ফাতোয়া শামী থেকে কিতাবুল জিহাদের দারস ৩য় পর্ব
بسم الله والحمد لله والصلاة والسلام على رسول الله وعلى آله وصحبه ومن والاه أما بعد:
আল্লাহর অশেষ শুকরিয়া বহু পরে হলেও তৃতীয় দারস শেয়ার করার তাওফিক হয়েছে। আলহামদু লিল্লাহ। আগের দুটি দারস “আবূ তালহা ওমর” আইডি থেকে দিয়েছিলাম। পাসওয়ার্ড ভুলে যাওয়ায় এখন থেকে “Abu Talha umar” আইডি থেকে শেয়ার করা হবে ইনশাআল্লাহ। এবারের তৃতীয় দারসে থাকছে জিহাদের হুকুম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা।
এক নজরে শিরোনাম :-
১. জিহাদের সর্বনিম্ন হুকুম ফরজে কেফায়াহ ২. কখন জিহাদ ফরজে কেফায়াহ
৩. কেন জিহাদ ফরজে কেফায়াহ
৪. ইবনে নুজাইম রহ. এর গুরুত্বপূর্ণ ৩টি পয়েন্ট
৫. ইকদামী জিহাদ অস্বীকারকারীদের আপত্তির জবাব
৬. ফরজে কেফায়াহর ব্যাখ্যা
৭. ফরজে কেফায়াহ ও ফরজে আঈনের পার্থক্য
৮. বছরে কত বার অভিযান চালাতে হবে?
৯. প্রত্যেক মুসলিম ভূখণ্ড পৃথক পৃথক অভিযান চালানো আবশ্যক
১০. হারাম শরীফে অভিযান চালানোর হুকুম
১১. আশহুরে হুরুমে জিহাদের হুকুম
১১. কখন জিহাদ ফরজে আঈন
১২. জিহাদ ফরজে আঈন হওয়ার ধরণ ও প্রক্রিয়া
১৩. একজন মুসলিম বন্দি হলে সারা দুনিয়ার মুসলিমদের দায়িত্ব তাকে উদ্ধার করা
১৪. বর্তমানে আমাদের উপর জিহাদের হুকুম কি?
আলোচনায় প্রবেশের আগে একটি নোট: গত একশতক ধরে ফরজে আঈনের মারহালা চলছে; আমাদের সামনে ফরজে কেফায়াহ জিহাদের কোন রূপরেখা নেই। তাই ফরজে কেফায়াহর আলোচনা কিছুটা জটিল মনে হতে পারে। তবে মনযোগ দিয়ে পড়লে সহজ লাগবে ইনশাআল্লাহ।
জিহাদের সর্বনিম্ন হুকুম ফরজে কেফায়াহ
ইবনে আবেদীন শামী (১২৫২ হি.) রহ. বলেন, قال في الدر المنتقى وليس بتطوع أصلا هو الصحيح. -رد المحتار: 4/122 دار الفكر.
‘দুররুল মুন্তাকা কিতাবে বলেছেন, জিহাদ কখনো নফল হয় না। এটিই সহীহ। -রদ্দুল মুহতার: ৪/১২২ইবনে নুজাঈম আল মিসরী (৯৭০হি.) রহ. বলেন,
وقد ظن بعض المشايخ من جواز القعود إذا لم يكن النفير عاما أنه تطوع في هذه الحالة وأكثرهم على أنه فرض كفاية فيها وليس بتطوع أصلا كما في الذخيرة وهو الصحيح كما في التتارخانية.-البحر الربائق: 5/77 دار الكتاب الإسلامي.
‘নাফিরে আমের হালত না হলে যেহেতু জিহাদে না যাওয়ার সুযোগ আছে; তাই কিছু মাশায়েখ মনে করেন তখন জিহাদ করা নফল। কিন্তু অধিকাংশ মাশায়েখের মতে তখন জিহাদ ফরজে কেফায়াহ। নফল কখনো নয়। এমনটি যাখীরাহ (নামক কিতাবেও) আছে। এবং এই মতটিই সহীহ যেমনটি তাতারখানিয়া কিতাবে রয়েছে।’ -আল বাহরুর রায়েক: ৫/৭৭ কখন জিহাদ ফরজে কেফায়াহ
আল্লামা তুমুরতাশী (১০০৪ হি.) রহ. বলেন, هو فرض كفاية ابتداء إن قام به البعض سقط عن الكل وإلا أثموا بتركه. -تنوير الأبصار مع رد المحتار: 6/199-200
“ইবতিদাআন জিহাদ ফরজে কেফায়াহ।” -রদ্দুর মুহতার: ৬/১৯৯ আলাউদ্দিন হাসকাফি (১০৮৮ হি.) রহ. ابتداء (ইবতিদাআন) এর উদ্দেশ্য এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন,
ابتداء أي إن لم يبدئونا -الدر المختار مع رد المحتار: 6/199
“প্রথমে অর্থাৎ যদি তারা আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সূচনা না করে (তাহলে আমাদের উপর ফরজে কেফায়াহ তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সূচনা করা।”-রদ্দুল মুহতার: ৬/১৯৯অর্থাৎ আমরা যাকে ইকদামী জিহাদ হিসেবে চিনি। ইসলামী রাষ্ট্রের সীমানা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে, আগে বেড়ে কাফের রাষ্ট্রে অভিযান পরিচালনা করা ফরজে কেফায়াহ।
কেন জিহাদ ফরজে কেফায়াহ
সাধারণত যেহেতু নাফিরে আম না হওয়া অবস্থায় জিহাদের উদ্দেশ্য ‘কাফেরদের শক্তি খর্ব করণ ও আল্লাহর কালেমা বুলন্দ করণ’ কিছু সংখ্যক লোকের দ্বারা অর্জন হওয়া সম্ভব তাই জিহাদ ফরজে কেফায়াহ। অবশ্য, যদি কখনো কিছু সংখ্যকের পক্ষে উদ্দেশ্য অর্জন সম্ভব না হয় তাহলে ফরজে কেফায়াহ ফরজে আঈনে পরিণত হবে। আলাউদ্দিন হাসকাফী রহ. বলেন,
كل ما فرض لغيره فهو فرض كفاية إذا حصل المقصود بالبعض، وإلا ففرض عين. -الدر المختار مع رد المحتار: 4/123
‘ফরজ লি গায়রিহি (তথা হাসান লি গায়রিহি) প্রত্যেক বিধান ফরজে কেফায়াহ হয়; যদি তার গায়ের টি কিছু সংখ্যক লোক দ্বারা অর্জন হয়ে যায়। অন্যথায় ফরজে আঈন। -রদ্দুল মুহতার: ৪/১২৩সিরাজুদ্দীন ইবনে নুজাঈম (১০০৫ হি.) রহ. বলেন, ‘কিছু সংখ্যক লোকের দ্বারা উদ্দেশ্যটি অর্জন হয়ে যাওয়া’ (জিহাদ ফরজে কেফায়াহ হওয়ার জন্য) এই শর্ত পূরণ হওয়া আবশ্যক। অন্যথায় নাফিরে আমের সাথে কোন পার্কথ্য হবে হবে না। কারণ নাফিরে আমের সময়ও জিহাদ হাসান লি গায়রিহি; অথচ তা ফরজে আঈন। কারণ তখন কিছু সংখ্যক লোকের দ্বারা উদ্দেশ্য অর্জন হয় না। -আন নাহরুল ফায়েক: ৩/১৯৯ দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ।
ইবনে নুজাইম রহ. এর গুরুত্বপূর্ণ ৩টি পয়েন্ট
আল্লামা ইবনে নুজাইম আল মিসরী রহ. ‘هو فرض كفاية ابتداء’ বাক্যের ‘ফরজ’ ‘কেফায়াহ’ ‘ইবতিদাআন’ এই তিনটি শব্দ থেকে তিনটি পয়েন্ট বের করেছেন। এবং কোরআন থেকে দলিলসহ আলোচনা করেছেন। তাই তাঁর আলোচনাটি উল্লেখ্য করা মোনাসিব মনে হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘এই বাক্য থেকে তিনটি পয়েন্ট বের হয়।
প্রথম পয়েন্ট: জিহাদ একটি ফরজ ইবাদাত। -এর দলিল কুরআনের সমস্ত কতঈ (অকাট্য) আদেশ। উদাহরণস্বরূপ কয়েকটি উল্লেখ করা হলো,
মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
فَإِذَا انْسَلَخَ الْأَشْهُرُ الْحُرُمُ فَاقْتُلُوا الْمُشْرِكِينَ حَيْثُ وَجَدْتُمُوهُمْ وَخُذُوهُمْ وَاحْصُرُوهُمْ وَاقْعُدُوا لَهُمْ كُلَّ مَرْصَدٍ فَإِنْ تَابُوا وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ فَخَلُّوا سَبِيلَهُمْ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ. -سورة التوبة: 5
‘অতঃপর সম্মানিত মাসসমূহ অতিবাহিত হলে মুশরিকদেরকে যেখানেই পাবে হত্যা করবে। তাদেরকে গ্রেফতার করবে, অবরোধ করবে এবং তাদেরকে ধরার জন্য প্রত্যেক ঘাটিতে ওঁৎ পেতে বসে থাকবে।’ -সূরা তাওবা: ৫আল্লাহ তাআলা বলেন,
قَاتِلُوا الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَلَا بِالْيَوْمِ الْآخِرِ وَلَا يُحَرِّمُونَ مَا حَرَّمَ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَلَا يَدِينُونَ دِينَ الْحَقِّ مِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ حَتَّى يُعْطُوا الْجِزْيَةَ عَنْ يَدٍ وَهُمْ صَاغِرُونَ. -سورة التوبة: 29
‘কিতাবীদের মধ্যে যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখে না এবং পরকালেও নয় এবং আল্লাহ ও তার রাসূল যা-কিছু হারাম করেছেন তাকে হারাম মনে করে না এবং সত্য দ্বীনকে নিজের দ্বীন বলে স্বীকার করে না, তাদের সঙ্গে যুদ্ধ কর, যাবৎ না তারা হেয় হয়ে নিজ হাতে জিযিয়া আদায় করে। -সূরা তাওবা: ২৯আল্লাহর বাণী,
وَقَاتِلُوا الْمُشْرِكِينَ كَافَّةً كَمَا يُقَاتِلُونَكُمْ كَافَّةً وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ مَعَ الْمُتَّقِينَ. -سورة التوبة: 36
‘এবং তোমরা সকলে মিলে মুশরিকদের সাথে লড়াই কর, যেমন তারা তোমাদের সাথে লড়াই করে। নিশ্চিত জেন, আল্লাহ মুত্তাকীদের সঙ্গে আছেন।’ -সূরা তাওবাহ: ৩৬ এই সকল দলীলের উপর আপত্তি তোলা যায় যে, যেহেতু এই নসগুলো (উসূলুল ফিকহের পরিভাষায়) عام خص عنه البعض (আম্মুন খুস্সা আনহুল বায) তাই এগুলো ظني الدلالة (অকাট্য নয়); আর যন্নিউদ দালালাহ দিয়ে ফরজ সাব্বস্ত হয় না!
এই আপত্তির জবাব হলো, আসলে যে বায অংশ কে খাস করার কথা বলা হচ্ছে তাদের মাঝে শিশু ও পাগল এই আদেশের অন্তর্ভূক্ত নয়; তা বিবেকের দ্বারাই প্রমাণিত। তাই এর কারণে উপরুক্ত নসগুলো যন্নি হওয়া আবশ্যক নয়। আর শিশু ও পাগল ছাড়া আরো যাদেরকে খাস করা হয়েছে (যেমন নারী ও বৃদ্ধ মোট কথা যাদের যুদ্ধ করার মতো শারিরীক গঠন নেই); নসগুলো শুরু থেকেই তাদের সাথে সম্পৃক্ত নয়। কারণ নসগুলোর শব্দ থেকেই পরিষ্কার যে, এখানে তারাই উদ্দেশ্য যাদের বিনয়াতুন সালেহা তথা যুদ্ধের উপযুক্ত গঠন আছে। (অর্থাৎ প্রত্যেক সুস্থ্য বালেগ পুরুষ)।
দ্বিতীয় পয়েন্ট: জিহাদ ফরজে কেফায়াহ আমল। -উপরে উল্লেখিত আয়াতগুলো যদিও জিহাদ ফরজে আঈন হওয়াকে প্রমাণ করে; তবে নিম্নোক্ত আয়াত স্পষ্ট প্রমাণ করে যে জিহাদ ফরজে কেফায়াহ। আল্লাহ তাআলা বলেন,
لَا يَسْتَوِي الْقَاعِدُونَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ غَيْرُ أُولِي الضَّرَرِ وَالْمُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ فَضَّلَ اللَّهُ الْمُجَاهِدِينَ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ عَلَى الْقَاعِدِينَ دَرَجَةً وَكُلًّا وَعَدَ اللَّهُ الْحُسْنَى وَفَضَّلَ اللَّهُ الْمُجَاهِدِينَ عَلَى الْقَاعِدِينَ أَجْرًا عَظِيمًا. -سورة النساء: 95
‘যে মুসলিমগণ কোন ওযর না থাকা সত্তেও (যুদ্ধে যোগদান না করে বরং ঘরে) বসে থাকে, তারা ও আল্লাহর পথে নিজেদের মাল ও জান দ্বারা জিহাদকারীগণ সমান নয়। যারা নিজেদের মাল ও জান দ্বারা জিহাদ করে আল্লাহ তাদেরকে, যারা বসে থাকে তাদের উপর মর্যাদায় শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। তবে আল্লাহ সকলকেই কল্যাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আর যারা ঘরে বসে থাকে আল্লাহ তাদের উপর মুজাহিদদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে মহা পুরস্কার দান করেছেন।’ -সূরা নিসা: ৯৫সুতরাং এখানে আল্লাহ যারা ঘরে বসে থাকে, তাদেরকেও কল্যাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। যদি জিহাদ ফরজে আঈন হতো তাহলে তারা কল্যাণ নয়; বরং গোনাহের ভাগিদার হতো।
তৃতীয় পয়েন্ট: (কাফেররা আক্রমণ না করা অবস্থায়) প্রথমে আমরা তাদের বিরুদ্ধে জিহাদের সূচনা করা ফরজে কেফায়াহ। কারণ এই বিষয়ে আয়াতগুলো আম এবং মুতলাক। তারা আমাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ করলে আমরা করতে পারব অন্যথায় পারব নাএরকম কোনো শর্ত নেই।’ -আল বাহরুর রায়েক: ৫/৭৭
ইকদামী জিহাদ অস্বীকারকারীদের আপত্তির জবাব
আপত্তি: আল্লাহ তাআলা বলেন, فَإِنْ قَاتَلُوكُمْ فَاقْتُلُوهُمْ. -البقرة: 191
“যদি তারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে; তাহলে তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর।” -সূরা বাকারাহ: ১৯১এই আয়াতে বলা হয়েছে তারা আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আসলে যেন আমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করি। সুতরাং তারা আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু না করাবস্থায় আমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করা ফরজে কেফায়াহ -বিষয়টি তো আয়াতের বিপরীত হয়েগেল!
আলাউদ্দীন হাসকাফী রহ. (১০৮৮ হি.) এই আপত্তির জবাব দিয়েছেন এভাবে,
وأما قوله تعالى: - فإن قاتلوكم فاقتلوهم. البقرة: 191 فمنسوخ بالعمومات ك فاقتلوا المشركين حيث وجدتموهم. التوبة: 5 -رد المحتار: 4/123
“অতঃপর আল্লাহ তাআলার বাণী ‘যদি তারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে; তাহলে তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর -সূরা বাকারাহ: ১৯১’ মানসূখ হয়েগেছে। ‘তোমরা মুশরিকদের যেখানে পাও সেখানেই হত্যা কর -সূরা তাওবাহ: ০৫’ এই জাতীয় আম আয়াতসমূহের দ্বারা।” -রদ্দুল মুহতার: ৪/১২৩আরেকটি জবাব হতে পারে যে, উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা দিফায়ী জিহাদের আদেশ দিয়েছেন; কিন্তু ইকদামী জিহাদকে তো নিষেধ করেন নি। সুতরাং এই আয়াতের মাফহুমে মুখালিখ (বিপরীত উদ্দেশ্য) ধরে আপত্তি তোলা ঠিক হয় নি। কারণ মাফহুমে মুখালিফ দলিল নয়।
ইবনে আবেদীন শামী রহ. এই আপত্তির আরো সুন্দর জবাব দিয়েছেন। তার সার সংক্ষেপ এই,
“ক্বিতালের বিধানটি পর্যায়ক্রমে নাযিল হয়েছে। প্রথমে প্রকাশ্যে দাওয়াত ও পরওয়া না করার নির্দেশ ছিল,
فَاصْدَعْ بِمَا تُؤْمَرُ وَأَعْرِضْ عَنِ الْمُشْرِكِينَ. -سورة الحجر: 94
‘সুতরাং তোমাকে যে বিষয়ে আদেশ করা হচ্ছে, তা প্রকাশ্যে মানুষকে শুনিয়ে দাও। (তথাপি) যারা শিরক করবে তাদের পরওয়া করো না। -সূরা হিজর: ৯৫দ্বিতীয়ত নির্দেশ ছিল উত্তম নাসিহা ও প্রয়োজনে বিতর্ক,
ادْعُ إِلَى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ. -النحل: 125
‘তুমি নিজ প্রতিপালকের পথে মানুষকে ডাকবে হিকমত ও সদুপদেশের মাধ্যমে আর (যদি কখনও বিতর্কের দরকার পড়ে, তবে) তাদের সাথে বিতর্ক করবে উৎকৃষ্ট পন্থায়। -সূরা নাহল: ১২৫তৃতীয়ত নির্দেশ এসেছে দিফায়ী জিহাদের,
أُذِنَ لِلَّذِينَ يُقَاتَلُونَ بِأَنَّهُمْ ظُلِمُوا وَإِنَّ اللَّهَ عَلَى نَصْرِهِمْ لَقَدِيرٌ. -الحج: 39
‘যাদের সঙ্গে যুদ্ধ করা হচ্ছে, তাদেরকে অনুমতি দেওয়া যাচ্ছে (তারা নিজেদের প্রতিরক্ষার্থে যুদ্ধ করতে পারে)। যেহেতু তাদের প্রতি জুলুম করা হয়েছে। নিশ্চয় জেনে রাখ, আল্লাহ তাদেরকে জয়যুক্ত করতে পরিপূর্ণ সক্ষম।’ -সূরা হাজ্জ: ৩৯ وَلَا تُقَاتِلُوهُمْ عِنْدَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ حَتَّى يُقَاتِلُوكُمْ فِيهِ فَإِنْ قَاتَلُوكُمْ فَاقْتُلُوهُمْ كَذَلِكَ جَزَاءُ الْكَافِرِينَ. -البقرة: 191
‘আর তোমরা মসজিদুল হারামের নিকট তাদের সঙ্গে ততক্ষণ পর্যন্ত যুদ্ধ করো না, যক্ষণ না তারা নিজেরা সেখানে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে, হ্যাঁ তারা যদি সেখানে যুদ্ধ শুরু করে তবে তোমরা তাদেরকে হত্যা করতে পার। এরূপ কাফিরদের শাস্তি সেটাই।’-সূরা বাকারাহ: ১৯১সর্বশেষ চতুর্থত ইকদামী জিহাদের আদেশ দেয়া হয়েছে,
وقاتلوهم حتى لا تكون فتنة. -البقرة: 193
‘তোমরা তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাক, যতক্ষণ না ফিতনা খতম হয়ে যায় এবং দ্বীন আল্লাহর হয়ে যায়।’ -সূরা বাকারাহ: ১৯৩ فاقتلوا المشركين حيث وجدتموهم. -التوبة: 5
‘মুশরিকদের যেখানেই পাবে হত্যা করবে।’ -সূরা তাওবাহ: ০৫আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী কারীম সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
«أُمِرْتُ أَنْ أُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَشْهَدُوا أَنْ لاَ إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ، وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ، وَيُقِيمُوا الصَّلاَةَ، وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ، فَإِذَا فَعَلُوا ذَلِكَ عَصَمُوا مِنِّي دِمَاءَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ إِلَّا بِحَقِّ الإِسْلاَمِ، وَحِسَابُهُمْ عَلَى اللَّهِ» -رواه البخاري: 25
‘ততক্ষণ আমাকে ক্বিতাল চালিয়ে যাবার নির্দেশ করা হয়েছে, যতক্ষণ না তারা সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর রসূল, এবং সালাত প্রতিষ্ঠা করে ও যাকাত প্রদান করে। যখন তারা এগুলো পালন করবে, আমার থেকে তাদের জান ও মালের নিরাপত্তা লাভ করবে। অবশ্য ইসলামের কোন হক থাকলে ভিন্ন কথা। আর তাদের হিসাবের ভার আল্লাহর উপর অর্পিত।’ -সহীহ বুখারী: ২৫অতঃপর ইকদামী জিহাদের উপর বিধানটি স্থির লাভ করেছে। এবং এই বিধান ক্বিয়ামত পর্যন্ত চলবে। -আল মাবসূত: ১০/২ দারুল মারিফাহ।
অর্থাৎ হারাম শরীফ ছাড়া সমস্ত জায়গায় সমস্ত যামানায় ইকদামী জিহাদ ফরজে কেফায়াহ এর উপরই বিধানটি স্থির লাভ করেছে। -রদ্দুল মুহতার: ৪/১২৩
ফরজে কেফায়াহর ব্যাখ্যা
আলাউদ্দিন হাসকাফী রহ. বলেন, (إن قام به البعض) ولو عبيدا أو نساء (سقط عن الكل وإلا) يقم به أحد في زمن ما (أثموا بتركه) أي أثم الكل من المكلفين. -الدر المختار مع رد المحتار: 4/123
‘যদি তা কিছু সংখ্যকের দ্বারা আদায় হয়ে যায়; যদিও গোলাম বা নারীদের দ্বারা হোক না কেন, তাহলে সকলের পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যাবে। আর যদি কেউ কোন সময় তা আদায় না করে; তাহলে বিধানটি তরক করার কারণে প্রত্যেক মুকাল্লাফ গোনাহগার হবে। -রদ্দুল মুহতার: ৪/১২৩ইবনে আবেদীন শামী রহ. বলেন,
هذه الجملة وقعت موقع التفسير لفرض الكفاية فتح. -رد المحتار: 4/123
‘এই বাক্যটি ফরজে কেফায়ার ব্যাখ্যা হিসেবে এসেছে।’-রদ্দুল মুহতার: ৪/১২৩ ফরজে কেফায়া ও ফরজে আঈনের পার্থক্য
ফরজে কেফায়াহর ক্ষেত্রে মুখ্য হলো সামগ্রিকভাবে বিধানটি আদায় হয়ে যাওয়া। যেমন: মৃত ব্যাক্তিকে গোসল করানো, কাফন পরানো এবং সালামের উত্তর দেয়া ইত্যাদি। তাই তা প্রত্যেক মুকাল্লাফ স্বয়ং নিজে আদায় করা আবশ্যক নয়; বরং কিছু সংখ্যক লোক তা আদায় করে ফেল্লে, সকলের দায়িত্ব আদায় হয়ে যায়। পক্ষান্তরে ফরজে আঈনের ক্ষেত্রে মুখ্য হলো প্রত্যেক আকেল বালেগ স্বয়ং নিজে বিধানটি পালন করা। তাই এখানে নিজেরটা নিজেই আদায় করতে হয়; একজনের টা অন্যজন আদায় করে দিতে পারে না। এই জন্যই ফরজে কেফায়া থেকে ফরজে আঈন উত্তম; কারণ তার গুরুত্ব বেশী। -রদ্দুল মুহতার: ৪/১২৩ বছরে কত বার অভিযান চালাতে হবে?
(وإلا) يقم به أحد في زمن ما (أثموا بتركه) -الدر المختار مع رد المحتار: 4/123
‘যদি তা কেউ কখনো আদায় না করে; সকলে গোনাহগার হবে।’ -রদ্দুল মুহতার: ৪/১২৩এই ইবারত থেকে বুঝে আসে, ‘কিছু সংখ্যক লোক যে কোন এক সময় তা আদায় করলেই সকলে দায়িত্বমুক্ত হয়ে যাবে।’ কিন্তু না বিষয়টি এমন নয়। -রদ্দুর মুহতার: ৪/১২৩
ইবনে আবেদীন শামী রহ. বলেন,
أنه يجب على الإمام في كل سنة مرة أو مرتين وحينئذ فلا يكفي فعله في سنة عن سنة أخرى. -رد المحتار: 4/123
‘ফরজে কেফায়া জিহাদ আদায় হওয়ার জন্য ইমামের উপর ওয়াজিব প্রত্যেক বছর এক দুই বার অভিযান পরিচালনা করা। আর এ ক্ষেত্রে আগের বছরের অভিযান পরের বছরের জন্য যথেষ্ট হবে না। -রদ্দুল মুহতার: ৪/১২৩ইমামুল হারামাইন জুয়াইনী (৪৭৮হি.) রহ. এই মাসআলা নিয়ে বিস্তারিত আলোকপাত করেছেন। তার বক্তব্যের মূল কথা হলো, ‘অনেকে বলেন যে, বছরে এক বার অভিযান পরিচালনা করলে ফরজে কেফায়াহ আদায় হয়ে যাবে। কিন্তু আমার মতে তা ঠিক নয়। কারণ এই ক্ষেত্রে সময় মুখ্য নয়; মুখ্য হলো সক্ষমতা। অর্থাৎ বছরে যত বার অভিযান পরিচালনা করতে সক্ষম হবে তত বার অভিযান পরিচালনা করা ফরজে কেফায়াহ। আর ফুকাহায়ে কেরাম বছরে এক দু বারের যে কথা বলেছেন তা মূলত স্বাভাবিক অবস্থার বিবেচনায় বলেছেন। কারণ সাধারণত বছরে এক দুই বারের বেশি অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব হয় না। -গিয়াসুল উমাম ফিত তিয়াসিয যুলাম: পৃ.২০৮
প্রত্যেক মুসলিম ভূখণ্ড পৃথক পৃথক অভিযান চালানো আবশ্যক
আমরা ফরজে কেফায়াহর ব্যাখ্যায় জেনেছি, কিছু সংখ্যক লোক বিধানটি আদায় করে নিলে সকলের পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যাবে। কথাটি থেকে বুঝা যায় পৃথিবীর যে কোন এক প্রান্তের মুসলিমরা ফরজে কেফায়া জিহাদ আদায় করে নিলে অপর প্রান্তের মুসলিমদের ফরিজাহও আদায় হয়ে যাবে। কিন্তু বিষয়টি এমন নয়; বরং প্রত্যেক প্রান্তের মুসলিমদের জন্য তাদের নিকটবর্তী কাফেরদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা আবশ্যক। আলাউদ্দিন হাসকাফী রহ. বলেন, وإياك أن تتوهم أن فرضيته تسقط عن أهل الهند بقيام أهل الروم مثلا. -الدر المختار: 4/124 دار الفكر
‘তুমি এমন ধারণা করা থেকে বিরত থাক যে, উদাহরণস্বরূপ -রুমের অধিবাসীগণ ফরজটি আদায়ের কারণে হিন্দুস্থানবাসীর ফরজও আদায় হয়ে যাবে।’ -রদ্দুল মুহতার: ৪/১২৪ব্যাখ্যায় শামী রহ. বলেন,
কেননা রূমবাসীর ক্বিতালের কারণে হিন্দবাসী থেকে (তাদের নিকটবর্তী কাফেরদের) অনিষ্ট দূর হবে না। -রদ্দুল মুহতার: ৪/১২৪
হাশিয়াতুস সাদিয়া কিতাবের মুসান্নিফ বলেন,
আল্লাহ তাআলা বলেন,
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قَاتِلُوا الَّذِينَ يَلُونَكُمْ مِنَ الْكُفَّارِ وَلْيَجِدُوا فِيكُمْ غِلْظَةً وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ مَعَ الْمُتَّقِينَ. -التوبة: 123
‘হে মুমিনগণ! কাফেরদের মধ্যে যারা তোমাদের নিকটবর্তী তোমরা তাদের সঙ্গে যুদ্ধ কর। তারা যেন তোমাদের মধ্যে কঠোরতা দেখতে পায়। নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তাকীদের সঙ্গে আছেন।’ -সূরা তাওবাহ: ১২৩এই আয়াতটি প্রমাণ করে, প্রত্যেক ভূখণ্ডবাসীর উপর জিহাদ ফরজ। তিনি আরো বলেন, ‘আয়াতটি প্রমাণ করে যে, কাফেরদের কাছাকাছি অবস্থানকারী প্রত্যেক মুসলিমের উপর জিহাদ ফরজে কেফায়াহ। তাই রুমবাসী আদায়ের দ্বারা হিন্দবাসী এবং মাওয়ারাউন নাহার বাসীর ফরজ আদায় হবে না (উদাহরণস্বরূপ)। -রদ্দুল মুহতার: ৪/১২৪
বাদায়েউস সনায়ে কিতাবে আছে,
وإذا كان فرضا على الكفاية فلا ينبغي للإمام أن يخلي ثغرا من الثغور من جماعة من الغزاة فيهم غنى وكفاية لقتال العدو. -بدائع الصنائع: 7/98
‘সুতরাং যখন জিহাদ ফরজে কেফায়াহ তাই ইমামের উচিত হবে না, কোন সীমান্ত শূন্য রাখা; একদল এমন মুজাহিদের থেকে যারা শত্রুকে শায়েস্তা করতে যথেষ্ট।’ -বাদায়ে সানায়ে: ৭/৯৮; রদ্দুল মুহতার: ৪/১২৪ হারাম শরীফে অভিযান চালানোর হুকুম
হারাম শরীফে যুদ্ধে জড়ানো হারাম। তবে কাফেররা যদি সেখানে যুদ্ধ শুরু করে; তাহলে তাদেরকে প্রতিহত করতে আমরাও যুদ্ধ করতে পারব। শামী রহ. বলেন, والمراد بقوله: سوى الحرم إذا لم يدخلوا فيه للقتال فلو دخلوه للقتال حل قتالهم فيه لقوله تعالى إلخ. -رد المحتار: 4/123
‘হারাম শরীফে যুদ্ধ করা যাবে না; এর উদ্দেশ্য হলো যখন কাফেররা তাতে যুদ্ধে লিপ্ত না হবে। যদি তারা সেখানে যুদ্ধ বাধায় তাহলে সেখানে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করা হালাল। কেননা আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, وَلَا تُقَاتِلُوهُمْ عِنْدَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ حَتَّى يُقَاتِلُوكُمْ فِيهِ فَإِنْ قَاتَلُوكُمْ فَاقْتُلُوهُمْ كَذَلِكَ جَزَاءُ الْكَافِرِينَ. -البقرة: 191
‘আর তোমরা মসজিদুল হারামের নিকট তাদের সঙ্গে ততক্ষণ পর্যন্ত যুদ্ধ করো না, যক্ষণ না তারা নিজেরা সেখানে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে, হ্যাঁ তারা যদি সেখানে যুদ্ধ শুরু করে তবে তোমরা তাদেরকে হত্যা করতে পার। এরূপ কাফিরদের শাস্তি সেটাই।’ -সূরা বাকারাহ: ১৯১; রদ্দুল মুহতার: ৪/১২৩ কখন জিহাদ ফরজে আঈন?
যখন শত্রু আক্রমণ করে বা আক্রমণ করার আশংকা দেখা দেয় তখন জিহাদ ফরজে আঈন হয়ে যায়। তুমুরতাশী রহ. ( হি.) বলেন, وفرض عين إن هجم العدو إلخ. -تنوير الأبصار مع رد المحتار: 4/126
‘এবং জিহাদ ফরজে আঈন যদি শত্রু আক্রমণ করে।’ -রদ্দুল মুহতার: ৪/১২৬ইবনে আবেদীন শামী রহ. বলেন,
ولا يخفى أن هذا عند هجوم العدو أو عند خوف هجومه. -رد المحتار: 4/122
‘বলার অপেক্ষা রাখে না যে, জিহাদ ফরজে আঈন হয়; শত্রু আক্রমণ করলে অথবা আক্রমণ করার আশংকা হলে।’ -রদ্দুল মুহতার: ৪/১২২আর শত্রুর আক্রমণ ও আক্রমণের সম্ভাবনাময় অবস্থাকে নাফিরে আম বলা হয়। ইবনে আবেদীন শামী রহ. বলেন,
أي دخل بلدة بغتة، وهذه الحالة تسمى النفير العام قال في الاختيار: والنفير العام أن يحتاج إلى جميع المسلمين. -رد المحتار: 4/127
‘(হুজুম) অর্থাৎ কোন মুসলিম ভূখণ্ডে হঠাৎ শত্রুর আগমন ঘটা। আর এই অবস্থাকে নাফিরে আম বলা হয়। ইখতিয়ার কিতাবে বলেছেন, ‘নাফিরে আমের সময় সমস্ত মুসলিমদের প্রয়োজন হয়।’ -রদ্দুল মুহতার: ৪/১২৭ জিহাদ ফরজে আঈন হওয়ার ধরণ বা প্রক্রিয়া
নাফিরে আমের সময় জিহাদ সারা পৃথিবীর সমস্ত মুসলিমদের উপর পর্যায়ক্রমে ফরজে আঈন হয়ে থাকে। ইবনে আবেদীন শামী রহ. বলেন, (قوله وفرض عين) أي على من يقرب من العدو، فإن عجزوا أو تكاسلوا فعلى من يليهم حتى يفترض على هذا التدريج على كل المسلمين شرقا وغربا. -رد المحتار: 4/126
‘ফরজে আঈন হয়ে যায় অর্থাৎ (প্রথমে) শত্রুর নিকটবর্তীদের উপর; তারা যদি অপারগ হয় কিংবা অবহেলা করে তখন তাদের পার্শ্ববর্তীদের উপর এভাবে ধীরে ধীরে সারা বিশ্বের সমস্ত মুসলিমদের উপর জিহাদ ফরজে আঈন হয়ে যায়।’ -রদ্দুল মুহতার: ৪/১২৬শামী রহ. বলেন,
ونقل صاحب النهاية عن الذخيرة أن الجهاد إذا جاء النفير إنما يصير فرض عين على من يقرب من العدو، فأما من وراءهم ببعد من العدو فهو فرض كفاية عليهم، حتى يسعهم تركه إذا لم يحتج إليهم فإن احتيج إليهم بأن عجز من كان يقرب من العدو عن المقاومة مع العدو أو لم يعجزوا عنها، لكنهم تكاسلوا ولم يجاهدوا فإنه يفترض على من يليهم فرض عين كالصلاة والصوم، لا يسعهم تركه ثم وثم إلى أن يفترض على جميع أهل الإسلام شرقا وغربا على هذا التدريج. -رد المحتار: 4/124
‘নেহায়ার লেখক যাখীরাহ থেকে বর্ণনা করেছেন যে, নিশ্চয় নাফিরে আমের সময় প্রথমে শত্রুর নিকটবর্তীদের উপর জিহাদ ফরজে আঈন হয়; পক্ষান্তরে যারা তাদের থেকে দূরে অবস্থান করছে তাদের উপর জিহাদ ফরজে কেফায়াহ। তাই যদি দূরবর্তীদের প্রয়োজন না পড়ে তাহলে তাদের জন্য জিহাদ না করার সুযোগ রয়েছে। অবশ্য, শত্রুর নিকটবর্তীরা প্রতিরোধে অক্ষম হলে অথবা অক্ষম না হওয়া সত্তেও অলসতা ও অবহেলা বসত জিহাদ করছে না; ইত্যাদি কারণে যদি দূরবর্তীদের প্রয়োজন দেখা দেয়; তখন তাদের উপর নামাজ ও রোজার মতোই জিহাদ ফরজ হয়ে যায়। তাদের জন্য জিহাদ ছেড়ে দেয়ার সুযোগ নেই। অতঃপর তাদের পার্শ্ববর্তী অতঃপর তাদের পার্শ্ববর্তী এভাবে পুরো বিশ্বের সকল মুসলিমদের উপর জিহাদ ফরজে আঈন হয়ে যায়।’ -রদ্দুল মুহতার: ৪/১২৪এই ক্ষেত্রে জিহাদ এই পরিমাণ দীর্ঘ হতে হবে যেন দূরবর্তীরা এসে পৌঁছোতে পারেন। ইবনে হুমাম রহ. ( ৮৬১হি.) বলেন,
وكان معناه إذا دام الحرب بقدر ما يصل الأبعدون وبلغهم الخبر وإلا فهو تكليف بما لا يطاق بخلاف إنقاذ الأسير وجوبه على الكل متجه من أهل المشرق والمغرب ممن علم. -فتح القدير: 5/440، رد المحتار: 4/126
‘আর তা তখনই হবে যখন যুদ্ধ এই পরিমাণ দীর্ঘ হবে যে দূরবর্তীদের কাছে খবর আসার পর তার যুদ্ধে ক্ষেত্রে পৌঁছাতে পারবে; অন্যথায় সক্ষম নয় এমন বিষয় আবশ্যক হওয়া লাযেম আসবে। তবে বন্দি মুক্তির বিষয়টি ভিন্ন। তা পূর্ব থেকে পশ্চিমের প্রত্যেক জ্ঞাত ব্যাক্তির উপর ওয়াজিব হওয়া যুক্তিযুক্ত।’ -ফাতহুল কাদীর: ৫/৪৪০ একজন মুসলিম বন্দি হলে সারা দুনিয়ার মুসলিমদের দায়িত্ব তাকে উদ্ধার করা
উপরোক্ত ইবনে হুমাম রহ. এর বক্তব্য থেকে স্পষ্ট, যদি কোন একজন মুসলিম কাফেরদের হাতে বন্দি হয়; তাহলে পূর্ব থেকে পশ্চিম সকল মুসলিমদের উপর ওয়াজিব তাকে উদ্ধার করা। শামী রহ. বলেন, وفي البزازية: مسلمة سبيت بالمشرق وجب على أهل المغرب تخليصها من الأسر ما لم تدخل دار الحرب وفي الذخيرة يجب على من لهم قوة اتباعهم لأخذ ما بأيديهم من النساء والذراري وإن دخلوا دار الحرب ما لم يبلغوا حصونهم، ولهم أن لا يتبعوهم للمال. -رد المحتار: 4/126
‘বায্যাযিয়াতে আছে, ‘প্রাচ্যে কোন একজন মুসলিম নারীকে বন্দি করা হয়েছে, পশ্চিমের অধিবাসীদের উপর ওয়াজিব তাকে বন্দিত্ব থেকে মুক্ত করা। যতক্ষণ না তারা দারুল হারবে পৌঁছায়।’ আর যাখিরা কিতাবে আছে, ‘যাদের পিছু নেবার ক্ষমতা আছে তারা কাফেরদের হাত থেকে বন্দি নারী-শিশুদের উদ্ধার করা ওয়াজিব দুর্গে প্রবেশের আগপর্যন্ত; যদিও দারুল হারবে পৌঁছে যাক না কেন। -রদ্দুল মুহতার: ৪/১২৬জিহাদ ফরজে আঈন হওয়ার আর একটি অবস্থা হলো, মুসলিমদের সংখ্যা কখনো যদি এতো কমে যায় যে, ফরজে কেফায়াহ আদায়ে সকলের প্রয়োজন হয়। শামী রহ. বলেন,
وكلا منا في فريضته ابتداء، وهذا لا يمكن أن يكون فرض عين إلا إذا كان بالمسلمين قلة والعياذ بالله تعالى بحيث لا يمكن أن يقوم به بعضهم، فحينئذ يفترض على كل واحد منهم عينا تأمل. -رد المحتار: 4/123 دار الفكر.
‘আমাদের আলোচনা চলছে ‘ইকদামী জিহাদ ফরজে কেফায়াহ’ তা নিয়ে; আর এটি ফরজে আঈন হওয়া সম্ভব নয়। তবে যদি মুসলিমদের সংখ্যা এত কম হয় যে (আল্লাহর পানাহ) তাদের কিছু সংখ্যক দ্বারা উদ্দেশ্যটি অর্জন করা সম্ভব নয়; তখন তাদের প্রত্যেকের উপর জিহাদ ফরজে আঈন হয়ে যাবে। -রদ্দুল মুহাতর: ৪/১২৩ অবশেষে কোন্ কোন্ অবস্থায় জিহাদ ফরজে আঈন হয়ে পরে এ সংক্রান্ত ইবনে কুদামা (৬২০ হি.) রহ. এর প্রসিদ্ধ বক্তব্যটি তুলে ধরা উুপকারী মনে করছি,
ويتعين الجهاد في ثلاثة مواضع؛ أحدها، إذا التقى الزحفان، وتقابل الصفان؛ حرم على من حضر الانصراف، وتعين عليه المقام... الثاني، إذا نزل الكفار ببلد، تعين على أهله قتالهم ودفعهم. الثالث إذا استنفر الإمام قوما لزمهم النفير معه. -المغني: 9/197
‘তিনটি অবস্থায় জিহাদ ফরজে আঈন হয়ে পড়ে, এক. যখন দুটি দল (মুসলিম বাহিনী ও কাফের বাহিনী) মুখোমুখি হয়া; তখন উপস্থিত কারো জন্য পালায়ন করা জায়েয নেই; বরং প্রত্যেকের উপর অটল থাকা ফরজে আঈন। দুই. যখন কাফেররা কোন মুসলিম ভূখণ্ডে প্রবেশ করে; তখন ঐ ভূখণ্ডবাসীর উপর প্রতিরোধ গড়ে তোলা ফরজে আঈন। তিন. যখন ইমাম কোন কওম কে জিহাদের আহ্বান জানাবে তখন ঐ কওমের উপর ইমামের সাথে জিহাদে যাওয়া ফরজে আঈন হয়ে যাবে।’ -আল মুগনী: ৯/১৯৭ বর্তমানে আমাদের উপর জিহাদের হুকুম কি
উপরোক্ত আলোচনা থেকে দিবালোকের ন্যায় পরিস্কার, বর্তমান বিশ্বে নাফিরে আমের অবস্থা বিদ্যমান। কারণ আপনি এমন কোন মুসলিম দেশ খুঁজে পাবেন না যারা আক্রান্ত নয়। হয়ত সরাসরি নিজে আক্রমণ বা আক্রমণের হুমকির স্বীকার; নয়ত তার পার্শ্ববর্তী মুসলিম দেশ। তাছাড়া কত মুসলিম বন্দির জীবন কাফেরদের বন্দিশালায় ধুকে ধুকে নিঃশেষ হচ্ছে তার তো কোনো ইয়ত্তাই নেই। এক আফিয়া সিদ্দিকীর ব্যাপারে জিজ্ঞেসিত হলে আমরা আল্লাহর দরবারে কী উত্তর দিব! অথচ আজ আমরা অলসতা ও অবহেলায় লিপ্ত। বিপরীতে যারা প্রতিরোধের চেষ্টা করছেন তাগুতী শক্তির মোকাবেলায় তারা খুবই সল্প। তাহলে বলুন কেন আমাদের উপর জিহাদ ফরজে আঈন হবে না! যেখানে আমরা বার বার ভেতরের তাগুতী শক্তির আক্রমণের স্বীকার হচ্ছি পাশাপাশি ভারতের অবশ্যম্ভাবী আক্রমণের হুমকী নিয়ে প্রতিটা মূহুর্ত কাটাচ্ছি!!
হ্যাঁ বাংলার কর্ণদাররা হয়ত বলবেন, আমাদের শক্তি নেই, অস্ত্র নেই, আমরা সক্ষম নয়; তাই আমাদের উপর ফরজ নয়!
এই বিষয়টির উপরই প্রস্তুত হবে আমাদের চতুর্থ দারস ‘কাদের উপর জিহাদ ফরজ ও কাদের উপর ফরজ নয়’। ইনশাআল্লাহুল আযীয।
وآخر دعوانا أن الحمد لله رب البعالمين.
Comment