‘ফী সাবীলিল্লাহ’-এর অর্থ:
‘ফী সাবীলিল্লাহ’-এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে, ‘আল্লাহর রাস্তায়’। শরীয়তের পরিভাষায় পূণ্যময় সকল কাজ এর অন্তর্ভুক্ত। তবে মূল অর্থের বিবেচনায় পূণ্যময় সকল কাজ এর অন্তর্ভুক্ত হলেও সাধারণত তা দ্বারা জিহাদ উদ্দেশ্য হয়ে থাকে এবং তা জিহাদ অর্থেই বেশি প্রশিদ্ধ। সুতরাং ‘ফী সাবীলিল্লাহ’-এর দু’টি অর্থ দাঁড়াবে— মূল অর্থ পূণ্যময় সকল কাজ এবং প্রশিদ্ধ অর্থ জিহাদ।
আর জানা কথা, আহকাম তথা বিধিবিধান সংক্রান্ত নুসূসে সতর্কতা কাম্য; বিপরিতে ফযীলত সংক্রান্ত নুসূসে শিথিলতার অবকাশ রয়েছে। এ কারণে ফুকাহায়ে কেরাম ফযীলত প্রমাণের ক্ষেত্রে যতটুকু শিথিলতা করেন, আহকাম প্রমাণের ক্ষেত্রে ততটুকু করেন না; বরং এক্ষেত্রে কঠোরতা অবলম্ভন করে থাকেন। -মাজমূউল ফাতাওয়া: ২০/২৬১-২৬২
তাই আহকাম সংক্রান্ত নুসূসের ক্ষেত্রে সতর্কতাস্বরূপ ‘ফী সাবীলিল্লাহ’ কেবল জিহাদ অর্থে প্রয়োগ হবে। আর ফযীলত সংক্রান্ত নুসূসে তা আল্লাহর রহমতের প্রশস্তার প্রতি লক্ষ্য রেখে জিহাদসহ পূণ্যময় সকল কাজের অর্থে প্রয়োগ হবে। যদিও ‘ফী সাবীলিল্লাহ’-এর সর্বোচ্চ প্রয়োগক্ষেত্র জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ।
ফুকাহা ও মুহাদ্দিসীনে কেরামের ‘ফী সাবীলিল্লাহ’-এর প্রয়োগ থেকে এমনই বুঝে আসে।
সহীহ বুখারীর এক হাদীসে এসেছে,
“আবায়া বিন রিফাআ’ রহ. বলেন, আমি জুমআ’র উদ্ধেশ্যে গমনকালে আবু আবস রাদি. আমাকে পেয়ে বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, যার দু’পা আল্লাহর রাস্তায় ধুলোমলিন হবে, আল্লাহ তাকে জাহান্নামের জন্য হারাম করে দেন।” –সহীহ বুখারী: ৯০৭
অন্য বর্ণনায় এসেছে,
“ইয়াযীদ বিন আবু মারয়াম বলেন, আমি জুমআ’র উদ্ধেশ্যে গমনকালে আবায়া বিন রিফাআ’ আমাকে পেয়ে বলেন, সুসংবাদ গ্রহণ করো। কেননা তোমার উক্ত হাঁটা আল্লাহর রাস্তায় (হাঁটা হিসেবে গণ্য হবে)। আমি আবু আবস রাদি.কে বলতে শুনেছি, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলেছেন, যার দু’পা আল্লাহর রাস্তায় ধুলোমলিন হবে, উভয় পা জাহান্নামের জন্য হারাম হয়ে যাবে।” -জামে’ তিরমিযী: ১৬৩২, সুনানে নাসায়ী: ৩১১৬। ইমাম তিরমিযী রহ. হাদীসটি হাসান সহীহ বলেছেন।
উভয় হাদীসের মাঝে সামঞ্জস্য হচ্ছে, ‘আবায়া বিন রিফাআ’ রহ. এর সাথে সাহাবী আবু আবস রাদি. এর উক্ত ঘটনা ঘটে। পরবর্তীতে ‘ইয়াযিদ বিন আবু মারয়াম’ রহ. এর সাথে বর্ণনাকারী ‘আবায়া বিন রিফাআ’ রহ. এর একই ঘটনা ঘটে। -ফাতহুল বারী: ২/৩৯১ (দারুল ফিকর); উমদাতুল কারী: ৬/২০৫ (দারু ইহয়াইত তুরাসিল আরাবী)
সাহাবী আবু আবস ও তাবেয়ী আবায়া বিন রিফাআ উভয়ই ‘ফী সাবীলিল্লাহ’ এর ব্যাপক অর্থ করে জুমআর উদ্ধেশ্যে গমনকে এর অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এবং ইমাম বুখারী রহ.ও উক্ত হাদীস জুমার উদ্ধেশ্যে হেঁটে যাওয়ার ফযীলত অধ্যায়ে বর্ণনা করেছেন। -ফাতহুল বারী: ৬/৩৫ (দারুল ফিকর); ফাইযুল বারী: ৪/১৬২ (ইলমিয়্যাহ); তুহফাতুল আহওয়াযী: ৬/২১৩ (ইলমিয়্যাহ)
উপর্যুক্ত হাদীস ইমাম বুখারী রহ. কিতাবুল জিহাদের ‘যার পা দুটি আল্লাহর রাস্তায় ধুলোমলিন হবে, তা জাহান্নামের জন্য হারাম হয়ে যাবে’— অধ্যায়েও বর্ণনা করেন। উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনে বাত্তাল রহ. (৪৪৯ হি.) বলেন,
“ফী সাবীলিল্লাহ হচ্ছে আল্লাহ তাআলার আনুগত্যের সকল ক্ষেত্র।” -শরহে ইবনে বাত্তাল: ৫/২৬ (মাকতাবাতুর রুশদ)
ইবনে বাত্তাল রহ. এর উক্ত বক্তব্য উল্লেখ করে ইবনে হাজার রহ. (৮৫২ হি.) বলেন,
“তিনি (ইবনে বাত্তাল) বলেন, ‘ফী সাবীলিল্লাহ দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহ তাআলার আনুগত্যের সকল ক্ষেত্র।’ বিষয়টি এমনই। তবে ফী সাবীলিল্লাহ শব্দ সাধারণভাবে ব্যবহার হলে জিহাদ উদ্দেশ্য হয়। গ্রন্থকার (ইমাম বুখারী) ব্যাপক অর্থে ফী সাবীলিল্লাহ (-সন্বলীত হাদীস) ‘জুমআয় হেঁটে যাওয়ার ফযীলত’ অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন।” -ফাতহুল বারী: ৬/৩৫ (দারুল ফিকর)
আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী রহ. (১৩৫২ হি.) বলেন,
“গ্রন্থকার (ইমাম বুখারী) ফী সাবীলিল্লাহ শব্দ (যার দু’পা আল্লাহর রাস্তায় ধুলোমলিন হবে- অধ্যায়ে) জিহাদের অর্থে ব্যবহার করেছেন। এ জন্য ইমাম আবু ইউসুফ ও মুহাম্মদ যাকাতের অধ্যায়ে ‘বাড়ি ও সম্পদ থেকে বিচ্ছিন্ন যোদ্ধা’ অর্থে ফী সাবীলিল্লাহ-এর ব্যাখ্যা করেছেন। আমার মতে শব্দের বাহ্যিক থেকে প্রমাণ হয়, শব্দটি প্রত্যেক পূণ্য কাজের অর্থে ব্যাপক। যেমনটি তিরমিযী বর্ণনাকৃত হাদীস দ্বারা প্রমাণীত হয়। তাই উক্ত শব্দের দুটি ব্যবহার রয়েছে; ব্যাপক অর্থ ও বিশেষ অর্থ। এ ধরণের (উৎসাহমূলক) হাদীসের ক্ষেত্রে ব্যাপক অর্থই বেশি উপযোগী। সম্ভবত পরিভাষায় ফী সাবীলিল্লাহ জিহাদের অর্থে প্রশিদ্ধ হওয়ার কারণে গ্রন্থকার এ অর্থে উল্লেখ করেছেন।” -ফাইযুল বারী: ৪/১৬২ (ইলমিয়্যাহ)
এ গেল ফযীলত সংক্রান্ত নুসূসে হাদীস-ব্যাখ্যাকারীদের বক্তব্য। তবে এর বিপরিতে আহকাম সংক্রান্ত নুসূসের ক্ষেত্রে ফুকাহায়ে কেরাম ‘ফী সাবীলিল্লাহ’কে জিহাদ অর্থে সীমাবদ্ধ রেখে মাসআলা বলেছেন।
শামসুল আইম্মাহ সারাখসী রহ. (৪৯০ হি.) বলেন,
“যদিও প্রত্যেক ভালো ও পূণ্য কাজ ‘ফী সাবীলিল্লাহ (-এর অন্তর্ভুক্ত); তথাপি সাধারণভাবে তা যুদ্ধ ও জিহাদ অর্থে ব্যবহার হয়।” একটু পরে বলেন, “সাবীলুল্লাহ’ সাধারণভাবে ব্যবহৃত হলে, তা দ্বারা যুদ্ধ ও জিহাদ উদ্দেশ্য হবে; অন্য কিছু নয়।” –শরহুস সিয়ারিল কাবীর: ৫/২৪৯ (ইলমিয়্যাহ)
যাকাতের খাতের আয়াতে ‘ফী সাবীলিল্লাহ’-এর ব্যাপারে ইমামদের মাঝে মতভেদ রয়েছে— কারো মতে শুধু মুজাহিদ উদ্দেশ্য; আবার কারো মতে মুজাহিদের সাথে হাজীও এর অন্তর্ভুক্ত হবে।
ইমাম আবু বকর জাসসাস রহ. (৩৭০ হি.) বলেন,
“(যাকাতের আয়াতে উল্লেখিত) ‘ফী সাবীলিল্লাহ’ দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে গরিব মুজাহিদ। গ্রন্থকার বলেন, ইমাম মুহাম্মদ থেকে বর্ণিত আছে যে, কেউ যদি তার সম্পদের এক-তৃতীয়াংশ ‘ফী সাবীলিল্লাহ’ ওসিয়ত করে, তাহলে তা থেকে নিজস্ব সম্পদ থেকে বিচ্ছিন্ন হাজীকে দেওয়া জায়েয আছে। আবু ইউসুফ থেকে বর্ণিত আছে যে, ‘ফী সাবীলিল্লাহ’ দ্বারা উদ্দেশ্য শুধু মুজাহিদগণ। শব্দের প্রয়োগের দাবী অনুযায়ী অধিক গ্রহণযোগ্য মত হচ্ছে, ‘ফী সাবীলিল্লাহ’ দ্বারা উদ্দেশ্য শুধু মুজাহিদগণ। উক্ত অর্থেই কুরআনের অধিকাংশ ‘ফী সাবীলিল্লাহ’ এসেছে।” –শরহে মুখতাসারে তাহাবী: ২/৩৭৫ (দারুল বাশায়ির)
মুজাহিদের সাথে হাজীও অন্তর্ভুক্ত হওয়ার মতের পক্ষে একটি হাদীস দ্বারা দলীল দেওয়া হয়েছে, যেখানে হজকে ‘ফী সাবীলিল্লাহ’ বলা হয়েছে। উক্ত মতের খণ্ডন করতে গিয়ে ইবনুল হুমাম রহ. (৮৬১ হি.) বলেন,
“উক্ত হাদীস দ্বারা দলীল উপস্থাপনে আপত্তি আছে। কেননা (আমাদের আলোচনার) মূল কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে, আয়াতে উল্লেখিত ‘সাবীলুল্লাহ’ দ্বারা উদ্দেশ্য কী? হাদীসে উল্লেখিত ‘ফী সাবীলিল্লাহ’ শব্দটি আয়াতে উল্লেখিত ‘ফী সাবীলিল্লাহ’ হওয়া আবশ্যক নয়। কেননা হাদীসে ব্যাপক অর্থ উদ্দেশ্য হওয়া সম্ভাবনা রয়েছে। বিপরিতে আয়াতে উক্ত ব্যাপকতা উদ্দেশ্য নয়; বরং এর বিশেষ এক প্রকার (জিহাদ) উদ্দেশ্য। অন্যথায় উক্ত (ব্যাপক) অর্থে সকল প্রকারের পূণ্যময় কাজ ‘ফী সাবীলিল্লাহ’-এর অন্তর্ভুক্ত।” –ফাতহুল কাদীর: ২/২৬৯ (ইলমিয়্যাহ)
এখান থেকে স্পষ্ট যে, কোনো ইমামই জিহাদ ও হজের বাইরে অন্য কিছুকে ‘ফী সাবীলিল্লাহ’-এর অন্তর্ভুক্ত মনে করেন না।[1]
সারকথা হচ্ছে, ‘ফী সাবীলিল্লাহ’-এর মৌলিক ও সর্বোচ্চ প্রয়োগক্ষেত্র জিহাদ। এবং আহকাম সংক্রান্ত নুসূসে উক্ত অর্থে সীমাবদ্ধ রাখা হবে। তবে ফযীলত সংক্রান্ত নুসূসে সকল ধরনের পূণ্যময় কাজের অর্থে ব্যাখ্যা করা যাবে।
উল্লেখ্য, ‘ফী সাবীলিল্লাহ’ ফযীলত সংক্রান্ত নুসূসে ব্যাপক অর্থে নেওয়ার অর্থ হচ্ছে, জিহাদকে সর্বোচ্চ প্রয়োগক্ষেত্র রেখে অন্যান্য পূণ্যময় কাজও এর অন্তর্ভুক্ত করা। তাই জিহাদকে বের করে অথবা খাটো করে অন্যান্য পূণ্যময় কাজের জন্য ব্যবহার করা নুসূস বহির্ভুত।
[1] এখানে একটি সংশয় দূর করা আবশ্যক—পরবর্তী কোনো কোনো হানাফী ফকীহ ‘ফী সাবীলিল্লাহ’কে ব্যাপক করে সকল পূণ্যময় কাজ এর অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তবে এতে মূল বিধানে কোনো প্রভাব পড়েনি। কেননা, হানাফীদের মতে যাকাত গ্রহণের জন্য গরিব হওয়া আবশ্যক। আর গরিব যেকোনো ব্যক্তিকে যাকাত দেওয়া জায়েয; সে মুজাহিদ হোক বা না হোক। সর্বোপরি এটা পরবর্তীদের মত; ইমামদের কারো মত নয়।
ফিকহুল জিহাদ; প্রথম পর্ব ➤ জিহাদের শাব্দিক ও পারিভাষিক অর্থ
https://dawahilallah.com/forum/%E0%A...A7%8D%E0%A6%A5
‘ফী সাবীলিল্লাহ’-এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে, ‘আল্লাহর রাস্তায়’। শরীয়তের পরিভাষায় পূণ্যময় সকল কাজ এর অন্তর্ভুক্ত। তবে মূল অর্থের বিবেচনায় পূণ্যময় সকল কাজ এর অন্তর্ভুক্ত হলেও সাধারণত তা দ্বারা জিহাদ উদ্দেশ্য হয়ে থাকে এবং তা জিহাদ অর্থেই বেশি প্রশিদ্ধ। সুতরাং ‘ফী সাবীলিল্লাহ’-এর দু’টি অর্থ দাঁড়াবে— মূল অর্থ পূণ্যময় সকল কাজ এবং প্রশিদ্ধ অর্থ জিহাদ।
আর জানা কথা, আহকাম তথা বিধিবিধান সংক্রান্ত নুসূসে সতর্কতা কাম্য; বিপরিতে ফযীলত সংক্রান্ত নুসূসে শিথিলতার অবকাশ রয়েছে। এ কারণে ফুকাহায়ে কেরাম ফযীলত প্রমাণের ক্ষেত্রে যতটুকু শিথিলতা করেন, আহকাম প্রমাণের ক্ষেত্রে ততটুকু করেন না; বরং এক্ষেত্রে কঠোরতা অবলম্ভন করে থাকেন। -মাজমূউল ফাতাওয়া: ২০/২৬১-২৬২
তাই আহকাম সংক্রান্ত নুসূসের ক্ষেত্রে সতর্কতাস্বরূপ ‘ফী সাবীলিল্লাহ’ কেবল জিহাদ অর্থে প্রয়োগ হবে। আর ফযীলত সংক্রান্ত নুসূসে তা আল্লাহর রহমতের প্রশস্তার প্রতি লক্ষ্য রেখে জিহাদসহ পূণ্যময় সকল কাজের অর্থে প্রয়োগ হবে। যদিও ‘ফী সাবীলিল্লাহ’-এর সর্বোচ্চ প্রয়োগক্ষেত্র জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ।
ফুকাহা ও মুহাদ্দিসীনে কেরামের ‘ফী সাবীলিল্লাহ’-এর প্রয়োগ থেকে এমনই বুঝে আসে।
সহীহ বুখারীর এক হাদীসে এসেছে,
عَنْ عَبَايَةَ بْنِ رِفَاعَةَ، قَالَ: أَدْرَكَنِي أَبُو عَبْسٍ وَأَنَا أَذْهَبُ إِلَى الجُمُعَةِ، فَقَالَ: سَمِعْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: «مَنِ اغْبَرَّتْ قَدَمَاهُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ حَرَّمَهُ اللَّهُ عَلَى النَّارِ» -رواه البخاري (907)
“আবায়া বিন রিফাআ’ রহ. বলেন, আমি জুমআ’র উদ্ধেশ্যে গমনকালে আবু আবস রাদি. আমাকে পেয়ে বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, যার দু’পা আল্লাহর রাস্তায় ধুলোমলিন হবে, আল্লাহ তাকে জাহান্নামের জন্য হারাম করে দেন।” –সহীহ বুখারী: ৯০৭
অন্য বর্ণনায় এসেছে,
عَنْ يَزِيدَ بْنِ أَبِي مَرْيَمَ، قَالَ: لَحِقَنِي عَبَايَةُ بْنُ رِفَاعَةَ بْنِ رَافِعٍ، وَأَنَا مَاشٍ إِلَى الجُمُعَةِ، فَقَالَ: أَبْشِرْ، فَإِنَّ خُطَاكَ هَذِهِ فِي سَبِيلِ اللَّهِ، سَمِعْتُ أَبَا عَبْسٍ يَقُولُ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَنْ اغْبَرَّتْ قَدَمَاهُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَهُمَا حَرَامٌ عَلَى النَّارِ» -رواه الترمذي (1632) والنسائي (3116) وفي الكبري (4309). وقال الترمذي: هذا حديث حسن صحيح.اهـــ
“ইয়াযীদ বিন আবু মারয়াম বলেন, আমি জুমআ’র উদ্ধেশ্যে গমনকালে আবায়া বিন রিফাআ’ আমাকে পেয়ে বলেন, সুসংবাদ গ্রহণ করো। কেননা তোমার উক্ত হাঁটা আল্লাহর রাস্তায় (হাঁটা হিসেবে গণ্য হবে)। আমি আবু আবস রাদি.কে বলতে শুনেছি, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলেছেন, যার দু’পা আল্লাহর রাস্তায় ধুলোমলিন হবে, উভয় পা জাহান্নামের জন্য হারাম হয়ে যাবে।” -জামে’ তিরমিযী: ১৬৩২, সুনানে নাসায়ী: ৩১১৬। ইমাম তিরমিযী রহ. হাদীসটি হাসান সহীহ বলেছেন।
উভয় হাদীসের মাঝে সামঞ্জস্য হচ্ছে, ‘আবায়া বিন রিফাআ’ রহ. এর সাথে সাহাবী আবু আবস রাদি. এর উক্ত ঘটনা ঘটে। পরবর্তীতে ‘ইয়াযিদ বিন আবু মারয়াম’ রহ. এর সাথে বর্ণনাকারী ‘আবায়া বিন রিফাআ’ রহ. এর একই ঘটনা ঘটে। -ফাতহুল বারী: ২/৩৯১ (দারুল ফিকর); উমদাতুল কারী: ৬/২০৫ (দারু ইহয়াইত তুরাসিল আরাবী)
সাহাবী আবু আবস ও তাবেয়ী আবায়া বিন রিফাআ উভয়ই ‘ফী সাবীলিল্লাহ’ এর ব্যাপক অর্থ করে জুমআর উদ্ধেশ্যে গমনকে এর অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এবং ইমাম বুখারী রহ.ও উক্ত হাদীস জুমার উদ্ধেশ্যে হেঁটে যাওয়ার ফযীলত অধ্যায়ে বর্ণনা করেছেন। -ফাতহুল বারী: ৬/৩৫ (দারুল ফিকর); ফাইযুল বারী: ৪/১৬২ (ইলমিয়্যাহ); তুহফাতুল আহওয়াযী: ৬/২১৩ (ইলমিয়্যাহ)
উপর্যুক্ত হাদীস ইমাম বুখারী রহ. কিতাবুল জিহাদের ‘যার পা দুটি আল্লাহর রাস্তায় ধুলোমলিন হবে, তা জাহান্নামের জন্য হারাম হয়ে যাবে’— অধ্যায়েও বর্ণনা করেন। উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনে বাত্তাল রহ. (৪৪৯ হি.) বলেন,
وسبيل الله جميع طاعاته.اهــــ -شرح صحيح البخاري لابن البطال ط. مكتبة الرشد (5/ 26)
“ফী সাবীলিল্লাহ হচ্ছে আল্লাহ তাআলার আনুগত্যের সকল ক্ষেত্র।” -শরহে ইবনে বাত্তাল: ৫/২৬ (মাকতাবাতুর রুশদ)
ইবনে বাত্তাল রহ. এর উক্ত বক্তব্য উল্লেখ করে ইবনে হাজার রহ. (৮৫২ হি.) বলেন,
قال: والمراد في سبيل الله جميع طاعاته اهـ. وهو كما قال، إلا أن المتبادر عند الإطلاق من لفظ سبيل الله الجهاد، وقد أورده المصنف في "فضل المشي إلى الجمعة" استعمالا للفظ في عمومه.اهــــ -فتح الباري ط. دار الفكر (6/ 35)
“তিনি (ইবনে বাত্তাল) বলেন, ‘ফী সাবীলিল্লাহ দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহ তাআলার আনুগত্যের সকল ক্ষেত্র।’ বিষয়টি এমনই। তবে ফী সাবীলিল্লাহ শব্দ সাধারণভাবে ব্যবহার হলে জিহাদ উদ্দেশ্য হয়। গ্রন্থকার (ইমাম বুখারী) ব্যাপক অর্থে ফী সাবীলিল্লাহ (-সন্বলীত হাদীস) ‘জুমআয় হেঁটে যাওয়ার ফযীলত’ অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন।” -ফাতহুল বারী: ৬/৩৫ (দারুল ফিকর)
আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী রহ. (১৩৫২ হি.) বলেন,
حمل المصنف قوله: «في سبيل الله» على الجهاد، ولذا فسره أبو يوسف ومحمد في باب الزكاة بمنقطع الغزاة. قلت: والظاهر أنه عالم [لعله: عام] لجميع سبل الخير، كما يدل عليه ما أخرجه الترمذي ... فله إطلاقان: عام، وخاص، والذي يناسب في نحو هذا الحديث هو الإطلاق العام، ولعل المصنف حمل على أنه اشتهر في الجهاد عرفا.اهــــ -فيض الباري ط. العلمية (4/ 162)
“গ্রন্থকার (ইমাম বুখারী) ফী সাবীলিল্লাহ শব্দ (যার দু’পা আল্লাহর রাস্তায় ধুলোমলিন হবে- অধ্যায়ে) জিহাদের অর্থে ব্যবহার করেছেন। এ জন্য ইমাম আবু ইউসুফ ও মুহাম্মদ যাকাতের অধ্যায়ে ‘বাড়ি ও সম্পদ থেকে বিচ্ছিন্ন যোদ্ধা’ অর্থে ফী সাবীলিল্লাহ-এর ব্যাখ্যা করেছেন। আমার মতে শব্দের বাহ্যিক থেকে প্রমাণ হয়, শব্দটি প্রত্যেক পূণ্য কাজের অর্থে ব্যাপক। যেমনটি তিরমিযী বর্ণনাকৃত হাদীস দ্বারা প্রমাণীত হয়। তাই উক্ত শব্দের দুটি ব্যবহার রয়েছে; ব্যাপক অর্থ ও বিশেষ অর্থ। এ ধরণের (উৎসাহমূলক) হাদীসের ক্ষেত্রে ব্যাপক অর্থই বেশি উপযোগী। সম্ভবত পরিভাষায় ফী সাবীলিল্লাহ জিহাদের অর্থে প্রশিদ্ধ হওয়ার কারণে গ্রন্থকার এ অর্থে উল্লেখ করেছেন।” -ফাইযুল বারী: ৪/১৬২ (ইলমিয়্যাহ)
এ গেল ফযীলত সংক্রান্ত নুসূসে হাদীস-ব্যাখ্যাকারীদের বক্তব্য। তবে এর বিপরিতে আহকাম সংক্রান্ত নুসূসের ক্ষেত্রে ফুকাহায়ে কেরাম ‘ফী সাবীলিল্লাহ’কে জিহাদ অর্থে সীমাবদ্ধ রেখে মাসআলা বলেছেন।
শামসুল আইম্মাহ সারাখসী রহ. (৪৯০ হি.) বলেন,
...كل خير وطاعة، وإن كان في سبيل الله، ولكن مطلقه يستعمل في الغزو والجهاد. وقال أيضا: إن سبيل الله إذا أطلق يراد به الغزو والجهاد دون غيره.اهــــ -شرح السير الكبير ط. العلمية (5/ 249-250)
“যদিও প্রত্যেক ভালো ও পূণ্য কাজ ‘ফী সাবীলিল্লাহ (-এর অন্তর্ভুক্ত); তথাপি সাধারণভাবে তা যুদ্ধ ও জিহাদ অর্থে ব্যবহার হয়।” একটু পরে বলেন, “সাবীলুল্লাহ’ সাধারণভাবে ব্যবহৃত হলে, তা দ্বারা যুদ্ধ ও জিহাদ উদ্দেশ্য হবে; অন্য কিছু নয়।” –শরহুস সিয়ারিল কাবীর: ৫/২৪৯ (ইলমিয়্যাহ)
যাকাতের খাতের আয়াতে ‘ফী সাবীলিল্লাহ’-এর ব্যাপারে ইমামদের মাঝে মতভেদ রয়েছে— কারো মতে শুধু মুজাহিদ উদ্দেশ্য; আবার কারো মতে মুজাহিদের সাথে হাজীও এর অন্তর্ভুক্ত হবে।
ইমাম আবু বকর জাসসাস রহ. (৩৭০ হি.) বলেন,
(وفي سبيل الله هم أهل الجهاد من الفقراء). قال أبو بكر: وقد روي عن محمد: أن من أوصى بثلث ماله في سبيل الله، أنه يجوز أن يجعل في الحاج المنقطع به. وروي عن أبي يوسف: أنهم الغزاة. ... والأظهر مما يقتضيه إطلاق اللفظ: أن يكون الغزاة، وعلى ذلك أكثر ما جاء من ألفاظ القرآن في سبيل الله.اهـــ -شرح مختصر الطحاوي للجصاص ط. دار البشائر الإسلامية (2/ 375)
“(যাকাতের আয়াতে উল্লেখিত) ‘ফী সাবীলিল্লাহ’ দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে গরিব মুজাহিদ। গ্রন্থকার বলেন, ইমাম মুহাম্মদ থেকে বর্ণিত আছে যে, কেউ যদি তার সম্পদের এক-তৃতীয়াংশ ‘ফী সাবীলিল্লাহ’ ওসিয়ত করে, তাহলে তা থেকে নিজস্ব সম্পদ থেকে বিচ্ছিন্ন হাজীকে দেওয়া জায়েয আছে। আবু ইউসুফ থেকে বর্ণিত আছে যে, ‘ফী সাবীলিল্লাহ’ দ্বারা উদ্দেশ্য শুধু মুজাহিদগণ। শব্দের প্রয়োগের দাবী অনুযায়ী অধিক গ্রহণযোগ্য মত হচ্ছে, ‘ফী সাবীলিল্লাহ’ দ্বারা উদ্দেশ্য শুধু মুজাহিদগণ। উক্ত অর্থেই কুরআনের অধিকাংশ ‘ফী সাবীলিল্লাহ’ এসেছে।” –শরহে মুখতাসারে তাহাবী: ২/৩৭৫ (দারুল বাশায়ির)
মুজাহিদের সাথে হাজীও অন্তর্ভুক্ত হওয়ার মতের পক্ষে একটি হাদীস দ্বারা দলীল দেওয়া হয়েছে, যেখানে হজকে ‘ফী সাবীলিল্লাহ’ বলা হয়েছে। উক্ত মতের খণ্ডন করতে গিয়ে ইবনুল হুমাম রহ. (৮৬১ হি.) বলেন,
ثم فيه نظر لأن المقصود ما هو المراد بسبيل الله المذكور في الآية. والمذكور في الحديث لا يلزم كونه إياه لجواز أنه أراد الأمر الأعم، وليس ذلك المراد في الآية بل نوع مخصوص، وإلا فكل الأصناف في سبيل الله بذلك المعنى.اهـــ -فتح القدير ط. العلمية (2/ 269)
“উক্ত হাদীস দ্বারা দলীল উপস্থাপনে আপত্তি আছে। কেননা (আমাদের আলোচনার) মূল কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে, আয়াতে উল্লেখিত ‘সাবীলুল্লাহ’ দ্বারা উদ্দেশ্য কী? হাদীসে উল্লেখিত ‘ফী সাবীলিল্লাহ’ শব্দটি আয়াতে উল্লেখিত ‘ফী সাবীলিল্লাহ’ হওয়া আবশ্যক নয়। কেননা হাদীসে ব্যাপক অর্থ উদ্দেশ্য হওয়া সম্ভাবনা রয়েছে। বিপরিতে আয়াতে উক্ত ব্যাপকতা উদ্দেশ্য নয়; বরং এর বিশেষ এক প্রকার (জিহাদ) উদ্দেশ্য। অন্যথায় উক্ত (ব্যাপক) অর্থে সকল প্রকারের পূণ্যময় কাজ ‘ফী সাবীলিল্লাহ’-এর অন্তর্ভুক্ত।” –ফাতহুল কাদীর: ২/২৬৯ (ইলমিয়্যাহ)
এখান থেকে স্পষ্ট যে, কোনো ইমামই জিহাদ ও হজের বাইরে অন্য কিছুকে ‘ফী সাবীলিল্লাহ’-এর অন্তর্ভুক্ত মনে করেন না।[1]
সারকথা হচ্ছে, ‘ফী সাবীলিল্লাহ’-এর মৌলিক ও সর্বোচ্চ প্রয়োগক্ষেত্র জিহাদ। এবং আহকাম সংক্রান্ত নুসূসে উক্ত অর্থে সীমাবদ্ধ রাখা হবে। তবে ফযীলত সংক্রান্ত নুসূসে সকল ধরনের পূণ্যময় কাজের অর্থে ব্যাখ্যা করা যাবে।
উল্লেখ্য, ‘ফী সাবীলিল্লাহ’ ফযীলত সংক্রান্ত নুসূসে ব্যাপক অর্থে নেওয়ার অর্থ হচ্ছে, জিহাদকে সর্বোচ্চ প্রয়োগক্ষেত্র রেখে অন্যান্য পূণ্যময় কাজও এর অন্তর্ভুক্ত করা। তাই জিহাদকে বের করে অথবা খাটো করে অন্যান্য পূণ্যময় কাজের জন্য ব্যবহার করা নুসূস বহির্ভুত।
[1] এখানে একটি সংশয় দূর করা আবশ্যক—পরবর্তী কোনো কোনো হানাফী ফকীহ ‘ফী সাবীলিল্লাহ’কে ব্যাপক করে সকল পূণ্যময় কাজ এর অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তবে এতে মূল বিধানে কোনো প্রভাব পড়েনি। কেননা, হানাফীদের মতে যাকাত গ্রহণের জন্য গরিব হওয়া আবশ্যক। আর গরিব যেকোনো ব্যক্তিকে যাকাত দেওয়া জায়েয; সে মুজাহিদ হোক বা না হোক। সর্বোপরি এটা পরবর্তীদের মত; ইমামদের কারো মত নয়।
ফিকহুল জিহাদ; প্রথম পর্ব ➤ জিহাদের শাব্দিক ও পারিভাষিক অর্থ
https://dawahilallah.com/forum/%E0%A...A7%8D%E0%A6%A5