওয়ামাত্র কুয়েত সরকার সেদেশের সকল ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত মানুষদের দেশ থেকে বের করে দিলেন। আরো একবার শরণার্থীতে পরিণত হলো হুমাম এর পরিবার। এবার তাঁদের আশ্রয় হলো জর্দানে। সেখান থেকে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে গিয়ে চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়াশোনা করলেন তিনি। বিয়ে করলেন তুর্কি একজন নারীকে। এই ব্যক্তিকেই আজ সিআইএ এর FOB চ্যাপম্যানে পেতে চলেছি আমরা।
একজন আপাতদৃষ্টিতে ভদ্র ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত ডাক্তার কেন সিআইএ এর ঘাঁটিতে আসবেন? জানার জন্য পেছনে ফিরতে হবে আরো একবার। আ বু দু জা না আ ল - খু রা সা নি নাম নিয়ে জাতিসংঘ ঘোষিত জঙ্গি( জিহাদি) সংগঠন আল-কায়েদা এর হয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তৎপরতা পরিচালিত করতেন কোনো এক ব্যক্তি। এই কোনো এক ব্যক্তি এবং জর্দানে বসবাসকারী হুমাম খলিল আল-বালাওয়ি এর মধ্যে যোগসূত্র খুঁজে পায় মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা CIA। ফলে, জর্দানের জেনারেল ইন্টেলিজেন্স ডিরেক্টরেট (GID) ও CIA এর মধ্যে ভালো সম্পর্ক থাকায় CIA তাদের এই হুমাম খলিলের ব্যবস্থা করার অনুরোধ করে। GID এর একটি দল, যার প্রধান ছিলেন রাজা আব্দুল্লাহ এর চাচাতো ভাই ক্যাপ্টেন শরীফ আলি বিন জায়েদ আল-ওউন, যথারীতি তাঁকে গ্রেফতার করে নিয়ে আসে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। বলে রাখা ভালো, উক্ত ক্যাপ্টেন শরীফ GID তে ১০ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন এবং তার পশ্চিমা মিত্রদের আস্থাভাজন ব্যক্তি ছিলেন।
যাইহোক, জর্দানিরা হুমাম খলিলকে সামান্য চাপ দেওয়ামাত্র সে ভেঙে পড়ে! যা সিআইএ এবং জর্দানি গোয়েন্দাদের ধারণার বাইরে ছিলো। সাধারণত আল-কায়েদা অপারেটররা নিজেদের রেজিস্ট্যান্স টু ইন্টারোগেশন (R2I) স্কিলের জন্য সুপরিচিত। তবে, এই অবিশ্বাস বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। কারণ, আটক থাকাকালীন এই ব্যক্তি জর্দানি ও মার্কিনী গোয়েন্দাদের অসংখ্য অজানা তথ্য প্রদান করে। যার অধিকাংশই তাদের ধারণার অতীত ছিলো। ফলে, জর্দানিরা হুমাম খলিল আল-বালাওয়িকে আল-কায়েদার ভেতরে নিজেদের একজন ডাবল এজেন্ট হিসাবে প্ল্যান্ট করার পরিকল্পনা করে!
ল্যাংলি তথা সিআইএ এর হেডকোয়ার্টারকে জর্দান এই পরিকল্পনা জানালে তারা দ্রুতই রাজি হয়ে যায়। কারণ, পূর্বে পৃথিবীর কোনো দেশের গোয়েন্দা সংস্থাই আল-কায়েদার অভ্যন্তরে বড় কোনো পর্যায়ে এজেন্ট প্ল্যান্ট করতে পারেনি। সুতরাং, সিআইএ তাঁকে পাসপোর্ট, ভিসা ও কিছু নগদ অর্থ সহ পাকিস্তানের নর্থ-ওয়াজিরিস্তানে আল-কায়েদার এলাকায় পৌঁছে দেয়!
হুমাম খলিল আল-বালাওয়ি নর্থ-ওয়াজিরিস্তানে যাওয়ামাত্র তাঁর জর্দান গোয়েন্দা সংস্থার হ্যান্ডলার ক্যাপ্টেন শরীফের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে ফেলেন। এভাবে তিন মাস অতিবাহিত হয়। এরপর, হঠাৎই একদিন তার পাঠানো এক ভিডিওবার্তা দেখে চমকে ওঠেন CIA ও GID সদস্যরা! ভিডিওতে তাঁকে আল-কায়েদার শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সাথে একটি তাঁবুতে দেখা যাচ্ছিলো! ভিডিওটা ল্যাংলিতে তোলপাড় ফেলে দেয়। প্রত্যেকের মস্তিষ্কে তখন একটাই চিন্তা খেলা করছে- "ওয়াও! অবশেষে কি অসাধারণ অ্যাসেটই না পাওয়া গেলো!"
হুমাম আল-খলিলের পরবর্তী কয়েকমাস নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণে ব্যয় হতে থাকে। CIA তাঁকে নিয়মিত ড্রোন স্ট্রাইকের জন্য টার্গেট কো-অর্ডিনেশন দিতে বলে। তিনি কো-অর্ডিনেশন তো বটেই, এমনকি ড্রোন থেকে হামলা হওয়ার পর ঘটনাস্থলের পরিস্থিতিও তাদের জানিয়ে দিতেন। এভাবে তাদের মাঝে নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রতিষ্ঠিত করে সে।
অবশেষে, FOB চ্যাপম্যানে অতিথি হওয়ার দিন ঘনিয়ে এলো। তিনি জানালেন, আল কায়েদার ২য় শীর্ষ নেতা শাইখ আইমান আয-যাওয়াহিরী কবে এবং কোথায় মেডিক্যাল চেকআপে বের হবেন, তা তাঁর জানা আছে। প্রমাণ হিসাবে জর্দানের গোয়েন্দা সংস্থা ও সিআইএ এর কাছে আইমান আয-যাওয়াহিরী এর বিগত বছরগুলোর স্বাস্থ্যবিষয়ক নথি পাঠান। যা সিআইএ এর রেকর্ডে থাকা নথির সাথে পুরোপুরি মিলে যায়।
সবকিছু ঠিক হওয়ার পর সিআইএ তাদের সেরা বিশেষজ্ঞদের একটা দলকে হুমাম খলিল আল-বালাওয়িকে ব্রিফ করা এবং প্রয়োজনীয় আধুনিক গ্যাজেট হস্তান্তরের জন্য পাঠিয়ে দেয়। পূর্বেই বলেছি, এই দলটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গুপ্তচর জগতের বিভিন্ন শাখার তারকাদের নিয়ে তৈরী ছিলো। তাদের সর্বমোট সংখ্যা ছিলো ১৪ জন। হুমাম খলিল প্রথমতঃ আফগানিস্তানে এসে দেখা করার পরিবর্তে পাকিস্তানে দেখা করার প্রস্তাব দেন। অনেক চাপাচাপির পরও সিআইএ রাজি না হওয়ায় পরিশেষে আফগানিস্তানেই সাক্ষাৎ করতে সম্মত হন তিনি।
ফেরত আসি ৩০শে ডিসেম্বর, ২০০৯ তে। ধূলোর ঝড় তুলে হুমাম খলিলকে বহনকারী গাড়িটি FOB চ্যাপম্যানের চেকপোস্টগুলো অতিক্রম করতে আরম্ভ করে। অবশেষে একপর্যায়ে তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে উপস্থিত সিআইএ এজেন্টদের সামনে এসে তার বহনকারী গাড়ি থেমে যায়। এইসময়ে তাঁকে বের করবার জন্য মার্কিন সিকিউরিটি টিমের সদস্যরা গাড়ির দিকে গেলে তিনি গাড়ির প্যাসেন্জার সিটের অপরপাশে সরে যান, এবং সেখান থেকে বের হন।
অদ্ভুত এই ব্যবহারের তাৎপর্য যতক্ষণে উপস্থিত সিআইএ তারকারা উপলব্ধি করতে পেরেছেন, ততক্ষণে তাদের কেউই আর পৃথিবীতে নেই!
হুমাম খলিল আল-বালাওয়ি "আল্লাহু আকবর" ধ্বনি দিয়ে শরীরে আটকানো ত্রিশ পাউন্ড এক্সপ্লোসিভের বিস্ফোরণ ঘটায়। ঘটনাস্থলেই ০৭ জন সিআইএ এজেন্ট এবং GID এর ক্যাপ্টেন শরীফ তথা জর্দানের রাজা আব্দুল্লাহ এর চাচাতো ভাই মৃত্যুবরণ করেন। সিআইএ কর্মকর্তারা পরবর্তীতে বলেন, ২০০৯ সাল হতে বিগত ২৫ বছরের ইতিহাসে এত বড় ধাক্কা আর কোনো ব্যক্তি কিংবা সংস্থা তাদের দিতে সমর্থ হয়নি!
পরিশিষ্টঃ সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি তখন পর্যন্ত পৃথিবীর সেরা হিসাবে পরিগণিত হতো। পরবর্তীতে এই অপারেশনে তাদের করা বিভিন্ন ভুল নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। CIA এবং GID খুব দ্রুতই হুমাম খলিলকে বিশ্বাস করে ফেলেছিল। এই কথাটি একাধিক CIA ও GID এজেন্ট অপারেশনের মূল হর্তাকর্তাদের বোঝাবার চেষ্টা করলেও পরবর্তীতে এই আল-কায়েদা অপারেটর তাদের বুদ্ধির খেলায় হারিয়ে দেয়, এবং দুই গোয়েন্দা সংস্থারই শীর্ষ কর্মকর্তাদের আস্থা অর্জন করতে সমর্থ হয়।
হুমাম খলিলের ব্যাপারে একজন CIA কর্মকর্তা বলেন- "কারোর এমনটা ভাবার অবকাশই ছিলো না যে, এই ব্যক্তি এমনটা করতে পারে। তাকে নিয়ে প্রত্যেকেই দারুণ আনন্দিত এবং উত্তেজিত ছিলো। অ্যাসেটের কর্মকান্ড মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি পর্যায়ের উচ্চস্তরে প্রশংসিত হচ্ছিলো।" তারপরই এটা ঘটলো। পরবর্তীতে অপারেশন নেপচুন স্পিয়ারে জাতিসংঘের সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকাভুক্ত এই দলের প্রধান শাইখ উসামা বিন লাদেনকে হত্যা করা গেলেও, আজ পর্যন্ত কোনো গোয়েন্দা সংস্থা শাইখ আইমান আয-যাওয়াহিরী এর টিকিটি স্পর্শ করতে সমর্থ হয়নি। বলা হয়ে থাকে, এই হুমাম খলিল আল-বালাওয়িকে স্বয়ং শাইখ আইমান আয-যাওয়াহিরী এই অপারেশনের ব্যাপারে পরিচালিত করেছিলেন।
সিআইএ এই অপারেশনে ১৪ জন তারকা এজেন্টকে একত্র করেছিল এক স্থানে। যেটা ছিলো আরেকটি বড় ভুল। এটা নিয়েও অনেক সমালোচনার শিকার হয় তারা। তবে, ততদিনে তাদের ক্ষতি যা হওয়ার হয়েই গিয়েছে।
(ঈষৎ সংশোধিত)
লেখকঃ- Predator11 | Collect From Facebook
সিআইএ এর মতো গোয়েন্দা সংস্থাকে ঘোল খাওয়ানো এবং বীরত্বপূর্ণ ফিদায়ী আক্রমণ করে সিআইএ টপ লেভেলের এজেন্ট + অপারেশনাল এক্সপার্টদের জাহান্নামে পাঠানো বীর যোদ্ধা ( হুমাম খলিল আল-বালাওয়ি) মুজাহিদদের নিকট আবু দুজানাহ আল খুরাসানি নামে পরিচিত ছিলেন । উম্মাহর এই বীর মুজাহিদ ফিদায়ী হামলা করার পূর্বে উম্মাহর জন্য রেখে যান মহামূল্যবান নসীহামূলক বার্তা ...
ফিদায়ী আক্রমণের বীর যোদ্ধার বার্তা -শহীদ আবু দুজানাহ আল খুরাসানি ( টেক্সট - PDF )
https://archive.org/details/AMessage...hurasanibangla
https://ia600704.us.archive.org/5/it...AbuDujanah.pdf
মুজাহিদ শায়েখের পক্ষ থেকে উম্মাহর যুবকদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান || শাইখ আবু দুজানা খোরাসানী (ভিডিও )
https://ia801005.us.archive.org/25/i...1909/Ahban.mp4
তার সম্পর্কে উইকিপিডিয়া
বাংলা - https://bn.m.wikipedia.org/wiki/%E0%...A6%AC%E0%A6%BF
ইংরেজি - https://en.m.wikipedia.org/wiki/Huma...ulal_al-Balawi
তাকে নিয়ে আমেরিকান সাংবাদিক Joby Warrick একটি বই লিখেছেন ❝ The Triple Agent ❞ নামে!
আবু দুজানাহ আল খুরাসানি মুসলিম যুবকদের হৃদয়ে সদা-সর্বদা ভাবে অনুপ্রেরণার বাহক হিসেবে প্রবাহমান থাকবেন। তার দাস্তান নিঃসন্দেহে কাপুরুষ আর পরাজিত মানসিকতায় আক্রান্ত মুসলিম পুরুষদের জিহাদি চেতনায় উজ্জীবিত হতে সাহায্য করবে। মহান রাব্বুল আলামিনের নিকট প্রার্থনা করি, আল্লাহ যেন এই বীর মুজাহিদকে জান্নাতুল ফিরদাউসের মেহমান হিসেবে কবুল করে নেন। আমীন।
Comment