জিহাদের শাব্দিক অর্থ:
জিহাদ শব্দটি جهد থেকে নির্গত, যার মূল অর্থ হচ্ছে কষ্ট। তা থেকে চেষ্টা ও সামর্থ অর্থেও ব্যবহৃত হয়। কেননা চেষ্টা করা ও সামর্থ ব্যয়ে কষ্ট করতে হয়। -মাকায়ীসুল লুগাহ: ১/৪৮৬ (দারুল ফিকর); তাহযীবুল লুগাহ: ৬/২৬ (দারু ইহয়াইত তুরাসিল আরবী); তিলবাতুত তালাবাহ: পৃ: ২৫ (মাকতাবাতুল মুসান্না)
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন,
“এবং (মুনাফিকরা তাদেরকেও দোষারূপ করে) যারা তাদের কষ্টে অর্জিত সম্পদ ছাড়া আর কিছুই পায় না।” –সূরা তাওবা: ৭৯; তাহযীবুল লুগাহ: ৬/২৬(দারু ইহয়াইত তুরাসিল আরবী); হেদায়াতুল কুরআন: ৩/৩৩৮ (তাওফীকিয়্যাহ)
অন্যত্র এরশাদ করেন,
“আর যদি তারা (মাতাপিতা) তোমাকে জোর করে যেন তুমি আমার সাথে এমন বস্তুর শরিক করো, যার কোনো দলীল তোমার কাছে নেই, তাহলে তাদের কথা মানবে না।” –সূরা আনকাবূত: ৮; বয়ানুল কুরআন: ৩/১০৪ (যাকারিয়া)
কবী শাম্মাখ তাঁর উটনীর প্রশংসা করে বলেন,
ভোরবেলা উটনীর স্তন সুস্বাধু ও মিষ্টি দুধে ভরে যায়; যা (আধিক্যের কারণে) দোহন করতে কষ্ট হয় না। -দিওয়ানুশ শাম্মাখ: ১১৭; কিতাবুল আইন: ১/১৫২ (দারুল হিলাল); তাহযীবুল লুগাহ: ৬/২৬ (দারু ইহয়াইত তুরাসিল আরবী)
আর جهاد শব্দটি আরবী ‘বাবে মুফাআলাহ’-এর ক্রিয়ামূল (مصدر)। আর বাবে মুফাআলার বৈশিষ্ট হচ্ছে, এতে সাধারণত দুই পক্ষের অংশগ্রহণ বোঝানো হয়। সুতরাং জিহাদ শব্দের অর্থ দাঁড়াবে, দুই পক্ষ মিলে একে অপরের বিপক্ষে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা এবং কষ্ট সহ্য করা। -ইরশাদুস সারী: ৫/৩১ (আমীরিয়্যাহ)
শরীয়তের পারিভাষায় জিহাদ:
এ গেল জিহাদের শাব্দিক অর্থ। জিহাদের পারিভাষিক সংজ্ঞা স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি হাদীসে দিয়েছেন।
মুসনাদে আহমাদের এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,
“আমর বিন আবাসা রাদি. থেকে বর্ণিত, জনৈক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করেন— হে আল্লাহর রাসূল, জিহাদ কী? রাসূল বলেন, কাফেরদের মুখোমুখি হলে তাদের বিরুদ্ধে কিতাল করা।” -মুসনাদে আহমাদ: ১৭০২৭; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক: ২০১০৭; শুআবুল ঈমান: ২২। হাইসামী ও মুনযিরী রহ. এর মতে হাদীসটি সহীহ।
উক্ত হাদীস থেকে বুঝে আসে, পরিভাষায় কেবল সশস্ত্র যুদ্ধকেই জিহাদ বলে। তবে সশস্ত্র যুদ্ধ যেহেতু জান ও মাল— উভয়টির সম্মিলিত ব্যবহারকেই বুঝায়, তাই মাল দ্বারা যুদ্ধ করাও (دلالة النص) হাদীসে উল্লেখিত জিহাদের অন্তর্ভুক্ত হবে।
তদ্রূপ জিহাদ পরিপূর্ণ ও কার্যকর হওয়ার জন্য জিহাদের প্রাথমিক প্রস্তুতি অপরিহার্য। উক্ত প্রস্তুতি ছাড়া ময়দানের জিহাদ সম্ভব নয়। তাই আবশ্যকীয় হিসেবে প্রাথমিক প্রস্তুতিও (اقتضاء النص) পরোক্ষভাবে জিহাদের অন্তর্ভুক্ত হবে।
ফিকহের স্বতশিদ্ধ একটি মূলনীতি হচ্ছে,
“যে কাজ ছাড়া ওয়াজিব বিধান পরিপূর্ণ হয় না, উক্ত কাজও ওয়াজিব।” -আল-বাহরুর রায়েক: ১/৬৪ (ইলমিয়্যাহ); আয-যাখীরাহ: ১০/২৩ (দারুল গারবিল ইসলামী); আল-মাজমূ’: ১/১২৪ (মাজমাউল মালিক ফাহাদ); আল-মুগনী: ২/২২০ (মাকতাবুল কাহেরা)
সারকথা, জিহাদের পারিভাষিক সংজ্ঞা হবে— আল্লাহর দীন বিজয় করা এবং কুফুরের দাপট খর্ব করার লক্ষ্যে কাফেরদের সাথে জান ও মাল দ্বারা সশস্ত্র যুদ্ধ করা এবং উক্ত যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করা। -জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ আওর এ’তেরাজাত কা ইলমী জায়েযাহ: ৫৯
ফুকাহায়ে কেরাম কর্তৃক জিহাদের সংজ্ঞা থেকে এমনই বুঝে আসে।
ইমাম আবু বাকার কাসানী রহ. (৫৮৭ হি.) বলেন,
“শরীয়তের পরিভাষায় জিহাদ হচ্ছে, জান, মাল, জিহ্বা বা অন্য যেকোনো উপায়ে আল্লাহ রাস্তায় যুদ্ধ করার জন্য নিজের সামর্থ ও সর্বশক্তি ব্যয় করা।” -বাদায়েউস সানায়ে: ৯/৯৭ (দারুল হাদীস)
মোল্লা আলী কারী রহ. (১০১৪ হি.) বলেন,
“পরিভাষায় জিহাদ হচ্ছে কাফেরদের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ করে অথবা সম্পদ বা মতামত দিয়ে কিংবা জনসংখ্যা বৃদ্ধি করে অথবা অন্য যেকোনো উপায়ে সাহায্য করে চেষ্টা করা।” –মিরকাতুল মাফাতীহ: ৭/৩১৯ (ইলমিয়্যাহ)
আলাউদ্দীন হাসকাফী রহ. (১০৮৮ হি.) বলেন,
“শরীয়তের পরিভাষায় জিহাদ হচ্ছে, দীনে হক (ইসলাম)-এর দাওয়াত দেওয়া এবং প্রত্যাখ্যানকারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। উক্ত সংজ্ঞা শুমুন্নী রহ. করেছেন। ইবনে কামাল রহ. জিহাদের সংজ্ঞা দিয়েছেন, আল্লাহর পথে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে অথবা সম্পদ বা মতামত দিয়ে কিংবা জনসংখ্যা বৃদ্ধি করে অথবা অন্য কোনভাবে সহায়তা করে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা।”
ইবনে আবেদীন শামী রহ. (১২৫২ হি.) উক্ত সংজ্ঞার টিকায় বলেন,
“গ্রন্থকারের কথা: ‘আর প্রত্যাখ্যানকারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা’: অর্থাৎ প্রত্যাখ্যানকারীর বিরুদ্ধে সরাসরি বা অন্য যেকোনো ভাবে যুদ্ধ করা। সুতরাং ইবনে কামাল রহ. এর সংজ্ঞা উক্ত সংজ্ঞার তাফসীল ও বিশ্লেষণ। -হালাবী
গ্রন্থকারের কথা: ‘যুদ্ধে’: অর্থাৎ যুদ্ধের সকল উপকরণ ও প্রকারভেদ এর অন্তর্ভুক্ত। যেমন আঘাত করা, ধ্বংস করা, পুড়ানো, গাছ-গাছালি কাটা ইত্যাদি।
গ্রন্থকারের কথা: ‘সহায়তা করে’: অর্থাৎ যদিও সে মুজাহিদ দলের সাথে সরাসরি জিহাদে বের হয়নি। -তাহতাবী
গ্রন্থকারের কথা: ‘জনসংখ্যা বৃদ্ধি করে’: (কিতাবে সংখ্যা বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত) ‘সাওয়াদ’ অর্থ হচ্ছে অনেক লোক। আর ‘সাওয়াদুল মুসলিমীন’ অর্থ হচ্ছে মুসলিমদের জামাআত। -মিসবাহ
গ্রন্থকারের কথা: ‘কিংবা অন্য কোনভাবে’: যেমন অসুস্থদের চিকিৎসা করা, (মুজাহিদদের) খানাপিনা প্রস্তুত করা। -তাহতাবী”। -রদ্দুল মুহতার আলাদ্দুররিল মুখতার: ৪/১২১ (দারুল ফিকর)
উক্ত সংজ্ঞা অনুযায়ী ময়দানের সশস্ত্র যুদ্ধ এবং যুদ্ধের প্রয়োজনীয় সকল কার্যক্রম, যেমন ময়দানের আগের প্রস্তুতি, জিহাদের প্রতি দাওয়াত, সৈন্য তৈরী, মাল ও অস্ত্র জোগাড়, যুদ্ধের পন্থা ও পদ্ধতি নির্ধারণ, জিহাদ ও মুজাহিদদের সংবাদ প্রচার, জিহাদের উপর উত্থাপিত আপত্তির জবাব ও সংশয় নিরসন ইত্যাদি জিহাদের অন্তর্ভু্ক্ত হবে।
তবে উপর্যুক্ত কার্যক্রম জিহাদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হচ্ছে, তা মূল যুদ্ধের প্রয়োজনে হতে হবে। অন্যথায় মূল যুদ্ধের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়, এমন কার্যক্রম জিহাদের অন্তর্ভুক্ত হবে না।
উল্লেখ্য, কোন কাজ মূল যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয়, তা সাধারণ জনগণের জন্য নির্ণয় করা অসম্ভব না হলেও মুশকিল বটে। তদ্রূপ কোন কাজে কতটুকু গুরুত্ব, শ্রম ও সময় দেওয়া প্রয়োজন, তাও ব্যক্তিগতভাবে নির্ণয় করা অনেকাংশে মুশকিল। তাই নিরাপদ হচ্ছে, কোনো জিহাদি তানজীম অথবা শরয়ী ও আধুনিক জিহাদ বিষয়ে বিজ্ঞ ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করা। অবশ্য ব্যক্তিগত উদ্যোগে সশস্ত্র যুদ্ধ অথবা যুদ্ধের প্রয়োজনীয় কাজ আঞ্জাম দেওয়ার মাধ্যমেও জিহাদের ফরযিয়াত আদায় হবে।
সুতরাং হাদীসে শুধু সশস্ত্র যুদ্ধ দ্বারা জিহাদকে সংজ্ঞায়িত করার কারণ হচ্ছে, সশস্ত্র যুদ্ধ জিহাদের চূড়ান্ত রূপ এবং সর্বোচ্চ স্তর।
জিহাদের সংজ্ঞা থেকে যা বুঝে আসে:
জিহাদের উক্ত সংজ্ঞা থেকে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট হলো—
এক. শাব্দিক অর্থে জিহাদ শব্দটি যতটি ব্যাপক; পারিভাষিক অর্থে ততটা ব্যাপক নয়। বরং জিহাদের পরিধি অনেক সঙ্কীর্ণ হয়ে এসেছে।
দুই. জিহাদ শব্দটি কেবল আল্লাহর রাস্তায় এবং দীন বিজয় করার লক্ষ্যে যুদ্ধকে বুঝায়। তাগুতের রাস্তায় এবং কুফুর প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে যুদ্ধকে জিহাদ বলা যাবে না। তদ্রূপ আঞ্চলিক গোত্রপ্রীতি, আত্মীয়প্রীতি বা দুনিয়াবি স্বার্থে যুদ্ধকেও জিহাদ বলা যাবে না।
তিন. দীন বিজয়ের লক্ষ্যে সশস্ত্র যুদ্ধ বহির্ভূত এবং যুদ্ধের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়, এমন কোনো কাজ জিহাদ বলে গণ্য হবে না; যদিও এর মাধ্যমে কুফুরের খণ্ডন ও ইসলামের বিজয় সাধিত হয়। এমন কাজের মাধ্যমে জিহাদের ফরযিয়াতও আদায় হবে না। হ্যাঁ, উক্ত কাজের গুরোত্ব ও মহাত্ব আপন জায়গায় স্বীকৃত এবং তা ক্ষেত্রবিশেষ জিহাদের চেয়ে বেশি গুরোত্বপূর্ণ হতে পারে।
চার. শরয়ী পরিভাষায় জিহাদ হওয়ার জন্য অপরপক্ষ কাফের হওয়া শর্ত কি না; ফলশ্রুতিতে মুসলিম বাগী, ডাকাতদল ইত্যাদির বিরুদ্ধে যুদ্ধকে জিহাদ বলা যাবে কি না— এ ব্যাপারে ফুকাহায়ে কেরামের মাঝে মতভেদ রয়েছে। কারো মতে শরয়ী জিহাদ হওয়ার জন্য অপরপক্ষ কাফের হওয়া শর্ত; বিপরিতে কারো মতে শর্ত নয়। তবে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই। সুতরাং পরিভাষাগত পার্থক্য ছাড়া মতভেদের তেমন কোনো ফলাফল নেই।
পারিভাষিক সংজ্ঞা নিয়ে কিছু কথা;
এক. শাব্দিক ও পারিভাষিক অর্থ এক নয়। শব্দ গঠনের সময় যে অর্থ বুঝানোর উদ্ধেশ্যে শব্দটি গঠন করা হয়, তা হচ্ছে শাব্দিক ও আক্ষরিক অর্থ। পরবর্তীতে উক্ত শব্দ যদি বিশেষ কোনো সমাজ, শাস্ত্র বা বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো অর্থে ব্যবহৃত হয়, তাহলে তা হবে পারিভাষিক অর্থ। যেমন, শরীয়তের পরিভাষা; ফিকহের পরিভাষা; ডাক্তার বিদ্যার পরিভাষা; ব্যবসায়ীদের পরিভাষা; বাগান এলাকার পরিভাষা; কৃষকদের পরিভাষা ইত্যাদি। সমাজ, শাস্ত্র ও বিষয়ের ভিন্নতার কারণে পারিভাষিক অর্থেও ভিন্নতা আসতে পারে।
আমাদের আলোচনায় মৌলিকভাবে শরয়ী পরিভাষা উদ্ধেশ্য এবং এটিই এখানে মূখ্য বিষয়। তবে হ্যাঁ, একটি শব্দ শরয়ী পরিভাষা, ফিকহের পরিভাষা এবং অন্যান্য পরিভাষায়ও একই অর্থে ব্যবহৃত হতে পারে।
দুই. কোনো শব্দের শরীয়ত কর্তৃক পারিভাষিক অর্থ থাকলে, শরীয়তের নুসূসে যেখানেই শব্দটি ব্যবহৃত হবে, শাব্দিক অর্থ গ্রহণ না করে তার পারিভাষিক অর্থ গ্রহণ করতে হবে।
তবে এ কথা সত্য, শরীয়তে কোনো শব্দের বিশেষ পরিভাষিক অর্থ থাকা সত্বেও কোনো কোনো সময় শাব্দিক অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তবে এ অজুহাতে সকল জায়গায় অথবা যেখানে-সেখানে শাব্দিক অর্থ নেওয়ার সুযোগ নেই। অন্যথায় সালাত, যাকাত, সিয়াম, হজ; এমনকি পুরো শরীয়তের কোনো হাকীকত থাকবে না।
তাই মূলনীতি হচ্ছে, কোনো শব্দের পারিভাষিক অর্থ থাকলে মৌলিকভাবে পারিভাষিক অর্থই গ্রহণ করতে হবে। তবে শব্দের পূর্বাপর এবং অন্যান্য আলামত ও লক্ষণ দ্বারা যদি শাব্দিক অর্থে ব্যবহৃত হওয়া প্রমাণীত হয়, তাহলে শাব্দিক অর্থ গ্রহণ করা হবে। -কিতাবুত তাহরীর: পৃ: ১৬৪ (মুস্তাফা বাবী); নিহায়াতুল উসূল: ২/৩৭৫ (তিজারিয়া)
উদাহরণ স্বরূপ ‘সালাত’ শব্দের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে দুআ করা। শরীয়তে উক্ত শব্দ বিশেষ এক পরিভাষায় ব্যবহৃত হয়েছে। তাই কুরআন ও হাদীসের নুসূসে সালাত শব্দ ব্যবহৃত হলে পারিভাষিক অর্থ নেওয়া হবে; তার শাব্দিক অর্থ নয়।
তবে ‘সালাত’ শব্দটি কুরআন ও হাদীসে কোথাও কোথাও শাব্দিক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে; যা বাক্যের অবস্থা, ধরন ও বিভিন্ন আলামত থেকে স্পষ্ট বুঝে আসে। তবে এ অজুহাতে যতেচ্ছা শব্দের শাব্দিক অর্থ নেওয়া যাবে না।
তদ্রূপ জিহাদ শব্দটিও শরীয়তে নির্দিষ্ট একটি পরিভাষায় ব্যবহৃত হয়েছে। তবে কুরআন ও হাদীসের কিছু জায়গায় জিহাদ শব্দ তার আক্ষরিক অর্থেও ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু উক্ত অজুহাতে যতেচ্ছা শাব্দিক অর্থে ব্যবহার করার কোনো সুযোগ নেই।[1]
[1] এক্ষেত্রে কেউ কেউ একটি মূলনীতি বলেছেন, যেখানে জিহাদ শব্দটি কোন বন্ধন (صلة) ছাড়া ব্যবহৃত হবে অথবা জিহাদের সাথে ‘ফিল্লাহ বা আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তকারী কোন সর্বনাম (ضمير) সহ ব্যবহৃত হবে, সেখানে জিহাদ তার শাব্দিক অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আর যেখানে জিহাদ শব্দটি ‘ফি সাবিলিল্লাহ’র বন্ধনের (صلة) সাথে ব্যবহৃত হবে, সেখানে পারিভাষিক অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকবে। [তুহফাতুল কারী: ৬/১৮৯] তবে এটি সিদ্ধান্তমূলক কোনো কথা নয়। এর ব্যতিক্রমও হতে পারে।
জিহাদ শব্দটি جهد থেকে নির্গত, যার মূল অর্থ হচ্ছে কষ্ট। তা থেকে চেষ্টা ও সামর্থ অর্থেও ব্যবহৃত হয়। কেননা চেষ্টা করা ও সামর্থ ব্যয়ে কষ্ট করতে হয়। -মাকায়ীসুল লুগাহ: ১/৪৮৬ (দারুল ফিকর); তাহযীবুল লুগাহ: ৬/২৬ (দারু ইহয়াইত তুরাসিল আরবী); তিলবাতুত তালাবাহ: পৃ: ২৫ (মাকতাবাতুল মুসান্না)
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন,
وَالَّذِينَ لَا يَجِدُونَ إِلَّا جُهْدَهُمْ -سورة التوبة: 79
“এবং (মুনাফিকরা তাদেরকেও দোষারূপ করে) যারা তাদের কষ্টে অর্জিত সম্পদ ছাড়া আর কিছুই পায় না।” –সূরা তাওবা: ৭৯; তাহযীবুল লুগাহ: ৬/২৬(দারু ইহয়াইত তুরাসিল আরবী); হেদায়াতুল কুরআন: ৩/৩৩৮ (তাওফীকিয়্যাহ)
অন্যত্র এরশাদ করেন,
وَإِنْ جَاهَدَاكَ لِتُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا -سورة العنكبوت: 8
“আর যদি তারা (মাতাপিতা) তোমাকে জোর করে যেন তুমি আমার সাথে এমন বস্তুর শরিক করো, যার কোনো দলীল তোমার কাছে নেই, তাহলে তাদের কথা মানবে না।” –সূরা আনকাবূত: ৮; বয়ানুল কুরআন: ৩/১০৪ (যাকারিয়া)
কবী শাম্মাখ তাঁর উটনীর প্রশংসা করে বলেন,
تصبحْ وقد ضمنتْ ضراتها عرقاً ** مِنْ طَيِّب الطَّعْمِ حُلواً غيرَ مَجْهودِ
ভোরবেলা উটনীর স্তন সুস্বাধু ও মিষ্টি দুধে ভরে যায়; যা (আধিক্যের কারণে) দোহন করতে কষ্ট হয় না। -দিওয়ানুশ শাম্মাখ: ১১৭; কিতাবুল আইন: ১/১৫২ (দারুল হিলাল); তাহযীবুল লুগাহ: ৬/২৬ (দারু ইহয়াইত তুরাসিল আরবী)
আর جهاد শব্দটি আরবী ‘বাবে মুফাআলাহ’-এর ক্রিয়ামূল (مصدر)। আর বাবে মুফাআলার বৈশিষ্ট হচ্ছে, এতে সাধারণত দুই পক্ষের অংশগ্রহণ বোঝানো হয়। সুতরাং জিহাদ শব্দের অর্থ দাঁড়াবে, দুই পক্ষ মিলে একে অপরের বিপক্ষে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা এবং কষ্ট সহ্য করা। -ইরশাদুস সারী: ৫/৩১ (আমীরিয়্যাহ)
শরীয়তের পারিভাষায় জিহাদ:
এ গেল জিহাদের শাব্দিক অর্থ। জিহাদের পারিভাষিক সংজ্ঞা স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি হাদীসে দিয়েছেন।
মুসনাদে আহমাদের এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,
عَنْ عَمْرِو بْنِ عَبَسَةَ، قَالَ: قَالَ رَجُلٌ: يَا رَسُولَ اللهِ ... وَمَا الْجِهَادُ؟ قَالَ: "أَنْ تُقَاتِلَ الْكُفَّارَ إِذَا لَقِيتَهُمْ". –رواه أحمد (17027) وعبد الرزاق (20107) والبيهقي في شعب الإيمان (22). وقال الهيثمي رحمه الله في مجمع الزوائد (3/ 207): رواه أحمد والطبراني، ورجاله رجال الصحيح.اهــــ وقال المنذري رحمه الله في الترغيب والترهيب (2/ 106): رواه أحمد بإسناد صحيح، ورواته محتج بهم في الصحيح.اهــــ
“আমর বিন আবাসা রাদি. থেকে বর্ণিত, জনৈক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করেন— হে আল্লাহর রাসূল, জিহাদ কী? রাসূল বলেন, কাফেরদের মুখোমুখি হলে তাদের বিরুদ্ধে কিতাল করা।” -মুসনাদে আহমাদ: ১৭০২৭; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক: ২০১০৭; শুআবুল ঈমান: ২২। হাইসামী ও মুনযিরী রহ. এর মতে হাদীসটি সহীহ।
উক্ত হাদীস থেকে বুঝে আসে, পরিভাষায় কেবল সশস্ত্র যুদ্ধকেই জিহাদ বলে। তবে সশস্ত্র যুদ্ধ যেহেতু জান ও মাল— উভয়টির সম্মিলিত ব্যবহারকেই বুঝায়, তাই মাল দ্বারা যুদ্ধ করাও (دلالة النص) হাদীসে উল্লেখিত জিহাদের অন্তর্ভুক্ত হবে।
তদ্রূপ জিহাদ পরিপূর্ণ ও কার্যকর হওয়ার জন্য জিহাদের প্রাথমিক প্রস্তুতি অপরিহার্য। উক্ত প্রস্তুতি ছাড়া ময়দানের জিহাদ সম্ভব নয়। তাই আবশ্যকীয় হিসেবে প্রাথমিক প্রস্তুতিও (اقتضاء النص) পরোক্ষভাবে জিহাদের অন্তর্ভুক্ত হবে।
ফিকহের স্বতশিদ্ধ একটি মূলনীতি হচ্ছে,
وما لا يت
م الواجب إلا به فهو واجب
“যে কাজ ছাড়া ওয়াজিব বিধান পরিপূর্ণ হয় না, উক্ত কাজও ওয়াজিব।” -আল-বাহরুর রায়েক: ১/৬৪ (ইলমিয়্যাহ); আয-যাখীরাহ: ১০/২৩ (দারুল গারবিল ইসলামী); আল-মাজমূ’: ১/১২৪ (মাজমাউল মালিক ফাহাদ); আল-মুগনী: ২/২২০ (মাকতাবুল কাহেরা)
সারকথা, জিহাদের পারিভাষিক সংজ্ঞা হবে— আল্লাহর দীন বিজয় করা এবং কুফুরের দাপট খর্ব করার লক্ষ্যে কাফেরদের সাথে জান ও মাল দ্বারা সশস্ত্র যুদ্ধ করা এবং উক্ত যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করা। -জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ আওর এ’তেরাজাত কা ইলমী জায়েযাহ: ৫৯
ফুকাহায়ে কেরাম কর্তৃক জিহাদের সংজ্ঞা থেকে এমনই বুঝে আসে।
ইমাম আবু বাকার কাসানী রহ. (৫৮৭ হি.) বলেন,
الجهاد ... في عرف الشرع يستعمل في بذل الوسع والطاقة بالقتال في سبيل الله عز وجل بالنفس والمال واللسان، أو غير ذلك.اهــــ
“শরীয়তের পরিভাষায় জিহাদ হচ্ছে, জান, মাল, জিহ্বা বা অন্য যেকোনো উপায়ে আল্লাহ রাস্তায় যুদ্ধ করার জন্য নিজের সামর্থ ও সর্বশক্তি ব্যয় করা।” -বাদায়েউস সানায়ে: ৯/৯৭ (দারুল হাদীস)
মোল্লা আলী কারী রহ. (১০১৪ হি.) বলেন,
الجهاد ... شرعا بذل المجهود في قتال الكفار مباشرة، أو معاونة بالمال أو بالرأي أو بتكثير السواد أو غير ذلك.اهــــ -مرقاة المفاتيح (7/ 319)
“পরিভাষায় জিহাদ হচ্ছে কাফেরদের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ করে অথবা সম্পদ বা মতামত দিয়ে কিংবা জনসংখ্যা বৃদ্ধি করে অথবা অন্য যেকোনো উপায়ে সাহায্য করে চেষ্টা করা।” –মিরকাতুল মাফাতীহ: ৭/৩১৯ (ইলমিয়্যাহ)
আলাউদ্দীন হাসকাফী রহ. (১০৮৮ হি.) বলেন,
وشرعا: الدعاء إلى الدين الحق وقتال من لم يقبله شمني. وعرفه ابن الكمال بأنه بذل الوسع في القتال في سبيل الله مباشرة أو معاونة بمال، أو رأي أو تكثير سواد أو غير ذلك. اهـ.
“শরীয়তের পরিভাষায় জিহাদ হচ্ছে, দীনে হক (ইসলাম)-এর দাওয়াত দেওয়া এবং প্রত্যাখ্যানকারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। উক্ত সংজ্ঞা শুমুন্নী রহ. করেছেন। ইবনে কামাল রহ. জিহাদের সংজ্ঞা দিয়েছেন, আল্লাহর পথে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে অথবা সম্পদ বা মতামত দিয়ে কিংবা জনসংখ্যা বৃদ্ধি করে অথবা অন্য কোনভাবে সহায়তা করে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা।”
ইবনে আবেদীন শামী রহ. (১২৫২ হি.) উক্ত সংজ্ঞার টিকায় বলেন,
قوله وقتال من لم يقبله) أي قتاله مباشرة أو لا فتعريف ابن كمال تفصيل لإجمال هذا ح. (قوله في القتال) أي في أسبابه وأنواعه من ضرب وهدم وحرق وقطع أشجار ونحو ذلك. (قوله أو معاونة إلخ) أي وإن لم يخرج معهم بدليل العطف ط. (قوله أو تكثير سواد) السواد العدد الكثير وسواد المسلمين جماعتهم مصباح. (قوله أو غير ذلك) كمداواة الجرحى وتهيئة المطاعم والمشار ط
“গ্রন্থকারের কথা: ‘আর প্রত্যাখ্যানকারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা’: অর্থাৎ প্রত্যাখ্যানকারীর বিরুদ্ধে সরাসরি বা অন্য যেকোনো ভাবে যুদ্ধ করা। সুতরাং ইবনে কামাল রহ. এর সংজ্ঞা উক্ত সংজ্ঞার তাফসীল ও বিশ্লেষণ। -হালাবী
গ্রন্থকারের কথা: ‘যুদ্ধে’: অর্থাৎ যুদ্ধের সকল উপকরণ ও প্রকারভেদ এর অন্তর্ভুক্ত। যেমন আঘাত করা, ধ্বংস করা, পুড়ানো, গাছ-গাছালি কাটা ইত্যাদি।
গ্রন্থকারের কথা: ‘সহায়তা করে’: অর্থাৎ যদিও সে মুজাহিদ দলের সাথে সরাসরি জিহাদে বের হয়নি। -তাহতাবী
গ্রন্থকারের কথা: ‘জনসংখ্যা বৃদ্ধি করে’: (কিতাবে সংখ্যা বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত) ‘সাওয়াদ’ অর্থ হচ্ছে অনেক লোক। আর ‘সাওয়াদুল মুসলিমীন’ অর্থ হচ্ছে মুসলিমদের জামাআত। -মিসবাহ
গ্রন্থকারের কথা: ‘কিংবা অন্য কোনভাবে’: যেমন অসুস্থদের চিকিৎসা করা, (মুজাহিদদের) খানাপিনা প্রস্তুত করা। -তাহতাবী”। -রদ্দুল মুহতার আলাদ্দুররিল মুখতার: ৪/১২১ (দারুল ফিকর)
উক্ত সংজ্ঞা অনুযায়ী ময়দানের সশস্ত্র যুদ্ধ এবং যুদ্ধের প্রয়োজনীয় সকল কার্যক্রম, যেমন ময়দানের আগের প্রস্তুতি, জিহাদের প্রতি দাওয়াত, সৈন্য তৈরী, মাল ও অস্ত্র জোগাড়, যুদ্ধের পন্থা ও পদ্ধতি নির্ধারণ, জিহাদ ও মুজাহিদদের সংবাদ প্রচার, জিহাদের উপর উত্থাপিত আপত্তির জবাব ও সংশয় নিরসন ইত্যাদি জিহাদের অন্তর্ভু্ক্ত হবে।
তবে উপর্যুক্ত কার্যক্রম জিহাদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হচ্ছে, তা মূল যুদ্ধের প্রয়োজনে হতে হবে। অন্যথায় মূল যুদ্ধের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়, এমন কার্যক্রম জিহাদের অন্তর্ভুক্ত হবে না।
উল্লেখ্য, কোন কাজ মূল যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয়, তা সাধারণ জনগণের জন্য নির্ণয় করা অসম্ভব না হলেও মুশকিল বটে। তদ্রূপ কোন কাজে কতটুকু গুরুত্ব, শ্রম ও সময় দেওয়া প্রয়োজন, তাও ব্যক্তিগতভাবে নির্ণয় করা অনেকাংশে মুশকিল। তাই নিরাপদ হচ্ছে, কোনো জিহাদি তানজীম অথবা শরয়ী ও আধুনিক জিহাদ বিষয়ে বিজ্ঞ ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করা। অবশ্য ব্যক্তিগত উদ্যোগে সশস্ত্র যুদ্ধ অথবা যুদ্ধের প্রয়োজনীয় কাজ আঞ্জাম দেওয়ার মাধ্যমেও জিহাদের ফরযিয়াত আদায় হবে।
সুতরাং হাদীসে শুধু সশস্ত্র যুদ্ধ দ্বারা জিহাদকে সংজ্ঞায়িত করার কারণ হচ্ছে, সশস্ত্র যুদ্ধ জিহাদের চূড়ান্ত রূপ এবং সর্বোচ্চ স্তর।
জিহাদের সংজ্ঞা থেকে যা বুঝে আসে:
জিহাদের উক্ত সংজ্ঞা থেকে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট হলো—
এক. শাব্দিক অর্থে জিহাদ শব্দটি যতটি ব্যাপক; পারিভাষিক অর্থে ততটা ব্যাপক নয়। বরং জিহাদের পরিধি অনেক সঙ্কীর্ণ হয়ে এসেছে।
দুই. জিহাদ শব্দটি কেবল আল্লাহর রাস্তায় এবং দীন বিজয় করার লক্ষ্যে যুদ্ধকে বুঝায়। তাগুতের রাস্তায় এবং কুফুর প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে যুদ্ধকে জিহাদ বলা যাবে না। তদ্রূপ আঞ্চলিক গোত্রপ্রীতি, আত্মীয়প্রীতি বা দুনিয়াবি স্বার্থে যুদ্ধকেও জিহাদ বলা যাবে না।
তিন. দীন বিজয়ের লক্ষ্যে সশস্ত্র যুদ্ধ বহির্ভূত এবং যুদ্ধের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়, এমন কোনো কাজ জিহাদ বলে গণ্য হবে না; যদিও এর মাধ্যমে কুফুরের খণ্ডন ও ইসলামের বিজয় সাধিত হয়। এমন কাজের মাধ্যমে জিহাদের ফরযিয়াতও আদায় হবে না। হ্যাঁ, উক্ত কাজের গুরোত্ব ও মহাত্ব আপন জায়গায় স্বীকৃত এবং তা ক্ষেত্রবিশেষ জিহাদের চেয়ে বেশি গুরোত্বপূর্ণ হতে পারে।
চার. শরয়ী পরিভাষায় জিহাদ হওয়ার জন্য অপরপক্ষ কাফের হওয়া শর্ত কি না; ফলশ্রুতিতে মুসলিম বাগী, ডাকাতদল ইত্যাদির বিরুদ্ধে যুদ্ধকে জিহাদ বলা যাবে কি না— এ ব্যাপারে ফুকাহায়ে কেরামের মাঝে মতভেদ রয়েছে। কারো মতে শরয়ী জিহাদ হওয়ার জন্য অপরপক্ষ কাফের হওয়া শর্ত; বিপরিতে কারো মতে শর্ত নয়। তবে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই। সুতরাং পরিভাষাগত পার্থক্য ছাড়া মতভেদের তেমন কোনো ফলাফল নেই।
পারিভাষিক সংজ্ঞা নিয়ে কিছু কথা;
এক. শাব্দিক ও পারিভাষিক অর্থ এক নয়। শব্দ গঠনের সময় যে অর্থ বুঝানোর উদ্ধেশ্যে শব্দটি গঠন করা হয়, তা হচ্ছে শাব্দিক ও আক্ষরিক অর্থ। পরবর্তীতে উক্ত শব্দ যদি বিশেষ কোনো সমাজ, শাস্ত্র বা বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো অর্থে ব্যবহৃত হয়, তাহলে তা হবে পারিভাষিক অর্থ। যেমন, শরীয়তের পরিভাষা; ফিকহের পরিভাষা; ডাক্তার বিদ্যার পরিভাষা; ব্যবসায়ীদের পরিভাষা; বাগান এলাকার পরিভাষা; কৃষকদের পরিভাষা ইত্যাদি। সমাজ, শাস্ত্র ও বিষয়ের ভিন্নতার কারণে পারিভাষিক অর্থেও ভিন্নতা আসতে পারে।
আমাদের আলোচনায় মৌলিকভাবে শরয়ী পরিভাষা উদ্ধেশ্য এবং এটিই এখানে মূখ্য বিষয়। তবে হ্যাঁ, একটি শব্দ শরয়ী পরিভাষা, ফিকহের পরিভাষা এবং অন্যান্য পরিভাষায়ও একই অর্থে ব্যবহৃত হতে পারে।
দুই. কোনো শব্দের শরীয়ত কর্তৃক পারিভাষিক অর্থ থাকলে, শরীয়তের নুসূসে যেখানেই শব্দটি ব্যবহৃত হবে, শাব্দিক অর্থ গ্রহণ না করে তার পারিভাষিক অর্থ গ্রহণ করতে হবে।
তবে এ কথা সত্য, শরীয়তে কোনো শব্দের বিশেষ পরিভাষিক অর্থ থাকা সত্বেও কোনো কোনো সময় শাব্দিক অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তবে এ অজুহাতে সকল জায়গায় অথবা যেখানে-সেখানে শাব্দিক অর্থ নেওয়ার সুযোগ নেই। অন্যথায় সালাত, যাকাত, সিয়াম, হজ; এমনকি পুরো শরীয়তের কোনো হাকীকত থাকবে না।
তাই মূলনীতি হচ্ছে, কোনো শব্দের পারিভাষিক অর্থ থাকলে মৌলিকভাবে পারিভাষিক অর্থই গ্রহণ করতে হবে। তবে শব্দের পূর্বাপর এবং অন্যান্য আলামত ও লক্ষণ দ্বারা যদি শাব্দিক অর্থে ব্যবহৃত হওয়া প্রমাণীত হয়, তাহলে শাব্দিক অর্থ গ্রহণ করা হবে। -কিতাবুত তাহরীর: পৃ: ১৬৪ (মুস্তাফা বাবী); নিহায়াতুল উসূল: ২/৩৭৫ (তিজারিয়া)
উদাহরণ স্বরূপ ‘সালাত’ শব্দের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে দুআ করা। শরীয়তে উক্ত শব্দ বিশেষ এক পরিভাষায় ব্যবহৃত হয়েছে। তাই কুরআন ও হাদীসের নুসূসে সালাত শব্দ ব্যবহৃত হলে পারিভাষিক অর্থ নেওয়া হবে; তার শাব্দিক অর্থ নয়।
তবে ‘সালাত’ শব্দটি কুরআন ও হাদীসে কোথাও কোথাও শাব্দিক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে; যা বাক্যের অবস্থা, ধরন ও বিভিন্ন আলামত থেকে স্পষ্ট বুঝে আসে। তবে এ অজুহাতে যতেচ্ছা শব্দের শাব্দিক অর্থ নেওয়া যাবে না।
তদ্রূপ জিহাদ শব্দটিও শরীয়তে নির্দিষ্ট একটি পরিভাষায় ব্যবহৃত হয়েছে। তবে কুরআন ও হাদীসের কিছু জায়গায় জিহাদ শব্দ তার আক্ষরিক অর্থেও ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু উক্ত অজুহাতে যতেচ্ছা শাব্দিক অর্থে ব্যবহার করার কোনো সুযোগ নেই।[1]
[1] এক্ষেত্রে কেউ কেউ একটি মূলনীতি বলেছেন, যেখানে জিহাদ শব্দটি কোন বন্ধন (صلة) ছাড়া ব্যবহৃত হবে অথবা জিহাদের সাথে ‘ফিল্লাহ বা আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তকারী কোন সর্বনাম (ضمير) সহ ব্যবহৃত হবে, সেখানে জিহাদ তার শাব্দিক অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আর যেখানে জিহাদ শব্দটি ‘ফি সাবিলিল্লাহ’র বন্ধনের (صلة) সাথে ব্যবহৃত হবে, সেখানে পারিভাষিক অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকবে। [তুহফাতুল কারী: ৬/১৮৯] তবে এটি সিদ্ধান্তমূলক কোনো কথা নয়। এর ব্যতিক্রমও হতে পারে।
Comment