তাবলীগের জন্য জিহাদ এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ও আবশ্যক যে, তা ব্যতিত তাবলীগের পূর্ণতা হতেই পারে না। যারা মনে করে যে, শুধু মৌখিক দাওয়াত-ই যথেষ্ট এবং সশস্ত্রযুদ্ধ ব্যতিত তাবলীগ সম্ভব তারা তাবলীগের উদ্দেশ্য বুঝার ক্ষেত্রে তিনটি ভুল করছে:
১. গুটি কয়েক ইবাদতের দাওয়াত দিয়ে মনে করে তাবলীগের হক আদায় হয়ে গেছে। অথচ সুস্থ মেধা সম্পন্ন ব্যক্তি মাত্রই এ কথা বুঝতে পারে যে– পূর্ণ তাবলীগ তখনই হবে যখন পূর্ণ ইসলামের দাওয়াত হবে। শুধুমাত্র নামায বা দু-তিনটি ইবাদতের দাওয়াতকে পূর্ণ দীনের তাবলীগ বলা যায় না। ইসলামী বিধানের চারটি শাখা– আকাইদ, ইবাদত, মুয়ামালাত ও হুদুদ-কিসাস। যতক্ষণ পর্যন্ত এ চার বিধানের সবগুলোর দাওয়াত দেওয়া না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত তাবলীগ পূর্ণ হবে না, আর আপনিও তাবলীগের ফরয দায়িত্ব থেকে মুক্ত হতে পারবেন না। যেমনিভাবে ব্যক্তিগত ইবাদতের সাথে সম্পৃক্ত অনেক বিধান আছে তেমনিভাবে মুয়ামালাত তথা– ঐ সকল বিধানাবলী যেগুলোতে একজন অন্যজনের সাথে মিলে কারবার করে; যেমন– বিবাহ, তালাক, ক্রয়-বিক্রয়, ইজারাহ-ইস্তিজারাহ, কৃষি ও চাকরী ইত্যাদি– এগুলোরও অনেক বিধান আছে। অনুরূপ ‘হুদূদ-কিসাস’ অর্থাৎ অপরাধীকে শাস্তি দিয়ে অপরাধের দার রুদ্ধ করা– ইসলামে এরও এমন অনেক বিধান আছে, যেগুলোর বিস্তর আলোচনা কুরআন-হাদীসে করা হয়েছে; ব্যভিচারীর জন্য এই শাস্তি, চোরের জন্য এই শাস্তি, অপবাদ আরোপকারীর জন্য আরেক শাস্তি, আবার ডাকাতের জন্য ভিন্ন শাস্তি। যতক্ষণ পর্যন্ত এ সবগুলো বিধানের তাবলীগ না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত একে পূর্ণ তাবলীগ বলা যাবে না।
২. শুধুমাত্র মৌখিক (দাওয়াত) তাবলীগকে যথেষ্ট মনে করে। ধারণা করে– যদি এটা চালু থাকে তাহলে সমাজ ঠিক হয়ে যাবে এবং সকল কাফের মুসলমানদের এ সামাজিকতা দেখে ইসলাম গ্রহণ করে নিবে। শরীয়তের শাস্তি প্রয়োগের না কোন প্রয়োজন আছে, না কাফেরদের সাথে সশস্ত্রযুদ্ধ করার। অথচ ‘দাওয়াত ও তাবলীগ’ শরীয়তের একটি পরিভাষা, যার ব্যাখ্যা হল–
যদি তাবলীগ কাফেরদের উদ্দেশ্যে হয়ে থাকে তাহলে তার সামনে কেবল ইসলামকে পেশ করাই তাবলীগের দায়িত্ব থেকে মুক্তির জন্য যথেষ্ঠ নয়। বরং ইসলাম গ্রহণ করার দাওয়াত দিতে হবে– যে গ্রহণ করবে সে তো আমাদের ভাই হয়ে যাবে, আর যে গ্রহণ করবে না তাকে ইসলামের শাসন মেনে নেওয়ার দাওয়াত দেওয়া হবে; অর্থাৎ শাসন ইসলামের-ই হবে; তবে তোমাদের কর আদায় করে ইসলামী শাসনের অনুগত থাকতে হবে। এর বিপরীতে অবশ্য ইসলামী শাসন তোমাদের জান-মাল হেফাজত করবে। আর যদি তারা ইসলামী শাসনও মানতে রাজি না হয় তাহলে তাদের সাথে সশস্ত্রযুদ্ধ করতে হবে এবং ততক্ষণ তাদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে যতক্ষণ না তারা ইসলাম অথবা ইসলামী শাসন গ্রহণ না করবে। ইসলাম কাউকে জোরপূর্বক মুসলমান বানানোর শিক্ষা দেয় না, তবে আল্লাহ তায়ালার যমীনে কাফেরদের (কর্তৃক) শাসনেরও অনুমতি দেয় না।
৩. তাদের চিন্তা-চেতনা হল– শুধু সৎ কাজের আদেশ দাও, অন্যায়ের ব্যপারে কোন আলোচনা করো না, অন্যায় আপনা-আপনি নিঃশেষ হয়ে যাবে। যেমন– যদি অন্ধকার দূর করতে চাও তাহলে ছোট্ট একটি মোমবাতি জ্বালাও– অন্ধকার দূর হয়ে যাবে। লাঠি হাতে পিটানো শুরু করবে না। বাহ্যিক দৃষ্টিতে যদিও তাদের এ দলিলটা অনেক শক্তিশালি মনে হয় কিন্তু বাস্তবে এ দৃষ্টিভঙ্গি একদম বিভ্রান্তিকর এবং দুনিয়াতে পাপাচার, অন্যায়, অবিচার ও অশ্লীলতা ছড়ানোর এক মহা সুরঙ্গ। যুক্তি-দলিলও এর সাক্ষ্য দেয়।
কুরআন-হাদিসের যেখানেই সৎ কাজের আদেশ করা হয়েছে সেখানেই অসৎ কাজ থেকে নিষেধও করা হয়েছে। যদি শুধু সৎ কাজের আদেশ-ই যথেষ্ট হত, অন্যায় থেকে বারণের কোন গুরুত্ব-ই না থাকত তাহলে আল্লাহ তায়ালা এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে আদেশ দিয়েছেন তা কি অনর্থক– নাউযু বিল্লাহ! না আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ হেকমত ও প্রজ্ঞা বুঝে আসেনি যে– সৎ কাজের আদেশের দ্বারা সকল অন্যায় আপনা-আপনি নিঃশেষ হয়ে যায়– নাউযুবিল্লাহ!!
তাছাড়া তখন এ কথাও বলা আবশ্যক হয়ে পড়বে যে, সাধ্যানুযায়ী অসৎ কাজের নিষেধের তিন স্তর– হাত, মুখ ও অন্তর– যেগুলোকে উম্মতের উলামায়ে কেরামগণ আজো পর্যন্ত ওয়াজিব মনে করেন সেগুলোর সবই শরীয়তের বিধান ও মেজাজ পরিপন্থি ছিল– নাউযুবিল্লাহ!!!
যুক্তি ও বাস্তবতার আলোকেও এর গুরুত্ব স্পষ্ট। কারণ মানুষ স্বভাবগত ভাবেই কুপ্রবৃত্তি ও গুনাহের প্রতি আগ্রহী। সৎ কাজের আদেশ যতই দেওয়া হোক না কেন যতক্ষণ পর্যন্ত অন্যায় থেকে বারণ না করা হবে ততক্ষণ পর্যন্ত সমাজ থেকে অন্যায় ও অশ্লীলতাকে মূলোৎপাটন করা সম্ভব হবে না।
এখন তো আরো মারাত্মক সংবাদ সামনে আসছে যে– মানুষদের দীনদার ও ঘনিষ্টতর বানানোর জন্য তাদের সাথে বেদআত ও গুনাহের আসরে পর্যন্ত শরীক হওয়া কেবল জায়েয-ই নয় বরং আবশ্যকও মনে করা হয়। এটা সম্পূর্ণ দীনের বিকৃতি ও অপব্যাখ্যা ছাড়া কিছু-ই না। দীন-হারা লোকদের জান্নাতী আমলে নিজেদের সাথে শরীক করার পরিবর্তে তারা নিজেরাই জাহান্নামী কর্মে লিপ্ত হচ্ছে। এর চেয়েও অবিচারের বিষয় হল, এটাকে কেবল জায়েযই মনে করা হচ্ছে না বরং সওয়াবের কাজ, নববী আদর্শ ও দীনের তাবলীগও মনে করা হচ্ছে। যদি বাস্তবে এমনই হয়ে থাকে যেমনটা শুনা যাচ্ছে তাহলে তো তাদের ঈমান-ই থাকবে না।
একটি মূলনীতি খুব ভাল করে বুঝে নিন, নিজে মুখস্ত করে অন্যদের নিকটও পৌঁছে দিন। মূলনীতিটি হল–
"لايقام الدين بهدمه"
দীনের বিপরীত কিছু করে, দীনকে বাদ দিয়ে কখনো দীন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।
চিন্তার বিষয় হল– যদি কেবল মৌখিক তাবলীগ দ্বারা পুরো জাতির সংশোধন হত এবং সকল কাফেররা ইসলাম গ্রহণ করত তাহলে আল্লাহ তায়ালা কুরআন মাজিদে বারবার কিতাল ও শরয়ী শাস্তির কথা কেন বলতেন? শাস্তির কথা উল্লেখ করার সাথে সাথে আল্লাহ তায়ালা এটাও বলেছেন যে– যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাক তাহলে শরীয়তের শাস্তি প্রয়োগ করতে তোমাদের কোন ধরনের দয়া আসা উচিৎ হবে না, আল্লাহ তায়ালার আইন সুতরাং তোমরা তা প্রয়োগ কর।
وَّ لَا تَاۡخُذۡکُمۡ بِہِمَا رَاۡفَۃٌ فِیۡ دِیۡنِ اللّٰہِ اِنۡ کُنۡتُمۡ تُؤۡمِنُوۡنَ بِاللّٰہِ وَ الۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ (سورة النور 24: 02)
আর যদি তোমরা আল্লাহ ও আখেরাতের উপর ঈমান রাখ তাহলে আল্লাহ তায়ালার দীনের বিষয়ে তাদের প্রতি দয়া যেন তোমাদের পেয়ে না বসে। (আন নূর ২৪:০২)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সকল নবীদের সর্দার এবং বিশ্ববাসীর জন্য রহমত স্বরূপ হওয়া সত্বেও মাদানী জীবনে দশ বছরের সামান্য সময়ে সাতাশ বার নিজ হাতে তরবারী উঠিয়ে, শিরস্ত্রান ও লৌহবর্ম পরে ময়দানে বের হয়েছেন। সত্তরের অধিক সৈন্য বাহিনী প্রস্তুত করে সশস্ত্র জিহাদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে কিয়ামত পর্যন্ত আগত প্রজন্মের জন্য শিক্ষা দিয়ে গিয়েছেন যে, আল্লাহর বাণী সুমুন্নত করা, প্রচার করা এবং তাবলীগে দীনের পূর্ণতা কেবল সশস্ত্র জিহাদের মাধ্যমেই সম্ভব।
আর যদি তাবলীগের উদ্দেশ্য মুসলামানদের জন্য হয়ে থাকে অর্থাৎ যারা ইসলামের দাওয়াতের মাধ্যমে মুসলমান হচ্ছে অথবা পূর্ব থেকেই মুসলমান ছিল; তাহলে তাদের উপর শরীয়ী বিধানের চারও শাখা– আকাইদ, ইবাদত, মুয়ামালাত ও হুদুদ-কিসাস আবশ্যকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। যদি কোন একটি বিধান ছেড়ে দেয় অথবা কোন অন্যায়ে লিপ্ত হয় তাহলে তাদের উপর শরীয়তের শাস্তি প্রয়োগ করতে হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জীবদ্দশায় চুরি ও যিনার শরয়ী শাস্তি প্রয়োগ করে এ বিষয়টি স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, সমাজে সংশোধনের একমাত্র মাধ্যম হল শরীয়তের শাস্তি প্রয়োগ করা, কেবল মৌখিক তাবলীগ যথেষ্ট নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জবানের শিক্ষা, নসীহত, দাওয়াত ও তাবলীগের চেয়ে কার শিক্ষা, নসীহত, দাওয়াত ও তাবলীগ উত্তম হতে পারে? তাঁর চেয়ে অধিক ইখলাস কার ভেতরে আছে যে, সে দাবি করতে পারে যে– অস্ত্র হাতে নেওয়া এবং শাস্তি প্রয়োগ করার কোন প্রয়োজন পড়বে না, সকল কাফের তাবলীগের মাধ্যমেই মুসলমান হয়ে যাবে এবং সমাজও ঠিক হয়ে যাবে¬– কারো যদি এমন ধারণা থাকে তাহলে সে যেন নিজের ঈমানের ব্যাপারে সচেতন হয়।
বাস্তবতাও সাক্ষ্য দেয় যে– শুধুমাত্র মৌখিক তাবলীগ কাফেরদের ইসলামে প্রবেশ এবং সমাজের সংশোধনের জন্য যথেষ্ট নয়। পুরো দুনিয়াতে লাখো মাদরাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রাত-দিন কেবল এ কাজই হচ্ছে– যেন আল্লাহ তায়ালার হুকুমগুলো মানুষদের দুয়ারে পৌঁছে। দুনিয়াতে অসংখ্য খানকাতে সমাজ সংশোধনের জন্য কী পরিমাণ-ই না চেষ্টা-মেহনত হচ্ছে! কত-ই না ওয়াজ-নসীহত চলছে!! মসজিদে, মসজিদে কুরআন-হাদীসের দরস হচ্ছে, জুমার বয়ান হচ্ছে এবং অন্যান্য বিভিন্ন মজলিসে উলামায়ে কেরামের নসীহতপূর্ণ বক্তৃতা হচ্ছে। কত ধরণের কিতাব, প্রবন্ধ, ক্যাসেট প্রকাশ করা হচ্ছে! প্রায় একশ বছর যাবৎ তাবলীগ জামাতও এ লক্ষ্যে কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছে। এ সকল তাবলীগ দ্বারা যদিও সমাজের কিছু না কিছু কাজ হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে; কিন্তু দেখার বিষয় হল, এতটুকুর দ্বারা কি এ কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে না এর দ্বারা শেষ হবে? ঐ সকল মাধ্যম দ্বারা শতাব্দীকাল যাবৎ তাবলীগের কাজ চলছে, কিন্তু গবেষণার দ্বারা জানা যায় যে, ধর্মহীন লোকদের বিপরীতে দীনদার লোকদের পরিমাণ আটার মধ্যে লবণের পরিমাণও না। তাবলীগের এ সকল চেষ্টা-মেহনতের দ্বারা সামান্য যে সকল লোক দীনদার হয়েছে তাদেরও এমন নড়বড়ে অবস্থা যে, তাদের পরিপক্কতা এখনো না হওয়ার মত। শরীয়তের হাজারো বিধান থেকে দু-চারটি– নামায, রোজা ইত্যাদির উপর আমল করছে, দাড়ি রাখছে, লম্বা জামা গায়ে পড়ছে– ব্যাস এতুটুকুকে যথেষ্ট মনে করছে। না বিবাহ,তালাক শরীয়ত মোতাবেক হচ্ছে, না মুয়ামালা পরিষ্কার আছে। না ক্রয়-বিক্রয় ঠিকঠাক হচ্ছে, না ব্যবসা-বাণিজ্য শরীয়ত সিদ্ধ হচ্ছে। না হুদুদ-কিসাদের কোন গুরুত্ব আছে, না আল্লাহর শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা আছে আর না সে জন্য জান কুরবান করার কোন আগ্রহ আছে।
মনে রাখবেন– আল্লাহ তায়ালা, পূববর্তী নবীগণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম রাযিআল্লাহু আনহুম এবং উম্মতের উলামাগণের সকলের ঐক্যমত সিদ্ধান্ত হল– কুফুর-শিরক ও অন্যায়-অপরাধ থেকে সমাজকে মুক্ত করার জন্য এবং দুনিয়ার মধ্যে আল্লাহর দীনকে বিজয়ী করার জন্য শুধুমাত্র মৌখিক তাবলীগ যথেষ্ট নয়। যতক্ষণ পর্যন্ত কিতালের মাধ্যমে কাফেরদের বড় বড় রাজত্বের শক্তি খর্ব করা না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত না সাধারণ কাফেররা প্রশস্ত চিত্তে ইসলামের সত্যতা স্বীকার করবে, না ঐ সকল কাফেরদের নিয়ন্ত্রণের প্রভাব, উন্নত প্রযুক্তি এবং নিকৃষ্ট প্রোপাগান্ডা ও চক্রান্তের মাধ্যমে প্রচারকৃত অশ্লীলতা ও অসভ্যতা থেকে মুসলমান সমাজ পবিত্র হবে। আল্লাহ তায়ালা এ বাস্তবতাকে বুঝার তৌফিক দান করেন। আমীন
Comment