আত্–তিবয়ান পাবলিকেশন্স
কর্তৃক প্রকাশিত
আল্লাহ্ আমাদের বিজয়ের জন্য প্রস্তুত করছেন
ইমাম আনওয়ার আল-আওলাকি (রহিমাহুল্লাহ)
এর থেকে
শেষ পর্ব
==================================================
===============================
আমরা সবাই আমাদের সমস্যার কথা স্বীকার করি। সকলেই বলে থাকি যে, উম্মাহ্ সমস্যায় জর্জরিত কিন্তু সমাধানের ক্ষেত্রে আমরা ভিন্নমত পোষণ করি। আমাদের সামনে কুর’আন ও সুন্নাহ্ থাকায় ভিন্নমত পোষণ করা আদৌ সমীচীন নয়। কুর’আন এবং সুন্নাহ-তে সমাধান পাওয়া গেলে ভিন্নমতের কোন অবকাশ নেই। তাহলে আমাদের সমস্যার সমাধান কি? এর সমাধান নিম্নোক্ত হাদীস থেকে পাওয়া যাবে। রাসূল (সাঃ) বলেনঃ
“যখন তোমরা ব্যাবসা-বাণিজ্যে ডুবে যাবে, গরুর লেজের পিছনে পড়ে থাকবে, কৃষিকার্য নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবে আর আল্লাহ্র পথে জিহাদ পরিত্যাগ করবে, আল্লাহ্তা‘আলা তোমাদের উপর দুর্দশা আপতিত করবেন এবং ততক্ষণ পর্যন্ত তা তুলে নেয়াহবে না যতক্ষণ না তোমরা তোমাদের প্রকৃত দ্বীন (অর্থাৎ ইসলামে) ফিরে আসবে।” [২৮]
এই হাদিস হতে আমাদের সমস্যা ও সম্ভব্য সমাধান জানা যাচ্ছে। মজার ব্যাপার হল, হাদিসে যে সব সমস্যার কথা বলা হয়েছে, কতিপয় মুসলিম তাই সমাধানের উপায় বলে দাবি করছেন। তাহলে সমস্যা কোথায়? রাসূল (সাঃ) স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, যখন তোমরা ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষিকর্ম, পশু-সম্পদের পিছনে ব্যস্ত হয়ে পড়বে এবং আল্লাহ্র পথে জিহাদ ত্যাগ করবে, তখন তোমরা নিগৃহীত হবে।
কতিপয় মুসলিম দাবী করে যে, যদি আমরা অন্যান্য জাতির ন্যায় কৃষি, শিল্প, বাণিজ্যসহ সকল ক্ষেত্রে ব্যাপক সমৃদ্ধি অর্জন করে ওদের সমকক্ষতা লাভ করতে পারি কেবল তখন উম্মতের বিজয় অর্জন হবে। সুতরাং আমরা যদি কৃষিতে সফল হই, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য ও প্রযুক্তিসহ সকল ক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করি এবং তাই উম্মতের সামনে সমাধানের খোলা পথ। কিন্তু রাসূল (সাঃ) সবগুলোকেই সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত করেন।
কতিপয় মুসলিম বলে থাকে যে, উম্মতকে সন্ত্রাসের পথ পরিহার করে ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি, প্রযুক্তিসহ সকল ক্ষেত্রে উন্নয়নের দিকে মনোযোগী হওয়া উচিত। কেবল এভাবেই পৃথিবীর অন্য সকল দেশের সাথে পাল্লা দিয়ে সমান তালে চলা সম্ভব। রাসূল (সাঃ) বলেন সেরকম করা ভুল আর আমরা ভুল করলে আল্লাহ্ তা‘আলা আমাদের অপমান করবেন। রাসূল (সাঃ) একথাও বলেছেন যে, এ সংকট উত্তরণের একমাত্র পথ – প্রকৃত দ্বীনে ফিরে যাওয়া। এ হাদিসের ভাষ্যকারগণ বলেন, ‘দ্বীনে ফিরে যাওয়া’ অর্থ হল জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহয় প্রত্যাবর্তন করা, কেননা রাসূল (সাঃ) জিহাদ ছেড়ে দেয়াকে দ্বীন পরিত্যাগের কারণ বলেছেন, তাহলে জিহাদ ও দ্বীন পরস্পর সমার্থক। সুতরাং উম্মাহর জন্য সমস্যার বাস্তব সম্মত একমাত্র সমাধান হল জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ-তে ফিরে যাওয়া।
ইবনে রজব আল-হাম্বলী (রহ.) একজন সালাফের কথা উল্লেখ করেন যাকে বলা হয়েছিল, “আপনি কেন নিজের ও আপনার পরিবারের জন্য একটি খামারের ব্যবস্থা করে নিচ্ছেন না?” তিনি জবাবে বলেছিলেন, “আল্লাহ্ তা‘আলা আমাকে পাঠিয়েছেন কৃষকদের হত্যা করে তাদের খামার নিয়ে নিতে।”
যখন উমার ইবন আল-খাত্তাব (রাঃ) শুনলেন যে, সাহাবীগণ জর্ডানে গণিমত হতে প্রাপ্ত উর্বর জমি কর্ষণে ব্যস্ত, শস্য ঘরে তোলার ভরা মৌসুম পর্যন্ত তিনি অপেক্ষা করলেন, তারপর সমস্ত ক্ষেত-খামার আগুনে পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দিলেন। কতিপয় সাহাবা অভিযোগ করতে আসলে তিনি বললেন, “এধরনের কাজ আহলে কিতাবগণ করে, তোমাদের কাজ হল আল্লাহ্র পথে জিহাদ করা এবং তাঁর দ্বীনকে প্রচার করা।” [২৯]
ক্ষেত-খামার ও কৃষিকার্য আহলে কিতাবগণের উপর ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর দ্বীন প্রচারের উদ্দেশ্যে বের হয়ে যাও; ওরা কৃষিকার্য করে তোমাদের খাওয়াবে; তারা তোমাদের জিযিয়া[৩০] ও খারাজ[৩১] প্রদান করবে।
রাসূল (সাঃ) বলেন, “আমার রিযিক আসে আমার বর্শার ছায়াতল হতে।” [৩২]
তাহলে রাসূল (সাঃ) এর রিযক যদি গণিমত হতে আসে তবে নিঃসন্দেহে তা সর্বশ্রেষ্ঠ রিযিক এবং ক্ষেত-খামার, ব্যবসা-বাণিজ্য, পশু-পালন – যেকোনো প্রকার উপার্জনের চেয়ে তা উত্তম।
ইরাকের ইসলামী আর্মি “আল-জাইশ আল-ইসলামী ফিল ইরাক” এর মুখপাত্রকে এক সাক্ষাৎকারে প্রশ্ন করা হয়, “আপনাদের অর্থনীতির উৎস কি?” জবাবে তিনি বলেন, “আমাদের অর্থনৈতিক উৎস গণিমতের মাল, তবে মুসলিমরা আমাদের কিছু অনুদান করতে চাইলে আমরা আপত্তি করি না।” তারা কারো মুখাপেক্ষী হতে চায় না। গণিমত দ্বারা তারা তাদের আল্লাহ্র পথে জিহাদে অর্থের যোগান দিতে চায়। তাহলে উম্মতের জন্য সমস্যার সুরাহা হচ্ছে জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ্। উম্মাহ যখন এই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতকে পুনর্জাগ্রত করে তখন জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ্ অনেকের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। মানুষ জিহাদ হতে দৌড়ে পালায়, কারণ এতে তাদের জীবন ও ধন- সম্পদ খোয়ানোর আশঙ্কা থাকে। কিন্তু মজার বিষয় হল, উম্মাহ যখন জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহর উপর থাকে উম্মতের তখন সবচেয়ে সচ্ছল অবস্থা বিরাজ করে এবং সবচেয়ে কমসংখ্যক লোক নিহত হয়।
মৃত্যুহারের একটি গ্রাফ চিত্র অঙ্কন করলে দেখা যাবে, সবচেয়ে কম সংখ্যক মুসলিম মারা গিয়েছিল যখন তারা জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহর উপর ছিল। আর উম্মাহ যখন তা ত্যাগ করে তখন মৃত্যুহার লক্ষাধিকে পৌঁছায়। অর্থনৈতিক অবস্থার গ্রাফচিত্র অঙ্কন করলে দেখা যাবে, উম্মাহ সবচেয়ে সচ্ছল ছিল, যখন তারা জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহর উপর ছিল আর তা ত্যাগ করার পর অর্থনৈতিক ভাবে তারা সবচেয়ে দুর্দশাগ্রস্ত হয়।
মানবতার ইতিহাসে ইসলামী রাষ্ট্র ব্যতিক্রমধর্মী। কেবল ইসলামী রাষ্ট্র তার জনগণের উপর কর আরোপ করে না। কিন্তু কেন? কারণ ইসলামী রাষ্ট্রের আয়ের উৎস হচ্ছে জিযিয়া, খারাজ, গণিমতের মাল এবং ফাঈ,[৩৩] সে কারণে ইসলামী রাষ্ট্রের জনগণের উপর কোন কর আরোপ করতে হয় না। কিন্তু বর্তমানে মুসলিম উম্মাহ জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ্ ত্যাগ করায় মুসলিম জনগণের উপর কর আরোপিত হচ্ছে। রাসূল (সাঃ) বলেন, “কর হারাম এবং যে ব্যক্তি করের সাথে সংশ্লিষ্ট কোন কাজে বা পেশায় নিয়োজিত হবে সে অভিশপ্ত।”
অতএব, সমাধান আসলে দুর্বোধ্য জটিল গুঢ়তত্ত্ব বা অসম্ভব কিছু নয় বরং সহজ সরল। মানুষের উচিত আড়মোড়া ভেঙ্গে জেগে ওঠা এবং এই একটি হাদিসের অর্থ অনুধাবন করে তদনুযায়ী আমল করা।
[২৮] আব্দুল্লাহ্ ইবন উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। সুনান আবু দাঊদ, অধ্যায়- ২৩, হাদিস নং ৩৪৫৫; সহীহ আল-জামী‘, হাদিস নং- ৬৮৮; আহমদ, হাদিস নং ৪৮২৫ এবং আবু উমাইয়া আত-তারুসী হতে মুসনাদ ইবনে উমার, হাদিস নং- ২২।
[২৯] সুবহানাল্লাহ! এ রকম একটি ঘটনা হল: আবু ইমরান বলেন, আবু আইয়্যুব হতে বর্ণিত: “আমরা মদিনা হতে কনস্টান্টিনোপল অভিযানের নিয়তে বের হলাম। আব্দুর রহমান বিন খালিদ বিন ওয়ালিদ ছিলেন আমাদের দলনেতা, রোমানগণ শহরের প্রাচীরে সারিবদ্ধভাবে প্রতিরোধের জন্য প্রস্তুত হয়েছিল। জনৈক মুসলিম সহসা শত্রুদের উপর হামলা চালাল। তখন অন্যান্য মুসলিমগণ বলে উঠল: থাম! থাম! আল্লাহ্ ব্যতীত কোন ইলাহ্ নেই। সে তো নিজেকে ধ্বংসের মুখে ফেলছে। আবু আইয়্যুব আল-আনসারী (রাঃ) বলেন,
وَأَنْفِقُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَلا تُلْقُوا بِأَيْدِيكُمْ إِلَى التَّهْلُكَةِ وَأَحْسِنُوا إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ
‘আর ব্যয় কর আল্লাহ্র পথে, তবে নিজের জীবনকে ধ্বংসের সম্মুখীন করো না। আর মানুষের প্রতি অনুগ্রহ কর। আল্লাহ্ অনুগ্রহকারীদেরকে ভালবাসেন।’[সূরা আল-বাকারাহঃ ১৯৫]
এই আয়াত আমাদের অর্থাৎ আনসারদের সম্পর্কে নাযিল হয়েছিল। যখন আল্লাহ্ তাঁর রাসলূ কে ﻭﺳﻠﻢ ﻋﻠﻴﻪ ﺍﷲ ﺻﻠﻰ সাহায্য করলেন, ইসলামকে বিজয় দান করলেন, আর আমরা বললাম এবার তাহলে আমরা জায়গা-জমিতে ফিরে যাই এবং সেগুলোর উন্নতি সাধন করি, তখন আল্লাহ্ উক্ত আয়াত নাযিল করেন।” আসলে যে জিহাদে ঝাঁপিয়ে পড়ে সে নিজেকে বিপদে ফেলে না বরং যে বসত-বাড়ি, ধন-সম্পদের মোহে পড়ে থাকে, সেগুলো উৎকর্ষ সাধনে ব্যস্ত হয়ে জিহাদ পরিহার করে, সেই নিজেকে বিপদে ফেলে। আবু ইমরান বলেন: আবু আইয়্যুব আমৃত্যু জিহাদ অব্যাহত রাখেন, শাহাদাহ্ লাভের পর কনস্টান্টিনোপলে তাঁকে দাফন করা হয়। (সুনান আবু দাঊদ, গ্রন্থ- ১৪, হাদিস নং- ২৫০৬)
[৩০] খিলাফতের বশ্যতা স্বীকার করে কাফিররা যে কর প্রদান করে।
[৩১] কাফিররা যে ভূমিকর খলিফাকে প্রদান করে।
[৩২] আহমাদ, আত-তাবারানী, সহীহ হিসেবে গণ্য, সহীহ আল-জামী‘ আস-সাগীর, হাদিস নং- ২৮২৮।
[৩৩] যুদ্ধ ছাড়া কাফিরদের কাছ থেকে যা অর্জিত হয় – যেমন মুসলিমদের ভয়ে কাফিররা তাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি রেখে পালাল, কিংবা তারা যুদ্ধ ব্যতীত আত্মসমর্পণ করল অথবা তারা জিযিয়া প্রদান করল, ইত্যাদি। ফাঈ-এর বণ্টন ইমামের নির্দেশানুযায়ী হবে।
আরও পড়ুন
৬ষ্ঠ পর্ব
Comment