بسم الله والحمد لله والصلاة والسلام على رسول الله وعلى آله وصحبه ومن والاه أما بعد:
প্রথমে ওই সকল সুভাকাঙ্ক্ষি ভাইদের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি ১ম পর্বে যাঁদের করা কমেন্টগুলো আমাকে ২য় পর্ব শিয়ার করতে অনুপ্রেরণা যোগিয়েছে। জাযাহুমুল্লাহু খাইরান।
২য় দারস: রিবাত ও মুরাবিত
রিবাত এর আভিধানিক অর্থ
রিবাতুন (رِبَاطٌ) শব্দটি বাবে মুফাআলা (بَابِ مُفَاعَلَةٌ) এর মাসদার। মাদ্দা: ربط অর্থ: বাঁধা। যেহেতু সীমান্তে শত্রুকে ভয়-ভীতি দেখাতে মুজাহিদ সর্বদা নিজের ঘোড়া বেঁধে রাখে এবং শত্রু পক্ষও তাদের ঘোড়া প্রস্তুত রাখে; তাই রিবাত কে রিবাত বলা হয়।
মুরাবিত অর্থ: সীমান্তরক্ষী, বর্ডারগার্ড।
রিবাতের পারিভাষিক অর্থ
শরীয়তের পরিভাষায় রিবাত বলা হয়, ইসলামী রাষ্ট্রকে শত্রুর আক্রমণ ও যাবতীয় অনিষ্ট থেকে পাহারা দেয়ার উদ্দেশ্যে সীমান্তে তথা এমন জায়গায় অবস্থান করা যেখানে ইসলামী রাষ্ট্রের সীমানা শেষ ও কাফের রাষ্ট্রের সীমানা শুরু।
আলাউদ্দীন হাসকাফী (১০৮৮হি.) রাহিমাহুল্লাহ বলেন,
الرباط وهو الإقامة في مكان ليس وراءه إسلام هو المختار. - الدر المختار وحاشية ابن عابدين: 4/121
“রিবাত বলা হয় এমন জায়গায় অবস্থান করাকে যার পর আর ইসলাম নেই। এটিই গ্রহণযোগ্য সজ্ঞা।” -আদ্দুররুল মুখতার রদ্দুল মুহতারসহ: ৪/১২১ দারুল ফিকর।
শামসুল আয়িম্মা সারাখসী (৪৮৩হি.) রাহিমাহুল্লাহ বলেন,
والمرابطة: عبارة عن المقام في ثغر العدو لإعزاز الدين ودفع شر المشركين عن المسلمين. -شرح السير الكبير: 1/7
“রিবাত হলো, দ্বীন ইসলামকে শক্তিশালী করা ও মুসলিম উম্মাহকে মুশরিকদের অনিষ্ট থেকে রক্ষা করার লক্ষ্যে শত্রুসীমান্তে অবস্থান করা।” -শরহুস সিয়ার: ১/৭
সীমান্তে অবস্থান করা আবশ্যক
সুতরাং মুরাবিত হওয়ার জন্য সীমান্তে অবস্থান করা আবশ্যক। অন্যথায় সকল মুসলমানই তো নিজ নিজ অবস্থানে থেকে মুরাবিত বলে গণ্য হবে।
তবে শত্রুসীমান্তে অবস্থানকারী মুজাহিদদের সাপোর্ট যোগাতে যে মুজাহিদরা পিছনের সীমান্তে অবস্থান করছে; যাদের সাপোর্ট ছাড়া শত্রুর মোকাবেলা করা সম্ভব না তারা মুরাবিতীন বলে গণ্য হবে।
ইবনে আবেদীন শামী রহ. (১২৫২ হি.) বলেন,
لكن لو كان الثغر المقابل للعدو لا تحصل به كفاية الدفع إلا بثغر وراءه فهما رباط كما لا يخفى. -رد المحتار: 4/121
“বলার অপেক্ষা রাখে না যে, যদি শত্রুসীমান্ত প্রতিরোধে যথেষ্ঠ না হয়; বরং পিছনের সীমান্তের সাহায্যের প্রয়োজন হয়; তাহলে উভয়টিই রিবাত। -রদ্দুল মুহতার: ৪/১২১
রিবাতের নিয়্যাত থাকলে সীমান্তবর্তী এলাকাবাসী মুরাবিত হতে পারবে
ইমাম মালেক (১৭৯ হি.) রাহিমাহুল্লাহর মতে মুরাবিত হওয়ার জন্য শর্ত, সীমান্ত নিজের ওয়াতন বা স্থায়ী বাসস্থান না হতে হবে। (তাঁর শর্ত মতে সীমান্তবর্তী এলাকার লোকেরা মুরাবিত হতে পারবে না।)
তবে ইবনে হাজার আসকালানী (৮৫২ হি.) রাহিমাহুল্লাহ ইমাম মালেক রহ. এর এই শর্তের উপর আপত্তি তুলেছেন। রিবাত সীমান্তে বাসস্থান বানানোর দ্বারাও হতে পারে; যদি তাতে বসবাসের উদ্দেশ্য হয় শত্রু প্রতিরোধ করা। আর এই জন্যেই তো বহু সালাফ নিজের বাসস্থানরূপে সীমান্তকে বেঁচে নিয়েছেন। -ফাতহুল বারী: ৬/৮৫ দারুল মারিফাহ।
ফতোয়া শামীতে ইবনে আবেদীন শামী (১২৫২ হি.) রহিমাহুল্লাহ ইবনে হাজার আসকালান (৮৫২ হি.) রহিমাহুল্লাহর মতকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। -রদ্দুল মুহতার: ৪/১২১ দারুল ফিকর।
রিবাতের ফাযায়েল
আলাউদ্দীন হাসকাফী (১০৮৮ হি.) রাহিমাহুল্লাহ রিবাতের ৭টি ফাযায়েল উল্লেখ করেছেন। প্রত্যেকটি হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।
এক. মাসব্যপী রোজা ও রাত জেগে ইবাদাতের চেয়েও উত্তম; আল্লাহর পথে এক দিন এক রাত রিবাত বা সীমান্ত পাহারা দেয়া।
সালমান ফারসী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
«رِبَاطُ يَوْمٍ وَلَيْلَةٍ خَيْرٌ مِنْ صِيَامِ شَهْرٍ وَقِيَامِهِ، وَإِنْ مَاتَ جَرَى عَلَيْهِ عَمَلُهُ الَّذِي كَانَ يَعْمَلُهُ، وَأُجْرِيَ عَلَيْهِ رِزْقُهُ، وَأَمِنَ الْفَتَّانَ» -رواه مسلم: (1913)
“আল্লাহর পথে এক দিন এক রাত সীমান্ত পাহারা, মাসব্যাপী রোজা ও রাত জেগে ইবাদাত করার চেয়ে উত্তম। আর যদি মুরাবিত অবস্থায় মারা যায়, তাহলে তাঁর আমলের সাওয়াব জারী থাকবে। এবং তাঁর জন্যে (শহীদসুলভ) রিযক চালু করে দেয়া হবে এবং সে ফিতনাসমূহ থেকে নিরাপদে থাকবে।” -সহীহ মুসলিম: ১৯১৩
সাহাল ইবনে সাদ আস সায়েদী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
«رِبَاطُ يَوْمٍ فِي سَبِيلِ اللَّهِ خَيْرٌ مِنَ الدُّنْيَا وَمَا عَلَيْهَا، وَمَوْضِعُ سَوْطِ أَحَدِكُمْ مِنَ الجَنَّةِ خَيْرٌ مِنَ الدُّنْيَا وَمَا عَلَيْهَا، وَالرَّوْحَةُ يَرُوحُهَا العَبْدُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ، أَوِ الغَدْوَةُ خَيْرٌ مِنَ الدُّنْيَا وَمَا عَلَيْهَا» -أخرجه البخاري: (2892)
“আল্লাহর পথে একদিন সীমান্ত পাহারা দেয়া, দুনিয়া ও তার মধ্যে যা কিছু আছে তার চেয়ে উত্তম। আর জান্নাতে তোমাদের কারো একটি চাবুক পরিমাণ জায়গা, দুনিয়া ও তার মধ্যে যা কিছু আছে তার চেয়ে উত্তম। আর আল্লাহর পথে (জিহাদে) বান্দার এক সকাল অথবা এক সন্ধ্যা গমন দুনিয়া ও তার মধ্যে যা কিছু আছে তার চেয়ে উত্তম।” -সহীহ বুখারী: ২৮৯২
দুই. মুরাবিত অবস্থায় মৃত্যু হলে আমলের সাওয়াব কিয়ামত পর্যন্ত জারী থাকবে।
সালমান ফারসী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
وَإِنْ مَاتَ جَرَى عَلَيْهِ عَمَلُهُ الَّذِي كَانَ يَعْمَلُهُ. -أخرجه مسلم: (1913)
“মুরাবিত (বর্ডারগার্ড) অবস্থায় মৃত্যুরবণ করলে; তার আমলের সাওয়াব জারী থাকবে।” -সহীহ মুসলিম: ১৯১৩
ফুদালা ইবনে উবাইদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
كل ميت يختم على عمله إلا الذي مات مرابطا في سبيل الله فإنه ينمى له عمله إلى يوم القيامة، ويأمن من فتنة القبر. -أخرجه الترمذي: (1621) وقال الترمذي: هذا حديث حسن صحيح.
“প্রত্যেক মৃত ব্যক্তির আমলের (সাওয়াব) বন্ধ করে দেয়া হয়। কিন্তু যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে মুরাবিত অবস্থায় মারা যায় আল্লাহ তা’আলা কিয়ামত পর্যন্ত তার আমল বৃদ্ধি করতে থাকেন এবং তাকে কবরের ফিতনা থেকে নিরাপদে রাখেন।” -সুনানে তিরমিযি: ১৬২১
আমল জারী থাকার উদ্দেশ্য
ইমাম সারাখসী (৪৮৩ হি.) রহ. বলেন, “মুরাবিতের আমল জারী থাকার উদ্দেশ্য হলো, সে কিয়ামত পর্যন্ত মুরাবিত হিসেবে রিবাতের সাওয়াব পেতে থাকবে। কেননা তার নিয়্যাত ছিলো জীবিত থাকলে কিয়ামত পর্যন্ত রিবাত পালন করে যাবে। আর সাওয়াব তো নিয়্যাত অনুযায়ী হয়ে থাকে।” -শরহুস সিয়ার: ১/৯
সারাখসীর এই ব্যখ্যা উল্লেখ করে, শামী রহ. বলেন, “এই ব্যখ্যা থেকে আমল জারী থাকার বিষয়টি স্পষ্ট। আর তা হলো, রিবাতের সাওয়াব চিরকাল পেতে থাকবে। তাছাড়া অপর একটি হাদীসে এসেছে যা সারাখসী রহ. উল্লেখ করেছেন। উবাই ইবনে কাব রাদিয়াল্লাল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
«لرباط يوم في سبيل الله من وراء عورة المسلمين محتسبا، من غير شهر رمضان، أعظم أجرا من عبادة مائة سنة، صيامها وقيامها، ورباط يوم في سبيل الله من وراء عورة المسلمين محتسبا، من شهر رمضان، أفضل عند الله وأعظم أجرا -أراه قال- من عبادة ألف سنة، صيامها وقيامها، فإن رده الله إلى أهله سالما، لم تكتب عليه سيئة ألف سنة، وتكتب له الحسنات، ويجرى له أجر الرباط إلى يوم القيامة»-أخرجه ابن ماجة (2768)
“রমাদান ছাড়া অন্য কোন মাসে সাওয়াবের আশায় মুসলিমদের ইজ্জত রক্ষায় আল্লাহর রাস্তায় একদিন রিবাত পালন করা আল্লাহর কাছে সওম ও কিয়াম সহ একশত বছরের ইবাদাতের চেয়েও অধিক উত্তম ও সাওয়াবের কাজ। আর রমাদান মাসে সাওয়াবের আশায় মুসলিমদের ইজ্জত রক্ষায় আল্লাহর রাস্তায় একদিন রিবাত পালন করা —আমার ধারণা তিনি বলেন- সওম ও কিয়ামসহ এক হাজার বছরের ইবাদাতের চেয়েও আল্লাহর কাছে বেশী উত্তম ও সাওয়াবের কাজ। তাকে যদি আল্লাহ তাআলা তার পরিবারের নিকট নিরাপদে ফিরিয়ে আনেন, তাহলে তার উপর এক হাজার বছরের গুনাহ লিখা হবে না। আর তার জন্য বহু সাওয়াব লিপিবদ্ধ করা হবে। আর তার জন্য কিয়ামত দিবস পর্যন্ত আল্লাহর পথে রিবাতে থাকার সাওয়াব প্রাপ্তি অব্যাহত থাকবে।” -সুনানে ইবনে মাজাহ: ২৭৬৮
কিন্তু হাদীসের সবগুলো তুরুক সামনে রাখলে বুঝে আসে, ‘রিবাতের সাওয়াবের পাশাপাশি মুরাবিত যে আমলে রত ছিলো সে আমলের সাওয়াবও কিয়ামত পর্যন্ত জারী থাকবে। কুরতুবী রহ. এমনটিই বলেছেন। এবং তিনি আবূ হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদিস দ্বারা দলিল পেশ করেছেন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
من مات مرابطا في سبيل الله أجري عليه أجر عمله الصالح الذي كان يعمل إلخ -أخرجه ابن ماجة (2767)
“আল্লাহর রাস্তায় যে ব্যক্তি মুরাবিত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে; তার ওই নেক আমলের সাওয়াব জারী করে দেয়া হয় যা সে করছিল।” -ইবনে মাজাহ: ২৭৬৭; তাফসীরে কুরতুবী: ৪/৩২৪ দারুল কুতুবিল মিসরিয়্যাহ।
তিন. মুরাবিতের জন্য রিযক জারী করে দেয়া হবে।
সালমান ফারসী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
« وَأُجْرِيَ عَلَيْهِ رِزْقُهُ» -رواه مسلم: (1913)
“এবং মুরাবিতের জন্যে (শহীদসুলভ) রিযক চালু করে দেয়া হবে।” -সহীহ মুসলিম: ১৯১৩
রিযিক জারী করা দ্বারা উদ্দেশ্য শহীদের মতো রিযক
উবাই বিন কাব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত ইবনে মাজার হাদীসটি, ইমাম সারাখসী রহ. শরহুস সিয়ারিল কাবীরে কিছু বৃদ্ধি করে উল্লেখ করেন। বৃদ্ধি করা অংশটি এই রূপ,
ومات مرابطا فحرام على الأرض أن تأكل لحمه ودمه، ولم يخرج من الدنيا حتى يخرج من ذنوبه كيوم ولدته أمه، وحتى يرى مقعده من الجنة، وزوجته من الحور العين، وحتى يشفع في سبعين من أهل بيته. -شرح السير الكبير: 1/6
“যে ব্যক্তি মুরাবিত অবস্থায় মারা যায়, তার রক্তমাংশ ভক্ষণ করা যমীনের উপর হারাম হয়ে যায়। এবং সে এমন অবস্থায় দুনিয়া ত্যাগ করে যেন সে সদ্য জন্মলাভ করা নবজাতকটির মতো নিষ্পাপ এবং জান্নাতে তার আসন ও হুর স্ত্রীকে দেখছে। পরিবারের সত্তর জনের ব্যাপারে তার সুপারিশ কবুল করা হবে।” -শরহু সিয়ার: ১/৬ আশ শিরকাতুশ শারকিয়্যাহ।
সারাখসির এই অতিরিক্ত অংশ উল্লেখ করার পর শামী (১২৫২ হি.) রহ. বলেন,
وظاهره أن من مات مرابطا يكون حيا في قبره كالشهيد وبه يظهر معنى إجراء رزقه عليه. -رد المحتار: 4/122
“এই হাদীস থেকে স্পষ্ট, যে ব্যক্তি মুরাবিত অবস্থায় মারা যাবে সে কবরে জীবিত থাকবে; যেমন শহীদ জীবিত থাকে। এবং এর দ্বারা কবরে তাঁর রিযক জারী থাকার উদ্দেশ্যও স্পষ্ট (যে, তা হবে শহীদসুলভ রিযিক)।” -রদ্দুল মুহতার: ৬/১৯৮ যাকারিয়্যাহ।
রিবাত অবস্থায় স্বাভাবিক মৃত্যু হলে এতো ফযীলত। চিন্তা করুন মুরাবিত যদি শাহাদাত বরণ করে; তাহলে কি পরিমাণ সাওয়াব। এক কথায় সোনায় সোহাগা নূরুন আলা নূর। বর্তমানে আফগানিস্তানের সীমান্তরক্ষীরা মুরাবিত, আল শাবাব নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের সীমান্তরক্ষীরা মুরাবিত। তাঁদের কী সৌভাগ্য! আল্লাহ আমাদের বাংলাদেশকেও ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করবার তাওফিক দান করুন। আমীন।
চার. মুরাবিত সকল ফিতনা থেকে নিরাপদে থাকবে।
সালমান ফারসী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
« وَأَمِنَ الْفَتَّانَ» -رواه مسلم: (1913)
“(এবং মুরাবিত ফিতনাসমূহ থেকে নিরাপদে থাকবে।” -সহীহ মুসলিম: ১৯১৩
সকল ফিতনা থেকে নিরাপদ থাকার উদ্দেশ্য
হাদীসে উল্লেখিত শব্দ الفَتَّانَ ফা এর মধ্যে যবর এবং পেশ উভয়টিই পড়া যাবে। যবর পড়লে হবে ফাত্তান। অর্থ শয়তান, কবরের আযাব।
আর পেশ পড়লে হবে ফুত্তান। ফাতিনুন এর বহুবচন। অর্থ পরিক্ষাকারী, বিভ্রান্তকারী। ইমাম কুরতুবী রহ. বলেন, “এটি ইসমে জিনস অর্থাৎ যত রকমের ফিতনা হতে পারে তার সবকটা থেকেই মুরাবিত নিরাপদ থাকবে।” -তাফসীরে কুরতুবী: ; রদ্দুল মুহতার: ৪/১২২ দারুল ফিকর।
মুরাবিতের কবরে সুওয়াল জাওয়াব হবে না
মুরাবিত কবরে যাবতীয় ফিতনা থেকে নিরাপদে থাকবে। সালমান ফারসী রাদিয়াল্লাহু আনহুর এই হাদীস উল্লেখ করার পর শামী (১২৫২ হি.) রহ. বলেন,
وقد استدل غير واحد بهذا الحديث على أن المرابط لا يسأل في قبره كالشهيد. -رد المحتار: 4/122
“অনেকেই এই হাদীস দ্বারা দলিল পেশ করেছেন যে, ‘কবরে মুরাবিতকে কোনো প্রশ্ন করা হবে না; যেমন শহীদকে কোনো প্রশ্ন করা হয় না।” -রদ্দুল মুহতার: ৪/১২২ দারুল ফিকর।
পাঁচ. হাশরের মাঠে মুরাবিতকে শহীদ হিসেবে ওঠানো হবে।
সালমান ফারসী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
«ويبعث يوم القيامة شهيدا» -أخرجه الطبراني في المعجم الكبير (6179)
“এবং কিয়ামতের দিন তাকে শহীদ হিসেবে ওঠানো হবে।” -মুজামে তবরানী: ৬১৭৯
অর্থাৎ মুরাবিত স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করলেও শহীদ হিসেবে তার হাশর হবে।
ছয়. মুরাবিতকে হাশরের ভয়াবহতা থেকে নিরাপদে রাখা হবে।
আবূ হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
«وبعثه الله يوم القيامة آمنا من الفزع» -أخرجه ابن ماجة (2767)
“এবং আল্লাহ তাআলা মুরাবিতকে কিয়ামতের দিন (হাশরের) ভয়াবহতা থেকে নিরাপদ অবস্থায় উঠাবেন।” -ইবনে মাজাহ: ২৭৬৭
সাত. মুরাবিতের এক রাকাত নামাজ অন্যদের পাঁচশত রাকাত নামাজের সমপরিমাণ। রিবাতে এক দিনার খরচ অন্য ক্ষেত্রে নয়শত দিনার খরচের সমপরিমাণ।
আবূ উমামা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
«إن صلاة المرابط تعدل خمس مائة صلاة، ونفقة الدينار والدرهم منه أفضل من تسعمائة دينار ينفقه في غيره» -أخرجه البيهقي في شعب الإيمان (3987)
“মুরাবিতের এক রাকাত নামাজ (অন্যদের) পাঁচশ রাকাত নামাজের সমপরিমাণ। এবং মুরাবিত রিবাতে এক দিনার বা দিরবাম খরচ করা; অন্য ক্ষেত্রে নয়শ দিনার খরচ করার সমপরিমাণ।”-শুআবুল ঈমান বায়হাকী: ৩৯৮৭
১৩টি আমল রয়েছে যার সাওয়াব আমলকারী মৃত্যুর পরেও জারী থাকে
অতঃপর শামী (১২৫২ হি.) রহ. কবিতা আকারে ঐ সকল আমলের কথা উল্লেখ করেছেন যেগুলোর সাওয়াব মৃত্যুর পরেও জারী থাকে।
১. দ্বীনি ইলম যা প্রচার প্রসার করা হয়েছে।
২. নেক সন্তানের দোআ।
৩. ফলগাছ রোপণ (যা থেকে জনসাধারণ ভক্ষণ করে)।
৪. সদকায়ে জারিয়া।
৫. কোরআন শরীফ মিরাস রেখে যাওয়া।
৬. রিবাত তথা ইসলামী রাষ্ট্রের সীমান্ত প্রহরা।
৭. কূপ খনন করে যাওয়া (যা থেকে জনসাধারণ ও পশু পাখির প্রয়োজন পূরণ হয়)।
৮. খাল খনন করে যাওয়া (যা থেকে চাষের জমিতে সেচ দেয়া যায়)।
৯. মুসাফির খানা/ সরাইখানা তৈরী করে যাওয়া।
১০. মসজিদ নির্মাণ করে যাওয়া।
১১. মাদ্রাসা নির্মাণ করে যাওয়া।
১২. আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করা।
১৩. অনুস্বরণযোগ্য সৎ আদর্শ রেখে যাওয়া। -রদ্দুল মুহতার: ৪/১২২ দারুল ফিকর।
সদাকায়ে জারিয়া আমলসমূহের মাঝে রিবাত সবার সেরা
ইমাম কুরতুবী রহ. বলেন,
أَنَّ الرِّبَاطَ أَفْضَلُ الْأَعْمَالِ الَّتِي يَبْقَى ثَوَابُهَا بَعْدَ الْمَوْتِ... فَإِنَّ الصَّدَقَةَ الْجَارِيَةَ وَالْعِلْمَ الْمُنْتَفَعَ بِهِ وَالْوَلَدَ الصَّالِحَ الذي يَدْعُو لِأَبَوَيْهِ يَنْقَطِعُ ذَلِكَ بِنَفَادِ الصَّدَقَاتِ وَذَهَابِ الْعِلْمِ وَمَوْتِ الْوَلَدِ. وَالرِّبَاطُ يُضَاعَفُ أَجْرُهُ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ، لِأَنَّهُ لَا مَعْنَى لِلنَّمَاءِ إِلَّا الْمُضَاعَفَةُ، وَهِيَ غَيْرُ مَوْقُوفَةٍ عَلَى سَبَبٍ فَتَنْقَطِعُ بِانْقِطَاعِهِ، بَلْ هِيَ فَضْلٌ دَائِمٌ مِنَ اللَّهِ تَعَالَى إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ. وَهَذَا لِأَنَّ أَعْمَالَ الْبِرِّ كُلَّهَا لَا يُتَمَكَّنُ مِنْهَا إِلَّا بِالسَّلَامَةِ مِنَ الْعَدُوِّ وَالتَّحَرُّزِ مِنْهُ بِحِرَاسَةِ بَيْضَةِ الدِّينِ وَإِقَامَةِ شَعَائِرِ الْإِسْلَامِ. -تفسير القرطبي: 4/325
“মৃত্যুর পরেও যে সকল আমলের সাওয়াব জারী থাকে তারমধ্যে সর্বোত্তম আমল হলো রিবাত। কেননা, সদাকা করা বস্তু শেষ হয়ে যাওয়ার দ্বারা, ইলম চলে যাওয়ার পর এবং সন্তান মারা যাওয়ার পর এ সকল আমলের সাওয়াবও শেষ হয়ে যায়। পক্ষান্তরে রিবাতের সাওয়াব বাড়তেই থাকে; কেননা তা এমন কিছুর উপর মাওকূফ নয় যা শেষ হওয়ার দ্বারা সাওয়াবও শেষ হয়ে যাবে। বরং তা আল্লাহর পক্ষ থেকে কিয়ামত পর্যন্ত বৃদ্ধি হতে থাকা একটি আমল। তাছাড়াও আরো একটি কারণ হলো, সমস্ত নেক আমল তখনই ঠিকভাবে পালন করা সম্ভব হবে যখন শত্রুর আক্রমণ থেকে ইসলামী রাষ্ট্র নিরাপদ থাকবে। আর তা তো মুরাবিতীন তথা সীমান্তরক্ষীদের দ্বারাই হয়ে থাকে। -তাফসীরে কুরতুবী: ৪/৩২৫
আল্লাহ তাআলা আমাদের ইসলামী ভূমিগুলো পুনরুদ্ধারের তাওফিক দান করুন এবং সেগুলোতে পরিপূর্ণ শারিয়া আঈন বাস্তবায়ন করে; রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে রিবাত পালনের সুযোগ করে দিন। আমীন।
আজ এ পর্যন্তই। ওয়া আখিরু দা’ওয়ানা আনিল হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন।
চলবে ইনশাআল্লাহ।
Comment