জিহাদের জন্য ইমাম শর্ত না হওয়ার দলীল:
এক. কুরআন ও হাদীসের ব্যাপক দলীল:
কুরআন ও হাদীসে জিহাদের হুকুম ব্যাপকভাবে এসেছে; ইমামের সাথে শর্তযুক্ত করা হয়নি। তাই দলীলের ব্যাপকতার দাবী হচ্ছে, হুকুম ব্যাপক হওয়া। তাই উক্ত ব্যাপক দলীলের সমমানের শর্তযুক্ত দলীল পাওয়া না গেলে জিহাদের ফরযিয়াতের বিধানও ব্যাপক থাকবে।
আমরা এখানে “উক্ত দলীলের সমমানের দলীল” হতে হবে- এমন শর্ত আরোপ করার কারণ হচ্ছে, হানাফী উসূলবিদদের মতে ব্যাপক দলীলকে শর্তযুক্ত করা মূলত ব্যাপক দলীলের ব্যাপকতাকে রহিত করার সমতুল্য।[1] আর কোন দলীলকে রহিত করার জন্য উক্ত দলীলের সমমানের দলীল হওয়া আবশ্যক; এরচেয়ে দুর্বল দলীল দ্বারা রহিত করা জায়েয নয়।[2]
উক্ত দুই উসূলের সমষ্টি থেকে উসূলবিদগণ আরেকটি উসূল বের করেন যে, ‘অকাট্যভাবে প্রমাণীত ব্যাপক কোন দলীলকে দুর্বলভাবে প্রমাণীত দলীল দ্বারা শর্তযুক্ত করা যাবে না’।[3]
তাই জিহাদ ফরয ও সহীহ হওয়ার ব্যাপারে কুরআন ও হাদীসের অকাট্য দলীলসমূহ ব্যাপকভাবে এসেছে, তাই উক্ত দলীলসমূহকে ইমাম থাকার সাথে শর্তযুক্ত করার জন্য অকাট্য দলীল লাগবে। যতক্ষণ উক্ত দলীল পাওয়া না যাবে ততক্ষণ ব্যাপকতার মূল দাবী হিসেবে জিহাদের জন্য ইমাম শর্তারোপ করা সহীহ হবে না।
এতক্ষণের আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়েছে যে, কোন শর্ত আরোপ করার জন্য শর্ত আরোপকারীর পক্ষ হতে দলীল লাগবে; শর্ত নাকচকারীর পক্ষ হতে নাকচ করার জন্য দলীল লাগবে না। বরং উক্ত শর্তের পক্ষে কোন দলীল না থাকাই উক্ত শর্ত ভিত্তিহীন হওয়ার জন্য যথেষ্ট। তদুপরি আমরা এখানে ‘অনুগ্রহ-পূর্বক’ কিছু দলীল উপস্থাপন করছি।
দুই. কুরআনে কারীম থেকে
আল্লাহ তাআলা বলেন,
“(হে নবী) আপনি আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করতে থাকুন। আপনি নিজে ছাড়া অন্যের ব্যাপারে যিম্মাদার নন। আর আপনি মুসলমানদেরকে (জিহাদের উপর) উৎসাহিত করতে থাকুন। অবশ্যই আল্লাহ কাফেরদের শক্তি খর্ব করে দিবেন। আর আল্লাহ শক্তি-সামর্থের দিক দিয়ে অত্যন্ত কঠোর এবং কঠিন শাস্তিদাতা।” –সূরা নিসা: ৮৪
উক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অন্য কেউ জিহাদ না করলেও একাকী জিহাদ করার আদেশ করেছেন। আর উসূলে ফিকহের মূলনীতি হচ্ছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কোন কাজের আদেশ করা হলে, উক্ত বিধান উম্মতের জন্যেও প্রযোজ্য হবে। তবে কোন দলীলের ভিত্তিতে উক্ত কাজ রাসূলের সাথে নির্দিষ্ট হলে ভিন্ন কথা।[4]
উক্ত মূলনীতিটি ইমামুল হারামাঈন জুওয়ানী রহ. খুব সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন,
“শরীয়ত প্রণেতা (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কৃত কাজ হয়ত পূণ্য ও সওয়াব হিসেবে হবে অথবা অন্য কিছু (অভ্যাস, মানবিক প্রয়োজন, ব্যক্তিগত রুচি ইত্যাদি) হিসেবে হবে। (কাজটি যে ধরনেরই হোক না কেন) যদি কোন দলীল উক্ত কাজটি রাসূলের বিশেষত্ব হওয়ার প্রমাণ বহন করে, তাহলে তা রাসূলের বিশেষত্ব ধরা হবে। আর বিশেষত্বের উপর কোন দলীল না থাকলে, তা শুধু রাসূলের সাথে নির্দিষ্ট হবে না। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেন, রাসূলের মাঝে রয়েছে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ।”[5]
উক্ত মূলনীতির আলোকে আয়াতের ভাষ্য হচ্ছে, আর কেউ জিহাদ না করলেও প্রত্যেকের জন্য একাকী জিহাদ করা আল্লাহর বিধান।
উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনে আতিয়্যাহ আন্দালূসী রহ. (৫৪২ হি.) বলেন,
“(একাকী জিহাদের) উক্ত হুকুম বাহ্যত শুধু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য ছিল। কিন্তু আমরা কোন দলীলে পাইনি যে, কোন কালে উম্মত ছাড়া শুধু রাসূলের উপর জিহাদ ফরয ছিল। আয়াতের অর্থ হচ্ছে, -আর আল্লাহই সর্বাজ্ঞাত- শাব্দিকভাবে রাসূলকে সন্বোধন করা হয়েছে (অন্যথায় রাসূল ও উম্মত সকলেই এর অন্তর্ভুক্ত)। আদেশ করার উক্ত পদ্ধতির উদাহরণ হচ্ছে, যেন প্রত্যেককে ব্যক্তিগতভাবে বলা হচ্ছে; অর্থাৎ, হে মুহাম্মদ এবং আপনার উম্মতের প্রত্যেক ব্যক্তিকে বলা হচ্ছে, ‘আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করো। আপনি নিজে ছাড়া অন্যের ব্যাপারে যিম্মাদার নন।’ তাই প্রত্যেক মুমিনের জন্য উচিৎ হচ্ছে, একাকী হলেও জিহাদ করার বাসনা রাখা। উক্ত হুকুমের অনুকরণেই রাসূল বলেছেন, ‘আল্লাহর কসম, আমার গর্দান বিচ্ছিন্ন হওয়া পর্যন্ত আমি তাদের সাথে জিহাদ করবো’। এবং আবু বকর রাদি. বলেন, ‘যদি ডান হাত আমার বিরোধিতা করে, তাহলে বাম হাত দ্বারা জিহাদ করবো’।”[6]
উক্ত আয়াত এবং ইবনে আতিয়্যাহ আন্দালূসী রহ. এর তাফসীর থেকে এটাই প্রমাণীত হয় যে, একাকী হলেও আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ চালিয়ে যেতে হবে। এতে ইমাম বা জামাআত না-থাকার অজুহাতে জিহাদ ছাড়া যাবে না।
তিন. আবু বাসীর রাদি. এর হাদীস।[7]
হুদাইবিয়ার বছর রাসূল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম উমরা পালনের উদ্ধেশ্যে মক্কায় যাত্রা করেন। কিন্তু মক্কার কাফেররা উমরা পালন করতে দেয়নি। এক পর্যায়ে কয়েকটি বিন্দুর উপর সন্ধিচুক্তি হয়। তন্মধ্যে একটি ছিল, মক্কা থেকে কোন লোক মদীনায় গেলে; সে মুসলিম হলেও, তাকে মক্কায় ফেরত দিতে হবে।
সন্ধির পরে আবু বাসীর রাদি. মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় গেলে সন্ধির কারণে তাঁকে মক্কার দুই দূতের সাথে ফেরত দিতে হলো। পরবর্তীতে তিনি কৌশল অবলম্বন করে এক দূতকে হত্যা করে ফেলেন। অন্য দূত ভয়ে মদীনার দিকে পালিয়ে যায় এবং আবু বাসীর রাদি.ও তার পিছনে পিছনে মদীনায় প্রবেশ করেন। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা থেকে তিনি বুঝতে পারলেন যে, কাফেররা আবার তাকে ফেরত নিতে চাইলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চুক্তি অনুযায়ী তাকে ফেরত দিবেন। তাই তিনি মদীনা থেকে বের হয়ে সাগরের উপকূল এলাকায় চলে যান। ঐ দিকে আবু জান্দাল রাদি. মক্কা থেকে চুপে চুপে বের হয়ে আবু বাসীর রাদি. এর সাথে মিলিত হন। এরপর থেকে মক্কা থেকে যে মুসলিমই বের হতে পারতেন, তিনি আবু বাসীর রাদি. এর সাথে মিলিত হতেন। এক পর্যায়ে তাদেরকে নিয়ে একটি দল সংগঠিত হয়ে যায়। তাই মক্কার কাফেররা ব্যবসার জন্য শামের দিকে যাওয়ার খবর পেলে তারা কাফেরদের উপর হামলা করতেন এবং তাদেরকে হত্যা করে তাদের সম্পদ গনিমত হিসেবে গ্রহণ করতেন। কুরাইশের কাফেররা (অবস্থা বেগতিক দেখে) রাসূল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আল্লাহ ও আত্মীয়তার দোহাই দিয়ে চুক্তির উক্ত বিন্দু বিলুপ্ত করার অনুরোধ করে বললো, এখন থেকে যারা মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় যাবে, তারা নিরাপদ থাকবে।[8]
উক্ত ঘটনায় আবু বাসীর রাদি. প্রথমে মক্কার দূতকে হত্যা করা এবং পরবর্তীতে তিনি ও তাঁর সাথীরা মিলে কাফেরদের উপর হামলা করা তথকালীন খলীফার তথ্যাবধানে বা অনুমতিতে হয়নি। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন মক্কার কাফেরদের সাথে যুদ্ধবিরতী-চুক্তিবদ্ধ ছিলেন। তাই তাদেরকে গোপনে জিহাদের অনুমতি দিলেও তা চুক্তিলঙ্ঘন হতো; যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে হওয়া অসম্ভব। গুরোত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের উক্ত জিহাদের কোন নিন্দা করেননি।
চার. সালামা বিন আকওয়া’ রাদি. এর হাদীস।
মদীনা থেকে অদূরে ‘গাবাহ’ নামক স্থান থেকে গাতফান ও ফাযারা গোত্রের লোকেরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দুগ্ধবতী উটনীগুলো ছিনতাই করে নিয়ে যায়। সালামা বিন আকওয়া’ রাদি. খবর পেয়ে দৌড় দিয়ে তাদের পিছু নেন এবং একাকী তাদের সাথে জিহাদ করে সকল উটনী উদ্ধার করেন।[9]
উক্ত ঘটনায় সালামা রাদি. দুগ্ধবতী উটনীগুলো উদ্ধারের জন্য মুসলিমদের ইমাম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুমতি ছাড়া একা কাফেরদের বিরুদ্ধে জিহাদ করেছেন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর উক্ত কাজে খুশি হয়ে অশ্বরোহী এবং পদাতিক উভয় অংশ দিয়েছেন।[10]
পাঁচ. আত্মরক্ষা-মূলক জিহাদ-সম্বলিত হাদীস।
মুখারিক শায়বানী রাদি. থেকে বর্ণিত,
جَاءَ رَجُلٌ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالَ: الرَّجُلُ يَأْتِينِي فَيُرِيدُ مَالِي، قَالَ: «ذَكِّرْهُ بِاللَّهِ» قَالَ: فَإِنْ لَمْ يَذَّكَّرْ؟ قَالَ: «فَاسْتَعِنْ عَلَيْهِ مَنْ حَوْلَكَ مِنَ الْمُسْلِمِينَ» قَالَ: فَإِنْ لَمْ يَكُنْ حَوْلِي أَحَدٌ مِنَ الْمُسْلِمِينَ؟ قَالَ: «فَاسْتَعِنْ عَلَيْهِ بِالسُّلْطَانِ» قَالَ: فَإِنْ نَأَى السُّلْطَانُ عَنِّي؟ قَالَ: «قَاتِلْ دُونَ مَالِكَ حَتَّى تَكُونَ مِنْ شُهَدَاءِ الْآخِرَةِ، أَوْ تَمْنَعَ مَالَكَ»
“এক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বলল, কেউ এসে আমার সম্পদ ছিনিয়ে নিতে চাচ্ছে (তাহলে আমি কী করবো?) রাসূল বললেন, তুমি তাকে আল্লাহর কথা স্বরণ করে দেও। উক্ত ব্যক্তি বলল, যদি এতে কাজ না হয়? রাসূল বললেন, তার ব্যাপারে তোমার আশেপাশের মুসলিমদের কাছে সাহায্য চাও। সে বলল, যদি আমার আশেপাশে কোন মুসলিম না থাকে? রাসূল বললেন, শাসকের কাছে সাহায্য চাও। সে বলল, যদি শাসক আমার থেকে দূরে হয়? রাসূল বললেন, তুমি সম্পদ উদ্ধার করার লক্ষ্যে যুদ্ধ করো; যতক্ষণ না তুমি আখেরাতের শহীদ হও অথবা সম্পদ উদ্ধার করো।[11]
কেউ জান, মাল, দীন বা সম্ভ্রমের উপর আক্রমণ করলে, তাকে হত্যা করে হলেও প্রতিহত করা বিষয়ক অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। উক্ত সকল হাদীস থেকে সমষ্টিগতভাবে প্রমাণীত হয় যে, জিহাদের জন্য ইমাম বা আমীর শর্ত নয়। উক্ত হাদীসে প্রশ্নকারী সাহাবী স্পষ্ট জিজ্ঞাসা করেছেন যে, যদি আমি শাসক থেকে দূরে হওয়ার কারণে তার কাছে সাহায্য চাইতে না পারি, তাহলে কী করবো? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কত স্পষ্ট করে বলেছেন, তুমি তোমার সম্পদ উদ্ধার করার জন্য যুদ্ধ করো।
উপরোক্ত হাদীসসমূহ দ্বারা ‘জিহাদের জন্য ইমাম শর্ত’ না হওয়ার ব্যাপারে দলীল দিলে কেউ কেউ আপত্তি করেন যে, উক্ত হাদীসসমূহে মূলত আত্মরক্ষা বা প্রতিহত-মূলক যুদ্ধের কথা বলা হয়েছে; নিয়মতান্ত্রিক যুদ্ধের কথা বলা হয়নি। তাই এ দ্বারা ‘জিহাদের জন্য ইমাম শর্ত নয়’ এর পক্ষে দলীল দেওয়া যাবে না।
উক্ত আপত্তির জবাবে বলবো, উক্ত হাদীসসমূহ থেকে ‘অস্ত্র উত্তোলন করা জায়েয’ প্রমাণীত হওয়ার ব্যাপারে কোন অস্পষ্টতা নেই। এখন আপনি এটাকে আত্মরক্ষামূলক, প্রতিহতমূলক বা দিফায়ী অথবা অন্য যেকোন নাম দেন, তাতে হাদীসের ‘ফিকহ’ তথা অস্ত্র উত্তোলন করা জায়েয হওয়ার ব্যাপারে কোন ধরনের প্রভাব পড়বে না। তদোপরি বর্তমানের অধিকাংশ জিহাদ হচ্ছে, আত্মরক্ষা বা প্রতিহত মূলক জিহাদ; আগ্রাসী বা ইকদামী জিহাদ নয়।
চার. উমাইয়া খেলাফতের বিরুদ্ধে হুসাইন বিন আলী রাদি. এর বিদ্রোহ।
মুওয়াবিয়া রাদি. এর ইন্তেকালের পর ইয়াযীদ বিন মুওয়াবিয়া খলীফা হলে হুসাইন বিন আলী রাদি.সহ অনেক সাহাবী তাকে খলীফা মানেননি। এদিকে কূফার লোকেরা খেলাফতের ভার গ্রহণ করার জন্য হুসাইন রাদি. এর কাছে অসংখ্য দূত ও চিঠি পাঠাতে থাকে। অবশেষে তিনি এস্তেখারা ও একটি স্বপ্নের ইঙ্গিতে, যা তিনি কাউকে জানাননি, কূফায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। পথিমধ্যে উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদের বাহীনিরা তাকে পথরোধ করে। ফলশ্রুতিতে উমাইয়া বাহীনির সাথে কারবালার ময়দানে যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং হুসাইন রাদি. ও তাঁর সকল সহযোদ্ধারা শাহাদত বরণ করেন।[12]
মুওয়াবিয়া রাদি. কর্তৃক নিজপুত্র ইয়াযীদকে যুবরাজ ঘোষণা করার পরে, বাবার মৃত্যুর পর ইয়াযীদ শামবাসীদের সন্তুষ্টিতে এবং অনেকটা জোরপূর্বকভাবে খেলাফত গ্রহণ করেন। ফলে শরয়ীভাবে তিনি খলীফা হয়ে যান। তাই হুসাইন রাদি. যখন ইয়াযীদের বিরুদ্ধে জিহাদ করেন, তখন খলীফা ইয়াযীদ ছিলেন; হুসাইন রাদি. নয়। বরং হুসাইন রাদি. কখনও নিজেকে খলীফা হিসেবে দাবী করেননি। আর হুসাইন রাদি. খলীফার অনুমতি নিয়ে জিহাদ করবেন দূরের কথা, তিনি তো উক্ত খলীফার বিরুদ্ধেই জিহাদ করেছেন।
উল্লেখ্য: জালিম শাসকের বিরুদ্ধে জিহাদ করা জায়েয কি’না, এ ব্যাপারে আমাদের আলোচনা উদ্ধেশ্য নয়। তাই এদিকে যাচ্ছি না। সংক্ষেপে এতটুকু বলে রাখি, উক্ত মাসআলায় সালাফদের মাঝে মতভেদ আছে।
পাঁচ. আব্বাসী খলীফাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে ইমাম আবু হানীফার সমর্থন;
আব্বাসী খলীফা মানসূরের বিরুদ্ধে মুহাম্মদ নফসে যাকিয়্যাহ ও ইবরাহীম নফসে মারযিয়্যাহ রহ. নেফাযে শরিয়ত ও একামতে দীনের জন্য সশস্ত্র বিদ্রোহ করেন এবং ইমাম আবু হানীফা রহ. তাদের পক্ষে ফতোয়া ও সম্পদ দিয়ে সহযোগীতা করেন। বরং ইমাম আবু হানীফা রহ. তো উক্ত জিহাদকে পঞ্চাশ নফল হজের চেয়ে উত্তম বলেছেন।[13]
উক্ত জিহাদে মুহাম্মদ নফসে যাকিয়্যাহ বা ইবরাহীম নফরে মারযিয়্যাহ না তারা ইমাম ছিলেন আর না তারা ইমামের পক্ষ হতে অনুমতি পেয়েছেন। তারা কোন ইমামের কাছে অনুমতি চাইবেন, যেখানে তারা স্বয়ং ইমামের বিরুদ্ধেই জিহাদ করছেন! এবং ইমাম আবু হানীফা রহ. তাদের উক্ত বিদ্রোহকে সমর্থন করেছেন। যদি জিহাদর জন্য ইমাম শর্ত হতো, তাহলে মুহাম্মদ ও ইবরাহীম রহ. এর জিহাদ কি ছিল এবং ইমাম আবু হানিফা রহ. ফতোয়া ও সম্পদ দিয়ে তাদেরকে কেন সহযোগীতা করেছেন?
ফিকহের অনেক মাসআলা থেকেও ‘জিহাদের জন্য ইমাম শর্ত নয়’ বিষয়টি প্রমাণীত হয়। তবে আমরা সামনে জিহাদে ইমামের সংশ্লিষ্টতা শিরনামে আলোচনা করা ইচ্ছা আছে। তখন ফিকহের অনেক এবারত চলে আসবে। তাই এখানে আর তা উল্লেখ করছি না।
[1] বাদাইউস সানাই: ১/৩১৩, কাশফুল আসরার: ২/২৬
[2] আহকামুল কুরআন: ৩/৫৬৮, বাদাইউস সানাই: ২/৫৬
[3] বাদাইউস সানাই: ১/৮৫, ২/৫৬
[4] আহকামুল কুরআন: ১/২৩৮, উসূলে জাসসাস: ৩/২২৬, উসূলে সারাখসী: ২/৮৯, আল-কাফী শরহুল বাযদাওয়ী: ৪/১৬৬৯
[5] আল-ওয়ারাকাত: ২০
[6] তাফসীরে ইবনে আতিয়্যাহ: ২/৮৬
[7] তুহফাতুল কারী: ৬/১৯১
[8] সহীহ বুখারী: ২৭৩১ (শুধুমাত্র দলিল ও তথসংশ্লিষ্ট অংশ সংক্ষেপে উল্লেখ করা হয়েছে)
[9] সহীহ বুখারী: ৩০৪১, সহীহ মুসলিম: ১৮০৬ (শুধুমাত্র দলিল ও তথসংশ্লিষ্ট অংশ সংক্ষেপে উল্লেখ করা হয়েছে)
[10] সহীহ মুসলিম: ১৮০৭
[11] সুনানে নাসায়ী: ৪০৮১, মুসনাদে আহমদ: ২২৫১৩, মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বাহ: ১৪/৩৪৫, মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক: ১০/১১৬। শাইখ মুহাম্মদ আওয়ামা সনদ হাসান বলেছেন।
[12] আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৮/১৮৩
[13] মুকাতিলুত তালিবিয়্যীন: ১৪১, ৩১০, ৩২৪
এক. কুরআন ও হাদীসের ব্যাপক দলীল:
কুরআন ও হাদীসে জিহাদের হুকুম ব্যাপকভাবে এসেছে; ইমামের সাথে শর্তযুক্ত করা হয়নি। তাই দলীলের ব্যাপকতার দাবী হচ্ছে, হুকুম ব্যাপক হওয়া। তাই উক্ত ব্যাপক দলীলের সমমানের শর্তযুক্ত দলীল পাওয়া না গেলে জিহাদের ফরযিয়াতের বিধানও ব্যাপক থাকবে।
আমরা এখানে “উক্ত দলীলের সমমানের দলীল” হতে হবে- এমন শর্ত আরোপ করার কারণ হচ্ছে, হানাফী উসূলবিদদের মতে ব্যাপক দলীলকে শর্তযুক্ত করা মূলত ব্যাপক দলীলের ব্যাপকতাকে রহিত করার সমতুল্য।[1] আর কোন দলীলকে রহিত করার জন্য উক্ত দলীলের সমমানের দলীল হওয়া আবশ্যক; এরচেয়ে দুর্বল দলীল দ্বারা রহিত করা জায়েয নয়।[2]
উক্ত দুই উসূলের সমষ্টি থেকে উসূলবিদগণ আরেকটি উসূল বের করেন যে, ‘অকাট্যভাবে প্রমাণীত ব্যাপক কোন দলীলকে দুর্বলভাবে প্রমাণীত দলীল দ্বারা শর্তযুক্ত করা যাবে না’।[3]
তাই জিহাদ ফরয ও সহীহ হওয়ার ব্যাপারে কুরআন ও হাদীসের অকাট্য দলীলসমূহ ব্যাপকভাবে এসেছে, তাই উক্ত দলীলসমূহকে ইমাম থাকার সাথে শর্তযুক্ত করার জন্য অকাট্য দলীল লাগবে। যতক্ষণ উক্ত দলীল পাওয়া না যাবে ততক্ষণ ব্যাপকতার মূল দাবী হিসেবে জিহাদের জন্য ইমাম শর্তারোপ করা সহীহ হবে না।
এতক্ষণের আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়েছে যে, কোন শর্ত আরোপ করার জন্য শর্ত আরোপকারীর পক্ষ হতে দলীল লাগবে; শর্ত নাকচকারীর পক্ষ হতে নাকচ করার জন্য দলীল লাগবে না। বরং উক্ত শর্তের পক্ষে কোন দলীল না থাকাই উক্ত শর্ত ভিত্তিহীন হওয়ার জন্য যথেষ্ট। তদুপরি আমরা এখানে ‘অনুগ্রহ-পূর্বক’ কিছু দলীল উপস্থাপন করছি।
দুই. কুরআনে কারীম থেকে
আল্লাহ তাআলা বলেন,
فَقَاتِلْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ لَا تُكَلَّفُ إِلَّا نَفْسَكَ وَحَرِّضِ الْمُؤْمِنِينَ عَسَى اللَّهُ أَنْ يَكُفَّ بَأْسَ الَّذِينَ كَفَرُوا وَاللَّهُ أَشَدُّ بَأْسًا وَأَشَدُّ تَنْكِيلًا -سورة النساء: 84
“(হে নবী) আপনি আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করতে থাকুন। আপনি নিজে ছাড়া অন্যের ব্যাপারে যিম্মাদার নন। আর আপনি মুসলমানদেরকে (জিহাদের উপর) উৎসাহিত করতে থাকুন। অবশ্যই আল্লাহ কাফেরদের শক্তি খর্ব করে দিবেন। আর আল্লাহ শক্তি-সামর্থের দিক দিয়ে অত্যন্ত কঠোর এবং কঠিন শাস্তিদাতা।” –সূরা নিসা: ৮৪
উক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অন্য কেউ জিহাদ না করলেও একাকী জিহাদ করার আদেশ করেছেন। আর উসূলে ফিকহের মূলনীতি হচ্ছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কোন কাজের আদেশ করা হলে, উক্ত বিধান উম্মতের জন্যেও প্রযোজ্য হবে। তবে কোন দলীলের ভিত্তিতে উক্ত কাজ রাসূলের সাথে নির্দিষ্ট হলে ভিন্ন কথা।[4]
উক্ত মূলনীতিটি ইমামুল হারামাঈন জুওয়ানী রহ. খুব সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন,
فعل صاحب الشريعة لا يخلو إما أن يكون على وجه القربة والطاعة أو غير ذلك، فإن دل دليل على الاختصاص به يحمل على الاختصاص، وإن لم يدل لا يخصص به؛ لأن الله تعالى يقول " لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ"
“শরীয়ত প্রণেতা (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কৃত কাজ হয়ত পূণ্য ও সওয়াব হিসেবে হবে অথবা অন্য কিছু (অভ্যাস, মানবিক প্রয়োজন, ব্যক্তিগত রুচি ইত্যাদি) হিসেবে হবে। (কাজটি যে ধরনেরই হোক না কেন) যদি কোন দলীল উক্ত কাজটি রাসূলের বিশেষত্ব হওয়ার প্রমাণ বহন করে, তাহলে তা রাসূলের বিশেষত্ব ধরা হবে। আর বিশেষত্বের উপর কোন দলীল না থাকলে, তা শুধু রাসূলের সাথে নির্দিষ্ট হবে না। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেন, রাসূলের মাঝে রয়েছে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ।”[5]
উক্ত মূলনীতির আলোকে আয়াতের ভাষ্য হচ্ছে, আর কেউ জিহাদ না করলেও প্রত্যেকের জন্য একাকী জিহাদ করা আল্লাহর বিধান।
উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনে আতিয়্যাহ আন্দালূসী রহ. (৫৪২ হি.) বলেন,
هذا أمر في ظاهر اللفظ للنبي عليه السلام وحده، لكن لم نجد قط في خبر أن القتال فرض على النبي صلى الله عليه وسلم دون الأمة مدة ما، المعنى- والله أعلم- أنه خطاب للنبي عليه السلام في اللفظ، وهو مثال ما يقال لكل واحد في خاصة نفسه، أي أنت يا محمد وكل واحد من أمتك القول له فَقاتِلْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ لا تُكَلَّفُ إِلَّا نَفْسَكَ ولهذا ينبغي لكل مؤمن أن يستشعر أن يجاهد ولو وحده، ومن ذلك قول النبي عليه السلام «والله لأقاتلنهم حتى تنفرد سالفتي» وقول أبي بكر وقت الردة: «ولو خالفتني يميني لجاهدتها بشمالي»
“(একাকী জিহাদের) উক্ত হুকুম বাহ্যত শুধু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য ছিল। কিন্তু আমরা কোন দলীলে পাইনি যে, কোন কালে উম্মত ছাড়া শুধু রাসূলের উপর জিহাদ ফরয ছিল। আয়াতের অর্থ হচ্ছে, -আর আল্লাহই সর্বাজ্ঞাত- শাব্দিকভাবে রাসূলকে সন্বোধন করা হয়েছে (অন্যথায় রাসূল ও উম্মত সকলেই এর অন্তর্ভুক্ত)। আদেশ করার উক্ত পদ্ধতির উদাহরণ হচ্ছে, যেন প্রত্যেককে ব্যক্তিগতভাবে বলা হচ্ছে; অর্থাৎ, হে মুহাম্মদ এবং আপনার উম্মতের প্রত্যেক ব্যক্তিকে বলা হচ্ছে, ‘আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করো। আপনি নিজে ছাড়া অন্যের ব্যাপারে যিম্মাদার নন।’ তাই প্রত্যেক মুমিনের জন্য উচিৎ হচ্ছে, একাকী হলেও জিহাদ করার বাসনা রাখা। উক্ত হুকুমের অনুকরণেই রাসূল বলেছেন, ‘আল্লাহর কসম, আমার গর্দান বিচ্ছিন্ন হওয়া পর্যন্ত আমি তাদের সাথে জিহাদ করবো’। এবং আবু বকর রাদি. বলেন, ‘যদি ডান হাত আমার বিরোধিতা করে, তাহলে বাম হাত দ্বারা জিহাদ করবো’।”[6]
উক্ত আয়াত এবং ইবনে আতিয়্যাহ আন্দালূসী রহ. এর তাফসীর থেকে এটাই প্রমাণীত হয় যে, একাকী হলেও আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ চালিয়ে যেতে হবে। এতে ইমাম বা জামাআত না-থাকার অজুহাতে জিহাদ ছাড়া যাবে না।
তিন. আবু বাসীর রাদি. এর হাদীস।[7]
হুদাইবিয়ার বছর রাসূল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম উমরা পালনের উদ্ধেশ্যে মক্কায় যাত্রা করেন। কিন্তু মক্কার কাফেররা উমরা পালন করতে দেয়নি। এক পর্যায়ে কয়েকটি বিন্দুর উপর সন্ধিচুক্তি হয়। তন্মধ্যে একটি ছিল, মক্কা থেকে কোন লোক মদীনায় গেলে; সে মুসলিম হলেও, তাকে মক্কায় ফেরত দিতে হবে।
সন্ধির পরে আবু বাসীর রাদি. মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় গেলে সন্ধির কারণে তাঁকে মক্কার দুই দূতের সাথে ফেরত দিতে হলো। পরবর্তীতে তিনি কৌশল অবলম্বন করে এক দূতকে হত্যা করে ফেলেন। অন্য দূত ভয়ে মদীনার দিকে পালিয়ে যায় এবং আবু বাসীর রাদি.ও তার পিছনে পিছনে মদীনায় প্রবেশ করেন। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা থেকে তিনি বুঝতে পারলেন যে, কাফেররা আবার তাকে ফেরত নিতে চাইলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চুক্তি অনুযায়ী তাকে ফেরত দিবেন। তাই তিনি মদীনা থেকে বের হয়ে সাগরের উপকূল এলাকায় চলে যান। ঐ দিকে আবু জান্দাল রাদি. মক্কা থেকে চুপে চুপে বের হয়ে আবু বাসীর রাদি. এর সাথে মিলিত হন। এরপর থেকে মক্কা থেকে যে মুসলিমই বের হতে পারতেন, তিনি আবু বাসীর রাদি. এর সাথে মিলিত হতেন। এক পর্যায়ে তাদেরকে নিয়ে একটি দল সংগঠিত হয়ে যায়। তাই মক্কার কাফেররা ব্যবসার জন্য শামের দিকে যাওয়ার খবর পেলে তারা কাফেরদের উপর হামলা করতেন এবং তাদেরকে হত্যা করে তাদের সম্পদ গনিমত হিসেবে গ্রহণ করতেন। কুরাইশের কাফেররা (অবস্থা বেগতিক দেখে) রাসূল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আল্লাহ ও আত্মীয়তার দোহাই দিয়ে চুক্তির উক্ত বিন্দু বিলুপ্ত করার অনুরোধ করে বললো, এখন থেকে যারা মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় যাবে, তারা নিরাপদ থাকবে।[8]
উক্ত ঘটনায় আবু বাসীর রাদি. প্রথমে মক্কার দূতকে হত্যা করা এবং পরবর্তীতে তিনি ও তাঁর সাথীরা মিলে কাফেরদের উপর হামলা করা তথকালীন খলীফার তথ্যাবধানে বা অনুমতিতে হয়নি। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন মক্কার কাফেরদের সাথে যুদ্ধবিরতী-চুক্তিবদ্ধ ছিলেন। তাই তাদেরকে গোপনে জিহাদের অনুমতি দিলেও তা চুক্তিলঙ্ঘন হতো; যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে হওয়া অসম্ভব। গুরোত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের উক্ত জিহাদের কোন নিন্দা করেননি।
চার. সালামা বিন আকওয়া’ রাদি. এর হাদীস।
মদীনা থেকে অদূরে ‘গাবাহ’ নামক স্থান থেকে গাতফান ও ফাযারা গোত্রের লোকেরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দুগ্ধবতী উটনীগুলো ছিনতাই করে নিয়ে যায়। সালামা বিন আকওয়া’ রাদি. খবর পেয়ে দৌড় দিয়ে তাদের পিছু নেন এবং একাকী তাদের সাথে জিহাদ করে সকল উটনী উদ্ধার করেন।[9]
উক্ত ঘটনায় সালামা রাদি. দুগ্ধবতী উটনীগুলো উদ্ধারের জন্য মুসলিমদের ইমাম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুমতি ছাড়া একা কাফেরদের বিরুদ্ধে জিহাদ করেছেন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর উক্ত কাজে খুশি হয়ে অশ্বরোহী এবং পদাতিক উভয় অংশ দিয়েছেন।[10]
পাঁচ. আত্মরক্ষা-মূলক জিহাদ-সম্বলিত হাদীস।
মুখারিক শায়বানী রাদি. থেকে বর্ণিত,
جَاءَ رَجُلٌ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالَ: الرَّجُلُ يَأْتِينِي فَيُرِيدُ مَالِي، قَالَ: «ذَكِّرْهُ بِاللَّهِ» قَالَ: فَإِنْ لَمْ يَذَّكَّرْ؟ قَالَ: «فَاسْتَعِنْ عَلَيْهِ مَنْ حَوْلَكَ مِنَ الْمُسْلِمِينَ» قَالَ: فَإِنْ لَمْ يَكُنْ حَوْلِي أَحَدٌ مِنَ الْمُسْلِمِينَ؟ قَالَ: «فَاسْتَعِنْ عَلَيْهِ بِالسُّلْطَانِ» قَالَ: فَإِنْ نَأَى السُّلْطَانُ عَنِّي؟ قَالَ: «قَاتِلْ دُونَ مَالِكَ حَتَّى تَكُونَ مِنْ شُهَدَاءِ الْآخِرَةِ، أَوْ تَمْنَعَ مَالَكَ»
“এক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বলল, কেউ এসে আমার সম্পদ ছিনিয়ে নিতে চাচ্ছে (তাহলে আমি কী করবো?) রাসূল বললেন, তুমি তাকে আল্লাহর কথা স্বরণ করে দেও। উক্ত ব্যক্তি বলল, যদি এতে কাজ না হয়? রাসূল বললেন, তার ব্যাপারে তোমার আশেপাশের মুসলিমদের কাছে সাহায্য চাও। সে বলল, যদি আমার আশেপাশে কোন মুসলিম না থাকে? রাসূল বললেন, শাসকের কাছে সাহায্য চাও। সে বলল, যদি শাসক আমার থেকে দূরে হয়? রাসূল বললেন, তুমি সম্পদ উদ্ধার করার লক্ষ্যে যুদ্ধ করো; যতক্ষণ না তুমি আখেরাতের শহীদ হও অথবা সম্পদ উদ্ধার করো।[11]
কেউ জান, মাল, দীন বা সম্ভ্রমের উপর আক্রমণ করলে, তাকে হত্যা করে হলেও প্রতিহত করা বিষয়ক অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। উক্ত সকল হাদীস থেকে সমষ্টিগতভাবে প্রমাণীত হয় যে, জিহাদের জন্য ইমাম বা আমীর শর্ত নয়। উক্ত হাদীসে প্রশ্নকারী সাহাবী স্পষ্ট জিজ্ঞাসা করেছেন যে, যদি আমি শাসক থেকে দূরে হওয়ার কারণে তার কাছে সাহায্য চাইতে না পারি, তাহলে কী করবো? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কত স্পষ্ট করে বলেছেন, তুমি তোমার সম্পদ উদ্ধার করার জন্য যুদ্ধ করো।
উপরোক্ত হাদীসসমূহ দ্বারা ‘জিহাদের জন্য ইমাম শর্ত’ না হওয়ার ব্যাপারে দলীল দিলে কেউ কেউ আপত্তি করেন যে, উক্ত হাদীসসমূহে মূলত আত্মরক্ষা বা প্রতিহত-মূলক যুদ্ধের কথা বলা হয়েছে; নিয়মতান্ত্রিক যুদ্ধের কথা বলা হয়নি। তাই এ দ্বারা ‘জিহাদের জন্য ইমাম শর্ত নয়’ এর পক্ষে দলীল দেওয়া যাবে না।
উক্ত আপত্তির জবাবে বলবো, উক্ত হাদীসসমূহ থেকে ‘অস্ত্র উত্তোলন করা জায়েয’ প্রমাণীত হওয়ার ব্যাপারে কোন অস্পষ্টতা নেই। এখন আপনি এটাকে আত্মরক্ষামূলক, প্রতিহতমূলক বা দিফায়ী অথবা অন্য যেকোন নাম দেন, তাতে হাদীসের ‘ফিকহ’ তথা অস্ত্র উত্তোলন করা জায়েয হওয়ার ব্যাপারে কোন ধরনের প্রভাব পড়বে না। তদোপরি বর্তমানের অধিকাংশ জিহাদ হচ্ছে, আত্মরক্ষা বা প্রতিহত মূলক জিহাদ; আগ্রাসী বা ইকদামী জিহাদ নয়।
চার. উমাইয়া খেলাফতের বিরুদ্ধে হুসাইন বিন আলী রাদি. এর বিদ্রোহ।
মুওয়াবিয়া রাদি. এর ইন্তেকালের পর ইয়াযীদ বিন মুওয়াবিয়া খলীফা হলে হুসাইন বিন আলী রাদি.সহ অনেক সাহাবী তাকে খলীফা মানেননি। এদিকে কূফার লোকেরা খেলাফতের ভার গ্রহণ করার জন্য হুসাইন রাদি. এর কাছে অসংখ্য দূত ও চিঠি পাঠাতে থাকে। অবশেষে তিনি এস্তেখারা ও একটি স্বপ্নের ইঙ্গিতে, যা তিনি কাউকে জানাননি, কূফায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। পথিমধ্যে উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদের বাহীনিরা তাকে পথরোধ করে। ফলশ্রুতিতে উমাইয়া বাহীনির সাথে কারবালার ময়দানে যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং হুসাইন রাদি. ও তাঁর সকল সহযোদ্ধারা শাহাদত বরণ করেন।[12]
মুওয়াবিয়া রাদি. কর্তৃক নিজপুত্র ইয়াযীদকে যুবরাজ ঘোষণা করার পরে, বাবার মৃত্যুর পর ইয়াযীদ শামবাসীদের সন্তুষ্টিতে এবং অনেকটা জোরপূর্বকভাবে খেলাফত গ্রহণ করেন। ফলে শরয়ীভাবে তিনি খলীফা হয়ে যান। তাই হুসাইন রাদি. যখন ইয়াযীদের বিরুদ্ধে জিহাদ করেন, তখন খলীফা ইয়াযীদ ছিলেন; হুসাইন রাদি. নয়। বরং হুসাইন রাদি. কখনও নিজেকে খলীফা হিসেবে দাবী করেননি। আর হুসাইন রাদি. খলীফার অনুমতি নিয়ে জিহাদ করবেন দূরের কথা, তিনি তো উক্ত খলীফার বিরুদ্ধেই জিহাদ করেছেন।
উল্লেখ্য: জালিম শাসকের বিরুদ্ধে জিহাদ করা জায়েয কি’না, এ ব্যাপারে আমাদের আলোচনা উদ্ধেশ্য নয়। তাই এদিকে যাচ্ছি না। সংক্ষেপে এতটুকু বলে রাখি, উক্ত মাসআলায় সালাফদের মাঝে মতভেদ আছে।
পাঁচ. আব্বাসী খলীফাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে ইমাম আবু হানীফার সমর্থন;
আব্বাসী খলীফা মানসূরের বিরুদ্ধে মুহাম্মদ নফসে যাকিয়্যাহ ও ইবরাহীম নফসে মারযিয়্যাহ রহ. নেফাযে শরিয়ত ও একামতে দীনের জন্য সশস্ত্র বিদ্রোহ করেন এবং ইমাম আবু হানীফা রহ. তাদের পক্ষে ফতোয়া ও সম্পদ দিয়ে সহযোগীতা করেন। বরং ইমাম আবু হানীফা রহ. তো উক্ত জিহাদকে পঞ্চাশ নফল হজের চেয়ে উত্তম বলেছেন।[13]
উক্ত জিহাদে মুহাম্মদ নফসে যাকিয়্যাহ বা ইবরাহীম নফরে মারযিয়্যাহ না তারা ইমাম ছিলেন আর না তারা ইমামের পক্ষ হতে অনুমতি পেয়েছেন। তারা কোন ইমামের কাছে অনুমতি চাইবেন, যেখানে তারা স্বয়ং ইমামের বিরুদ্ধেই জিহাদ করছেন! এবং ইমাম আবু হানীফা রহ. তাদের উক্ত বিদ্রোহকে সমর্থন করেছেন। যদি জিহাদর জন্য ইমাম শর্ত হতো, তাহলে মুহাম্মদ ও ইবরাহীম রহ. এর জিহাদ কি ছিল এবং ইমাম আবু হানিফা রহ. ফতোয়া ও সম্পদ দিয়ে তাদেরকে কেন সহযোগীতা করেছেন?
ফিকহের অনেক মাসআলা থেকেও ‘জিহাদের জন্য ইমাম শর্ত নয়’ বিষয়টি প্রমাণীত হয়। তবে আমরা সামনে জিহাদে ইমামের সংশ্লিষ্টতা শিরনামে আলোচনা করা ইচ্ছা আছে। তখন ফিকহের অনেক এবারত চলে আসবে। তাই এখানে আর তা উল্লেখ করছি না।
[1] বাদাইউস সানাই: ১/৩১৩, কাশফুল আসরার: ২/২৬
[2] আহকামুল কুরআন: ৩/৫৬৮, বাদাইউস সানাই: ২/৫৬
[3] বাদাইউস সানাই: ১/৮৫, ২/৫৬
[4] আহকামুল কুরআন: ১/২৩৮, উসূলে জাসসাস: ৩/২২৬, উসূলে সারাখসী: ২/৮৯, আল-কাফী শরহুল বাযদাওয়ী: ৪/১৬৬৯
[5] আল-ওয়ারাকাত: ২০
[6] তাফসীরে ইবনে আতিয়্যাহ: ২/৮৬
[7] তুহফাতুল কারী: ৬/১৯১
[8] সহীহ বুখারী: ২৭৩১ (শুধুমাত্র দলিল ও তথসংশ্লিষ্ট অংশ সংক্ষেপে উল্লেখ করা হয়েছে)
[9] সহীহ বুখারী: ৩০৪১, সহীহ মুসলিম: ১৮০৬ (শুধুমাত্র দলিল ও তথসংশ্লিষ্ট অংশ সংক্ষেপে উল্লেখ করা হয়েছে)
[10] সহীহ মুসলিম: ১৮০৭
[11] সুনানে নাসায়ী: ৪০৮১, মুসনাদে আহমদ: ২২৫১৩, মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বাহ: ১৪/৩৪৫, মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক: ১০/১১৬। শাইখ মুহাম্মদ আওয়ামা সনদ হাসান বলেছেন।
[12] আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৮/১৮৩
[13] মুকাতিলুত তালিবিয়্যীন: ১৪১, ৩১০, ৩২৪
Comment