সংশয়ের পক্ষের দলীল ও পর্যালোচনা:
শুরুতে একটি কথা বলে রাখি, উক্ত শর্তের প্রবক্তরা একদিকে জিহাদের সংজ্ঞা ব্যাপক করলেও অন্যদিকে শুধু কিতালের জন্য ইমামকে শর্ত করেন; জিহাদের অন্য ক্ষেত্রের জন্য নয়।[1] কিন্তু শর্ত হওয়ার পক্ষে যে দলীল উপস্থাপন করেন, তা থেকে এমন বিশ্লেষণ বুঝে আসে না।
উক্ত সংশয়ের পক্ষে যে দলীলসমূহ উপস্থাপন করা হয়, তা হচ্ছে নিম্নোরূপ;
প্রথম দলীল: আবু হুরায়রা রাদি. এর হাদীস।[2]
আবু হুরায়রা রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
“প্রত্যেক শাসকের সাথে জিহাদ করা তোমাদের উপর ওয়াজিব, হোক সে সৎ বা অসৎ। প্রত্যেক মুসলিমের পিছনে নামায পড়া তোমাদের উপর ওয়াজিব, হোক সে সৎ বা অসৎ; যদিও সে কবীরা গুণাহ করে থাকে। প্রত্যেক মুসলিমের জানাযা পড়া তোমাদের উপর ওয়াজিব, হোক সে সৎ বা অসৎ; যদি সে কবীরা গুণাহ করে থাকে।”[3]
উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় শাইখ যাফর আহমদ উসমানী রহ. (১৩৯৪ হি.) বলেন,
“হাদীসে ‘জিহাদের জন্য ইমাম শর্ত’ এবং ‘ইমাম ছাড়া জিহাদ সহীহ নয়’ -এর প্রমাণ রয়েছে। কেননা তাঁর (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বানী হলো, “প্রত্যেক আমীরের সাথে তোমাদের উপর জিহাদ ওয়াজিব”। তো যখন মুসলিমদের কোন ইমাম থাকবে না, তখন আর জিহাদ নেই। হ্যাঁ, তখন মুসলিমদের উপর ওয়াজিব হলো, তাদের জন্য একজন আমীর অনুসন্ধান করা।”[4]
প্রথমেই বলে রাখি, উক্ত হাদীসের উপর সনদগত আপত্তি থাকলেও একাধিক সনদে বর্ণিত হওয়ার কারণে মুহাদ্দিসগণ হাদীসটি প্রমাণীত বলেছেন। ফলে তা আকীদার কিতাবেও স্থান পেয়েছে।[5] তাই হাদীসের আলোচিত অংশটি প্রমাণীত ধরেই উক্ত হাদীস থেকে আলোচিত মাসআলার প্রমাণ্যতা নিয়ে পর্যালোচনা করার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।
এক. উক্ত হাদীসের তিনটি অংশ রয়েছে; নেককার ও বদকার আমীরের সাথে জিহাদ করা, নেককার ও বদকার ইমামের পিছনে নামায পড়া এবং নেককার ও বদকার ব্যক্তির জানাযার নামায পড়া। তিনটি বিধান একসাথে একই ধাঁচে উল্লেখিত হয়েছে। তাই উসূল অনুযায়ী হাদীসের তিন অংশ থেকে একই ধরনের হুকুম প্রমাণীত হওয়ার কথা। হাদীসের প্রথম অংশ থেকে জিহাদের জন্য আমীর শর্ত প্রমাণীত হলে হাদীসের দ্বিতীয় অংশ থেকে নামাযের জন্য ইমাম শর্ত প্রমাণীত হওয়ার কথা। আর জানা কথা, নামাযের জন্য ইমাম শর্ত হওয়ার অর্থ হচ্ছে, নামাযের জন্য জামাআত শর্ত। কেননা জামাআত ছাড়া নামাযে ইমাম হওয়ার কোন সম্ভাবনাই নেই। কিন্তু আমাদের জানা মতে, নামাযের জন্য জামাত ফরয, ওয়াজিব না সুন্নত- এ ব্যাপারে ইমামদের মাঝে মতভেদ থাকলেও কারও মতে নামায সহীহ হওয়ার জন্য ইমাম বা জামাত শর্ত নয়।[6] বরং শাইখ নিজে জামাআতের অধ্যায়ে উক্ত হাদীস থেকে নামাযের জন্য জামাআত ওয়াজিব হওয়ার হুকুম বের করেছেন; জামাআত ছাড়া নামায সহীহ হবে না- এমন হুকুম বের করেননি।[7]
তাই হাদীসের এক অংশ থেকে এক বিধান প্রমাণ করা এবং একই ধরনের অন্য অংশ থেকে উক্ত বিধান প্রমাণ না করে ভিন্ন বিধান প্রমাণ করা উসূলী দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের কাছে বোধগম্য নয়।
দুই. যে হাদীসটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইমামের ফিসকের বাহানায় জিহাদ ছাড়ার অযুহাত খণ্ডন করার জন্য বলেছেন এবং মুহাদ্দিস ও ফকীহগণ একই উদ্ধেশ্যে স্বস্ব কিতাবে উল্লেখ করেছেন, সে হাদীস থেকে ‘জিহাদের জন্য ইমাম শর্ত’ প্রমাণ করে জিহাদকে কার্যত অকেজ করা বা জিহাদ ছাড়ার বাহানা বের করা হচ্ছে! কোন ফকীহ বা মুহাদ্দিস উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় ‘জিহাদের জন্য ইমাম শর্ত’ এমন কোন কথা বলেননি। যদি উক্ত হাদীস থেকে ‘জিহাদের জন্য ইমাম বা আমীর শর্ত’ বুঝে আসতো, তাহলে ফকীহগণ অবশ্যই তা উল্লেখ করতেন। বরং হাদীসের ব্যাখ্যাকারীগণ উক্ত হাদীসের আলোকে ‘আমীর ফাসেক হলেও জিহাদ করতে হবে’ এমনটিই বলেছেন।
‘মাসাবীহুস সুন্নাহ’ এর প্রশিদ্ধ ব্যাখ্যাকার মুজহিরী হানাফী রহ. (৭২৭ হি.) বলেন,
“শাসক জালিম হওয়ার কারণে জিহাদ তরক করা জায়েয নয়। বরং শাসক জালিম হলেও তার সাথে মিলে জিহাদ করা মানুষের উপর ওয়াজিব। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘প্রত্যেক আমীরের সাথে মিলে জিহাদ করা তোমাদের উপর ওয়াজিব; হোক সে নেককার বা বদকার’।”[8]
‘মিশকাতুল মাসাবীহ’ এর ব্যাখ্যাকার শারাফুদ্দীন তীবী রহ. (৭৪৩ হি.) বলেন,
“আমার মতে, প্রত্যেক বাক্যের বাহ্যিক থেকে একটি বিষয় ওয়াজিব এবং অন্য বিষয়টি জায়েজ প্রমাণীত হয়। প্রথম বাক্য মুসলিমদের উপর জিহাদ ওয়াজিব এবং ফাসেক শাসকের সাথে জিহাদ জায়েজ প্রমাণ বহন করে। দ্বিতীয় বাক্য জামাআতে নামায পড়া ওয়াজিব এবং ফাসেক ইমামের পিছনে নামায পড়া জায়েয প্রমাণ বহন করে। তৃতীয় বাক্য মুসলিমদের জানাযা পড়া ওয়াজিব এবং জানাযা ফাসেকের উপর প্রকাশ পাওয়া জায়েয হওয়ার উপর প্রমাণ বহন করে। এ হচ্ছে, হাদীসের বাহ্যিক মর্ম।”[9]
তিন. উক্ত হাদীস থেকে জিহাদের জন্য আমীর শর্ত হওয়ার মত গ্রহণ করে নিলেও ‘জিহাদের জন্য আমীর শর্ত’ প্রমাণীত হয়; ‘জিহাদের জন্য ইমাম শর্ত’ প্রমাণীত হয় না। কিন্তু শাইখ আমীরের উপর ইমামুল মুসলিমীনের সকল শর্ত জোড়ে দিয়েছেন এবং জিহাদের জন্য এমন আমীর শর্ত করেছেন, যার মাঝে ইমামুল মুসলিমীনের সকল শর্ত বিদ্যমান থাকা আবশ্যক।[10]
শাইখের আরেকটি বক্তব্যের পর্যালোচনা
প্রসঙ্গত শাইখের আরেকটি এবারত নিয়ে একটু পর্যালোচনা করে নেই। শাইখ রহ. আরেকটু সামনে গিয়ে বলেন,
“আমি বলব, যদি আলেমরা বা মুসলিম জামাআত কোন ব্যক্তির কাছে বায়আত দেয়, যে সীমানা পাহারা দেওয়া, ভূমি হেফাজত করা, জিহাদের জন্য সৈন্য পাঠানো ও বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ইসলামের বিধিবিধান প্রয়োগ করতে এবং শক্তি ও সামর্থের ভিত্তিতে জালিম থেকে মাজলুমের হক বুঝিয়ে দিতে সক্ষম নয়, তাহলে সে আমীরও হবে না ইমামও হবে না। বরং সে হচ্ছে ‘হাকাম’ এর মত এবং মানুষ তাকে যে বায়আত দিয়েছে, তা ‘তাহকীম’ এর মত। এক্ষেত্রে কাগজে-কলমে বা লোকমুখে আমীর বা ইমাম উচ্চারিত হওয়া কোন ফলপ্রসূ হবে না। কেননা এমারত ও ইমামত এর ভিত্তি হচ্ছে, শক্তি ও সামর্থের উপর; শুধু নাম বা প্রসিদ্ধির উপর নয়। তাই জনসাধারণের উপর তাকে বায়আত দেওয়া, তার আনুগত্য করা ও তার সাথে জিহাদ করা ওয়াজিব হবে না এবং তাকে বায়আত দেওয়ার দ্বারা মুসলিমদের দায়িত্ব থেকে ‘নসবুল ইমাম’ এর ওয়াজিব আদায় হবে না। বরং তাদের উপর ওয়াজিব হচ্ছে, উল্লেখিত শর্তসমৃদ্ধ কোন শাসক খোঁজে বের করা।”[11]
উল্লেখ্য: ফিকহের পরিভাষায় দুই পক্ষের সন্তুষ্টিতে কাউকে বিচারক বানানোকে ‘তাহকীম’ এবং নিয়োগকৃত ব্যক্তিকে ‘হাকাম’ বলে।
শাইখ উক্ত এবারতে কয়েকটি বিষয় দাবী করেছেন;
ক. শুধু কয়েকজনের বাইয়াতের মাধ্যমে কেউ আমীর বা ইমাম হয়ে যায় না। বরং সর্বোচ্চ তাকে ‘হাকাম’ বলা যেতে পারে। কেননা আমীর বা ইমাম হওয়ার জন্য ‘কুওয়াতে কাহেরা’ তথা শত্রুকে পরাভূত করতে পারার মত শক্তি ও সামর্থ শর্ত।
খ. তাই এমন আমীরকে বাইয়াত দেওয়া, আনুগত্য করা এবং তার সাথে মিলে জিহাদ করা মুসলিমদের উপর ওয়াজিব নয়।
গ. এমন আমীরকে বাইয়াত দেওয়ার মাধ্যমে মুসলিমদের যিম্মা থেকে ‘নসবুল ইমাম’ এর ফরযিয়াত আদায় হবে না।
ঘ. মুসলিমদের উপর ওয়াজিব হচ্ছে, শক্তি ও সামর্থ-বিশিষ্ট শাসক খোঁজে বের করা।
শাইখের তৃতীয় বক্তব্যের সাথে আমাদের কোন দ্বিমত নেই। কেননা যদি জিহাদের আমীরকে বাইয়াত দেওয়ার মাধ্যমে ‘নসবুল ইমাম’ এর ফরযিয়াত আদায় হয়ে যায়, তাহলে খেলাফত প্রতিষ্টা করার জন্য জিহাদ করার কি দরকার? আর আমরা জিহাদের জন্য আমীরের হাতে বাইয়াতকে ইমামের হাতে বাইয়াত মনে করি না এবং উক্ত জিহাদের বাইয়াতের পক্ষে ইমামের বাইয়াতের কোন দলীল উপস্থাপন করি না। বরং জিহাদের বাইয়াতের মূল দলীল হচ্ছে, ফিকহের একটি গুরোত্বপূর্ণ মূলনীতি;
“যে বস্তু ছাড়া ওয়াজিব বিধান পরিপূর্ণ আদায় হয় না, তাহলে উক্ত বস্তু ওয়াজিব হয়ে যায়।”
উক্ত মূলনীতির ব্যাপারে চার মাযহাব মোটামুটি একমত।[12]
তবে শাইখের বাকি তিন বক্তব্যের ব্যাপারে আমাদের কিছু অবুঝা রয়ে গেছে;
প্রথম বক্তব্যের ব্যাপারে কথা হচ্ছে, শাইখ রহ. ইমাম ও আমীর উভয় শব্দকে এক করে ফেলেছেন। ফলাফল-স্বরূপ কয়েকজন ব্যক্তির বাইয়াতের মাধ্যমে যেভাবে কেউ ইমাম হয়ে যায় না, তদ্রূপ আমীরও হতে পারে না। অথচ আমাদের জানামতে ইমাম এবং আমীর শব্দদুটি ‘ইমামত’ শাস্ত্রের দুইটি পরিভাষা। উভয়ের মাঝে কিছুটা পার্থক্য রয়েছ। সাধারণত ইমাম শব্দ দ্বারা খলীফা বুঝায়; বিপরিতে আমীর শব্দটি শাসক, গভর্নর, এবং নির্দিষ্ট কোন দল, জাতি বা শাখার নেতার অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।[13]
আমরা হাদীসে ‘ইমারত’ ও ‘আমীর’ শব্দদ্বয় ‘খেলাফত’ ও ‘খলীফা’ ছাড়া ছোটখাটো নেতৃত্বের ব্যাপারে ব্যবহৃত হতে দেখি। আব্দুল্লাহ বিন আমর রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
“তিনজন ব্যক্তির জন্য জায়েয নয় যে, তারা কোন মরুভূমিতে থাকবে; অথচ তাদের মধ্য হতে একজনকে আমীর নির্ধারণ করেননি।”[14]
আবু সাঈদ খুদরী রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
“যখন তিনজন ব্যক্তি সফরে বের হয়, তাদের একজনকে যেন আমীর বানিয়ে নেয়।”[15]
উক্ত হাদীসদ্বয়ে সফরে তিনজনের ছোট এক জামাআতের জন্য একজন আমীর বানানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অথচ উক্ত আমীরের ক্ষেত্রে ইমামুল মুসলিমীনের সকল শর্ত যে প্রযোজ্য হবে না, তা বলাই বাহুল্য।
আবু হুরায়রা রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
“যে আমার আনুগত্য করল, সে আল্লাহর আনুগত্য করল। যে আমার অবাধ্যতা করল, সে আল্লাহর অবাধ্যতা করল। আর যে আমার আমীরের আনুগত্য করল, সে আমার আনুগত্য করল। যে আমার আমীরের অবাধ্যতা করল, সে আমার অবাধ্যতা করল।”[16]
হাদীসের শব্দ থেকেই বুঝে আসে যে, এখানে আমীর দ্বারা খলীফা উদ্ধেশ্য নয়। বরং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উক্ত হাদীসটি মুজাহিদের একটি দলকে উদ্ধেশ্য করে বলেছেন।[17]
ফকীহ ও মুহাদ্দিসদের মতেও আমীর শব্দটি যেমন খলীফার ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়, তদ্রূপ খেলাফত ও ইমামতের নিচের পর্যায়ের দায়িত্বশীলের ক্ষেত্রেও আমীর শব্দ ব্যবহার হয় এবং উক্ত এমারতের জন্য ইমামতের সকল শর্ত পাওয়া জরুরী নয়।[18]
তাই যেমন হাদীসে আমীর শব্দ আসলেই তা দ্বারা খলীফা উদ্ধেশ্য হওয়া জরুরী নয়। তদ্রূপ আমীর হওয়ার জন্য ‘কুওয়াতে কাহেরা’ শর্ত নয়।
শাইখের দ্বিতীয় বক্তব্যের ব্যাপারে কথা হচ্ছে, সম্ভবত শাইখ এখানে “এমন আমীরকে বাইয়াত দেওয়া, আনুগত্য করা এবং তার সাথে মিলে জিহাদ করা মুসলিমদের উপর ওয়াজিব নয়” দ্বারা মূলত বুঝাতে চাচ্ছেন যে, মুসলিমদের উপর খলীফাকে বাইয়াত দেওয়া, আনুগত্য করা এবং তার সাথে মিলে জিহাদ করা যেভাবে ওয়াজিব, উক্ত আমীরকে বাইয়াত দেওয়া সেভাবে ওয়াজিব নয়। যদি এমনটি উদ্ধেশ্য হয়ে থাকে, তাহলে এ ব্যাপারে কোন আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু যখন জিহাদ ফরযে আইন হয়ে যায় এবং উক্ত ফরয পূর্ণভাবে আদায়ের জন্য একজনকে আমীর বানানোর প্রয়োজন পড়ে, তখন কি জিহাদের ফরযিয়াত পূর্ণভাবে আদায়ের জন্য একজন আমীরের হাতে জিহাদের বাইয়াত দেওয়া ওয়াজিব হবে না! এবং জিহাদ ও তৎসংশ্লিষ্ট বিষয়ে উক্ত আমীরের আনুগত্য করা ও তার সাথে মিলে জিহাদ ওয়াজিব হবে না!
উল্লেখ্য: শাইখ এখানে এমন আমীরের সাথে মিলে জিহাদ করা ওয়াজিব না হওয়ার মাসআলা বললেও এমন আমীরের সাথে জিহাদ করা জায়েয হবে কি’না, এ মাসআলাটি বলেননি।
শাইখের চতুর্থ যে বক্তব্য, “মুসলিমদের উপর ওয়াজিব হচ্ছে, শক্তি ও সামর্থ-বিশিষ্ট শাসক খোঁজে বের করা” এ ব্যাপারে সোজাসাপ্টা কথা হচ্ছে, যখন পুরো দুনিয়ায় কোথাও খেলাফত নেই, কোথাও কোন শরয়ী খলীফা নেই, এমতাবস্থায় আমরা খলীফা কোথায় খোঁজবো? খলিফা কি অটোমেটিকভাবে কোথাও থেকে আবির্ভাব হবে যে, তাকে খোঁজলে পাওয়া যাবে? নাকি শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে খলীফা বানাতে হয়? শক্তিপ্রয়েগ ছাড়া আদৌ কি খেলাফত প্রতিষ্টা ও খলীফা হওয়া সম্ভব? ইসলামের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত শক্তিপ্রয়োগ ছাড়া একজনও কি খলীফা হতে পেরেছিলেন?
ফলাফল হচ্ছে, জিহাদ ছাড়া নসবুল ইমাম সম্ভব নয়। ইমাম ছাড়া জিহাদ জায়েয নয়। আবার নসবুল ইমাম এবং জিহাদ উভয়টি ফরয আমল; ছাড়ারও সুযোগ নেই, করারও সুযোগ নেই। আমরা এ কোন চক্রের গোলকধাঁধায় ঢুকলাম!
[1] এ’লাউস সুনান: ১২/৮
[2] এ’লাউস সুনান: ১২/৪
[3] সুনানে আবু দাউদ: ২৫৩৩, সুনানে বায়হাকী ৬/৮২, শুআবুল ঈমান: ১১/৪৪৩। ইমাম বায়হাকী রহ. বলেন, “উক্ত হাদীসের সনদ সহীহ। তবে ‘মাকহুল রহ. আবু হুরায়রা রাদি. এর সাক্ষাত পাননি। তাই সনদে বিচ্ছিন্নতা আছে।”
উল্লেখ্য: উক্ত হাদীসের মর্ম অন্যন্য হাদীসে বর্ণিত হওয়ার কারণে সকল সনদ মিলিয়ে হাদীসের মূল বক্তব্য প্রমাণীত বলা যায়। -মারিফাতুস সুনানি ওয়াল আসার: ৪/২১৪, নসবুর রায়াহ: ২/২৬-২৯, এ’লাউস সুনান: ১২/৪-৬
[4] এলাউস সুনান: ১২/৪
[5] আল-আকীদাতুত তাহাবিয়্যাহ: ২৩
[6] আল-ইকনা’: ১/১৪৪
[7] এ’লাউস সুনান: ৪/১৯২
[8] মাফাতীহ শরহে মাসাবীহ: ১/১৫১
[9] শরহুল মিশকাত লিততীবী: ৪/১১৫৬
[10] শাইখের এবারত ইতিপূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি।
[11] এলাউস সুনান: ১২/৫
[12] আল-বাহরুর রায়েক: ১/৬৪, আয-যাখীরাহ: ১০/২৩, আল-মাজমূ’: ১/১২৪, আল-মুগনী: ২/২২০
[13] রদ্দুল মুহতার: ১/৫৪৮, রাওযাতুত তালেবীন: ১০/৪৯, আল-মিসবাহুল মুনীর: ১/২৩
[14] মুসনাদে আহমদ: ৬৬৪৭, মু’জামে কাবীর: ১৩/৫৭। হাইসামী রহ. বলেন, উক্ত সনদে ‘ইবনে লাহীআ’ নামক এক বর্ণনাকারী আছেন। তার হাদীস ‘হাসান’ পর্যায়ের। তবে মুসনাদে আহমদের বাকি বর্ণনাকারীরা সহীহ হাদীসের বর্ণনাকারী। -মাজমাউয যাওয়ায়েদ: ৪/৮২
[15] সুনানে আবু দাউদ: ২৬০৮, মু’জামে আওসাত: ৮/১০০, মুসনাদে আবু ইয়া’লা: ২/৩১৯, সুনানে বায়হাকী: ১০/৫৪৫। নববি রহ. হাদীসটিকে ‘হাসান’ বলেছেন। মুনযিরি রহ. হাদীসটির ব্যাপারে কোন মন্তব্য করেননি। -রিয়াযুস সালেহীন: পৃ: ২৯৯, মুখতাসারে আবু দাউদ: ২/১৭৭
[16] সহীহ বুখারী: ৭১৩৭, সহীহ মুসলিম: ১৮৩৫
[17] ফাতহুল বারী: ১৩/১১২
[18] আল-আহকামুস সুলতানিয়া; মাওয়ারদী: ৬৯, আল-আহকামুস সুলতানিয়া; আবু ইয়া’লা: ৩৯, মাজমূউল ফাতাওয়া: ২৮/৩৯০, নাইলুল আওতার: ৮/২৯৪
শুরুতে একটি কথা বলে রাখি, উক্ত শর্তের প্রবক্তরা একদিকে জিহাদের সংজ্ঞা ব্যাপক করলেও অন্যদিকে শুধু কিতালের জন্য ইমামকে শর্ত করেন; জিহাদের অন্য ক্ষেত্রের জন্য নয়।[1] কিন্তু শর্ত হওয়ার পক্ষে যে দলীল উপস্থাপন করেন, তা থেকে এমন বিশ্লেষণ বুঝে আসে না।
উক্ত সংশয়ের পক্ষে যে দলীলসমূহ উপস্থাপন করা হয়, তা হচ্ছে নিম্নোরূপ;
প্রথম দলীল: আবু হুরায়রা রাদি. এর হাদীস।[2]
আবু হুরায়রা রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
الجِهادُ واجِبٌ عَلَيكُم مَعَ كُلِّ أميرٍ، بَرًّا كان أو فاجِرًا، والصَّلاةُ واجِبَةٌ عَلَيكُم خَلفَ كُلَّ مُسلِمٍ، بَرًّا كان أو فاجِرًا وإِن عَمِلَ الكبائرَ، والصَّلاةُ واجِبَةٌ على كُلِّ مُسلِمٍ بَرًّا كان أو فاجِرًا وإِن عَمِلَ الكبائرَ.
“প্রত্যেক শাসকের সাথে জিহাদ করা তোমাদের উপর ওয়াজিব, হোক সে সৎ বা অসৎ। প্রত্যেক মুসলিমের পিছনে নামায পড়া তোমাদের উপর ওয়াজিব, হোক সে সৎ বা অসৎ; যদিও সে কবীরা গুণাহ করে থাকে। প্রত্যেক মুসলিমের জানাযা পড়া তোমাদের উপর ওয়াজিব, হোক সে সৎ বা অসৎ; যদি সে কবীরা গুণাহ করে থাকে।”[3]
উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় শাইখ যাফর আহমদ উসমানী রহ. (১৩৯৪ হি.) বলেন,
وفي الحديث دلالة على اشتراط الأمير للجهاد وأنه لا يصح بدونه؛ لقوله : «الجهاد واجب عليكم مع كل أمير إلخ» فإذا لم يكن للمسلمين إمام فلا جهاد ، نعم يجب على المسلمين أن يلتمسوا لهم أميرا.
“হাদীসে ‘জিহাদের জন্য ইমাম শর্ত’ এবং ‘ইমাম ছাড়া জিহাদ সহীহ নয়’ -এর প্রমাণ রয়েছে। কেননা তাঁর (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বানী হলো, “প্রত্যেক আমীরের সাথে তোমাদের উপর জিহাদ ওয়াজিব”। তো যখন মুসলিমদের কোন ইমাম থাকবে না, তখন আর জিহাদ নেই। হ্যাঁ, তখন মুসলিমদের উপর ওয়াজিব হলো, তাদের জন্য একজন আমীর অনুসন্ধান করা।”[4]
প্রথমেই বলে রাখি, উক্ত হাদীসের উপর সনদগত আপত্তি থাকলেও একাধিক সনদে বর্ণিত হওয়ার কারণে মুহাদ্দিসগণ হাদীসটি প্রমাণীত বলেছেন। ফলে তা আকীদার কিতাবেও স্থান পেয়েছে।[5] তাই হাদীসের আলোচিত অংশটি প্রমাণীত ধরেই উক্ত হাদীস থেকে আলোচিত মাসআলার প্রমাণ্যতা নিয়ে পর্যালোচনা করার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।
এক. উক্ত হাদীসের তিনটি অংশ রয়েছে; নেককার ও বদকার আমীরের সাথে জিহাদ করা, নেককার ও বদকার ইমামের পিছনে নামায পড়া এবং নেককার ও বদকার ব্যক্তির জানাযার নামায পড়া। তিনটি বিধান একসাথে একই ধাঁচে উল্লেখিত হয়েছে। তাই উসূল অনুযায়ী হাদীসের তিন অংশ থেকে একই ধরনের হুকুম প্রমাণীত হওয়ার কথা। হাদীসের প্রথম অংশ থেকে জিহাদের জন্য আমীর শর্ত প্রমাণীত হলে হাদীসের দ্বিতীয় অংশ থেকে নামাযের জন্য ইমাম শর্ত প্রমাণীত হওয়ার কথা। আর জানা কথা, নামাযের জন্য ইমাম শর্ত হওয়ার অর্থ হচ্ছে, নামাযের জন্য জামাআত শর্ত। কেননা জামাআত ছাড়া নামাযে ইমাম হওয়ার কোন সম্ভাবনাই নেই। কিন্তু আমাদের জানা মতে, নামাযের জন্য জামাত ফরয, ওয়াজিব না সুন্নত- এ ব্যাপারে ইমামদের মাঝে মতভেদ থাকলেও কারও মতে নামায সহীহ হওয়ার জন্য ইমাম বা জামাত শর্ত নয়।[6] বরং শাইখ নিজে জামাআতের অধ্যায়ে উক্ত হাদীস থেকে নামাযের জন্য জামাআত ওয়াজিব হওয়ার হুকুম বের করেছেন; জামাআত ছাড়া নামায সহীহ হবে না- এমন হুকুম বের করেননি।[7]
তাই হাদীসের এক অংশ থেকে এক বিধান প্রমাণ করা এবং একই ধরনের অন্য অংশ থেকে উক্ত বিধান প্রমাণ না করে ভিন্ন বিধান প্রমাণ করা উসূলী দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের কাছে বোধগম্য নয়।
দুই. যে হাদীসটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইমামের ফিসকের বাহানায় জিহাদ ছাড়ার অযুহাত খণ্ডন করার জন্য বলেছেন এবং মুহাদ্দিস ও ফকীহগণ একই উদ্ধেশ্যে স্বস্ব কিতাবে উল্লেখ করেছেন, সে হাদীস থেকে ‘জিহাদের জন্য ইমাম শর্ত’ প্রমাণ করে জিহাদকে কার্যত অকেজ করা বা জিহাদ ছাড়ার বাহানা বের করা হচ্ছে! কোন ফকীহ বা মুহাদ্দিস উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় ‘জিহাদের জন্য ইমাম শর্ত’ এমন কোন কথা বলেননি। যদি উক্ত হাদীস থেকে ‘জিহাদের জন্য ইমাম বা আমীর শর্ত’ বুঝে আসতো, তাহলে ফকীহগণ অবশ্যই তা উল্লেখ করতেন। বরং হাদীসের ব্যাখ্যাকারীগণ উক্ত হাদীসের আলোকে ‘আমীর ফাসেক হলেও জিহাদ করতে হবে’ এমনটিই বলেছেন।
‘মাসাবীহুস সুন্নাহ’ এর প্রশিদ্ধ ব্যাখ্যাকার মুজহিরী হানাফী রহ. (৭২৭ হি.) বলেন,
لا يجوز ترك الجهاد بأن يكون الإمام ظالمًا، بل يجب على الناس موافقة الإمام في الجهاد وإن كان ظالمًا؛ لقوله عليه السلام: "الجهاد واجب عليكم مع كلِّ أميرٍ بَرًا كان أو فاجرًا".
“শাসক জালিম হওয়ার কারণে জিহাদ তরক করা জায়েয নয়। বরং শাসক জালিম হলেও তার সাথে মিলে জিহাদ করা মানুষের উপর ওয়াজিব। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘প্রত্যেক আমীরের সাথে মিলে জিহাদ করা তোমাদের উপর ওয়াজিব; হোক সে নেককার বা বদকার’।”[8]
‘মিশকাতুল মাসাবীহ’ এর ব্যাখ্যাকার শারাফুদ্দীন তীবী রহ. (৭৪৩ হি.) বলেন,
أقول: في ظاهر كل قرينة دلالة علي وجوب أمر وجواز آخر، فالأولي تدل علي وجوب الجهاد علي المسلمين، وعلي جواز كون الفاسق أميرا، والثانية تدل علي وجوب الصلاة بالجماعة عليهم، وجواز أن يكون الفاجر إماما، والثالثة علي وجوب الصلاة عليهم وعلي جواز صدورها عن الفاجر، هذا ظاهر الحديث.
“আমার মতে, প্রত্যেক বাক্যের বাহ্যিক থেকে একটি বিষয় ওয়াজিব এবং অন্য বিষয়টি জায়েজ প্রমাণীত হয়। প্রথম বাক্য মুসলিমদের উপর জিহাদ ওয়াজিব এবং ফাসেক শাসকের সাথে জিহাদ জায়েজ প্রমাণ বহন করে। দ্বিতীয় বাক্য জামাআতে নামায পড়া ওয়াজিব এবং ফাসেক ইমামের পিছনে নামায পড়া জায়েয প্রমাণ বহন করে। তৃতীয় বাক্য মুসলিমদের জানাযা পড়া ওয়াজিব এবং জানাযা ফাসেকের উপর প্রকাশ পাওয়া জায়েয হওয়ার উপর প্রমাণ বহন করে। এ হচ্ছে, হাদীসের বাহ্যিক মর্ম।”[9]
তিন. উক্ত হাদীস থেকে জিহাদের জন্য আমীর শর্ত হওয়ার মত গ্রহণ করে নিলেও ‘জিহাদের জন্য আমীর শর্ত’ প্রমাণীত হয়; ‘জিহাদের জন্য ইমাম শর্ত’ প্রমাণীত হয় না। কিন্তু শাইখ আমীরের উপর ইমামুল মুসলিমীনের সকল শর্ত জোড়ে দিয়েছেন এবং জিহাদের জন্য এমন আমীর শর্ত করেছেন, যার মাঝে ইমামুল মুসলিমীনের সকল শর্ত বিদ্যমান থাকা আবশ্যক।[10]
শাইখের আরেকটি বক্তব্যের পর্যালোচনা
প্রসঙ্গত শাইখের আরেকটি এবারত নিয়ে একটু পর্যালোচনা করে নেই। শাইখ রহ. আরেকটু সামনে গিয়ে বলেন,
قلت : فلو بايع العلماء أو جماعة من المسلمين رجلا لا يقدر على سد الثغور وحماية البيضة وجر العساكر وتنفيذ الأحكام بشوكته وبأسه ولا على إنصاف المظلوم من الظالم بقدرته وسطوته لا يكون ذلك أميرا ولا إماما ، وإنما هو بمنزلة الحكم ومبايعة الناس له منزلة التحكيم ولا يجدى تسميته إماما أو أميرا في القراطيس وأفواه الناس فإن مدار الإمارة والإمامة على القوة والقدرة دون التسمية والشهرة فقط ، فلا يجب على عامة المسلمين مبايعته ولا إطاعة أحكامه ، ولا الجهاد معه ولا يسقط بمبايعته مثله واجب نصب الإمام عن ذمة المسلمين ، بل عليهم أن يلتمسوا لهم واليا قادرا بالقدرة التي مر ذكرها.
“আমি বলব, যদি আলেমরা বা মুসলিম জামাআত কোন ব্যক্তির কাছে বায়আত দেয়, যে সীমানা পাহারা দেওয়া, ভূমি হেফাজত করা, জিহাদের জন্য সৈন্য পাঠানো ও বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ইসলামের বিধিবিধান প্রয়োগ করতে এবং শক্তি ও সামর্থের ভিত্তিতে জালিম থেকে মাজলুমের হক বুঝিয়ে দিতে সক্ষম নয়, তাহলে সে আমীরও হবে না ইমামও হবে না। বরং সে হচ্ছে ‘হাকাম’ এর মত এবং মানুষ তাকে যে বায়আত দিয়েছে, তা ‘তাহকীম’ এর মত। এক্ষেত্রে কাগজে-কলমে বা লোকমুখে আমীর বা ইমাম উচ্চারিত হওয়া কোন ফলপ্রসূ হবে না। কেননা এমারত ও ইমামত এর ভিত্তি হচ্ছে, শক্তি ও সামর্থের উপর; শুধু নাম বা প্রসিদ্ধির উপর নয়। তাই জনসাধারণের উপর তাকে বায়আত দেওয়া, তার আনুগত্য করা ও তার সাথে জিহাদ করা ওয়াজিব হবে না এবং তাকে বায়আত দেওয়ার দ্বারা মুসলিমদের দায়িত্ব থেকে ‘নসবুল ইমাম’ এর ওয়াজিব আদায় হবে না। বরং তাদের উপর ওয়াজিব হচ্ছে, উল্লেখিত শর্তসমৃদ্ধ কোন শাসক খোঁজে বের করা।”[11]
উল্লেখ্য: ফিকহের পরিভাষায় দুই পক্ষের সন্তুষ্টিতে কাউকে বিচারক বানানোকে ‘তাহকীম’ এবং নিয়োগকৃত ব্যক্তিকে ‘হাকাম’ বলে।
শাইখ উক্ত এবারতে কয়েকটি বিষয় দাবী করেছেন;
ক. শুধু কয়েকজনের বাইয়াতের মাধ্যমে কেউ আমীর বা ইমাম হয়ে যায় না। বরং সর্বোচ্চ তাকে ‘হাকাম’ বলা যেতে পারে। কেননা আমীর বা ইমাম হওয়ার জন্য ‘কুওয়াতে কাহেরা’ তথা শত্রুকে পরাভূত করতে পারার মত শক্তি ও সামর্থ শর্ত।
খ. তাই এমন আমীরকে বাইয়াত দেওয়া, আনুগত্য করা এবং তার সাথে মিলে জিহাদ করা মুসলিমদের উপর ওয়াজিব নয়।
গ. এমন আমীরকে বাইয়াত দেওয়ার মাধ্যমে মুসলিমদের যিম্মা থেকে ‘নসবুল ইমাম’ এর ফরযিয়াত আদায় হবে না।
ঘ. মুসলিমদের উপর ওয়াজিব হচ্ছে, শক্তি ও সামর্থ-বিশিষ্ট শাসক খোঁজে বের করা।
শাইখের তৃতীয় বক্তব্যের সাথে আমাদের কোন দ্বিমত নেই। কেননা যদি জিহাদের আমীরকে বাইয়াত দেওয়ার মাধ্যমে ‘নসবুল ইমাম’ এর ফরযিয়াত আদায় হয়ে যায়, তাহলে খেলাফত প্রতিষ্টা করার জন্য জিহাদ করার কি দরকার? আর আমরা জিহাদের জন্য আমীরের হাতে বাইয়াতকে ইমামের হাতে বাইয়াত মনে করি না এবং উক্ত জিহাদের বাইয়াতের পক্ষে ইমামের বাইয়াতের কোন দলীল উপস্থাপন করি না। বরং জিহাদের বাইয়াতের মূল দলীল হচ্ছে, ফিকহের একটি গুরোত্বপূর্ণ মূলনীতি;
وما لا يتم الواجب إلا به فهو واجب
“যে বস্তু ছাড়া ওয়াজিব বিধান পরিপূর্ণ আদায় হয় না, তাহলে উক্ত বস্তু ওয়াজিব হয়ে যায়।”
উক্ত মূলনীতির ব্যাপারে চার মাযহাব মোটামুটি একমত।[12]
তবে শাইখের বাকি তিন বক্তব্যের ব্যাপারে আমাদের কিছু অবুঝা রয়ে গেছে;
প্রথম বক্তব্যের ব্যাপারে কথা হচ্ছে, শাইখ রহ. ইমাম ও আমীর উভয় শব্দকে এক করে ফেলেছেন। ফলাফল-স্বরূপ কয়েকজন ব্যক্তির বাইয়াতের মাধ্যমে যেভাবে কেউ ইমাম হয়ে যায় না, তদ্রূপ আমীরও হতে পারে না। অথচ আমাদের জানামতে ইমাম এবং আমীর শব্দদুটি ‘ইমামত’ শাস্ত্রের দুইটি পরিভাষা। উভয়ের মাঝে কিছুটা পার্থক্য রয়েছ। সাধারণত ইমাম শব্দ দ্বারা খলীফা বুঝায়; বিপরিতে আমীর শব্দটি শাসক, গভর্নর, এবং নির্দিষ্ট কোন দল, জাতি বা শাখার নেতার অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।[13]
আমরা হাদীসে ‘ইমারত’ ও ‘আমীর’ শব্দদ্বয় ‘খেলাফত’ ও ‘খলীফা’ ছাড়া ছোটখাটো নেতৃত্বের ব্যাপারে ব্যবহৃত হতে দেখি। আব্দুল্লাহ বিন আমর রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
وَلَا يَحِلُّ لِثَلَاثَةِ نَفَرٍ يَكُونُونَ بِأَرْضِ فَلَاةٍ إِلَّا أَمَّرُوا عَلَيْهِمْ أَحَدَهُمْ.
“তিনজন ব্যক্তির জন্য জায়েয নয় যে, তারা কোন মরুভূমিতে থাকবে; অথচ তাদের মধ্য হতে একজনকে আমীর নির্ধারণ করেননি।”[14]
আবু সাঈদ খুদরী রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
إِذَا خَرَجَ ثَلَاثَةٌ فِي سَفَرٍ فَلْيُؤَمِّرُوا أَحَدَهُمْ.
“যখন তিনজন ব্যক্তি সফরে বের হয়, তাদের একজনকে যেন আমীর বানিয়ে নেয়।”[15]
উক্ত হাদীসদ্বয়ে সফরে তিনজনের ছোট এক জামাআতের জন্য একজন আমীর বানানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অথচ উক্ত আমীরের ক্ষেত্রে ইমামুল মুসলিমীনের সকল শর্ত যে প্রযোজ্য হবে না, তা বলাই বাহুল্য।
আবু হুরায়রা রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«مَنْ أَطَاعَنِي فَقَدْ أَطَاعَ اللَّهَ، وَمَنْ عَصَانِي فَقَدْ عَصَى اللَّهَ، وَمَنْ أَطَاعَ أَمِيرِي فَقَدْ أَطَاعَنِي، وَمَنْ عَصَى أَمِيرِي فَقَدْ عَصَانِي»
“যে আমার আনুগত্য করল, সে আল্লাহর আনুগত্য করল। যে আমার অবাধ্যতা করল, সে আল্লাহর অবাধ্যতা করল। আর যে আমার আমীরের আনুগত্য করল, সে আমার আনুগত্য করল। যে আমার আমীরের অবাধ্যতা করল, সে আমার অবাধ্যতা করল।”[16]
হাদীসের শব্দ থেকেই বুঝে আসে যে, এখানে আমীর দ্বারা খলীফা উদ্ধেশ্য নয়। বরং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উক্ত হাদীসটি মুজাহিদের একটি দলকে উদ্ধেশ্য করে বলেছেন।[17]
ফকীহ ও মুহাদ্দিসদের মতেও আমীর শব্দটি যেমন খলীফার ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়, তদ্রূপ খেলাফত ও ইমামতের নিচের পর্যায়ের দায়িত্বশীলের ক্ষেত্রেও আমীর শব্দ ব্যবহার হয় এবং উক্ত এমারতের জন্য ইমামতের সকল শর্ত পাওয়া জরুরী নয়।[18]
তাই যেমন হাদীসে আমীর শব্দ আসলেই তা দ্বারা খলীফা উদ্ধেশ্য হওয়া জরুরী নয়। তদ্রূপ আমীর হওয়ার জন্য ‘কুওয়াতে কাহেরা’ শর্ত নয়।
শাইখের দ্বিতীয় বক্তব্যের ব্যাপারে কথা হচ্ছে, সম্ভবত শাইখ এখানে “এমন আমীরকে বাইয়াত দেওয়া, আনুগত্য করা এবং তার সাথে মিলে জিহাদ করা মুসলিমদের উপর ওয়াজিব নয়” দ্বারা মূলত বুঝাতে চাচ্ছেন যে, মুসলিমদের উপর খলীফাকে বাইয়াত দেওয়া, আনুগত্য করা এবং তার সাথে মিলে জিহাদ করা যেভাবে ওয়াজিব, উক্ত আমীরকে বাইয়াত দেওয়া সেভাবে ওয়াজিব নয়। যদি এমনটি উদ্ধেশ্য হয়ে থাকে, তাহলে এ ব্যাপারে কোন আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু যখন জিহাদ ফরযে আইন হয়ে যায় এবং উক্ত ফরয পূর্ণভাবে আদায়ের জন্য একজনকে আমীর বানানোর প্রয়োজন পড়ে, তখন কি জিহাদের ফরযিয়াত পূর্ণভাবে আদায়ের জন্য একজন আমীরের হাতে জিহাদের বাইয়াত দেওয়া ওয়াজিব হবে না! এবং জিহাদ ও তৎসংশ্লিষ্ট বিষয়ে উক্ত আমীরের আনুগত্য করা ও তার সাথে মিলে জিহাদ ওয়াজিব হবে না!
উল্লেখ্য: শাইখ এখানে এমন আমীরের সাথে মিলে জিহাদ করা ওয়াজিব না হওয়ার মাসআলা বললেও এমন আমীরের সাথে জিহাদ করা জায়েয হবে কি’না, এ মাসআলাটি বলেননি।
শাইখের চতুর্থ যে বক্তব্য, “মুসলিমদের উপর ওয়াজিব হচ্ছে, শক্তি ও সামর্থ-বিশিষ্ট শাসক খোঁজে বের করা” এ ব্যাপারে সোজাসাপ্টা কথা হচ্ছে, যখন পুরো দুনিয়ায় কোথাও খেলাফত নেই, কোথাও কোন শরয়ী খলীফা নেই, এমতাবস্থায় আমরা খলীফা কোথায় খোঁজবো? খলিফা কি অটোমেটিকভাবে কোথাও থেকে আবির্ভাব হবে যে, তাকে খোঁজলে পাওয়া যাবে? নাকি শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে খলীফা বানাতে হয়? শক্তিপ্রয়েগ ছাড়া আদৌ কি খেলাফত প্রতিষ্টা ও খলীফা হওয়া সম্ভব? ইসলামের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত শক্তিপ্রয়োগ ছাড়া একজনও কি খলীফা হতে পেরেছিলেন?
ফলাফল হচ্ছে, জিহাদ ছাড়া নসবুল ইমাম সম্ভব নয়। ইমাম ছাড়া জিহাদ জায়েয নয়। আবার নসবুল ইমাম এবং জিহাদ উভয়টি ফরয আমল; ছাড়ারও সুযোগ নেই, করারও সুযোগ নেই। আমরা এ কোন চক্রের গোলকধাঁধায় ঢুকলাম!
[1] এ’লাউস সুনান: ১২/৮
[2] এ’লাউস সুনান: ১২/৪
[3] সুনানে আবু দাউদ: ২৫৩৩, সুনানে বায়হাকী ৬/৮২, শুআবুল ঈমান: ১১/৪৪৩। ইমাম বায়হাকী রহ. বলেন, “উক্ত হাদীসের সনদ সহীহ। তবে ‘মাকহুল রহ. আবু হুরায়রা রাদি. এর সাক্ষাত পাননি। তাই সনদে বিচ্ছিন্নতা আছে।”
উল্লেখ্য: উক্ত হাদীসের মর্ম অন্যন্য হাদীসে বর্ণিত হওয়ার কারণে সকল সনদ মিলিয়ে হাদীসের মূল বক্তব্য প্রমাণীত বলা যায়। -মারিফাতুস সুনানি ওয়াল আসার: ৪/২১৪, নসবুর রায়াহ: ২/২৬-২৯, এ’লাউস সুনান: ১২/৪-৬
[4] এলাউস সুনান: ১২/৪
[5] আল-আকীদাতুত তাহাবিয়্যাহ: ২৩
[6] আল-ইকনা’: ১/১৪৪
[7] এ’লাউস সুনান: ৪/১৯২
[8] মাফাতীহ শরহে মাসাবীহ: ১/১৫১
[9] শরহুল মিশকাত লিততীবী: ৪/১১৫৬
[10] শাইখের এবারত ইতিপূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি।
[11] এলাউস সুনান: ১২/৫
[12] আল-বাহরুর রায়েক: ১/৬৪, আয-যাখীরাহ: ১০/২৩, আল-মাজমূ’: ১/১২৪, আল-মুগনী: ২/২২০
[13] রদ্দুল মুহতার: ১/৫৪৮, রাওযাতুত তালেবীন: ১০/৪৯, আল-মিসবাহুল মুনীর: ১/২৩
[14] মুসনাদে আহমদ: ৬৬৪৭, মু’জামে কাবীর: ১৩/৫৭। হাইসামী রহ. বলেন, উক্ত সনদে ‘ইবনে লাহীআ’ নামক এক বর্ণনাকারী আছেন। তার হাদীস ‘হাসান’ পর্যায়ের। তবে মুসনাদে আহমদের বাকি বর্ণনাকারীরা সহীহ হাদীসের বর্ণনাকারী। -মাজমাউয যাওয়ায়েদ: ৪/৮২
[15] সুনানে আবু দাউদ: ২৬০৮, মু’জামে আওসাত: ৮/১০০, মুসনাদে আবু ইয়া’লা: ২/৩১৯, সুনানে বায়হাকী: ১০/৫৪৫। নববি রহ. হাদীসটিকে ‘হাসান’ বলেছেন। মুনযিরি রহ. হাদীসটির ব্যাপারে কোন মন্তব্য করেননি। -রিয়াযুস সালেহীন: পৃ: ২৯৯, মুখতাসারে আবু দাউদ: ২/১৭৭
[16] সহীহ বুখারী: ৭১৩৭, সহীহ মুসলিম: ১৮৩৫
[17] ফাতহুল বারী: ১৩/১১২
[18] আল-আহকামুস সুলতানিয়া; মাওয়ারদী: ৬৯, আল-আহকামুস সুলতানিয়া; আবু ইয়া’লা: ৩৯, মাজমূউল ফাতাওয়া: ২৮/৩৯০, নাইলুল আওতার: ৮/২৯৪
Comment