আত্–তিবয়ান পাবলিকেশন্স
কর্তৃক প্রকাশিত
আল্লাহ্ আমাদের বিজয়ের জন্য প্রস্তুত করছেন
ইমাম আনওয়ার আল-আওলাকি (রহিমাহুল্লাহ)
এর থেকে
পর্ব : ৬ষ্ঠ
==================================================
===============================
(৫) ফিতনার চরম মাত্রা অনুধাবন করা
ফিতনা কতখানি ভয়াবহ হবে তার কতিপয় নমুনা বা ইঙ্গিত হল:-
প্রথম ইঙ্গিত: রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন ‘আল-মালহামা’য় রোমানদের মোকাবিলা করবে যে মুসলিম বাহিনী তার এক-তৃতীয়াংশ পিছু হটে যাবে। মনে রাখা প্রয়োজন যে, কেবল শ্রেষ্ঠ মু’মনিগণ এই যুদ্ধে যাবে তা সত্ত্বেও এক-তৃতীয়াংশ রণে ভঙ্গ দিবে। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন যে আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের মৃত্যু পর্যন্ত তওবাহ্ কবুল করবেন না। তারা মু’মিন ছিলেন ও আল্লাহ্র রাহে বের হয়ে ছিলেন, তারা মুজাহিদ ছিলেন ও সামনের কাতারে শামিল ছিলেন, এর পরও পৃষ্ঠপ্রদর্শন করায় আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের তওবাহ্ কবুল করবেন না। সে সময় ফিতনা এমনই কঠিন ও ভয়াবহ হবে।
ফিতনা থেকে নিরাপদে থাকার জন্য ঈমানে দৃঢ় ও বলীয়ান হতে হবে। ঈমানের সাথে সেসময় টিকে থাকা হবে জনমানবহীন শূন্য মরুপ্রান্তর অতিক্রম করার মতই দুঃসাধ্য। রসদ যদি পর্যাপ্ত না হয়, সওয়ারী যান নষ্ট হয়ে যায় আর গন্তব্যে পৌঁছানো না যায় তবে মৃত্যু অনিবার্য। ঈমানে একজনকে শতভাগ বলীয়ান হতে হবে। তিরিশ, পঞ্চাশ বা আশিভাগ ঈমানে ব্যতিক্রম কিছু ঘটবে না, শতভাগ ঈমান না হলে মৃত্যু অবধারিত। অর্ধপূর্ণ পাত্র হল খালি পাত্রেরই নামান্তর; পরিপূর্ণ মাত্রায় ঈমানে বলীয়ান হয়ে প্রয়োজনীয় মুহূর্তের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে, কারণ তা বিশেষ মর্যাদা সম্পন্ন এক বিশেষ মুর্হূত, সেই সময়ের পুরস্কার হবে অন্য যেকোন সময়ের তুলনায় বহু গুণ বেশি। ঈমানে দৃঢ় ও বলিষ্ঠ যারা কেবল তারাই সে সৌভাগ্য অর্জন করবে। সেই সময় পর্যন্ত জীবিত থাকলে আল্লাহ্ তা‘আলা যেন আমাদের সেই সৌভাগ্যবান হওয়ার তৌফিক দান করেন। আমীন।
দ্বিতীয় ইঙ্গিতঃ আমরা যে সেই সময়ের দিকে এগিয়ে চলেছি তার আরেক নমুনা বা ইঙ্গিত হচ্ছে, পাশ্চাত্যে মৌলবাদের উত্থান এবং রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণী বিষয়াবলীতে ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব।
’দ্যা নিউজ উইক’ পত্রিকা “বুশ এ্যান্ড গড” শিরোনামে একটি আর্টিকেল প্রকাশ করে যেখানে ইউরোপীয় বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে বলা হয়, “আমেরিকান পররাষ্ট্রনীতিতে বিভিন্ন চলক ও লক্ষ্য নির্ধারণী গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের একটি হল ধর্ম। কিন্তু তারা বলেন যে আমেরিকান ইতিহাসে এই প্রথমবারের মত মনে হচ্ছে পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে ধর্মীয় প্রসঙ্গ মূখ্য ভূমকিা পালন করছে। বুশ একবার মাহমুদ আব্বাসকে বলেছিল, “ঈশ্বর আমাকে আফগানিস্তানে যেতে বলেছে” তাহলে কংগ্রেস বা আমেরিকান জনগণ বা সংবিধান নয়; আফগানিস্তানে অভিযানের কারণ ছিল “ঈশ্বরের আদেশ”!
ডেনমার্ক-ইউরোপের অন্যতম ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, যেখানে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে আক্রমণ করে ব্যাঙ্গাত্মক ও শ্লেষর্পূণ কার্টুন ছাপানো শুরু হয়। কেউ কখনও ভাবেনি যে, ডেনমাকের্র মত ছোট্ট একটি রাষ্ট্র এমন একটি বিষয় তৈরী করবে, যার ফলশ্রুতিতে ঐ ঘটনার উপর ভিত্তি করে পাশ্চাত্য রাষ্ট্রসমূহ মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হবে। পাশ্চাত্য বিশ্ব রাষ্ট্রীয়ভাবে ডেনমার্ককে সমর্থন করেছে। পশ্চিমা জনগোষ্ঠীও ডেনমার্কের পাশে এসে দাঁড়ায় যার জ্বলন্ত উদাহরণ হল, সুইডিশ পররাষ্টমন্ত্রীর পদত্যাগ। তার নির্দেশে ব্যাঙ্গাত্মক কার্টুন ছবি সম্পন্ন ওয়েবসাইট বন্ধ করে দেয়ায়, সে জনরোষের মুখে পড়ে এবং পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। তাহলে পশ্চিমা জগত মুসলিমদের সাথে আচরণের ক্ষেত্রে ক্রমশই মৌলবাদের দিকে এগিয়ে চলেছে; এমন নয় যে ওরা হঠাৎ করে খুব ধার্মিক হয়ে গেছে – বরং ওদের কোন ধর্মের বালাই নাই, বর্তমান বাইবেলের শিক্ষা হতে ওরা বহু দূরে, কিন্তু মুসলিমদের বিরোধিতার প্রশ্নে ওরা ধমের্র আশ্রয় নিচ্ছে।
তৃতীয় ইঙ্গিতঃ খ্রীস্টান ধর্মীয় নেতাদের প্রায়ই জিঘাংসামূলক মন্তব্য করতে শোনা যায়, উদাহরণস্বরূপ – বিখ্যাত মার্কিন খৃষ্ট ধর্ম প্রচারক বিলি গ্রাহামের পুত্র ফ্রাংকলিন গ্রাহাম রূঢ় ভাষায় বলে যে, “ইসলাম হল শয়তানের ধর্ম।” প্যাট রবার্টসন মুসলমিদের ইয়াজুজ মাজুজের সাথে তুলনা করে।
এ ধরনের মন্তব্য বর্তমানে বেড়েই চলেছে যা ইঙ্গিত প্রদান করে যে, আমরা আল-মালহামা-র নিকটবর্তী হচ্ছি, কেননা মানসিকভাবে প্রয়োজনীয় স্বাতন্ত্র্য ও বিদ্বেষভাব প্রকটভাবে বিরাজ করছে। যেকোন যুদ্ধ; ময়দানের পূর্বে মন-মগজে প্রথম আলোড়ন জাগায়। মন-মানসিকতায় প্রথমে তোলপাড় শুরু হয়, পাশ্চাত্যে সেই প্রক্রিয়া এখন চলছে।
চতুর্থ ইঙ্গিতঃ আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে খিলাফাহ্ প্রদানের পূর্বে মুসলিম উম্মাহ্কে বিভিন্ন স্তর বা ধাপ অতিক্রম করতে হবে, ব্যাপারটি ট্রেনে ভ্রমণের মত যেখানে পর্যায়ক্রমে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়… স্টেশন অতিক্রম করতে হয়, উম্মতকেও ধাপে ধাপে কয়েকটি স্টেশন পার হতে হবে যার একটি হল – ‘আল-ইবতিলা’ (ঈমানের পরীক্ষা)।
আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন,
أَمْ حَسِبْتُمْ أَنْ تُتْرَكُوا وَلَمَّا يَعْلَمِ اللَّهُ الَّذِينَ جَاهَدُوا مِنْكُمْ وَلَمْ يَتَّخِذُوا مِنْ دُونِ اللَّهِ وَلا رَسُولِهِ وَلا الْمُؤْمِنِينَ وَلِيجَةً وَاللَّهُ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ
“তোমরা কি মনে কর যে, তোমাদের ছেড়ে দেয়া হবে এমনি, যতক্ষণ না আল্লাহ্ জেনে নেবেন তোমাদের মাঝে কে (আল্লাহ্র পথে) যুদ্ধ করেছে এবং কে আল্লাহ্, তাঁর রাসূল ও মুসলমানদের ব্যতীত অন্য কাউকে অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করা থেকে বিরত রয়েছে।”
সুতরাং জান্নাতে যাওয়ার এবং দুনিয়ার বুকে প্রতিষ্ঠা লাভের পূর্বে যে দু’টি স্টেশন বা ঘাঁটি অতিক্রম করতে হবে তা হলঃ জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ্ এবং আল-ওয়ালা ওয়াল- বারা। এই দু’টি বিষয়ে সঠিক বুঝ না থাকলে দুনিয়ার বুকে প্রতিষ্ঠা লাভ করা সম্ভব নয়। উম্মতকে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করতে হবে আর স্পষ্টরূপে ফুটিয়ে তুলতে হবে যে, তাদের ওয়ালা তথা ভালবাসা ও আনুগত্য আল্লাহ্, তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও মু’মিনগণের প্রতি আর শয়তান ও অবিশ্বাসীদের সাথে সংশ্লিষ্ট না থাকা ও তাদের হতে দূরত্ব বজায় রাখা।
কতিপয় আলেম, কিছু ইসলামী সংগঠন ও সাধারণ মুসলিমদের মধ্য হতেও অনেকে উক্ত দু’টি বিষয়কে বিচ্যুত করতে চায়, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত ‘তামকীন’ বা শক্তি অর্জন করতে হলে এ দু’টি বিষয় কোনভাবে উপেক্ষা করার নয়, আল্লাহ্ তা‘আলা এই উম্মতকে এখন পরীক্ষা করছেন। আমাদের এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে যেখানে আমাদের ঈমান অথবা কুফরীর মাঝে একটিকে বেছে নিতে হচ্ছে। এ সিদ্ধান্ত মূলত সেই পরীক্ষার একটি অংশ যা সমাজের উচ্চস্তর হতে নিম্নস্তর পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রথমে রাজা-বাদশাহ্, প্রেসিডেন্ট ও আলেম উলামা হতে শুরু করে সাধারণ জনগণ সকলের উপরই পরীক্ষা চলছে। রাজা-বাদশাহ্ ও প্রেসিডেন্টদের পরীক্ষা প্রায় শেষ, ওরা কুফরীকেই বাছাই করে নিয়েছে; আল্লাহ্ই ভাল জানেন, আমার মনে হয় তাদের পরীক্ষার ফলাফল বা সম্ভাব্য পরিণতি সর্বজনবিদিত। এখন আলেমগণের কঠিন পরীক্ষা চলছে – ‘হয় তোমরা আমাদের পক্ষে, না হয় আমাদের বিপক্ষে’- এমন মন্তব্য দ্বারা বুশ তাদের মহা ফিৎনায় ফেলেছে। এবং সে বিভিন্ন দেশের রাজা-বাদশাহ্ ও প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত করছে যারা পুলিশ অফিসার সদৃশ ওর প্রতিনিধিত্ব করছে। বুশের স্বার্থে ও সেবায় ওরা সূচারু রূপে দায়িত্ব পালন করে যায়।
‘হয় তুমি আমাদের পক্ষে, না হয় বিপক্ষে’; এখন যে কোন একটি সিদ্ধান্ত নিতে হবে- একই সাথে দু’পক্ষে সহাবস্থান করা সম্ভব নয়। আজ থেকে দশ বছর পূর্বে কেউ চাইলে জিহাদের উপর খুৎবা দেয়ার পর বাদশাহর ভোজ সভায় শরীক হতে পারত; কিন্তু এখন দ্বৈত ভূমকিা পালন করা অসম্ভব। কার কোন পক্ষে অবস্থান তা পরিষ্কার হতে হবে। মাঝের ভেদ-রেখা সুস্পষ্ট হয়ে দু’পক্ষ ক্রমশ পরস্পর হতে পৃথক হয়ে যাবে। এ কারণে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, এই পরীক্ষা ততক্ষণ পর্যন্ত চলবে, যতক্ষণ না মানুষ দুই শিবিরে সম্পূর্ণ বিভক্ত হয়ে পড়বে। একটি শিবির হবে পূর্ণাঙ্গ মু’মিনদের যেখানে কোন মুনাফিক থাকবে না আর অপর শিবিরটি কুফরীপূর্ণ, ঈমান নিশ্চিহ্ন।
বর্তমানে ঈমান-কুফর একত্রে মিশে রয়েছে; যতক্ষণ না এই মিশ্রণ বিদূরিত হয়ে স্বাতন্ত্র্য আসবে, ততক্ষণ উম্মতের বিজয় অর্জন হবে না। সাইয়্যিদ কুতুব (রহ.) তার তাফসীর ফী যিলালিল কুর’আনে বলেন, “আল্লাহ্ তা‘আলা ততক্ষণ দুনিয়ার বুকে কাউকে প্রতিষ্ঠা দান করেন না, যতক্ষণ পর্যন্ত স্পষ্টভাবে জেনে নেন যে, কে তাঁর পক্ষে আর কে তাঁর বিপক্ষে।”
এটা সম্ভব হবে না যতক্ষণ না উম্মাহ্ মিশ্রিত অবস্থায় থাকবে। এখন এই উম্মাহ্ প্রয়োজন, মু’মিন এবং মুনাফিক – এ দু’টি শিবিরকে বিভক্ত করে দেয়া।আল্লাহ্ তা‘আলা বুশের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে পরীক্ষা করছেন। বুশ এবং মুজাহিদরা ভিন্ন ভিন্ন দিক থেকে সাধারণ মানুষকে পরীক্ষায় ফেলছে এবং তাদের মতাদর্শ গ্রহণে জনগণকে আকৃষ্ট করছে। আর এ কারণেই আমেরিকানরা একে বলে থাকে- “The battle of mind & heart” (স্নায়ু যদ্ধু)। তবে বাস্তবিক এটা হক্ব ও বাতিলের মধ্যে লড়াই।
وَمَنْ يَتَوَلَّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَالَّذِينَ آَمَنُوا فَإِنَّ حِزْبَ اللَّهِ هُمُ الْغَالِبُونَ
“আর যারা আল্লাহ্, তাঁর রাসূল এবং মু’মিনদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করে, তারাই আল্লাহ্র দল এবং তারাই বিজয়ী।“
সুতরাং আল্লাহ্র অনুসারীগণ ততক্ষণ বিজয়ী হতে পারবে না যতক্ষণ না আল-ওয়ালা-র ব্যাপারটি স্পষ্ট হয় -মু’মিনদের প্রতি ওয়ালা।
সংক্ষেপে পিছনের আলোচনায় ফিরে তাকাই, আল্লাহ্ তা‘আলা কোন পরিণতি চাইলে তিনি তার প্রয়োজনীয় ক্ষেত্র তৈরী করবেন। আমরা এই মূলনীতি প্রমাণের জন্য তিনটি ঐতিহাসিক ঘটনা উল্লেখ করেছিঃ বু’য়াস, পারস্য জয় এবং সালাহ্ উদ্দিন আইয়্যুবীর (রহ.) দৃষ্টান্ত।
আমরা আরও আলোচনায় এনেছিঃ
১) ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে
২) আল্লাহ্ কিছু নির্দিষ্ট অঞ্চল (ইসলামের পুনর্জাগরণের জন্য) প্রস্তুত করছেন।
৩) পাশ্চাত্যে মৌলবাদের উত্থান।
৪) উম্মতকে অবশ্যই প্রতিষ্ঠা লাভ করতে হলে দু’টি ঘাঁটি অতিক্রম করতে হবে।
আরও পড়ুন
Comment