দ্বিতীয় দলীল: হুযায়ফা রাদি. এর হাদীস।[1]
হুযায়ফা বিন ইয়ামান রাদি. বলেন,
“মানুষ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে ভালো (শরিয়তের বিধিবিধান) বিষয়ে জানতে চায়, আর আমি মন্দ বিষয়ে জানতে চাই; যাতে না মন্দ আমাকে পেয়ে বসে।[2]
আমি জানতে চাইলাম, হে আল্লাহর রাসূল, আমরা জাহিলিয়্যাতের মন্দ অবস্থায় ছিলাম। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এই কল্যাণ (ইসলাম) দিলেন। উক্ত কল্যাণের পরে কি কোন মন্দ (অবস্থা) আছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ।
আমি বললাম, উক্ত মন্দের পরে কি কোন কল্যাণ আছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, তবে তাতে ধোঁয়া আছে। (অর্থাৎ উক্ত কল্যাণ আগের মত নির্ভেজাল হবে না; বরং এতে কিছু আবর্জনা থেকে যাবে)
আমি বললাম, ধোঁয়া কি? তিনি বললেন, কিছু মানুষ এমন হবে, যারা আমার রাস্তায় চলবে না। তাদের কিছু কাজ তুমি চিনলেও কিছু কাজ চিনবে না। (অর্থাৎ জায়েয না-জায়েয উভয় ধরনের কাজ করবে।)
আমি বললাম, উক্ত কল্যাণের পরে কি কোন মন্দ আছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, জাহান্নামের দরজাসমূহের দিকে (অর্থাৎ ভ্রষ্টতার দিকে) আহ্বানকারী হবে। যে তাদের ডাকে সাড়া দিবে তারা তাকে উক্ত জাহান্নামে (অর্থাৎ ভ্রষ্টতায়) ফেলে দিবে।
আমি বললাম, আমাদের জন্য তাদের পরিচয় বলে দিন (যাতে আমরা তাদের থেকে দূরে থাকতে পারি)। তিনি বললেন, তারা আমাদের বংশেরই হবে এবং আমাদের ভাষায়ই কথা বলবে।
আমি বললাম, ঐ সময় আমাকে পেয়ে গেলে আপনি আমাকে কি দিকনির্দেশনা দিবেন? তিনি বললেন, মুসলিমদের জামাআত এবং তাদের ইমামকে আকড়ে ধরো।
আমি বললাম, যদি মুসলিমদের কোন জামাআত এবং ইমাম না থাকেন? তিনি বললেন, উক্ত সকল দল থেকে দূরে থাকো; যদিও এতে গাছের শিকড়ে কামড় দিয়ে থাকতে হয় আর এ অবস্থায় তোমার মৃত্যু এসে যায়।”[3]
উক্ত হাদীস উল্লেখ করে শাইখ যাফর আহমদ উসমানী রহ. বলেন,
“উক্ত হাদীসের সারাংশ হচ্ছে, মুসলিম ব্যক্তি ইমাম ও আমীর ছাড়া কোন জামাআতে থাকলে, তার জন্য বিধান হচ্ছে, সে উক্ত দল থেকে পৃথক হয়ে ব্যক্তিগত বিষয়ে সীমাবদ্ধ থাকা। সে জিহাদ ও এ জাতীয় কাজ, যা জামাআত ছাড়া পূর্ণ হয় না, তা করতে আদিষ্ট নয়। ভালো করে বুঝে নাও।”[4]
উল্লেখ্য: উক্ত হাদীসে ‘জামাআতুল মুসলিমীন’ দ্বারা এমন জামাআত উদ্ধেশ্য, যার ইমাম আছেন; যেকোন জামাআত উদ্ধেশ্য নয়। হাদীস থেকে এমনই বুঝে আসে।[5]
উক্ত হাদীস দ্বারা জিহাদ সহীহ হওয়ার জন্য ইমাম শর্ত হওয়ার ব্যাপারে যে দলীল দেওয়া হয়েছে, এর জবাবে বলবো;
এক. হাদীসের শব্দ একেবারে ব্যাপক। যদি আমরা উক্ত হাদীসকে বর্তমান সময় ও পরিস্থিতিতে প্রয়োগ করি, তাহলে শব্দের ব্যাপকতার দাবী অনুযায়ী খলীফা না থাকা অবস্থায় সমষ্টিগত চিন্তা বাদ দিয়ে শুধুমাত্র ব্যক্তিকেন্দ্রিক বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে। উক্ত ব্যাপকতা অনুযায়ী বর্তমানের সমষ্টিগত কোন কাজ, যেমন তা’লীম ও তাদরীস, তারবিয়া ও তাযকিয়া, দাওয়াত ও তাবলীগ ইত্যাদি কিছুই করা যাবে না।
কিন্তু শাইখ রহ. উক্ত ব্যাপকতাকে একটু সঙ্কীর্ণ করে এমন কাজের সাথে নির্দিষ্ট করেছেন “যা জামাআত ছাড়া পূর্ণ হয় না”। উক্ত শর্ত আরোপের ফলাফল-স্বরূপ উল্লেখিত কাজসমূহ হাদীসের অন্তর্ভুক্ত হবে না এবং ইমাম ও আমীর না থাকাবস্থায়ও তা সহীহ হয়ে যাবে। কিন্তু এতে আমাদের আপত্তি থেকে যায়;
ক. শাইখের পক্ষ হতে আরোপিত শর্তের ভিত্তি কী? কেননা যদি আমরা খাইখের উক্ত শর্ত বিনাবাক্যে মেনে নেই, তাহলে আরেকজন এসে অন্য আরেকটি শর্ত আরোপ করলে, তা প্রত্যাখ্যান করবো কীভাবে? বিপরীতে আমরা এভাবে সবার পক্ষ হতে সকল শর্ত মেনে নিলে, তখন আর হাদীসের মর্ম খুঁজে পাওয়া যাবে না।
খ. “যা জামাআত ছাড়া পূর্ণ হয় না” এমন কাজের মাঝে জুমআ’, ঈদ ইত্যাদি রয়েছে। তাহলে কি উক্ত হাদীসের আলোকে ইমাম ও আমীরের অনুপস্থিতিতে তা সহীহ হবে না? কেননা উক্ত এবাদতসমূহ জামাআত ছাড়া সহীহ হয় না।
গ. শাইখ এমন কাজের কথা বলেননি, “যা জামাআত ছাড়া সহীহ হয় না”; বরং এমন কাজের কথা বলেছেন, “যা জামাআত ছাড়া পূর্ণ হয় না”। কোন কাজ সহীহ হয়ে গেলেই তা পূর্ণতায় পৌঁছে না। আর জানা কথা, দাওয়াত ও তাবলীগ ইত্যাদি আমলসমূহ জামাআত ছাড়া সহীহ হলেও তা জামাআত ছাড়া পূর্ণ হয় না। তাই শাইখের ব্যাখ্যা অনুযায়ী খলীফার অনুপস্থিতিতে দাওয়াত, তাবলীগ ইত্যাদি করাও সহীহ হবে না!
আর যদি বলা হয় যে, আসলে শাইখের উদ্ধেশ্য খলীফার অনুপস্থিতিতে এমন কাজ নাকচ করা, যা খলীফা ছাড়া অন্য কেউ করার চেষ্টা করলে অনৈক্য ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিবে। ফলে উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি হবে। তাই খেলাফত প্রতিষ্টা পর্যন্ত উক্ত কাজগুলো বিলম্ব করা হবে। যদি শাইখ বাস্তবে এমনটিই বুঝিয়ে থাকেন, তাহলে তখন মূল দলীল দাঁড়াবে অনৈক্য ও বিশৃঙ্খলা; হুযায়ফা রাদি. এর হাদীস নয়।
অনৈক্য ও বিশৃঙ্খলার দলীলের উপর আমাদের পর্যালোচনা সামনে আসছে ইনশাআল্লাহ।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, শাইখ রহ. হুযায়ফা রাদি. এর হাদীসের প্রয়োগক্ষেত্র যদিও এমন কাজের সাথে সংযুক্ত করেছেন, “যা জামাআত ছাড়া পূর্ণ হয় না”। তবে শাইখ রহ. মূলত এ দ্বারা একমাত্র ইমামের উপস্থিতিকে জিহাদের সাথে নির্দিষ্ট করেছেন।
শাইখ রহ. অন্যত্র বলেন,
“ইবনে হাজার আসকালানী বলেন, সঠিক মত হচ্ছে, মৌলিকভাবে কাফেরদের সাথে জিহাদ করা; হোক তা হাত, জিহ্বা, সম্পদ অথবা অন্তর দ্বারা, তা প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরয। আসকালানীর কথা এখানে শেষ।
আমি বলবো, কোন একজন ফকীহও বলেননি যে, ইমাম ছাড়া কাফেরদের সাথে জিহাদ করা ফরয। তাই প্রমাণীত হলো যে, হাত দ্বারা জিহাদ ওয়াজিব হওয়ার বিধান ইমাম থাকার সাথে শর্তযুক্ত। ভালো করে বুঝে নাও।”[6]
শাইখ রহ. এখানে জিহাদের অন্যান্য প্রকারের জন্য ইমামকে শর্তযুক্ত না করা; বরং শুধু সশস্ত্র জিহাদের জন্য ইমামকে শর্তযুক্ত করা এ কথার প্রতি ইঙ্গিত করে যে, “এ জাতীয় কাজ, যা জামাআত ছাড়া পূর্ণ হয় না” দ্বারা মূলত একমাত্র সশস্ত্র জিহাদকে বুঝিয়েছেন।
দুই. জাবির বিন আব্দুল্লাহ রাদি. বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি,
“কিয়ামত পর্যন্ত আমার উম্মতের এক দল সর্বদা হকের উপর লড়াই করে বিজয়ী থাকবে।”[7]
উক্ত হাদীস দ্বারা প্রমাণীত হয় যে, কিয়ামত পর্যন্ত এক দল সর্বদা হকের উপর অটল থাকবে এবং হকের পক্ষে জিহাদ করে যাবে। অথচ এটাও বাস্তবতা যে, কিয়ামত পর্যন্ত সর্বদা খলীফা ও খেলাফত থাকবে না। তাই খলীফার অনুপস্থিতকালীন সময়ে যদি বলা হয় যে, উক্ত হক দল তখনও আছে, তাহলে শাইখের দলীল ঠিক থাকবে না। কেননা তাদের প্রধান কাজ হচ্ছে, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা। আর শাইখের দাবী হচ্ছে, ইমামের অনুপস্থিতিতে জিহাদ করা জায়েয নয়। আর যদি বলা হয় যে, তখন উক্ত হক দল নেই, তাহলে –নাঊযুবিল্লাহ- হাদীস মিথ্যা হওয়া আবশ্যক হবে।
উল্লেখ্য: জাবির রাদি. এর উক্ত হাদীসকে ইমাম থাকার শর্তে শর্তযুক্ত করা সঠিক হবে না। কেননা হাদীসের মূল উদ্ধেশ্যই হচ্ছে, এমন এক দলের মহত্ব ও মর্যাদা বর্ণনা করা, যারা সর্বদা হকের উপর অটল থাকবে; কোন ফেতনা তাদেরকে তাদের দীন থেকে হঠাতে পারবে না। এখন যদি ফেতনার সময় তাদের অস্থিত্বই না থাকে, তাহলে তাদের ফযীলতের মূল কারণই থাকলো না।
তদ্রূপ তাদের জিহাদ করার বৈশিষ্টকে ইমাম থাকার সাথে শর্তযুক্ত করা সঠিক হবে না। কেননা “কিয়ামত পর্যন্ত ও সর্বদা” হাদীসের শব্দদ্বয় তা নাকচ করে দেয়।
তিন. তাহলে হুযায়ফা রাদি. এর হাদীসের আসল ব্যাখ্যা ও প্রয়োগক্ষেত্র।
এখন আমরা হুযায়ফা রাদি. এর হাদীসের আসল ব্যাখ্যা ও প্রয়োগক্ষেত্র মুহাদ্দিস ও হাদীসের ব্যাখ্যাকারগণের বক্তব্য থেকে বুঝার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।
উক্ত হাদীসের দুটি ব্যাখ্যা হতে পারে;
ক. উক্ত হাদীসে “উক্ত সকল দলসমূহ” দ্বারা বাতেল দলসমূহ বুঝানো হয়েছে। তখন হাদীসের মর্ম হবে, “তুমি উক্ত সকল বাতেল দলসমূহ থেকে দূরে থাকো”। উক্ত ব্যাখ্যার প্রতি হাদীসের আগের অংশ থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায়। আগের অংশ হচ্ছে, ধোঁয়াযুক্ত কল্যাণের পর এমন এক মন্দ যুগ আসবে, যে সময় জাহান্নামের দিকে আহ্বানকারীরা থাকবে। তখন মুসলিমদের জামাআত ও ইমাম থাকলে তা আকড়ে ধরো। এর পর বলা হয়েছে, মুসলিমদের জামাআত ও ইমাম না থাকাবস্থায় উক্ত দলসমূহ থেকে দূরে থাকো। স্পষ্টতই এখানে ‘উক্ত দলসমূহ’ দ্বারা আগে উল্লেখিত জাহান্নামের দিকে আহ্বানকারী ফেতনার দলসমূহ বুঝানো হয়েছে।
মোল্লা আলী কারী রহ. (১০১৪ হি.) বলেন,
“তিনি বলেন, তুমি উক্ত সকল দলসমূহ ত্যাগ করো।’ অর্থাৎ পথভ্রষ্ট দলসমূহ, যা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের রাস্তা থেকে ছিটকে পড়েছে।”[8]
তাই উক্ত সময় আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আকীদাপোষণকারী কোন জামাআত থাকলে তাদের থেকে দূরে থাকার আদেশ হাদীসে দেওয়া হয়নি। সর্বোচ্চ বলা যায় যে, খলীফার অনুপস্থিতিতে হক জামাআতে যুক্ত হওয়া বা দূরে থাকার ব্যাপারে হাদীসে কোন নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। তাই এমতাবস্থায় কোন হক দল থাকলে, তাদের সাথে যুক্ত হওয়া যাবে কি’না- তা অন্য দলীলের ভিত্তিতে সমাধান হবে; উক্ত হাদীস থেকে নয়।
খ. হাদীসে “উক্ত দলসমূহ” দ্বারা ইমামের অনুপস্থিতিতে খেলাফত অর্জনের জন্য মুসলিমদের মাঝে পরস্পর যুদ্ধরত দলসমূহ বুঝানো হয়েছে।
আবুল আব্বাস কুরতুবী রহ. (৬৫৬ হি.) বলেন,
“হাদীসের শব্দ ‘উক্ত দলসমূহ থেকে দূরে থাকো’, তাতে ফেতনার সময় দূরে থাকার আদেশ করা হয়েছে। উক্ত আদেশ ওয়াজিব ও বাধ্যতামূলক। কেননা তা ছাড়া দীন নিরাপদ থাকবে না। উক্ত দূরে থাকা হচ্ছে, বিভিন্ন দলসমূহের মাঝে খেলাফতের বাইয়াত সংগঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত কারও সাথে যুক্ত না হওয়া। তবে ‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আকদ’ খেলাফতের বৈশিষ্ট ও গুণগত যোগ্য কাউকে বাইয়াত দিলে তার জন্য খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে এবং তার অবাধ্যতা করা সবার জন্য হারাম হয়ে যাবে। যদি আহলুল হাল্লি ওয়াল আকদের মাঝে মতানৈক্য দেখা দেয় এবং (এর প্রেক্ষিতে) তারা দুইজনকে খেলাফতের বাইয়াত দেন, যেমনটি আব্দুল্লাহ বিন যুবাইর রাদি. ও মারওয়ান বিন হাকাম রহ. এর ক্ষেত্রে হয়েছিলো, তাহলে প্রথমজন প্রধান্য পাবেন।”[9]
ইবনে হাজার আসকালানী রহ. (৮৫২ হি.) বলেন,
“তাবারী রহ. বলেন, সঠিক মতানুযায়ী হাদীসের মর্ম হচ্ছে, যার খেলাফতের ব্যাপারে সকলে ঐক্যমত পূষণ করেছেন, তার অনুগত দলের সাথে যুক্ত থাকা আবশ্যক। যে তার বাইয়াত ভঙ্গ করবে, সে জামাআত থেকে বের হয়ে যাবে। তিনি আরও বলেন, হাদীসে এরও প্রমাণ রয়েছে যে, মানুষের যখন কোন ইমাম থাকবে না এবং মানুষ দলে দলে বিভক্ত হয়ে পড়বে, তখন ফেরকাবন্দীর ক্ষেত্রে কারও অনুসরণ করবে না; বরং অনিষ্টতায় পতিত হওয়ার শঙ্কায় সকল দল থেকে সামর্থানুযায়ী দূরে থাকবে। অন্যান্য হাদীসসমূহে বর্ণিত মর্ম উক্ত ব্যাখ্যার উপর প্রয়োগ করা হবে এবং উক্ত ব্যাখ্যার মাধ্যমে বাহ্যিক বৈপরীত্য হাদীসসমূহের মাঝে সামঞ্জস্য হয়ে যাবে। উক্ত ব্যাখ্যাকে আব্দুর রাহমান বিন কুরায রাদি. এর হাদীস আরও শক্তিশালী করে।”[10]
গ. উক্ত হাদীসের আরেকটি ব্যাখ্যা হতে পারে, উক্ত হাদীস দ্বারা এমন সময় বুঝানো হয়েছে, যখন ফেতনা-ফাসাদে দুনিয়া ভরে যাবে। কেউ কারও কথা শুনতে চাইবে না এবং এর সংশোধন করাও সম্ভব না। যে সময়ের বিবরণ আমরা নিম্নোক্ত হাদীস থেকে কিছুটা আঁচ করতে পারি।
আবু হুরায়রা রাদি. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন,
“কিয়ামত ততক্ষণ পর্যন্ত কায়েম হবে না, …. যতক্ষণ না নারীর সাথে দিনে প্রকাশ্যে রাস্তার মাঝখানে যিনা করা হবে। কেউ তাতে বাধা বা ব্যাঘাত দিবে না। সেদিন সর্বোত্তম ব্যক্তি সে হবে, যে বলবে, যদি রাস্তা থেকে একটু সরিয়ে যেতে! তাদের মধ্য হতে উক্ত ব্যক্তি তোমাদের আবু বকর ও উমরের মত হবে।”[11]
যখন পৃথিবীর এমন অবস্থা হবে তখন নিজের দীন ও ঈমান বাঁচানোর লক্ষ্যে সকল লোক থেকে বিচ্ছন্ন হয়ে একাকী জীবনযাপন করা হবে হাদীসের উদ্ধেশ্য। আল্লাহু আ’লাম।
যাই হোক, উক্ত হাদীসের মর্ম কখনও এ নয় যে, খেলাফত বিলুপ্ত বা খলীফাশূণ্য হলেই সকল কাজ বাদ দিয়ে একাকী জীবনযাপন এবং ব্যক্তিকেন্দ্রীক হয়ে যেতে হবে। আমাদের জানামতে হাদীসের এমন ব্যাখ্যা কেউই করেননি। অন্যথায় উক্ত অবস্থায় মুসলিমদের গুরোত্বপূর্ণ অন্যান্য ফরয আমলসমূহ কীভাবে আদায় করা হবে এবং বিশেষ করে খেলাফত প্রতিষ্ঠার ফরয দায়িত্ব কীভাবে আদায় হবে?
[1] এ’লাউস সুনান: ১২/৪
[2] ফেতনার ব্যাপারে জানার এটাই ফায়দা যে, ফেতনা যখন প্রকাশ পায় এবং মানুষ আগে থেকে ফেতনার ব্যাপারে সতর্ক থাকে, তাহলে ফেতনার অনিষ্টতা থেকে রক্ষা পাবে। -তুহফাতুল কারী: ৭/১৫৪
[3] সহীহ বুখারী: ৩৬০৬, সহীহ মুসলিম: ১৮৪৭
[4] এলাউস সুনান: ১২/৫
[5] ফাইযুল বারী: ৬/৪৫৯
[6] এ’লাউস সুনান: ১২/৮
[7] সহীহ মুসলিম: ১৫৬
[8] মিরকাতুল মাফাতীহ: ১০/১০
[9] আল-মুফহিম: ৪/৫৭
[10] ফাতহুল বারী: ১৩/৩৭
[11] মুসতাদরাকে হাকিম: ৪/৫৪১। ইমাম হাকিম রহ. সহীহ বলেছেন। তবে যাহাবী রহ. উক্ত হাদীসকে উপকথার মত বলেছেন। আরও দেখুৃন: ইতহাফুল জামাআহ: ২/১৪৭
হুযায়ফা বিন ইয়ামান রাদি. বলেন,
كَانَ النَّاسُ يَسْأَلُونَ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنِ الخَيْرِ، وَكُنْتُ أَسْأَلُهُ عَنِ الشَّرِّ مَخَافَةَ أَنْ يُدْرِكَنِي، فَقُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّا كُنَّا فِي جَاهِلِيَّةٍ وَشَرٍّ، فَجَاءَنَا اللَّهُ بِهَذَا الخَيْرِ، فَهَلْ بَعْدَ هَذَا الخَيْرِ مِنْ شَرٍّ؟ قَالَ: «نَعَمْ» قُلْتُ: وَهَلْ بَعْدَ ذَلِكَ الشَّرِّ مِنْ خَيْرٍ؟ قَالَ: «نَعَمْ، وَفِيهِ دَخَنٌ» قُلْتُ: وَمَا دَخَنُهُ؟ قَالَ: «قَوْمٌ يَهْدُونَ بِغَيْرِ هَدْيِي، تَعْرِفُ مِنْهُمْ وَتُنْكِرُ» قُلْتُ: فَهَلْ بَعْدَ ذَلِكَ الخَيْرِ مِنْ شَرٍّ؟ قَالَ: «نَعَمْ، دُعَاةٌ إِلَى أَبْوَابِ جَهَنَّمَ، مَنْ أَجَابَهُمْ إِلَيْهَا قَذَفُوهُ فِيهَا» قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، صِفْهُمْ لَنَا؟ فَقَالَ: «هُمْ مِنْ جِلْدَتِنَا، وَيَتَكَلَّمُونَ بِأَلْسِنَتِنَا» قُلْتُ: فَمَا تَأْمُرُنِي إِنْ أَدْرَكَنِي ذَلِكَ؟ قَالَ: تَلْزَمُ جَمَاعَةَ المُسْلِمِينَ وَإِمَامَهُمْ، قُلْتُ: فَإِنْ لَمْ يَكُنْ لَهُمْ جَمَاعَةٌ وَلاَ إِمَامٌ؟ قَالَ «فَاعْتَزِلْ تِلْكَ الفِرَقَ كُلَّهَا، وَلَوْ أَنْ تَعَضَّ بِأَصْلِ شَجَرَةٍ، حَتَّى يُدْرِكَكَ المَوْتُ وَأَنْتَ عَلَى ذَلِكَ»
“মানুষ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে ভালো (শরিয়তের বিধিবিধান) বিষয়ে জানতে চায়, আর আমি মন্দ বিষয়ে জানতে চাই; যাতে না মন্দ আমাকে পেয়ে বসে।[2]
আমি জানতে চাইলাম, হে আল্লাহর রাসূল, আমরা জাহিলিয়্যাতের মন্দ অবস্থায় ছিলাম। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এই কল্যাণ (ইসলাম) দিলেন। উক্ত কল্যাণের পরে কি কোন মন্দ (অবস্থা) আছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ।
আমি বললাম, উক্ত মন্দের পরে কি কোন কল্যাণ আছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, তবে তাতে ধোঁয়া আছে। (অর্থাৎ উক্ত কল্যাণ আগের মত নির্ভেজাল হবে না; বরং এতে কিছু আবর্জনা থেকে যাবে)
আমি বললাম, ধোঁয়া কি? তিনি বললেন, কিছু মানুষ এমন হবে, যারা আমার রাস্তায় চলবে না। তাদের কিছু কাজ তুমি চিনলেও কিছু কাজ চিনবে না। (অর্থাৎ জায়েয না-জায়েয উভয় ধরনের কাজ করবে।)
আমি বললাম, উক্ত কল্যাণের পরে কি কোন মন্দ আছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, জাহান্নামের দরজাসমূহের দিকে (অর্থাৎ ভ্রষ্টতার দিকে) আহ্বানকারী হবে। যে তাদের ডাকে সাড়া দিবে তারা তাকে উক্ত জাহান্নামে (অর্থাৎ ভ্রষ্টতায়) ফেলে দিবে।
আমি বললাম, আমাদের জন্য তাদের পরিচয় বলে দিন (যাতে আমরা তাদের থেকে দূরে থাকতে পারি)। তিনি বললেন, তারা আমাদের বংশেরই হবে এবং আমাদের ভাষায়ই কথা বলবে।
আমি বললাম, ঐ সময় আমাকে পেয়ে গেলে আপনি আমাকে কি দিকনির্দেশনা দিবেন? তিনি বললেন, মুসলিমদের জামাআত এবং তাদের ইমামকে আকড়ে ধরো।
আমি বললাম, যদি মুসলিমদের কোন জামাআত এবং ইমাম না থাকেন? তিনি বললেন, উক্ত সকল দল থেকে দূরে থাকো; যদিও এতে গাছের শিকড়ে কামড় দিয়ে থাকতে হয় আর এ অবস্থায় তোমার মৃত্যু এসে যায়।”[3]
উক্ত হাদীস উল্লেখ করে শাইখ যাফর আহমদ উসমানী রহ. বলেন,
فتلخص منه أن المسلم إذا كان في جماعة ليس لهم إمام وأمير فهو مأمور بالاعتزال واللزوم بخاصة نفسه، وليس بمأمور بالجهاد وما يشبهه من الأمور مما لا يتم بدون الجماعة فافهم.
“উক্ত হাদীসের সারাংশ হচ্ছে, মুসলিম ব্যক্তি ইমাম ও আমীর ছাড়া কোন জামাআতে থাকলে, তার জন্য বিধান হচ্ছে, সে উক্ত দল থেকে পৃথক হয়ে ব্যক্তিগত বিষয়ে সীমাবদ্ধ থাকা। সে জিহাদ ও এ জাতীয় কাজ, যা জামাআত ছাড়া পূর্ণ হয় না, তা করতে আদিষ্ট নয়। ভালো করে বুঝে নাও।”[4]
উল্লেখ্য: উক্ত হাদীসে ‘জামাআতুল মুসলিমীন’ দ্বারা এমন জামাআত উদ্ধেশ্য, যার ইমাম আছেন; যেকোন জামাআত উদ্ধেশ্য নয়। হাদীস থেকে এমনই বুঝে আসে।[5]
উক্ত হাদীস দ্বারা জিহাদ সহীহ হওয়ার জন্য ইমাম শর্ত হওয়ার ব্যাপারে যে দলীল দেওয়া হয়েছে, এর জবাবে বলবো;
এক. হাদীসের শব্দ একেবারে ব্যাপক। যদি আমরা উক্ত হাদীসকে বর্তমান সময় ও পরিস্থিতিতে প্রয়োগ করি, তাহলে শব্দের ব্যাপকতার দাবী অনুযায়ী খলীফা না থাকা অবস্থায় সমষ্টিগত চিন্তা বাদ দিয়ে শুধুমাত্র ব্যক্তিকেন্দ্রিক বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে। উক্ত ব্যাপকতা অনুযায়ী বর্তমানের সমষ্টিগত কোন কাজ, যেমন তা’লীম ও তাদরীস, তারবিয়া ও তাযকিয়া, দাওয়াত ও তাবলীগ ইত্যাদি কিছুই করা যাবে না।
কিন্তু শাইখ রহ. উক্ত ব্যাপকতাকে একটু সঙ্কীর্ণ করে এমন কাজের সাথে নির্দিষ্ট করেছেন “যা জামাআত ছাড়া পূর্ণ হয় না”। উক্ত শর্ত আরোপের ফলাফল-স্বরূপ উল্লেখিত কাজসমূহ হাদীসের অন্তর্ভুক্ত হবে না এবং ইমাম ও আমীর না থাকাবস্থায়ও তা সহীহ হয়ে যাবে। কিন্তু এতে আমাদের আপত্তি থেকে যায়;
ক. শাইখের পক্ষ হতে আরোপিত শর্তের ভিত্তি কী? কেননা যদি আমরা খাইখের উক্ত শর্ত বিনাবাক্যে মেনে নেই, তাহলে আরেকজন এসে অন্য আরেকটি শর্ত আরোপ করলে, তা প্রত্যাখ্যান করবো কীভাবে? বিপরীতে আমরা এভাবে সবার পক্ষ হতে সকল শর্ত মেনে নিলে, তখন আর হাদীসের মর্ম খুঁজে পাওয়া যাবে না।
খ. “যা জামাআত ছাড়া পূর্ণ হয় না” এমন কাজের মাঝে জুমআ’, ঈদ ইত্যাদি রয়েছে। তাহলে কি উক্ত হাদীসের আলোকে ইমাম ও আমীরের অনুপস্থিতিতে তা সহীহ হবে না? কেননা উক্ত এবাদতসমূহ জামাআত ছাড়া সহীহ হয় না।
গ. শাইখ এমন কাজের কথা বলেননি, “যা জামাআত ছাড়া সহীহ হয় না”; বরং এমন কাজের কথা বলেছেন, “যা জামাআত ছাড়া পূর্ণ হয় না”। কোন কাজ সহীহ হয়ে গেলেই তা পূর্ণতায় পৌঁছে না। আর জানা কথা, দাওয়াত ও তাবলীগ ইত্যাদি আমলসমূহ জামাআত ছাড়া সহীহ হলেও তা জামাআত ছাড়া পূর্ণ হয় না। তাই শাইখের ব্যাখ্যা অনুযায়ী খলীফার অনুপস্থিতিতে দাওয়াত, তাবলীগ ইত্যাদি করাও সহীহ হবে না!
আর যদি বলা হয় যে, আসলে শাইখের উদ্ধেশ্য খলীফার অনুপস্থিতিতে এমন কাজ নাকচ করা, যা খলীফা ছাড়া অন্য কেউ করার চেষ্টা করলে অনৈক্য ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিবে। ফলে উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি হবে। তাই খেলাফত প্রতিষ্টা পর্যন্ত উক্ত কাজগুলো বিলম্ব করা হবে। যদি শাইখ বাস্তবে এমনটিই বুঝিয়ে থাকেন, তাহলে তখন মূল দলীল দাঁড়াবে অনৈক্য ও বিশৃঙ্খলা; হুযায়ফা রাদি. এর হাদীস নয়।
অনৈক্য ও বিশৃঙ্খলার দলীলের উপর আমাদের পর্যালোচনা সামনে আসছে ইনশাআল্লাহ।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, শাইখ রহ. হুযায়ফা রাদি. এর হাদীসের প্রয়োগক্ষেত্র যদিও এমন কাজের সাথে সংযুক্ত করেছেন, “যা জামাআত ছাড়া পূর্ণ হয় না”। তবে শাইখ রহ. মূলত এ দ্বারা একমাত্র ইমামের উপস্থিতিকে জিহাদের সাথে নির্দিষ্ট করেছেন।
শাইখ রহ. অন্যত্র বলেন,
قال: والتحقيق أن جنس جهاد الكفار متعين على كل مسلم، إما بيده وإما بلسانه وإما بماله وإما بقلبه انتهي. قلت: ولم يقل أحد إنه -أي قتال الكفار- يجب بدون الإمام، فثبت أن وجوب الجهاد باليد مشروط بوجوده فافهم.
“ইবনে হাজার আসকালানী বলেন, সঠিক মত হচ্ছে, মৌলিকভাবে কাফেরদের সাথে জিহাদ করা; হোক তা হাত, জিহ্বা, সম্পদ অথবা অন্তর দ্বারা, তা প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরয। আসকালানীর কথা এখানে শেষ।
আমি বলবো, কোন একজন ফকীহও বলেননি যে, ইমাম ছাড়া কাফেরদের সাথে জিহাদ করা ফরয। তাই প্রমাণীত হলো যে, হাত দ্বারা জিহাদ ওয়াজিব হওয়ার বিধান ইমাম থাকার সাথে শর্তযুক্ত। ভালো করে বুঝে নাও।”[6]
শাইখ রহ. এখানে জিহাদের অন্যান্য প্রকারের জন্য ইমামকে শর্তযুক্ত না করা; বরং শুধু সশস্ত্র জিহাদের জন্য ইমামকে শর্তযুক্ত করা এ কথার প্রতি ইঙ্গিত করে যে, “এ জাতীয় কাজ, যা জামাআত ছাড়া পূর্ণ হয় না” দ্বারা মূলত একমাত্র সশস্ত্র জিহাদকে বুঝিয়েছেন।
দুই. জাবির বিন আব্দুল্লাহ রাদি. বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি,
«لَا تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِي يُقَاتِلُونَ عَلَى الْحَقِّ ظَاهِرِينَ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ»
“কিয়ামত পর্যন্ত আমার উম্মতের এক দল সর্বদা হকের উপর লড়াই করে বিজয়ী থাকবে।”[7]
উক্ত হাদীস দ্বারা প্রমাণীত হয় যে, কিয়ামত পর্যন্ত এক দল সর্বদা হকের উপর অটল থাকবে এবং হকের পক্ষে জিহাদ করে যাবে। অথচ এটাও বাস্তবতা যে, কিয়ামত পর্যন্ত সর্বদা খলীফা ও খেলাফত থাকবে না। তাই খলীফার অনুপস্থিতকালীন সময়ে যদি বলা হয় যে, উক্ত হক দল তখনও আছে, তাহলে শাইখের দলীল ঠিক থাকবে না। কেননা তাদের প্রধান কাজ হচ্ছে, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা। আর শাইখের দাবী হচ্ছে, ইমামের অনুপস্থিতিতে জিহাদ করা জায়েয নয়। আর যদি বলা হয় যে, তখন উক্ত হক দল নেই, তাহলে –নাঊযুবিল্লাহ- হাদীস মিথ্যা হওয়া আবশ্যক হবে।
উল্লেখ্য: জাবির রাদি. এর উক্ত হাদীসকে ইমাম থাকার শর্তে শর্তযুক্ত করা সঠিক হবে না। কেননা হাদীসের মূল উদ্ধেশ্যই হচ্ছে, এমন এক দলের মহত্ব ও মর্যাদা বর্ণনা করা, যারা সর্বদা হকের উপর অটল থাকবে; কোন ফেতনা তাদেরকে তাদের দীন থেকে হঠাতে পারবে না। এখন যদি ফেতনার সময় তাদের অস্থিত্বই না থাকে, তাহলে তাদের ফযীলতের মূল কারণই থাকলো না।
তদ্রূপ তাদের জিহাদ করার বৈশিষ্টকে ইমাম থাকার সাথে শর্তযুক্ত করা সঠিক হবে না। কেননা “কিয়ামত পর্যন্ত ও সর্বদা” হাদীসের শব্দদ্বয় তা নাকচ করে দেয়।
তিন. তাহলে হুযায়ফা রাদি. এর হাদীসের আসল ব্যাখ্যা ও প্রয়োগক্ষেত্র।
এখন আমরা হুযায়ফা রাদি. এর হাদীসের আসল ব্যাখ্যা ও প্রয়োগক্ষেত্র মুহাদ্দিস ও হাদীসের ব্যাখ্যাকারগণের বক্তব্য থেকে বুঝার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।
উক্ত হাদীসের দুটি ব্যাখ্যা হতে পারে;
ক. উক্ত হাদীসে “উক্ত সকল দলসমূহ” দ্বারা বাতেল দলসমূহ বুঝানো হয়েছে। তখন হাদীসের মর্ম হবে, “তুমি উক্ত সকল বাতেল দলসমূহ থেকে দূরে থাকো”। উক্ত ব্যাখ্যার প্রতি হাদীসের আগের অংশ থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায়। আগের অংশ হচ্ছে, ধোঁয়াযুক্ত কল্যাণের পর এমন এক মন্দ যুগ আসবে, যে সময় জাহান্নামের দিকে আহ্বানকারীরা থাকবে। তখন মুসলিমদের জামাআত ও ইমাম থাকলে তা আকড়ে ধরো। এর পর বলা হয়েছে, মুসলিমদের জামাআত ও ইমাম না থাকাবস্থায় উক্ত দলসমূহ থেকে দূরে থাকো। স্পষ্টতই এখানে ‘উক্ত দলসমূহ’ দ্বারা আগে উল্লেখিত জাহান্নামের দিকে আহ্বানকারী ফেতনার দলসমূহ বুঝানো হয়েছে।
মোল্লা আলী কারী রহ. (১০১৪ হি.) বলেন,
أي (قال: "فاعتزل تلك الفرق كلها") ، أي: الفرق الضالة الواقعة على خلاف الجادة من طريق أهل السنة والجماعة
“তিনি বলেন, তুমি উক্ত সকল দলসমূহ ত্যাগ করো।’ অর্থাৎ পথভ্রষ্ট দলসমূহ, যা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের রাস্তা থেকে ছিটকে পড়েছে।”[8]
তাই উক্ত সময় আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আকীদাপোষণকারী কোন জামাআত থাকলে তাদের থেকে দূরে থাকার আদেশ হাদীসে দেওয়া হয়নি। সর্বোচ্চ বলা যায় যে, খলীফার অনুপস্থিতিতে হক জামাআতে যুক্ত হওয়া বা দূরে থাকার ব্যাপারে হাদীসে কোন নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। তাই এমতাবস্থায় কোন হক দল থাকলে, তাদের সাথে যুক্ত হওয়া যাবে কি’না- তা অন্য দলীলের ভিত্তিতে সমাধান হবে; উক্ত হাদীস থেকে নয়।
খ. হাদীসে “উক্ত দলসমূহ” দ্বারা ইমামের অনুপস্থিতিতে খেলাফত অর্জনের জন্য মুসলিমদের মাঝে পরস্পর যুদ্ধরত দলসমূহ বুঝানো হয়েছে।
আবুল আব্বাস কুরতুবী রহ. (৬৫৬ হি.) বলেন,
وقوله فاعتزل تلك الفرق كلَّها، هذا أمرٌ بالاعتزال عند الفتن، وهو على جهة الوجوب لأنه لا يَسلَمُ الدِّينُ إلاَّ بذلك، وهذا الاعتزال عبارة عن ترك الانتماء إلى من لم تتم إمامته من الفرق المختلفة، فلو بايع أهل الحل والعقد لواحدٍ موصوف بشروط الإمامة لانعقدت له الخلافة وحرمت على كل أحدٍ المخالفة، فلو اختلف أهل الحل والعقد فعقدوا لإمامين كما اتفق لابن الزبير ومروان لكان الأول هو الأرجح كما تقدَّم.
“হাদীসের শব্দ ‘উক্ত দলসমূহ থেকে দূরে থাকো’, তাতে ফেতনার সময় দূরে থাকার আদেশ করা হয়েছে। উক্ত আদেশ ওয়াজিব ও বাধ্যতামূলক। কেননা তা ছাড়া দীন নিরাপদ থাকবে না। উক্ত দূরে থাকা হচ্ছে, বিভিন্ন দলসমূহের মাঝে খেলাফতের বাইয়াত সংগঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত কারও সাথে যুক্ত না হওয়া। তবে ‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আকদ’ খেলাফতের বৈশিষ্ট ও গুণগত যোগ্য কাউকে বাইয়াত দিলে তার জন্য খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে এবং তার অবাধ্যতা করা সবার জন্য হারাম হয়ে যাবে। যদি আহলুল হাল্লি ওয়াল আকদের মাঝে মতানৈক্য দেখা দেয় এবং (এর প্রেক্ষিতে) তারা দুইজনকে খেলাফতের বাইয়াত দেন, যেমনটি আব্দুল্লাহ বিন যুবাইর রাদি. ও মারওয়ান বিন হাকাম রহ. এর ক্ষেত্রে হয়েছিলো, তাহলে প্রথমজন প্রধান্য পাবেন।”[9]
ইবনে হাজার আসকালানী রহ. (৮৫২ হি.) বলেন,
قال الطبري: والصواب أن المراد من الخبر لزوم الجماعة الذين في طاعة من اجتمعوا على تأميره، فمن نكث بيعته خرج عن الجماعة، قال: وفي الحديث أنه متى لم يكن للناس إمام فافترق الناس أحزابا فلا يتبع أحدا في الفرقة ويعتزل الجميع إن استطاع ذلك خشية من الوقوع في الشر، وعلى ذلك يتنزل ما جاء في سائر الأحاديث، وبه يجمع بين ما ظاهره الاختلاف منها، ويؤيده رواية عبد الرحمن بن قرط المتقدم ذكرها،
“তাবারী রহ. বলেন, সঠিক মতানুযায়ী হাদীসের মর্ম হচ্ছে, যার খেলাফতের ব্যাপারে সকলে ঐক্যমত পূষণ করেছেন, তার অনুগত দলের সাথে যুক্ত থাকা আবশ্যক। যে তার বাইয়াত ভঙ্গ করবে, সে জামাআত থেকে বের হয়ে যাবে। তিনি আরও বলেন, হাদীসে এরও প্রমাণ রয়েছে যে, মানুষের যখন কোন ইমাম থাকবে না এবং মানুষ দলে দলে বিভক্ত হয়ে পড়বে, তখন ফেরকাবন্দীর ক্ষেত্রে কারও অনুসরণ করবে না; বরং অনিষ্টতায় পতিত হওয়ার শঙ্কায় সকল দল থেকে সামর্থানুযায়ী দূরে থাকবে। অন্যান্য হাদীসসমূহে বর্ণিত মর্ম উক্ত ব্যাখ্যার উপর প্রয়োগ করা হবে এবং উক্ত ব্যাখ্যার মাধ্যমে বাহ্যিক বৈপরীত্য হাদীসসমূহের মাঝে সামঞ্জস্য হয়ে যাবে। উক্ত ব্যাখ্যাকে আব্দুর রাহমান বিন কুরায রাদি. এর হাদীস আরও শক্তিশালী করে।”[10]
গ. উক্ত হাদীসের আরেকটি ব্যাখ্যা হতে পারে, উক্ত হাদীস দ্বারা এমন সময় বুঝানো হয়েছে, যখন ফেতনা-ফাসাদে দুনিয়া ভরে যাবে। কেউ কারও কথা শুনতে চাইবে না এবং এর সংশোধন করাও সম্ভব না। যে সময়ের বিবরণ আমরা নিম্নোক্ত হাদীস থেকে কিছুটা আঁচ করতে পারি।
আবু হুরায়রা রাদি. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন,
لَا تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى لَا يَبْقَى عَلَى وَجْهِ الْأَرْضِ أَحَدٌ لِلَّهِ فِيهِ حَاجَةٌ، وَحَتَّى تُوجَدَ الْمَرْأَةُ نَهَارًا جِهَارًا تُنْكَحُ وَسَطَ الطَّرِيقِ، لَا يُنْكِرُ ذَلِكَ أَحَدٌ وَلَا يُغَيِّرَهُ، فَيَكُونُ أَمْثَلَهُمْ يَوْمَئِذٍ الَّذِي يَقُولُ: لَوْ نَحَّيْتَهَا عَنِ الطَّرِيقِ قَلِيلًا، فَذَاكَ فِيهِمْ مِثْلُ أَبِي بَكْرٍ وَعُمَرَ فِيكُمْ
“কিয়ামত ততক্ষণ পর্যন্ত কায়েম হবে না, …. যতক্ষণ না নারীর সাথে দিনে প্রকাশ্যে রাস্তার মাঝখানে যিনা করা হবে। কেউ তাতে বাধা বা ব্যাঘাত দিবে না। সেদিন সর্বোত্তম ব্যক্তি সে হবে, যে বলবে, যদি রাস্তা থেকে একটু সরিয়ে যেতে! তাদের মধ্য হতে উক্ত ব্যক্তি তোমাদের আবু বকর ও উমরের মত হবে।”[11]
যখন পৃথিবীর এমন অবস্থা হবে তখন নিজের দীন ও ঈমান বাঁচানোর লক্ষ্যে সকল লোক থেকে বিচ্ছন্ন হয়ে একাকী জীবনযাপন করা হবে হাদীসের উদ্ধেশ্য। আল্লাহু আ’লাম।
যাই হোক, উক্ত হাদীসের মর্ম কখনও এ নয় যে, খেলাফত বিলুপ্ত বা খলীফাশূণ্য হলেই সকল কাজ বাদ দিয়ে একাকী জীবনযাপন এবং ব্যক্তিকেন্দ্রীক হয়ে যেতে হবে। আমাদের জানামতে হাদীসের এমন ব্যাখ্যা কেউই করেননি। অন্যথায় উক্ত অবস্থায় মুসলিমদের গুরোত্বপূর্ণ অন্যান্য ফরয আমলসমূহ কীভাবে আদায় করা হবে এবং বিশেষ করে খেলাফত প্রতিষ্ঠার ফরয দায়িত্ব কীভাবে আদায় হবে?
[1] এ’লাউস সুনান: ১২/৪
[2] ফেতনার ব্যাপারে জানার এটাই ফায়দা যে, ফেতনা যখন প্রকাশ পায় এবং মানুষ আগে থেকে ফেতনার ব্যাপারে সতর্ক থাকে, তাহলে ফেতনার অনিষ্টতা থেকে রক্ষা পাবে। -তুহফাতুল কারী: ৭/১৫৪
[3] সহীহ বুখারী: ৩৬০৬, সহীহ মুসলিম: ১৮৪৭
[4] এলাউস সুনান: ১২/৫
[5] ফাইযুল বারী: ৬/৪৫৯
[6] এ’লাউস সুনান: ১২/৮
[7] সহীহ মুসলিম: ১৫৬
[8] মিরকাতুল মাফাতীহ: ১০/১০
[9] আল-মুফহিম: ৪/৫৭
[10] ফাতহুল বারী: ১৩/৩৭
[11] মুসতাদরাকে হাকিম: ৪/৫৪১। ইমাম হাকিম রহ. সহীহ বলেছেন। তবে যাহাবী রহ. উক্ত হাদীসকে উপকথার মত বলেছেন। আরও দেখুৃন: ইতহাফুল জামাআহ: ২/১৪৭
Comment