অতি সম্প্রতি সারা বিশ্ব খাস করে বাংলাদেশের আন্দোলন আর বিপ্লবের ব্যাপারে জানতে গিয়ে বেশ কয়েকটি বিষয় দৃষ্টিগোচর হয়। যদিও ৭১ এ দেশ স্বাধীনের পর থেকে বাংলাদেশে এমন কোন জিহাদী মুভমেন্ট দেখা যায় না যা দেশের গতিপথ পরিবর্তন করতে পারে। তাই বাংলাদেশ আন্দোলন আর বিপ্লব বলতে সাধারণত শেখ মুজিবের হত্যা, ক্রু, পাল্টা ক্রু, ৭ নভেম্বর বিপ্লব, জিয়াউর রহমানের হত্যা এবং সর্বশেষ এরশাদের পতন আন্দোলনকে বুঝায়। কারণ এই আন্দোলন আর বিপ্লবগুলো শুধু মাত্র দেশের শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন করেনি বরং দেশে গতিপথ পর্যন্ত পরিবর্তন করেছে। জিহাদি তানজিমগুলোর মাঝে জামাতুল মুজাহিদিন এর ভাইদের সর্বহারা নিধন এবং নির্দিষ্ট এলাকা ভিত্তিক শারিয়াহ কায়েম আর হরকাতুল জিহাদের ভাইদের নির্দিষ্ট একটি গণতান্ত্রিক দলকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা আন্দোলন বাংলাদেশের পরিপেক্ষিতে কোন যুগাপোযোগী পরিবর্তন আনতে পারিনি।
বাংলাদেশের এই আন্দোলন আর বিপ্লব নিয়ে আলোচনা কালে যে দুইটি শব্দ বার বার সামনে এসেছে তাহলো
==> থিউরিসম (তাত্ত্বিকতা)
==> একটিভিসম (সক্রিয়তাবাদ)
আলোচনা সামনে নেওয়ার আগে এই দুটি শব্দের সাধারণ ব্যাখ্যা জানা প্রয়োজন।
১) থিউরিসম (তাত্ত্বিকতা)ঃ তাত্ত্বিকতা হলো কোন বিষয় কিভাবে হবে, তার লক্ষ্য কি, উদ্দেশ্য কি, গতিপ্রকৃতি কি, গঠনতন্ত্র কি, সর্বপরি কাজের পদ্ধতি কি এই সম্পর্কে জ্ঞান রাখা।
২) একটিভিসম (সক্রিয়তাবাদ)ঃ সক্রিয়তাবাদ হচ্ছে তত্ত্বকে ব্যবহার করে জিব্বাহর কর্মসূচি, কলমের কমর্সুচি এবং তলোয়ারের কর্মসূচির মাধ্যমে লক্ষ্য অর্জন করা।
উদাহরণ সরূপ বলা যায়, একে-৪৭ কিভাবে বানাতে হবে এই সম্পর্কে জ্ঞান রাখা হলো তত্ত্ব অর্জন এবং এই তত্ত্ব দিয়ে একে-৪৭ বানানো সক্রিয়তা। ঠিক একইভাবে, কিভাবে আন্দোলন করতে হবে তার, উদ্দেশ্য কি, লক্ষ্য কি, প্রক্রিয়া কি এই সম্পর্কে জ্ঞান রাখা হল তাত্ত্বিকতা, আর সেই তত্ত্বের ভিত্তিতে আন্দোলন করে লক্ষ্য অর্জন করা হচ্ছে সক্রিয়তা।
যে কোন আন্দোলনের জন্য এই দুটি বিষয়ের সমন্বয় অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তা না হলে যে কোন আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়বে। অতীতের আন্দোলন থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়ার অনেক কিছু থাকলেও তথ্যের ভুল হওয়ার ভয় এবং জ্ঞানের সল্পতার কারণে অতীতের জটিল সমীকরণে হাত দেওয়া থেকে বিরত থেকে অতি সম্প্রতি (২০২১ সালে ২৫ এবং ২৬ মার্চ) বাংলাদেশের মাটিতে ঘটে যাওয়া রক্তাক্ত আন্দোলন থেকে কিছু আলোচনা করতে পারি।
থিউরিসম (তাত্ত্বিকতা)ঃ এই আন্দোলনের তাত্ত্বিকতা দিকে তাকালে আমরা শুরু থেকে এই মাঝে কিছু ফাক ফোকর দেখতে পারবো। কারণ মোদিকে কেন এই দেশে আসতে দেওয়া হবে না এই বিষয় খোদ হেফাজতের অনেক নেতার কাছে পরিষ্কার ছিল না। যেমনঃ একজন আলেম, মোদিকে কেন বাংলাদেশে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না এই ব্যাপারে তার বক্তিতায় বলেছেন বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র আর মোদী কট্টর হিন্দুবাদের প্রসারক সুতরাং বাংলার মাটিতে এমন মৌলবাদীর প্রবেশ অধিকার দেওয়ার যায় না।
আসলেই কি বাংলাদেশে মোদীর আগমনের বাধা দেওয়ার কারণ কি এটাই? মোটেও না, মোদী এই দেশে আসতে পারবে না কারণ মোদীর হাত আমাদের মুসলমান ভাইদের রক্তে রঞ্জিত, আমাদের মা-বোনদের ইজ্জত আব্রুর দাগ মোদীর সারা শরীরের আছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা এবং মুসলমানদের দুশমন কখনই মুসলিম প্রধান এই দেশে প্রবেশ করতে পারবে না। উল্লেখিত আলেম নিজেই এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন, ঠিক সেভাবে নিজের তালিবদের এবং ভক্তদের বুঝাতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই হিফাজতের আন্দোলন চলাকালে লাখ লাখ মানুষ শুধু আমাদের তালিবুল ইলম ভাইদের মরতে দেখেছে অথচ সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেনি। আন্দোলনের আগে আন্দোলনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য ঠিক না করা মূলত আন্দোলনের তত্ত্বে সবচেয়ে বড় ভুল হিসাবে পরিগনিত।
একটিভিসম (সক্রিয়তাবাদ)ঃ এই আন্দোলনে যা ছিল তা হলো একটিভিসম (সক্রিয়তাবাদ)। আলহামদুলিল্লাহ আমাদের তালিবুল ইলম ভাইয়েরা তাদের জীবন দিতেও পিছ পা হোন নি। সুবহানআল্লাহ ভোগ বিলাস আর অর্জনের এই সময়ের জীবনের মায়া ত্যাগ করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া বর্তমান যুগের এমন এক উদাহরণ যার তারিফ যত করা হবে ততো কম। কিন্তু স্বাভাবিক ভাবে তত্ত্বের এত বড় ফাক নিয়ে আন্দোলন খুব দ্রুত স্মিত হয়ে আসে৷ কারণ শুরু থেকে এই আন্দোলন থেকে কি হাসিল করা হবে তা না আন্দোলনকারীদের জানা ছিল আর না আন্দোলনের নেতারা এই ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন।
আলহামদুল্লাহ, ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। স্বাভাবিকভাবে কুরআন হাদীসের আলোকে আন্দোলনের তত্ত্ব বের করে আনা সম্ভব। আর কাওমি মাদ্রাসারগুলোর ভিত্তিই হচ্ছে আকাবীর থেকে পাওয়া শরীয়ত সম্মত জিহাদী আন্দোলনের তত্ত্বকে বাস্তবতা রূপ দেওয়ার প্রচেষ্টা। কিন্তু প্রথম থেকে এই আন্দোলনের কো৷ন উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য না থাকায় হেফাজতের উপর সরকার এবং জনগণের পক্ষ থেকে চাপ বাড়তে থাকে, যার ফলশ্রুতিতে আন্দোলন চরমভাবে পর্যাদুস্ত হয়। আন্দোলনের শুরু থেকে উলামাদের উচিত ছিল কেন এই আন্দোলন, এই আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য কি তা সাধারণ জণগনের কাছে পরিষ্কার করা। কারণ আজো অনেক ধর্মপ্রাণ মুসলিমরাও বুঝতে পারছে না যে মোদী দেশে আসলে ইসলামের এমন কি ক্ষতি হয়ে যাবে? এবং এই বিষয়েও প্রশ্ন উঠেছে যা, মোদী আগেও বাংলাদেশে এসেছে তখন কেন বাধা দেওয়া হয়নি এখনই বা কেন? তাছাড়া এত কিছু পরও তো ভারতের সাথে বাংলাদেশে কূটনৈতিক সম্পর্ক আছে, ব্যবসায়িক লেনদেন আছে, আছে সীমান্ত হত্যার মত বিষয়; এই সকল ইস্যুতে হেফাজতের নেতারা কেন সোচ্চার হচ্ছেন না? তাই জুম্মার নামাজ পর বাইতুল মোকাররাম মিছিল ছাড়া আন্দোলনের অন্য কোন পর্যায়ে সাধারণ জনগণের তেমন কোন স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহন দেখা যায়নি। কমপক্ষে তালিবুল ইলম ভাইয়েরা যারা রাস্তায় তাদের রক্ত দিয়েছেন তাদের কাছে অব্যশই এই আন্দোলনের লক্ষ্য বা আন্দোলন শেষে কি দাবী আদায় করা হবে এইটুকু পরিষ্কার করা দরকার ছিল। আমি এই বলছি না আন্দোলনের লক্ষ্য জানা ছাড়া যারা নিজের প্রাণ উতসর্গ করছেন তাদের প্রাণের কোন মূল্য নেই; না, বরং আমার এই আশা রাখি আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জাত তাদের শহীদ হিসাবে কবুল করেছেন। কিন্তু তালেবুল ইলম ভাইদের কাছে লক্ষ্য পরিষ্কার থাকলে, হেফাজতের নেতারা গ্রেফতার হলে বা নির্যাতনের মুখে পরলে তালেবুল ইলম ভাইয়েরা এই আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু তত্ত্বের গাফেলতি ভাইদের সক্রিয়তাকে অপমানিত করেছে।
পাকিস্তানের দিকে তাকালে আমরা বর্তমানে চলমান ফ্রান্স বিরোধী আন্দোলনে এই দুই বিষয়ের এক সুন্দর সমন্বয় দেখতে পারবো। ফ্রান্সে শ্রেণিকক্ষে মহানবী (স.)-এর ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শন করে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান এবং এর পক্ষে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রনের সমর্থনের কারণে তেহরিকে লাব্বাইক পাকিস্তান (টিএলপি) ঘটনার সময় থেকেই বিক্ষোভ করে আসছিল। কিন্তু সম্প্রতি তারা পাকিস্তান থেকে ফরাসি রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কারের দাবিতে জোরালো আন্দোলন গড়ে তোলে। সেই আন্দোলনে বেশ কয়েকজনের প্রাণহানী হয়। এতে সরকার টিএলপি’কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। পুলিশ সূত্রে বলা হয়, নিষিদ্ধ ঘোষিত দলটি, পুলিশ স্টেশনে হামলা, পুলিশ সদস্য ও রেঞ্জার, আধাসামরিক অফিসারদের ঘিরে ফেলা, উর্ধতন একজন পুলিশ অফিসারকে অপহরণ করলে পাঞ্জাব প্রদেশের পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে। কিন্তু তাতে আন্দোলন থেমে থাকেনি। আরো জোরালো হয়েছে। এ অবস্থায় টিএলপি নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে বাধ্য হয়েছে সরকার। (https://m.mzamin.com/article.php?mzamin=270934) অবশেষে সরকার ঘোষণা দিয়েছে ফরাসি রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কারের বিষয়টি পাকিস্তানের পার্লামেন্টে তোলা হয়েছে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল যে, পাকিস্তানে এই আন্দোলনের আহবান দিয়েছেন তেহরিকে লাব্বাইক পাকিস্তান (টিএলপি) এর প্রতিষ্ঠাতাকালীন আমীর খাদিম হোসাইন রিজভী। আন্দোলনের আহবানের কিছু দিন পর (১৯ নভেম্বর ২০২০) তিনি ইন্তেকাল করেন। তার মৃত্যুর সাথে সাথে কিন্তু আন্দোলন থেমে যায়নি শুধু সাময়িক সময়ের জন্য কিছুটা বিলম্বিত হয়েছিল আর এই বিলম্বকাল ছিল আমীরের জানাযা এবং দাফনের সময়টুকু। তার পর আন্দোলন তার আগের গতিতে ফিরে আসে। কারণ আমীর সাহেবের মৃত্যুর পর তার পরবর্তী নেতৃস্থানীয়রা, নেতা-কর্মী, এমনকি সাধারণ সসমর্থকেরা পর্যন্ত এই আন্দোলনের লক্ষ্য আর উদ্দেশ্যের ব্যাপারে পরিষ্কার ছিল।
যদিও তেহরিকে লাব্বাইক পাকিস্তান (টিএলপি) একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল তাই আদর্শিকভাবে তাদের নিকট থেকে আমাদের গ্রহণ করার মত কিছু নেই। তাই আমরা অনুকরণে জন্য আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে পরিচিত জিহাদী তানজিম "তানজিম কায়েদাতুল জিহাদ" এর দিকে তাকাতে পারি। আল কায়েদা শুরু এখন পর্যন্ত তাদের সকল কার্যক্রমে এমনকি প্রতি সুক্ষাদিসুক্ষ বিষয়ে তাত্ত্বিকতা এবং সক্রিয়তা এক অসাধারণ এবং অকল্পনীয় সমন্বয় দেখা যাবে৷ ২০০১ সালে টুইন টাওয়ার হামলার পর আমেরিকা এবং পাকিস্তান যৌথভাবে আফগানিস্তানে হামলা করে। এই হামলার আল কায়েদার হাজার হাজার স্থানীয় এবং আরব মুজাহিদ শহীহ হোন। আরো শহীহ হন শত শত মুজাহিদ নেতা। কিন্তু বর্তমানে আল কায়েদার দিকে তাকালে আমরা এই আঘাতের কোন ক্ষতি দেখতে পায় না। কারণ প্রথন থেকে আল কায়েদায় তাদের উদ্দেশ্য (গ্লোবাল জিহাদ), লক্ষ্য (কুফফার শাসন ব্যবস্থার পতন), গঠন তন্ত্র, নেতৃত্বের পর্যায়ক্রম, কার্য পদ্ধতি তথা মানহায সংক্রান্ত সকল তত্ত্ব শুধু মাত্র আমীর কাছে নয় বরং সকল নেতৃত্ব স্থানীয় ব্যক্তি, সকল স্থানীয় এবং বিদেশি মুজাহিদ সদস্য এবং সমর্থকদের নিকট পরিষ্কার ছিল। তাই এত নেতৃস্থানীয় কমান্ডারের শাহাদাতের পর তরুণ শহীদ নেক মুহাম্মদ মুজাহিদ (রাহিঃ) এর মত ব্যক্তিত্বরা জিহাদের নতুন প্রজন্ম গড়ে তুলেন যা ২০০৬ সালে আল কায়েদাকে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে কুফফারদের বিরুদ্ধে চরম শক্তি হিসাবে আত্নপ্রকাশে সাহায্য করে।
তাই ইসলামী আন্দোলনের নেতাদের খাস করে আমার তালিবুল ইলম ভাইদের উদ্দেশ্য বলতে চাই, যে কোন আন্দোলনের পূর্বে আপনারা আন্দোলনের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, কার্য পদ্ধতি নির্বাচন করুন। আপনারা যদি বাংলার মুসলিমদের জন্য কোন দাবী আদায় করতে চান তাহলে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করুন, যদি সরকারের পতনের দাবী রাখেন তাহলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক অবস্থা পর্যালোচনা যোগ্য, আর যদি হিন্দের নাপাক বাহীনিকে বাংলার মাটিতে টেনে এনে তাদের হত্যা করতে চান তাহলে সারা বিশ্বে মুজাহিদ গ্রুপ গুলোর লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এবং কার্যপ্রক্রিয়া আমাদের সামনে উদাহরণ হিসেবে উপস্থিত আছে।
সর্বপরি, বিগত আন্দোলনগুলোতে আমাদের যেসকল ভাই তাদের জীবন কুরবান করছেন, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা তাদের কুরবানীকে কবুল করুন। তাদের শাহাদাতের উত্তম মোকাম দান করুন। এবং আমাদের নেতাদের তত্ত্ব আর সক্রিয়তা সমন্বয়ে আন্দোলনগুলো আরো বেগবান করার তৌফিক দেন।
*হে আমাদের পালনকর্তা! এবং আমাদের উপর এমন দায়িত্ব অর্পণ করো না, যেমন আমাদের পূর্ববর্তীদের উপর অর্পণ করেছ, হে আমাদের প্রভূ! এবং আমাদের দ্বারা ঐ বোঝা বহন করিও না, যা বহন করার শক্তি আমাদের নাই। আমাদের পাপ মোচন কর। আমাদেরকে ক্ষমা কর এবং আমাদের প্রতি দয়া কর। তুমিই আমাদের প্রভু। সুতরাং কাফের সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদের কে সাহায্যে কর। (সুরাতুল বাকারাহ - ২৮৬)
আমীন ইয়া রাব্বুস শুহাদা ওয়া রাব্বুল আলামিন।।
বাংলাদেশের এই আন্দোলন আর বিপ্লব নিয়ে আলোচনা কালে যে দুইটি শব্দ বার বার সামনে এসেছে তাহলো
==> থিউরিসম (তাত্ত্বিকতা)
==> একটিভিসম (সক্রিয়তাবাদ)
আলোচনা সামনে নেওয়ার আগে এই দুটি শব্দের সাধারণ ব্যাখ্যা জানা প্রয়োজন।
১) থিউরিসম (তাত্ত্বিকতা)ঃ তাত্ত্বিকতা হলো কোন বিষয় কিভাবে হবে, তার লক্ষ্য কি, উদ্দেশ্য কি, গতিপ্রকৃতি কি, গঠনতন্ত্র কি, সর্বপরি কাজের পদ্ধতি কি এই সম্পর্কে জ্ঞান রাখা।
২) একটিভিসম (সক্রিয়তাবাদ)ঃ সক্রিয়তাবাদ হচ্ছে তত্ত্বকে ব্যবহার করে জিব্বাহর কর্মসূচি, কলমের কমর্সুচি এবং তলোয়ারের কর্মসূচির মাধ্যমে লক্ষ্য অর্জন করা।
উদাহরণ সরূপ বলা যায়, একে-৪৭ কিভাবে বানাতে হবে এই সম্পর্কে জ্ঞান রাখা হলো তত্ত্ব অর্জন এবং এই তত্ত্ব দিয়ে একে-৪৭ বানানো সক্রিয়তা। ঠিক একইভাবে, কিভাবে আন্দোলন করতে হবে তার, উদ্দেশ্য কি, লক্ষ্য কি, প্রক্রিয়া কি এই সম্পর্কে জ্ঞান রাখা হল তাত্ত্বিকতা, আর সেই তত্ত্বের ভিত্তিতে আন্দোলন করে লক্ষ্য অর্জন করা হচ্ছে সক্রিয়তা।
যে কোন আন্দোলনের জন্য এই দুটি বিষয়ের সমন্বয় অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তা না হলে যে কোন আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়বে। অতীতের আন্দোলন থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়ার অনেক কিছু থাকলেও তথ্যের ভুল হওয়ার ভয় এবং জ্ঞানের সল্পতার কারণে অতীতের জটিল সমীকরণে হাত দেওয়া থেকে বিরত থেকে অতি সম্প্রতি (২০২১ সালে ২৫ এবং ২৬ মার্চ) বাংলাদেশের মাটিতে ঘটে যাওয়া রক্তাক্ত আন্দোলন থেকে কিছু আলোচনা করতে পারি।
থিউরিসম (তাত্ত্বিকতা)ঃ এই আন্দোলনের তাত্ত্বিকতা দিকে তাকালে আমরা শুরু থেকে এই মাঝে কিছু ফাক ফোকর দেখতে পারবো। কারণ মোদিকে কেন এই দেশে আসতে দেওয়া হবে না এই বিষয় খোদ হেফাজতের অনেক নেতার কাছে পরিষ্কার ছিল না। যেমনঃ একজন আলেম, মোদিকে কেন বাংলাদেশে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না এই ব্যাপারে তার বক্তিতায় বলেছেন বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র আর মোদী কট্টর হিন্দুবাদের প্রসারক সুতরাং বাংলার মাটিতে এমন মৌলবাদীর প্রবেশ অধিকার দেওয়ার যায় না।
আসলেই কি বাংলাদেশে মোদীর আগমনের বাধা দেওয়ার কারণ কি এটাই? মোটেও না, মোদী এই দেশে আসতে পারবে না কারণ মোদীর হাত আমাদের মুসলমান ভাইদের রক্তে রঞ্জিত, আমাদের মা-বোনদের ইজ্জত আব্রুর দাগ মোদীর সারা শরীরের আছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা এবং মুসলমানদের দুশমন কখনই মুসলিম প্রধান এই দেশে প্রবেশ করতে পারবে না। উল্লেখিত আলেম নিজেই এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন, ঠিক সেভাবে নিজের তালিবদের এবং ভক্তদের বুঝাতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই হিফাজতের আন্দোলন চলাকালে লাখ লাখ মানুষ শুধু আমাদের তালিবুল ইলম ভাইদের মরতে দেখেছে অথচ সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেনি। আন্দোলনের আগে আন্দোলনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য ঠিক না করা মূলত আন্দোলনের তত্ত্বে সবচেয়ে বড় ভুল হিসাবে পরিগনিত।
একটিভিসম (সক্রিয়তাবাদ)ঃ এই আন্দোলনে যা ছিল তা হলো একটিভিসম (সক্রিয়তাবাদ)। আলহামদুলিল্লাহ আমাদের তালিবুল ইলম ভাইয়েরা তাদের জীবন দিতেও পিছ পা হোন নি। সুবহানআল্লাহ ভোগ বিলাস আর অর্জনের এই সময়ের জীবনের মায়া ত্যাগ করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া বর্তমান যুগের এমন এক উদাহরণ যার তারিফ যত করা হবে ততো কম। কিন্তু স্বাভাবিক ভাবে তত্ত্বের এত বড় ফাক নিয়ে আন্দোলন খুব দ্রুত স্মিত হয়ে আসে৷ কারণ শুরু থেকে এই আন্দোলন থেকে কি হাসিল করা হবে তা না আন্দোলনকারীদের জানা ছিল আর না আন্দোলনের নেতারা এই ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন।
আলহামদুল্লাহ, ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। স্বাভাবিকভাবে কুরআন হাদীসের আলোকে আন্দোলনের তত্ত্ব বের করে আনা সম্ভব। আর কাওমি মাদ্রাসারগুলোর ভিত্তিই হচ্ছে আকাবীর থেকে পাওয়া শরীয়ত সম্মত জিহাদী আন্দোলনের তত্ত্বকে বাস্তবতা রূপ দেওয়ার প্রচেষ্টা। কিন্তু প্রথম থেকে এই আন্দোলনের কো৷ন উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য না থাকায় হেফাজতের উপর সরকার এবং জনগণের পক্ষ থেকে চাপ বাড়তে থাকে, যার ফলশ্রুতিতে আন্দোলন চরমভাবে পর্যাদুস্ত হয়। আন্দোলনের শুরু থেকে উলামাদের উচিত ছিল কেন এই আন্দোলন, এই আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য কি তা সাধারণ জণগনের কাছে পরিষ্কার করা। কারণ আজো অনেক ধর্মপ্রাণ মুসলিমরাও বুঝতে পারছে না যে মোদী দেশে আসলে ইসলামের এমন কি ক্ষতি হয়ে যাবে? এবং এই বিষয়েও প্রশ্ন উঠেছে যা, মোদী আগেও বাংলাদেশে এসেছে তখন কেন বাধা দেওয়া হয়নি এখনই বা কেন? তাছাড়া এত কিছু পরও তো ভারতের সাথে বাংলাদেশে কূটনৈতিক সম্পর্ক আছে, ব্যবসায়িক লেনদেন আছে, আছে সীমান্ত হত্যার মত বিষয়; এই সকল ইস্যুতে হেফাজতের নেতারা কেন সোচ্চার হচ্ছেন না? তাই জুম্মার নামাজ পর বাইতুল মোকাররাম মিছিল ছাড়া আন্দোলনের অন্য কোন পর্যায়ে সাধারণ জনগণের তেমন কোন স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহন দেখা যায়নি। কমপক্ষে তালিবুল ইলম ভাইয়েরা যারা রাস্তায় তাদের রক্ত দিয়েছেন তাদের কাছে অব্যশই এই আন্দোলনের লক্ষ্য বা আন্দোলন শেষে কি দাবী আদায় করা হবে এইটুকু পরিষ্কার করা দরকার ছিল। আমি এই বলছি না আন্দোলনের লক্ষ্য জানা ছাড়া যারা নিজের প্রাণ উতসর্গ করছেন তাদের প্রাণের কোন মূল্য নেই; না, বরং আমার এই আশা রাখি আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জাত তাদের শহীদ হিসাবে কবুল করেছেন। কিন্তু তালেবুল ইলম ভাইদের কাছে লক্ষ্য পরিষ্কার থাকলে, হেফাজতের নেতারা গ্রেফতার হলে বা নির্যাতনের মুখে পরলে তালেবুল ইলম ভাইয়েরা এই আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু তত্ত্বের গাফেলতি ভাইদের সক্রিয়তাকে অপমানিত করেছে।
পাকিস্তানের দিকে তাকালে আমরা বর্তমানে চলমান ফ্রান্স বিরোধী আন্দোলনে এই দুই বিষয়ের এক সুন্দর সমন্বয় দেখতে পারবো। ফ্রান্সে শ্রেণিকক্ষে মহানবী (স.)-এর ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শন করে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান এবং এর পক্ষে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রনের সমর্থনের কারণে তেহরিকে লাব্বাইক পাকিস্তান (টিএলপি) ঘটনার সময় থেকেই বিক্ষোভ করে আসছিল। কিন্তু সম্প্রতি তারা পাকিস্তান থেকে ফরাসি রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কারের দাবিতে জোরালো আন্দোলন গড়ে তোলে। সেই আন্দোলনে বেশ কয়েকজনের প্রাণহানী হয়। এতে সরকার টিএলপি’কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। পুলিশ সূত্রে বলা হয়, নিষিদ্ধ ঘোষিত দলটি, পুলিশ স্টেশনে হামলা, পুলিশ সদস্য ও রেঞ্জার, আধাসামরিক অফিসারদের ঘিরে ফেলা, উর্ধতন একজন পুলিশ অফিসারকে অপহরণ করলে পাঞ্জাব প্রদেশের পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে। কিন্তু তাতে আন্দোলন থেমে থাকেনি। আরো জোরালো হয়েছে। এ অবস্থায় টিএলপি নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে বাধ্য হয়েছে সরকার। (https://m.mzamin.com/article.php?mzamin=270934) অবশেষে সরকার ঘোষণা দিয়েছে ফরাসি রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কারের বিষয়টি পাকিস্তানের পার্লামেন্টে তোলা হয়েছে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল যে, পাকিস্তানে এই আন্দোলনের আহবান দিয়েছেন তেহরিকে লাব্বাইক পাকিস্তান (টিএলপি) এর প্রতিষ্ঠাতাকালীন আমীর খাদিম হোসাইন রিজভী। আন্দোলনের আহবানের কিছু দিন পর (১৯ নভেম্বর ২০২০) তিনি ইন্তেকাল করেন। তার মৃত্যুর সাথে সাথে কিন্তু আন্দোলন থেমে যায়নি শুধু সাময়িক সময়ের জন্য কিছুটা বিলম্বিত হয়েছিল আর এই বিলম্বকাল ছিল আমীরের জানাযা এবং দাফনের সময়টুকু। তার পর আন্দোলন তার আগের গতিতে ফিরে আসে। কারণ আমীর সাহেবের মৃত্যুর পর তার পরবর্তী নেতৃস্থানীয়রা, নেতা-কর্মী, এমনকি সাধারণ সসমর্থকেরা পর্যন্ত এই আন্দোলনের লক্ষ্য আর উদ্দেশ্যের ব্যাপারে পরিষ্কার ছিল।
যদিও তেহরিকে লাব্বাইক পাকিস্তান (টিএলপি) একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল তাই আদর্শিকভাবে তাদের নিকট থেকে আমাদের গ্রহণ করার মত কিছু নেই। তাই আমরা অনুকরণে জন্য আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে পরিচিত জিহাদী তানজিম "তানজিম কায়েদাতুল জিহাদ" এর দিকে তাকাতে পারি। আল কায়েদা শুরু এখন পর্যন্ত তাদের সকল কার্যক্রমে এমনকি প্রতি সুক্ষাদিসুক্ষ বিষয়ে তাত্ত্বিকতা এবং সক্রিয়তা এক অসাধারণ এবং অকল্পনীয় সমন্বয় দেখা যাবে৷ ২০০১ সালে টুইন টাওয়ার হামলার পর আমেরিকা এবং পাকিস্তান যৌথভাবে আফগানিস্তানে হামলা করে। এই হামলার আল কায়েদার হাজার হাজার স্থানীয় এবং আরব মুজাহিদ শহীহ হোন। আরো শহীহ হন শত শত মুজাহিদ নেতা। কিন্তু বর্তমানে আল কায়েদার দিকে তাকালে আমরা এই আঘাতের কোন ক্ষতি দেখতে পায় না। কারণ প্রথন থেকে আল কায়েদায় তাদের উদ্দেশ্য (গ্লোবাল জিহাদ), লক্ষ্য (কুফফার শাসন ব্যবস্থার পতন), গঠন তন্ত্র, নেতৃত্বের পর্যায়ক্রম, কার্য পদ্ধতি তথা মানহায সংক্রান্ত সকল তত্ত্ব শুধু মাত্র আমীর কাছে নয় বরং সকল নেতৃত্ব স্থানীয় ব্যক্তি, সকল স্থানীয় এবং বিদেশি মুজাহিদ সদস্য এবং সমর্থকদের নিকট পরিষ্কার ছিল। তাই এত নেতৃস্থানীয় কমান্ডারের শাহাদাতের পর তরুণ শহীদ নেক মুহাম্মদ মুজাহিদ (রাহিঃ) এর মত ব্যক্তিত্বরা জিহাদের নতুন প্রজন্ম গড়ে তুলেন যা ২০০৬ সালে আল কায়েদাকে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে কুফফারদের বিরুদ্ধে চরম শক্তি হিসাবে আত্নপ্রকাশে সাহায্য করে।
তাই ইসলামী আন্দোলনের নেতাদের খাস করে আমার তালিবুল ইলম ভাইদের উদ্দেশ্য বলতে চাই, যে কোন আন্দোলনের পূর্বে আপনারা আন্দোলনের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, কার্য পদ্ধতি নির্বাচন করুন। আপনারা যদি বাংলার মুসলিমদের জন্য কোন দাবী আদায় করতে চান তাহলে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করুন, যদি সরকারের পতনের দাবী রাখেন তাহলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক অবস্থা পর্যালোচনা যোগ্য, আর যদি হিন্দের নাপাক বাহীনিকে বাংলার মাটিতে টেনে এনে তাদের হত্যা করতে চান তাহলে সারা বিশ্বে মুজাহিদ গ্রুপ গুলোর লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এবং কার্যপ্রক্রিয়া আমাদের সামনে উদাহরণ হিসেবে উপস্থিত আছে।
সর্বপরি, বিগত আন্দোলনগুলোতে আমাদের যেসকল ভাই তাদের জীবন কুরবান করছেন, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা তাদের কুরবানীকে কবুল করুন। তাদের শাহাদাতের উত্তম মোকাম দান করুন। এবং আমাদের নেতাদের তত্ত্ব আর সক্রিয়তা সমন্বয়ে আন্দোলনগুলো আরো বেগবান করার তৌফিক দেন।
*হে আমাদের পালনকর্তা! এবং আমাদের উপর এমন দায়িত্ব অর্পণ করো না, যেমন আমাদের পূর্ববর্তীদের উপর অর্পণ করেছ, হে আমাদের প্রভূ! এবং আমাদের দ্বারা ঐ বোঝা বহন করিও না, যা বহন করার শক্তি আমাদের নাই। আমাদের পাপ মোচন কর। আমাদেরকে ক্ষমা কর এবং আমাদের প্রতি দয়া কর। তুমিই আমাদের প্রভু। সুতরাং কাফের সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদের কে সাহায্যে কর। (সুরাতুল বাকারাহ - ২৮৬)
আমীন ইয়া রাব্বুস শুহাদা ওয়া রাব্বুল আলামিন।।
Comment