Announcement

Collapse
No announcement yet.

ফতোয়া শামী থেকে কিতাবুল জিহাদের দারস

Collapse
X
 
  • Filter
  • Time
  • Show
Clear All
new posts

  • ফতোয়া শামী থেকে কিতাবুল জিহাদের দারস

    بسم الله والحمد لله والصلاة والسلام على رسول الله وعلى آله وصحبه ومن والاه أما بعد:


    এক ভাই “রদ্দুল মুহতার” থেকে কিতাবুল জিহাদ পড়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন। দারুণ আগ্রহ-উদ্দীপনা নিয়ে অনুরোধ করলেন। ভাইয়ের অনুরোধকে নিজের জন্যে গণিমত মনে হলো। কিতাবুল জিহাদ তাকরার মোযাকারার এই সুযোগে জিহাদের ছোট বড় সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম মাসআলাগুলো আয়েত্বে এসে যাবে এর চেয়ে বড় খুশির আর কি হতে পারে।
    তাই ভাইকে নিয়ে রদ্দুল মুহতার থেকে কিতাবুল জিহাদের সাপ্তাহিক দারস শুরু হলো। আল্লাহ আমাদেরকে শেষ অবধি পৌঁছার তাউফিক দান করুন আমীন। অতঃপর মনে হলো দারসগুলো ফোরামের ভাইদের সাথে শিয়ার করা দরকার। এতে আমারও বাংলায় দারসগুলো নোট হয়ে যাবে পাশাপাশি ভাইয়েরাও উপকৃত হতে পারবেন। আল্লাহ তায়ালা দারসগুলো দ্বারা সকলকে উপকৃত করুন। আমীন।
    প্রথম দারস

    ৪টি বিষয়ের আলোচনা হবে ইনশাআল্লাহ।
    ১. কিতাবুল হুদুদ ও কিতাবুল জিহাদের মাঝে মুনাসাবাত বা সম্পর্ক।
    ২. সিয়ার এর শাব্দিক ও পারিভাষিক সজ্ঞা।
    ৩. জিহাদের সবব ও ইল্লত।
    ৪. জিহাদের ফযীলত।
    প্রথম দুটি আলোচনা আলাউদ্দিন হাসকাফী রহ. আদ দুররুল মুখতারের মতনে উল্লেখ আছে। চার নং আলোচনা মুহাশশি ইবনে আবেদীন শামী রহ. এর হাশিয়া রদ্দুল মুহতারে উল্লেখ আছে। আর তিন নং আলোচনাটি ইবনে নুজাঈম আল মিসরী রহ. এর আল বাহরুর রায়েকে উল্লেখ আছে। তো চলুন মূল আলোচনায় যাওয়া যাক।
    প্রথম আলোচনা: কিতাবুল জিহাদ ও ‍হুদুদের মাঝে মুনাসাবাত

    সাধারণত ফিকহের কিতাবসমূহে কিতাবুল হুদুদ (দণ্ডবিধি) এর পরই কিতাবুস সিয়ার (সমরনীতি) উল্লেখ করা হয়। কারণ এই দুটি অধ্যায় পরষ্পর দু’দিক থেকে সম্পর্কযুক্ত।
    এক. উভয়টির মাকসাদ বা উদ্দেশ্য এক। আর তা হলো إخلاء العالم من الفساد অর্থাৎ সন্ত্রাসমুক্ত পৃথিবী গড়া।
    দুই. উভয়টি হাসান লি গায়রিহি। অর্থাৎ ফি নাফসিহি জিহাদ মারামারি কাটাকাটি কোনো ভালো কাজ নয় এমনিভাবে হুদুদ -হাত কেটে দেয়া, পাথর মেরে হত্যা করা ইত্যাদি ভালো কাজ নয়; তবে বিশেষ কিছু উদ্দেশ্যে হুদুদ ও জিহাদকে আবশ্যক করা হয়েছে। আর তা হলো: “ই’লাউ কালিমাতিল্লাহ আল্লাহর দ্বীন বিজয় করা
    জিহাদের অনন্য একটি উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর দুশমন কাফের মুশরিকদের সামরিক সক্ষমতা নষ্ট করে দেয়া। এমনিভাবে পাঁচ প্রকার হদের প্রত্যেকটির রয়েছে নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য। যেমন: হদ্দে সারিকা চুরি ডাকাতির শাস্তির উদ্দেশ্য সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। হদ্দে যিনা ভ্যাবিচারের শাস্তির উদ্দেশ্য চরিত্র ও বংশপ্রজন্মের হিফাজত করা। মদ পানের শাস্তির উদ্দেশ্য আকল ও বুদ্ধিমত্তাকে সুস্থ্য রাখা। হদ্দে তুহমা অপবাদের শাস্তির উদ্দেশ্য ইজ্জত সম্মানের রক্ষণাবেক্ষণ।
    হাসান লি গায়রিহির বিষয়টি সামনে এসেছে তাই একটি বিষয় তাম্বীহ করা সমীচীন মনে করছি। আর তা হলো: জিহাদ তো হাসান লি গায়রিহি! কথাটা এমন ভঙ্গি করে বলা হয় যেন হাসান লি গায়রিহি হওয়ার কারণে জিহাদ গুরুত্বহীন বা কমগুরুত্বপূর্ণ একটি আমল।
    এই ব্যাপারে প্রথম কথা হলো: কোনো বিধানের গুরুত্ব ও ফযীলতের বিষয়টি আমরে তাওকিফী তথা শারে (শরীয়ত প্রণেতার) উপর নির্ভরশীল। কোনো বান্দার ক্ষমতা নেই কোন বিধানের কি ফযীলত তা ঠিক করার। বরং তা কেবল আল্লাহ তা’য়ালাই করতে পারেন। সুতরাং ফুকাহায়ে কেরাম হাসান লি যাতিহি ও গায়রিহির যে প্রকার করে থাকেন তা দ্বারা কোনো বিধানের গুরুত্ব ও ফযীলতের স্তর নির্ণয় করা উদ্দেশ্য নয়। তাই কোনো বিধান হাসান লি গায়রিহি হওয়া তার কম গুরুত্ব হওয়ার প্রমাণ নয়।
    দ্বিতীয় কথা হলো: ইলম এবং তালীম তায়াল্লুমও কিন্তু হাসান লি গায়রিহি। তাই বলে কি ইলমের ‍গুরুত্ব কম? দারস তাদরীসের গুরুত্ব কম? যাকাতও কিন্তু হাসান লি গায়রিহি তাই বলে কি যাকাতের গুরুত্ব কম? হাসান লি গায়রিহি হওয়ার কারণে জিহাদের গুরুত্ব কমে গেলে ইলম, যাকাত, তাযকিয়া, রিয়াজাত মুজাহাদাহ ইত্যাদি ইসলামের বহু গুরুত্বপূর্ণ বিধান গুরুত্বহীন হয়ে যাবে। আল ইয়াযু বিল্লাহ। তাই আবারও বলছি হাসান কবীহ এর তাকসীমটা কোনো বিধানের ফযীলত ও গুরুত্ব নির্ধারণ করার জন্যে নয়; বরং তাদকীকের সাথে প্রতিটি বিধানের হুকুম বুঝার জন্যে। সুতরাং এমন ধারণা থেকে ফিরে আসা উচিত।
    তৃতীয় কথা হলো: হাসান লি গায়রিহি হওয়ার কারণে জিহাদের গুরুত্ব আরো বেশি প্রমাণিত হয়। কারণ যে গায়র এর কারণে জিহাদের বিধান এসেছে তা হলো ইলায়ে কালিমাতিল্লাহ আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠা। এর চেয়ে মহান আর কি হতে পারে। এই মহান উদ্দেশ্যে যে বিধানটি মাশরো হয়েছে সেই বিধানটিও কত মহান সুবহানাল্লাহ। আল্লাহ আমাদের সহীহ সমজ দান করুন। আমীন।
    যাই হোক কিতাবুল জিহাদ ও কিতাবুস সিয়ার উভয়টির মাঝে ‘মাকসাদ (সন্ত্রাসমুক্ত পৃথিবী গড়া) ও হাসান লি গাইরিহি’ এই দুই দিক থেকে মিল থাকার কারণে এক সাথে উল্লেখ করা হয়।
    এখন জানার বিষয় হলো কিতাবুল হুদুদ কে কেন আগে উল্লেখ করা হয় এবং সিয়ারকে কেন পরে উল্লেখ করা হয়।
    দুটি কারণে কিতাবুল হুদুদকে আগে ও কিতাবুস সিয়ার কে পরে উল্লেখ করা হয়।
    এক. জিহাদের দ্বারা যে ফাসাদ দূর করা উদ্দেশ্য তা সবচেয়ে বড় ও নিকৃষ্ট অর্থাৎ কুফর। আর হুদুদের দ্বারা যে ফাসাদ দূর করা উদ্দেশ্য তা কুফরের তুলনায় ছোট ও কম নিকৃষ্ট অর্থাৎ ফিসক। আর তালীমের ক্ষেত্রে নিয়ম হলো ছোট ও সহজকে আগে উল্লেখ করা বড় ও কঠিনকে পরে উল্লেখ করা।
    দুই. জিহাদ করা হয় কাফেরদের সাথে সুতরাং জিহাদ হলো কাফেরদের সাথে মোআমেলা। আর হুদুদের অধিকাংশ মোআমেলা হয় মুসলমানদের সাথে। আর মুসলিমদের সাথে সম্পৃক্ত বিষয়কে আগে উল্লেখ করা উত্তম।
    দ্বিতীয় আলোচনা: জিহাদের শাব্দিক ও পারিভাষিক সজ্ঞা

    জ্ঞাতব্য, কিতাবুল জিহাদের সকল মাসায়েল ইকদামী জিহাদের সাথে সম্পৃক্ত; অল্প কিছু মাসআলা দিফায়ী জিহাদের সাথে যুক্ত। এই বিষয়টি মাথায় রাখলে মাসআলাগুলো বুঝতে সহজ হবে ইনশাআল্লাহ।
    এই অধ্যায় কে كتاب السير (কিতাবুস সিয়ার), كتاب الجهاد (কিতাবুল জিহাদ) ও كتاب المغازي (কিতাবুল মাগাযী) নামে উল্লেখ করা হয়।
    سِيَرٌ শব্দটি ‍سِيْرَةٌ এর বহুবচন। অর্থ তরীকা পদ্ধতি। মাসদার السَيْرُ অর্থ সফর করা ভ্রমণ করা। এটি فِعْلَةٌ এর ওযনে। এই ওযনটি হায়আত ও হালাত বুঝানোর জন্যে আসে। সুতরাং সিয়ার মানে সফর ও ভ্রমণের তরীকা পদ্ধতি। কিন্তু শরীয়তের পরিভাষায় শব্দটি শুধুমাত্র জিহাদ সংক্রান্ত সফর ভ্রমণ ও বিধিবিধান বুঝাতে নির্দিষ্ট হয়েগেছে। যেমন মানাসিক শব্দটি হজ সংক্রান্ত বিধিবিধান বুঝাতে নির্দিষ্ট।
    مَغَازِيْ শব্দটি مَغْزَاةٌ এর বহুবচন। মাসদার غَزْوٌ وَ غَزَاةٌ وَغَزْوَانٌ অর্থ ইচ্ছে করা। শরীয়তের পরিভাষায় এটি কেবলমাত্র কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সাথে নির্দিষ্ট।
    جِهَادٌ শব্দটি فِعَالٌ ওযনে بَابِ مُفَاعَلَةٌ এর মাসদার। এটি جُهْدٌ মাদ্দা (মূল ধাতু) থেকে আসলে তার অর্থ শক্তি, কুওয়ত, তাকত। جَهْدٌ মাদ্দা থেকে আসলে তার অর্থ কষ্ট, চেষ্টা, মেহনত। যেহেতু জিহাদে উভয় পক্ষ একে অপরকে ঘায়েল করতে শক্তি ও চেষ্টা ব্যায় করে তাই জিহাদ কে জিহাদ বলে।
    শরীয়তের পরিভাষায় জিহাদ
    আদ দুররুল মুখতারে আলাউদ্দিন হাসকাফী রহ. জিহাদের দুটি পারিভাষিক সজ্ঞা উল্লেখ করেছেন। প্রথমটি শুমুন্নি থেকে যা সংক্ষিপ্ত। আর দ্বিতীয়টি ইবনে কামাল থেকে যা বিস্তারিত।
    শুমুন্নি রহ. সজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে, الدُّعَاءُ إلَى الدِّينِ الْحَقِّ وَقِتَالُ مَنْ لَمْ يَقْبَلْهُ ‘ইসলাম গ্রহণের প্রতি আহ্বান করা; যারা ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকার করবে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা।’ ইবনে হুমাম, ইবনে নুজাঈম প্রমূখ ফুকাহায়ে কেরামও এভাবে জিহাদের সজ্ঞা দিয়েছেন।
    ইবনে কামাল সজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে,
    بِأَنَّهُ بَذْلُ الْوُسْعِ فِي الْقِتَالِ فِي سَبِيلِ اللَّهِ مُبَاشَرَةً أَوْ مُعَاوَنَةً بِمَالٍ، أَوْ رَأْيٍ أَوْ تَكْثِيرِ سَوَادٍ أَوْ غَيْرِ ذَلِكَ. -الدر المختار مع رد المحتار: 4/121

    “জিহাদ হলো, আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধে সর্ব শক্তি ব্যয় করা। তা হতে পারে সরাসরি যুদ্ধে শরীক হয়ে অথবা সম্পদ, পরামর্শ, দল ভারি করণ ইত্যাদি বিভিন্ন উপায়ে সাহায্য করার মাধ্যমে।” -রদ্দুল মুহতার: ৪/১২১ দারুল ফিকর।
    ব্যাখ্যায় শামী রহ. বলেন, যুদ্ধে শরীক হওয়া দ্বারা উদ্দেশ্য যুদ্ধের যত ধরণ হতে পারে সব অন্তর্ভুক্ত। যেমন আঘাত করা, গুড়িয়ে দেয়া, জ্বালিয়ে দেয়া, গাছপালা কেটে ফেলা ইত্যাদি।
    যুদ্ধে সাহায্য করা দ্বারা উদ্দেশ্য যদিও সরাসরি সৈন্য দলের সাথে যুদ্ধের ময়দানে বের হয়নি। আতফ থেকে এমনটিই বুঝে আসে।
    দল ভারি করণ দ্বারা উদ্দেশ্য, মুসলিম সৈনিকদের সংখ্যা বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে তাদের সাথে বের হওয়া যদিও বাস্তবে যুদ্ধ করতে সক্ষম না হয়।
    সাহায্যের আরো কিছু উপায় যেমন: আহত মুজাহিদদের চিকিৎসা করা, সেবা-যত্ন করা, মুজাহিদদের খাবার রান্না করা, পানির ব্যবস্থা করা ইত্যাদি। -রদ্দুল মুহতার: ৪/১২১ দারুল ফিকর।
    শামী রহ. এর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ থেকে দ্বিবালোকের মতো পরিষ্কার যে, আমরা যারা জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর উদ্দেশ্যে দাওয়াতি কাজ করছি, অর্থ ব্যায় করছি, আনসার হচ্ছি, মিডিয়ায় কাজ করছি ইত্যাদি সবই জিহাদের অন্তর্ভুক্ত।
    জিহাদ শব্দটি মুতলাক আসলে
    জিহাদ শব্দটি মুতলাক ব্যবহার হলে তার দ্বারা কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ উদ্দেশ্য হয়। ভীন্ন কোনো অর্থ নিতে হলে দলীল ও করীনাহ লাগবে। এই বিষয়ে দলিল হিসেবে কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করা সমীচীন মনে করছি। হযরত আবূ হুরাইরা রা. বর্ণনা করেন,
    1. جاء رجل إلى رسول الله صلى الله عليه وسلم، فقال: دلني على عمل يعدل الجهاد؟ قال: «لا أجده» قال: «هل تستطيع إذا خرج المجاهد أن تدخل مسجدك فتقوم ولا تفتر، وتصوم ولا تفطر؟»، قال: ومن يستطيع ذلك؟- صحيح البخاري ح.2785
    “এক ব্যক্তি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বলল, আমাকে এমন একটি আমলের সন্ধান দিন যা জিহাদের সমতুল্য। নবীজী বললেন, (জিহাদের সমান হতে পারে এমন কোনো আমল) আমি পাই না। তুমি কি পারবে যখন মুজাহিদ জিহাদে বের হবে তুমি মসজিদে প্রবেশ করে নামাজ আদায় করতে থাকবে (এক মূহুর্তের জন্যেও) নামাজ পড়া বাদ দিবে না এবং রোজা রাখতে থাকবে (অল্প সময়ের জন্যেও রোজা ভাঙবে না?’ লোকটি বলে উঠলেন কার সাধ্য আছে তা করার!” -সহীহ বুখারী: ২৮৮৫
    এই হাদীস থেকে স্পষ্ট যে, সালাত ও সিয়াম নফসের জিহাদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া সত্তেও নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘জিহাদের সমান কোনো আমল আমি পাই না।’ সুতরাং বুঝা গেল জিহাদ শব্দটি মুতলাক আসলে তার উদ্দেশ্য কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা।
    1. أن أبا سعيد الخدري رضي الله عنه، حدثه قال: قيل: يا رسول الله أي الناس أفضل؟ فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم: «مؤمن يجاهد في سبيل الله بنفسه وماله»، قالوا: ثم من؟ قال: «مؤمن في شعب من الشعاب يتقي الله، ويدع الناس من شره» صحيح البخاري ح. 2786
    “আবূ সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল! কোন ব্যক্তি সর্বোত্তম?’ নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘ওই মোমিন উত্তম যে নিজের জান মাল দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করে।’ তারা আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘এরপর কোন ব্যক্তি উত্তম?’ তিনি বললেন, ‘ওই মোমিন যে (লোকালয় ছেড়ে) কোনো পাহাড়ী উপত্যকায় বসবাস করে আল্লাহকে ভয় করে ও নিজের অনিষ্ট থেকে মানুষকে নিরাপদ রাখে।” -সহীহ বুখারী: ২৭৮৬
    লক্ষ্য করুন, এই হাদীসে পাহাড়ে ইবাদাতকারী ব্যক্তি নফসের জিহাদকারী হওয়া সত্তেও তার বিপরীত একটি প্রকার হিসেবে উল্লেখ করেছেন আল্লাহর পথে জান মার দ্বারা জিহাদকারীকে। সুতরাং এর দ্বারা উদ্দেশ্য কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধকারী। বুঝাগেল জিহাদ শব্দটি মুতলাক আসলে কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধকেই বুঝায়।
    1. عن أبي هريرة رضي الله عنه، قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: «من آمن بالله وبرسوله، وأقام الصلاة، وصام رمضان كان حقا على الله أن يدخله الجنة، جاهد في سبيل الله أو جلس في أرضه التي ولد فيها»، فقالوا: يا رسول الله، أفلا نبشر الناس؟ قال: «إن في الجنة مائة درجة، أعدها الله للمجاهدين في سبيل الله، ما بين الدرجتين كما بين السماء والأرض، إلخ صحيح البخاري ح. 2790
    “আবূ হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনে এবং নামাজ ও রোজা পালন করে, আল্লাহর উপর হক তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো; চাই সে জিহাদ করুক বা নিজের ভূমিতে বসে থাকুক। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, আমরা কি মানুষদের এই সুসংবাদ শুনিয়ে দিব না? তিনি বললেন, নিশ্চয় জান্নাতে একশত স্তর রয়েছে সুগুলো আল্লাহ তায়ালা মুজাহিদ ফি সাবিলিল্লাহর জন্যে প্রস্তুত রেখেছেন। একেক টি স্তরের দূরত্ব জমিন থেকে আসমান পরিমাণ।” -সহীহ বুখারী: ২৭৯০
    দেখুন, এই হাদীসে নিজ ভূমিতে বসে থাকা ব্যক্তিকে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নন মুজাহিদ বলে অবহিত করেছেন; অথচ সে তো নামাজ রোজা ইত্যাদি নফসের কষ্ট হয় এমন সকল ইবাদাত পালন করছেন!
    তো সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয়েগেল যে, জিহাদ শব্দটি শাব্দিক অর্থে ব্যপক হলেও পরবর্তীতে তা পারিভাষিক অর্থে খাস হয়েগেছে। আর তা হলো কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। সুতরাং জিহাদের ফাযায়েল সম্বলিত সকল হাদীস ও আয়াত দ্বারা উদ্দেশ্য কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ফযীলত ও গুরুত্ব। শাব্দিক বিবেচনায় ভিন্ন কোন অর্থ মুরাদ নিতে হলে দলীল ও করীনা অবশ্যই লাগবে। জিহাদের ফারীজাহ আদয় করতে হলে কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে শরীক হয়েই আদায় করতে হবে। চাই সরাসরি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করে হোক; চাই যুদ্ধে অর্থ সম্পদ বুদ্ধি পরামর্শ ইত্যাদি বিভিন্ন তরীকায় সাহায্য করে হোক। আল্লাহ তা’য়ালা আমাদের বুঝার তাওফিক দান করুন। আমীন।
    তৃতীয় আলোচনা: জিহাদের সবব ও ইল্লত

    জিহাদের সবব কি? এই বিষয়ে বিশিষ্ট হানাফী ফকীহ আল্লামা ইবনে নুজাঈম আল মিসরি (৯৭০হি.) রহ. বলেন,
    وسبب الجهاد عندنا كونهم حربا علينا وعند الشافعي هو كفرهم كذا في النهاية -البحر الرائق: 5/76

    “আমাদের মতে জিহাদের সবব হলো কাফেররা হারবী হওয়া। আর ইমাম শাফীর মতে জিহাদের সবব হলো কুফর।” -আল বাহরুর রায়েক: ৫/৭৬ দারুল কিতাবির ইসলামী।
    হারবী হওয়ার দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, যুদ্ধ করতে সক্ষম হওয়া; যদিও সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হয় নি। بنية صالحة (উপযুক্ত গঠন) থাকাই হারবী হওয়ার আলামত। প্রখ্যাত হানাফী ফকীহ ইমাম মাওসিলী (৬৮৩ হি.) রহ. বলেন,
    لأن إباحة القتل بناء على أهلية الحراب على ما عرف -الإختيار في تعليل المختار: 4/148

    “হত্যা করা বৈধ হয় যুদ্ধ করতে সক্ষম হওয়ার উপর ভিত্তি করে। এমনটিই প্রমাণিত।” -আল ইখতিয়ার: ৪/১৪৮ মাতবাআতুল হালাবী।
    শামসুল আয়িম্মাহ সারাখসী রহ. বলেন,
    فإنه بالمخالفة في الدين يصير حربا للمسلمين والرجل له بنية صالحة للمحاربة والمرأة ليست لها بنية صالحة للمحاربة إلخ -شرح الجامع الصغير: 2/29

    “ভিন্ন ধর্মাবলম্বি হওয়া দ্বারাই মুসলিমদের বিরুদ্ধে হারবী প্রমাণিত হয়ে যায়। বাকি পুরুষের জন্যে যুদ্ধের উপযুক্ত গঠন রয়েছে; পক্ষান্তরে নারীর গঠন যুদ্ধের উপযুক্ত নয়।” -শরহুল জামিউস সগীর: ২/২৯ দারুল হাদীস।
    হারবী হওয়া দ্বারা যে যুদ্ধের উপযুক্ত গঠন থাকাই যথেষ্ঠ এই বিষয়টি হাদীস থেকেও প্রমাণিত হয়। হযরত আতিয়া আল ‍কুরাযী রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন,
    عرضنا على النبي صلى الله عليه وسلم يوم قريظة فكان من أنبت قتل، ومن لم ينبت خلي سبيله، فكنت ممن لم ينبت فخلي سبيلي. -أخرجه الترمذي (1584) وقال هذا حديث حسن صحيح.

    “বনু কুরাইযার (যুদ্ধের) দিন আমাদেরকে নবীজীর সম্মুখে পেশ করা হচ্ছিল। তখন যার নাভির নিচে চুল গজিয়েছে তাকে হত্যা করা হয়েছিল; আর যার গজায়নি তাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। তখনো আমার চুল গজায়নি তাই আমাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল।” – সুনানে তিরমিযি: ১৫৮৪
    বনু কুরাইযার ইয়াহুদিদের ব্যপারে নবীজী এটা দেখেন নি যে, কে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে আর কে করেনি; বরং দেখেছেন কার যুদ্ধের উপযু্ক্ত গঠন আছে আর কার নেই। আর পুরুষের বালেগ হওয়াই যুদ্ধের উপযুক্ত গঠন থাকার প্রমাণ। সুতরাং প্রমাণিত হয়েগেল জিহাদের সবব হলো হারবী হওয়া। আর হারবী দ্বারা উদ্দেশ্য হলো যুদ্ধ করতে সক্ষম হওয়া; যদিও সরাসরি যুদ্ধ করেনি।
    উপরের আলোচনা থেকে এটিও প্রমাণ হয়ে গেল যে, কাফেরদের বালেগ পুরুষদের হত্যা করা বৈধ; যদিও তারা সামরিক বাহিনীর সদস্য না হয়। কারণ ইসলামে সামরিক বেসামরিক হওয়ার ভিত্তি বলেগ হওয়া/যুদ্ধের উপযুক্ত গঠন থাকার উপর; সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা বা না করার উপর নয়।
    এই বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয় উসূলুল ফিকহের এই নীতি দ্বারা যে, যেকোনো বিধানের ইল্লতের জন্যে একটি শর্ত হলো ইল্লতটি ওয়াসফে জাহের হতে হবে। অর্থাৎ এমন কোনো বিষয়ের উপর বিধানের ভিত্তি রাখা হয় যা খুব সহজেই অনুমেয়। যাতে কোনো অস্পষ্টতা নেই। সুতরাং কে যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছে আর কে করেনি এই বিষয়টি সহজে অনুমেয় নয়; বরং খুবই জটিল। তাই বিধানের ভিত্তিটি রাখা হয়েছে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার মতো উপযুক্ত গঠন তথা বলেগ হওয়ার উপর। আর এটি ওয়াসফে জাহের সহজে অনুমেয়।
    চতুর্থ আলোচনা: জিহাদের ফযিলত

    এ বিষয়ে অসংখ্য আয়াত ও হাদীস রয়েছে। উলামায়ে ইসলামের অগণিত মুস্তাকেল রচনা রয়েছে। যা আলোচনা করে শেষ করার সাধ্য নেই। তাই এখানে আমরা শুধু শামী রহ. এর রদ্দুল মুহতারে উল্লেখ করা তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট আলোচনা করে ক্ষ্যন্ত হবো।
    এক. শাহাদাত বরণ করা বান্দার হকসমূহেরও কাফ্ফারাহ
    আমর ইবনে আস রাদিয়াল্লাহু আনহুর ছেলে আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
    «يُغْفَرُ لِلشَّهِيدِ كُلُّ ذَنْبٍ إِلَّا الدَّيْنَ» -أخرجه مسلم (1886)

    “শহীদের সকল পাপ মাফ করে দেয়া হয়; তবে ঋণ (মাফ করা হয় না)।” -সহীহ মুসলিম: ১৮৮৬
    শামসুল আয়িম্মা সারাখসী রহ. শরহুস সিয়ার গ্রন্থে এই জাতীয় একাধিক হাদীস উল্লেখ করার পর বলেন, ‘এই হাদীসগুলো দ্বারা বান্দার হকের গুরুত্ব প্রমাণিত হয়। কেউ কেউ বলেছেন এটি ইসলামের শুরু যগের বিধান এই জন্যেই তো ইসলামের শুরুযুগে কেউ ঋণ রেখে মারা গেলে নবীজী তার জানাযা পড়তেন না। কিন্তু পরবর্তীতে তা মানসূখ হয়েগেছে। নবীজী বলেছেন,
    «أَنَا أَوْلَى بِالْمُؤْمِنِينَ مِنْ أَنْفُسِهِمْ، فَمَنْ تُوُفِّيَ مِنَ المُؤْمِنِينَ فَتَرَكَ دَيْنًا، فَعَلَيَّ قَضَاؤُهُ، وَمَنْ تَرَكَ مَالًا فَلِوَرَثَتِهِ» -أخرجه البخاري (2298).

    আমি মোমিনদের নিকট তাদের প্রাণের চেয়েও অধিক প্রিয়। যে ব্যক্তি ঋণের বোঝা নিয়ে মারা যায় (এবং ঋণ পরিশোধ করার মত সম্পদ রেখে না যায়) তা পরিশোধ করার দায়িত্ব আমার। আর যে ব্যক্তি সম্পদ রেখে যায়, তা তার উত্তরাধিকারীদের জন্য।” -সহীহ বুখারী: ২২৯৮
    তাছাড়া সুনানে ইবনে মাজাহ শরীফের একটি হাদীসে এসেছে, মিরদাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন,
    أن النبي - صلى الله عليه وسلم - دعا لأمته عشية عرفة بالمغفرة، فأجيب: إني قد غفرت لهم ما خلا الظالم، فإني آخذ للمظلوم منه، قال: أي رب، إن شئت أعطيت المظلوم من الجنة، وغفرت للظالم" فلم يجب عشيته، فلما أصبح بالمزدلفة أعاد الدعاء، فأجيب إلى ما سأل، قال: فضحك رسول الله - صلى الله عليه وسلم - أو قال: تبسم - فقال له أبو بكر وعمر: بأبي أنت وأمي! إن هذه لساعة ما كنت تضحك فيها، فما الذي أضحكك؟ أضحك الله سنك! قال: "إن عدو الله إبليس، لما علم أن الله عز وجل قد استجاب دعائي، وغفر لأمتي، أخذ التراب فجعل يحثوه على رأسه، ويدعو بالويل والثبور، فأضحكني ما رأيت من جزعه". -أخرجه ابن ماجة (3013)

    “আরাফার দিন বিকেল বেলা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মতের জন্যে মাগফেরাতের দোয়া করলেন। তখন (আল্লাহর পক্ষ থেকে) জবাব দেয়া হয়েছে যে, আমি তাদের সকলকে ক্ষমা করে দিলাম; তবে জালেমকে নয়। কেননা আমি জালেম থেকে মাজলোমের জন্যে অধিকার আদায় করে ছাড়বো। নবীজী বললেন, হে প্রভূ! আপনি চাইলে তো মাজলোমকে জান্নাত থেকে (তার হক) আদায় করে দিতে পারেন আর জালেমকে ক্ষমা করে দিতে পারেন। কিন্তু সেই বিকেলে তা কবুল করা হয়নি। যখন মুযদালাফায় সকাল হলো নবীজী পুনরায় দোয়া করলেন। তখন তাঁর দোয়া কবুল করা হলো। এতে নবীজী হাসলেন। আবু বকর ও ওমর জিজ্ঞেস করলেন আপনার হাসির কারণ জানতে পারি? তিনি বললেন, আল্লাহর দুশমন ইবলিস যখন জানতে পারল আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করেছেন এবং আমার উম্মতকে মাফ করে দিয়েছেন; তখন ইবলিস তার মাথায় মাটি ঢালা শুরু করেছে এবং ধ্বংসের বদ দোয়া দিচ্ছে। আমি তার এমন করুণ অবস্থা দেখে হাসছি।” -সুনানে ইবনে মাজাহ: ৩০১৩
    অতঃপর শামী রহ. বলেন,
    فَلَا يَبْعُدُ مِثْلُ ذَلِكَ فِي حَقِّ الشَّهِيدِ الْمَدْيُونِ. -رد المحتار: 4/120

    “ঋণগ্রস্ত শহীদের ব্যাপারেও এমনটি দূরবর্তী নয় (যে আল্লাহ তায়ালা জান্নাত থেকে তার ঋণ পরিশোধ করে দিবেন)।” -রদ্দুল মুহতার: ৪/১২০ দারুল ফিকর।
    দুই. জিহাদের পাশাপাশি গনীমত লাভের নিয়্যাত থাকা
    হযরত আবূ হুরাইরাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন,
    أن رجلا قال: يا رسول الله، رجل يريد الجهاد في سبيل الله وهو يبتغي عرضا من عرض الدنيا، فقال رسول الله -صلى الله عليه وسلم-: "لا أجر له"، فأعظم ذلك الناس، وقالوا للرجل: عد لرسول الله -صلى الله عليه وسلم-، فلعلك لم تفهمه، فقال: يا رسول الله، رجل يريد الجهاد في سبيل الله وهو يبتغي عرضا من عرض الدنيا، فقال: "لا أجر له"، فقالوا للرجل: عد لرسول الله -صلى الله عليه وسلم-، فقال له الثالثة، فقال له: "لا أجر له". -أخرجه أبو داود (2516) والحاكم في مستدركه (2436) وقال: هذا حديث صحيح الإسناد ولم يخرجاه.

    এক ব্যক্তি বললো, হে আল্লাহর রাসূল! এক ব্যক্তি আল্লাহর পথে জিহাদের ইচ্ছা করেছে এবং সে এর দ্বারা পার্থিব সম্পদও অর্জন করতে চায়, (এ ব্যক্তির কি হবে)? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সে কোনো নেকী পাবে না। লোকেরা এতে অবাক হলো। তারা ঐ ব্যক্তিকে বললো, তুমি পুনরায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করে দেখো। মনে হয় তুমি তাঁকে বুঝিয়ে বলতে পারনি। সে বললো, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর পথে জিহাদের ইচ্ছা করেছে এবং সে এর দ্বারা পার্থিব সম্পদও অর্জন করতে চায়। তিনি বললেন, সে কোনো নেকী পাবে না। লোকেরা বললো, তুমি বিষয়টি আবারো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করো। লোকটি তৃতীয়বার তাঁকে জিজ্ঞেস করলো। তিনি বললেন, সে কোনো নেকী পাবে না।” -সুনানে আবু দাউদ: ২৫১৬
    শামসুল আয়িম্মা সারাখসী রহ. এই হাদীস উল্লেখ করার পর বলেন, এর দুটি ব্যাখ্যা হতে পারে:
    এক. বাহ্যিকভাবে মানুষদের দেখাচ্ছে সে জিহাদের উদ্দেশ্যে বের হয়েছে; কিন্তু তার আসল উদ্দেশ্য হলো গণিমত/সম্পদ লাভ করা। এটি মুনাফিকদের অবস্থা। সুতরাং এমন ব্যক্তি কোনো নেকী পাবে না। অথবা তার প্রধান উদ্দেশ্য সম্পদ। এই ব্যক্তিও কোন নেকী পাবে না।
    দুই. তার আসল উদ্দেশ্য জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ; পাশাপাশি গণিমত লাভের আশা থাকে। তাহলে তাতে কোনো সমস্যা নেই। যেমনটি আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,
    {لَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنَاحٌ أَنْ تَبْتَغُوا فَضْلًا مِنْ رَبِّكُمْ } [البقرة: 198]

    “তোমরা (হজ্জের সময়ে ব্যবসা বা মজুর খাটার মাধ্যমে) স্বীয় প্রতিপালকের অনুগ্রহ সন্ধান করলে তাতে তোমাদের কোন গুনাহ নেই।” -সূরা বাকারাহ: ১৯৮
    সুতরাং যেমনিভাবে হজ্জ আদায়ের উদ্দেশ্যে বের হয়ে পথে ব্যবসা বা মজুরি খেটে রোজগারের কারণে হজ্বের সাওয়াব থেকে মাহরোম হবে না; তেমনিভাবে জিহাদের উদ্দেশ্যে বের হয়ে পাশাপাশি গণিমত লাভের আশা করার কারণেও জিহাদের সাওয়াব থেকে মাহরোম হবে না। -শরহুস সিয়ার: ১/২৬ আশ শিরকাতুস শারকিয়্যাহ।
    এই বিষয়ে ইবনে হাজার আসকালানী রহ. সুন্দর আলোচনা করেছেন। باب من قاتل لتكون كلمة الله هي العليا শিরোনামের অধিনে তার আলোচনাটি উল্লেখ আছে। বিস্তারিত জানতে আলোচনাটি পড়ে নিতে পারেন ইনশাআল্লাহ। সংক্ষেপে তাঁর আলোচনার মূল কথা হলো: গণিমত লাভের নিয়্যত বা জিহাদের নিয়্যত এই দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যক্তি পাঁচ প্রকার।
    ১. আসল মাকসাদ গণিমত যিমনান (পাশাপাশি) ইলায়ে কালিমাতিল্লাহ হয়েছে। এমনটি মাহযোর (নিষিদ্ধ)। কোনো নেকী পাবে না।
    ২. আসল মাকসাদ জিহাদ যিমনান ইলায়ে কালিমাতিল্লাহ হয় নি। এটিও মাহযোর। কোন নেকী পাবে না।
    ৩. আসল মাকসাদ জিহাদ ও গণিমত উভয়টিই। এটিও মাহযোর। কোনো নেকী পাবে না।
    ৪. আসল মাকসাদ জিহাদ যিমনান (পাশাপাশি) গণিমত লাভ হয়েছে। কোন ক্ষতি নেই। তবে আখেরাতে তিন ভাগের একভাগ নেকী পাবেন। দুই ভাগ দুনিয়াতে পেয়ে গেছেন।
    ৫. আসল মাকসাদ জিহাদ যিমনান গণিমত লাভ হয় নি। সবচেয়ে উত্তম। আখেরাতে পরিপূর্ণ সাওয়াব পাবেন। -ফাতহুল বারী: ৬/২৮ দারুর মারিফাহ।
    তিন. কাফেরদের বিরুদ্ধে জিহাদ উত্তম নাকি নাফসের বিরুদ্ধে জিহাদ উত্তম
    এই বিষয়ে দলিলসহ বিস্তারিত জানতে ফাতহুল কাদীর থেকে ইবনুল হুমাম রহ. এর আলোচনাটি মোতালাআ করতে পারেন ইনশাআল্লাহ। আমরা এখানে অতি সংক্ষেতে শুধূ সার কথাটা উল্লেখ করছি।
    নফসের জিহাদ দ্বারা যদি উদ্দেশ্য হয় ইখলাস তাহলে কোনো সন্দেহ নেই নফসের জিহাদ উত্তম। কারণ ইখলাস হলো সকল আমলের রূহ; ইখলাস ছাড়া কোনো আমলই গ্রহণযোগ্য হবে না। এটি শুধু জিহাদের বেলায় নয়; নামাজ রোজা হজ্জ যাকাত সকল আমলের বেলায় প্রযোজ্য। এই দৃষ্টিকোণ থেকেই ইবনে হুমাম রহ. বিস্তারিত আলোচনা করেছেন এবং দেখিয়েছেন নফসকে প্রতিটি আমলের ক্ষেত্রে ইখলাসের উপর অটল রাখা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
    আর নফসের জিহাদ দ্বারা যদি উদ্দেশ্য হয় প্রচলিত তরীকায় তাসাউফের মেহনত মোজাহাদা, রিয়াজাত মোশাহাদাহ তাহলে নিঃসন্দেহে জিহাদ উত্তম। জিহাদের সাথে এটার কোনো তোলনাই চলবে না। কারণ এটা নফল আর জিহাদ ফরজ। তা ছাড়া জিহাদে বান্দা আল্লাহ তায়ালার জন্যে তার সবচেয়ে প্রিয়ো বস্তু জান মাল ব্যয় করে দেয়। সুতরাং এরচেয়ে উত্তম আর কী হতে পারে? ইমাম ইযযুদ্দীন ইবনে আব্দিস সালাম এই বিষয়ে সুন্দর আলোচনা করেছেন তার কিতাব ‘আহকামুল জিহাদ ওয়া ফাযায়িলুহু’ তে।
    ফরজে আঈনের গুরুত্ব ফরজে কিফায়া থেকে বেশি; তাই নামাজ রোজা, যাকাত, হজ্জ বেশি ফযীলতপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ। তবে জিহাদ যখন ফরজে আঈন হয়ে যায়; তখন তা নামাজ রোজার মতোই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে।
    আজকের আলোচনা এই পর্যন্তই।
    وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين
    চলবে ইনশাআল্লাহ।




Working...
X