জিহাদের বিধান অবতীর্ণ হওয়ার ক্রমবিকাশ:[1]
ইসলামের সকল বিধান একসাথে অবতীর্ণ হয়নি। তদ্রূপ অনেক বিধান প্রথম ধাপেই পূর্ণাঙ্গরূপে অবতীর্ণ হয়নি। বরং ধাপে ধাপে অবতীর্ণ হয়ে পূর্ণাঙ্গরূপে পৌঁছেছে; যাতে নবমুসলিমদের জন্য তা সহনীয় ও উপযোগী হয়। দীর্ঘ তেইশ বছরে অনেক ধাপ অতিক্রম করে ইসলাম তার পূর্ণ চূড়ায় আরোহণ করে।
একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,
“আম্মাজান আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, কুরআনের সর্বপ্রথম যে সূরা অবতীর্ণ হয়েছিল, তা ছিল মুফাসসাল (ছোট) সূরা; যাতে জান্নাত ও জাহান্নামের আলোচনা ছিল। এর মাধ্যমে মানুষ যখন ইসলামের দিকে ফিরতে লাগল (অর্থাৎ ইসলাম গ্রহণ করতে শুরু করল), তখন হালাল ও হারাম সম্বলিত বিধান অবতীর্ণ হতে লাগল। আর যদি প্রথমেই বলা হত— ‘তোমরা মদ খেও না’, তাহলে তারা বলে উঠত, “আমরা কখনোই মদ ছাড়ব না”। যদি বলা হত— ‘তোমরা যিনা করো না’, তারা বলে উঠত, 'আমরা কখনোই যিনা ছাড়ব না।” –সহীহ বুখারী: ৪৯৯৩
জিহাদের বিধানও প্রথম ধাপেই পূর্ণাঙ্গরূপে অবতীর্ণ হয়নি। বরং ধাপে ধাপে একাধিক স্থর অতিক্রম করে মক্কা বিজয়ের পরে পূর্ণাঙ্গতায় পৌঁছেছে।
আমরা উক্ত স্থর ও ধাপসমূহকে চারটি ধাপে ভাগ করতে পারি:
এক. জিহাদ নিষিদ্ধ:
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম মদীনায় হিজরত করার আগ পর্যন্ত জিহাদ নিষিদ্ধ ছিল। বরং সাহাবায়ে কেরাম জিহাদের অনুমতি চাওয়া সত্বেও জিহাদের অনুমতি দেওয়া হয়নি।
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন,
“তুমি কি তাদেরকে দেখোনি, যাদেরকে বলা হয়েছিল, তোমরা নিজেদের হাতকে (যুদ্ধ করা থেকে) সংযত রাখো এবং নামায কায়েম করো, যাকাত আদায় করো? অতঃপর যখন তাদের উপর জিহাদ ফরয করা হলো, তাদের একদল লোক মানুষকে এতটা ভয় করতে লাগল, যেমন আল্লাহকে ভয় করা হয়; কিংবা তার চেয়েও বেশি। তারা বলতে লাগল, হে আমাদের রব, কেন আমাদের উপর জিহাদ ফরজ করলেন? যদি আমাদেরকে আরো কিছুকাল অবকাশ দিতেন! (হে রাসূল) আপনি (তাদেরকে) বলে দিন, পার্থিব ভোগ সীমিত। আর পরকাল মুত্তাকীদের জন্য উত্তম। আর তোমাদের প্রতি সুতা পরিমানও জুলুম করা হবে না।” –সূরা নিসা: ৭৭
ইবনে আব্বাস রাদি. থেকে বর্ণিত এক হাদীসে এসেছে,
“ইবনে আব্বাস রাদি. থেকে বর্ণিত, আবদুর রহমান ইবনে আউফ রাদি. ও তাঁর কিছু সাথি মক্কায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমরা যখন মুশরিক ছিলাম, তখন আমরা সম্মানিত ছিলাম। কিন্তু যখন আমরা ঈমান গ্রহণ করলাম, তখন আমরা অবমানিত হয়ে গেছি।’ তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘আমাকে ক্ষমা করে দেওয়ার আদেশ করা হয়েছে। সুতরাং তোমরা যুদ্ধ বাধাইও না।’ এরপর যখন আল্লাহ আমাদের মদিনায় স্থানান্তরিত করলেন, তখন তিনি আমাদেরকে যুদ্ধের আদেশ দিলেন। তখন তারা যুদ্ধ করা থেকে হাত গুটিয়ে নিল। উক্ত প্রেক্ষাপটে আল্লাহ তাআলা উক্ত আয়াত অবতীর্ণ করেন, ‘তুমি কি তাদেরকে দেখোনি, যাদেরকে বলা হয়েছিল, তোমরা নিজেদের হাতকে (যুদ্ধ করা থেকে) সংযত রাখো এবং নামায কায়েম করো’।” –সুনানে নাসায়ী: ৩০৮৬; মুস্তাদরাকে হাকিম: ২৩৭৭; সুনানে বায়হাকী: ১৭৭৪১। ইমাম হাকিম রহ. বুখারীর শর্ত অনুযায়ী সহীহ বলেন এবং যাহাবী রহ. তা সমর্থন করেন।
ইমাম আবু বকর জাসসাস রহ. (৩৭০ হি.) বলেন,
“উম্মতের এ ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই যে, হিজরতের আগে জিহাদ নিষিদ্ধ ছিল।” –আহকামুল কুরআন: ১/৩১১ (ইলমিয়্যাহ)। আরো দেখুন: তাফসীরে ইবনুল আরাবী: ৩/৩০১ (ইলমিয়্যাহ); তাফসীরে কুরতুবী: ২/৩৪৭ (দারুল কুতুবিল মিসরিয়্যাহ); তাফসীরে ইবনে কাসীর: ২/৩৫৯ (দারু তায়বাহ)
দুই. জিহাদের অনুমতি:
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করে যাওয়ার পথে মদীনায় পৌঁছার আগেই নিম্নোক্ত আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার মাধ্যমে জিহাদের অনুমতি দেওয়া হয়; তখনো জিহাদ ফরয করা হয়নি।
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন,
“যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হয়ে থাকে, তাদেরকে যুদ্ধের অনুমতি এজন্য দেওয়া হলো যে, তাদের প্রতি জুলুম করা হয়েছে। এবং আল্লাহ তাদেরকে সাহায্য করতে অবশ্যই সক্ষম। যাদেরকে তাদের বাড়ি-ঘর থেকে অন্যায়ভাবে বের করে দেওয়া হয়েছে শুধু এই অপরাধে যে, তারা বলে আমাদের পালনকর্তা আল্লাহ।” –সূরা হজ: ৩৯, ৪০
অধিকাংশ মুফাসসিরদের মতে জিহাদের বিধানসম্বলিত সর্বপ্রথম উক্ত আয়াতটি অবতীর্ণ হয়।
হাদীসে এসেছে,
“ইবনে আব্বাস রাদি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মক্কা থেকে বের করে দেওয়া হলো, আবু বকর রাদি. বলে উঠেন, তারা তাদের নবীকে বের করে দিয়েছে, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন, তারা অবশ্যই ধ্বংস হবে। তখন (সূরা হজের উক্ত আয়াত) “যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হয়ে থাকে, তাদেরকে যুদ্ধের অনুমতি এজন্য দেওয়া হলো যে, তাদের প্রতি জুলুম করা হয়েছে। এবং আল্লাহ তাদেরকে সাহায্য করতে অবশ্যই সক্ষম”— অবতীর্ণ হয়। (আবু বকর রাদি. বলেন) আমি বুঝতে পেরেছি যে, অতিসত্বর যুদ্ধ হবে। ইবনে আব্বাস রাদি. বলেন, উক্ত আয়াত জিহাদের ব্যাপারে সর্বপ্রথম অবতীর্ণ আয়াত।[2]” –সুনানে নাসায়ী: ৩০৮৫; জামে’ তিরমিযী: ৩১৭১; মুসনাদে আহমাদ: ১৮৬৩; সহীহ ইবনে হিব্বান: ৪৭১০; মুস্তাদরাকে হাকিম: ২৩৭৬। ইমাম তিরমিযী রহ. হাদীসটি হাসান বলেন। ইমাম হাকিম রহ. বুখারী ও মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী সহীহ বলেন এবং যাহাবী রহ. তা সমর্থন করেন।
তাফসীরে কুরতুবীতে এসেছে,
“ইবনে আব্বাস রাদি. ও ইবনে জুবাইর রহ. বলেন, (জিহাদের বৈধতার উপর্যুক্ত আয়াত) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনার দিকে হিজরত করার পথে অবতীর্ণ হয়।” –তাফসীরে কুরতুবী: ১২/৬৮ (দারুল কুতুবিল মিসরিয়্যাহ) [3]
তিন. দিফায়ী জিহাদ ফরয:
জিহাদের অনুমতি দেওয়ার কিছুকাল পরে নিম্নোক্ত আয়াতের মাধ্যমে দিফায়ী জিহাদ ফরয করা হয়।
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন,
“তোমরা আল্লাহর রাস্তায় তাদের সাথে জিহাদ করো, যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এবং সীমালঙ্ঘন করো না। অবশ্যই আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না।” –সূরা বাকারা: ১৯০[4]
উক্ত আয়াতের মাধ্যমে কেবল দিফায়ী জিহাদ ফরয করা হয়। তাই উক্ত আয়াত নাযিল হওয়ার পরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু দিফায়ী জিহাদে সীমাবদ্ধ ছিলেন; ইকদামী জিহাদ করেননি।
রাবী’ বিন আনাস রহ. থেকে বর্ণিত হয়েছে,
“রাবী’ বিন আনাস রহ. থেকে ‘তোমরা আল্লাহর রাস্তায় তাদের সাথে জিহাদ করো, যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে’ আয়াতের ব্যাখ্যায় বর্ণিত হয়েছে— তিনি বলেন, জিহাদ (ফরয হওয়া)-র ব্যাপারে মদীনায় উক্ত আয়াত সর্বপ্রথম অবতীর্ণ হয়েছে। উক্ত আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেবল তাদের সাথে যুদ্ধ করতেন, যারা তাঁর সাথে যুদ্ধ জড়াত। এবং যারা তাঁর সাথে যুদ্ধ এড়িয়ে চলত রাসূলও তার থেকে বিরত থাকতেন। সূরা তাওবার অবতীর্ণ হওয়া পর্যন্ত (উক্ত অবস্থা চলতে থাকে)।” - তাফসীরে তাবারী: ৩/৫৬১ (মুআসসাসাতুর রিসালাহ); আহকামুল কুরআন: ১/৩১২ (ইলমিয়্যাহ)
জিহাদের উক্ত ধাপ প্রথম হিজরীর শেষের দিকে অথবা দ্বিতীয় হিজরীর শুরুর দিকে অবতীর্ণ হয়। -আলহাবী লিল-ফাতাওয়া লিসসুয়ূতী: ১/২৮৮ (দারুল ফিকর)
উল্লেখ্য, দিফায়ী জিহাদ ফরয হওয়ার উপর্যক্ত বিধান ব্যাপকভাবে সকল মুসলিমদের জন্য সকল কালের ক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছিল। তবে আনাসারী সাহাবীদের জন্য মদীনার অভ্যন্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিরাপত্তা দেওয়া এবং শত্র কর্তৃক আক্রমন প্রতিহত করা— তা বাইয়াতে আকাবার অঙ্গীকারনামার ভিত্তিতে আগে থেকেই ফরয ছিল।
চার. ইকদামী জিহাদ ফরয:
অষ্টম হিজরীতে মক্কা বিজয়ের পরে ইকদামী জিহাদ ফরয করা হয়। -ইকমালুল মু’লিম লিলকাযী ইয়ায: ১/২২৯ (দারুল ওয়াফা); আলহাবী লিল-ফাতাওয়া লিসসুয়ূতী: ১/২৮৮ (দারুল ফিকর)
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন,
“আর তোমরা তাদের (কাফেরদের) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকো, যতক্ষণ না ফিতনা দূরীভূত হয় এবং দীন একমাত্র আল্লাহর হয়ে যায়। এতে যদি তারা বিরত হয়ে যায়, তাহলে জালিম ছাড়া অন্য কারো প্রতি কোনো কঠোরতা নেই।” –সূরা বাকারা: ১৯৩
অন্যত্র এরশাদ হয়েছে,
“তোমরা আহলে কিতাব (তথা ইহুদি ও নাসারা)-এর ঐ লোকদের সাথে যুদ্ধ করো, যারা আল্লাহ ও পরকালের উপর ঈমান রাখে না; আল্লাহ ও তাঁর রসূল যা হারাম করেছেন, তারা তা হারাম হিসেবে গ্রহণ করে না এবং সত্য দীন গ্রহণ করে না, যতক্ষণ না তারা লাঞ্চিত হয়ে জিযিয়া প্রদান করে।” –সূরা তাওবা: ২৯
হাদীসে এসেছে,
“ইবনে উমর রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমাকে আদেশ করা হয়েছে, যেন মানুষের সাথে যুদ্ধ করি; যতক্ষণ না তারা সাক্ষ্য দেয়—আল্লাহ ছাড়া কোনো মা’বুদ নেই ও মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর রাসূল; নামায কায়েম করে এবং যাকাত আদায় করে। যখন তা আদায় করবে, তারা নিজেদের জান ও মাল আমার থেকে রক্ষা করে নিল। তবে ইসলামের ন্যায়সঙ্গত কোনো কারণ থাকলে ভিন্ন কথা। এবং তাদের হিসাব আল্লাহর কাছে ন্যস্ত।” -সহীহ বুখারী: ২৫, সহীহ মুসলিম: ২২
জিহাদের বিধান উক্ত চতুর্থ ধাপে এসে স্থীর হয়েছে। চতুর্থ ধাপ অবতীর্ণ হওয়ার পর থেকে কিয়ামত পর্যন্ত চতুর্থ ধাপের বিধান বলঃবৎ থাকবে। -রদ্দুল মুহতার: ৪/১২৩ (দারুল ফিকর)
উল্লেখ্য, মক্কা বিজয়ের পরে মুশরিকদের জন্য যে চার মাসের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল, হয়ত ইসলাম গ্রহণ করবে; অন্যথায় আরব উপদ্বীপ ছেড়ে চলে যাবে— উক্ত সুযোগ একটি সাময়িকী বিধান ছিল মাত্র; জিহাদের পৃথক কোনো ধাপ নয়।
শেষ ধাপের দ্বারা পূর্ববর্তী ধাপসমূহ রহিত হয়ে গেছে?
জিহাদের শেষ ধাপ অবতীর্ণ হওয়ার মাধ্যমে জিহাদ তার সর্বোচ্চ চূড়ায় আরোহণ করে। এখন উক্ত চূড়ান্ত ধাপের উপর আমল করার চেষ্টা করতে হবে। তবে পূর্ববর্তী তিন ধাপ রহিত হয়ে যায়নি। বরং শক্তি ও সামর্থের ভিত্তিতে তা এখনও আমলযোগ্য। চূড়ান্ত ধাপের জিহাদ করার সামর্থ না থাকলে সামর্থানুযায়ী পূর্ববরতী ধাপের উপর আমল করা হবে। তখন উক্ত ধাপের উপর আমল করা ফরয।
কেননা জিহাদের বিধান অবতীর্ণ হওয়ার সময় মুসলিমদের শক্তি ও সামর্থের প্রতি লক্ষ্য রেখেই অবতীর্ণ হয়েছে। সুতরাং পরবর্তী যুগেও মুসলিমদের শক্তি ও সামর্থের ভিত্তিতে উপযোগী ধাপ অনুযায়ী আমল করা হবে। -আস-সারিমুল মাসলূল: ২২৯ (দারু ইবনে হাযাম); আল-বুরহান ফী উলূমিল কুরআন: ২/৪২-৪৩ (দারুল মা’রেফা); আল-ইতকান ফী উলূমিল কুরআন: ৩/৬৮-৬৯ (আল-হাইয়াতুল মিসরিয়্যাহ); রাসায়েলে কাশ্মীরী: ৪/১২৯ (এদারাতুল কুরআন)
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. (৭২৮ হি.) বলেন,
“সুতরাং যে মুমিন এমন এলাকায় বসবাস করবে যেখানে সে দুর্বল অথবা এমন সময় জীবনযাপন করেব যখন সে দুর্বল, তখন সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের শানে কটাক্ষকারী আহলে কিতাবি ও মুশরিকদের সাথে সবর, সংযত ও ক্ষমার আয়াতের উপর আমল করবে। আর যারা (জিহাদের) সামর্থ রাখে, তারা দীনের ব্যাপারে কটাক্ষকারী আইম্মাতুল কুফুরের সাথে কিতাল সম্বলিত আয়াত এবং আহলে কিতাবিদের সাথে নতি স্বীকার করে জিযয়া গ্রহণ করা পর্যন্ত কিতাল সম্বলিত আয়াতের উপর আমল করবে।” -আস-সারিমুল মাসলূল: ২২৯ (দারু ইবনে হাযাম)
তবে সামর্থের ভিত্তিতে উপযুক্ত ধাপে আমল করার অর্থ এ নয় যে, উক্ত ধাপেই ক্ষান্ত থাকবে। বরং এবং সর্বোচ্চ চেষ্টা ও প্রস্তুতির মাধ্যমে চূড়ান্ত ধাপে পৌঁছার আপ্রাণ চেষ্টা করা হবে। কেননা, যখন চতুর্থ ধাপের জিহাদ কিয়ামত পর্যন্ত ফরয করা হলো, তখন উক্ত ফরয আদায়ের জন্য চেষ্টা ও প্রস্তুতি গ্রহণ করাও ফরয হয়ে যায়। ফিকহের স্বতশিদ্ধ মূলনীতি হচ্ছে,
“যে কাজ ছাড়া ওয়াজিব বিধান পরিপূর্ণ হয় না, উক্ত কাজও ওয়াজিব।” -আল-বাহরুর রায়েক: ১/৬৪ (ইলমিয়্যাহ); আয-যাখীরাহ: ১০/২৩ (দারুল গারবিল ইসলামী); আল-মাজমূ’: ১/১২৪ (মাজমাউল মালিক ফাহাদ); আল-মুগনী: ২/২২০ (মাকতাবুল কাহেরা)
[1] বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা এ জন্য জরুরি যে, জিহাদের বিভিন্ন ধাপ অনুসারে বিভিন্ন আয়াত ও হাদীস রয়েছে। এখন উক্ত ক্রমবিকাশ না জানলে কারো কাছে উক্ত আয়াত ও হাদীসসমূহের মাঝে পারস্পরিক বিরোধ মনে হতে পারে। তবে বর্তমানে বিষয়টি আরো গুরোত্বের দাবি রাখে। কেননা, পশ্চিমা কাফের ও প্রাচ্যবিদ কাফেরদের ভয়ে ভীত এক শ্রেণী চূড়ান্ত ধাপের আগের কোনো ধাপের আয়াত ও হাদীস উপস্থাপন করে ইকদামী জিহাদ অস্বীকার করার অপচেষ্টা করেছে। তাই উক্ত স্খলন থেকে বাঁচার জন্য উক্ত আলোচনাটি বেশ গুরোত্বপূর্ণ।
[2] অধিকাংশ মুফাসসিরদের মতে জিহাদের ব্যাপারে সর্বপ্রথম (দ্বিতীয় ধাপে উল্লেখিত) সূরা হজের ৩৯ ও ৪০ নং আয়াত অবতীর্ণ হয়। তবে কারো কারো মত হচ্ছে, (তৃতীয় ধাপে উল্লিখিত) সূরা বাকারার আয়াত সর্বপ্রথম জিহাদের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে। -তাফসীরে তাবারী: ১৮/৬৪৪-৬৪৫ (মুআসসাসাতুর রিসালাহ); আহকামুল কুরআন: ১/৩১২ (ইলমিয়্যাহ); তাফসীরে ইবনে কাসীর: ৫/৪৩৩ (দারু তায়বাহ)
তবে উভয় মতের মধ্যে সামঞ্জস্য হচ্ছে, জিহাদের বৈধতার ব্যাপারে সর্বপ্রথম সূরা হজের আয়াত অবতীর্ণ হয় এবং জিহাদ ফরয হওয়ার ব্যাপারে সর্বপ্রথম সূরা বাকারার আয়াত অবতীর্ণ হয়। আয়াতের বাহ্যিক থেকেও তা স্পষ্ট, সূরা হজের আয়াতে জিহাদের অনুমতি দেওয়া হয়েছে; পক্ষান্তরে সূরা বাকারার আয়াতে জিহাদের আদেশ করা হয়েছে। -আহকামুল কুরআন: ১/৩১২ (ইলমিয়্যাহ)
[3] কোনো কোনো বর্ণনামতে হিজরত করে মদীনায় যাওয়ার পরে জিহাদের অনুমতি সম্বলিত আয়াত অবতীর্ণ হয়। আবার কোনো বর্ণনামতে জিহাদের অনুমতি পাওয়ার পরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদেরকে মদীনায় হিজরত করার আদেশ করেন। দেখুন: তাফসীরে তাবারী: ৩/৫৬১ (মুআসসাসাতুর রিসালাহ); আহকামুল কুরআন: ১/৩১২ (ইলমিয়্যাহ); সীরাতে ইবনে হিশাম: ১/৪৬৮ (মুস্তাফা বাবী); আল-বেদায়া ওয়ান নেহায়া: ৩/১৬৯ (দারুল ফিকর)
[4] আয়াতে “সীমালঙ্গন করো না”-এর দুটি ব্যাখ্যা রয়েছে। এক. আগ বেড়ে কাফেরদের উপর আক্রমন করো না। উক্ত ব্যাখ্যা অনুযায়ী তখনো ইকদামী জিহাদ নিষিদ্ধ ছিল। এবং পরবর্তীতে চতুর্থ ধাপের আয়াত দ্বারা আয়াতের উক্ত অংশ রহিত হয়ে গেছে।
দুই. নারী, শিশু, বৃদ্ধসহ যুদ্ধ করতে অক্ষমদেরকে উপর আক্রমন করো না। তখন আয়াতের কোনো অংশ রহিত হবে না। -আহকামুল কুরআন: ১/৩১২ (ইলমিয়্যাহ)
উক্ত ব্যাখ্যা অনুযায়ী ইকদামী জিহাদ কখন বৈধ করা হয়, তা স্পষ্ট নয়। তবে দ্বিতীয় ধাপের আয়াতে যেহেতু ব্যাপকভাবে জিহাদের অনুমতি দেওয়া হয়েছে, সে হিসেবে বলা যায় যে, তখন থেকেই ইকদামী জিহাদ বৈধ ছিল; যদিও মক্কা বিজয়ের আগ পর্যন্ত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইকদামী জিহাদ করেননি।
আগের পর্ব:
ফিকহুল জিহাদ; পঞ্চম পর্ব ➤ ইসলাম প্রচার হয়েছে তরবারির জোরে নাকি আখলাকের বলে?
- https://dawahilallah.com/forum/মূল-ফ...
ইসলামের সকল বিধান একসাথে অবতীর্ণ হয়নি। তদ্রূপ অনেক বিধান প্রথম ধাপেই পূর্ণাঙ্গরূপে অবতীর্ণ হয়নি। বরং ধাপে ধাপে অবতীর্ণ হয়ে পূর্ণাঙ্গরূপে পৌঁছেছে; যাতে নবমুসলিমদের জন্য তা সহনীয় ও উপযোগী হয়। দীর্ঘ তেইশ বছরে অনেক ধাপ অতিক্রম করে ইসলাম তার পূর্ণ চূড়ায় আরোহণ করে।
একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,
عَنْ عَائِشَةَ أُمِّ المُؤْمِنِينَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا، قَالَتْ: إِنَّمَا نَزَلَ أَوَّلَ مَا نَزَلَ مِنْهُ [أي من القرآن] سُورَةٌ مِنَ المُفَصَّلِ، فِيهَا ذِكْرُ الجَنَّةِ وَالنَّارِ، حَتَّى إِذَا ثَابَ النَّاسُ إِلَى الإِسْلاَمِ نَزَلَ الحَلاَلُ وَالحَرَامُ، وَلَوْ نَزَلَ أَوَّلَ شَيْءٍ: لاَ تَشْرَبُوا الخَمْرَ، لَقَالُوا: لاَ نَدَعُ الخَمْرَ أَبَدًا، وَلَوْ نَزَلَ: لاَ تَزْنُوا، لَقَالُوا: لاَ نَدَعُ الزِّنَا أَبَدًا. –صحيح البخاري (4993)
“আম্মাজান আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, কুরআনের সর্বপ্রথম যে সূরা অবতীর্ণ হয়েছিল, তা ছিল মুফাসসাল (ছোট) সূরা; যাতে জান্নাত ও জাহান্নামের আলোচনা ছিল। এর মাধ্যমে মানুষ যখন ইসলামের দিকে ফিরতে লাগল (অর্থাৎ ইসলাম গ্রহণ করতে শুরু করল), তখন হালাল ও হারাম সম্বলিত বিধান অবতীর্ণ হতে লাগল। আর যদি প্রথমেই বলা হত— ‘তোমরা মদ খেও না’, তাহলে তারা বলে উঠত, “আমরা কখনোই মদ ছাড়ব না”। যদি বলা হত— ‘তোমরা যিনা করো না’, তারা বলে উঠত, 'আমরা কখনোই যিনা ছাড়ব না।” –সহীহ বুখারী: ৪৯৯৩
জিহাদের বিধানও প্রথম ধাপেই পূর্ণাঙ্গরূপে অবতীর্ণ হয়নি। বরং ধাপে ধাপে একাধিক স্থর অতিক্রম করে মক্কা বিজয়ের পরে পূর্ণাঙ্গতায় পৌঁছেছে।
আমরা উক্ত স্থর ও ধাপসমূহকে চারটি ধাপে ভাগ করতে পারি:
এক. জিহাদ নিষিদ্ধ:
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম মদীনায় হিজরত করার আগ পর্যন্ত জিহাদ নিষিদ্ধ ছিল। বরং সাহাবায়ে কেরাম জিহাদের অনুমতি চাওয়া সত্বেও জিহাদের অনুমতি দেওয়া হয়নি।
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন,
أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ قِيلَ لَهُمْ كُفُّوا أَيْدِيَكُمْ وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ فَلَمَّا كُتِبَ عَلَيْهِمُ الْقِتَالُ إِذَا فَرِيقٌ مِنْهُمْ يَخْشَوْنَ النَّاسَ كَخَشْيَةِ اللَّهِ أَوْ أَشَدَّ خَشْيَةً وَقَالُوا رَبَّنَا لِمَ كَتَبْتَ عَلَيْنَا الْقِتَالَ لَوْلَا أَخَّرْتَنَا إِلَى أَجَلٍ قَرِيبٍ قُلْ مَتَاعُ الدُّنْيَا قَلِيلٌ وَالْآخِرَةُ خَيْرٌ لِمَنِ اتَّقَى وَلَا تُظْلَمُونَ فَتِيلًا -سورة النساء: 77
“তুমি কি তাদেরকে দেখোনি, যাদেরকে বলা হয়েছিল, তোমরা নিজেদের হাতকে (যুদ্ধ করা থেকে) সংযত রাখো এবং নামায কায়েম করো, যাকাত আদায় করো? অতঃপর যখন তাদের উপর জিহাদ ফরয করা হলো, তাদের একদল লোক মানুষকে এতটা ভয় করতে লাগল, যেমন আল্লাহকে ভয় করা হয়; কিংবা তার চেয়েও বেশি। তারা বলতে লাগল, হে আমাদের রব, কেন আমাদের উপর জিহাদ ফরজ করলেন? যদি আমাদেরকে আরো কিছুকাল অবকাশ দিতেন! (হে রাসূল) আপনি (তাদেরকে) বলে দিন, পার্থিব ভোগ সীমিত। আর পরকাল মুত্তাকীদের জন্য উত্তম। আর তোমাদের প্রতি সুতা পরিমানও জুলুম করা হবে না।” –সূরা নিসা: ৭৭
ইবনে আব্বাস রাদি. থেকে বর্ণিত এক হাদীসে এসেছে,
عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ: أَنَّ عَبْدَ الرَّحْمَنِ بْنَ عَوْفٍ وَأَصْحَابًا لَهُ أَتَوْا النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِمَكَّةَ، فَقَالُوا: يَا رَسُولَ اللَّهِ، إِنَّا كُنَّا فِي عِزٍّ وَنَحْنُ مُشْرِكُونَ، فَلَمَّا آمَنَّا صِرْنَا أَذِلَّةً، فَقَالَ: «إِنِّي أُمِرْتُ بِالْعَفْوِ فَلَا تُقَاتِلُوا» فَلَمَّا حَوَّلَنَا اللَّهُ إِلَى الْمَدِينَةِ أَمَرَنَا بِالْقِتَالِ فَكَفُّوا، فَأَنْزَلَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ: "أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ قِيلَ لَهُمْ كُفُّوا أَيْدِيَكُمْ وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ". –رواه النسائي في المجتبى (3086) وفي الكبرى (4279) والحاكم (2377) والبيهقي في السنن (17741). وقال الحاكم رحمه الله: صحيح على شرط البخاري.اهـــ ووافقه الذهبي.
“ইবনে আব্বাস রাদি. থেকে বর্ণিত, আবদুর রহমান ইবনে আউফ রাদি. ও তাঁর কিছু সাথি মক্কায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমরা যখন মুশরিক ছিলাম, তখন আমরা সম্মানিত ছিলাম। কিন্তু যখন আমরা ঈমান গ্রহণ করলাম, তখন আমরা অবমানিত হয়ে গেছি।’ তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘আমাকে ক্ষমা করে দেওয়ার আদেশ করা হয়েছে। সুতরাং তোমরা যুদ্ধ বাধাইও না।’ এরপর যখন আল্লাহ আমাদের মদিনায় স্থানান্তরিত করলেন, তখন তিনি আমাদেরকে যুদ্ধের আদেশ দিলেন। তখন তারা যুদ্ধ করা থেকে হাত গুটিয়ে নিল। উক্ত প্রেক্ষাপটে আল্লাহ তাআলা উক্ত আয়াত অবতীর্ণ করেন, ‘তুমি কি তাদেরকে দেখোনি, যাদেরকে বলা হয়েছিল, তোমরা নিজেদের হাতকে (যুদ্ধ করা থেকে) সংযত রাখো এবং নামায কায়েম করো’।” –সুনানে নাসায়ী: ৩০৮৬; মুস্তাদরাকে হাকিম: ২৩৭৭; সুনানে বায়হাকী: ১৭৭৪১। ইমাম হাকিম রহ. বুখারীর শর্ত অনুযায়ী সহীহ বলেন এবং যাহাবী রহ. তা সমর্থন করেন।
ইমাম আবু বকর জাসসাস রহ. (৩৭০ হি.) বলেন,
لم تختلف الأمة أن القتال كان محظورا قبل الهجرة. –أحكام القرآن للجصاص (1/ 311) ط. العلمية
“উম্মতের এ ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই যে, হিজরতের আগে জিহাদ নিষিদ্ধ ছিল।” –আহকামুল কুরআন: ১/৩১১ (ইলমিয়্যাহ)। আরো দেখুন: তাফসীরে ইবনুল আরাবী: ৩/৩০১ (ইলমিয়্যাহ); তাফসীরে কুরতুবী: ২/৩৪৭ (দারুল কুতুবিল মিসরিয়্যাহ); তাফসীরে ইবনে কাসীর: ২/৩৫৯ (দারু তায়বাহ)
দুই. জিহাদের অনুমতি:
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করে যাওয়ার পথে মদীনায় পৌঁছার আগেই নিম্নোক্ত আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার মাধ্যমে জিহাদের অনুমতি দেওয়া হয়; তখনো জিহাদ ফরয করা হয়নি।
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন,
أُذِنَ لِلَّذِينَ يُقَاتَلُونَ بِأَنَّهُمْ ظُلِمُوا وَإِنَّ اللَّهَ عَلَى نَصْرِهِمْ لَقَدِيرٌ (39) الَّذِينَ أُخْرِجُوا مِنْ دِيَارِهِمْ بِغَيْرِ حَقٍّ إِلَّا أَنْ يَقُولُوا رَبُّنَا اللَّهُ –سورة الحج: 39، 40
“যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হয়ে থাকে, তাদেরকে যুদ্ধের অনুমতি এজন্য দেওয়া হলো যে, তাদের প্রতি জুলুম করা হয়েছে। এবং আল্লাহ তাদেরকে সাহায্য করতে অবশ্যই সক্ষম। যাদেরকে তাদের বাড়ি-ঘর থেকে অন্যায়ভাবে বের করে দেওয়া হয়েছে শুধু এই অপরাধে যে, তারা বলে আমাদের পালনকর্তা আল্লাহ।” –সূরা হজ: ৩৯, ৪০
অধিকাংশ মুফাসসিরদের মতে জিহাদের বিধানসম্বলিত সর্বপ্রথম উক্ত আয়াতটি অবতীর্ণ হয়।
হাদীসে এসেছে,
عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ، قَالَ: «لَمَّا أُخْرِجَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِنْ مَكَّةَ قَالَ أَبُو بَكْرٍ: أَخْرَجُوا نَبِيَّهُمْ، إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ لَيَهْلِكُنَّ، فَنَزَلَتْ: "أُذِنَ لِلَّذِينَ يُقَاتَلُونَ بِأَنَّهُمْ ظُلِمُوا وَإِنَّ اللَّهَ عَلَى نَصْرِهِمْ لَقَدِيرٌ"، فَعَرَفْتُ أَنَّهُ سَيَكُونُ قِتَالٌ» قَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ: «فَهِيَ أَوَّلُ آيَةٍ نَزَلَتْ فِي الْقِتَالِ» -رواه النسائي (3085) والترمذي (3171) وأحمد (1863) وابن حبان في صحيحه (4710) والحاكم (2376). وقال الترمذي رحمه الله: هذا حديث حسن.اهـــ وقال الحاكم رحمه الله: هذا حديث صحيح على شرط الشيخين.اهـــ ووافقه الذهبي. وقال ابن القيم رحمه الله في زاد المعاد ط. مؤسسة الرسالة (3/ 64): إسناده على شرط الصحيحين.اهــــ
“ইবনে আব্বাস রাদি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মক্কা থেকে বের করে দেওয়া হলো, আবু বকর রাদি. বলে উঠেন, তারা তাদের নবীকে বের করে দিয়েছে, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন, তারা অবশ্যই ধ্বংস হবে। তখন (সূরা হজের উক্ত আয়াত) “যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হয়ে থাকে, তাদেরকে যুদ্ধের অনুমতি এজন্য দেওয়া হলো যে, তাদের প্রতি জুলুম করা হয়েছে। এবং আল্লাহ তাদেরকে সাহায্য করতে অবশ্যই সক্ষম”— অবতীর্ণ হয়। (আবু বকর রাদি. বলেন) আমি বুঝতে পেরেছি যে, অতিসত্বর যুদ্ধ হবে। ইবনে আব্বাস রাদি. বলেন, উক্ত আয়াত জিহাদের ব্যাপারে সর্বপ্রথম অবতীর্ণ আয়াত।[2]” –সুনানে নাসায়ী: ৩০৮৫; জামে’ তিরমিযী: ৩১৭১; মুসনাদে আহমাদ: ১৮৬৩; সহীহ ইবনে হিব্বান: ৪৭১০; মুস্তাদরাকে হাকিম: ২৩৭৬। ইমাম তিরমিযী রহ. হাদীসটি হাসান বলেন। ইমাম হাকিম রহ. বুখারী ও মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী সহীহ বলেন এবং যাহাবী রহ. তা সমর্থন করেন।
তাফসীরে কুরতুবীতে এসেছে,
قَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ وَابْنُ جُبَيْرٍ: نَزَلَتْ عِنْدَ هِجْرَةِ رَسُول اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِلَى الْمَدِينَةِ.اهــــ -تفسير القرطبي (12/ 68) ط. دار الكتب المصرية
“ইবনে আব্বাস রাদি. ও ইবনে জুবাইর রহ. বলেন, (জিহাদের বৈধতার উপর্যুক্ত আয়াত) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনার দিকে হিজরত করার পথে অবতীর্ণ হয়।” –তাফসীরে কুরতুবী: ১২/৬৮ (দারুল কুতুবিল মিসরিয়্যাহ) [3]
তিন. দিফায়ী জিহাদ ফরয:
জিহাদের অনুমতি দেওয়ার কিছুকাল পরে নিম্নোক্ত আয়াতের মাধ্যমে দিফায়ী জিহাদ ফরয করা হয়।
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন,
وَقَاتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ الَّذِينَ يُقَاتِلُونَكُمْ وَلَا تَعْتَدُوا إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْمُعْتَدِينَ -سورة البقرة: 190
“তোমরা আল্লাহর রাস্তায় তাদের সাথে জিহাদ করো, যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এবং সীমালঙ্ঘন করো না। অবশ্যই আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না।” –সূরা বাকারা: ১৯০[4]
উক্ত আয়াতের মাধ্যমে কেবল দিফায়ী জিহাদ ফরয করা হয়। তাই উক্ত আয়াত নাযিল হওয়ার পরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু দিফায়ী জিহাদে সীমাবদ্ধ ছিলেন; ইকদামী জিহাদ করেননি।
রাবী’ বিন আনাস রহ. থেকে বর্ণিত হয়েছে,
عَنِ الرَّبِيعِ بْنِ أَنَسٍ فِي قَوْلِهِ تَعَالَى: "وَقَاتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ الَّذِينَ يُقَاتِلُونَكُمْ" قَالَ: هَذِهِ أَوَّلُ آيَةٍ نَزَلَتْ فِي الْقِتَالِ بِالْمَدِينَةِ، فَلَمَّا نَزَلَتْ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُقَاتِلُ مَنْ يُقَاتِلَهُ، وَيَكُفُّ عَمَّن كَفَّ عَنْهُ حَتَّى نَزَلَتْ بَرَاءَة.اهــــ -تفسير الطبري (3/ 561) ط. مؤسسة الرسالة؛ أحكام القرآن للجصاص (1/ 312) ط العلمية
“রাবী’ বিন আনাস রহ. থেকে ‘তোমরা আল্লাহর রাস্তায় তাদের সাথে জিহাদ করো, যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে’ আয়াতের ব্যাখ্যায় বর্ণিত হয়েছে— তিনি বলেন, জিহাদ (ফরয হওয়া)-র ব্যাপারে মদীনায় উক্ত আয়াত সর্বপ্রথম অবতীর্ণ হয়েছে। উক্ত আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেবল তাদের সাথে যুদ্ধ করতেন, যারা তাঁর সাথে যুদ্ধ জড়াত। এবং যারা তাঁর সাথে যুদ্ধ এড়িয়ে চলত রাসূলও তার থেকে বিরত থাকতেন। সূরা তাওবার অবতীর্ণ হওয়া পর্যন্ত (উক্ত অবস্থা চলতে থাকে)।” - তাফসীরে তাবারী: ৩/৫৬১ (মুআসসাসাতুর রিসালাহ); আহকামুল কুরআন: ১/৩১২ (ইলমিয়্যাহ)
জিহাদের উক্ত ধাপ প্রথম হিজরীর শেষের দিকে অথবা দ্বিতীয় হিজরীর শুরুর দিকে অবতীর্ণ হয়। -আলহাবী লিল-ফাতাওয়া লিসসুয়ূতী: ১/২৮৮ (দারুল ফিকর)
উল্লেখ্য, দিফায়ী জিহাদ ফরয হওয়ার উপর্যক্ত বিধান ব্যাপকভাবে সকল মুসলিমদের জন্য সকল কালের ক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছিল। তবে আনাসারী সাহাবীদের জন্য মদীনার অভ্যন্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিরাপত্তা দেওয়া এবং শত্র কর্তৃক আক্রমন প্রতিহত করা— তা বাইয়াতে আকাবার অঙ্গীকারনামার ভিত্তিতে আগে থেকেই ফরয ছিল।
চার. ইকদামী জিহাদ ফরয:
অষ্টম হিজরীতে মক্কা বিজয়ের পরে ইকদামী জিহাদ ফরয করা হয়। -ইকমালুল মু’লিম লিলকাযী ইয়ায: ১/২২৯ (দারুল ওয়াফা); আলহাবী লিল-ফাতাওয়া লিসসুয়ূতী: ১/২৮৮ (দারুল ফিকর)
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন,
وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لَا تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ لِلَّهِ فَإِنِ انْتَهَوْا فَلَا عُدْوَانَ إِلَّا عَلَى الظَّالِمِينَ -سورة البقرة: 193
“আর তোমরা তাদের (কাফেরদের) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকো, যতক্ষণ না ফিতনা দূরীভূত হয় এবং দীন একমাত্র আল্লাহর হয়ে যায়। এতে যদি তারা বিরত হয়ে যায়, তাহলে জালিম ছাড়া অন্য কারো প্রতি কোনো কঠোরতা নেই।” –সূরা বাকারা: ১৯৩
অন্যত্র এরশাদ হয়েছে,
قَاتِلُوا الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَلَا بِالْيَوْمِ الْآخِرِ وَلَا يُحَرِّمُونَ مَا حَرَّمَ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَلَا يَدِينُونَ دِينَ الْحَقِّ مِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ حَتَّى يُعْطُوا الْجِزْيَةَ عَنْ يَدٍ وَهُمْ صَاغِرُونَ -سورة التوبة: 29
“তোমরা আহলে কিতাব (তথা ইহুদি ও নাসারা)-এর ঐ লোকদের সাথে যুদ্ধ করো, যারা আল্লাহ ও পরকালের উপর ঈমান রাখে না; আল্লাহ ও তাঁর রসূল যা হারাম করেছেন, তারা তা হারাম হিসেবে গ্রহণ করে না এবং সত্য দীন গ্রহণ করে না, যতক্ষণ না তারা লাঞ্চিত হয়ে জিযিয়া প্রদান করে।” –সূরা তাওবা: ২৯
হাদীসে এসেছে,
عَنِ ابْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «أُمِرْتُ أَنْ أُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَشْهَدُوا أَنْ لاَ إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ، وَيُقِيمُوا الصَّلاَةَ، وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ، فَإِذَا فَعَلُوا ذَلِكَ عَصَمُوا مِنِّي دِمَاءَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ إِلَّا بِحَقِّ الإِسْلاَمِ، وَحِسَابُهُمْ عَلَى اللَّهِ». –رواه البخاري (25) ومسلم (22)
“ইবনে উমর রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমাকে আদেশ করা হয়েছে, যেন মানুষের সাথে যুদ্ধ করি; যতক্ষণ না তারা সাক্ষ্য দেয়—আল্লাহ ছাড়া কোনো মা’বুদ নেই ও মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর রাসূল; নামায কায়েম করে এবং যাকাত আদায় করে। যখন তা আদায় করবে, তারা নিজেদের জান ও মাল আমার থেকে রক্ষা করে নিল। তবে ইসলামের ন্যায়সঙ্গত কোনো কারণ থাকলে ভিন্ন কথা। এবং তাদের হিসাব আল্লাহর কাছে ন্যস্ত।” -সহীহ বুখারী: ২৫, সহীহ মুসলিম: ২২
জিহাদের বিধান উক্ত চতুর্থ ধাপে এসে স্থীর হয়েছে। চতুর্থ ধাপ অবতীর্ণ হওয়ার পর থেকে কিয়ামত পর্যন্ত চতুর্থ ধাপের বিধান বলঃবৎ থাকবে। -রদ্দুল মুহতার: ৪/১২৩ (দারুল ফিকর)
উল্লেখ্য, মক্কা বিজয়ের পরে মুশরিকদের জন্য যে চার মাসের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল, হয়ত ইসলাম গ্রহণ করবে; অন্যথায় আরব উপদ্বীপ ছেড়ে চলে যাবে— উক্ত সুযোগ একটি সাময়িকী বিধান ছিল মাত্র; জিহাদের পৃথক কোনো ধাপ নয়।
শেষ ধাপের দ্বারা পূর্ববর্তী ধাপসমূহ রহিত হয়ে গেছে?
জিহাদের শেষ ধাপ অবতীর্ণ হওয়ার মাধ্যমে জিহাদ তার সর্বোচ্চ চূড়ায় আরোহণ করে। এখন উক্ত চূড়ান্ত ধাপের উপর আমল করার চেষ্টা করতে হবে। তবে পূর্ববর্তী তিন ধাপ রহিত হয়ে যায়নি। বরং শক্তি ও সামর্থের ভিত্তিতে তা এখনও আমলযোগ্য। চূড়ান্ত ধাপের জিহাদ করার সামর্থ না থাকলে সামর্থানুযায়ী পূর্ববরতী ধাপের উপর আমল করা হবে। তখন উক্ত ধাপের উপর আমল করা ফরয।
কেননা জিহাদের বিধান অবতীর্ণ হওয়ার সময় মুসলিমদের শক্তি ও সামর্থের প্রতি লক্ষ্য রেখেই অবতীর্ণ হয়েছে। সুতরাং পরবর্তী যুগেও মুসলিমদের শক্তি ও সামর্থের ভিত্তিতে উপযোগী ধাপ অনুযায়ী আমল করা হবে। -আস-সারিমুল মাসলূল: ২২৯ (দারু ইবনে হাযাম); আল-বুরহান ফী উলূমিল কুরআন: ২/৪২-৪৩ (দারুল মা’রেফা); আল-ইতকান ফী উলূমিল কুরআন: ৩/৬৮-৬৯ (আল-হাইয়াতুল মিসরিয়্যাহ); রাসায়েলে কাশ্মীরী: ৪/১২৯ (এদারাতুল কুরআন)
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. (৭২৮ হি.) বলেন,
فمن كان من المؤمنين بأرض هو فيها مستضعف أو في وقت هو فيه مستضعف فليعمل بآية الصبر والصفح والعفو عمن يؤذي الله ورسوله من الذين أوتوا الكتاب والمشركين. وأما أهل القوة فإنما يعملون بآية قتال أئمة الكفر الذين يطعنون في الدين وبآية قتال الذين أوتوا الكتاب حتى يعطوا الجزية عن يد وهم صاغرون.اهــــ -الصارم المسلول (ص: 229) ط. دار ابن حزم
“সুতরাং যে মুমিন এমন এলাকায় বসবাস করবে যেখানে সে দুর্বল অথবা এমন সময় জীবনযাপন করেব যখন সে দুর্বল, তখন সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের শানে কটাক্ষকারী আহলে কিতাবি ও মুশরিকদের সাথে সবর, সংযত ও ক্ষমার আয়াতের উপর আমল করবে। আর যারা (জিহাদের) সামর্থ রাখে, তারা দীনের ব্যাপারে কটাক্ষকারী আইম্মাতুল কুফুরের সাথে কিতাল সম্বলিত আয়াত এবং আহলে কিতাবিদের সাথে নতি স্বীকার করে জিযয়া গ্রহণ করা পর্যন্ত কিতাল সম্বলিত আয়াতের উপর আমল করবে।” -আস-সারিমুল মাসলূল: ২২৯ (দারু ইবনে হাযাম)
তবে সামর্থের ভিত্তিতে উপযুক্ত ধাপে আমল করার অর্থ এ নয় যে, উক্ত ধাপেই ক্ষান্ত থাকবে। বরং এবং সর্বোচ্চ চেষ্টা ও প্রস্তুতির মাধ্যমে চূড়ান্ত ধাপে পৌঁছার আপ্রাণ চেষ্টা করা হবে। কেননা, যখন চতুর্থ ধাপের জিহাদ কিয়ামত পর্যন্ত ফরয করা হলো, তখন উক্ত ফরয আদায়ের জন্য চেষ্টা ও প্রস্তুতি গ্রহণ করাও ফরয হয়ে যায়। ফিকহের স্বতশিদ্ধ মূলনীতি হচ্ছে,
وما لا يتم الواجب إلا به فهو واجب
“যে কাজ ছাড়া ওয়াজিব বিধান পরিপূর্ণ হয় না, উক্ত কাজও ওয়াজিব।” -আল-বাহরুর রায়েক: ১/৬৪ (ইলমিয়্যাহ); আয-যাখীরাহ: ১০/২৩ (দারুল গারবিল ইসলামী); আল-মাজমূ’: ১/১২৪ (মাজমাউল মালিক ফাহাদ); আল-মুগনী: ২/২২০ (মাকতাবুল কাহেরা)
[1] বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা এ জন্য জরুরি যে, জিহাদের বিভিন্ন ধাপ অনুসারে বিভিন্ন আয়াত ও হাদীস রয়েছে। এখন উক্ত ক্রমবিকাশ না জানলে কারো কাছে উক্ত আয়াত ও হাদীসসমূহের মাঝে পারস্পরিক বিরোধ মনে হতে পারে। তবে বর্তমানে বিষয়টি আরো গুরোত্বের দাবি রাখে। কেননা, পশ্চিমা কাফের ও প্রাচ্যবিদ কাফেরদের ভয়ে ভীত এক শ্রেণী চূড়ান্ত ধাপের আগের কোনো ধাপের আয়াত ও হাদীস উপস্থাপন করে ইকদামী জিহাদ অস্বীকার করার অপচেষ্টা করেছে। তাই উক্ত স্খলন থেকে বাঁচার জন্য উক্ত আলোচনাটি বেশ গুরোত্বপূর্ণ।
[2] অধিকাংশ মুফাসসিরদের মতে জিহাদের ব্যাপারে সর্বপ্রথম (দ্বিতীয় ধাপে উল্লেখিত) সূরা হজের ৩৯ ও ৪০ নং আয়াত অবতীর্ণ হয়। তবে কারো কারো মত হচ্ছে, (তৃতীয় ধাপে উল্লিখিত) সূরা বাকারার আয়াত সর্বপ্রথম জিহাদের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে। -তাফসীরে তাবারী: ১৮/৬৪৪-৬৪৫ (মুআসসাসাতুর রিসালাহ); আহকামুল কুরআন: ১/৩১২ (ইলমিয়্যাহ); তাফসীরে ইবনে কাসীর: ৫/৪৩৩ (দারু তায়বাহ)
তবে উভয় মতের মধ্যে সামঞ্জস্য হচ্ছে, জিহাদের বৈধতার ব্যাপারে সর্বপ্রথম সূরা হজের আয়াত অবতীর্ণ হয় এবং জিহাদ ফরয হওয়ার ব্যাপারে সর্বপ্রথম সূরা বাকারার আয়াত অবতীর্ণ হয়। আয়াতের বাহ্যিক থেকেও তা স্পষ্ট, সূরা হজের আয়াতে জিহাদের অনুমতি দেওয়া হয়েছে; পক্ষান্তরে সূরা বাকারার আয়াতে জিহাদের আদেশ করা হয়েছে। -আহকামুল কুরআন: ১/৩১২ (ইলমিয়্যাহ)
[3] কোনো কোনো বর্ণনামতে হিজরত করে মদীনায় যাওয়ার পরে জিহাদের অনুমতি সম্বলিত আয়াত অবতীর্ণ হয়। আবার কোনো বর্ণনামতে জিহাদের অনুমতি পাওয়ার পরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদেরকে মদীনায় হিজরত করার আদেশ করেন। দেখুন: তাফসীরে তাবারী: ৩/৫৬১ (মুআসসাসাতুর রিসালাহ); আহকামুল কুরআন: ১/৩১২ (ইলমিয়্যাহ); সীরাতে ইবনে হিশাম: ১/৪৬৮ (মুস্তাফা বাবী); আল-বেদায়া ওয়ান নেহায়া: ৩/১৬৯ (দারুল ফিকর)
[4] আয়াতে “সীমালঙ্গন করো না”-এর দুটি ব্যাখ্যা রয়েছে। এক. আগ বেড়ে কাফেরদের উপর আক্রমন করো না। উক্ত ব্যাখ্যা অনুযায়ী তখনো ইকদামী জিহাদ নিষিদ্ধ ছিল। এবং পরবর্তীতে চতুর্থ ধাপের আয়াত দ্বারা আয়াতের উক্ত অংশ রহিত হয়ে গেছে।
দুই. নারী, শিশু, বৃদ্ধসহ যুদ্ধ করতে অক্ষমদেরকে উপর আক্রমন করো না। তখন আয়াতের কোনো অংশ রহিত হবে না। -আহকামুল কুরআন: ১/৩১২ (ইলমিয়্যাহ)
উক্ত ব্যাখ্যা অনুযায়ী ইকদামী জিহাদ কখন বৈধ করা হয়, তা স্পষ্ট নয়। তবে দ্বিতীয় ধাপের আয়াতে যেহেতু ব্যাপকভাবে জিহাদের অনুমতি দেওয়া হয়েছে, সে হিসেবে বলা যায় যে, তখন থেকেই ইকদামী জিহাদ বৈধ ছিল; যদিও মক্কা বিজয়ের আগ পর্যন্ত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইকদামী জিহাদ করেননি।
আগের পর্ব:
ফিকহুল জিহাদ; পঞ্চম পর্ব ➤ ইসলাম প্রচার হয়েছে তরবারির জোরে নাকি আখলাকের বলে?
- https://dawahilallah.com/forum/মূল-ফ...