শাহাদাতের সন্ধানে ছুটে চলাই মুমিনের জীবনযাপনের সর্বোত্তম পদ্ধতি
আবু হুরাইরা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, মুমিনের জীবনের সর্বোত্তম অবস্থা হলো ঐ ব্যক্তির অবস্থা যে আল্লাহর পথে জিহাদের জন্য ঘোড়ার লাগাম ধরে থাকে (অর্থাৎ পূর্ণ প্রস্তুত থাকে), (শত্রুর আগমণের) সংবাদ কিংবা (সাহায্যের আবেদনমূলক) চিৎকার শুনতে পাওয়া মাত্রই সে ঘোড়ার পিঠে উড়ে চলে, সম্ভাব্য (সকল) স্থানে শাহাদাত ও মৃত্যুকে খুঁজে ফেরে, কিংবা ঐ ব্যক্তি যে কোন পাহাড়ের চূড়ায় বা কোন উপত্যকায় কয়েকটি ছাগল নিয়ে বসবাস করে, নামায কায়েম করে, যাকাত প্রদান করে, এবং মৃত্য পর্যন্ত আল্লাহর ইবাদত করে, সে মানুষের শুধু কল্যাণই সাধণ করে (ক্ষতি করে না) [সহিহ মুসলিম, ১৮৮৯]
হাদিসের ব্যাখায় ইমাম নববী রহিমাহুল্লাহ (মৃ: ৬৭৬ হি.) বলেন,
المعاش هو العيش، وهو الحياة، وتقديره والله أعلم: «مِن خير أحوال عيشهم: رجل ممسك». قوله صلى الله عليه وسلم: «يطير على متنه كلما سمع هيعة أو فزعة طار على متنه، يبتغي القتل والموت مظانه» معناه: يسارع على ظهره، وهو متنه، كلما سمع هيعة، وهي الصوت عند حضور العدو، وهى بفتح الهاء وإسكان الياء، والفزعة بإسكان الزاي، وهي النهوض إلى العدو.
ومعنى «يبتغي القتل مظانه» : يطلبه في مواطنه التي يرجى فيها لشدة رغبته في الشهادة، وفي هذا الحديث فضيلة الجهاد والرباط والحرص على الشهادة. شرح النووي على مسلم: (13/35 ط. دار إحياء التراث العربي: 1392)
… ‘সম্ভাব্য স্থানে শাহাদাত ও মৃত্যুকে খুঁজে বেড়ায়’ এর অর্থ হলো, শাহাদাতের প্রতি তীব্র আকাঙ্খার কারণে ঐ সব স্থানে শাহাদাতকে খুঁজে বেড়ায় যেখানে শাহাদাতের সম্ভাবনা থাকে। এই হাদিস জিহাদ, রিবাত ও শাহাদাতের আকাঙ্খার ফযিলত প্রমাণ করে। [ -শরহে মুসলিম, ১৩/৩৫]
হাদিসের দ্বিতীয় অংশে যে পাহাড়ের চূড়ায় বা উপত্যকায় একাকী বসবাস করে ইবাদত বন্দেগী করার প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে, আলেমগণ বলেছেন, এটা ফিতনার সময়ের বিধান, এর দলিল হলো সহিহ বুখারীর এই হাদিস,
عن أبي سعيد الخدري رضي الله عنه، قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: «يوشك أن يكون خير مال الرجل غنم، يتبع بها شعف الجبال ومواقع القطر، يفر بدينه من الفتن» صحيح البخاري: (19)
আবু সাইদ খুদরী রাযিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, অচিরেই মানুষের উত্তম সম্পদ হবে ছাগলপাল, যা নিয়ে সে পাহাড়ের চূড়ায় ও বৃষ্টিবর্ষণের স্থানসমূহে বসবাস করবে, দ্বীন রক্ষার্থে সে ফিতনা থেকে পলায়ন করবে।
[-সহিহ বুখারী, ১৯] (বিস্তারিত দেখুন, ইমাম নববীর শরহে মুসলিম ১৩/৩৪ দারু ইহইয়াউত তুরাস, ফাতহুল বারী, 6/6-7 দারুল ফিকর, তাকমিলাতু ফাতহিল মুলহিম, ৩/৩৪৭ দারু ইহইয়াউত তুরাস)
আর স্বাভাবিক অবস্থায় মানুষের সাথে মিলে থাকা, বিশেষকরে জিহাদের উদ্দেশ্যে লোকালয়ে থাকা একাকী পাহাড়-উপত্যকায় থেকে ইবাদত করার চেয়ে অনেক উত্তম, একসাহাবী একটি পাহাড়ের শৃঙ্গের পাশ দিয়ে অতিক্রম করেন, যাতে একটি ছোট্ট সুন্দর ঝর্ণা ছিল, জায়গাটি সাহাবীর বেশ পছন্দ হয়, তিনি ভাবেন, যদি আমি মানুষের থেকে পৃথক হয়ে এই পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থান করি তাহলে কতই না উত্তম হয়, তবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে জিজ্ঞেস না করে আমি কখনোই তা করবো না। পরে তিনি রাসূলের নিকট এ বিষয়টি উপস্থাপন করলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন,
لاَ تَفْعَلْ، فَإِنَّ مُقَامَ أَحَدِكُمْ فِي سَبِيلِ اللهِ أَفْضَلُ مِنْ صَلاَتِهِ فِي بَيْتِهِ سَبْعِينَ عَامًا، أَلاَ تُحِبُّونَ أَنْ يَغْفِرَ اللَّهُ لَكُمْ وَيُدْخِلَكُمُ الجَنَّةَ، اغْزُو فِي سَبِيلِ اللهِ، مَنْ قَاتَلَ فِي سَبِيلِ اللهِ فَوَاقَ نَاقَةٍ وَجَبَتْ لَهُ الجَنَّةُ.أخرجه أحمد: (10785) والترمذي: والحاكم: (2382) (1650) وقال الترمذي: هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ. وقال الحاكم: (هذا حديث صحيح على شرط مسلم) ووافقه الذهبي، وقال الشيخ شعيب في تحقيقه لمسند أحمد: (إسناده حسن)
তুমি এটা করো না, কেননা আল্লাহর রাস্তায় একমূহুর্ত অবস্থান করা ঘরে বসে সত্তর বছর ইবাদত করার চেয়েও উত্তম, তোমরা কি চাওনা না আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করে দিবেন, তোমাদের জান্নাতে প্রবেশ করাবেন? আল্লাহর পথে যুদ্ধ করো, যে আল্লাহর পথে একমূহুর্ত যুদ্ধ করবে তার জন্য জান্নাত অবধারিত হয়ে যাবে।[-সুনানে তিরমিযি, ১৬৫০, মুসনাদে আহমদ, ৯৬৭২ ইমাম তিরমিযি ও শায়েখ শুয়াইব আরনাউত হাদিসটিকে হাসান বলেছেন।]
এখানে প্রসঙ্গত ফিতনা কাকে বলে তাও স্পষ্ট করা দরকার, অনেকে জিহাদকেই ফিতনা মনে করে,
বিশেষকরে নুসাইরী,শিয়া, রাফেদী ও মুরতাদ-ইসলামবিদ্বেষী সরকারের বিপক্ষে যুদ্ধকেই ফিতনা মনে করে নিরপেক্ষ হয়ে বসে থাকে, কিন্তু ফিতনা কাকে বলে এই বিষয়ে ইসলামে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।
ফিতনা সম্পর্কে সবচেয়ে জ্ঞানী সাহাবী হলেন হুযাইফা রাযিআল্লাহু আনহু, তিনি নিজেই বলেন, ‘মানুষ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে কল্যাণকর বিষয়াদী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতো, আর আমি তাকে অকল্যাণ (ফিতনা-ফাসাদ ইত্যাদি) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতাম, যেন আমি এগুলো থেকে বেঁচে থাকতে পারি।
[সহিহ বুখারী, ৩৬০৬ সহিহ মুসলিম, ১৮৪৭]
সাহাবায়ে কেরামও তাকে ফিতনা বিষয়ে সবচেয়ে বেশি জ্ঞানী হিসেবে স্বীকৃতি দিতেন,
[সহিহ বুখারী, ৫২৫ সহিহ মুসলিম, ১৪৪]
তো এই মহান সাহাবী হুযাইফা রাযিআল্লাহু আনহু সুস্পষ্ট রুপে বলেছেন, ‘ফিতনা হলো যখন হক-বাতিল অস্পষ্ট হয়ে যায়’, অর্থাৎ যদি কখনো এমন হয় যে, কোন পক্ষ হক আর কোন পক্ষ বাতিল তা নির্ধারণ করা না যায় তখন শরিয়ত আমাদের কোনো পক্ষ অবলম্বন করতে নিষেধ করেছে, কিন্তু যেখানে এক পক্ষ কুরআনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ করছে, আর অপর পক্ষ গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠা কিংবা বহাল রাখার জন্য যুদ্ধ করছে সেক্ষেত্রে শরিয়ত আমাদের কুরআনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য যারা লড়াই করছে তাদের পক্ষে যোগদানের জন্য সুষ্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছে, এ বিষয়ে হুযাইফা ও সালমান রাযিআল্লাহু আনহুমা, এবং কাবে আহবার রহিমাহুল্লাহু থেকে নিম্নে বর্ণিত আছারগুলো লক্ষ্য করুন,
«لَمَّا قَدِمَ حُذَيْفَةُ عَلَى جُوخَا أَتَى أَبَا مَسْعُودٍ يُسَلِّمُ عَلَيْهِ، فَقَالَ أَبُو مَسْعُودٍ: مَا شَأْنُ سَيْفِكَ هَذَا يَا أَبَا عَبْدِ اللهِ؟ قَالَ: أَمَّرَنِي عُثْمَان عَلَى جُوخَا، فَقَالَ: يَا أَبَا عَبْدِ اللهِ، أَتَخْشَى أَنْ تَكُونَ هَذِهِ فِتْنَةً، حِينَ طَرَدَ النَّاسُ سَعِيدَ بْنَ الْعَاصِ، قَالَ لَهُ حُذَيْفَةُ: أَمَا تَعْرِفُ دِينَك يَا أَبَا مَسْعُودٍ، قَالَ: بَلَى، قَالَ: فَإِنَّهَا لاَ تَضُرُّك الْفِتْنَةُ مَا عَرَفْتَ دِينَك، إنَّمَا الْفِتْنَةُ إِذَا اشْتَبَهَ عَلَيْك الْحَقُّ وَالْبَاطِلُ فَلَمْ تَدْرِ أَيَّهُمَا تَتَّبِعُ، فَتِلْكَ الْفِتْنَةُ». أخرجه ابن أبي شيبة: 38447
হুযাইফা রাযি. যখন জুখার গভর্ণর হয়ে আসেন তখন আবু মাসউদ রাযি. তাকে সালাম জানানোর জন্য আসেন, আবু মাসউদ বলেন, হে আবু আব্দুল্লাহ আপনার সাথে তরবারী কেন? হুযাইফা রাযিআল্লাহু আনহু বলেন, উসমান রাযি. আমাকে জুখার গভর্ণর বানিয়েছেন। আবু মাসউদ রাযিআল্লাহু আনহু বললেন, এই যে লোকেরা (সাবেক গভর্ণর) সাইদ বিন আসকে তাড়িয়ে দিল এ কারণে কি আপনি কোন ফিতনা হওয়ার আশংকা করছেন? হুযাইফা রাযিআল্লাহু আনহু বললেন, হে আবু মাসউদ, আপনি কি আপনার দ্বীন সম্পর্কে অবগত নন? আবু মাসউদ বললেন, হাঁ, অবশ্যই। হুযাইফা রাযিআল্লাহু আনহু বললেন, যতদিন আপনি আপনার দ্বীনের ব্যাপারে অবগত থাকবেন, ততদিন ফিতনা আপনার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। ফিতনা তো হলো যখন হক-বাতিল অস্পষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে আপনি কি করবেন, কোন পক্ষে যাবেন তা নির্ধারণ করতে পারবেন না।
[ -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, ৩৮৪৪৭ এ আছারটি হাফেয ইবনে হাযারও ফাতহুল বারীতে সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ করেছেন, দেখুন ফাতহুল বারী, ১৩/৪৯ দারুল ফিকর।]
عَن طَارِقِ بْنِ شِهَابٍ، قَالَ: «قَالَ سَلْمَانُ لِزَيْدِ بْنِ صُوحَانَ: كَيْفَ أَنْتَ إذَا اقْتَتَلَ الْقُرْآنُ وَالسُّلْطَانُ؟ قَالَ: إذًا أَكُونُ مَعَ الْقُرْآنِ، قَالَ: نِعْمَ الزُّويَيْدُ: إذًا أَنْتَ». أخرجه ابن أبي شيبة: (30926)
তারেক বিন শিহাব বলেন, সালমান রাযিআল্লাহু আনহু যায়েদ বিন সুহানকে জিজ্ঞেস করলেন, যখন কুরআনের অনুসারী ও শাসকের মধ্যে যুদ্ধ হবে তখন তুমি কি করবে, যায়েদ বললেন, আমি কুরআনের অনুসারীদের পক্ষ অবলম্বন করবো, সালমান রাযিআল্লাহু আনহু (খুশি হয়ে) বললেন, তাহলে তুমি কতই না উত্তম যায়েদ হবে।
[-মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, ৩০৯২৬]
عَن كَعْبٍ، قَالَ: «يَقْتَتِلُ الْقُرْآنُ وَالسُّلْطَانُ قَالَ: فَيَطَأُ السُّلْطَانُ عَلَى صِمَاخِ الْقُرْآنِ فَلأْيًا بِلأْيِ، وَلأْيًا بِلأي، مَا تَنْفَلتُنَّ مِنْهُ». أخرجه ابن أبي شيبة: (30927) وأبو عبيد في فضائل القرآن: (132)
মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবার টিকায় শায়েখ আওয়ামা বলেন,
والمعنى - والله أعلم سيكون اقتتال بين أهل القرآن والسلطان، وتكون الغلبة لأهل القرآن، وتكون شدَّةً بشدةٍ، قلَّ ما تنفلتن وتنجون منها. (تعليق الشيخ عوامه على المصنف : 15/562 ط. دار القبلة)
উল্লিখিত আছরটির অর্থ হলো, অচিরেই কুরআনের অনুসারী ও বাদশার অনুসারীদের মধ্যে যুদ্ধ হবে, এবং কুরআনের অনুসারীদেরই বিজয় হবে। তবে হবে যুদ্ধ ঘোরতর, তোমাদের কম লোকই তার ভয়াবহতা থেকে মুক্তি পাবে।
[-মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, ১৫/৫৬২]
বস্তুত, নামায কায়েম না করা এবং কুরআন-সুন্নাহর পরিবর্তে মানবরচিত আইন দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালনা করা, শাসকের বিপক্ষে বিদ্রোহ ওয়াজিব হওয়ার স্বতন্ত্র ক্ষেত্র, চাই এসব কাজের কারণে শাসককে মুরতাদ বলা হোক বা না হোক, বরং অনেক আলেমগণ এসব ক্ষেত্রে শাসকের বিপক্ষে যুদ্ধ করে তাকে অপসারিত করা উম্মতের ইজমায়ী সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ওয়াজিব বলে দাবী করেছেন।
আবু হুরাইরা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, মুমিনের জীবনের সর্বোত্তম অবস্থা হলো ঐ ব্যক্তির অবস্থা যে আল্লাহর পথে জিহাদের জন্য ঘোড়ার লাগাম ধরে থাকে (অর্থাৎ পূর্ণ প্রস্তুত থাকে), (শত্রুর আগমণের) সংবাদ কিংবা (সাহায্যের আবেদনমূলক) চিৎকার শুনতে পাওয়া মাত্রই সে ঘোড়ার পিঠে উড়ে চলে, সম্ভাব্য (সকল) স্থানে শাহাদাত ও মৃত্যুকে খুঁজে ফেরে, কিংবা ঐ ব্যক্তি যে কোন পাহাড়ের চূড়ায় বা কোন উপত্যকায় কয়েকটি ছাগল নিয়ে বসবাস করে, নামায কায়েম করে, যাকাত প্রদান করে, এবং মৃত্য পর্যন্ত আল্লাহর ইবাদত করে, সে মানুষের শুধু কল্যাণই সাধণ করে (ক্ষতি করে না) [সহিহ মুসলিম, ১৮৮৯]
হাদিসের ব্যাখায় ইমাম নববী রহিমাহুল্লাহ (মৃ: ৬৭৬ হি.) বলেন,
المعاش هو العيش، وهو الحياة، وتقديره والله أعلم: «مِن خير أحوال عيشهم: رجل ممسك». قوله صلى الله عليه وسلم: «يطير على متنه كلما سمع هيعة أو فزعة طار على متنه، يبتغي القتل والموت مظانه» معناه: يسارع على ظهره، وهو متنه، كلما سمع هيعة، وهي الصوت عند حضور العدو، وهى بفتح الهاء وإسكان الياء، والفزعة بإسكان الزاي، وهي النهوض إلى العدو.
ومعنى «يبتغي القتل مظانه» : يطلبه في مواطنه التي يرجى فيها لشدة رغبته في الشهادة، وفي هذا الحديث فضيلة الجهاد والرباط والحرص على الشهادة. شرح النووي على مسلم: (13/35 ط. دار إحياء التراث العربي: 1392)
… ‘সম্ভাব্য স্থানে শাহাদাত ও মৃত্যুকে খুঁজে বেড়ায়’ এর অর্থ হলো, শাহাদাতের প্রতি তীব্র আকাঙ্খার কারণে ঐ সব স্থানে শাহাদাতকে খুঁজে বেড়ায় যেখানে শাহাদাতের সম্ভাবনা থাকে। এই হাদিস জিহাদ, রিবাত ও শাহাদাতের আকাঙ্খার ফযিলত প্রমাণ করে। [ -শরহে মুসলিম, ১৩/৩৫]
হাদিসের দ্বিতীয় অংশে যে পাহাড়ের চূড়ায় বা উপত্যকায় একাকী বসবাস করে ইবাদত বন্দেগী করার প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে, আলেমগণ বলেছেন, এটা ফিতনার সময়ের বিধান, এর দলিল হলো সহিহ বুখারীর এই হাদিস,
عن أبي سعيد الخدري رضي الله عنه، قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: «يوشك أن يكون خير مال الرجل غنم، يتبع بها شعف الجبال ومواقع القطر، يفر بدينه من الفتن» صحيح البخاري: (19)
আবু সাইদ খুদরী রাযিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, অচিরেই মানুষের উত্তম সম্পদ হবে ছাগলপাল, যা নিয়ে সে পাহাড়ের চূড়ায় ও বৃষ্টিবর্ষণের স্থানসমূহে বসবাস করবে, দ্বীন রক্ষার্থে সে ফিতনা থেকে পলায়ন করবে।
[-সহিহ বুখারী, ১৯] (বিস্তারিত দেখুন, ইমাম নববীর শরহে মুসলিম ১৩/৩৪ দারু ইহইয়াউত তুরাস, ফাতহুল বারী, 6/6-7 দারুল ফিকর, তাকমিলাতু ফাতহিল মুলহিম, ৩/৩৪৭ দারু ইহইয়াউত তুরাস)
আর স্বাভাবিক অবস্থায় মানুষের সাথে মিলে থাকা, বিশেষকরে জিহাদের উদ্দেশ্যে লোকালয়ে থাকা একাকী পাহাড়-উপত্যকায় থেকে ইবাদত করার চেয়ে অনেক উত্তম, একসাহাবী একটি পাহাড়ের শৃঙ্গের পাশ দিয়ে অতিক্রম করেন, যাতে একটি ছোট্ট সুন্দর ঝর্ণা ছিল, জায়গাটি সাহাবীর বেশ পছন্দ হয়, তিনি ভাবেন, যদি আমি মানুষের থেকে পৃথক হয়ে এই পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থান করি তাহলে কতই না উত্তম হয়, তবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে জিজ্ঞেস না করে আমি কখনোই তা করবো না। পরে তিনি রাসূলের নিকট এ বিষয়টি উপস্থাপন করলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন,
لاَ تَفْعَلْ، فَإِنَّ مُقَامَ أَحَدِكُمْ فِي سَبِيلِ اللهِ أَفْضَلُ مِنْ صَلاَتِهِ فِي بَيْتِهِ سَبْعِينَ عَامًا، أَلاَ تُحِبُّونَ أَنْ يَغْفِرَ اللَّهُ لَكُمْ وَيُدْخِلَكُمُ الجَنَّةَ، اغْزُو فِي سَبِيلِ اللهِ، مَنْ قَاتَلَ فِي سَبِيلِ اللهِ فَوَاقَ نَاقَةٍ وَجَبَتْ لَهُ الجَنَّةُ.أخرجه أحمد: (10785) والترمذي: والحاكم: (2382) (1650) وقال الترمذي: هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ. وقال الحاكم: (هذا حديث صحيح على شرط مسلم) ووافقه الذهبي، وقال الشيخ شعيب في تحقيقه لمسند أحمد: (إسناده حسن)
তুমি এটা করো না, কেননা আল্লাহর রাস্তায় একমূহুর্ত অবস্থান করা ঘরে বসে সত্তর বছর ইবাদত করার চেয়েও উত্তম, তোমরা কি চাওনা না আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করে দিবেন, তোমাদের জান্নাতে প্রবেশ করাবেন? আল্লাহর পথে যুদ্ধ করো, যে আল্লাহর পথে একমূহুর্ত যুদ্ধ করবে তার জন্য জান্নাত অবধারিত হয়ে যাবে।[-সুনানে তিরমিযি, ১৬৫০, মুসনাদে আহমদ, ৯৬৭২ ইমাম তিরমিযি ও শায়েখ শুয়াইব আরনাউত হাদিসটিকে হাসান বলেছেন।]
এখানে প্রসঙ্গত ফিতনা কাকে বলে তাও স্পষ্ট করা দরকার, অনেকে জিহাদকেই ফিতনা মনে করে,
বিশেষকরে নুসাইরী,শিয়া, রাফেদী ও মুরতাদ-ইসলামবিদ্বেষী সরকারের বিপক্ষে যুদ্ধকেই ফিতনা মনে করে নিরপেক্ষ হয়ে বসে থাকে, কিন্তু ফিতনা কাকে বলে এই বিষয়ে ইসলামে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।
ফিতনা সম্পর্কে সবচেয়ে জ্ঞানী সাহাবী হলেন হুযাইফা রাযিআল্লাহু আনহু, তিনি নিজেই বলেন, ‘মানুষ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে কল্যাণকর বিষয়াদী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতো, আর আমি তাকে অকল্যাণ (ফিতনা-ফাসাদ ইত্যাদি) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতাম, যেন আমি এগুলো থেকে বেঁচে থাকতে পারি।
[সহিহ বুখারী, ৩৬০৬ সহিহ মুসলিম, ১৮৪৭]
সাহাবায়ে কেরামও তাকে ফিতনা বিষয়ে সবচেয়ে বেশি জ্ঞানী হিসেবে স্বীকৃতি দিতেন,
[সহিহ বুখারী, ৫২৫ সহিহ মুসলিম, ১৪৪]
তো এই মহান সাহাবী হুযাইফা রাযিআল্লাহু আনহু সুস্পষ্ট রুপে বলেছেন, ‘ফিতনা হলো যখন হক-বাতিল অস্পষ্ট হয়ে যায়’, অর্থাৎ যদি কখনো এমন হয় যে, কোন পক্ষ হক আর কোন পক্ষ বাতিল তা নির্ধারণ করা না যায় তখন শরিয়ত আমাদের কোনো পক্ষ অবলম্বন করতে নিষেধ করেছে, কিন্তু যেখানে এক পক্ষ কুরআনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ করছে, আর অপর পক্ষ গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠা কিংবা বহাল রাখার জন্য যুদ্ধ করছে সেক্ষেত্রে শরিয়ত আমাদের কুরআনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য যারা লড়াই করছে তাদের পক্ষে যোগদানের জন্য সুষ্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছে, এ বিষয়ে হুযাইফা ও সালমান রাযিআল্লাহু আনহুমা, এবং কাবে আহবার রহিমাহুল্লাহু থেকে নিম্নে বর্ণিত আছারগুলো লক্ষ্য করুন,
«لَمَّا قَدِمَ حُذَيْفَةُ عَلَى جُوخَا أَتَى أَبَا مَسْعُودٍ يُسَلِّمُ عَلَيْهِ، فَقَالَ أَبُو مَسْعُودٍ: مَا شَأْنُ سَيْفِكَ هَذَا يَا أَبَا عَبْدِ اللهِ؟ قَالَ: أَمَّرَنِي عُثْمَان عَلَى جُوخَا، فَقَالَ: يَا أَبَا عَبْدِ اللهِ، أَتَخْشَى أَنْ تَكُونَ هَذِهِ فِتْنَةً، حِينَ طَرَدَ النَّاسُ سَعِيدَ بْنَ الْعَاصِ، قَالَ لَهُ حُذَيْفَةُ: أَمَا تَعْرِفُ دِينَك يَا أَبَا مَسْعُودٍ، قَالَ: بَلَى، قَالَ: فَإِنَّهَا لاَ تَضُرُّك الْفِتْنَةُ مَا عَرَفْتَ دِينَك، إنَّمَا الْفِتْنَةُ إِذَا اشْتَبَهَ عَلَيْك الْحَقُّ وَالْبَاطِلُ فَلَمْ تَدْرِ أَيَّهُمَا تَتَّبِعُ، فَتِلْكَ الْفِتْنَةُ». أخرجه ابن أبي شيبة: 38447
হুযাইফা রাযি. যখন জুখার গভর্ণর হয়ে আসেন তখন আবু মাসউদ রাযি. তাকে সালাম জানানোর জন্য আসেন, আবু মাসউদ বলেন, হে আবু আব্দুল্লাহ আপনার সাথে তরবারী কেন? হুযাইফা রাযিআল্লাহু আনহু বলেন, উসমান রাযি. আমাকে জুখার গভর্ণর বানিয়েছেন। আবু মাসউদ রাযিআল্লাহু আনহু বললেন, এই যে লোকেরা (সাবেক গভর্ণর) সাইদ বিন আসকে তাড়িয়ে দিল এ কারণে কি আপনি কোন ফিতনা হওয়ার আশংকা করছেন? হুযাইফা রাযিআল্লাহু আনহু বললেন, হে আবু মাসউদ, আপনি কি আপনার দ্বীন সম্পর্কে অবগত নন? আবু মাসউদ বললেন, হাঁ, অবশ্যই। হুযাইফা রাযিআল্লাহু আনহু বললেন, যতদিন আপনি আপনার দ্বীনের ব্যাপারে অবগত থাকবেন, ততদিন ফিতনা আপনার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। ফিতনা তো হলো যখন হক-বাতিল অস্পষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে আপনি কি করবেন, কোন পক্ষে যাবেন তা নির্ধারণ করতে পারবেন না।
[ -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, ৩৮৪৪৭ এ আছারটি হাফেয ইবনে হাযারও ফাতহুল বারীতে সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ করেছেন, দেখুন ফাতহুল বারী, ১৩/৪৯ দারুল ফিকর।]
عَن طَارِقِ بْنِ شِهَابٍ، قَالَ: «قَالَ سَلْمَانُ لِزَيْدِ بْنِ صُوحَانَ: كَيْفَ أَنْتَ إذَا اقْتَتَلَ الْقُرْآنُ وَالسُّلْطَانُ؟ قَالَ: إذًا أَكُونُ مَعَ الْقُرْآنِ، قَالَ: نِعْمَ الزُّويَيْدُ: إذًا أَنْتَ». أخرجه ابن أبي شيبة: (30926)
তারেক বিন শিহাব বলেন, সালমান রাযিআল্লাহু আনহু যায়েদ বিন সুহানকে জিজ্ঞেস করলেন, যখন কুরআনের অনুসারী ও শাসকের মধ্যে যুদ্ধ হবে তখন তুমি কি করবে, যায়েদ বললেন, আমি কুরআনের অনুসারীদের পক্ষ অবলম্বন করবো, সালমান রাযিআল্লাহু আনহু (খুশি হয়ে) বললেন, তাহলে তুমি কতই না উত্তম যায়েদ হবে।
[-মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, ৩০৯২৬]
عَن كَعْبٍ، قَالَ: «يَقْتَتِلُ الْقُرْآنُ وَالسُّلْطَانُ قَالَ: فَيَطَأُ السُّلْطَانُ عَلَى صِمَاخِ الْقُرْآنِ فَلأْيًا بِلأْيِ، وَلأْيًا بِلأي، مَا تَنْفَلتُنَّ مِنْهُ». أخرجه ابن أبي شيبة: (30927) وأبو عبيد في فضائل القرآن: (132)
মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবার টিকায় শায়েখ আওয়ামা বলেন,
والمعنى - والله أعلم سيكون اقتتال بين أهل القرآن والسلطان، وتكون الغلبة لأهل القرآن، وتكون شدَّةً بشدةٍ، قلَّ ما تنفلتن وتنجون منها. (تعليق الشيخ عوامه على المصنف : 15/562 ط. دار القبلة)
উল্লিখিত আছরটির অর্থ হলো, অচিরেই কুরআনের অনুসারী ও বাদশার অনুসারীদের মধ্যে যুদ্ধ হবে, এবং কুরআনের অনুসারীদেরই বিজয় হবে। তবে হবে যুদ্ধ ঘোরতর, তোমাদের কম লোকই তার ভয়াবহতা থেকে মুক্তি পাবে।
[-মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, ১৫/৫৬২]
বস্তুত, নামায কায়েম না করা এবং কুরআন-সুন্নাহর পরিবর্তে মানবরচিত আইন দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালনা করা, শাসকের বিপক্ষে বিদ্রোহ ওয়াজিব হওয়ার স্বতন্ত্র ক্ষেত্র, চাই এসব কাজের কারণে শাসককে মুরতাদ বলা হোক বা না হোক, বরং অনেক আলেমগণ এসব ক্ষেত্রে শাসকের বিপক্ষে যুদ্ধ করে তাকে অপসারিত করা উম্মতের ইজমায়ী সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ওয়াজিব বলে দাবী করেছেন।
Comment