আফগান রণাঙ্গনে শহিদের তাজা লাশ
শাইখ আবু হুজাইফা আস-সুদানি হাফি.
খোস্ত বিজয়ের পর আফগান মুজাহিদগণ পাকতিয়া প্রদেশের রাজধানী গারদিজের দিকে অগ্রসর হয়। বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন জালালুদ্দীন হক্কানি রহ.। সহযোগী বাহিনি হিসেবে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন ‘জাবহাতুশ শাইখাইন’ এর একদল আরব মুজাহিদ। তাঁদের আমির ছিলেন আবুল হারিস আল-উর্দুনি আর সেনা কমান্ডার ছিলেন আবু মুআজ আল-খুস্তি আল-ফিলিস্তিনি।
৩৩০০ মিটার উঁচুতে সাতিকান্দো পর্বতের চূড়ায় আরব আনসার ভাইগণ তাঁদের প্রথম তাঁবু স্থাপন করেন। সেই তাঁবু থেকে, সুউচ্চ পাহাড় চূড়ায় আর সুদৃশ্য পাইন গাছে ঢাকা পাহাড়ের বিস্তৃত পাদদেশ থেকে আমাদের অনুসন্ধানী পেট্রলিং শুরু হয়। অগ্রবর্তী ক্যাম্প তৈরি, ব্যাক লাইন নির্ধারণ, কামান স্থাপন, চেকপয়েন্ট স্থাপন, যোগাযোগের জাল বিস্তার, হাসপাতাল তৈরি ইত্যাদির জন্য ছক কষার কাজ আরম্ভ হয়ে যায়।
আরব মুজাহিদদের মধ্যে আল-জামাআতুল ইসলামিয়াতুল মিসরিয়ার জওয়ানদের একটি গ্রুপ ছিল। তাদের তিন জন গারদিজের পূর্বে ‘সৈয়দ করম’ নামক গ্রামে একটি কাজে যায়। তাঁরা হলেন: হুজাইফা, হামজা, তৃতীয় জনের নাম আমি ভুলে গেছি। কাজ সেরে ফেরার পথে তাঁরা এক বিশ্বাসঘাতকের ফাঁদে পড়েন। হামজা ও হুজাইফা শহিদ হয়ে যান। আল্লাহ তাঁদের কবুল করুন। তৃতীয় জন আত্মরক্ষা করতে সক্ষম হন।
আরব মুজাহিদগণ গিয়ে উভয় শহিদের লাশ নিয়ে আসেন। তাঁদেরকে পেছনের ঘাঁটিতে সমাহিত করা হয়। পরে তাঁদের পাশে মুজাহিদ নেতা শহিদ আবু বানান আল-জাযায়িরির লাশও দাফন করা হয়। আল্লাহ তাঁকে কবুল করুন। তিনি ‘খালদুন’ ট্রেনিং ক্যাম্পের প্রধান প্রশিক্ষক ছিলেন। তাঁর হাতে শত শত মুজাহিদ প্রশিক্ষণ লাভ করে। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন শাইখ লিবির পুত্র ও আবু জুবাইদা আল-ফিলিস্তিনি। আল্লাহ তাঁর মুক্তি ত্বরান্বিত করুন।
কেন্দ্রীয় কবরস্তান ছিল অগ্রবর্তী ঘাঁটিতে; যেখানে ভাই রিবয়ি বিন আমির আল-জাযায়িরি শহিদ হয়েছিলেন। আল্লাহ তাঁকে কবুল করুন। তাঁর পাশেই শুয়ে আছেন বিশ জনেরও বেশি আরব আনসার মুজাহিদ। তাঁদের সবাইকে আল্লাহ কবুল করুন। পেছনের ঘাঁটিতে কেবল তিনটি কবর ছিল: আবু বানান আল-জাযায়িরি, হামজা আল-মিসরি ও হুজাইফা আল-মিসরির কবর। আল্লাহ তাঁদের শাহাদাতকে কবুল করুন। মুজাহিদ স্বল্পতার কারণে পেছনের ঘাঁটিটি একসময় ছেড়ে দেয়া হয়।
জনৈক আরব মুজাহিদ একটি কবরে ভাঙ্গন দেখতে পান। তিনি খেয়াল করেন, একপাশের মাটি গভীরভাবে দেবে গেছে। তিনি মুজাহিদ কমান্ডার আবু মুআজ আল-খুস্তিকে বিষয়টি জানান। কমান্ডার আমি অধমকে এই বিষয়টির দায়িত্ব দেন। আমাকে সাহায্য করার জন্য আরও চারজন দক্ষ ভাইকেও ঠিক করে দেন। তাঁরা হলেন: আবু মুসআব আশ-শামরানি রহ., হাইদারা আত-তাবুকি রহ., আব্দুল মাজিদ আল-মিসরি ও মাসউদি আল-জাযায়িরি। কমান্ডার আমাদেরকে কবরগুলো নিরীক্ষণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।
আমরা পাঁচ জন সেই কবর তিনটির কাছে যাই। ভেঙ্গে পড়া কবরটি আবু বানান আল-জাযায়িরির ছিল না। আমরা তার কবরটি চিনতাম। এটি হয়তো হুজাইফা আল-মিসরির কবর হবে অথবা হামজা আল-মিসরির। আমরা কবরটি খননের সিদ্ধান্ত নিই। পরে অবস্থা বুঝে উপযুক্ত একটি ব্যবস্থা নেয়া যাবে।
আমরা কোদাল দিয়ে ধীরে ধীরে খুঁড়তে থাকি। এক মিটার গভীরে যাওয়ার পর আমরা কোদাল রেখে দিই। এরপর আমরা সতর্কতার সাথে হাত দিয়ে মাটি সরাতে শুরু করি। আমাদের মনে অজানা এক শঙ্কা—কী ঘটতে যাচ্ছে সামনে?
আমি মাথার দিক থেকে খুঁড়ছিলাম। ধীরে ধীরে ... একটু একটু করে ... অল্প অল্প মাটি সরাচ্ছিলাম।
আল্লাহু আকবার! লাশ দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। মাটি ও কাদায় পুরো শরীর ঢেকে গিয়েছিল। সুবহানাল্লাহ ... তিনিই ... হাঁ তিনিই ... ওই তো দেখা যাচ্ছে এখন। আমি চিনতে পেরেছি। আমি চিনতে পেরেছি। হামজা আল-মিসরি। আল্লাহ তাঁর প্রতি রহম করুন।
ইয়া আল্লাহ! আজকেই যেন তাকে দাফন করা হয়েছে। মৌন শান্তিতে ... পরম নিশ্চিন্তে ... গভীর আরামে তিনি ঘুমোচ্ছেন। আমাদের ক্ষমা করো হে বীর! আমরা তোমার নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটিয়েছি। আল্লাহ তোমার ওপর রহম করুন; বরকত নাজিল করুন।
আমি তার মুখ, দাড়ি ও চুল থেকে মাটি ও কাদা সরাতে থাকি। তাঁর আঙ্গুলগুলো নাড়াচাড়া করি। এখনো যেন কোমল ও হৃষ্টপুষ্ট। নখগুলো দীর্ঘ—যেমনটি সাধারণত হয়ে থাকে। সেই সবুজ সামরিক প্যান্ট, সেই আফগানি পোশাক এখনো গায়ে জড়ানো। এখানে ওখানে শুকিয়ে আছে ছোপ ছোপ লাল রক্ত।
আমরা দাঁড়িয়ে আছি এক শহিদের সামনে। একটি তরতাজা লাশ। শরীরের প্রতিটি অংশ দৃশ্যমান। সবকিছু সুস্পষ্ট—চোখের তারায় ভাসছে। কিছুই বদলায়নি। সব আগের মতো।
আমরা প্রথমে লাশটি বের করি। তারপর কবর মেরামতের দিকে মনোযোগ দিই। সংস্কার শেষে পুনরায় আমাদের ভাইকে তার বিছানায় শুয়ে দিই। বিদায় জানাই ফের। নতুন করে আবার দাফন করি। শেষ বারের মতো তার দিকে তাকিয়ে রই।
আমরা পুরো সময়টি হিসেব করি—তাঁকে যখন প্রথম দাফন করা আর যখন দ্বিতীয়বার বের করা হয়। দেখি দশ মাসের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। আল্লাহ তোমাকে কবুল করুন হে হামজা! শহিদদের মিছিলে তোমাকেও শামিল করুন।
কথায় কথা আসে। আমরা আফগানের সরকারি বাহিনির সৈন্যদের লাশ দেখেছি। এক দিন কি দুই দিন না যেতেই তাদের শরীর ফুলে ওঠে। তারপর গলে ফেটে যায়। কালো বর্ণের রক্তের স্রোত বয়। কীট বের হয়। তীব্র দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। কাছে যাওয়ার উপায় থাকে না।
আলহামদুলিল্লাহ। সকল রহমত ও নিয়ামত আল্লাহর কাছ থেকেই আসে। দোয়া করি, আল্লাহ যেন আমাদেরকে জিহাদের পথে অটল-অবিচল রাখেন। শাহাদাতের মাধ্যমে আমাদের জীবনের সমাপ্তি ঘটান। বুক পেতে যেন আমরা শহিদ হই—কখনো যেন পিঠ না দেখাই।
মূল আরবি: খাওয়াতিরু সাজিন, শাইখ আবু-হুজাইফা আস-সুদানী হাফি : ৫৫ - ৫৭
Comment