بسم الله الرحمن الرحيم
وصلى الله تعالى على خير خلقه محمد وعلى آله وأصحابه أجمعين. أما بعد!
وصلى الله تعالى على خير خلقه محمد وعلى آله وأصحابه أجمعين. أما بعد!
মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম সাহেব আমাদের দেশের একজন স্বনামধন্য আলেম। গাযওয়াতুল হিন্দ এবং ভারতের বিরুদ্ধে জিহাদ নিয়ে তাঁর মিনিট ছয়েকের একটি ভিডিও বয়ান দেখেছি। উনার মূল উদ্দেশ্য যা বুঝতে পেরেছি, তিনি বলতে চাচ্ছেন:
বর্তমান মূহুর্তে ভারতের বিরুদ্ধে জিহাদের আওয়াজ তুললে সেখানে বসবাসরত মুসলমানদের জন্য তা ক্ষতির কারণ হয়ে যাবে, তাদের জীবন হুমকির মুখে পড়বে। সামরিক পন্থার চেয়ে বরং দাওয়াতের মাধ্যমে ইসলাম প্রচারের পন্থা গ্রহণ করা উপকারের হবে।
তিনি বলেছেন: হিন্দুস্তানে ইসলাম তো এই দাওয়াতের মাধ্যমেই ছড়িয়েছে। অর্থাৎ আমরা আমাদের পূর্ববর্তী বুযুর্গদের সে পন্থাই অবলম্বন করে এগিয়ে যেতে পারি।
প্রসঙ্গক্রমে তাঁর বয়ানে গাযওয়াতুল হিন্দ এবং রাষ্ট্রীয় শক্তির মাধ্যমে ইসলাম প্রচার উভয়টি বিষয় বলা যায় গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে।
গাযওয়াতুল হিন্দ হয়ে গেছে, নতুন করে গাযওয়াতুল হিন্দের প্রসঙ্গ টেনে আনার কোনো অর্থ নাই।
ইসলাম প্রচার হিন্দুস্থানে যা হয়েছে বুযুর্গদের ও ওলামা মাশায়েখদের দাওয়াতের মাধ্যমে হয়েছে, রাজা বাদশাদের তথা ইসলামী রাষ্ট্র শক্তির এতে কোনো ভূমিকা বা সহযোগিতা নাই।
আমার ব্যক্তিগত মূল্যায়ন
এটা সত্য যে, হিন্দুস্তানে জিহাদের কথা বলতে গেলে সেখানকার মুসলমানদের উপর ভারত সরকার আরও বেশি ক্ষেপে যাবে।
এটাও সত্য যে, ওলামা মাশায়েখ ও বুযুর্গানে দ্বীন অতুলনীয় মেহনতের মাধ্যমে ইসলাম প্রচার করেছেন।
তথাপি কথা থেকে যায়….।
# জিহাদের কথা বললে কাফেররা ক্ষেপে যায় ঠিক, কিন্তু জিহাদের কথা না বললে কাফেররা ক্ষেপে না তাও কিন্তু না। আসলে কাফেরদের সাথে মুসলমানদের ঈমান-কুফরের চিরন্তন দ্বন্দ্ব। আমরা জিহাদের কথা না বললেও তারা আমাদের ক্ষতি সাধনের চেষ্টা থেকে বিরত হবে না। এটি একটি চিরন্তন রীতি। মক্কায় তো জিহাদের কথা ছিল না, তথাপি কাফেররা সাহাবায়ে কেরামের উপর নির্যাতন করলো, দেশ থেকে বের করে দিলো। আমরা হিন্দুস্তানিরা তো ব্রিটেনের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে যাইনি, তথাপি তারা আমাদের দখল করলো, নির্যাতন করলো, গোলামের মতো আচরণ করলো। ৪৭ এর পর থেকে আজ অবধি ভারতে মুসলমানরা নির্যাতিত। অথচ ভারতের মুসলমানরা তো কখনও ভারতের বিরুদ্ধে জিহাদের কথা বলে না। জিহাদের কথা যা বলে, বাংলাদেশি বা পাকিস্তানীরা বলে। চীনে মুসলমানরা নির্যাতিত। ‘গাযওয়াতুল চীন’ বলে তো কোনো হাদিস নাই।
যাহোক, পৃথিবীর ইতিহাস এর সাক্ষী। কিন্তু আমরা কেন জানি ভাবতে চাই: আমরা জিহাদ ছেড়ে দিলেই কাফেররা আমাদের থেকে বিরত হয়ে যাবে। ঘর বানিয়ে ঘরের প্রতিরক্ষা না করলে চোর বিরত হবে না, চোরের বরং সুবিধাই হবে।
# হিন্দুস্তানের মুসলিম সুলতানদের ইসলাম প্রচারে কোনো ভূমিকা বা সহযোগিতা নাই কথাটা আমার কাছে খুবই অবাস্তব এবং পূর্বপুরুষদের ইহসানের না-শোকরি মনে হয়।
পীর মাশায়েখদের দাওয়াতের দ্বারা ব্যক্তি পর্যায়ে অনেকে ইসলাম গ্রহণ করলেও ইসলামী রাষ্ট্র সুলতানরাই কায়েম করেছেন। মুসলিমদের নিরাপত্তা তারাই দিয়েছেন। ইসলামী আইন অনুসারে বিচারের ব্যবস্থা তারাই করেছেন। মসজিদ মাদরাসা ইত্যাদি দ্বীনি প্রতিষ্ঠান তারাই পরিচালনা করেছেন। পরবর্তীতে উলামা মাশায়েখদের জন্য দাওয়াতের রাস্তা তারাই তৈয়ার করেছেন। উলামা মাশায়েখদের নিরাপত্তা তারাই দিয়েছেন। তারা না থাকলে দায়ীরা দাওয়াতের কাজ করতে পারতো না। আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি কলিম সিদ্দিকি জেলে। ডা. জাকির নায়েক দেশান্তরিত। তারা তো জিহাদের কথা বলেন না।
আসলে দায়ীদের পিছনে সুলতানদের তরবারি না থাকলে দায়ীরা দাওয়াতের কাজ করতে পারে না, যেমনটা পারা যাচ্ছে না বর্তমান ভারতে। কারও যদি অবিশ্বাস হয় তাহলে তিনি নিজে দাওয়াতের নজির স্থাপন করে দেখান যদি পারেন। আমরা দেখতে চাই, জিহাদ ছেড়ে দাওয়াত আমরা কতটুকু দিতে পারলাম, মুসলিমদের নিরাপত্তা কতটুকু প্রতিষ্ঠা হলো, কাফেররা দ্বীনে ইসলাম কতটুকু গ্রহণ করলো। ভারতে তো প্রায় একশো বছর যাবত আসলে জিহাদ নাই-ই। তথাপি দিন দিন শুধু অবনতি। অস্ত্র ধরা ছাড়া প্রতিকার সম্ভব- এই আশায় আমরা আর কতকাল জিহাদ ছেড়ে বসে থাকবো। ভারতের ৩৫ কোটি মুসলমান যদি নিজেরাই জিহাদি চেতনা ধারণ করে নেমে পড়তো তাহলে কত আগেই হিন্দুস্তান বিজয় হয়ে যেতো বলা যায় না, বাহির থেকে হিন্দুস্তানে জিহাদের আলাদা ফিকির করতে হতো না। যেসকল মুসলিম সুলতান হিন্দুস্তানে অভিযান চালিয়ে ইসলামী শাসন কায়েম করেছেন, তাদের সকলের সম্মিলিত বাহিনির সংখ্যাও হয়তো ভারতের বর্তমান মুসলিমদের সংখ্যার সমান হবে না। আসলে এটা জিহাদের বরকতেই সম্ভব ছিল। আমরা আজ সংখ্যায় অনেক, কিন্তু জিহাদ ছেড়ে দিয়ে স্রোতে ভেসে আসা পচা লাউয়ের মতো হয়ে গেছি। এখন আমাদের কোনো শক্তি নাই। আমাদের শত্রুরা আমাদের আর ভয় পায় না। ভয় যদি পায় তাহলে একটা জিনিসকেই পায়। সেটা হলো: জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ।
# গাযওয়াতুল হিন্দের যে হাদিসটি তিনি সহীহ বলেছেন সেটি শুধু একটি ভবিষ্যদ্বাণী নয়, একটি হুকুম, একটি ফজিলত: যে দল হিন্দে জিহাদ করবে আল্লাহ তাদের মাফ করে দিবেন, যেমন যে দল ঈসা আলাইহিস সালামের সাথে থাকবে আল্লাহ তাদের মাফ করে দিবেন।
এটি একটি উৎসাহের বিষয়, একটি প্রতিযোগিতারও বিষয়, নিজেকে প্রস্তত করারও বিষয়। যেন আমি ঈসা আলাইহিস সালামের দলে এবং তাঁর সাথে থাকতে পারি, যেন আমি হিন্দুস্তানে জিহাদ করে নিজেকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করে নিতে পারি। হাদিসের এই ফজিলতটি আলোচনার কোনো বিষয় নয় কথাটি আমি মানতে পারি না। অন্য দশটা ফজিলতের মতো এটাও একটা আলোচনার ও লাভ করার জন্য উদগ্রীব হওয়ার বিষয় মনে হয় আমার কাছে।
# যদি গাযওয়াতুল হিন্দের হাদিস না থাকতো?
হিন্দুস্তানে জিহাদের হুকুম গাযওয়াতুল হিন্দের হাদিসের সাথে সম্পৃক্ত নয়। গাযওয়াতুল হিন্দের হাদিসে এ হুকুম বয়ান করা হয়নি যে, হিন্দের বিরুদ্ধে জিহাদ করা ফরয। হিন্দের বিরুদ্ধে জিহাদ করা ফরয- এ বিষয়টি শরীয়তের অন্যান্য দলীল প্রমাণের সাথে সম্পৃক্ত। গাযওয়াতুল হিন্দের হাদিস না থাকলেও হিন্দের বিরুদ্ধে জিহাদ ফরয হতো। অবস্থাটা এখন এমন দাঁড়িয়েছে: যেন গাযওয়াতুল হিন্দের হাদিসকে জয়িফ বানানো গেলেই হিন্দের জিহাদ থেকে আমরা দায়মুক্ত হয়ে যাবো। বিষয়টা তো তা নয়। হিন্দ আমাদের হারানো ভূমি। অধিকন্তু ৩৫ কোটি হিন্দুস্তানী ভাইবোন খড়গের নিচে নিষ্পেষিত জীবন যাপন করছেন। ইসলামের ভূমি উদ্ধার এবং আমাদের নির্যাতিত মুসলিম ভাইবোনদের উদ্ধার করার জন্য জিহাদ ফরয। আর এই ফরয যেমন বাংলাদেশ পাকিস্তানের মুসলমানদের উপর বর্তায়, হিন্দের ভাইবোনদের নিজেদের উপরও বর্তায়। সবার পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতেই জিহাদ আগাতে হবে। এই ফরিজার সাথে গাযওয়াতুল হিন্দের হাদিসের কোনো সম্পর্ক নেই। তবে এই ফরিজা আদায় করলে জিহাদের স্বাভাবিক ফজিলত লাভের পাশাপাশি খুসুসি আরেকটি ফজিলতও পাওয়া যাবে। গাযওয়াতুল হিন্দের এই অতিরিক্ত ফজিলতটি না থাকলেও জিহাদের হুকুম তার আপন গতিতেই চলতো।
আমার মনে হয় হুজুরের বয়ানটিতে কিছু কথা বেশ এদিক সেদিক হয়ে গেছে। বিষয়গুলো আরও ভাবার মতো। যদি জিহাদ আমরা ছেড়ে দিই তাহলে আমাদের ও হিন্দের ভাইবোনদের করণীয় কি তাও স্পষ্ট করা উচিত। হুজুর যে দাওয়াতের কথা বলেছেন, তা অনেকটা অসম্ভব। হিন্দুদের সামনে এ কথা উচ্চারণ করা জিহাদের চেয়েও ভয়ংকর হবে যে: তোমাদের ধর্ম মিথ্যা, আমাদের ধর্ম ইসলাম সত্য, তোমরা তোমাদের ধর্ম ছেড়ে আমাদের ধর্ম গ্রহণ করে নাও। বাস্তবে আমরা কলিম সিদ্দিকি বা জাকির নায়েকের মতো দায়ীদের সাথে কি আচরণ হচ্ছে তা দেখেছি। অতএব, এই দাওয়াতই একমাত্র করণীয়- বিষয়টি আমার কাছে খুবই জটিল লাগে। যদি আমরা জিহাদ ছেড়ে দিই তাহলে তার বৈধতা কতটুকু, আর জিহাদ ছেড়ে আমাদের করণীয় কি- সবগুলো বিষয়ে সুস্পষ্ট রোডম্যাপ দেয়া উচিত। বিশেষ কোনো বিষয় বা বিশেষ কোনো দলের ভুলত্রুটির সমালোচনাই আমার মনে হয় মুসলমানদের মুক্তি ও দায়িত্ব আদায়ের জন্য যথেষ্ট নয়। ওয়াল্লাহু তাআলা আ’লাম।
Comment