আত্–তিবয়ান পাবলিকেশন্স
কর্তৃক প্রকাশিত
আল্লাহ্ আমাদের বিজয়ের জন্য প্রস্তুত করছেন
ইমাম আনওয়ার আল-আওলাকি (রহিমাহুল্লাহ)
এর থেকে
পর্ব : ৩য়
==================================================
===============================
কর্তৃক প্রকাশিত
আল্লাহ্ আমাদের বিজয়ের জন্য প্রস্তুত করছেন
ইমাম আনওয়ার আল-আওলাকি (রহিমাহুল্লাহ)
এর থেকে
পর্ব : ৩য়
==================================================
===============================
(৩) বিজয় অতি নিকটে
প্রথমে আমরা একটা জিনিস ধরে নেই, পরে এর সত্যতা যাচাই করে দেখি। ধরে নেই, বিজয় অতি নিকটে। এবার তা প্রমাণ করার চেষ্টা করি। আমরা বিষয়টি যে মূলনীতির আলোকে পর্যালোচনা করব তা হলঃ আল্লাহ্ কোন পরিণতি চাইলে তার উপযোগী মাধ্যম ও তৈরি করবেন। এখন দেখা যাক এ মূলনীতিটি কতটুকু শুদ্ধ। সেজন্য আমরা ইতিহাস প্রসিদ্ধ কতগুলো ঘটনা উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করি।
প্রথম উদাহরণ: বুখারী শরীফে আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মক্কায় দীর্ঘ ১৩ বছর দা‘ওয়াহ্ দেন। সেখানে আশানুরূপ ফল না পেয়ে তিনি তায়েফে গমন করেন, কিন্তু সেখানেও তিনি বৈরী পরিস্থিতির শিকার হন। প্রতি বছর হজ্জের মৌসুমে তিনি বিভিন্ন গোত্রের কাছে দা‘ওয়াহ্ দিতেন এবং নির্দিষ্টভাবে তিনি তাদের কাছে সাহায্যের অঙ্গীকার চাইতেন, যাতে তিনি তাঁর রবের বাণী সবার নিকট পৌঁছাতে পারেন। কিন্তু কেউই তাঁর কথায় পুরোপুরি সম্মত হতে পারেনি। আল্লাহ্ চাচ্ছিলেন এই সুবর্ণ সুযোগ কোন গোত্র লাভ করুক: আল-আওস ওয়াল-খাযরাজ। কিন্তু কিভাবে তা হল? আওস এবং খাযরাজ গোত্রদ্বয় অন্তহীন দ্বন্দ্বযুদ্ধে লিপ্ত ছিল। তারা প্রতিদিন জেগে উঠে যুদ্ধ করত। এ রকমই ছিল তাদের জীবন। শেষমেশ তারা রণে ভঙ্গ দিল। এই যুদ্ধ তাদের সহ্যশীলতার চরম মাত্রায় পৌঁছাল। তাদের জীবনে এরপরে এল বুয়াসের দিন। আয়েশা (রাঃ) এ প্রসঙ্গে বলেন, “বুয়াসের দিন ছিল আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে রাসূলের জন্য উপহারস্বরূপ” মদিনায় ‘বুয়াসের’ ঘটনার সময় রাসূলের মদিনার সাথে কোন সংশ্লিষ্টতা ছিল না; তাহলে বুয়াসের দিন কি ঘটেছিল? এটি এমন একদিন যেদিন দুই গোত্র মুখোমুখি যুদ্ধে লিপ্ত হয়। তুমুল যুদ্ধের ফলে তাদের উভয় গোত্রই নেতৃত্ব শূন্য হয়ে পড়ে। ফলে যখন রাসূল (সাঃ) তাদের নিকট আসেন, তারা ছিল নেতৃত্বহীন। কারণ তাদের নেতৃস্থানীয় লোকদের সকলে নিহত ও অবশিষ্টরা আহত হয়েছিল।
কুর’আনে বর্ণিত ঘটনাসমূহ লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, যারা নবীগণের বিরোধিতা করে তারা একটি বিশেষ শ্রেণীর হয়ে থাকে। কুর’আনে ওদেরকে ‘আল-মালা’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। কিন্তু কি ওদের পরিচয়? এরা হল নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ, হতে পারে তা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, মিডিয়া সম্পর্কিত কিংবা সামাজিক। এরাই আম্বিয়াদের বিরোধিতা করে। কেন? কারণ ওরা নেতৃত্ব ও সামাজিক সুযোগ সুবিধা হারানোর আশঙ্কা করে। ওরা ওদের অবস্থার কোন রকম পরিবর্তন চায় না। ফলে ওরা আম্বিয়াদের দা‘ওয়াতের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ওরা ভাল করেই জানে আম্বিয়াগণ ওদের ক্ষমতা চূর্ণ করে আল্লাহ্র বিধান কায়েম করতে চায়। এমতাবস্থায় সমাজের সকলেই হবে সমান। খলিফা নিযুক্ত হবে আল্লাহ্র আইন কায়েম করার জন্য, কারো ব্যক্তি স্বার্থ সংরক্ষণের সুযোগ থাকবে না।
আবু বকর আল-সিদ্দীক (রাঃ), উমর ইবন আল-খাত্তাব (রাঃ) কেহই ব্যক্তি স্বার্থের কারণে নয়, বরং আল্লাহ্র কিতাব ও বিধান কায়েমের জন্য খলিফা নিযুক্ত হন। খলিফাকে বলা হয় ‘মাসুল’ কেননা, কিয়ামতে তাঁকে দায়িত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে। খিলাফতের পদে নিয়োজিত ব্যক্তি দায়িত্ব কর্তব্য সম্বন্ধে বিচার দিবসে আল্লাহ্র কাছে জিজ্ঞাসিত হবে। কেহই এই পদ পেতে চাইত না; খলিফাগণকে এই পদে জোরপূর্বক নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। আবু বকর (রাঃ) বাইয়াত দিতে চেয়েছিলেন উমর (রাঃ)-এর নিকট। উমরের নিকট আবু বকর জোরপূর্বক খিলাফতের দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। এরপর লোকেরা খিলাফতের দায়িত্ব আব্দুল্লাহ ইবনে উমরের নিকট হস্তান্তরের দাবি জানালে তাঁর পিতা উমর (রাঃ) বলেন, “আমি চাই না আমার পরিবারের দু’জন লোক বিচার দিবসে আল্লাহ্র নিকট খিলাফতের দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হোক।”
সুতরাং আল-মালা হল সেসকল লোক যারা ইসলামের বিরুদ্ধাচরণ করে। যেমনঃ ফিরআউন, কারূন, আবু জাহল, আবু লাহাব প্রমুখ। সামাজিক পদমর্যাদার কারণে ওরা অর্থ, যশ, খ্যাতি, সম্মানসহ ও বিবিধ চরম সুযোগ সুবিধা অর্জন করে। তা সত্ত্বে ওরা ক্ষতিগ্রস্ত। ওরা নিজেদের মুক্ত ও স্বাধীনচেতা মনে করলেও মানব-রচিত ব্যবস্থাধীনে প্রকৃত অর্থে কেউই স্বাধীন নয়। রাবিয়া ইবন আমীর (রাঃ) যখন পারস্যে গমন করেন, পারস্যের নেতা জানতে চান, “তোমরা কেন আমাদের বাসভূমিতে এসেছ? অর্থের প্রয়োজন থাকলে তোমাদের সকলকে অর্থ প্রদানের ব্যবস্থা করব, সুতরাং আমাদেরকে আমাদের মত থাকতে দিয়ে তোমরা চলে যাও।” জবাবে রাবিয়া বললেন, “এ রকম কোন উদ্দেশ্যে আমরা এখানে আগমন করিনি। মানুষদের সৃষ্টির দাসত্ব করা হতে মুক্ত করে শুধু সৃষ্টার তথা আল্লাহ্র দাসত্বে নিয়োজিত করার জন্য ও ধর্মের নামে যে জুলুমের বেড়াজাল তৈরি হয়েছে তা ছিন্ন করে কেবল ইসলামের ন্যায়-বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের প্রেরণ করা হয়েছে। আমরা মানুষকে এই দুনিয়ার সংকীর্ণতা থেকে বের করে এই পৃথিবী ও আখিরাতের বিশালতায় নিয়ে যেতে চাই।”
রাবিয়া ইবন আমীর (রাঃ) ধর্মতত্ত্বের ছাত্র ছিলেন না, তা সত্ত্বেও অন্যান্য সকল ধর্মের জুলুম তথা অবিচারের কথা বললেন। অন্য সকল ধর্ম সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান অর্জনের প্রয়োজন ছিল না, কারণ ওহীর জ্ঞান দ্বারা তিনি ওয়াকিবহাল ছিলেন যে, কেবল ইসলাম-ই ন্যায় বিচার ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করতে পারে, বাকি সকল ধর্মই জুলুমপরায়ণ।
পূর্বেও নেতৃত্ব না থাকায় বুয়াসের দিন ছিল নতুন ক্ষেত্র তৈরির প্রস্তুতি পর্ব। হজ্জে গমন করে আনসারগণ মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সম্পর্কে শুনে বলেছিলেন, “চল, আমরা এ ব্যক্তিকে আমাদের বাসভূমিতে নিয়ে যাই। আল্লাহ্ হয়ত আমাদেরকে তাঁর দ্বারা একত্রিত ও সংঘবদ্ধ করবেন।” সুবহানাল্লাহ্! নেতৃত্ব ছাড়া মানবতা টিকে থাকতে পারে না; ভাল-মন্দ উভয়ক্ষেত্রেই নেতৃত্ব প্রয়োজন। আর-রাহমানের বাহিনীর যেমন নেতৃত্ব ও দিক নির্দেশনা প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন আশ-শয়তানের বাহিনীরও। মানব প্রকৃতি আসলে এমনই; কাউকে না কাউকে আমাদের প্রয়োজন যে আমাদের পথ দেখাবে। প্রস্তুতি পর্বের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল আনসারগণ ছিল ইহুদীদের প্রতিবেশী। ওদের নিকট আনসারগণ একজন রাসূলের আগমনের কথা জানতেন, কিন্তু সে সময় অন্য কোন আরব গোষ্ঠী এ ব্যাপারে কিছুই জানত না। আনসারগণ ইহুদীদের বলতে শুনতেন, “আমাদের মাঝে একজন রাসূল প্রেরণ করা হবে। তখন আমরা তোমাদের সেভাবে হত্যা করব, যেভাবে আ’দ জাতিকে ধ্বংস করা হয়েছিল।” ইহুদীরা আনসারদের একজন রাসূল আগমনের এবং তাদেরকে বিনাশের হুমকি দিত, যদিও বাস্তবে হয়েছিল ঠিক তার উল্টো। কোন নির্দিষ্ট পরিণতির দিকে কি এসব ঘটনা পূর্ব প্রস্তুতি মূলক ছিল না? আল্লাহ্ তা‘আলা চান যে, আনসারগণ মানুষ এবং রাসূল (সাঃ) -এর সেবায় নিয়োজিত হোক।
সুতরাং ঘটনা পরম্পরায় তাদের প্রস্তুতি চলছিল। আনসারগণ বুয়াসের দিন যুদ্ধ করেন কোন পূর্বাপর ধারণা ছাড়াই যে, ঐ দিন তাদের ইসলামের নিকটবর্তী করতে যাচ্ছে। বুয়াসের যুদ্ধ ছিল জাহেলিয়াতের যুদ্ধ, কিন্তু তা তাদের আল্লাহ্ তা‘আলার দিকে ধাবিত করছিল।
২য় উদাহরণ: আরেকটি উদাহরণ হল, যখন উমর বিন আল-খাত্তাব(রাঃ) পারস্য সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযানে বাহিনী প্রেরণ করেন, সেই মুসলিম বাহিনীর প্রধান সেনাপতি উবায়দা আস-সাকাফী(রাঃ) ছিলেন অত্যন্ত অকুতোভয় অসমসাহসী। তাঁর প্রয়োজনাতিরিক্ত ঝুঁকি নেয়ার দরুন আল-জিসরের যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী প্রায় হারতেই বসেছিল। সেদিন মুসলিম বাহিনীর অর্ধেক সদস্য শাহাদাত বরণ করেছিলেন। পারস্য সাম্রাজ্যেও সেসময় সবর্ণ সুযোগ ছিল মুসলিম বাহিনীকে পুরোপুরি ঘায়েল করার; তারা মনে করেছিল, পালের হাওয়া তাদের দিকেই বইছে। মুসলিমরা এ যাবত পারস্যের যত ভূমি দখল করেছিল, সবই তারা ফিরে পেতে যাচ্ছে।
“আত-তারিখ আল-ইসলামী” এর গ্রন্থকার মাহমুদ শাকির বলেন, “কিন্তু আল্লাহ্ মু’মিনগণের সাথেই আছেন।” যদি মু’মিনগণ বিজয়ের শর্ত পূরণ করে, যে কোন ভাবে হোক তারা বিজয় লাভ করবেই। সংখ্যা কিংবা নিউক্লিয়ার বোমা থাকা এক্ষেত্রে কোন নির্ধারক বা শর্ত নয়। ঈমানের শর্ত পূরণ হলে আল্লাহ্ বিজয় দান করবেন। যেহেতু আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন,
إِنَّ اللَّهَ يُدَافِعُ عَنِ الَّذِينَ آَمَنُوا إِنَّ اللَّهَ لا يُحِبُّ كُلَّ خَوَّانٍ كَفُورٍ
“নিশ্চয়ই আল্লাহ্ মু’মিনদেরকে রক্ষা করবেন …”
“নিশ্চয়ই আল্লাহ্ মু’মিনদেরকে রক্ষা করবেন …”
যাদের অধিক সমরাস্ত্র বা অধিক সৈন্য সামন্ত রয়েছে এর মানে এই নয় যে আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের অভিভাবক বরং তিনি তাদের অভিভাবক যাদের পূর্ণ ও দৃঢ় ঈমান আছে। আপাত দৃষ্টিতে মুসলিমরা পরাজয় বরণের সম্মুখীন হলেও আল্লাহ্ তা‘আলা নির্ধারিত পরিণামের উপায় বা মাধ্যম সৃষ্টি করে দিলেন। মুসলিমদেরকে বিপদ থেকে কেবল আল্লাহ্ই উদ্ধার করেন। পারস্যের রাজধানীতে দুই প্রধান নেতৃত্ব পরস্পর বিবাদে জড়িয়ে পড়ে, রুস্তম প্রায় অর্ধেক সৈন্য সহ এক পক্ষে বিভক্ত হয়ে পড়ে, আর অন্য পক্ষে বাকি অর্ধেক সৈন্য। মুসলিম বাহিনীর বিরুদ্ধে নিযুক্ত জেনারেলকে রাজধানীতে বিবাদ মেটানোর জন্য তলব করা হয়। মুসলিমদের যেখানে পুরাদস্তুর পরাজয় ও নিশ্চিহ্ন হওয়ার উপক্রম হয়েছিল, শত্রুপক্ষ চলে যাওয়ায় একাকী তারা সেখানে অপেক্ষা করতে লাগল, ইত্যবসরে খলিফা শক্তি সঞ্চার ও পূর্ণ উদ্যমে আক্রমণ পরিচালনা করার সুযোগ পেলেন। শত্রুপক্ষের মাঝে বিবাদ ঠিক সময় মতই ঘটেছিল কারণ আল্লাহ্ তা‘আলা চেয়েছিলেন এই জমিন ইসলামের জন্য উন্মুক্ত হোক। যদিও একসময় মনে হয়েছিল যুদ্ধের ফলাফল মুসলিমদের প্রতিকূলে, আল্লাহ্ তা‘আলা শেষ পর্যন্ত তাদের বিজয়ী করলেন।
আরও পড়ুন
Comment