তৃতীয় দলীল: আবু হুরায়রা রাদি. এর হাদীস;
জিহাদের জন্য ইমাম শর্তে পক্ষে তৃতীয় দলীল উপস্থাপন করা হয় যে, আবু হুরায়রা রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
উক্ত হাদীসে জিহাদের জন্য ইমাম তথা রাষ্ট্রপ্রধানকে শর্ত করা হয়েছে। তাই রাষ্ট্রপ্রধানের অনুপস্থিতি বা অনুমতি ছাড়া জিহাদ করা জায়েয হবে না।[2]
এ ব্যাপারে আমাদের কথা হচ্ছে;
এক. আবু হুরায়রা রাদি. থেকে বর্ণিত অন্য হাদীসে এসেছে,
স্পষ্টত উক্ত হাদীসে ইমাম দ্বারা নামাযের ইমাম উদ্ধেশ্য। তাহলে কী উক্ত হাদীসের ভিত্তিতে নামাযের জন্য ইমাম শর্ত বলা হবে! আমরা আলোচনার শুরুতে বলে এসেছি যে, জামাত ফরয, ওয়াজিব না সুন্নত –এ ব্যাপারে ইমামদের মাঝে মতভেদ থাকলেও, কারও মতে নামায সহীহ হওয়ার জন্য জামাত শর্ত নয়। তাই নামাযের অধ্যায়ে উক্ত হাদীসের ভিত্তিতে নামাযের ইমামকে শর্তযুক্ত করা না হলে, একই ধরনের হাদীস দ্বারা জিহাদের জন্য ইমাম শর্তযুক্ত করা উসূলী দৃষ্টিকোণ থেকে বোধগম্য নয়।
দুই. উক্ত হাদীসের সাথে “জিহাদের জন্য ইমাম শর্ত” এর নূন্যতম সম্পর্ক নেই। বরং উক্ত হাদীস ইমামের দায়িত্ব এবং প্রজাদের আনুগত্যের ব্যাপারে বলা হয়েছে; জিহাদকে আমীর বা ইমামের সাথে শর্তযুক্ত করার জন্য নয়। মূল হাদীস হচ্ছে,
হাদীসের পূর্বাপর থেকে স্পষ্ট বুঝে আসে যে, হাদীসটি ইমাম ও আমীরের আনুগত্যের ব্যাপারে বর্ণিত হয়েছে; জিহাদের জন্য ইমাম বা আমীরকে শর্ত করার জন্য নয়।
উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমাম নববী রহ. বলেন,
‘মাসাবীহুস সুন্নাহ’ এর প্রশিদ্ধ ব্যাখ্যাকার মুজহিরী হানাফী রহ. (৭২৭ হি.) বলেন,
কাযী ইয়ায রহ. (৫৪৪ হি.) বলেন,
আমরা এখানে হাদীসের ব্যাখ্যা গ্রন্থসমূহ থেকে কয়েকটি কিতাবের উদ্ধৃতি উল্লেখ করেছি। অন্যথায় হাদীসের অন্যান্য কিতাবেও অনুরূপ ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এখানে মুহাদ্দিসদের ব্যাখ্যাসমূহ থেকে ইমাম ও আমীরের দায়িত্ব এবং প্রজাদের আনুগত্যের বিষয়টি ফুটে উঠে। কেউই উক্ত হাদীস থেকে “জিহাদের জন্য ইমাম শর্ত” এমন কিছু ইস্তেন্বাত করেননি।
চতুর্থ দলীল: অনৈক্য ও বিশৃঙ্খলা;
“জিহাদের জন্য ইমাম শর্ত” এর পক্ষে চতুর্থ অনৈক্য ও বিশৃঙ্খলার দলীল উপস্থাপন করা হয়। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, জিহাদ একটি জামাআতবদ্ধ আমল। তাই ঐক্যমত কোন নেতার অধীনে ছাড়া জিহাদ করলে অনৈক্য ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে যে, কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শেষ করে বা কাফেরদের সাথে যুদ্ধ চলাকালীন সময়েই নিজেদের মাঝে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছেন। সকল মানুষ এক ব্যক্তির অধীনে সমবেত হওয়া যুক্তি ও বাস্তবতার বিচারে অসম্ভব। আবার খলীফা ছাড়া অন্য কারও অধীনে সমবেত হতে শরয়ীভাবে কাউকে বাধ্য করা যাবে না। তাই “ইমাম ছাড়া জিহাদ জায়েয নয়”।
এ ক্ষেত্রে আমাদের কথা হচ্ছে,
ক. উক্ত আপত্তি তো প্রচলিত দীনি কাজগুলোর ব্যাপারেও হওয়ার কথা। কেননা জিহাদের মত উক্ত কাজগুলোতেও অনৈক্য ও বিশৃঙ্খলা হওয়া সম্ভব। বরং বাস্তবেও সর্বসম্মত নেতৃত্বের অভাবে তাদের মাঝেও অনেক অনৈক্য ও বিশৃঙ্খলা রয়েছে। কিন্তু এ কারণে কি উক্ত দীনী কাজগুলো নাজায়েয হবে! এবং তা বন্ধ করে দেওয়া উচিৎ!!
খ. লাভ-ক্ষতির বিষয়ে শরিয়ত অনেক গুরোত্ব দিয়েছে। তবে কোনটি কল্যাণকর আর কোনটি ক্ষতিকর, তা নির্ণয়ের পরিমাপ কি? প্রত্যেকে নিজের মত করে লাভ-ক্ষতি ঠিক করলে বিষয়টি এক “হাইয়্যুলা” হয়ে যাবে। একটি বিষয় একজনের কাছে কল্যাণকর মনে হলে অন্যজনের কাছে তা ক্ষতিকর মনে হতে পারে। তাই শরীয়তের দলীল, সালাফদের বুঝ এবং ফকীহ মুজতাহিদদের বক্তব্যের আলোকে লাভ-ক্ষতি ঠিক করতে হবে।
গ. নির্দিষ্ট ব্যক্তি, গোষ্টি বা দলের ভুলের কারণে তাদের সাথে সম্পৃক্ত সকল কাজ ভুল ও নাজায়েয প্রমাণীত হয়ে যায় না। বর্তমানে তাদরীস ও তা’লীম, তাসাওউফ ও তাযকিয়া এবং দাওয়াত ও তাবলীগ ইত্যাদি গুরোত্বপূর্ণ ও উপকারী কাজের সাথে সম্পৃক্ত কিছু ব্যক্তি থেকে অনেক সময় ক্ষতিকর কাজ সংগঠিত হয়ে থাকে। তার মানে কি উক্ত কাজগুলো নাজায়েয হয়ে যাবে এবং তা বন্ধ করে দিতে হবে! তখন আমাদের দায়িত্ব কি উক্ত ভুলসমূহ শোধরানোর চেষ্টা করা, নাকি উক্ত কাজকে বন্ধ করে দেওয়া? শরীয়তের পূর্ণ বুঝের অভাব বা শরঈ বিধানের প্রতি গাফলতির কারণে প্রত্যেক যুগে প্রত্যেক শাখার সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তি থেকে এমন ঘটনা সংগঠিত হয়েছে। কিন্তু উম্মতের রাহবারগণ তখন কোন কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন? উক্ত ভুলের কারণে উক্ত কাজকে বন্ধ করে দিয়েছেন, নাকি তা শোধরানোর চেষ্টা করেছেন??
ঘ. শরীয়তের একটি মূলনীতি হচ্ছে,
উক্ত মূলনীতির আলোকে কাফের ও জালেমদের হাতে নির্যাতিত হওয়া, আল্লাহর বিধানের বিপরিতে গাইরুল্লার বিধান অনুযায়ী চলতে বাধ্য হওয়া, শরীয়তের পবিত্র বিধানসমূহের ব্যাপারে তুচ্ছতাচ্ছিল্য শুনতে থাকা এবং প্রাণের চেয়ে প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শানে কটু কথা শুনা বেশি ক্ষতিকর, না শাতেমে রাসূলের উচিৎ শিক্ষা দেওয়া, আল্লাহর যমিনকে কাফেরদের কলোনি থেকে বের করা এবং নির্যাতিত মা-বোনদেরকে উদ্ধার করার জন্য ইমাম ছাড়া জিহাদ করার দরুন সম্ভাব্য ক্ষতির আশঙ্কা বেশি ক্ষতিকর? আশা করি, শরীয়তের মিজায, সালাফদের বুঝ এবং দীনী গায়রতের আলোকে তা নির্ণয় করা চেষ্টা করা হবে।
[1] সহীহ বুখারী: ২৯৫৭, সহীহ মুসলিম: ১৮৪১
[2] আল-ফিকহুল আকবার: বঙ্গানুবাদ ও ব্যাখ্যা: ৩৮৯
[3] সহীহ মুসলিম: ৪১৬
[4] সহীহ বুখারী: ২৯৫৭, সহীহ মুসলিম: ১৮৪১
[5] শরহু মুসলিম লিননববী: ১২/২৩০
[6] মাফাতীহ শরহে মাসাবীহ: ৪/২৮৫
[7] ইকমালুল মু’লিম: ৬/২৪৯
[8] তাবয়ীনুল হাকায়েক: ১/৯৮, আল-বাহরুর রায়েক: ১/২৮৯, আদ-দুররুল মুখতার (রদ্দুল মুহতারসহ): ১/৪১২, আল-আশবাহ ওয়ান নাযাইর; (শরহুল হামাবীসহ): ১/২৮৬
জিহাদের জন্য ইমাম শর্তে পক্ষে তৃতীয় দলীল উপস্থাপন করা হয় যে, আবু হুরায়রা রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«إِنَّمَا الْإِمَامُ جُنَّةٌ، يُقَاتَلُ مِنْ وَرَائِهِ، وَيُتَّقَى بِهِ»
“ইমাম হচ্ছেন, ঢাল-স্বরূপ, তার পিছনে থেকে যুদ্ধ করা হবে এবং তার মাধ্যমে আত্মরক্ষা করা হবে।”[1]উক্ত হাদীসে জিহাদের জন্য ইমাম তথা রাষ্ট্রপ্রধানকে শর্ত করা হয়েছে। তাই রাষ্ট্রপ্রধানের অনুপস্থিতি বা অনুমতি ছাড়া জিহাদ করা জায়েয হবে না।[2]
এ ব্যাপারে আমাদের কথা হচ্ছে;
এক. আবু হুরায়রা রাদি. থেকে বর্ণিত অন্য হাদীসে এসেছে,
"إِنَّمَا الْإِمَامُ جُنَّةٌ، فَإِذَا صَلَّى قَاعِدًا فَصَلُّوا قُعُودًا، وَإِذَا قَالَ: سَمِعَ اللهُ لِمَنْ حَمِدَهُ. فَقُولُوا: اللهُمَّ رَبَّنَا لَكَ الْحَمْدُ، فَإِذَا وَافَقَ قَوْلُ أَهْلِ الْأَرْضِ قَوْلَ أَهْلِ السَّمَاءِ غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ"
“ইমাম হচ্ছেন ঢাল-স্বরূপ। তিনি যখন বসে নামায পড়বেন, তোমরাও বসে নামায পড়বে। তিনি যখন سمع الله لمن حمده বলবেন, তোমরা اللهم ربنا لك الحمد বলবে। কেননা যমিনবাসী (নামাযী)র কথা আকাশবাসী (ফেরেশতা)র সাথে মিলে গেলে তার পিছনের সমস্থ গুণাহ মাফ হয়ে যায়।”[3]স্পষ্টত উক্ত হাদীসে ইমাম দ্বারা নামাযের ইমাম উদ্ধেশ্য। তাহলে কী উক্ত হাদীসের ভিত্তিতে নামাযের জন্য ইমাম শর্ত বলা হবে! আমরা আলোচনার শুরুতে বলে এসেছি যে, জামাত ফরয, ওয়াজিব না সুন্নত –এ ব্যাপারে ইমামদের মাঝে মতভেদ থাকলেও, কারও মতে নামায সহীহ হওয়ার জন্য জামাত শর্ত নয়। তাই নামাযের অধ্যায়ে উক্ত হাদীসের ভিত্তিতে নামাযের ইমামকে শর্তযুক্ত করা না হলে, একই ধরনের হাদীস দ্বারা জিহাদের জন্য ইমাম শর্তযুক্ত করা উসূলী দৃষ্টিকোণ থেকে বোধগম্য নয়।
দুই. উক্ত হাদীসের সাথে “জিহাদের জন্য ইমাম শর্ত” এর নূন্যতম সম্পর্ক নেই। বরং উক্ত হাদীস ইমামের দায়িত্ব এবং প্রজাদের আনুগত্যের ব্যাপারে বলা হয়েছে; জিহাদকে আমীর বা ইমামের সাথে শর্তযুক্ত করার জন্য নয়। মূল হাদীস হচ্ছে,
«مَنْ أَطَاعَنِي فَقَدْ أَطَاعَ اللَّهَ، وَمَنْ عَصَانِي فَقَدْ عَصَى اللَّهَ، وَمَنْ يُطِعِ الأَمِيرَ فَقَدْ أَطَاعَنِي، وَمَنْ يَعْصِ الأَمِيرَ فَقَدْ عَصَانِي، وَإِنَّمَا الإِمَامُ جُنَّةٌ يُقَاتَلُ مِنْ وَرَائِهِ وَيُتَّقَى بِهِ، فَإِنْ أَمَرَ بِتَقْوَى اللَّهِ وَعَدَلَ، فَإِنَّ لَهُ بِذَلِكَ أَجْرًا وَإِنْ قَالَ بِغَيْرِهِ فَإِنَّ عَلَيْهِ مِنْهُ»
“যে আমার আনুগত্য করলো, সে আল্লাহর আনুগত্য করলো আর যে আমার অবাধ্যতা করলো, সে আল্লাহর অবাধ্যতা করলো। যে আমীরের আনুগত্য করলো, সে আমার আনুগত্য করলো আর যে আমীরের অবাধ্যতা করলো, সে আমার অবাধ্যতা করলো। ইমাম হচ্ছেন, ঢাল-স্বরূপ। তার পিছনে থেকে যুদ্ধ করা হয় এবং তার মাধ্যমে নিরাপত্তা অর্জন করা হয়। সে যদি আল্লাহর তাকওয়ার আদেশ করে এবং ন্যায় বিচার করে, তাহলে তার জন্য পুরস্কার রয়েছে। আর যদি এর বিপরিত কিছু করে, তাহলে এর শাস্তি তার উপর বর্তাবে।”[4]হাদীসের পূর্বাপর থেকে স্পষ্ট বুঝে আসে যে, হাদীসটি ইমাম ও আমীরের আনুগত্যের ব্যাপারে বর্ণিত হয়েছে; জিহাদের জন্য ইমাম বা আমীরকে শর্ত করার জন্য নয়।
উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমাম নববী রহ. বলেন,
قوله صلى الله عليه وسلم (الإمام جنة) أي كالستر لأنه يمنع العدو من أذى المسلمين ويمنع الناس بعضهم من بعض ويحمي بيضة الإسلام ويتقيه الناس ويخافون سطوته ومعنى يقاتل من ورائه أي يقاتل معه الكفار والبغاة والخوارج وسائر أهل الفساد والظلم مطلقا
“হাদীসের শব্দ “ইমাম হচ্ছেন, ঢাল-স্বরূপ” অর্থাৎ, তিনি পর্দার মত। কেননা তিনি শত্রুকে মুসলিমদের কষ্ট দেওয়া থেকে ও একে অন্যের উপর জুলুম করা থেকে বিরত রাখেন এবং তিনি মুসলিম ভূখণ্ডের হেফাজত করেন। (কেননা) মানুষ ইমাম ও তার দাপটকে ভয় করে। আর “তার পিছনে থেকে যুদ্ধ করা হয়” অর্থাৎ, তার সাথে মিলে ব্যাপকভাবে কাফের, বাগী, খারেজী ও সকল প্রকারের ফাসাদ ও জুলুমকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হয়।”[5]‘মাসাবীহুস সুন্নাহ’ এর প্রশিদ্ধ ব্যাখ্যাকার মুজহিরী হানাফী রহ. (৭২৭ হি.) বলেন,
"إنما الإمام جُنَّةٌ، يقاتَلُ من ورائه ويُتَّقَى به"؛ يعني: الإمام كترسٍ ينبغي أن يكون قدام جيشه في الحرب؛ ليقاتل المسلمونَ الكفارَ بقوته واستظهاره، ويتعلم الجيشُ الشجاعةَ منه، ولا يجوز له أن يفرَّ ويترك المسلمين بين الكفار، وكذلك في جميع الأمور ينبغي أن يكون ملجأً للمسلمين، يقضي حوائِجَهم، ويعينُهُم على أمورِهِم، ويدفع الظالمينَ عن المظلومين.
“ইমাম হচ্ছেন, ঢাল-স্বরূপ। তার পিছনে থেকে যুদ্ধ করা হয় এবং তার মাধ্যমে নিরাপত্তা অর্জন করা হয়।” অর্থাৎ, ইমাম হচ্ছেন, ঢালের মত। ইমামের জন্য উচিৎ হচ্ছে, তিনি যুদ্ধে বাহিনীর আগে থাকবেন; যাতে মুসলিমরা তার শক্তি ও সাহায্যে কাফেরদের সাথে যুদ্ধ করতে পারেন এবং বাহিনী তার থেকে বিরত্ব শিখতে পারেন। মুসলিমদেরকে কাফেরদের সামনে রেখে তার জন্য পালিয়ে যাওয়া জায়েয নয়। তদ্রূপ সকল ক্ষেত্রে, তার জন্য উচিৎ হচ্ছে, তিনি মুসলিমদের আশ্রয়কেন্দ্র হবেন; তাদের প্রয়োজন পূরণ করে দিবেন, তাদের বিষয়াবলিতে সাহায্য করবেন এবং মজলুম থেকে জালিমকে প্রতিহত করবেন।”[6]কাযী ইয়ায রহ. (৫৪৪ হি.) বলেন,
وقوله: " إنما الإمام جنة، يقاتل من ورائه ويتقى به " الحديث: أى أنه كالساتر وكالترس لمنعه وحمايته بيضة المسلمين، واتقائهم بمكانه ونظره عدوهم، وهو معنى قوله: " يقاتل من ورائه ". وكذا جاء فى إمام الصلاة، لأنه ساتر من وراءه من المأمومين، وواق لهم السهو والزلل، وقطع المار بين أيديهم، كما بقى الترس سلاح العدو.
“হাদীসের শব্দ “ইমাম হচ্ছেন, ঢাল-স্বরূপ। তার পিছনে থেকে যুদ্ধ করা হয় এবং তার মাধ্যমে নিরাপত্তা অর্জন করা হয়।” অর্থাৎ, ইমামের (শত্রুদের) প্রতিহত করা ও মুসলিম ভূখণ্ড হেফাজত এবং তার অবস্থানের মাধ্যমে (মুসলিমদের) নিরাপত্তা অর্জন ও শত্রুদের প্রতি তার সজাগ দৃষ্টির কারণে তিনি হচ্ছেন, (সাধারণ মুসলিমদের জন্য) পর্দা ও ঢালের মত। এটাই হচ্ছে, “তার পিছনে থেকে যুদ্ধ করা হয়” এর অর্থ। উক্ত শব্দে নামাযের ক্ষেত্রে বর্ণিত হয়েছে। কেননা ইমাম হচ্ছেন, তার পিছনের মুক্তাদীদের জন্য পর্দা-স্বরূপ; তাদের ভুল-ভ্রান্তি থেকে বাঁচিয়ে রাখেন এবং তাদের সামনে দিয়ে অতিক্রমকারীদেরকে বাধা দেন। যেমন ঢাল শত্রুর অস্ত্র থেকে বাঁচিয়ে রাখে।”[7]আমরা এখানে হাদীসের ব্যাখ্যা গ্রন্থসমূহ থেকে কয়েকটি কিতাবের উদ্ধৃতি উল্লেখ করেছি। অন্যথায় হাদীসের অন্যান্য কিতাবেও অনুরূপ ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এখানে মুহাদ্দিসদের ব্যাখ্যাসমূহ থেকে ইমাম ও আমীরের দায়িত্ব এবং প্রজাদের আনুগত্যের বিষয়টি ফুটে উঠে। কেউই উক্ত হাদীস থেকে “জিহাদের জন্য ইমাম শর্ত” এমন কিছু ইস্তেন্বাত করেননি।
চতুর্থ দলীল: অনৈক্য ও বিশৃঙ্খলা;
“জিহাদের জন্য ইমাম শর্ত” এর পক্ষে চতুর্থ অনৈক্য ও বিশৃঙ্খলার দলীল উপস্থাপন করা হয়। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, জিহাদ একটি জামাআতবদ্ধ আমল। তাই ঐক্যমত কোন নেতার অধীনে ছাড়া জিহাদ করলে অনৈক্য ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে যে, কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শেষ করে বা কাফেরদের সাথে যুদ্ধ চলাকালীন সময়েই নিজেদের মাঝে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছেন। সকল মানুষ এক ব্যক্তির অধীনে সমবেত হওয়া যুক্তি ও বাস্তবতার বিচারে অসম্ভব। আবার খলীফা ছাড়া অন্য কারও অধীনে সমবেত হতে শরয়ীভাবে কাউকে বাধ্য করা যাবে না। তাই “ইমাম ছাড়া জিহাদ জায়েয নয়”।
এ ক্ষেত্রে আমাদের কথা হচ্ছে,
ক. উক্ত আপত্তি তো প্রচলিত দীনি কাজগুলোর ব্যাপারেও হওয়ার কথা। কেননা জিহাদের মত উক্ত কাজগুলোতেও অনৈক্য ও বিশৃঙ্খলা হওয়া সম্ভব। বরং বাস্তবেও সর্বসম্মত নেতৃত্বের অভাবে তাদের মাঝেও অনেক অনৈক্য ও বিশৃঙ্খলা রয়েছে। কিন্তু এ কারণে কি উক্ত দীনী কাজগুলো নাজায়েয হবে! এবং তা বন্ধ করে দেওয়া উচিৎ!!
খ. লাভ-ক্ষতির বিষয়ে শরিয়ত অনেক গুরোত্ব দিয়েছে। তবে কোনটি কল্যাণকর আর কোনটি ক্ষতিকর, তা নির্ণয়ের পরিমাপ কি? প্রত্যেকে নিজের মত করে লাভ-ক্ষতি ঠিক করলে বিষয়টি এক “হাইয়্যুলা” হয়ে যাবে। একটি বিষয় একজনের কাছে কল্যাণকর মনে হলে অন্যজনের কাছে তা ক্ষতিকর মনে হতে পারে। তাই শরীয়তের দলীল, সালাফদের বুঝ এবং ফকীহ মুজতাহিদদের বক্তব্যের আলোকে লাভ-ক্ষতি ঠিক করতে হবে।
গ. নির্দিষ্ট ব্যক্তি, গোষ্টি বা দলের ভুলের কারণে তাদের সাথে সম্পৃক্ত সকল কাজ ভুল ও নাজায়েয প্রমাণীত হয়ে যায় না। বর্তমানে তাদরীস ও তা’লীম, তাসাওউফ ও তাযকিয়া এবং দাওয়াত ও তাবলীগ ইত্যাদি গুরোত্বপূর্ণ ও উপকারী কাজের সাথে সম্পৃক্ত কিছু ব্যক্তি থেকে অনেক সময় ক্ষতিকর কাজ সংগঠিত হয়ে থাকে। তার মানে কি উক্ত কাজগুলো নাজায়েয হয়ে যাবে এবং তা বন্ধ করে দিতে হবে! তখন আমাদের দায়িত্ব কি উক্ত ভুলসমূহ শোধরানোর চেষ্টা করা, নাকি উক্ত কাজকে বন্ধ করে দেওয়া? শরীয়তের পূর্ণ বুঝের অভাব বা শরঈ বিধানের প্রতি গাফলতির কারণে প্রত্যেক যুগে প্রত্যেক শাখার সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তি থেকে এমন ঘটনা সংগঠিত হয়েছে। কিন্তু উম্মতের রাহবারগণ তখন কোন কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন? উক্ত ভুলের কারণে উক্ত কাজকে বন্ধ করে দিয়েছেন, নাকি তা শোধরানোর চেষ্টা করেছেন??
ঘ. শরীয়তের একটি মূলনীতি হচ্ছে,
مَنْ ابْتَلَى بِبَلِيَّتَيْنِ وَهُمَا مُتَسَاوِيَتَانِ يَأْخُذُ بِأَيِّهِمَا شَاءَ وَإِنْ اخْتَلَفَا يَخْتَارُ أَهْوَنَهُمَا.
“কেউ দুই বিপদের সম্মুখীন হলে (যে, যেকোন একটি গ্রহণ করতেই হবে, তাহলে ক্ষতির বিবেচনায়) উভয় বিপদ সমান হলে, যেকোন একটি গ্রহণ করতে পারবে। আর উভয়টির মাঝে কমবেশি থাকলে, তুলনামূলক হালকা বিপদটি গ্রহণ করতে হবে।”[8]উক্ত মূলনীতির আলোকে কাফের ও জালেমদের হাতে নির্যাতিত হওয়া, আল্লাহর বিধানের বিপরিতে গাইরুল্লার বিধান অনুযায়ী চলতে বাধ্য হওয়া, শরীয়তের পবিত্র বিধানসমূহের ব্যাপারে তুচ্ছতাচ্ছিল্য শুনতে থাকা এবং প্রাণের চেয়ে প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শানে কটু কথা শুনা বেশি ক্ষতিকর, না শাতেমে রাসূলের উচিৎ শিক্ষা দেওয়া, আল্লাহর যমিনকে কাফেরদের কলোনি থেকে বের করা এবং নির্যাতিত মা-বোনদেরকে উদ্ধার করার জন্য ইমাম ছাড়া জিহাদ করার দরুন সম্ভাব্য ক্ষতির আশঙ্কা বেশি ক্ষতিকর? আশা করি, শরীয়তের মিজায, সালাফদের বুঝ এবং দীনী গায়রতের আলোকে তা নির্ণয় করা চেষ্টা করা হবে।
[1] সহীহ বুখারী: ২৯৫৭, সহীহ মুসলিম: ১৮৪১
[2] আল-ফিকহুল আকবার: বঙ্গানুবাদ ও ব্যাখ্যা: ৩৮৯
[3] সহীহ মুসলিম: ৪১৬
[4] সহীহ বুখারী: ২৯৫৭, সহীহ মুসলিম: ১৮৪১
[5] শরহু মুসলিম লিননববী: ১২/২৩০
[6] মাফাতীহ শরহে মাসাবীহ: ৪/২৮৫
[7] ইকমালুল মু’লিম: ৬/২৪৯
[8] তাবয়ীনুল হাকায়েক: ১/৯৮, আল-বাহরুর রায়েক: ১/২৮৯, আদ-দুররুল মুখতার (রদ্দুল মুহতারসহ): ১/৪১২, আল-আশবাহ ওয়ান নাযাইর; (শরহুল হামাবীসহ): ১/২৮৬