সন্ত্রাস বিরোধী আইন (Anti-Terrorism Act) বলতে বোঝায় এমন একটি আইনি কাঠামো যা রাষ্ট্র কর্তৃক তথাকথিত "সন্ত্রাসী কার্যকলাপ" প্রতিরোধ, তদন্ত এবং দমন করার উদ্দেশ্যে প্রণীত হয়। সাধারণভাবে এসব আইনে ‘সন্ত্রাস’ সংজ্ঞায়িত করা হয় এমনভাবে যাতে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যদি রাষ্ট্রের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে বা তার আদর্শিক পরিকাঠামোকে প্রশ্ন তোলে, তখন তাদের কার্যকলাপকে সহজেই ‘সন্ত্রাসী’ তকমা দিয়ে দমন করা যায়। এসব আইনে বিচার-বহির্ভূত গ্রেপ্তার, দীর্ঘ সময় ধরে রিমান্ড, গোপন সাক্ষ্য, এমনকি বিচারের আগেই সামাজিকভাবে অপরাধী বানিয়ে দেওয়ার সুযোগ থাকে।
মূল বক্তব্য: এই আইন আসলে কাদের জন্য?
যদিও নাম শুনে মনে হয় এই আইন সমাজে প্রকৃত সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়, বাস্তবতা হলো — এসব আইন মূলত মুসলিম মুজাহিদিনদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়, যারা ইসলামী রাষ্ট্র ও শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করছে।
এই আইনের ছত্রছায়ায় বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র ও পশ্চিমা প্রভাবাধীন দেশগুলোতে, এমন বহু সংগঠন ও ব্যক্তি যারা "খিলাফাহ প্রতিষ্ঠা", "শরীয়াহভিত্তিক শাসন" অথবা "উম্মাহর ঐক্য"র মতো ধারণা প্রচার করছে, তাদের বিরুদ্ধে একের পর এক দমন-পীড়নের অভিযান চালানো হয়েছে। কেউ যদি কেবল দিন প্রতিষ্ঠার ধারণা নিয়ে কাজ করে — চরমপন্থা ছাড়াই — তবুও তার ওপর সন্ত্রাসবিরোধী আইনের করাঘাত পড়ে যায়।
টুইন টাওয়ার হামলার পর আমেরিকা এমন এক অবস্থায় পড়ে যায়, যেখানে তারা মনে করে যে আফগানিস্তানের মুজাহিদদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। তবে এই সিদ্ধান্তের পেছনে কেবল প্রতিশোধ বা প্রতিরক্ষা নয়, বরং কূটনৈতিক ও কৌশলগত জটিলতা ছিল অনেক গভীর।
প্রথমত, আমেরিকা একা এই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইছিল না। তারা জানত, এককভাবে মুসলিম ভূমিতে হামলা চালালে মুসলিম বিশ্বে এর প্রতিক্রিয়া ভয়াবহ হতে পারে। তাই তারা মিত্রদের পাশে টেনে আনার চেষ্টা করে — যেন এই যুদ্ধকে একটি সম্মিলিত "আন্তর্জাতিক উদ্যোগ" হিসেবে উপস্থাপন করা যায়।
দ্বিতীয়ত, আমেরিকা চাইছিল পুরো বিশ্বের মধ্যে এই যুদ্ধে একটি নৈতিক ও আইনি বৈধতা তৈরি করতে। তারা "War on Terror" নামক একটি ধারণা বাজারজাত করে, যার আওতায় শুধু আফগানিস্তান নয় বরং যেকোনো ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলনকে সহজেই সন্ত্রাসের ছাপে দমন করা সম্ভব হয়। জাতিসংঘ থেকে শুরু করে নানা আন্তর্জাতিক সংস্থা ও মিডিয়াকে ব্যবহার করে তারা এমন এক বয়ান নির্মাণ করে, যেন এই যুদ্ধটা আসলে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য, সভ্যতার রক্ষার জন্য।
এই দুই সংকট — একাকীত্বের আতঙ্ক এবং বৈধতার অভাব — কাটিয়ে ওঠার জন্য আমেরিকা যে কৌশল নিয়েছিল, তা পরবর্তী বিশ বছরে মুসলিম উম্মাহর ওপর এক নিষ্ঠুর ও সূক্ষ্ম আগ্রাসনের রূপরেখা তৈরি করে দেয়।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কের টুইন টাওয়ার ও পেন্টাগনে আত্মঘাতী হামলার ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্র কেবল একটি সামরিক জবাব নয়, বরং একটি বৈশ্বিক রাজনৈতিক ও আইনগত জবাব প্রস্তুত করতে চায়। যুদ্ধ কেবল বোমা ও গুলির মাধ্যমে নয়, বরং ন্যারেটিভ ও আইনের মাধ্যমেও পরিচালিত হয় — এটা বুঝে তারা দ্রুত জাতিসংঘের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সমর্থন ও আইনগত বৈধতা অর্জনের উদ্যোগ নেয়। এই প্রক্রিয়ায় গৃহীত হয় বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রেজোলিউশন, যা পরবর্তীতে ‘সন্ত্রাস বিরোধী আইন’ প্রণয়নে বৈশ্বিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করে
জাতিসংঘের রেজোলিউশনসমূহ:
১. রেজোলিউশন ১৩৬৮ (১২ সেপ্টেম্বর ২০০১)
২. রেজোলিউশন ১৩৭৩ (২৮ সেপ্টেম্বর ২০০১)
এই রেজোলিউশন অনুযায়ী গঠিত হয় Counter-Terrorism Committee (CTC), যেটি জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে এবং তাদের রিপোর্ট দাখিল করতে বাধ্য করে।
এই রেজোলিউশনদ্বয়ের ফলে, বিশ্বের বহু দেশ ২০০১–২০০3 সালের মধ্যে নিজ নিজ দেশে সন্ত্রাস বিরোধী আইন প্রণয়ন বা পূর্ববর্তী আইন সংশোধন করে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রণীত USA PATRIOT Act, যুক্তরাজ্যের Anti-terrorism, Crime and Security Act 2001, ভারতের UAPA-র পুনর্বিন্যাস, এবং এমনকি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতেও কঠোর আইন চালু হয়— যেগুলোর অনেকটাই জাতিসংঘের ১৩৭৩ রেজোলিউশনের নির্দেশনার আলোকে গঠিত।
অবশেষে, জাতিসংঘের রেজোলিউশন ১৩৭৩-এর নির্দেশনা অনুসারে, একটি বৈশ্বিক কাঠামোর আওতায় সন্ত্রাসবিরোধী আইন প্রণয়ন করা হয়— যার উদ্দেশ্য ছিল প্রতিটি রাষ্ট্রকে নিজ নিজ অভ্যন্তরে তথাকথিত সন্ত্রাস প্রতিরোধে একইধরনের আইনগত কাঠামো গড়ে তোলা এবং তা কার্যকর করা।
এই আইনি কাঠামো ছিল বাধ্যতামূলক— জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অধ্যায় VII অনুযায়ী গৃহীত হওয়ায়, সদস্য রাষ্ট্রগুলোর উপর এটি আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরি করে। অর্থাৎ, কোনো রাষ্ট্র এর নির্দেশনা উপেক্ষা করতে পারে না। প্রত্যেক রাষ্ট্রকে নিজ নিজ সংবিধান ও আইন অনুযায়ী রেজোলিউশন ১৩৭৩ বাস্তবায়নের জন্য আইন, প্রশাসন ও গোয়েন্দা কাঠামো ঢেলে সাজাতে বাধ্য করা হয়।
বাংলাদেশও এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ২০০৯ সালে "সন্ত্রাসবিরোধী আইন (Anti-Terrorism Act, 2009)" প্রণয়ন করে, যা ২০১২ ও ২০১৩ সালে সংশোধিত হয়।
এই আইনে বেশ কিছু ধারা আছে যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ‘সন্ত্রাস’ সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টায় করা হয়েছে, তবে বাস্তবে এসব ধারা এতটাই অব্যবস্থিত, ব্যাখ্যাতীত এবং অস্পষ্ট যে তা রাজনৈতিক বিরোধীদের দমন, ইসলামপন্থীদের টার্গেট করা, এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।
বিশেষ করে, ইসলামী আন্দোলন, শরিয়া প্রতিষ্ঠার ডাক, বা খিলাফাহর ধারণার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করাকেও কখনো কখনো এই আইনের আওতায় "চরমপন্থা" বলে চিহ্নিত করে দমনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
একে বলা যায় "সন্ত্রাসবিরোধী আইনের বৈশ্বিক ছাঁচ"— এমন একটি আইনি কাঠামো যা জাতিসংঘের ১৩৭৩ রেজোলিউশনের মাধ্যমে সমস্ত সদস্য রাষ্ট্রের ওপর বাধ্যতামূলকভাবে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, আপনি জাতিসংঘের যেকোনো রাষ্ট্রেই যান না কেন— হোক তা বাংলাদেশ, মিসর, ইন্দোনেশিয়া কিংবা নাইজেরিয়া— "সন্ত্রাসবিরোধী আইন" সেখানে পাবেন, এবং সেই আইনে আপনি খুঁজে পাবেন একই ধরণের ভাষা, একই ধরণের অপরাধের সংজ্ঞা, এবং একই ধরণের দমনমূলক ক্ষমতা।
সাধারণ কাঠামোটি এমন:
তাই ধরুন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি মৌলিক মোড় আসে—যেমন একটি জুলাই বিপ্লব, যেখানে জনগণের ব্যাপক জাগরণ ও পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষায় একটি নতুন রাষ্ট্রকাঠামো গঠিত হয়। এই নতুন বাস্তবতায় সরকার চাইলে বহু বিতর্কিত আইন—যেমন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, বিশেষ ক্ষমতা আইন কিংবা রাজনৈতিক দমনমূলক বিধান—সহজেই সংশোধন বা বাতিল করতে পারে। কারণ সেগুলো মূলত অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে প্রণীত হয়েছিল, এবং জনগণের ইচ্ছার সাথে সাংঘর্ষিক হলে তাদের বিলোপ আইনত ও নৈতিকভাবে যৌক্তিক হয়।
কিন্তু সন্ত্রাসবিরোধী আইন—এটি একেবারেই ভিন্ন বাস্তবতার অংশ। এ আইন শুধুমাত্র বাংলাদেশের নিজস্ব প্রয়াসে গঠিত নয়; বরং এটি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ১৩৭৩ নম্বর রেজোলিউশনের ভিত্তিতে প্রণীত, যা সকল সদস্য রাষ্ট্রের জন্য আইনি বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করে। ফলে, বিপ্লবের পর নতুন সরকার এই আইন বাতিল করতে চাইলেও তা করতে পারবে না—অন্তত আন্তর্জাতিক আইনি কাঠামোর ভেতরে থেকে নয়।
কিন্তু সন্ত্রাসবিরোধী আইন এমন এক কাঠামোর অংশ, যা আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে বাধ্যতামূলক এবং তা রাষ্ট্রীয় ধারাবাহিকতার নীতি (principle of state continuity) দ্বারা সংরক্ষিত।
জাতিসংঘের অধ্যায় VII অনুযায়ী গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো—বিশেষত নিরাপত্তা পরিষদের রেজোলিউশনসমূহ—সব সদস্য রাষ্ট্রের জন্য আইনি বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করে। সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ এই আইন মানতে আন্তর্জাতিকভাবে বাধ্য। এর ব্যত্যয় ঘটালে দেশটি কূটনৈতিক চাপে পড়তে পারে, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে পারে, এমনকি ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ হিসেবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে পারে।
আওয়ামী লীগ, বিএনপি কিংবা দেশের সুদ ব্যবসায়ী ইউনুস কখনোই সন্ত্রাসবিরোধী আইন বাতিলের পক্ষপাতী হবে না—এটি একটি বাস্তবতাস্বরূপ। কারণ এই আইন তাদের ক্ষমতা ও স্বার্থ রক্ষার জন্য অপরিহার্য একটি হাতিয়ার। তারা জানে, এই আইন তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে, ফলে আইনটি ছাড়ার কোনো আগ্রহ তাদের নেই।
তবে যদি কখনো কোনো সরকার বা গোষ্ঠী এই আইন বাতিলের চিন্তা করে, তাহলে তাদের প্রথমে মোকাবেলা করতে হবে আন্তর্জাতিক ক্ষমতাসীন পশ্চিমাদের কঠোর প্রতিক্রিয়ার মুখে পড়া। পশ্চিমারা তখন দাবি করবে, "তোমরা এই আইন বাতিল করতে চাও—অর্থাৎ তোমরা সন্ত্রাসী বা জঙ্গিদের পৃষ্ঠপোষক।" এই লেবেলিংয়ের মাধ্যমে তারা দেশের ওপর সন্দেহের ছায়া ফেলবে, যা আন্তর্জাতিক মানচিত্রে দেশের অবস্থান দুর্বল করে দেয়।
এরপর আসবে নানা ধরনের সঙ্কট। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দেখা দেবে আর্থিক নিষেধাজ্ঞা, ব্যাংকিং সেবা থেকে বঞ্চিত হওয়া, বাণিজ্যিক লেনদেনে বাঁধা, এবং বৈদেশিক বিনিয়োগের সংকট। এসব আর্থিক চাপ দেশের ব্যবসায়ী সমাজের ওপর তীব্র প্রভাব ফেলবে।
এছাড়াও রাজনৈতিক ও সামরিক চাপও বেড়ে যাবে। সামরিক আগ্রাসন, কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতা, তথ্যপ্রযুক্তি ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর নজরদারি, এমনকি নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর চাপ সৃষ্টি—সবই হয়ে উঠতে পারে বাস্তবতার অংশ। এই সব বাধা অতিক্রম করতে না পারলে কোনো সরকারই সাহস করে সন্ত্রাসবিরোধী আইন বাতিলের পথে যেতে পারবে না।
যদিও এটি সত্য যে বাংলাদেশের সন্ত্রাসবিরোধী আইন দেশের সংবিধানের আওতায় গৃহীত হয়েছে, এবং এটিকে অনেক সময় ‘রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের’ একটি অংশ হিসেবেও উপস্থাপন করা হয়, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। সংবিধান, সার্বভৌমত্ব, জনগণের ইচ্ছা—এসব শব্দ মূলত কাগজে-কলমে আছে, কিন্তু ক্ষমতার বাস্তব খেলার মাঠে সেগুলো প্রায়ই নিছক শোভামাত্র।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সরকার এক ধরনের আন্তর্জাতিক আনুগত্যের শৃঙ্খলে আবদ্ধ কুকুর, যেখানে পশ্চিমা বিশ্ব—বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় শক্তিগুলো—'উন্নয়ন', 'গণতন্ত্র', 'মানবাধিকার', 'ঋণ', ও 'বাণিজ্য'র নামে রাষ্ট্রের গলায় হাড্ডি ঝুলিয়ে রেখেছে। আর আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব—যেই দলের হোক না কেন—চিরকাল লেজ নাড়িয়ে সেই হাড্ডির জন্য প্রভুদের আনুগত্য প্রকাশে ব্যস্ত।
এমন একটি প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের বিতর্কিত বহু আইন—যেমন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বা বিশেষ ক্ষমতা আইন—সময় ও জনচাপ অনুযায়ী পরিবর্তিত বা সংশোধিত হতে পারে। কারণ, এসব আইন দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ব্যালান্সের উপাদান। কিন্তু সন্ত্রাসবিরোধী আইন এক entirely ভিন্ন শ্রেণির আইন, যার শিকড় প্রোথিত জাতিসংঘ ও পশ্চিমা নিরাপত্তা কাঠামোর গভীরে। এটি শুধুমাত্র একটি আইন নয়—এটি একটি আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর অংশ, একটি আদর্শিক দমনযন্ত্র, যার উদ্দেশ্য হচ্ছে মুসলিমবিশ্বে যেকোনো প্রকার ‘পুনর্জাগরণ’, ‘প্রতিরোধ’ বা ‘বিপ্লব’-কে শিকড়েই নিষ্পেষণ করা।
তাই, যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না কেন—চাই তা আওয়ামী লীগ হোক, বিএনপি হোক, কিংবা কোনো নোবেল বিজয়ী সুদব্যবসায়ী হোক—এই আইনের মূলে হাত দেওয়া তাদের সাধ্যের বাইরে। তারা বরং এই আইনের দোহাই দিয়ে আরও বেশি দমন-পীড়নকেই বৈধতা দেবে, আর পশ্চিমাদের সামনে তাদের বিশ্বস্ততা প্রমাণে আরও কিছু "ভক্তি প্রদর্শনের" অভিনয় করবে।
অতএব, সন্ত্রাসবিরোধী আইন কখনোই কেবল একটি আইনি বা সাংবিধানিক বিষয় নয়। এটি একটি নতুন উপনিবেশিক দাসত্বের শৃঙ্খল, যেখান থেকে মুক্তি পেতে হলে কেবল সংবিধান বদলানো বা নির্বাচন জয় করাই যথেষ্ট নয়—প্রয়োজন আদর্শিক মুক্তি, অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা, এবং রাজনৈতিক আত্মবিশ্বাসের এক নবযাত্রা।
মূল বক্তব্য: এই আইন আসলে কাদের জন্য?
যদিও নাম শুনে মনে হয় এই আইন সমাজে প্রকৃত সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়, বাস্তবতা হলো — এসব আইন মূলত মুসলিম মুজাহিদিনদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়, যারা ইসলামী রাষ্ট্র ও শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করছে।
এই আইনের ছত্রছায়ায় বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র ও পশ্চিমা প্রভাবাধীন দেশগুলোতে, এমন বহু সংগঠন ও ব্যক্তি যারা "খিলাফাহ প্রতিষ্ঠা", "শরীয়াহভিত্তিক শাসন" অথবা "উম্মাহর ঐক্য"র মতো ধারণা প্রচার করছে, তাদের বিরুদ্ধে একের পর এক দমন-পীড়নের অভিযান চালানো হয়েছে। কেউ যদি কেবল দিন প্রতিষ্ঠার ধারণা নিয়ে কাজ করে — চরমপন্থা ছাড়াই — তবুও তার ওপর সন্ত্রাসবিরোধী আইনের করাঘাত পড়ে যায়।
টুইন টাওয়ার হামলার পর আমেরিকা এমন এক অবস্থায় পড়ে যায়, যেখানে তারা মনে করে যে আফগানিস্তানের মুজাহিদদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। তবে এই সিদ্ধান্তের পেছনে কেবল প্রতিশোধ বা প্রতিরক্ষা নয়, বরং কূটনৈতিক ও কৌশলগত জটিলতা ছিল অনেক গভীর।
প্রথমত, আমেরিকা একা এই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইছিল না। তারা জানত, এককভাবে মুসলিম ভূমিতে হামলা চালালে মুসলিম বিশ্বে এর প্রতিক্রিয়া ভয়াবহ হতে পারে। তাই তারা মিত্রদের পাশে টেনে আনার চেষ্টা করে — যেন এই যুদ্ধকে একটি সম্মিলিত "আন্তর্জাতিক উদ্যোগ" হিসেবে উপস্থাপন করা যায়।
দ্বিতীয়ত, আমেরিকা চাইছিল পুরো বিশ্বের মধ্যে এই যুদ্ধে একটি নৈতিক ও আইনি বৈধতা তৈরি করতে। তারা "War on Terror" নামক একটি ধারণা বাজারজাত করে, যার আওতায় শুধু আফগানিস্তান নয় বরং যেকোনো ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলনকে সহজেই সন্ত্রাসের ছাপে দমন করা সম্ভব হয়। জাতিসংঘ থেকে শুরু করে নানা আন্তর্জাতিক সংস্থা ও মিডিয়াকে ব্যবহার করে তারা এমন এক বয়ান নির্মাণ করে, যেন এই যুদ্ধটা আসলে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য, সভ্যতার রক্ষার জন্য।
এই দুই সংকট — একাকীত্বের আতঙ্ক এবং বৈধতার অভাব — কাটিয়ে ওঠার জন্য আমেরিকা যে কৌশল নিয়েছিল, তা পরবর্তী বিশ বছরে মুসলিম উম্মাহর ওপর এক নিষ্ঠুর ও সূক্ষ্ম আগ্রাসনের রূপরেখা তৈরি করে দেয়।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কের টুইন টাওয়ার ও পেন্টাগনে আত্মঘাতী হামলার ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্র কেবল একটি সামরিক জবাব নয়, বরং একটি বৈশ্বিক রাজনৈতিক ও আইনগত জবাব প্রস্তুত করতে চায়। যুদ্ধ কেবল বোমা ও গুলির মাধ্যমে নয়, বরং ন্যারেটিভ ও আইনের মাধ্যমেও পরিচালিত হয় — এটা বুঝে তারা দ্রুত জাতিসংঘের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সমর্থন ও আইনগত বৈধতা অর্জনের উদ্যোগ নেয়। এই প্রক্রিয়ায় গৃহীত হয় বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রেজোলিউশন, যা পরবর্তীতে ‘সন্ত্রাস বিরোধী আইন’ প্রণয়নে বৈশ্বিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করে
জাতিসংঘের রেজোলিউশনসমূহ:
১. রেজোলিউশন ১৩৬৮ (১২ সেপ্টেম্বর ২০০১)
হামলার পরদিনই এই রেজোলিউশন পাস করা হয়। এতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ৯/১১-কে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য একটি গুরুতর হুমকি হিসেবে ঘোষণা করে। এই রেজোলিউশনের মাধ্যমে সকল সদস্য রাষ্ট্রকে আহ্বান জানানো হয়— হামলাকারীদের দমন ও বিচারের আওতায় আনতে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করতে। এই প্রথমবার জাতিসংঘ আত্মরক্ষার অধিকার (Article 51 of the UN Charter) প্রকাশ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ নেয়।
২. রেজোলিউশন ১৩৭৩ (২৮ সেপ্টেম্বর ২০০১)
এই রেজোলিউশনটি ৯/১১-র জবাবে গৃহীত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আইনি পদক্ষেপ। এতে সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে বলা হয়—
- সন্ত্রাসবাদীদের অর্থায়ন প্রতিরোধে ব্যবস্থা নিতে,
- সন্ত্রাসীদের নিরাপদ আশ্রয় না দিতে,
- সীমান্তে নজরদারি জোরদার করতে,
- এবং অভ্যন্তরীণভাবে উপযুক্ত আইনি কাঠামো তৈরির মাধ্যমে সন্ত্রাস বিরোধী আইন প্রণয়ন করতে।
এই রেজোলিউশন অনুযায়ী গঠিত হয় Counter-Terrorism Committee (CTC), যেটি জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে এবং তাদের রিপোর্ট দাখিল করতে বাধ্য করে।
এই রেজোলিউশনদ্বয়ের ফলে, বিশ্বের বহু দেশ ২০০১–২০০3 সালের মধ্যে নিজ নিজ দেশে সন্ত্রাস বিরোধী আইন প্রণয়ন বা পূর্ববর্তী আইন সংশোধন করে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রণীত USA PATRIOT Act, যুক্তরাজ্যের Anti-terrorism, Crime and Security Act 2001, ভারতের UAPA-র পুনর্বিন্যাস, এবং এমনকি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতেও কঠোর আইন চালু হয়— যেগুলোর অনেকটাই জাতিসংঘের ১৩৭৩ রেজোলিউশনের নির্দেশনার আলোকে গঠিত।
অবশেষে, জাতিসংঘের রেজোলিউশন ১৩৭৩-এর নির্দেশনা অনুসারে, একটি বৈশ্বিক কাঠামোর আওতায় সন্ত্রাসবিরোধী আইন প্রণয়ন করা হয়— যার উদ্দেশ্য ছিল প্রতিটি রাষ্ট্রকে নিজ নিজ অভ্যন্তরে তথাকথিত সন্ত্রাস প্রতিরোধে একইধরনের আইনগত কাঠামো গড়ে তোলা এবং তা কার্যকর করা।
এই আইনি কাঠামো ছিল বাধ্যতামূলক— জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অধ্যায় VII অনুযায়ী গৃহীত হওয়ায়, সদস্য রাষ্ট্রগুলোর উপর এটি আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরি করে। অর্থাৎ, কোনো রাষ্ট্র এর নির্দেশনা উপেক্ষা করতে পারে না। প্রত্যেক রাষ্ট্রকে নিজ নিজ সংবিধান ও আইন অনুযায়ী রেজোলিউশন ১৩৭৩ বাস্তবায়নের জন্য আইন, প্রশাসন ও গোয়েন্দা কাঠামো ঢেলে সাজাতে বাধ্য করা হয়।
বাংলাদেশও এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ২০০৯ সালে "সন্ত্রাসবিরোধী আইন (Anti-Terrorism Act, 2009)" প্রণয়ন করে, যা ২০১২ ও ২০১৩ সালে সংশোধিত হয়।
এই আইনে বেশ কিছু ধারা আছে যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ‘সন্ত্রাস’ সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টায় করা হয়েছে, তবে বাস্তবে এসব ধারা এতটাই অব্যবস্থিত, ব্যাখ্যাতীত এবং অস্পষ্ট যে তা রাজনৈতিক বিরোধীদের দমন, ইসলামপন্থীদের টার্গেট করা, এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।
বিশেষ করে, ইসলামী আন্দোলন, শরিয়া প্রতিষ্ঠার ডাক, বা খিলাফাহর ধারণার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করাকেও কখনো কখনো এই আইনের আওতায় "চরমপন্থা" বলে চিহ্নিত করে দমনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
একে বলা যায় "সন্ত্রাসবিরোধী আইনের বৈশ্বিক ছাঁচ"— এমন একটি আইনি কাঠামো যা জাতিসংঘের ১৩৭৩ রেজোলিউশনের মাধ্যমে সমস্ত সদস্য রাষ্ট্রের ওপর বাধ্যতামূলকভাবে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, আপনি জাতিসংঘের যেকোনো রাষ্ট্রেই যান না কেন— হোক তা বাংলাদেশ, মিসর, ইন্দোনেশিয়া কিংবা নাইজেরিয়া— "সন্ত্রাসবিরোধী আইন" সেখানে পাবেন, এবং সেই আইনে আপনি খুঁজে পাবেন একই ধরণের ভাষা, একই ধরণের অপরাধের সংজ্ঞা, এবং একই ধরণের দমনমূলক ক্ষমতা।
সাধারণ কাঠামোটি এমন:
- সন্ত্রাস বা উগ্রবাদ সংজ্ঞায় এমন অস্পষ্ট শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে যা ইসলামী আদর্শ প্রচার বা খিলাফাহর ধারণাকেও অভিযুক্ত করতে পারে।
- আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে বিশাল ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে — যেমন গ্রেপ্তারের আগে তথ্য গোপন রাখা, দীর্ঘ সময় আটক রাখা, ডিজিটাল পর্যবেক্ষণ ইত্যাদি।
- প্রতিটি দেশে একটি ‘কাউন্টার টেররিজম ইউনিট’ বা তদরূপ সংস্থা তৈরি হয়েছে— যা জাতিসংঘে প্রতিবেদন দাখিল করে।
তাই ধরুন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি মৌলিক মোড় আসে—যেমন একটি জুলাই বিপ্লব, যেখানে জনগণের ব্যাপক জাগরণ ও পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষায় একটি নতুন রাষ্ট্রকাঠামো গঠিত হয়। এই নতুন বাস্তবতায় সরকার চাইলে বহু বিতর্কিত আইন—যেমন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, বিশেষ ক্ষমতা আইন কিংবা রাজনৈতিক দমনমূলক বিধান—সহজেই সংশোধন বা বাতিল করতে পারে। কারণ সেগুলো মূলত অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে প্রণীত হয়েছিল, এবং জনগণের ইচ্ছার সাথে সাংঘর্ষিক হলে তাদের বিলোপ আইনত ও নৈতিকভাবে যৌক্তিক হয়।
কিন্তু সন্ত্রাসবিরোধী আইন—এটি একেবারেই ভিন্ন বাস্তবতার অংশ। এ আইন শুধুমাত্র বাংলাদেশের নিজস্ব প্রয়াসে গঠিত নয়; বরং এটি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ১৩৭৩ নম্বর রেজোলিউশনের ভিত্তিতে প্রণীত, যা সকল সদস্য রাষ্ট্রের জন্য আইনি বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করে। ফলে, বিপ্লবের পর নতুন সরকার এই আইন বাতিল করতে চাইলেও তা করতে পারবে না—অন্তত আন্তর্জাতিক আইনি কাঠামোর ভেতরে থেকে নয়।
কিন্তু সন্ত্রাসবিরোধী আইন এমন এক কাঠামোর অংশ, যা আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে বাধ্যতামূলক এবং তা রাষ্ট্রীয় ধারাবাহিকতার নীতি (principle of state continuity) দ্বারা সংরক্ষিত।
জাতিসংঘের অধ্যায় VII অনুযায়ী গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো—বিশেষত নিরাপত্তা পরিষদের রেজোলিউশনসমূহ—সব সদস্য রাষ্ট্রের জন্য আইনি বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করে। সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ এই আইন মানতে আন্তর্জাতিকভাবে বাধ্য। এর ব্যত্যয় ঘটালে দেশটি কূটনৈতিক চাপে পড়তে পারে, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে পারে, এমনকি ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ হিসেবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে পারে।
আওয়ামী লীগ, বিএনপি কিংবা দেশের সুদ ব্যবসায়ী ইউনুস কখনোই সন্ত্রাসবিরোধী আইন বাতিলের পক্ষপাতী হবে না—এটি একটি বাস্তবতাস্বরূপ। কারণ এই আইন তাদের ক্ষমতা ও স্বার্থ রক্ষার জন্য অপরিহার্য একটি হাতিয়ার। তারা জানে, এই আইন তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে, ফলে আইনটি ছাড়ার কোনো আগ্রহ তাদের নেই।
তবে যদি কখনো কোনো সরকার বা গোষ্ঠী এই আইন বাতিলের চিন্তা করে, তাহলে তাদের প্রথমে মোকাবেলা করতে হবে আন্তর্জাতিক ক্ষমতাসীন পশ্চিমাদের কঠোর প্রতিক্রিয়ার মুখে পড়া। পশ্চিমারা তখন দাবি করবে, "তোমরা এই আইন বাতিল করতে চাও—অর্থাৎ তোমরা সন্ত্রাসী বা জঙ্গিদের পৃষ্ঠপোষক।" এই লেবেলিংয়ের মাধ্যমে তারা দেশের ওপর সন্দেহের ছায়া ফেলবে, যা আন্তর্জাতিক মানচিত্রে দেশের অবস্থান দুর্বল করে দেয়।
এরপর আসবে নানা ধরনের সঙ্কট। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দেখা দেবে আর্থিক নিষেধাজ্ঞা, ব্যাংকিং সেবা থেকে বঞ্চিত হওয়া, বাণিজ্যিক লেনদেনে বাঁধা, এবং বৈদেশিক বিনিয়োগের সংকট। এসব আর্থিক চাপ দেশের ব্যবসায়ী সমাজের ওপর তীব্র প্রভাব ফেলবে।
এছাড়াও রাজনৈতিক ও সামরিক চাপও বেড়ে যাবে। সামরিক আগ্রাসন, কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতা, তথ্যপ্রযুক্তি ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর নজরদারি, এমনকি নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর চাপ সৃষ্টি—সবই হয়ে উঠতে পারে বাস্তবতার অংশ। এই সব বাধা অতিক্রম করতে না পারলে কোনো সরকারই সাহস করে সন্ত্রাসবিরোধী আইন বাতিলের পথে যেতে পারবে না।
যদিও এটি সত্য যে বাংলাদেশের সন্ত্রাসবিরোধী আইন দেশের সংবিধানের আওতায় গৃহীত হয়েছে, এবং এটিকে অনেক সময় ‘রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের’ একটি অংশ হিসেবেও উপস্থাপন করা হয়, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। সংবিধান, সার্বভৌমত্ব, জনগণের ইচ্ছা—এসব শব্দ মূলত কাগজে-কলমে আছে, কিন্তু ক্ষমতার বাস্তব খেলার মাঠে সেগুলো প্রায়ই নিছক শোভামাত্র।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সরকার এক ধরনের আন্তর্জাতিক আনুগত্যের শৃঙ্খলে আবদ্ধ কুকুর, যেখানে পশ্চিমা বিশ্ব—বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় শক্তিগুলো—'উন্নয়ন', 'গণতন্ত্র', 'মানবাধিকার', 'ঋণ', ও 'বাণিজ্য'র নামে রাষ্ট্রের গলায় হাড্ডি ঝুলিয়ে রেখেছে। আর আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব—যেই দলের হোক না কেন—চিরকাল লেজ নাড়িয়ে সেই হাড্ডির জন্য প্রভুদের আনুগত্য প্রকাশে ব্যস্ত।
এমন একটি প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের বিতর্কিত বহু আইন—যেমন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বা বিশেষ ক্ষমতা আইন—সময় ও জনচাপ অনুযায়ী পরিবর্তিত বা সংশোধিত হতে পারে। কারণ, এসব আইন দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ব্যালান্সের উপাদান। কিন্তু সন্ত্রাসবিরোধী আইন এক entirely ভিন্ন শ্রেণির আইন, যার শিকড় প্রোথিত জাতিসংঘ ও পশ্চিমা নিরাপত্তা কাঠামোর গভীরে। এটি শুধুমাত্র একটি আইন নয়—এটি একটি আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর অংশ, একটি আদর্শিক দমনযন্ত্র, যার উদ্দেশ্য হচ্ছে মুসলিমবিশ্বে যেকোনো প্রকার ‘পুনর্জাগরণ’, ‘প্রতিরোধ’ বা ‘বিপ্লব’-কে শিকড়েই নিষ্পেষণ করা।
তাই, যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না কেন—চাই তা আওয়ামী লীগ হোক, বিএনপি হোক, কিংবা কোনো নোবেল বিজয়ী সুদব্যবসায়ী হোক—এই আইনের মূলে হাত দেওয়া তাদের সাধ্যের বাইরে। তারা বরং এই আইনের দোহাই দিয়ে আরও বেশি দমন-পীড়নকেই বৈধতা দেবে, আর পশ্চিমাদের সামনে তাদের বিশ্বস্ততা প্রমাণে আরও কিছু "ভক্তি প্রদর্শনের" অভিনয় করবে।
অতএব, সন্ত্রাসবিরোধী আইন কখনোই কেবল একটি আইনি বা সাংবিধানিক বিষয় নয়। এটি একটি নতুন উপনিবেশিক দাসত্বের শৃঙ্খল, যেখান থেকে মুক্তি পেতে হলে কেবল সংবিধান বদলানো বা নির্বাচন জয় করাই যথেষ্ট নয়—প্রয়োজন আদর্শিক মুক্তি, অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা, এবং রাজনৈতিক আত্মবিশ্বাসের এক নবযাত্রা।
Comment