১৫ আমান ও যুদ্ধ-বিরতি চুক্তি (০৪) মুরতাদদের সাথে যুদ্ধ-বিরতি চুক্তি
মতন: والمرتدّين بلا مالٍ، فإن أخذ لم يردّ. – মুরতাদদের সাথে কোনো অর্থ-সম্পদ গ্রহণ ব্যতীত চুক্তি করতে পারবো। তবে গ্রহণ করা হলে ফিরিয়ে দেওয়া হবে না। শরাহ: ইমামুল মুসলিমিন যদি মুরতাদদের সাথে চুক্তি করার মাঝে ইসলাম ও মুসলিমদের মাসলাহাত বিদ্যমান মনে করেন তাহলে চুক্তি করতে পারবেন। যেমন:
ক. হতে পারে মুরতাদরা এমন সংঘবদ্ধ ও শক্তিশালী যে, এ মূহুর্তে তাদের বিরুদ্ধে কিতাল করে পেরে উঠা যাবে না।
খ. কিংবা হতে পারে কিতাল না করে কিছুদিন সময় দিলে মুরতাদরা আবারও ইসলাম নিয়ে ভাববে, তাদের সংশয় দূর হয়ে যাবে, নতুন করে মুসলমান হয়ে যাবে। বিশেষত তারা নিজেরাই যদি সময় দেয়ার আবেদন করে। কাফেরের বিরুদ্ধে কিতালের দ্বারা দ্বীনে ইসলামের প্রসারই উদ্দেশ্য। যখন তারা কিতাল ব্যতীত মুসলমান হয়ে যাওয়ার আশা আছে, তখন কিছুদিন সময় দিতে সমস্যা কোথায়।[1]
তবে এই চুক্তির বিনিময়ে তাদের থেকে কোনো অর্থ-সম্পদ গ্রহণ করবে না। কেননা, চুক্তির বিনিময়ে কাফেরদের থেকে যে অর্থ-সম্পদ গ্রহণ করা হয় তা এক রকম জিযিয়ার মতোই। যেসব কাফের থেকে জিযিয়া গ্রহণ করা যায়, চুক্তির বিনিময়ে অর্থও তাদের থেকেই গ্রহণ করা যাবে। মুরতাদদের থেকে জিযিয়া গ্রহণ করা যায় না তাই চুক্তির বিনিময়ে অর্থও গ্রহণ করা যাবে না।[2]
তবে গ্রহণ করে ফেললে ফিরিয়ে দিবে না। কারণ, মুরতাদরা হারবি, তাদের সম্পদ হারবি কাফেরের সম্পদের মতো মুবাহ। এ কারণে আমরা যদি তাদেরকে পরাস্ত করে তাদের সম্পদ দখল করি তাহলে তা গনিমতে পরিণত হবে। মুবাহ সম্পদ যখন তাদের সম্মতিতে আমাদের হাতে এসেছে, আমরা তার মালিক হয়ে গেছি, তাই ফিরিয়ে দিবো না।
পক্ষান্তরে বাগিদের থেকে চুক্তির বিনিময়ে অর্থ গ্রহণ করলে যুদ্ধ শেষে বাগিরা যখন ইমামুল মুসলিমিনের বশ্যতা স্বীকার করবে তাদের সম্পদ তাদেরকে ফিরিয়ে দিতে হবে। কারণ, তা মুসলিমের সম্পদ। আর মুসলিমের সম্পদ গনিমত হয় না। তবে যুদ্ধ চলাকালে ফিরিয়ে দিবে না। এ অবস্থায় ফিরিয়ে দিলে এ সম্পদকে তারা ইমামের বিরুদ্ধে ব্যবহার করবে, তাই তখন ফিরিয়ে না দিয়ে বশ্যতা স্বীকার করার পর ফিরিয়ে দিবে।[3]
সংশয় ও জওয়াব
মুরতাদের বিধান হচ্ছে তাওবা করে ইসলামে ফিরে আসতে আদেশ দেয়া, যে সংশয়ে পড়ে ইসলাম ত্যাগ করেছে তা দূর করার চেষ্টা করা। ফিরে না আসলে হত্যা করে ফেলা। কিন্তু এখানে চুক্তি করার বৈধতা দেয়া হচ্ছে! স্পষ্ট যে, চুক্তি করার অর্থ- হত্যা না করার নিশ্চয়তা দেয়া। মুরতাদকে হত্যা না করে এভাবে ছেড়ে রাখা কিভাবে বৈধ হয়?
উত্তর:
চুক্তির আলোচনাটি একক কোনো মুরতাদের ক্ষেত্রে নয়, সংঘবদ্ধ মুরতাদ গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে, যখন বড় একটা দল বা গোষ্ঠী মুরতাদ হয়ে দারুল ইসলামের একটা অংশ দখল করে ফেলে।[4] অবস্থা এমন পর্যায়ে গড়ায় যে, তাদের বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিক যুদ্ধ প্রয়োজন। একক ব্যক্তি মুরতাদ হলে তাকে ধরে জেলে বন্দী করে তার সংশয় দূর করার ব্যবস্থা করা সম্ভব এবং ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করা সম্ভব। গ্রহণ না করলে হত্যা করে দেয়া হবে। এ ধরনের মুরতাদকে বলা হয় ‘মাকদুর আলাইহি’ মুরতাদ। এদের বেলায় মুরতাদের স্বাভাবিক বিধান প্রযোজ্য। অর্থাৎ বন্দী করে সংশয় দূর করে ইসলাম গ্রহণ করানোর চেষ্টা করা হবে, গ্রহণ না করলে হত্যা করে দেয়া হবে।
পক্ষান্তরে মুরতাদ যখন একটা শক্তিধর সশস্ত্র তায়েফা হয় (‘তায়েফায়ে মুমতানিআ’) তাদের ক্ষেত্রে চুক্তির প্রসঙ্গটি প্রযোজ্য। এরা হারবি কাফেরদের হুকুমে। তবে হারবিদের সাথে এদের একটা পার্থক্য হলো, হারবিদের গোলাম বানানো যায় কিংবা জিযিয়ার শর্তে যিম্মি বানিয়ে রাখা যায়, মুরতাদের বেলায় এমন নয়। হয় মুসলমান হবে নয় হত্যা করে দেয়া হবে। হত্যা না করে গোলাম বা যিম্মি বানিয়ে রাখা যাবে না। তাদের সাথে চুক্তির বিষয়টি সাময়িক। ফিলহাল তাদের বিরুদ্ধে অভিযানের শক্তি নাই, কিংবা অভিযান পরিচালনা না করে কিছুদিন অবকাশ দেয়ার মাঝে মাসলাহাত বিদ্যমান। এ কারণেই চুক্তি করা হচ্ছে। আমরা যখন পূর্ণ প্রস্তুতি নিতে পারবো, কিংবা যখন মনে হবে আর বেশি অবকাশ দেয়ার দরকার নাই- আমরা অভিযান পরিচালনা করবো।
মুরতাদরা বন্দী হলে তখন মুরতাদের স্বাভাবিক বিধান প্রযোজ্য হবে। অর্থাৎ ইসলাম গ্রহণ করবে নইলে হত্যা করে দেয়া হবে। তবে পরাস্ত করে তাদের যে সম্পদ দখল করা হবে তা গনিমতে পরিণত হবে। এক্ষেত্রে ব্যক্তি মুরতাদের সাথে ব্যবধান হবে। একক ব্যক্তি মুরতাদ হলে তাকে যখন হত্যা করা হয় তার সম্পদ গনিমত হয় না, বরং তার মুসলিম উত্তরাধিকারিরা তা পায়। পক্ষান্তরে সংঘবদ্ধ মুরতাদ গোষ্ঠী দারুল ইসলামের এলাকা দখল করে নিলে তাদের সম্পদ হারবিদের সম্পদের মতো হয়ে যায়। মুজাহিদগণ এলাকা বিজয় করার দ্বারা তা গনিমতে পরিণত হয়।
তাহলে ব্যক্তি মুরতাদ ও দলগত মুরতাদের মধ্যকার পার্থক্য দাঁড়াচ্ছে:
ক. ব্যক্তি মুরতাদ যেহেতু ইমামের শক্তির আওতাধীন তাই তাকে পাকড়াও করে বন্দী করা হবে। মুসলমান হলে ভালো অন্যথায় হত্যা করে দেয়া হবে। তার সাথে চুক্তি করা নিষ্প্রয়োজন। তাকে হত্যা না করে ছেড়ে রাখা নাজায়েয।
পক্ষান্তরে দলগত মুরতাদকে যেহেতু স্বাভাবিকভাবে পাকড়াও করা সম্ভব নয় বরং যুদ্ধাভিযান প্রয়োজন, তাই তাদের সাথে মাসলাহাতের বিবেচনায় চুক্তি করে যুদ্ধ পিছানো জায়েয।
খ. ব্যক্তি মুরতাদকে হত্যা করার পর তার সম্পদ গনিমত হবে না, বরং তার মুসলিম উত্তরাধিকারিরা তা পাবে।
পক্ষান্তরে দলগত মুরতাদদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয় পরাস্ত করার পর তাদের সম্পদ হারবিদের সম্পদের ন্যায় গনিমতে পরিণত হবে। মুরতাদদের মুসলিম আত্মীয়রা তা পাবে না, বরং গনিমতের নিয়মানুযায়ী তা বণ্টন হবে।
সকল শর্তসহ এ ব্যাপারে বিস্তারিত বিধান ফিকহের কিতাবাদিতে দ্রষ্টব্য।
[1] وإذا غلب المرتدون على دار من دور المسلمين، فلا بأس بموادعتهم إذا خيفوا أو لم يؤمن غلبتهم. وكذلك إن كانت الموادعة أصلح في تدبير المسلمين. –شرح مختصر الكرخي للقدوري: 17\922
نصالح المرتدين حتى ننظر في أمورهم؛ لأن الإسلام مرجو منهم فجاز تأخير قتالهم طمعا في إسلامهم. -البحر الرائق شرح كنز الدقائق (5/ 86)
[2] তাদের থেকে চুক্তির বিনিময়ে অর্থ গ্রহণকে বিভিন্ন কিতাবে নাজায়েয বলা হয়েছে। যেমন
ক. ইমাম কুদুরি রহ. এর শারহু মুখতাসারিল কারখিতে কারখি রহ. এর বক্তব্য এসেছে-
وإن أخذ من المرتدين مال على الموادعة فإن ذلك لا يجوز. ولا ينبغي أن يوادع المرتدون على مال. –شرح مختصر الكرخي: 17\922، كتاب السير
খ. কানযের শরাহয় মোল্লা মিসকিন রহ. বলেন-
فإن أخذ منهم مالا مع أنه لا يجوز لا يرد إليهم. –شرح مسكين على الكنز (مخطوطة): 377
গ. গায়াতুল বায়ানে ইতকানি রহ. বলেন-
فلو وادعهم على المال لا يجوز، لأنه في معنى الجزية، فلا يجوز أخذ الجزية من أهل الردة. –عاية البيان: 8\248
[3] فتح القدير للكمال ابن الهمام (5/ 459) و) مع هذا (لو أخذه لا يرده) عليهم لأن مالهم فيء للمسلمين إذا ظهروا، بخلاف ما إذا أخذ من أهل البغي حيث يرد عليهم بعدما وضعت الحرب أوزارها لأنه ليس فيئا إلا أنه لا يرده حال الحرب لأنه إعانة لهم. اهـ
[4] وأطلق في جواز صلح المرتدين وهو مقيد بما إذا غلبوا على بلدة وصار دارهم دار الحرب وإلا فلا؛ لأن فيه تقرير المرتد على الردة وذلك لا يجوز ولذا قيده الفقيه أبو الليث بما ذكرنا كذا في الفتح. -البحر الرائق شرح كنز الدقائق (5/ 86)
قال الفقيه أبو الليث في " شرح الجامع الصغير ": هذا إذا غلبت المرتدون على مدينة وصارت دارهم دار الحرب. يدل على ما ذكره الفقيه وضع المسألة في مختصر الكرخي بقوله: غلب المرتدون على دار من دور الإسلام فلا بأس بموادعتهم عند الخوف. -البناية شرح الهداية (7/ 118)
Comment